জন্ম থেকে মৃত্যু। এই চলার পথটির নামই জীবন। কিন্তু সব জীবন অর্থবহ হয় না। সবার জীবন নিয়ে জীবনী হয় না, তাই ইতিহাস তাঁদের ধরেও রাখে না। ইতিহাস ধরে রাখে শুধু তাঁদেরই, যাঁরা হয়ে ওঠেন বিশিষ্ট ও অনন্য-অসাধারণ জীবনের অধিকারী। যে জীবনকে সবাই শ্রদ্ধা করে। আবার অনেকে অনুকরণ-অনুসরণ করার চেষ্টা করে। এমন জীবন শুধু জন্মসূত্রে পাওয়া যায়না, এটা অর্জন করতে হয় কঠোর শ্রম, গভীর নিষ্ঠা ও আত্মত্যাগ দিয়ে। এর জন্য তৈরী কোনো পথ নেই, পথ তৈরী করে করে এগোতে হয়। সেক্ষেত্রে প্রেরণা হয়ে পথ দেখায় এক মহৎ জীবনবোধ, আদর্শবোধ ও দেশপ্রেম। দেশমাতৃকাকে স্বাধীন করার মহান আদর্শে দীক্ষিত এমনি কিছু মুক্তি-পাগল মানুষ ‘জীবন-মৃত্যুকে পায়ের ভৃত্য’ করে সেদিন এগিয়ে এসেছিলেন ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামের কাফেলায়। অনেকের সঙ্গে সংগ্রামের এই কাফেলায় সামিল হয়েছিলেন বিপ্লবী বাদল গুপ্তও।
অগ্নিযুগের সশস্ত্র বিপ্লবী আন্দোলনের সূচনা থেকেই ঢাকার অনুশীলন সমিতি, যুগান্তর পার্টি, চট্টগ্রামের দি ইন্ডিয়ান রিপাবলিকান আর্মি, বেঙ্গল ভলান্টিয়ার্স, কলকাতার অনুশীলন সমিতি, মেদিনীপুর বিপ্লবী দল, বিপ্লবী কমিউনিস্ট সংগঠন, মামলার বিপ্লবী দল ও স্বরাজ পার্টিসহ অন্যান্য বিপ্লবী দল স্বাধীনতা সংগ্রামে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব পালন করে। এসমস্ত দলের অসংখ্য বিপ্লবী সদস্যরা ভারতমাতার স্বাধীনতার জন্য নিজের জীবন উৎসর্গ করেন। বাদল গুপ্তও এই জীবন উৎসর্গকারী বিপ্লবীদের একজন।
বাদল গুপ্ত একজন বাঙ্গালি বিপ্লবী। তাঁর আসল নাম সুধীর গুপ্ত। ডাক নাম ছিল বাদল। বাদল গুপ্ত জন্মেছিলেন ১৯১২ সালে। ঢাকার বিক্রমপুর এলাকার পূর্ব শিমুলিয়া গ্রামে। যা বর্তমানে বাংলাদেশের মুন্সীগঞ্জ জেলার অন্তর্গত। তাঁর বাবার নাম অবনী গুপ্ত। তাঁর পিতৃব্য নরেন্দ্র গুপ্ত ও ধরণী গুপ্ত মুরারীপুকুর বোমা মামলায় দণ্ডিত হয়েছিলেন। পারিবারিকভাবেই বাদল গুপ্ত বিপ্লবী রাজনৈতিক পরিবেশে বড় হয়ে উঠেন। যা তাঁর পরবর্তী বিপ্লবী জীবনকে প্রভাবিত করে।
বাদল গুপ্তের পড়াশুনার হাতেখড়ি পরিবারে বাবা-মার কাছে। তারপর প্রাথমিক পড়াশুনা শেষ হলে তাঁকে ভর্তি করানো হয় বানারিপাড়া স্কুলে। ছোটবেলা থেকেই বাদল গুপ্ত ছিলেন অসীম সাহসী ও দুরন্ত স্বভাবের। পড়াশুনার পাশাপাশি খেলাধুলার প্রতিও তাঁর বেশ মনোযোগ ছিল। স্কুলে পড়াশুনার সময় থেকেই বাদল গুপ্ত স্বদেশপ্রেম ও রাজনীতির নানা