সেদিন ছিল আমাবস্যার রাত। চট্টগ্রামের অভয়মিত্র শ্মশানঘাট ভীষণ ভীতসঙ্কুল জায়গা হিসেবে পরিচিত। দিনের বেলায় যেতেও লোকজন ভয় পায়। অথচ বিনোদবিহারী চৌধুরীকে আদেশ দেওয়া হয়েছিল এমনই একটি জায়গায় মাস্টারদার সঙ্গে দেখা করতে হবে। সবার সঙ্গে তিনি দেখা করেন না। তাঁর সঙ্গে দেখা হওয়া সৌভাগ্যের ব্যাপার। সুতরাং বিপ্লবী মন্ত্রে দীক্ষিত ১৯ বছরের টগবগে বিনোদবিহারী হাজির হলেন অভয়মিত্র শ্মশানঘাটে।
বহু দিনের সংস্কার ছিল শ্মশানে নাকি নানা রকম ভুত-প্রেতের আনাগোনা থাকে। তাই শ্মশানে এসে কিছুটা ভয় পাচ্ছিলেন তিনি। এদিক ওদিক হাঁটছিলেন, হঠাৎ করেই পিঠে হাতের স্পর্শ পেয়ে ভীষণ চমকে গেলেন, ফিরে তাকিয়ে দেখলেন এক ভদ্রলোক, দেখতে কিছুটা খাটো, সাদা ধুতির ওপর সাদা পাঞ্চাবি অন্ধকারে ফুটে উঠেছে। তখন রাত ৮টার মতো বাজে। তিনি মুগ্ধ চোখে তাঁর দিকে তাকিয়ে থাকলেন, ইনিই হলেন বিখ্যাত বিপ্লবী সূর্যসেন, সবাই যাঁকে মাস্টারদা বলে ডাকে। সামনাসামনি তাঁর সঙ্গে এটাই তাঁর প্রথম সাক্ষাৎ । মাস্টারদা তাঁকে জড়িয়ে ধরে বললেন, কিরে ভয় পেয়েছিস? তিনি ভয়ের কথা স্বীকার করলেন। সত্যিই তিনি ভয় পেয়েছিলেন। তারপর মাস্টারদা তাঁকে নানা রকম প্রশ্ন করতে লাগলেন। তিনি কেন বিপ্লবী দলে আসতে চান। বিপ্লবী দলে না আসর জন্য নানাভাবে তাঁকে বোঝাতেও লাগলেন। কিন্তু তিনি তখন দৃঢপ্রতিজ্ঞ, যেকোনো প্রকারেই হোক তিনি বিপ্লবী দলে ঢুকবেন। সুতরাং এক সময় বললেন, “আমি একজন সচেতন নাগরিক হিসেবে বিপ্লবী দলে ঢুকে ইংরেজদের অত্যাচার-নির্যাতনের প্রতিশোধ নিতে চাই, আপনি দয়া করে আমাকে নিরুৎসাহী করবেন না”। শুনে সূর্যসেন স্মিত হাসলেন।
পরবর্তী সাক্ষাতেও মাস্টারদা বিনোদবিহারীকে বিপ্লবী দলে নেবেন না বলে জানিয়ে দেন। একপর্যায়ে তিনি মাস্টারদার সঙ্গে রেগে যেয়ে বললেন, “আপনিই কী ভারতীয় উপমহাদেশের একমাত্র বিপ্লবী? অন্য দলও তো আছে। আপনি আমাকে না নিলে আমি অন্যদের দলে যোগ দেব।” এরপরই মাস্টারদা তাঁকে জড়িয়ে ধরে দলে নিয়েছিলেন।
এভাবেই সেদিনকার সেই একাগ্র দেশপ্রেমিক ও সাহসী যুবকটি বিপ্লবীদের দলে নিজের নাম লিখিয়েছিলেন। শুধু নাম লেখানো নয়, নিরীহ ভারতীয়দের হত্যা ও দেশ দখলকারী ব্রিটিশদের মনে কাঁপুনি ধরিয়ে দেয়ার জন্য মাস্টারদা সূর্যসেনের নেতৃত্বে তিনি জীবন বাজি রেখে যুদ্ধ করেছেন।
