১৯৩০ সালের ২৯ আগস্ট সকালে বাংলার ইনস্পেক্টর জেনারেল অব পুলিশ এফ জে লোম্যান জেল পুলিশের সুপারিনটেনডেন্ট অসুস্থ মি. বার্টকে দেখতে হাসপাতালে যান। অসংখ্য পুলিশ সতর্ক নিরাপত্তা বেষ্টনী তৈরী করে লোম্যানকে পাহারা দিয়ে হাসপাতালে নিয়ে যায়। এই নিরাপত্তা বেষ্টনীর মধ্যেই লোম্যানকে হত্যার উদ্দেশ্যে বিপ্লবীরা সতর্ক অবস্থায় হাসপাতালে রোগী বেশে অবস্থান করছিলেন। বিপ্লবী দলের নেতৃত্বে ছিলেন বিনয় বসু। এফ জে লোম্যান তাঁর সহকর্মী মি. বার্টকে দেখে হাসপাতালের ওয়ার্ড থেকে বের হওয়ার পরপরই বিনয় বসুর রিভলবারের গুলিতে নিহত হন এবং লোম্যানের দেহ রক্ষী আহত হন। এসময় ব্রিটিশভক্ত একজন কন্ট্রাক্টর বিনয় বসুকে জড়িয়ে ধরে রাখার চেষ্টা করেন। বিনয় বসু ততক্ষণাৎ তাঁকে একটি মাত্র ঘুষি মারেন। এক ঘুষিতে সেই কন্ট্রাক্টর যমালয়ে চলে যান। বিনয় বসু হাসপাতালের সুউচ্চ পাঁচিলের উপর উঠে সুকৌশলে পার্শ্ববর্তী বাড়ির ছাদের পানির ট্যাঙ্কের উপর লাফিয়ে পড়েন এবং মুহূর্তের মধ্যে বাড়ির ভিতর দিয়ে নিরাপদ স্থানে চলে যান। লোম্যান হত্যাকারী বিপ্লবী বিনয় বসুকে উদ্দেশ্য করে সেদিন বাংলার অপরাজেয় কথাশিল্পী শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় তাঁকে আর্শিবাদ করে বলেছিলেন, “ধন্যি ছেলে, দেখিয়ে গেছে আমরাও জবাব দিতে জানি”।
এই অপ্রত্যাশিত ঘটনার পর ঢাকায় সর্বত্র পুলিশের অমানুষিক অত্যাচার শুরু হয়। প্রকাশ্য দিবালোকে বাংলার ইন্সপেক্টর জেনারেল অব পুলিশ এফ জে লোম্যানকে হত্যা করার পর এক আততায়ীর নিরাপদে পালিয়ে যাওয়ার ঘটনা ঢাকা পুলিশের অকর্মণ্যতার পরিচায়ক। সুতারং অকর্মণ্যতার গ্লানি দূর করার জন্য আসামীর সন্ধান করতে পুলিশ হন্যে হয়ে ছোটে শহরের ওলি-গলিতে। জনসাধারণকে মারধর শুরু করে। যুবকদের ধরে থানায় আটক রেখে নির্যাতন চালায়। এসময় ঢাকাবাসী পুলিশের অন্যায় অত্যাচারে অতিষ্ট হয়ে উঠে। পুলিশের অত্যাচারের ভয়ে অনেক স্কুল-কলেজের ছাত্ররা ঢাকা ছেড়ে গ্রামে চলে যায়। লোম্যান হত্যাকারী আততায়ীকে পুলিশ ধরতে সক্ষম না হলেও তাঁর সম্পর্কে তথ্য সংগ্রহ করতে পেরেছিল। আততায়ী যুবকের নাম: বিনয় বসু। তাঁর বাবার নাম: রেবতী মোহন বসু। গ্রাম: রাউথভোগ, বিক্রমপুর। বিনয় বসু মেডিকেল কলেজের চতুর্থ বর্ষের ছাত্র। বিনয় বসুকে গ্রেফতার করার জন্য পুলিশ সারা বাংলা তন্নতন্ন করে খোঁজে। সর্বত্র বিনয় বসুর ছবিযুক্ত পোস্টার লাগিয়ে দেওয়া হয়। ধরিয়ে দেওয়ার জন্য মোটা অংকের টাকা, দশ সহস্র মুদ্রা ঘোষণা করা হয়। কিন্তু কোথাও বিনয় বসুকে পাওয়া গেল না। কেউ ধরিয়েও দিল না।