বিষয় পড়াশুনার মাধ্যমে সচেতন হয়ে উঠেন। কারণ ওই সময় সারা ভারতে ব্রিটিশবিরোধী ও ভারতমাতার স্বাধীনতা আন্দোলন ছড়িয়ে পড়ে। যা ভারত উপমহাদেশের প্রতিটি সচেতন পরিবারের সদস্যরা জানতেন। সন্ধ্যার পর ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলন নিয়ে পাড়া-মহল্লায় আলোচনা হতো। এই আলোচনায় অনেক সময় ক্ষুদিরাম, প্রফুল্ল চাকী, বাঘা যতীনসহ আরো অনেক বিপ্লবীর বিপ্লবী জীবনের কথা উঠে আসতো। তখন এসব পরিবারের কিশোর- তরুণরা খুব মনোযোগ দিয়ে সেসব কিংবদন্তী বিপ্লবীদের জীবন কাহিনী শুনতেন। কিশোর-তরুণরা আবার মাঝে মাঝে বিপ্লবীদের নিয়ে লেখা বিভিন্ন বই-পুস্তক সংগ্রহ করে বেশ আগ্রহ সহকারে পড়তেন। বাদল গুপ্তও ছিলেন সেইসব তরুণদের মধ্যে একজন।
বাদল গুপ্ত বানারিপাড়া স্কুলে পড়াশুনার সময় সেখানকার শিক্ষক নিকুঞ্জ সেনের সংস্পর্শে আসেন। তাঁর সান্নিধ্যেই মূলত স্বদেশী রাজনীতিতে হাতেখড়ি হয় বাদল গুপ্তের। বানারিপাড়া স্কুলের শিক্ষক নিকুঞ্জ সেন ছিলেন বিপ্লববাদী দলের সদস্য। এই শিক্ষকের মাধ্যমে খুব সম্ভবত নবম-দশম শ্রেণীতে পড়ার সময় তিনি বেঙ্গল ভলেন্টিয়ার্স (বিভি) নামে একটি গুপ্ত বিপ্লবী সংগঠনের সাথে সক্রিয়ভাবে যুক্ত হন (বেঙ্গল ভলান্টিয়ার্সের ঢাকা শাখা)। তাঁর আন্তরিক নিষ্ঠা ও কার্যক্রমের মধ্য দিয়ে অল্পদিনেই বিপ্লববাদী দলের একজন সংগঠক হয়ে উঠেন তিনি ।
১৯২৮ সালে সারা ভারতের বিপ্লবীদের উপর ইংরেজ শাসকগোষ্ঠী নির্মম- নিষ্ঠুরভাবে অত্যাচার-নির্যাতন চালাতে শুরু করে। এ অত্যাচার পূর্বের সকল অত্যাচারকে ছাড়িয়ে যায়। এসময় ব্রিটিশ প্রশাসন তাঁদের সাম্রাজ্য রক্ষার জন্য মরিয়া হয়ে উঠে। একের পর এক বিপ্লবীকে ধরে নিয়ে বিনা বিচারে জেলখানায় আটক রাখে। তারপর বন্দীদের উপর পাশবিক নির্যাতন চালায়। এই নির্যাতনের কারণে ওই সময় অনেক বিপ্লবী মানসিকভাবে ভারসাম্যহীন হয়ে পড়ে। তাঁরা জীবনে আর কোনোদিন পুরোপুরি সুস্থ্ হয়ে উঠেননি। বড়লাটকে উদ্দেশ্য করে ক্ষুদিরামের বোমা হামলার পর ব্রিটিশ সরকার বিপ্লবীদের দৃঢ়ভাবে দমন করার সিদ্ধান্ত নেয়। যাঁরা সশস্ত্র বিদ্রোহের মাধ্যমে ব্রিটিশ- শাসনকে উচ্ছেদ করতে চাইবে, তাঁদেরকে নিশ্চিহ্ন করার পরিকল্পনা করে এবং যাঁদেরকে প্রমাণের অভাবে ফাঁসিকাষ্ঠে ঝুলিয়ে হত্যা করা যাবে না, তাঁদেরকে আন্দামানে পাঠানোর সিদ্ধান্ত নেয় ব্রিটিশ সরকার। বিংশ শতাব্দীর শুরু থেকে চল্লিশের দশক পর্যন্ত ব্রিটিশ সরকার ফাঁসিকাষ্ঠ থেকে রেহাই পাওয়া প্রায় সকল সশস্ত্র বিপ্লবীকে আন্দামানে পাঠায়। আর আন্দামান সেলুলার জেল ছিল সবচেয়ে ভয়ংকার জেল। যেখান থেকে কেউ ফিরে আসতো না। এক কথায় বলা যায়, এটা ছিল ব্রিটিশদের তৈরী দ্বিতীয় মৃত্যু ফাঁদ।