এই বিপ্লবী নেতা বিনোদবিহারী চৌধূরী ১৯১১ সালের ১০ জানুয়ারী চট্টগ্রাম জেলার বোয়ালখালি থানায় জন্মগ্রহণ করেন৷ চট্টগ্রাম জেলার ফটিকছড়ি থানার রঙামাটি বোর্ড স্কুলে তাঁর প্রাথমিক শিক্ষা শুরু হয়েছিল৷ সেখান থেকে তিনি করোনেশন উচ্চ বিদ্যালয়, বোয়ালখালির পি.সি. সেন সারোয়ারতলি উচ্চ বিদ্যালয়, চিটাগাং কলেজ এবং কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে মাধ্যমিক ও উচ্চতর শিক্ষা লাভের জন্য যান। ১৯২৯ সালে মাধ্যমিক স্কুল সার্টিফিকেট পরীক্ষায় কৃতিত্বের সাথে উত্তীর্ণ হওয়ার জন্য তাঁকে বৃত্তি প্রদান করা হয়৷ ১৯৩৪ এবং ১৯৩৬ সালে ব্রিটিশ রাজের রাজপুটনার ডিউলি ডিটেনশন ক্যাম্পে বন্দী অবস্থায় থাকার সময় তিনি প্রথম শ্রেণীতে আই.এ. এবং বি.এ. পাস করেন।
বাবা কামিনী কুমার চৌধুরী ছিলেন পেশায় উকিল। মা রামা চৌধুরী ছিলেন গৃহিনী। শৈশবেই বিনোদবিহারী চৌধুরী তাঁর বাবা কামিনী কুমার চৌধুরীর কাছ থেকে পেয়েছিলেন বিপ্লবী চেতনা। ‘২১-‘২২ সালে যখন তিনি ভারতব্যাপী অসহযোগ আন্দোলনে জড়িয়ে পরেন। তখন কামিনী কুমার চৌধূরী তাঁর সার্বক্ষণিক সঙ্গী হিসেবে পেয়েছিলেন ছেলে ১১ বছরের বিনোদবিহারীকে। তখন থেকেই বিনোদবিহারী দেখে এসেছেন কামিনী কুমারকে বিলেতি কাপড় ছেড়ে খদ্দরের কাপড় পরতে। শুধু যে নিজে পরতেন তা-ই নয়, ছেলেমেয়েদেরও খদ্দরের কাপড় কিনে দিতেন। মূলত বাবাকে দেখেই তাঁর মধ্যে স্বদেশ প্রেম জেগে ওঠে।
বিপ্লবীদের দলে নাম লেখানোর অল্প দিনের মধ্যেই বিনোদবিহারী চৌধুরী মাস্টারদা সূর্যসেনের প্রিয়ভাজন হয়ে উঠেছিলেন। ১৯৩০ সালের ঐতিহাসিক অস্ত্রাগার লুন্ঠনে বিনোদবিহারী চৌধুরী তাই হতে পেরেছিলেন সূর্যসেনের অন্যতম তরুণ সহযোগী। বিপ্লবী দলের সর্বাধিনায়ক মাস্টারদা বিপ্লবীদেরকে চারটি ‘অ্যাকশন গ্রুপে’ ভাগ করেছিলেন। প্রথম দলের দায়িত্বে ছিল ফৌজি অস্ত্রাগার আক্রমণ, দ্বিতীয় দলে ছিল পুলিশ অস্ত্রাগার দখল, তৃতীয় দলের ছিল টেলিগ্রাফ ভবন দখল, চতুর্থ দলের ছিল রেললাইন উৎপাটন। বিনোদবিহারী চৌধুরী ছিলেন পুলিশ অস্ত্রাগার দখল করার গ্রুপে। সেদিন মাস্টারদা সবাইকে ডেকে যার যার দায়িত্ব বুঝিয়ে ছড়িয়ে পড়তে বললেন। বিনোদবিহারীসহ আরো জনা দশেকের দায়িত্ব ছিল দামপাড়া পুলিশ লাইনের আশপাশে রাত ১০টার মধ্যে উপস্থিত থাকা। তাঁরা