বঙ্গভঙ্গের প্রতিবাদে দেশ উত্তাল হয়ে ওঠায় বিপিনচন্দ্র পালের বুকে স্বদেশ প্রেমের আগুন জ্বলে উঠল। আচার্য শিবনাথ শাস্ত্রীর পৌরোহিত্যে বিপিন পাল বুকের রক্ত দ্বারা লিখে শপথ করলেন-
১. সরকারী চাকুরী করিব না
২. বৃটিশের দাসত্ব করিব না।
৩. প্রয়োজনের অতিরিক্ত সঞ্চয় করিব না।
৪. যথাসাধ্য স্বাধীনতা সংগ্রামে আত্মনিয়োগ করিব।
তাঁর করা উপরের প্রতিজ্ঞা থেকে বোঝা যায় জাতীয় স্বাধীনতা আন্দোলন বিপিনচন্দ্র পালের মনে প্রচণ্ডভাবে রেখাপাত করেছিল। তিনি যেসব প্রতিজ্ঞা করেছিলেন তা রক্ষা করার জন্য আপ্রাণ চেষ্টা করেছিলেন।
ব্রিটিশ বিরোধী এই বিপ্লবী বিরল প্রতিভার অধিকারী ছিলেন। তিনি হলেন একাধারে রাজনীতিবিদ, লেখক, সাংবাদিক ও সমাজ সংস্কারক। উপমহাদেশের রাজনীতিবিদদের মধ্যে তাঁর বাগ্মীতা ছিল অসাধারণ। ব্রিটিশ সরকারের বিরুদ্ধে তিনি অনলবর্ষী বক্তৃতা দিতেন। তাঁর আহবানে হাজার হাজার যুবক ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামে ঝাঁপিয়ে পড়ে। তিনি ছিলেন চরমপন্থী রাজনীতির অন্যতম প্রধান প্রবক্তা।
একজন প্রবাদতুল্য রাজনৈতিক হিসেবে রাজনীতিতে প্রত্যক্ষ ভূমিকা পালন করেও তিনি তাঁর অসাধারণ সৃষ্টিকর্মের জন্য আজও আমাদের প্রেরণার উৎস হয়ে বেঁচে আছেন। উনিশ শতকের আধুনিক বাংলা সাহিত্যের ক্রমবিকাশ হয়েছিল একদল তরুণ লেখকের হাতে। তাঁদের মধ্যে বিপিনচন্দ্র পালের ভূমিকা অন্যতম। রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডের পরও বিপিনচন্দ্র পালের জীবনের একটা বড় অংশ জুড়ে আছে সাহিত্য সাধনা। জীবিকার জন্য কখনও বিদ্যালয়ে শিক্ষকতা করেছেন আবার কখনও স্বাধীনভাবে সাংবাদিকতা করেছেন। উপমহাদেশের সাড়া জাগানো বহু সংবাদপত্রের সম্পাদনাও তিনি করেছেন।
সেকালের নিয়মানুসারে ইংরেজি শিক্ষিত তরুণরা সাহেবী জীবনের প্রতি আকৃষ্ট হতেন কিংবা সরকারি চাকুরি গ্রহণ করতেন। কিন্তু বিপিনচন্দ্র পাল তা করেননি বরং তাঁর কাছে প্রথম ও প্রধান বিষয় ছিলো ‘স্বাধীনতা লাভ’। স্বাধীনতা সংগ্রাম ও মানুষের মুক্তির জন্য জীবনের প্রতিটি মুহূর্ত ব্যয় করেছেন। তাঁর কর্মজীবন পর্যালোচনা করলে দেখা যায়, ভোগ নয়, ত্যাগই মুখ্য। দারুণ অর্থ কষ্টের মধ্যেও ‘দেশ-মাতা’র কথা ভেবে ভুলে গেছেন সকল যন্ত্রণা।