এসকল ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে ব্রিটিশ নরপশুদের চরম শিক্ষা দেওয়ার জন্য সুভাষ চন্দ্র বসু তখন ‘বেঙ্গল ভলান্টিয়ার্স’ কে এ্যাকশনধর্মী বিপ্লবী প্লাটফর্মে রূপান্তর করেন। উদ্দেশ্য একটাই প্রতিশোধ নেয়া এবং ভারত থেকে ব্রিটিশদের উচ্ছেদ করা। পরিকল্পনা অনুযায়ী শুরু হয় ভলান্টিয়ার্সদের আগ্নেয়াস্ত্র চালানোর প্রশিক্ষণ। এই প্রশিক্ষণ কর্মশালায় দীনেশ গুপ্ত ভলান্টিয়ার্সদের প্রশিক্ষণ দিতেন। এক পর্যায়ে সুভাষ চন্দ্র বসুর নেতৃত্বে এই ভলান্টিয়ার্স বিপ্লবীরা কুখ্যাত ব্রিটিশ পুলিশ অফিসারদেরকে হত্যা করার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন। ১৯২৯-৩০ সালের মধ্যে দীনেশ গুপ্তের প্রশিক্ষিত বিপ্লবীরা ডগলাস (Douglas), বার্জ (Burge) এবং পেডি (Paddy) কে হত্যা করে। এরা ছিল কুখ্যাত অত্যাচারী ব্রিটিশ জেলা ম্যাজিস্ট্রেট। বাংলার বিপ্লবীরা একের পর এক তাঁদের সহযোদ্ধাদের হত্যার প্রতিশোধ নিতে থাকে। ফলে ব্রিটিশ সরকার ১৯৩০ সালের দিকে আরো বেশী স্বৈরচারী হয়ে উঠে এবং স্বাধীনতাকামী বিপ্লবীদের উপর অত্যাচার, নির্যাতনের মাত্রা বহুগুণে বাড়িয়ে দেয়। এসময় ব্রিটিশ পুলিশ শত-সহস্র রাজনৈতিক নেতা-কর্মী ও বিপ্লবীদের গ্রেফতার করে একের পর এক জেলে আটক রেখে নির্যাতন চালায়। ওই সময় ব্রিটিশ পুলিশ সুভাষচন্দ্র বসু, যতীন্দ্রমোহন সেনগুপ্ত এবং সত্য বকসীর মতো নেতৃত্বকেও গ্রেফতার করে আলিপুর সেন্ট্রাল জেলে আটক রাখে। অন্যদিকে একই সময় স্বাধীনতা-সংগ্রামী নেতা-কর্মীদের গ্রেপ্তার করে আলিপুর সেন্ট্রাল জেল ভরিয়ে ফেলা হচ্ছিল। এই সমস্ত বন্দীদের মধ্যে ছিলেন অসংখ্য সশস্ত্র বিপ্লবী দলের সদস্য এবং অহিংস আন্দোলনের স্বেচ্ছাসেবকরা। এহেন বাস্তবতা ও পরিস্থিতির ফলে আলিপুর সেন্ট্রাল জেলে নতুন বন্দীদের জায়গা দেওয়া মুশকিল হয়ে পড়ে। এ সমস্যা ছিল প্রতিটি ওয়ার্ডে ওয়ার্ডে।