যথাসময়ে মিলিটারী পোশাক পরে উপস্থিত হলেন। সঙ্গে ছিল আলমারি ভাঙার জন্য দুখানা শাবল। কথা ছিল রাত ১০টায় আরেক গ্রুপ পাহাড়ে উঠে প্রহরীদের আটক করবে এবং ‘বন্দেমাতরম’ বলে চিৎকার করবে। এই চিৎকারের সঙ্গে সঙ্গে যাঁরা জঙ্গলের চারদিকে থাকবে তাঁরাও একযোগে ‘বন্দেমাতরম’ বলে চিৎকার করে পাহাড়ে পৌঁছাবে। দুরু দুরু বুকে অপেক্ষা করছেন তাঁরা। তখনো তাঁরা জানেন না তাঁদের মিশন কতটুকু সফল হবে। জীবনের প্রথম এ ধরনের একটি অপারেশন করছেন। এমন সময় হঠাৎ করে ওপর থেকে ‘বন্দেমাতরম’ চিৎকার শুনতে পেলেন । সঙ্গে সঙ্গে তাঁরাও জঙ্গল থেকে একযোগে ‘বন্দেমাতরম’ চিৎকার দিয়ে পাহাড়ের ওপরে উঠে পড়লেন। শত্রুরা তাঁদের চিৎকার শুনে ভাবল, তাঁরা হয়তো সংখ্যায় অনেক। তারা ভয়ে পালাল। এরপর বিনোদবিহারীরা পুলিশ লাইনের ভেতরে ঢুকে শাবল দিয়ে আলমারি ভেঙে রাইফেল বারুদ নিয়ে নিলেন। আর যা প্রয়োজন হবে না তাতে আগুন লাগিয়ে দিলেন। সে দিন তাঁরা সবাই যার যার দায়িত্ব সঠিকভাবে পালন করেছিলেন বলেই পুলিশ লাইন আক্রমণ সফল হয়েছিল। তাঁদের হাতে প্রচুর অস্ত্রশস্ত্র এসেছিল, যা পরে জালালাবাদ যুদ্ধে কাজে লাগানো হয়।
১৮ এপ্রিল রাতে চট্টগ্রামে ব্রিটিশদের মূল ঘাঁটিগুলোর পতন ঘটিয়ে মাস্টারদার নেতৃত্বে শহর তাঁদের নিয়ন্ত্রণে চলে আসে। নেতা-কর্মীরা দামপাড়া পুলিশ লাইনে সমবেত হয়ে জাতীয় পতাকা উত্তোলন করে এবং মাস্টারদাকে প্রেসিডেন্ট ইন কাউন্সিল, ইন্ডিয়ান রিপাবলিকান আর্মি চিটাগাং ব্রাঞ্চ বলে ঘোষণা করা হয় এবং রীতিমতো মিলিটারি কায়দায় কুচকাওয়াজ করে মাস্টারদা সূর্যসেনকে সংবর্ধনা দেওয়া হয়। তুমুল ‘বন্দেমাতরম’ ধ্বনি ও আনন্দ-উল্লাসের মধ্যে এ অভিষেক অনুষ্ঠিত হয়।
‘৩০সালের এ ঘটনার পর ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলন জঙ্গি রূপ ধারণ করে। সে দিনের এসব বিপ্লবীর দুঃসাহসিক কর্মকান্ড ব্যর্থ হয়নি। চট্টগ্রাম সম্পূর্ণরূপে ব্রিটিশ শাসন থেকে মুক্ত ছিল চার দিন। এই কয়েক দিনে ব্রিটিশ সৈন্যরা শক্তি সঞ্চয় করে বিপ্লবী দলের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়েছিল। বিপ্লবী মন্ত্রে দীক্ষিত বিনোদবিহারীরাও বীর বিক্রমে পরে জালালাবাদ পাহাড়ে যুদ্ধ চালিয়ে গিয়েছিলেন।