আর অন্যদিকে বিনয় বসু ও দলীয় সদস্য সুপতি রায় মুসলিম শ্রমিক বেশে দোলাইগঞ্জ রেলওয়ে স্টেশন থেকে ট্রেনে চড়ে চাষাড় যান। চাষাড় রেলওয়ে স্টেশনে ট্রেন থামা মাত্র তাঁরা দেখতে পেলেন, পুলিশ প্রতিটি কামরায় উঠে আততায়ীকে ধরার জন্য চিরুনী অভিযান চালাচ্ছে। বিনয় বসু ও সুপতি রায় খুব সতর্কভাবে পুলিশের চোখ ফাঁকি দিয়ে ট্রেন থেকে নেমে যান। তাঁরা দুজন স্থানীয় বিপ্লবী গিরিজা সেনের বাড়িতে আত্মগোপন করেন। পরদিন ভোরে তাঁরা খেয়া পার হয়ে বন্দরে যান (নারায়নগঞ্জ শহরের বিপরীত পাড়)। সেখান থেকে বৈদ্যনাথবাজার। তারপর মেঘনা পাড়ি দেওয়ার পালা। মেঘনা পাড়ি দেওয়ার জন্য মুসলমান শ্রমিকের বেশ পরিত্যাগ করে সুপতি রায় জমিদার এবং বিনয় বসু জমিদার ভৃত্যের ছদ্মবেশ ধারণ করেন । বিনয় বসু জমিদারের (সুপতি রায়) সফরের জন্য একখানা নৌকা জোগাড় করেন। শুরু হয় মেঘনা পাড়ি। কিন্তু পথিমধ্যে আরেক বিপদ এসে উপস্থিত। এ বিপদের নাম কালবৈশাখী ঝড়। অনেক কষ্টে তাঁরা ওই পারে গিয়ে স্টীমারে উঠতে সক্ষম হন। স্টীমারে উঠে পুনরায় মুসলমান শ্রমিকের বেশ ধরেন। তারপর স্টীমারে চড়ে ভৈরবে এসে স্টেশনে যান এবং ট্রেনে চড়ে কালকাতার উদ্দেশ্যে রওয়ানা হন। কিশোরগঞ্জ স্টেশনে এসে তাঁরা দেখতে পান, পুলিশ আততায়ীকে ধরার জন্য ট্রেনে উঠে গাড়ীর কামরাগুলো একে একে তল্লাশী চালাচ্ছে। এসময় তাঁরা কিছুটা ভীত হয়ে পড়েন। দুজনই কিংকর্তব্যবিমূঢ়। হঠাৎ জানালার পাশে টি.টিকে দেখতে পান। দুজনে তড়িঘড়ি করে গাড়ি থেকে নেমে টি.টির পা জড়িয়ে ধরে বলেন, “কর্তা এইবার একটা আকাম কইরা ফালাইছি। এইবারের মতো আমগো মাফ কইরা দ্যান। আমরা পোলাপান মানুষ, তাড়াতাড়ি গাড়িতে উঠতা গিয়া টিকিট কইরতা পারি নাই। এহন পুলিশ ধইরা নিব”। টি.টি বললেন, “কোথাকার টিকিট চাই”? “খাইছে অহন জায়গার নামতো মনে নাই। মকবুল চাচা কি যে কইছিল, ভুইল্যা গেছি। সবুর করেন, মনে কইরা কইতাছি। হো হো কইলকাতা। কইলকাতা গিয়া আমরা কাপড়ের দোকানে কাম কইরুম। কর্তা আর দেরি কইরেন না, কর্তা। আপনার চরণ ধরি। লই যান টিকেট ঘরে। আমরাও আপনার লগে যাইতাছি।” দুজনই টি.টির সাথে টিকেট ঘরের দিকে চলে যান। ইতিমধ্যে ট্রেনের সকল কামরা তল্লাশী করা শেষ হয়েছে। উভয়ে গিয়ে ট্রেনের কামরায় উঠলেন। ট্র্রেন চলে গেল ময়মনসিংহ স্টেশনে।