জেলের মধ্যে সৃষ্টি হলো এক অরাজক ও অসহনীয় অবস্থা। এই অবস্থা থেকে পরিত্রাণ পাওয়ার জন্য রাজবন্দীরা ঐক্যবদ্ধ হন। তাঁরা নানা বিষয়ে প্রতিবাদ শুরু করেন। যা এক সময় বিক্ষোভে পরিণত হয়। রাজবন্দীরা জেলকোড অনুযায়ী বেশ কয়েকটি দাবিতে জেলের মধ্যে আন্দোলন শুরু করেন। এই আন্দোলন দমানোর জন্য ব্রিটিশ পুলিশ নির্মমভাবে লাঠিচার্জের উন্মত্ততায় মেতে উঠে। বিপ্লবীরাও নিজেদের বাঁচাতে প্রতিবাদ করেন। হঠাৎ জেলের পাগলা ঘন্টি বাজানো হল। সকল পুলিশ অস্ত্রহাতে রাজবন্দীদের উপর নির্মম-নিষ্ঠুর অত্যাচার শুরু করলো। সুভাষচন্দ্র বসু, যতীন্দ্রমোহন এবং সত্য বকসীরাও বাদ গেলেন না এই অত্যাচার থেকে। এই খবর ছড়িয়ে পড়ল জেলের ভিতরের সমস্ত ওয়ার্ডে। অবশেষে জানা গেল এই নির্মম-নিষ্ঠুর অত্যাচারের পিছনে রয়েছে ইন্সপেক্টর জেনারেল কর্নেল এনএস সিম্পসন । যিনি পূর্বেও বন্দী বিপ্লবীদের উপর অমানুষিক অত্যাচার চালাতেন।
জেলের বাইরের ভলান্টিয়ার্সের বিপ্লবীরা প্রস্তুতি নিলেন অত্যাচারী সিম্পসনকে উচিৎ শিক্ষা দেওয়ার জন্য। পরিকল্পনা হলো শুধু সিম্পসন নয়, অত্যাচারী ইংরেজ আমলাদেরকে বুঝিয়ে দিতে হবে যে, বাঙ্গালীরাও লড়তে জানে, প্রতিশোধ নিতে জানে, মারতে জানে এবং এজন্য জীবন দিতেও তাঁরা পিছু হটে না। ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদকে কাঁপিয়ে দিতে হবে, বুঝিয়ে দিতে হবে এই দেশমাতৃকা আমাদের।
বিপ্লবীরা জেলের কুখ্যাত ইন্সপেক্টর জেনারেল কর্নেল এনএস সিম্পসনকে টার্গেট করলেন। তৎকালীন সময়ে কলকাতার ডালহৌসি স্কোয়ারে অবস্থিত ছিল ব্রিটিশ শাসকদের সচিবালয়। যার নাম রাখা হয়েছিল ‘রাইটার্স ভবন’। এই ভবনেই উচ্চপদস্থ ব্রিটিশ আমলারা নিয়মিত অফিস করতেন।
বিপ্লবীদের পরবর্তী অভিযান ছিল কলকাতার ‘রাইটার্স বিল্ডিং’ আক্রমণ। অসংখ্য পুলিশ প্রহরী পরিবেষ্টিত দুর্ভেদ্য অফিস ‘রাইটার্স বিল্ডিং’। এই ভবন আক্রমণ করে সেখান হতে ফেরার আশা কেউ করতে পারে না। বিপ্লবী নেতৃবৃন্দের মধ্যে আলোচনা চলল কে এই আক্রমণ পরিচালনা করবেন? এই দুঃসাহসী অভিযান পরিচালনার দায়িত্ব নিলেন বাদল গুপ্ত, দীনেশ গুপ্ত ও বিনয় বসু। কিশোর বয়স থেকেই বিনয় বসু, দীনেশ গুপ্ত ও বাদল গুপ্ত পরস্পর পরিচিত ছিলেন। তিনজনই ছিলেন পূর্ববাংলার (ঢাকার) সন্তান। কৈশোরকাল থেকে তিনজন দেশপ্রেমের মন্ত্রে উদ্বুদ্ধ হয়ে দেশমাতার মুক্তিযজ্ঞে নিজেদেরকে নিয়োজিত করেন। ঘটনাচক্রে এই তিন বন্ধুই একসঙ্গে ‘রাইটার্স বিল্ডিং’ আক্রমণের দায়িত্ব নেন।