জালালাবাদ যুদ্ধ ছিল বিনোদবিহারী চৌধুরীর প্রথম সম্মুখযুদ্ধ। সে দিন তিনি ব্রিটিশ সৈন্যদের বিরুদ্ধে লড়েছিলেন অসীম সাহসিকতায়। গলায় গুলিবিদ্ধ হয়েও লড়াই থামাননি বিনোদবিহারী চৌধুরী। চোখের সামনে দেখেছিলেন ১২ জন সহকর্মীর মৃত্যু। সে সময়ের এক ঘটনা বললেন তিনি, “আমরা দলে ছিলাম ৫৪ জন, পাহাড়ে লুকিয়ে আছি, তিন দিন কারো পেটে ভাত পড়েনি। পাহাড়ি গাছের দু-একটি আম খেয়ে দিন পার করেছি। এ কারণে বিপ্লবীদের মধ্যে চাঞ্চল্য দেখা দিয়েছে। এর মধ্যেই একদিন বিকেলে অম্বিকাদা কীভাবে যেন বড় এক হাঁড়ি খিচুড়ি নিয়ে হাজির হলেন। আমরা তো অবাক। ওইদিন সেই খিচুরি আমাদের কাছে মনে হয়েছিল অমৃত।”
এর আগে অস্ত্রাগারে আগুন লাগাতে গিয়ে হিমাংশু সেন বলে এক বিপ্লবী অগ্নিদগ্ধ হয়। তাঁকে নিরাপদ স্থানে রাখার জন্য অনন্ত সিংহ ও গনেশ ঘোষ, আনন্দ গুপ্ত ও মাখন ঘোষাল দামপাড়া ত্যাগ করে। এ ঘটনার পর তৎকালীন চট্টগ্রাম জেলা ম্যাজিস্ট্রেট সমুদ্র বন্দরের বিদেশী জাহাজ থেকে অস্ত্র সংগ্রহ করে সৈন্য নিয়ে তাঁদের আক্রমণ করে। কিন্তু লোকনাথ বলের নেতৃত্বে একদল বিপ্লবী তার যোগ্য জবাব দিয়েছিল। এদিকে অনন্ত সিংহ ও গণেশ ঘোষ হিমাংশুকে রেখে ফিরে না আসতে মাস্টারদা অন্যান্যদের সঙ্গে পরামর্শ করে দামপাড়া ছেড়ে নিকটবর্তী পাহাড়ে আশ্রয় নেওয়ার সিদ্ধান্ত নেন। ২১ এপ্রিল তারিখেও তাঁদের সঙ্গে যোগাযোগ না হওয়ায় শেষ রাতের দিকে পুনরায় শহর আক্রমণের উদ্দেশ্যে বিনোদ বিহারীরা ফতোয়াবাদ পাহাড় থেকে রওনা হলেন। মাস্টারদা তাঁদের ডেকে বললেন, আমরা যেকোন প্রকারেই আমাদের কর্মসূচি পালন করব। শেষ পর্যন্ত সিদ্ধান্ত হলো ভোর রাতে চট্টগ্রাম শহর আক্রমণ করা হবে। বিনোদবিহারী চৌধুরীরা ফতেয়াবাদ পাহাড় থেকে সময়মতো শহরে পৌঁছাতে পারলেন না। ভোরের আলো ফোটার আগেই তাঁদের আশ্রয় নিতে হলো জালালাবাদ পাহাড়ে। ঠিক করা হলো রাতের বেলা এখান থেকেই শহরে ব্রিটিশ সৈন্যদের অন্যান্য ঘাঁটি আক্রমণ করা হবে। কিন্তু দুর্ভাগ্য, গরু-বাছুরের খোঁজে আসা রাখালরা মিলিটারী পোশাক পরিহিত বিপ্লবীদের দেখে পুলিশে খবর দেয়। ওই রাখালদের দেখেই সূর্যসেন প্রমোদ গুনেছিলেন। তখনই তিনি ধারণা করেন শত্রুর সঙ্গে সংঘর্ষ অনিবার্য। অল্প কিছুক্ষণের মধ্যে তাঁর আশংকা বাস্তাব হলো। মাস্টারদা সূর্যসেন লোকনাথ বলকে আসন্ন যুদ্ধ পরিচালনার দায়িত্ব দিলেন।