ময়মনসিংহ স্টেশনে আবার এক মহাবিপদে পড়লেন তাঁরা। ট্র্রেন থামার সাথে সাথে এক দারোগা তাঁদের বগিতে উঠে তাঁর সহযোগী পুলিশ কনস্টেবলদের বলছেন, “চারদিক সতর্ক দৃষ্টি রাখবি তোরা। দেখিস বিনয় বোসটা যেন কোনো ফাঁকে পালিয়ে না যায়। ও ব্যাটা ভয়ানক ধূর্ত, এই গাড়িতে হয়তো কোথাও লুকিয়ে আছে”। সঙ্গী পুলিশরা দারোগা সাহেবের প্রতিটি কথা সমর্থন করলেন। বিনয় বসু ও সুপতি রায় ততক্ষণাৎ পুলিশকে ফাঁকি দেয়ার পরামর্শ সেরে নিয়ে বিনয় বসু ছেঁড়া কাপড় মুড়ি দিয়ে শুয়ে রইলেন আর সুপতি রায় দু-হাত জোড় করে দারোগার দিকে দাঁড়িয়ে রইলেন। মুখে-চোখে তাঁর এমনি ভাব যেন দারোগা দেখে বুঝতে পারেন তিনি অত্যন্ত ভয়ের সাথে দাঁড়িয়ে আছেন। দারোগা তাঁর দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞাস করলেন, “কিরে ব্যাটা! অমন হা করে এখানে দাঁড়িয়ে আছিস কেন”? ছদ্মবেশী সুপতি রায় অত্যন্ত বিনয়ের সাথে উত্তর দিলেন, “আপনাগো অনুমতি না পাইলে তো বইতে পারি না হুজুর! আর কি কইতাছেন আপনে, বিনয় বোস আবার ক্যাডা? তারে ধরবার লাইগা বলছেন- পাইলে ধইরা দিমু আমরা”। দারোগা উত্তরে বললেন, “আচ্ছা বেশ ভাল কথা। বিনয়কে যদি ধরতে পারিস দশ হাজার টাকা বকশিশ পাবি বুঝলি”।
দারোগার উদ্দেশ্যে সুপতি রায় বললেন, “বড় বিপদে পড়েছি হুজুর! ভাতিজাডারে লইয়া চলছিলাম ট্রেনে তার হয়ে গেছে তাপ। কাইল থাইক্যা গায়ে দুই একডা ফুসকিরিও উঠতাছে বড় ভাবনায় পড়ছি সাব”। “ফুসকিরি কিসের ফুসকিরি রে ব্যাটা?” কথাগুলো বলে দারোগা উঠে দাঁড়ালেন। ততক্ষণে দারোগার মুখ বিবর্ণ হয়ে পড়েছে, বিনয় বসুকে ধরার উৎসাহ অনেকটা কমে এসেছে। সুপতি রায় কামরার একপাশে শায়িত ভাতিজাটিকে দেখিয়ে বললেন, “আমার চাচাতো ভাই নূর মিয়ার পোলা প্রলাপ বকছে হুজুর! কাঁপতেছে এক্কেবারে বেহুঁশ এই দেহুন”। এই কথা বলে রোগীর দেহে জড়ানো কাপড়ে হাত দিতেই দারোগা এক লাফে দুই/তিন হাত দূরে সরে গেলেন এবং মুখ ভ্যাংচাইয়া বললেন, “আর দেখবার কাজ কি রে ব্যাটা? বসন্ত রোগী নিয়ে ট্রেনে চড়েছ আবার বলছো দেখুন!” বসন্তরোগভীত দারোগা পরবর্তী স্টেশনে সদলবলে নেমে গেলেন।
