ভগৎ সিংয়ের প্রাথমিক পড়াশুনার হাতেখড়ি পরিবারে। তারপর স্কুলে পড়ার পালা। কিন্তু ভগৎ সিং তাঁর সমবয়সী ছেলেদের মতো লাহোরের খালসা হাইস্কুলে পড়াশোনা করেননি। কারণ এই স্কুলে পড়াশুনা করলে ব্রিটিশ কর্তৃপক্ষের প্রতি আনুগত্য দেখাতে হয়। যে কারণে তাঁর ঠাকুরদাদা তাঁকে এখানে পড়াশুনা করাতে রাজি ছিলেন না। তিনি ভগৎ সিংকে অন্য একটি স্কুলে পড়াশুনা করানোর সিদ্ধান্ত নেন। তাই ভগৎ সিংয়ের বাবা তাঁকে আর্যসমাজের বিদ্যালয় দয়ানন্দ অ্যাংলো-বৈদিক স্কুলে ভর্তি করান।
এই স্কুলে পড়াশুনার সময় হঠাৎ একদিন দুপুর বেলা ভগৎ সিংকে খুঁজে পাওয়া যাচ্ছিল না। স্কুলের সবাই বাড়ি ফিরেছে, কিন্তু ভগৎ সিংকে কোথাও পাওয়া গেল না। তিনি তখন ক্লাস সেভেনে পড়েন। বয়স মাত্র ১২ বছর। সবাই তাঁকে খুঁজতে বের হলো। ওদিকে জালিয়ানওয়ালাবাগের হত্যাকাণ্ডের খবর সর্বত্র ছড়িয়ে পড়েছে, আতঙ্কে সবাই ছুটাছুটি করছেন। স্কুলে খবর নিয়ে জানা গেল ভগৎ সিং যথারীতি ক্লাস করেছেন; তারপর কোথায় গেছেন কেউ জানেন না। অনেক রাতে তাঁর দেখা মিলল। হাতে জালিয়ানওয়ালাবাগের শত শহীদের রক্ত মাখা মাটি।
১৯১৯ সালের ১৩ এপ্রিল ইংরেজ সেনানায়ক ব্রিগেডিয়ার রেগিনাল্ড ডায়ারের নির্দেশে ১০০ জন গুর্খা সৈন্য আর ২টি সাজোয়া গাড়ি নিয়ে জালিয়ানওয়ালাবাগে ২০০০- এর মত বিদ্রোহীকে হতাহত করা হয়। বাগের মাঝখানে কুয়োতে পাথর ফেলে কিছু মানুষকে জীবন্ত পুঁতে ফেলা হয়। এটি জালিয়ানওয়ালাবাগ হত্যাকাণ্ড নামে পরিচিত।
সেদিন স্কুল থেকে বেরিয়ে ভগৎ সিং সেই মর্মান্তিক ঘটনা শোনেন, এরপর তিনি বাসে করে ৪০/৫০ মাইল দূরে অমৃতসরের জালিয়ানওয়ালাবাগে ছুটে যান। সেখানকার ত্রাস ও দুর্যোগের পরিবেশ উপেক্ষা করে কুড়িয়ে আনেন সেই রক্তরঞ্জিত মাটি। এই মাটি তাঁর কাছে সোনার চেয়েও খাঁটি। এ মাটি বিদ্রোহের প্রতীক।
এভাবে ভগৎ সিং ছেলেবেলা থেকেই ব্রিটিশদের প্রতি ঘৃণা ও বিপ্লবীদের প্রতি শ্রদ্ধা প্রর্দশন করেছেন। আর দেশকে মুক্ত করার জন্য জীবন বাজী রেখে ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে বিভিন্ন আন্দোলন সংগ্রামে অংশগ্রহণ করেছেন এবং শেষ পর্যন্ত ব্রিটিশদের দেয়া ফাঁসির রজ্জু হাসিমুখে বরণ করেছেন।