লোকনাথ বল যুদ্ধের একটি ছক তৈরি করলেন। বিনোদবিহারীসহ কয়েকজনকে ত্রিশাল আক্রমণের দায়িত্ব দিলেন। শত্রুপক্ষ যেন কোনক্রমে পাহাড়ে উঠে আসতে না পারে সেজন্য তাঁদের যুদ্ধকৌশল কী হবে তা বলে দিলেন তিনি। বেলা ৪টা নাগাদ পাহাড় থেকে তাঁরা দেখলেন সৈন্যবোঝাই একটি ট্রেন জালালাবাদ পাহাড়ের পূর্ব দিকে থামল। ডাবল মার্চ করে ব্রিটিশ সৈন্যরা পাহাড়ের দিকে অগ্রসর হচ্ছে। কাছে আসার সঙ্গে সঙ্গে দুই পক্ষের তুমুল যুদ্ধ শুরু হলো। শত্রুরা কিছুতেই পাহাড়ের ওপর উঠতে পারছিল না। শত্রুরা তাঁদের দিকে বৃষ্টির মতো গুলি ছুঁড়ছিল। আর বিনোদবিহারীদের তেমন কোনো অস্ত্রও ছিল না। এ ছিল এক অসমান যুদ্ধ। এই যুদ্ধে প্রথম শহীদ হলেন হরিগোপাল বল নামে ১৫ বছরের এক বিপ্লবী। শহীদের রক্তে জালালাবাদ পাহাড় সিক্ত হলো। কিছুক্ষণ পরেই তিনি দেখতে পেলেন আরেক বিপ্লবী বিধু গুলিবিদ্ধ হয়ে পড়ে যাচ্ছেন। মারা যাওয়ার আগে বিধু বললেন, “নরেশ আমার বুকেও হাদাইছে একখান গুলি। তোরা প্রতিশোধ নিতে ছাড়বি না”। বিধু ছিলেন মেডিকেল স্কুলের শেষ বর্ষের ছাত্র। খুব রসিক। মারা যাওয়ার আগেও তাঁর রসিকতা কমেনি। একে একে নরেশ রায়, ত্রিপুরা সেনও শহীদ হলেন। হঠাৎ করে একটা গুলি এসে বিনোদবিহারীর গলার বাঁ দিকে ঢুকে ডান দিক দিয়ে বেরিয়ে গেল। দুই হাতে গুলি ছুঁড়ছিলেন তিনি। এক সময় অসহ্য যন্ত্রণায় জ্ঞান হারালেন। ঘন্টাখানেক অচৈতন্য থাকার পর বিনোদবিহারী দেখলেন শত্রু-সৈন্যরা সব পালিয়ে গেছে। গলার মধ্যে তখন অসহ্য যন্ত্রণা। ফোঁটা ফোঁটা রক্ত ঝরছে। পরনের লুঙ্গিটা খুলে বিপ্লবীরা তাঁর গলায় ব্যান্ডেজ করে দিলেন। মাস্টারদা সিদ্ধান্ত নিলেন জালালাবাদ পাহাড় ছেড়ে অন্য পাহাড়ের ঘন জঙ্গলে রাতের মতো আশ্রয় নেবেন। পরবর্তী কর্মসূচি হবে গেরিলা যুদ্ধ।
তাঁর ধীরগতিতে চলার কারণেই একসময় মাস্টারদার কাছ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়লেন বিনোদবিহারী। তখন লোকনাথ বলের সাথে আলাপ করে সিদ্ধান্ত নেয়া হলো শহরের আশপাশ থেকে গ্রামের ভেতরে প্রবেশ করবেন সবাই। প্রায় গ্রামে তাঁদের দলের ছেলেরা রয়েছে। সেখানে গোপন আশ্রয়ের ব্যবস্থা করা হবে। লোকনাথ বল তাঁদের নির্দেশ দিলেন, অপরাহ্ন পর্যন্ত ধানক্ষেতে লুকিয়ে থাকতে। বিকেল ৪টার দিকে ধানক্ষেত থেকে বের হয়ে আবার হাঁটা ধরলেন। গলায় প্রচন্ড ব্যথা। ক্ষণে ক্ষণে রক্তপাত