দারোগা চলে যাওয়ার পর তাঁরা নিরাপদে জগন্নাথগঞ্জ ঘাটে পৌঁছালেন। জগন্নাথগঞ্জ ঘাট হতে সিরাজগঞ্জ আর সেখান থেকে সোজা কলকাতা। ট্রেন শিয়ালদহ স্টেশনে পৌঁছানোর পূর্বে তাঁরা দমদম স্টেশনে নেমে ওয়ালীউল্লাহ লেনে অবস্থিত বিপ্লবী সুরেশ মজুমদারের বাড়িতে গিয়ে উঠেন। সুরেশ বাবুর বাড়ি ছিল বিপ্লবীদের অন্যতম আশ্রয়স্থল। ঢাকা থেকে বহু বিপদ-আপদের পথ পাড়ি দিয়ে বিনয় বসু কলকাতা পৌঁছলেও নেতৃবৃন্দ নিশ্চিন্ত বোধ করেননি। বরং তাঁরা বিনয়কে সর্বোচ্চ নিরাপদ স্থানে রাখার জন্য ‘কাতারামগড়’ কালিয়ারীতে পাঠানোর ব্যবস্থা করলেন। অন্যদিকে কলকাতা পুলিশ গোপন সূত্রে জানতে পেরেছিল, বিনয় কলকাতায় পালিয়ে রয়েছে এবং এখান থেকে খুব শীঘ্রই নিরাপদ আশ্রয়ে চলে যাবেন। ফলে সবগুলো রেলস্টেশনে তাঁকে ধরার জন্য বিশেষ সতর্ক দৃষ্টি রাখা হয়েছে।
ব্যান্ডেল স্টেশনে সশস্ত্র পুলিশ বাহিনী বন্দুক হাতে প্রস্তুত। দুই-তিন মিনিটের মধ্যেই কলকাতাগামী ট্রেন এসে পৌঁছাবে। তাঁদের উর্ধ্বতন কর্মকর্তা সবগুলো কামরা বিশেষভাবে তল্লাশী করার নির্দেশ প্রদান করেছেন। কারণ এই গাড়ীতেই বিনয় বসুর থাকার সম্ভাবনা রয়েছে। ট্রেন এসেছে এমন সময় জেলা ম্যাজিস্ট্রেটের মোটরগাড়ি দেখে পুলিশ বিস্মিত হল। তারা দেখল মোটরগাড়ি হতে নামলেন জেলা ম্যাজিস্ট্রেটের কনফিডেন্টসিয়াল ক্লার্ক সরোজ রায় এবং তাঁর সঙ্গে দুজন আত্মীয়। আত্মীয় দুজনকে ট্রেনের কামরায় তুলে দিয়ে তিনি হাসি মুখে পুলিশকে বললেন, “চারদিকে নজর রেখো। বিনয় বসু এই গাড়ীতে আসার কথা। বেটা ভারী ধূর্ত। কোনো ছদ্মবেশ ধারন করে হয়ত পালিয়ে যাবে। খুব সাবধান। মনে রেখ এবারের পুরস্কার দশ হাজার টাকা”। তারপর সরোজ বাবু গাড়িতে উঠে চলে যান। সরোজ বাবুর আত্মীয় দুজনের একজন ছিলেন বিনয় বসু। সরোজ বাবুই বিনয় বসুর পালাবার ব্যবস্থা করেন।
বিনয় বসু কাতারামগড় কালিয়ারীতে দলীয় বন্ধু অনাথ দাশগুপ্তের বাড়ী চলে গেলেন। এই বাড়ি ছিলো বিপ্লবীদের আর একটি গোপন আস্তানা। সেখান থেকে তিনি কিছুদিন পর কলকাতায় আসেন। নেতারা চিন্তিত হয়ে পড়েন তাঁর নিরাপত্তার জন্য। বিপ্লবীরা দেশবরণ্যে নেতৃবৃন্দের কাছে তাঁর ব্যাপারে পরামর্শ চান। আচার্য প্রফুল্লচন্দ্র, লেডী অবলা বসু, শরৎ বসু, সুভাষ বসু, শরৎ চাটার্জিসহ প্রায় সকল নেতাই আত্মরক্ষার জন্য বিনয় বসুকে বিদেশে পাঠিয়ে দেয়ার উপদেশ দেন।
তাঁকে বিদেশ পাঠানোর জন্য কিংস-বর্জ ডকের জনৈক পদস্থ কর্মচারীকেও ঠিক করা হল। পরদিন তাঁকে সমুদ্রগামী একখানা জাহাজে তুলে দেওয়া হবে। যাতে করে তিনি সোজা ইটালীতে যেতে পারেন। কিন্তু সকল পরামর্শ ও প্রস্তুতির অবসান ঘটালেন তিনি। কিছুতেই মাতৃভূমি ছেড়ে যেতে রাজি হলেন না বিনয় বসু। বরং পরবর্তী অভিযানে অংশ গ্রহণের জন্য সিনিয়র বিপ্লবীদের কাছে দৃঢ় সংকল্প ব্যক্ত করেন।