বিপিনচন্দ্র পাল জন্মেছিলেন সিপাহী বিপ্লবের এক বছর পরে ১৮৫৮ সালের ৭ নভেম্বর। বর্তমান হবিগঞ্জ জেলার সদর থানার পইল গ্রামে। তাঁর বাবা রামচন্দ্র পাল। তিনি ছিলেন পইল গ্রামের এক মাঝারি জমিদার। জমিদার হওয়া সত্বেও তিনি ছিলেন সর্বজন শ্রদ্ধেয় ব্যক্তিত্ব। কর্মজীবনে রামচন্দ্র পাল ঢাকার সাব-জজ কোর্টের পেশকারের চাকুরি করেন।
রামচন্দ্র পাল কোর্টে কয়েক বছর চাকুরি করার পর নিজ জেলা সিলেটের ফেঞ্চুগঞ্জ চলে আসেন। তারপর সিলেট বারে আইনজীবী হিসেবে যুক্ত হন। একসময় তিনি সিলেটের একজন খ্যাতনামা উকিল হিসেবে সম্মান ও সুনাম অর্জন করেন। তিনি ছিলেন শিক্ষানুরাগী। তাঁর বাসায় থেকে মফঃস্বলের বহু ছাত্র উচ্চশিক্ষা গ্রহণ করেন। বিপিনচন্দ্র পালের মাও ছিলেন উদার ও মানবিক গুণের অধিকারী। পারিবারিকভাবেই বিপিনচন্দ্র পালের মধ্যে সাম্য ও মানবতা বোধের দৃষ্টিভঙ্গী গড়ে উঠে।
পড়াশুনার হাতেখড়ি বাবার কাছে। পাঁচ বছর বয়সে বাংলা বর্ণমালা শিক্ষা শুরু হয়। রামায়ণ-মহাভারত-পুরাণের শ্লোক শুনে তাঁর বাল্যশিক্ষা শুরু হয়। ১৮৬৬ সালে বিপিনচন্দ্র পালকে তাঁর বাবা নয়া সড়ক স্কুলে ভর্তি করিয়ে দেন। তারপর ১৮৬৯ সালে তাঁকে সিলেট গভর্নমেন্ট স্কুলে ভর্তি করানো হয়। এই স্কুল থেকে তিনি এন্ট্রান্স পরীক্ষায় রেকর্ড সংখ্যক নম্বর পেয়ে পাশ করেন। ১৮৭৪ সালের ডিসেম্বর মাসে উচ্চশিক্ষার জন্য কলকাতায় যান। ১৮৭৫ সালে তিনি প্রেসিডেন্সি কলেজে ভর্তি হন। এই কলেজ থেকে এফ.এ. কোর্স ফাইনাল পরীক্ষা দেয়ার কিছুদিন আগে তিনি জল বসন্তে আক্রান্ত হন। ফলে ফাইনাল পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করতে পারেননি। এরপর তিনি ক্যাথিড্রাল মিশন কলেজে ভর্তি হন। এখান থেকে ১৮৭৭ সালে পুনরায় এফ.এ. পরীক্ষা দেন।
১৮৮১ সালের ডিসেম্বর মাসে তিনি পণ্ডিত শিবনাথ শাস্ত্রীর এক পালিতা বিধবা কন্যা নৃত্যকালীকে বিয়ে করেন। তাঁদের সংসারে দুই ছেলে ও দুই মেয়ের জন্ম হয়।