ভগৎ সিং জন্মেছিলেন ১৯০৭ সালের ২৭ সেপ্টেম্বর। পশ্চিম পাঞ্জাবের লায়লপুর জেলার বংগা গ্রামে। একসময় পাঞ্জাবের ওই অঞ্চলে জলের অভাবে চাষ-আবাদ কিছুই হত না। উনিশ শতকের শেষদিকে মধ্য পাঞ্জাবের বেশ কিছু লোক উত্তর-পশ্চিম অঞ্চলে এসে প্রচুর পরিশ্রম করে খাল কেটে চাষবাস শুরু করেন। ভগৎ সিংয়ের পূর্বপুরুষ ছিলেন তাঁদের দলে। তাঁরা ছিলেন দুঃসাহসী, কঠোর পরিশ্রমী আর স্বাধীন চিন্তার মানুষ। তাঁদের বলা হত জাঠ। ভগৎ সিংয়ের ঠাকুরদাদা অর্জুন সিংহ। তিনি দয়ানন্দ সরস্বতীর হিন্দু সমাজ সংস্কার আন্দোলনে আর্যসমাজের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। ভগৎ সিংয়ের বাবার নাম সর্দার কিষাণ সিংহ সান্ধু এবং মা বিদ্যাবতী। তাঁর বাবা ছিলেন একজন মানবপ্রেমিক মানুষ। সমাজের মানুষের কল্যাণে নিয়েজিত থাকাই ছিল তাঁর জীবনের আসল ব্রত। ভগৎ সিংয়ের ছোটকাকা স্বর্ণ সিং ছিলেন একজন বিপ্লবী। বিপ্লবী কর্মকান্ডে জড়িত থাকার অপরাধে দীর্ঘদিন জেলে ছিলেন। যে কারণে মাত্র ২৩ বছর বয়সে মারা যান। তাঁর মেজকাকা অজিত সিং ছিলেন আরেক বিপ্লবী। তিনি লালা লাজপত রায়ের খুব কাছের লোক ছিলেন। অজিত সিং পাঞ্জাবে ‘ভারত দেশপ্রেমিক সমিতি’ গড়ে তুলে বিপ্লবী কার্যক্রম শুরু করেন। তাদের পুরো পরিবারই ব্রিটিশ রাজের বিরুদ্ধে বিপ্লবী কর্মকাণ্ডে জড়িত ছিলেন। এমন এক দেশপ্রেমিক বিপ্লবী রাজনৈতিক পরিবেশে ধীরে ধীরে ভগৎ সিং বেড়ে উঠেন।
১৯২১ সালে চিত্তরঞ্জন দাশের মাধ্যমে গান্ধীজী বিপ্লবীদের সাথে যোগাযোগ করেন এবং তাঁদেরকে অসহযোগ আন্দোলনে যুক্ত হতে বলেন। তিনি বিপ্লবীদের জানান অসহযোগ আন্দোলন করে এক বছরের মধ্যে স্বরাজ এনে দিবেন। যদি না পারেন তাহলে বিপ্লবীরা আবার সশস্ত্র সংগ্রামে সামিল হলে তাঁর বলার মতো কিছু থাকবে না। গান্ধীজীর অনুরোধে বিপ্লবীরা সাময়িকভাবে সম্মত হন। এসময় কিশোর ভগৎ সিং অসহযোগ আন্দোলনে যুক্ত হন। তিনি নিজ এলাকাতে অসহযোগ আন্দোলন গড়ে তোলেন। তিনি সহপাঠীদের সাথে নিয়ে বিলাতী কাপড় জোগাড় করে মহানন্দে পোড়াতে শুরু করেন। তখন তাঁর বয়স মাত্র ১৪ বছর। ওই বয়স থেকে তিনি ইউরোপীয় বিপ্লবী আন্দোলনের উপর পড়াশোনা করেন এবং শেষ পর্যন্ত মার্ক্সবাদে আকৃষ্ট হন। অসহযোগ আন্দোলন চলার সময় তিনি একদিন ব্রিটিশ শাসকগোষ্ঠীর প্রতি ক্ষুব্ধ হয়ে ঘৃণা প্রকাশ করার জন্য তাঁর সরকারি স্কুলবই ও স্কুলের পোষাক পুড়িয়ে ফেলেন।