বিপ্লবীদের পরবর্তী অভিযান ছিল কলকাতার ‘রাইটার্স বিল্ডিং’ আক্রমণ। অসংখ্য পুলিশ প্রহরী পরিবেষ্টিত দুর্ভেদ্য অফিস ‘রাইটার্স বিল্ডিং’। এই ভবন আক্রমণ করে সেখান হতে ফেরার আশা কেউ করতে পারে না। বিপ্লবী নেতৃবৃন্দের মধ্যে আলোচনা চলল কে এই আক্রমণ পরিচালনা করবেন? এই দুঃসাহসী অভিযান পরিচালনার দায়িত্ব নিলেন বিনয় বসু। তাঁর সঙ্গী হলেন আরো দুজন নির্ভীক যুবক। দীনেশ গুপ্ত ও বাদল গুপ্ত। কিশোর বয়স থেকেই বিনয় বসু, দীনেশ গুপ্ত ও বাদল গুপ্ত পরস্পর পরিচিত ছিলেন। তিনজনই ছিলেন পূর্ববাংলার (ঢাকার) সন্তান। কৈশোরকাল থেকে তিনজন দেশপ্রেমের মন্ত্রে উদ্বুদ্ধ হয়ে দেশমাতার মুক্তিযজ্ঞে নিজেদেরকে নিয়োজিত করেন। ঘটনাচক্রে এই তিন বন্ধুই একসঙ্গে রাইটার্স বিল্ডিং আক্রমণের দায়িত্ব নেন।
বিপ্লবী নেতারা অনেক ভেবেচিন্তে তাঁদেরকে ‘রাইটার্স বিল্ডিং’ আক্রমণ করার অনুমতি দেন। বিপ্লবী নেতারা স্থির করলেন ভারত সরকারের সরকারী অফিসের সর্বাপেক্ষা শক্তিশালী কেন্দ্রস্থল ‘রাইটার্স বিল্ডিং’ আক্রমণ করে দেখাতে হবে যে বিপ্লবীরা সক্রিয় রয়েছেন। তাঁদের একজনকে জেলে বন্দী করলে দশজন অগ্রসর হয়।
ওই বছর ইংরেজ শাসকগোষ্ঠীর অত্যাচার-নির্যাতন আরো শতগুণে বেড়ে যায়। শত শত রাজনৈতিক নেতা-কর্মী ও বিপ্লবীদের গ্রেফতার করে জেলে আটক রেখে নির্যাতন চালায় তারা। এই সময় ব্রিটিশ পুলিশ সুভাষচন্দ্র বসু, যতীন্দ্রমোহন সেনগুপ্ত এবং সত্য বকসীর মতো নেতৃত্বকেও গ্রেফতার করে আলিপুর সেন্ট্রাল জেলে আটক রাখে। একের পর এক নেতা-কর্মীকে গ্রেপ্তার করে আলিপুর সেন্ট্রাল জেল ভরিয়ে ফেলা হচ্ছিল। এই সব বন্দীদের মধ্যে ছিলেন অসংখ্য সশস্ত্র বিপ্লবী দলের সদস্য এবং অহিংস আন্দোলনের স্বেচ্ছাসেবকরা। একপর্যায়ে আলিপুর সেন্ট্রাল জেলের নির্দিষ্ট ওয়ার্ডে নতুন বন্দীদের জায়গা দেওয়া যাচ্ছিলনা ।
জেলের মধ্যে সৃষ্টি হলো এক অসহনীয় অবস্থা। রাজবন্দীদের মধ্যে বিক্ষোভ দানা বেঁধে উঠেছিল। তাঁরা জেলকোড অনুযায়ী কয়েকটি দাবিতে আন্দোলন শুরু করেন। এই আন্দোলন দমানোর জন্য ব্রিটিশ পুলিশ বেদমভাবে লাঠিচার্জ চালায়। রাজবন্দীরের উপর চলল নির্মম-নিষ্ঠুর অত্যাচার। সুভাসচন্দ্র, যতীন্দ্রমোহন এবং সত্য বকসীরাও বাদ গেলেন না নির্মম-নিষ্ঠুর অত্যাচার থেকে। এঘটনার খবর ছড়িয়ে পড়ল জেলের ভিতরে। জানা গেল এই নির্মম- নিষ্ঠুর অত্যাচারের পিছনে রয়েছে ইন্সপেক্টর জেনারেল কর্নেল এনএস সিম্পসন সাহেব।