হচ্ছিল। এক সময় লোকনাথ বলকে তিনি বললেন, “আমি অত্যন্ত দুর্বল বোধ করছি। আমার জন্য আপনাদের পথ চলতে খুব অসুবিধা হচ্ছে। আমাকে রেখে আপনারা চলে যান”। লোকনাথ বল বললেন, “এই অবস্থায় তোমাকে কীভাবে ফেলে যাব”। তাঁরা যেখানে দাঁড়িয়েছিলেন তার ৪ মাইলের মধ্যেই কুমিরা। তখন ছোট কুমিরা গ্রামে তাঁর খুড়তুত ভাইয়ের শ্বশুরবাড়ি। জেঠাশ্বশুর ছিলেন ইউনিয়ন বোর্ডের প্রেসিডেন্ট। সেখানেই বিনোদবিহারী আশ্রয় নিলেন।
খুড়তুত ভাইয়ের শ্বশুরবাড়িতে বিনোদবিহারীর চিকিৎসা চলে দীর্ঘদিন। তাঁদের আদর-যত্নে তিনি সুস্থ হয়ে উঠলেন। এরই মধ্যে গান্ধীজির নেতৃত্বে ভারতের সর্বত্রই লবন আইন ভঙ্গ আন্দোলন শুরু হয়। কুমিরাতেও কংগ্রেস স্বেচ্ছাসেবকদের শিবির স্থাপিত হলো। আন্দোলন দমনের জন্য গ্রামে পুলিশ বাহিনী ক্যাম্প করে। ফলে বিনোদবিহারীকে তাঁর আশ্রয়স্থল হারাতে হলো। গ্রামে পুলিশ বাহিনী ক্যাম্প করার ফলে শঙ্কিত হয়ে পড়েন আশ্রয়দাতারা। ঠিক করা হলো, এখান থেকে তাঁকে সরিয়ে ফেলা হবে। কারণ তিনি এখানে ধরা পড়লে বাড়ির সবাইকে বিপ্লবীকে আশ্রয় দেওয়ার অভিযোগে জেলে পচতে হবে। সমস্যা হলো কীভাবে পালাবেন তিনি। সে সময় তাঁর বৌদি বাপের বাড়িতে এসেছেন। তাঁকে পাঠানো হবে চট্টগ্রামের চাকতাই। বৌদির সঙ্গে পরামর্শ করে ঠিক করলেন, তিনিও বউ সাজবেন। লাল পাড়ের শাড়ি হাতে শাঁখা ও চুড়ি পরে বউ সাজলেন বিনোদ বিহারী। বিকেল নাগাদ তিনি পৌঁছে গেলেন চাকতাই। পথে দুবার সৌভাগ্যক্রমে পুলিশ বেষ্টনী পার হয়ে চলে এসেছিলেন।
কিন্তু এভাবে পালিয়ে বেশিদিন থাকতে পারলেন না তিনি। তাঁকে জীবিত বা মৃত ধরে দেওয়ার জন্য ৫০০ টাকা পুরস্কার ঘোষণা করা হয়। শেষ পর্যন্ত ১৯৩৩ সালের জুন মাসে ব্রিটিশ সরকারের হাতে বিনোদবিহারী চৌধুরী গ্রেপ্তার হলেন। কোনো সাক্ষ্য-প্রমাণ সংগ্রহ করতে না পারলেও ‘বেঙ্গল ক্রিমিনাল ল অ্যামেন্ডমেন্ট অ্যাক্টে’ বিনা বিচারে পাঁচ বছর কারারুদ্ধ রাখা হয় তাঁকে। এরপরও বিনোদবিহারী চৌধুরীকে আরো দু’বার বন্দী জীবন কাটাতে হয়েছে। ‘৪১ সালের মে মাসে গান্ধীজীর ভারত ছাড় আন্দোলনে যোগদানের প্রস্তুতিকালে গ্রেপ্তার হন তিনি এবং ছাড়া পান ‘৪৫ সালের শেষের দিকে। ‘৬৫ সালে ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধ শুরু হলে পাকিস্তান সরকার ‘সিকিউরিটি অ্যাক্ট’ অনুযায়ী বিনোদবিহারী চৌধুরীকে বিনা বিচারে এক বছর কারাগারে আটকে রাখে।