এক বছরের মধ্যে সারাদেশে অসহযোগ আান্দোলন ছড়িয়ে পড়ে। এতে সকল শ্রেণী-পেশার মানুষ যুক্ত হয়। ১৯২২ সালের ৫ ফেব্রুয়ারী হঠাৎ উত্তরপ্রদেশের গোরখপুর জেলার চৌরীচেরা গ্রামে কৃষকদের শান্তিপূর্ণ অসহযোগ আন্দোলন হঠিয়ে দেয়ার জন্য পুলিশ জনতার উপর গুলি চালায়। এতে কয়েকজন কৃষক মারা যায়। ফলে বিক্ষুব্ধ জনতা থানা ঘেরোও করে আগুন জ্বালিয়ে দেয়। থানার ভিতর ২২ জন পুলিশ পুড়ে মারা যায়। এতদিন ধরে ব্রিটিশ প্রশাসন ভারতের স্বাধীনতাকামী জনগণের উপর যে অত্যাচার-নির্যাতন চালিয়েছে সে তুলনায় এটি কিছুই নয়। এটি ছিল একটি বিক্ষিপ্ত দুঃখজনক ঘটনা। তবু গান্ধীজী এই ঘটনার কারণে অসহযোগ আন্দোলন থেকে সরে দাঁড়ান।
অসহযোগ আন্দোলন থেমে যাওয়ার পর ভগৎ সিং ‘শিখ গুরুদ্বার’ সংস্কারের কাজে যুক্ত হন। শিখ ধর্মের নানা অনুষ্ঠান যেখানে পালিত হয় সেই মন্দিরকে বলে গুরুদ্বার। এইসব গুরুদ্বারে যে আয় হত তার প্রায় বড়ো অংশই পুরোহিতরা নিজেদের ব্যক্তিগত বিলাসে ব্যয় করতেন। গুরুদ্বার সংস্কার আন্দোলনের নেতারা বলেন, তা হবে না। নির্বাচিত প্রতিনিধি দল গঠন করতে হবে। তাঁরাই আয়-ব্যয়ের হিসাব রাখবেন। এই আন্দোলনে যোগ দিয়ে ভগৎ সিং বড়ো বড়ো চুল রাখলেন, কোমরে ঝুলালেন শিখ ধর্মের নিয়ম অনুসারে কৃপাণ নামে তলোয়ারের চেয়ে ছোটো একটা অস্ত্র, মাথায় পড়লেন বড়ো কালো পাগড়ি। সেই সময়ের কথা বলতে গিয়ে ভগৎ সিং তাঁর ‘কেন আমি নাস্তিক?’ বইয়ে লিখছেন, ‘সেই সময়ে অমি লম্বা লম্বা চুল রাখতে থাকি। কিন্তু শিখ বা অন্য কোন ধর্মের পৌরাণিক কাহিনী বা মতবাদে আমি আস্থা রাখতে পারিনি। তবু ঈশ্বরে আমার খুব বিশ্বাস ছিল।’
মেট্রিক পাশ করার পর ভগৎ সিং ন্যাশনাল কলেজে (স্বদেশী বিদ্যালয়) ভর্তি হন। এই কলেজে ভগৎ সিং দুজন বিশিষ্ট অধ্যাপকের কাছে পড়াশুনার সুযোগ পান। অধ্যাপক পরমানন্দের কাছে শুনলেন ইতিহাসের কত জানা-অজানা কাহিনী। শুনলেন আন্দামান জেলে বন্দী বীর দেশপ্রেমিকদের কথা। অধ্যাপক নিজেই এই আন্দামানে বহুদিন বন্দী জীবন কাটিয়েছেন।
অধ্যাপক জয়চন্দ্র বিদ্যালঙ্কারের কাছে শুনলেন বিশ্ব-ইতিহাস নিয়ে আলোচনা। তখন থেকে ভগৎ সিং বুঝতে পারলেন, ভারতের স্বাধীনতা তখনই আসবে যখন এদেশের মানুষের একটা বড়ো অংশ সচেতন হবে। আর তার জন্য চাই বিশেষ শিক্ষা আর বিশাল কর্মকাণ্ড। ভগৎ সিং এই কলেজে পড়ার সময় আজীবন সংগ্রামের সাথী রূপে শুকদেব, যশপাল এবং ভগবতীচরণ ভোরার মতো কয়েকজন অসম সাহসী তরুণকে সহযোদ্ধা হিসেবে পেয়ে যান। ভগৎ সিং খুব মনোযোগী ও পরিশ্রমী ছাত্র ছিলেন। যে বিষয় বুঝতে পারতেন না তা বুঝার