বিপ্লবীদের টার্গেট ছিল কারা বিভাগের ইন্সপেক্টর জেনরেল লে. কর্নেল সিম্পসন। যিনি বসতেন ‘রাইটার্স বিল্ডিং’-এ। জেলখানার বন্দীদের উপর পাশবিক নির্যাতনের জন্য কুখ্যাত ছিল সিম্পসন। তাই সিম্পসনের নাম হত্যাতালিকার শীর্ষে ছিল। সিম্পসনের পরে ছিল সেক্রেটারী মি. আলবিয়ানের নাম। আলবিয়ানের পর ছিল ইন্সপেক্টর জেনারেল অফ পুলিশ মি. ক্রেগ ও জুডিসিয়াল সেক্রেটারী মি. নেলসনের নাম। এরা সবাই ছিল নির্যাতনের জন্য কুখ্যাত পুলিশ অফিসার। স্বাধীনতাকামী বিপ্লবীদের উপর এরা নানামাত্রিক অত্যাচার-নির্যাতন চালাতেন।
১৯৩০ সালের ৮ ডিসেম্বর ‘রাইটার্স বিল্ডিং’ আক্রমণ করার সিদ্ধান্ত নেয়া হল। আক্রমণের জন্য সকল প্রস্তুতি গ্রহণ করা হল। খুব সতর্ক অবস্থায় তাঁদের প্রশিক্ষণের কাজও সমাপ্ত হল। বিনয় বসু, বাদল গুপ্ত ও দিনেশ গুপ্ত বিপ্লবী নেতৃবৃন্দের সাথে আলোচনা করে বিদায় নিলেন। ৮ ডিসেম্বর এ্যাকশনের জন্য তিন বিপ্লবী প্রস্তুত। ‘রাইটার্স বিল্ডিং’ এর একটি কক্ষে কারা বিভাগের সর্বময় কর্তা ইন্সপেক্টর জেনারেল কর্নেল সিম্পসন তাঁর কাজকর্ম পরিচালনা করছেন। তাঁর ব্যক্তিগত সহকারী জ্ঞান গুহ পাশে দাঁড়িয়ে আলোচনা করছেন। বেলা ঠিক ১২টা। সামরিক পোশাক পরে তিনজন বাঙালী যুবক এসে কর্নেল সিম্পসনের সঙ্গে সাক্ষাৎ করতে আগ্রহ প্রকাশ করেন।
তাঁরা সিম্পসনের চাপরাশীকে (সহকারী) ঠেলে কামরার ভিতরে প্রবেশ করেন। হঠাৎ পদধ্বনী শুনে কর্নেল তাঁদের দিকে তাকান। বিস্ময়-বিমূঢ় চিত্তে দেখতে পান সম্মুখে মিলিটারী পোশাক পরে তিনজন বাঙালী যুবক রিভলবার হাতে দণ্ডায়মান। মুহূর্তের মধ্যে বিনয়ের কণ্ঠে ধ্বনিত হয় ‘প্রে টু গড কর্নেল। ইওর লাষ্ট আওয়ার ইজ কামিং।’ কথাগুলি উচ্চারণের সঙ্গে সঙ্গে তিনটি রিভলবার হতে ছয়টি গুলি সিম্পসনের দেহ ভেদ করে। সিম্পসন লুটিয়ে পড়ে মেঝের উপর। এরপরই গুলির আঘাতে আহত হন জুডিসিয়েল সেক্রেটারী মি. নেলসন। এলোপাথাড়ি গুলি বর্ষণ করতে করতে আততায়ীরা পরবর্তী লক্ষ্য হোম সেক্রেটারী আলবিয়ান মারের কক্ষের দিকে অগ্রসর হন। ততক্ষণে এই আক্রমণ প্রতিরোধের জন্য ছুটে আসেন পুলিশ-ইন্সপেক্টর জেনারেল মি. ক্র্যাগ ও সহকারী ইন্সপেক্টর জেনারেল মি. জোনস। তাঁরা কয়েক রাউণ্ড গুলিও ছোঁড়েন। কিন্তু বিনয়-বাদল-দীনেশের বেপরোয়া গুলির মুখে তাঁরা দাঁড়াতে পারলেন না। প্রাণ নিয়ে পালালেন। সমস্ত ‘রাইটার্স বিল্ডিং’ জুড়ে তখন এক বিভীষিকাময় রাজত্ব। চারিদিকে