সংসার জীবনের পূর্বেই বিপিনচন্দ্র পাল রাজনীতিতে যুক্ত হন। ১৯৭৭ সালে তিনি সেকালের উদারপন্থি সমাজ সংস্কারক দার্শনিক শিবনাথ শাস্ত্রী দ্বারা প্রভাবিত হন। আচার্য শিবনাথ শাস্ত্রীর আদর্শে ও প্রেরণায় স্বাধীনতার সাধকদলের সদস্য হিসেবে বিপিনচন্দ্র পাল দীক্ষা গ্রহণ করেন। এসময় থেকে তিনি স্বদেশ-স্বজাতির মুক্তির লক্ষ্যে সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে রাজনৈতিক আন্দোলন গড়ে তোলার ব্রতে নিজেকে সম্পূর্ণ নিবেদন করেন। প্রথমদিন শরৎচন্দ্র রায়, আনন্দচন্দ্র মিত্র, কালীশঙ্কর-সুকুল, তারাকিশোর চৌধুরী, সুন্দরীমোহন দাস এবং বিপিনচন্দ্র পাল দীক্ষা গ্রহণ করেন।
তৎকালীন ভারতীয় রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ জনগণের মধ্যে জাতীয়তাবোধ ও রাজনৈতিক চেতনা জাগ্রত করার উদ্দেশ্যে সিলেটে ন্যাশনাল ইন্সটিটিউট স্থাপন করেন। শ্রীহট্ট শহরের এই প্রতিষ্ঠানটি ১৮৭৯ সালে পরিচালনার অভাবে বন্ধ হয়ে যাওয়ার উপক্রম হয়। এই সংবাদে কলিকাতাস্থ শ্রীহট্ট সম্মেলনীর সদস্যগণ অত্যন্ত উদ্বিগ্ন হয়ে বিপিনচন্দ্র পাল ও রাজেন্দ্র চৌধুরীকে শ্রীহট্টে প্রেরণ করেন। বিপিনচন্দ্র পাল ১৮৮০ সালের ৫ জানুয়ারি এই স্কুলকে ‘শ্রীহট্ট জাতীয় বিদ্যালয়’ হিসাবে রূপান্তর করেন। ইহাই ভারতের প্রথম জাতীয় প্রতিষ্ঠান। তখনও ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেসের জন্ম হয়নি। বিপিনচন্দ্র পাল এই জাতীয় বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক, ব্রজেন্দ্রনাথ দ্বিতীয় শিক্ষক এবং রাজেন্দ্র চৌধুরী তৃতীয় শিক্ষকের পদ গ্রহণ করেন। এই জাতীয় বিদ্যালয়টি ব্রিটিশ সরকার পরিচালিত শিক্ষা নীতিমালাকে অগ্রাহ্য করে নিজস্ব ধারায় চলে।
বিপিনচন্দ্র পাল জীবনের প্রথম ১৮৭৯ সালে উড়িষ্যার কটক একাডেমীতে প্রথমে সাধারণ শিক্ষক হিসেবে এবং পরে প্রধান শিক্ষক হিসেবে শিক্ষকতা করেন। তবে খুব বেশিদিন তিনি সেখানে থাকেননি। ১৮৮০ সালের জুলাই মাসের শেষে কলকাতায় ফিরে যান। ১৮৮১ সালের আগস্ট মাসে রায়বাহাদুর নারায়ণ স্বামী মুদালিয়ারের প্রতিষ্ঠিত উচ্চ ইংরেজি বিদ্যালয়ে প্রধান শিক্ষক হিসেবে নিযুক্ত হন।
এরপর তিনি বাঙ্গালোরে কিছুদিন একটি হাইস্কুলে প্রধান শিক্ষক হিসেবে শিক্ষকতা করেন। বিপিনচন্দ্র পাল ১৮৮০ দশকের কোনো এক সময় নিজ জেলা সিলেটের হবিগঞ্জের বর্তমান সরকারি উচ্চ বিদ্যালয়েও কিছুদিন শিক্ষকতা করেছেন।