১৯৩০ সালে মাস্টারদা সূর্যসেনের বিপ্লবী দলে ঢোকার আগে থেকেই যে দেশপ্রেম বিনোদবিহারীর মধ্যে অঙ্কুরিত হয়েছিল তা দিন দিন বিস্তারিত হয়েছে। অবিরাম দেশের জন্য কাজ করে গেছেন তিনি। ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলন শেষ হওয়ার পর ‘৫২-র ভাষা আন্দোলনের সময় তিনি রেখেছেন গুরুত্বপূর্ণ ভুমিকা। ‘৫২-র ভাষা আন্দোলনের সময় তিনি ছিলেন আইনসভার সদস্য। ২১শে ফেব্রুয়ারির দিন বিনোদ বিহারী ফরাশগঞ্জ থেকে ২টার সময় আইনসভায় যোগদানের জন্য রিকশা করে আসছিলেন। মেডিকেল কলেজের সামনে আসার সঙ্গে সঙ্গে তিন-চারজন ছেলে তাঁকে রিকশা থেকে নামিয়ে বলল, “আপনাকে যেতে দেব না। দেখে যান কীভাবে আমাদের লোকজনদের হত্যা করা হয়েছে”। ওরা একটা ঘরে নিয়ে গিয়ে তাঁকে বরকতের মৃতদেহ দেখাল। বিকৃত হয়ে গেছে চেহারা। তারপর তিনি তাদেরকে বললেন, “আমরা তো তোমাদেরই লোক। মুসলিম লীগ দেশ চালাচ্ছে। আমাকে যদি আইনসভায় যেতে না দাও তাতে তো ওদেরই লাভ হবে। বরং সেখানে গিয়ে বললে সরা বিশ্ব শুনবে”। তখন তারা বুঝল এবং তাঁকে ছেড়ে দিল। সে দিন তাঁরা এই বর্বরতার বিরুদ্ধে আইনসভায় কঠোর মত ব্যক্ত করেছিলেন।
‘৭১ সালে চট্টগ্রাম থেকে পালিয়ে ভারতে গিয়ে তরুণ যোদ্ধাদের ট্রেনিংয়ে পাঠিয়েছেন বিনোদবিহারী। মুক্তিযুদ্ধের সময় রাইফেল হাতে নিতে পারেননি বটে কিন্তু ক্যাম্পে ক্যাম্পে গিয়ে তরুণ মুক্তিযোদ্ধাদের অনুপ্রাণিত করেছেন।
১৯৩০ সালে কংগ্রেস চট্টগ্রাম জেলা কমিটির সহ-সম্পাদক, ১৯৪০-৪৬ সালে বঙ্গীয় প্রাদেশিক কংগ্রেস নির্বাহী কমিটির সদস্য, ‘৪৬ সালে কংগ্রেস চট্টগ্রাম জেলা কমিটির সাধারণ সম্পাদক ছিলেন বিনোদবিহারী । ১৯৪৭ সালে ৩৭ বছর বয়সে পশ্চিম পাকিস্তান কংগ্রেসের সদস্য হন তিনি। ১৯৫৮ সালে আইয়ুব খান সামরিক আইন জারির মাধ্যমে সব রাজনৈতিক দলকে বেআইনি ঘোষণা করলে রাজনীতি থেকে অবসর নেন তিনি ৷ তাঁর স্ত্রীর নাম বিভা চৌধুরী। ছেলের নাম বিবেকান্দ্র চৌধুরী।
মাঝে তিনি ১৯৩৯ সালে দৈনিক পত্রিকার সহকারী সম্পাদক হিসাবে তাঁর কর্মজীবন শুরু করেন। এরপর ১৯৪০ সালে চট্টগ্রাম কোর্টের একজন আইনজীবি হিসাবে অনুশীলন শুরু করেন। কিন্ত অবশেষে তিনি তাঁর দীর্ঘ কর্মজীবনে শিক্ষকতাকেই পেশা হিসাবে গ্রহণ করেন।