শুধু ছুটাছুটি। কে কোন দিকে পালাবে খুঁজে পায় না। কলরব- কোলাহল- চিৎকার। শুধু এক রব ‘বাঁচতে চাও তো পালাও’। ‘রাইটার্স বিল্ডিং’ আক্রমণের সংবাদ পেয়ে পুলিশ কমিশনার টেগার্ট আসেন। ডেপুটি কমিশনার গার্ডন আসেন সশস্ত্র বাহিনী নিয়ে। জুডিসিয়েল সেক্রেটারী মি. নেলসন, মি. টয়নয় প্রমুখ অনেক ইংরেজ রাজপুরুষ আহত হলেন। আক্রমণ প্রতিহত করার জন্য ডেকে আনা হল গুর্খা বাহিনীকেও।
একদিকে তিনজন বাঙালী তরুণ, হাতে শুধু তিনটি রিভলবার। আর অপরদিকে রাইফেলধারী সুশিক্ষিত গুর্খাবাহিনী। আরম্ভ হল ‘অলিন্দ যুদ্ধ’। ইংরেজ মুখপত্র ‘স্টেটসম্যান’ পত্রিকার ভাষায় ‘বারান্দা বেটল’। দীনেশের পিঠে একটি গুলি বিদ্ধ হল। তিনি তাতে ভ্রুক্ষেপও করলেন না। অসংকোচে গুলিবর্ষণ করতে লাগলেন শত্রুকে লক্ষ্য করে। যতক্ষণ পর্যন্ত বিনয়-বাদল-দিনেশের হাতে গুলি ছিল, ততক্ষণ কেউ তাঁদের আক্রমণ করে প্রতিহত করতে পারেননি। একপর্যায়ে তাঁদের গুলি নিঃশেষ হল। গুর্খা ফৌজ অনবরত গুলিবর্ষণ করে চলল। তখন তিনজন বিপ্লবী একটি শূন্য কক্ষে প্রবেশ করে সঙ্গে আনা ‘সায়নাইড’-বিষের পুরিয়াগুলি মুখে দিলেন। বিষ-ক্রিয়ায় অতি-দ্রুত জীবনপ্রদীপ নিবে না যাওয়ার আশংকায় এবং মৃত্যুকে নিশ্চিত করার জন্য প্রত্যেকেই নিজ নিজ ললাট লক্ষ্য করে রিভলবারে রাখা শেষ গুলিটি ছুঁড়ে দিলেন। বাদল তৎক্ষণাৎ মৃত্যুবরণ করেন। বিনয় ও দীনেশ সাংঘাতিক আঘাতপ্রাপ্ত হয়ে মেঝের উপর পড়ে রইলেন।
ভীষণভাবে আহত বিনয় ও দীনেশকে একটু সুস্থ করে ইংরেজ বাহিনী তাঁদের উপর চালাল প্রচণ্ড অত্যাচার। এরপর উভয়কেই পুলিশ মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে পাঠিয়ে দেয়। পুলিশ কমিশনার টেগার্ট এতদিন পরে বিনয়ের উপর আক্রোশ মিটানোর সুযোগ পেলেন। অচেতন বিনয়ের হাতের আঙ্গুলের উপর বুট দিয়ে সবগুলি অঙ্গুল ভেঙ্গে ফেলে বীরত্ব প্রদর্শন করলেন।
বিনয় ছিলেন মেডিকেল স্কুলের চতুর্থ বর্ষের ছাত্র। তিনি জানতেন মৃত্যুর পথ। হাসপাতালে থাকা অবস্থায় তিনি ১৪ ডিসেম্বর রাতে আকাঙ্খিত মৃত্যুকে বরণ করার জন্য মস্তিষ্কের ‘ব্যাণ্ডেজে’র ভিতর অঙ্গুল ঢুকিয়ে স্বীয় মস্তিষ্ক বের করে আনেন এবং মৃত্যুকে বরণ করে নেন। অন্যদিকে ডাক্তার ও নার্সদের আপ্রাণ চেষ্টায় দীনেশ ক্রমশ সুস্থ হয়ে উঠেন। সুস্থ হওয়ার পর তাঁকে হাসপাতাল থেকে কনডেমড সেলে নেয়া হয়। তারপর দীনেশের বিচারের জন্য আলীপুরের সেসন জজ মি. গ্রালিকের সভাপতিত্বে ব্রিটিশ সরকার এক ট্রাইবুনাল গঠন করে ফাঁসির আদেশ দেয়। ১৯৩১ সালের ৭ জুলাই দীনেশের ফাঁসি কার্যকর করা হয়।