বিপিনচন্দ্র পাল কোথাও বেশিদিন স্থির হতে পারেননি। যখনই তাঁর আত্মমর্যাদা বোধ ও স্বাধীন চিন্তার একটু ব্যঘাত হয়েছে তখনই তিনি সেই কাজ ছেড়ে দিয়েছেন।
১৮৮৫ সালে বোম্বে সম্মেলনের ভিতর দিয়ে সর্বভারতীয় রাজনৈতিক দল জাতীয় কংগ্রেসের জন্ম হয়। ভারতের জাতীয় আন্দোলনের ইতিহাসে এক নুতন অধ্যায়ের সূচনা হয়। বালগঙ্গাধর তিলক, লালা লাজপত রায়, বিপিনচন্দ্র পাল ও অরবিন্দ ঘোষ প্রমুখ নেতৃবৃন্দ দেশবাসীর মধ্যে আত্মবিশ্বাস ও আত্মনির্ভরতা গড়ে তুলতে সাহায্য করেন এবং আত্মত্যাগের মহান আদর্শে উদ্বুদ্ধ হয়ে সংগ্রামে অবতীর্ণ হওয়ার জন্য আহ্বান জানান।
কংগ্রেসের জন্মের পর থেকে নিজস্ব দৃষ্টিভঙ্গি দ্বারা নিয়মতান্ত্রিক আন্দোলন পরিচালিত হতে থাকে। অল্পদিনের মধ্যে বিপিনচন্দ্র পাল সর্বভারতীয় পর্যায়ের একজন নেতা হিসাবে পরিচিত হয়ে উঠেন। বিপিনচন্দ্র পাল অসাধারণ বক্তা হওয়ার কারণে বিভিন্ন সভা-সমাবেশের মাধ্যমে ব্রিটিশ শাসনের জনগণকে জাগ্রত করেন। কিন্তু গান্ধীজী জাতীয় কংগ্রেসের নেতৃত্ব গ্রহণের পর থেকে কংগ্রেসের অভ্যন্তরে মধ্যপন্থি ও চরমপন্থি অংশের মধ্যে এক সাময়িক ভাঙ্গন সৃষ্টি হয়। নানা উত্থান-পতনের মধ্য দিয়ে বিপিনচন্দ্র পাল মতাদর্শগতভাবে গান্ধীবাদী ধারার বিরুদ্ধে অবস্থান নেন এবং চরমপন্থি অংশের নেতৃত্বে চলে আসেন। এসময় তিনি গান্ধী নেহেরুর রাজনৈতিক প্রভুত্বের বিরুদ্ধে এক চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়ান। ব্রিটিশ শাসন থেকে দেশকে মুক্ত করতে তিনি প্রত্যক্ষভাবে রাজনৈতিক লড়াই-সংগ্রামে যুক্ত হন।
১৮৯০-৯২ সাল পর্যন্ত বিপিনচন্দ্র পাল কলকাতায় পাবলিক লাইব্রেরি ও পৌরকর্পোরেশনে কিছুদিন কাজ করেন। ১৮৯২-৯৩ সাল পর্যন্ত তিনি কলকাতা কর্পোরেশনের লাইসেন্স ইন্সপেকটার হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। ১৮৯৯ সালে তিনি সাধারণ ব্রাহ্মসমাজের বৃত্তি নিয়ে গবেষণার জন্য অক্সফোর্ডের ম্যানচেষ্টার কলেজে যান। সেখানকার পাঠক্রম শেষ করার পর সারা ইংল্যাণ্ড ও আমেরিকা ভ্রমণ করে তিনি হিন্দুধর্ম, ভারতীয় রাজনীতি ও মাদকদ্রব্য নিবারণ সম্বন্ধে বক্তৃতা করেন এবং ১৯০০ সালে তিনি দেশে ফিরে আসেন।