১৯৩০ সালের ৮ ডিসেম্বর সকাল। সকল প্রস্তুতি সম্পন্ন। খুব গোপনীয়ভাবে এবং সতর্ক অবস্থায় অস্ত্র প্রশিক্ষণের কাজও সমাপ্ত হল। বিনয়-বাদল-দীনেশ ভলান্টিয়ার্সের বিপ্লবী নেতৃবৃন্দের সাথে আলোচনা করে বিদায় নিলেন। ৮ ডিসেম্বর দুপুর ১২ টা, এ্যাকশনের জন্য তিন বিপ্লবী প্রস্তুত। ‘রাইটার্স বিল্ডিং’ এর একটি কক্ষে কারা বিভাগের সর্বময় কর্তা ইনপেক্টর জেনারেল কর্নেল সিম্পসন তার নিয়মিত কাজকর্ম পরিচালনা করছেন। তার ব্যক্তিগত সহকারী জ্ঞান গুহ পাশে দাঁড়িয়ে কি বিষয়ে যেন আলোচনা করছেন। ঠিক এমন সময় সামরিক পোশাক পরে তিনজন বাঙালী যুবক রাইটার্স বিল্ডিংয়ে প্রবেশ করলেন। প্রহরীকে বললেন, তাঁরা কর্নেল সিম্পসনের সঙ্গে সাক্ষাৎ করতে চান।
তাঁরা সিম্পসনের ব্যক্তিগত সহকারীকে ঠেলে কামরার ভিতরে প্রবেশ করেন। হঠাৎ পদধ্বনী শুনে কর্নেল তাঁদের দিকে তাকান। বিস্ময়-বিমূঢ় চিত্তে দেখতে পান সম্মুখে মিলিটারী পোশাক পরে তিনজন বাঙালী যুবক রিভলবার হাতে দণ্ডায়মান। মুহূর্তের মধ্যে বিনয়ের কণ্ঠে ধ্বনিত হয় “প্রে টু গড কর্নেল। ইওর লাষ্ট আওয়ার ইজ কামিং।” কথাগুলি উচ্চারণের সঙ্গে সঙ্গে তিনটি রিভলবার হতে ছয়টি গুলি সিম্পসনের দেহ ভেদ করে। সিম্পসন লুটিয়ে পড়ে মেঝের উপর। এরপরই গুলির আঘাতে আহত হন জুডিসিয়েল সেক্রেটারী মি. নেলসন। এলোপাথাড়ি গুলি বর্ষণ করতে করতে আততায়ীরা পরবর্তী লক্ষ্য হোম সেক্রেটারী আলবিয়ান মারের কক্ষের দিকে অগ্রসর হন। ততক্ষণে এই আক্রমণ প্রতিরোধের জন্য ছুটে আসেন পুলিশ- ইন্সপেক্টর জেনারেল মি. ক্র্যাগ ও সহকারী ইন্সপেক্টর জেনারেল মি. জোনস। তাঁরা কয়েক রাউণ্ড গুলিও ছোঁড়েন। কিন্তু বিনয়- বাদল-দীনেশের বেপরোয়া গুলির মুখে তাঁরা দাঁড়াতে পারলেন না। প্রাণ নিয়ে পালালেন। সমস্ত ‘রাইটার্স বিল্ডিং’ জুড়ে তখন এক বিভীষিকাময় রাজত্ব। চারিদিকে শুধু ছুটাছুটি। কে কোন দিকে পালাবে খুঁজে পায় না। কলরব-কোলাহল- চিৎকার। শুধু এক রব ‘বাঁচতে চাও তো পালাও’। ‘রাইটার্স বিল্ডিং’ আক্রমণের সংবাদ পেয়ে পুলিশ কমিশনার টেগার্ট আসেন। ডেপুটি কমিশনার গার্ডন আসেন সশস্ত্র বাহিনী নিয়ে। জুডিসিয়েল সেক্রেটারী মি. নেলসন, মি. টয়নয় প্রমুখ অনেক ইংরেজ রাজপুরুষ আহত হলেন। আক্রমণ প্রতিহত করার জন্য ডেকে আনা হল গুর্খা বাহিনীকেও।
একদিকে তিনজন বাঙালী তরুণ, হাতে শুধু তিনটি রিভলবার। আর অপরদিকে রাইফেলধারী সুশিক্ষিত গুর্খাবাহিনী। আরম্ভ হল ‘অলিন্দ যুদ্ধ’। ইংরেজ মুখপত্র ‘স্টেটসম্যান’ পত্রিকার ভাষায় ‘বারান্দা বেটল’। দীনেশের পিঠে একটি গুলি বিদ্ধ হল। তিনি তাতে ভ্রুক্ষেপও করলেন না। অসংকোচে গুলিবর্ষণ করতে লাগলেন শত্রুকে লক্ষ্য করে। যতক্ষণ পর্যন্ত বিনয়-বাদল- দিনেশের হাতে গুলি ছিল, ততক্ষণ কেউ তাঁদের আক্রমণ করে প্রতিহত করতে পারেননি। একপর্যায়ে তাঁদের গুলি নিঃশেষ হল। গুর্খা ফৌজ অনবরত গুলিবর্ষণ করে চলল। তখন তিনজন বিপ্লবী একটি শূন্য কক্ষে প্রবেশ করে সঙ্গে আনা ‘সায়নাইড’- বিষের পুরিয়াগুলি মুখে দিলেন। বিষক্রিয়ায় অতি দ্রুত জীবনপ্রদীপ নিবে না যাওয়ার আশংকায় এবং মৃত্যুকে নিশ্চিত করার জন্য প্রত্যেকেই নিজ নিজ ললাট লক্ষ্য করে রিভলবারে রাখা শেষ গুলিটি ছুঁড়ে দিলেন। বাদল তৎক্ষণাৎ মৃত্যুবরণ করেন। বিনয় ও দীনেশ সাংঘাতিক আঘাতপ্রাপ্ত হয়ে মেঝের উপর পড়ে রইলেন।
ভীষণভাবে আহত বিনয় ও দীনেশকে একটু সুস্থ করে ইংরেজ বাহিনী তাঁদের উপর চালাল প্রচণ্ড অত্যাচার। এরপর উভয়কেই পুলিশ মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে পাঠিয়ে দেয়। পুলিশ কমিশনার টেগার্ট এতদিন পরে বিনয়ের উপর আক্রোশ মিটানোর সুযোগ পেলেন। অচেতন বিনয়ের হাতের আঙ্গুলের উপর বুট দিয়ে সবগুলি অঙ্গুল ভেঙ্গে ফেলে বীরত্ব প্রদর্শন করলেন।
বিনয় ছিলেন মেডিকেল স্কুলের চতুর্থ বর্ষের ছাত্র। তিনি জানতেন মৃত্যুর পথ। হাসপাতালে থাকা অবস্থায় তিনি ১৪ ডিসেম্বর রাতে আকাঙ্খিত মৃত্যুকে বরণ করার জন্য মস্তিষ্কের ব্যাণ্ডেজের ভিতর অঙ্গুল ঢুকিয়ে স্বীয় মস্তিষ্ক বের করে আনেন এবং মৃত্যুকে বরণ করে নেন। অন্যদিকে ডাক্তার ও নার্সদের আপ্রাণ চেষ্টায় দীনেশ ক্রমশ সুস্থ হয়ে উঠেন। সুস্থ হওয়ার পর তাঁকে হাসপাতাল থেকে ‘কনডেমড.’সেলে নেয়া হয়। তারপর দীনেশের বিচারের জন্য আলীপুরের সেসন জজ মি. গ্রালিকের সভাপতিত্বে ব্রিটিশ সরকার এক ট্রাইবুনাল গঠন করে ফাঁসির আদেশ দেয়। ১৯৩১ সালের ৭ জুলাই দীনেশের ফাঁসি কার্যকর করা হয়।
ভারত স্বাধীন হওয়ার পরে বিনয়-বাদল-দীনেশের নামানুসারে কলকাতার ডালহৌসি স্কয়ারের নাম পাল্টে রাখা হয় বি-বা-দী বাগ। অর্থাৎ বিনয়-বাদল-দীনেশ বাগ।
তথ্য ও ছবিসূত্র:
১। অগ্নিযুগের ইতিহাস: ব্রজেন্দ্রনাথ অর্জুন। প্রকাশক: মুক্তধারা। প্রকাশকাল; ডিসেম্বর ১৯৭৯।
২। বাংলার বিপ্লব প্রচেষ্টা: হেমচন্দ্র কানুনগো। চিরায়ত প্রকাশনী, কলকাতা। প্রকাশকাল: জুন, ১৯২৮।
৩। স্বাধীনতা সংগ্রামে সশস্ত্র বিপ্লবীদের ভূমিকা: সুধাংশু দাশগুপ্ত, ন্যাশনাল বুকস এজেন্সি কলকাতা।
৪। ফাঁসির মঞ্চে গেয়ে গেল যারা: চিন্ময় চৌধুরী। দে’জ পাবলিকেশন, কলকাতা। প্রকাশকাল: জানুয়ারী ১৯৯৮।
৫। বিদ্রোহী ভারত: নীহাররঞ্জন গুপ্ত। মিত্র ও ঘোষ পাবলিশার্স প্রা: লি:- কলকাতা, প্রকাশকাল: অগ্রহায়ণ-১৩৯১।
৬। হেমেন্দ্রনাথ দাসগুপ্ত, ভারতের বিপ্লব কাহিনী, ২য় ও ৩য় খন্ড, কলকাতা, ১৯৪৮।
লেখক : রফিকুল ইসলাম (শেখ রফিক)