বিনয় বসু জন্মেছিলেন ১৯০৮ সালের ১১ সেপ্টেম্বর। মুন্সিগঞ্জ জেলার রোহিতভোগ গ্রামে। তাঁর বাবার নাম রেবতীমোহন বসু। তিনি ছিলেন একজন প্রকৌশলী। বিনয়ের বাবা পরিবার নিয়ে ঢাকাতে বসবাস করতেন। তাই বিনয় বসু ছোটবেলা থেকে ঢাকায় বড় হয়েছেন। ঢাকা থেকে ম্যাট্রিক পাস করার পর তিনি মিটফোর্ড মেডিকেল স্কুল (বর্তমানের স্যার সলিমুল্লাহ মেডিকেল কলেজ) এ ভর্তি হন। এই মেডিকেল কলেজে পড়াশুনার সময় বিনয় বসু বিপ্লববাদী রাজনীতিতে যুক্ত হন। ব্রিটিশবিরোধী অগ্নিবিপ্লবী হেমচন্দ্র ঘোষের সংস্পর্শে এসে বিপ্লববাদী যুগান্তর দলে যুক্ত হন তিনি।
শৈশব থেকে বিনয় বসু ছিলেন প্রচন্ড জেদী ও সাহসী। বিপ্লববাদী দলে যুক্ত হওয়ার পর তিনি তাঁর অসীম সাহস ও দূরদর্শিতা দিয়ে ব্রিটিশ শাসকদের উচিৎ শিক্ষা দেওয়ার শপথ নেন। বিপ্লবী কর্মকান্ডে যুক্ত থাকার জন্য তিনি তাঁর ডাক্তারী লেখাপড়া শেষ করতে পারেননি। তিনি বিপ্লবী দলে যুক্ত হওয়ার পর সহপাঠীদের অনেককেই বিপ্লবী দলে যুক্ত করেন। ১৯২৮ সালে তিনি ও তাঁর সহপাঠী সহযোদ্ধারা নেতাজী সুভাষ চন্দ্র বসুর ‘বেঙ্গল ভলান্টিয়ার্সে’ যুক্ত হন। এই বিপ্লবী দলে যুক্ত হওয়ার অল্পদিনের মধ্যেই বিনয় বসু এই দলের ঢাকা শাখা গড়ে তোলেন। এসময় সারা ভারত জুড়ে চলতে থাকে বিপ্লবীদের উপর পুলিশের জুলুম-নির্যাতন। তাঁরা এই নির্যাতনের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ান।
ভারত স্বাধীন হওয়ার পরে বিনয়-বাদল-দীনেশের নামানুসারে কলকাতার ডালহৌসি স্কয়ারের নাম পাল্টে রাখা হয় বি-বা-দী বাগ। অর্থাৎ বিনয়-বাদল- দীনেশ বাগ।
তথ্য ও ছবিসূত্র:
১। অগ্নিযুগের ইতিহাস: ব্রজেন্দ্রনাথ অর্জুন। প্রকাশক: মুক্তধারা। প্রকাশকাল; ডিসেম্বর ১৯৭৯।
২। বাংলার বিপ্লব প্রচেষ্টা: হেমচন্দ্র কানুনগো। চিরায়ত প্রকাশনী, কলকাতা। প্রকাশকাল: জুন, ১৯২৮।
৩। স্বাধীনতা সংগ্রামে সশস্ত্র বিপ্লবীদের ভূমিকা: সুধাংশু দাশগুপ্ত, ন্যাশনাল বুকস এজেন্সি কলকাতা।
৪। ফাঁসির মঞ্চে গেয়ে গেল যারা: চিন্ময় চৌধুরী। দে’জ পাবলিকেশন, কলকাতা। প্রকাশকাল: জানুয়ারী ১৯৯৮।
৫। বিদ্রোহী ভারত: নীহাররঞ্জন গুপ্ত। মিত্র ও ঘোষ পাবলিশার্স প্রা: লি:- কলকাতা, প্রকাশকাল: অগ্রহায়ণ-১৩৯১।
৬। হেমেন্দ্রনাথ দাসগুপ্ত, ভারতের বিপ্লব কাহিনী, ২য় ও ৩য় খন্ড, কলকাতা, ১৯৪৮।
লেখক: রফিকুল ইসলাম (শেখ রফিক)