জন্য বার বার ভালো করে চেষ্টা করতেন। ইতিহাস ও রাজনীতি বিষয়ক পড়াশুনার প্রতি তাঁর আগ্রহ ছিল সবচেয়ে বেশি। সহপাঠীদেরকে নিয়ে পাঠচক্র করতেন। সবাইকে নিয়ে দেশ বিদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের ইতিহাস পড়তেন। পড়লেন ইতালির দেশপ্রেমিক ম্যাৎসিনি ও গ্যারিবল্ডি অস্ট্রিয়ার শাসককে উৎখাত করে ইতালিকে স্বাধীনতার ইতিহাস, আয়ারল্যান্ডের বিপ্লবী ইমন-ডি-ভ্যালেরার লেখা আয়ারল্যান্ডের স্বাধীনতার জন্য সংগ্রাম ও রুশ বিপ্লবী ক্রোপটকিনের ঘটনাবহুল জীবনের নানা দিক। আরো পড়লেন ভলতেয়ার আর রুশোর আগুন ঝরানো রচনাবলী। পড়াশুনার সাথে সাথে ভগৎ সিং লাহোরের ন্যাশনাল ড্রামাটিক ক্লাবের সভ্য হয়ে যুবকদের মধ্যে স্বদেশপ্রেম জাগিয়ে তোলার জন্য একে একে অভিনয় করলেন সম্রাট চন্দ্রগুপ্ত, রাণাপ্রতাপ, ভারত দুর্দশা। এসব নাটকের খল-চরিত্রে বিদেশী শাসকের অন্যায়-অত্যাচারের রূপরেখা ফুটে উঠত। এইভাবে মঞ্চে সফল একাধিক নাটকের মাধ্যমে কলেজের ছাত্র সমাজের মধ্যে বিদ্রোহের উদ্দীপনা নিয়ে এলেন তিনি।
১৯২৩ সালে ভগৎ সিং বি.এ. ক্লাসে ভর্তি হন। কিছুদিন পর বাড়ি থেকে বিয়ে করার জন্য বার বার চাপ আসতে থাকে। কিন্তু ভগৎ সিং বিয়ে করতে রাজি নন। তিনি মনে মনে প্রতিজ্ঞা করেন, দেশের স্বাধীনতার জন্য প্রয়োজনে জীবন উৎসর্গ করবেন। তাই লাহোরের বিপ্লবী নেতা শচীন সান্যালের পরামর্শে ভগৎ সিং কানপুরের বিপ্লবী গণেশ শঙ্করের কাছে চলে যান। গণেশ শঙ্করের ‘প্রতাপ প্রেস’ ছিল উত্তরপ্রদেশের বিপ্লবীদের মিলন কেন্দ্র। গণেশ শঙ্করের মাধ্যমে এখানে বসেই ভগৎ সিং বিপ্লবী পথের অগ্নিমন্ত্রে দীক্ষা নেন। ছুড়ে ফেলেন উচ্চ শিক্ষার ডিগ্রী লাভের মোহকে। উপেক্ষা করলেন বাবার সুখী পরিবারের নিরাপদ জীবন, ফিরেও তাকালেন না গৃহকোণের দিকে। দুনিয়ার সব ছন্নছাড়া বাঁধনহারা মুক্তিকামী মিছিলে এক হয়ে গেলেন তিনি। যুক্ত হলেন ‘হিন্দুস্থান রিপাবলিকান এসোসিয়েশন’-এ। তারপর থেকেই শুরু হয় তাঁর সশস্ত্র বিপ্লবী জীবনের পথচলা।
১৯২৪ সালে ভারত উপমহাদেশব্যাপী ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলন ছড়িয়ে পড়ে এবং সর্বত্র সংগঠিত হয় সশস্ত্র বিপ্লববাদী সংগঠন। চট্টগ্রামে রেলওয়ে ডাকাতি, বঙ্গের বিভিন্ন জায়গায় রাজনৈতিক ডাকাতি ও বিপ্লববাদীদের সশস্ত্র কার্যকলাপের কারণে বঙ্গীয় প্রাদেশিক পরিষদে ব্রিটিশ ‘১ নং বেঙ্গল অর্ডিনান্স’ নামে এক জরুরি আইন পাশ করে। এই আইনের উদ্দেশ্য ছিল, ‘রাজনৈতিক কার্যকলাপের জন্য সন্দেহভাজনদের বিনা বিচারে আটক রাখা’।