বিপিনচন্দ্র পাল প্রাণশক্তি দিয়ে জাগিয়ে তোলেন ঘুমন্ত জাতিকে। তিনি পরাধীনতার শৃঙ্খল ভাঙ্গার আহ্বান জানান। ক্রমেই লালা লাজপত রায়, বাল গঙ্গাধর তিলকের সাথে ঘনিষ্ঠ হয়ে উঠেন। তিনি শুধু কলকাতায় বসে থাকেননি, সারা ভারতবর্ষের প্রতিটি অঞ্চলে ঘুরে ঘুরে পরাধীন ভারতবর্ষের রাজনৈতিক পরিস্থিতি তুলে ধরেন। সমগ্র দেশে অল্পদিনের মধ্যে আলোড়ন সৃষ্টি করে ঘুমন্ত ভারতকে স্বাধীনতার মন্ত্রে উদ্বুদ্ধ করেন। দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন দাশ তাঁকে ‘গুরুদেব’ বলে সম্বোধন করতেন। লালা লাজপত রায়, বাল গঙ্গাধর তিলক ও বিপিনচন্দ্র পাল তখনকার ভারতে রাজনৈতিক অঙ্গনে তিন দিকপাল ছিলেন। তাঁদেরকে সংক্ষেপে লাল-বাল-পাল বলা হত। ভারতের বিপ্লবী আন্দোলনের চিন্তা ও মতবাদকে জনসাধারণের মধ্যে পৌছে দেওয়ার কারণে তিনি ‘চরমপন্থী’ নেতা হিসেবে পরিচিতি লাভ করেন।
তিনি সব সময়ই বিপ্লবীপন্থাকে স্বাধীনতা লাভের একমাত্র পথ বলে মনে করতেন। কংগ্রেস রাজনীতির সময়ও তিনি চরমপন্থার দিকে ছিলেন। গান্ধীজীর অহিংসবাদ দিয়ে ভারতের স্বাধীনতা লাভ সম্ভব নয় বলে তিনি মনে করতেন এবং তা অকুন্ঠ চিত্তে সভা-সমাবেশে বলতেন।
বিপিনচন্দ্র পাল ১৯০৪ সালে বোম্বাইয়ে কংগ্রেসের সভাপতিত্ব করেন। ১৯০৬ সালে শ্রীহট্ট সুরমা উপত্যকার প্রথম রাষ্ট্রীয় সম্মেলনে বক্তৃতা দেন। ১৯০৮ সালে করিমগঞ্জে সুরমা উপত্যকার দ্বিতীয় সম্মেলনে বক্তৃতা করেন। এছাড়া ১৯০৫ সালের বঙ্গভঙ্গ প্রতিরোধের আন্দোলনে ঐতিহাসিক ভূমিকা পালন করেন।
ভারতে স্বাধীনতা ও মুক্ত সমাজের স্বপ্নকে রূপায়িত করার জন্য তিনি আমরণ সংগ্রাম করেছেন। ব্রিটিশদের চোখে তিনি ছিলেন একজন দুঃসাহসী নেতা। এজন্য তাঁকে দীর্ঘদিন কারাবরণ করতে হয়েছে।
১৯০৫-১৯০৮ সাল পর্যন্ত তাঁর জ্বালাময়ী বক্তৃতায় ব্রিটিশের ভিত নড়ে যায়। ১৯০৭ সালে মাদ্রাজে তিনি যে বক্তৃতা প্রদান করেন তাতে সারাদেশে এক জাগরণ সৃষ্টি হয়। সেক্রেটারী অব স্টেট ও বড়লাট বিপিনচন্দ্রকে শৃঙ্খলিত করার জন্য ব্যতিব্যস্ত হয়ে উঠেন।
১৯০৬ সালে তিনি ‘বন্দেমাতরম’ পত্রিকা প্রকাশ করেন। ১৯০৬ সালের ১৮ সেপ্টেম্বর বিপিনচন্দ্র পাল ‘বন্দেমাতরম’ পত্রিকায় এক সুদীর্ঘ প্রবন্ধ রচনা করেন। তিনি লিখেন, “আমরা যদি সরকারকে কোনরূপে সাহায্য করতে অস্বীকৃত হই তাহলে একদিনেই শাসনতন্ত্র অচল হয়ে পড়বে”। বিংশ শতাব্দীর প্রথম দশকে বিপিনচন্দ্র পাল তাঁর জ্বালাময়ী বক্তৃতা ও ক্ষুরধার লেখনীর মাধ্যমে দেশবাসীকে জাতীয়তাবাদী ভাবধারায় উদ্দীপ্ত করে জাগিয়ে তোলেন।
বিপিনচন্দ্র পাল বিভিন্ন সাহিত্য-সংস্কৃতি-সংগঠনের সাথেও জড়িত ছিলেন। তিনি তাঁর পত্রিকার লেখার জন্য তরুণ সাহিত্যসেবীদের অনুপ্রেরণা যোগাতেন। তিনি সাহিত্য বিষয়ে মত বিনিময়ে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের কাছে যেমন এসেছিলেন, তেমনি পত্রিকা সম্পাদনা সূত্রে রামানন্দ চট্টোপাধ্যায়ের সঙ্গে ঘনিষ্ঠতা গড়ে তোলেন। আবার দর্শন চিন্তার জন্য ব্রজেন্দ্রনাথ শীলের সাথে সখ্যতা গড়ে উঠে।
‘বন্দেমাতরম’ পত্রিকার সম্পাদক থাকা অবস্খায় তাঁকে শ্রী অরবিন্দের বিরুদ্ধে একটি মামলায় সাক্ষ্য দিতে বলা হয়। তিনি সাক্ষ্য দিলে ও সত্য কথা বললে অরবিন্দের নিশ্চিত জেল হত, তাই বিপিনচন্দ্র পাল সাক্ষ্য দিতে অস্বীকার করেন। ফলে আদালত অবমাননার দায়ে বিপিনচন্দ্র পালকে ৬ (ছয়) মাস সাধারণ কারাদণ্ড দেয়া হয়। অরবিন্দকে রক্ষা করতে গিয়ে তিনি নিজে কারাভোগ করলেন। জেল থেতে ছাড়া পেয়ে বিপিনচন্দ্র পাল ১৯০৮ সালে ইংল্যাণ্ডে যান এবং সেখানে ‘স্বরাজ’ নামে একটি জার্নাল প্রকাশ করেন। এ সময়ে তিনি ভারতীয় রাজনীতি, ধর্ম ও দর্শন সম্বন্ধে বহু বক্তৃতা প্রদান করেন। কিন্তু ১৯১১ সালে বোম্বাই পদার্পণ করা মাত্র তাঁকে রাজদ্রোহের অপরাধে আবার জেলে নিক্ষেপ করা হয়”।
১৯১২ সালে বিপিনচন্দ্র পাল জেল থেকে মুক্তি পান। জেল থেকে তিনি যখন বের হয়ে এলেন তখন বিপিনচন্দ্র পালকে সর্বস্তরের জনগণের পক্ষ থেকে কলকাতায় এক অভ্যর্থনা প্রদান করা হয়। অভ্যর্থনা সঙ্গীত রচনা করলেন দ্বিজেন্দ্রলাল।
১৮৮০ সালে তিনি প্রকাশ করেন সিলেটের প্রথম বাংলা সংবাদপত্র পরিদর্শন। এছাড়া তিনি ‘বেঙ্গল পাবলিক অপিনিয়ন’ (১৮৮৩), ‘নিউ ইন্ডিয়া’ (১৯০১), ‘বন্দেমাতরম’ (১৯০৬), ‘স্বরাজ’ (১৯০৮), ‘হিন্দু রিভিউ’ (১৯১২), ‘আলোচনা’ (১৯১৩), ‘ট্রিবিউন’, ‘সোনার বাংলা’ (১৩৩১ বাংলা), ‘ইনডিপেনডেন্ট’, ‘ডেমোক্রেট’, ‘ফ্রিডম ফেলোশিপ’, ‘ট্রিবুনি’, ‘জনশক্তি’ (১৯১৯) সহ অনেক পত্রিকায় সাংবাদিক ও সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করেন। যৌবনের প্রথমদিকে কথাসাহিত্যের ভেতর দিয়ে তাঁর সাহিত্য জীবনের সূচনা হয়েছিল। তাঁর সৃষ্টির মধ্যে প্রবন্ধের সংখ্যা বেশি। তাছাড়া তিনি উপন্যাস, জীবনী, আত্মজীবনী, ইতিহাস রচনা করেছেন। তাঁর ‘সত্তর বছর’ বইটি সেকালের সামাজিক-রাজনৈতিক ইতিহাসের দলিল হিসেবে স্বীকৃত।