১৯৭৭ সালে ‘চট্টগ্রাম কেন্দ্রীয় প্লাজা উদযাপন পরিষদ, সমাজসেবী’ হিসেবে, ১৯৮৮ সালে ‘চট্টলা ইয়ুথ কেয়ার দেশসেবক’ হিসেবে, ১৯৯৫ সালে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় জাতীয় সংহতি পরিষদ কর্তৃক, ১৯৯৮ সালে দৈনিক ভোরের কাগজ, ঢাকা, দৈনিক জনকন্ঠ, ঢাকা, ‘চট্টগ্রাম পরিষদ কলকাতা কর্তৃক সেবাকর্মী’ হিসেবে সম্মাননা পান। ২০০১ সালে বিনোদবিহারী চৌধুরীকে স্বাধীনতা পদক প্রদান করা হয়।
সংক্ষিপ্ত জীবনী:
জন্ম: শ্রী বিনোদ বিহারী চৌধূরী ১৯১১ সালের ১০ জানুয়ারী চট্টগ্রাম জেলার বোয়ালখালি থানায় জন্মগ্রহণ করেন।
বাবা-মা: বাবা কামিনী কুমার চৌধুরী। মা রামা চৌধুরী ছিলেন গৃহিনী।
পড়াশুনা: চট্টগ্রাম জেলার ফটিকছড়ি থানার রঙামাটি বোর্ড স্কুলে তাঁর প্রাথমিক শিক্ষা শুরু হয়েছিল ৷ সেখান থেকে তিনি করোনেশন উচ্চ বিদ্যালয়, বোয়ালখালির পি.সি. সেন সারোয়ারতলি উচ্চ বিদ্যালয়, চিটাগাং কলেজ এবং কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে মাধ্যমিক ও উচ্চতর শিক্ষা লাভের জন্য যান। ১৯২৯ সালে মাধ্যমিক স্কুল সার্টিফিকেট পরীক্ষায় কৃতিত্তের সাথে উত্তীর্ণ হওয়ার জন্য তাঁকে বৃত্তি প্রদান করা হয়। ১৯৩৪ এবং ১৯৩৬ সালে ব্রিটিশ রাজের রাজপুটনার ডিউলি ডিটেনশন ক্যাম্পে বন্দী অবস্থায় থাকার সময় তিনি প্রথম শ্রেণীতে আই.এ. এবং বি.এ. পাস করেন।
কর্মজীবন: ১৯৩০ সালে কংগ্রেস চট্টগ্রাম জেলা কমিটির সহ-সম্পাদক, ‘৪০-‘৪৬ সালে বঙ্গীয় প্রাদেশিক কংগ্রেস নির্বাহী কমিটির সদস্য, ‘৪৬ সালে কংগ্রেস চট্টগ্রাম জেলা কমিটির সাধারণ সম্পাদক ছিলেন বিনোদবিহারী । ১৯৪৭ সালে ৩৭ বছর বয়সে পশ্চিম পাকিস্তান কংগ্রেসের সদস্য হন তিনি। ১৯৫৮ সালে আইয়ুব খান সামরিক আইন জারির মাধ্যমে সব রাজনৈতিক দলকে বেআইনি ঘোষণা করলে রাজনীতি থেকে অবসর নেন তিনি ৷
মাঝে তিনি ১৯৩৯ সালে দৈনিক পত্রিকার সহকারী সম্পাদক হিসাবে তাঁর কর্মজীবন শুরু করেন। এরপর ১৯৪০ সালে চট্টগ্রাম কোর্টের একজন আইনজীবি হিসাবে অনুশীলন শুরু করেন। কিন্ত অবশেষে তিনি তাঁর দীর্ঘ কর্মজীবনে শিক্ষকতাকেই পেশা হিসাবে গ্রহণ করেন।
স্ত্রী ও ছেলে-মেয়ে:তাঁর স্ত্রীর নাম বিভা চৌধুরী। ছেলের নাম বিবেকান্দ্র চৌধুরী।
তথ্যসূত্র: বিনোদবিহারী চৌধুরীর সরাসরি সাক্ষাৎকার নিয়ে জীবনীটি করা হয়েছে।
লেখক : হিমেল চৌধূরী