বিপিনচন্দ্র পালের প্রথম উপন্যাস ‘শোভনা’ প্রকাশিত হয় ১৮৮৪ সালে। ‘শোভনা’ উপন্যাসে তিনি ছদ্মনাম ‘হরিদাস ভারতী’ ব্যবহার করেন। ‘শোভনা’ নারীসমাজের মধ্যে জাগরণ সৃষ্টির উদ্দেশ্য লিখিত একটি উপন্যাস।
বিপিনচন্দ্র পাল বাংলায় ১৫টি এবং ইংরেজিতে ১৭টির বেশী বই লিখেছেন। বাংলা ও ইংরেজী ভাষায় লিখিত তাঁর ২৫টিরও বেশী বই বিশ্বের প্রধান প্রধান বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে পড়ানো হয়।
সত্যিকার অর্থে বিপিনচন্দ্র পাল ছিলেন নারীমুক্তির স্বপ্নদ্রষ্টা। ছাত্রাবস্থায় তিনি ব্রাহ্মসমাজে যোগদান করেন। তরুণ বয়স থেকেই বিধবা বিবাহের পক্ষে ছিলেন। তাঁর বলিষ্ঠ অঙ্গীকার ছিলো, বিধবা-বিবাহ প্রচলন করা, বাল্য বিবাহ ও বহু বিবাহরোধ এবং নারীশিক্ষার প্রচলনে ভারতীয় সমাজে ব্যাপক জাগরণ সৃষ্টি করা। এ ধরনের নানা কুসংস্কারের বিরুদ্ধে বিপিনচন্দ্র পাল আমৃত্যু লড়েছেন। ব্রাহ্মসমাজ দ্বারা পরিচালিত হয়ে নিজে একজন বিধবাকে বিবাহ করেন। ফলে সমাজচ্যুত হয়ে নিজ বাড়ি থেকে বিতাড়িত হন। নারীর অধিকার বাস্তবায়নে ব্যক্তিজীবনে একাধিক উদাহরণ রেখে গেছেন। বিপিনচন্দ্র পাল তাঁর এক বিধবা মেয়েকে বিয়ে দিয়েছিলেন অগ্নিযুগের বিপ্লবী উল্লাস কর দত্তের সাথে। বিপিনচন্দ্র পালের উদ্যোগ ও প্রচেষ্টা শুধুমাত্র বিধবা বিবাহ প্রবর্তনের ক্ষেত্রেই সীমাবদ্ধ ছিলো না, বিভিন্ন কুসংস্কারের বিরুদ্ধে লেখালেখি ও সভা-সমিতিতে বক্তব্যের মাধ্যমে তিনি জনমত গঠন করেন। নারীশিক্ষা বিস্তারের ক্ষেত্রে তাঁর যথেষ্ট অবদান ছিল।
১৯২১ সালে অসহযোগ আন্দোলনের কর্মসূচীতে মহাত্মা গান্ধীর সাথে মতের মিল না হওয়ায় তিনি গান্ধীর মতাদর্শের বিরোধীতা করেন। গান্ধীজীর নেতৃত্বে সংগ্রামের কৌশল নিয়ে হতাশ হয়ে কংগ্রেসের নেতা দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন দাস, মতিলাল নেহরু, বিপিনচন্দ্র পাল প্রমুখ নেতৃবর্গ এক নতুন কর্মসূচি নিয়ে ‘স্বরাজ দল’ নামে এক নতুন রাজনৈতিক দল গঠন করেন। স্বরাজ দলের প্রধান কর্মসূচি ছিলো :
১. আইন সভায় প্রবেশ করে সরকারের কার্যের বিরোধিতা করা।
২. সরকারি বাজেট প্রত্যাখ্যান করা।
৩. নানাবিধ বিল ও প্রস্তাব উত্থাপন করিয়া জাতীয়তাবাদের অগ্রগতিতে সহায়তা করা।
৪. সুনির্দিষ্ট অর্থনৈতিক নীতি গ্রহণ করিয়া বিদেশী শোষণ বন্ধ করা।
বৃটিশ সরকার ভারতের শাসন সংস্কারের জন্য ১৯২৭ সালে সাইমন কমিশন গঠন করেন। এই কমিশনে কোন ভারতীয়কে গ্রহণ না করায় সাইমন কমিশন বর্জন করার দাবিতে দেশ উত্তাল হয়ে উঠে। বিপিনচন্দ্র পাল সাইমন কমিশন বর্জনের জন্য জ্বালাময়ী ভাষায় বিভিন্ন জনসভায় বক্তব্য রাখেন। শ্রীহট্টের সুনামগঞ্জে সাইমন কমিশন বয়কটের দাবীতে অনুষ্ঠিত জনসভায় তিনি সাইমন কমিশন বয়কট অন্দোলনে ঝাঁপিয়ে পড়তে আহ্বান জানান।
১৯২৮ সালে সুরমা উপত্যকা রাজনৈতিক সম্মেলন এবং সুরমা উপত্যকা যুব সম্মেলন একসঙ্গে অনুষ্ঠিত হয়। এই সম্মেলনের সভাপতি ছিলেন ডা. সুন্দরীমোহন দাস। সম্মেলনের অতিথি ছিলেন নিপিন পাল ও গদর পার্টির নেতা বাবা গুরুদিং সিং। এই সম্মেলনে বিপিনচন্দ্র পালের ভাষণ ত্রিশ দশকে শ্রীহট্টবাসীর স্বাধীনতা আন্দোলনে ঐতিহাসিক ভূমিকা রাখে। বিপিনচন্দ্র পাল সুরমা উপত্যকার প্রতিটি রাজনৈতিক সংগ্রামে নিজেকে ছায়ার মত জড়িয়ে রেখেছিলেন। চা শ্রমিক ও শিল্প-শ্রমিকদের বিভিন্ন আন্দোলনে ভারতবর্ষের জাতীয় নেতাদের মধ্যে যারা সোচ্চার হয়ে উঠেন তাঁদের মধ্য বিপিনচন্দ্র পাল অন্যতম।
ভারতবর্ষের স্বাধীনতার প্রশ্নে মোতিলাল নেহেরু, চিন্তরঞ্জন দাস, মহাত্মা গান্ধীর সাথে ভিন্নমত পোষণ করে বিপিনচন্দ্র পাল শেষ জীবনে রাজনীতি থেকে দূরে সরে আসেন। জীবনের শেষাংশে সাহিত্য সৃষ্টিতে তিনি আত্মনিয়োগ করেন। ১৯৩২ সালের ২০ মে তিনি মৃত্যুবরণ করেন।
তথ্য ও ছবিসূত্র:
১। বিপিন চন্দ্র পাল: মাহাফুজুর রহমান, প্রকাশক বাংলা একাডেমী, প্রকাশকাল: জুন ১৯৯৯ সাল।
২। চরিতাভিধান: সম্পাদনা-সামসুজ্জামান খান/সেলিনা হোসেন, প্রকাশক বাংলা একাডেমী, প্রকাশকাল: জুন ১৯৮৫ সাল।
৩। স্বাধীনতা সংগ্রামে সশস্ত্র বিপ্লবীদের ভূমিকা: সুধাংশু দাশগুপ্ত, প্রকাশকাল ১৯৯০ সাল, কলকাতা
লেখক : রফিকুল ইসলাম (শেখ রফিক)