১৯২৫ সালের ৯ আগষ্ট। উত্তর প্রদেশের কাকোরী রেল স্টেশন দিয়ে ব্রিটিশ পুলিশ সরকারী টাকা নিয়ে যাচ্ছিল। যখন ট্র্রেন কাকোরী স্টেশনে থামলো তখন ট্রেনে ডাকাত পড়েছে খবর ছড়িয়ে পড়ল। সবাই আতঙ্কিত। এমন সময় হঠাৎ ১৪/১৫ জন সশস্ত্র লোকের মধ্যে একজন বললেন, ‘আপনাদের কোনো ভয় নেই। আপনাদের কিছু নিতে আসিনি। এই গাড়িতে করে ইংরেজ আমাদের দেশের টাকা লুট করে নিয়ে যাচ্ছিল। আমরা সেই টাকা উদ্ধার করে দেশের কাজের জন্য নিয়ে গেলাম।’
এরপর ব্রিটিশ সরকার শুরু করে ‘কাকোরী ষড়যন্ত্র মামলা’। এই মামলাকে কেন্দ্র করে পুলিশ উত্তর প্রদেশের নেতৃস্থানীয় ৪৪ জনকে গ্রেফতার করে। মামলায় রাজেন লাহিড়ী, ঠাকুর রোশন সেন, আসফাকুল্লা খান এবং রামপ্রসাদ বিসমিল্লার ফাঁসি হয় ও গণেশ শঙ্কর, শচীন সান্যালসহ ১৪ জনকে আন্দামানে পাঠানো হয়।
এই ঘটনার পর দলের নির্দেশে ভগৎ সিং কানপুর থেকে পাঞ্জাবে চলে আসেন। এখানে এসে তিনি সহযোদ্ধাদের নিয়ে ‘নওজোয়ান ভারতসভা’ নামে একটি দল গঠন করেন। এই দলের সভাপতি হন রামকিষণ ও ভগৎ সিং হন সম্পাদক। এই দলের মূল উদ্দেশ্য ছিল ভারতে দিনমজুর ও কিষাণদের এক করে সশস্ত্র বিপ্লবের সপক্ষে নিয়ে যাওয়া। ১৯২৫ সালের শেষের দিকে বিপ্লবী শচীন সান্যালের পরিচালনায় উত্তর প্রদেশে প্রতিষ্ঠিত ‘হিন্দুস্থান রিপাবলিকান এসোসিয়েশন’ ইংরেজিতে লেখা দুটি বই প্রকাশ করেন। বই দুটিতে বিপ্লবের গতি-প্রকৃতি এবং বিপ্লবী দলের গঠন প্রণালী নিয়ে বিশদ আলোচনা করা হয়েছে। ভগৎ সিংয়ের নেতৃত্বে পাঞ্জাবের তরুণ ছাত্রসমাজ বই দুটি পড়ে সেদিন বিপ্লবী আদর্শে জীবন গড়ে তোলার শপথ নিয়েছিলেন। ভগৎ সিং তাঁদের পূর্ববর্তী ও সমসাময়িক বিপ্লবীদের ধর্মীয় ও আধ্যাত্মিক চেতনার ঐতিহাসিক সীমাবদ্ধতা কাটিয়ে আধুনিক যুগের উপযোগী বস্তুবাদ ও বিজ্ঞানচেতনাকে হাতিয়ার করে বিপ্লবী জীবন গড়ে তোলার জন্য নতুন পথ দেখান।
১৯২৬-২৭ সাল, পুরো এক বছর ভগৎ সিং ভারতের স্বাধীনতা, ভারতের গণমানুষের মুক্তি কোন পথে, এবিষয় নিয়ে অনেক পড়াশুনা করেন। পূর্বেই তিনি মার্ক্সবাদ সম্পর্কে অধ্যয়ন করেছিলেন। যে কারণে তিনি মাত্র একবছরের মধ্যে সমাজতান্ত্রিক আদর্শকে ধারণ করে এগুতে থাকেন। গরীব-মেহনতি মানুষ, যারা পিছিয়ে পড়া ও কুসংস্কারাছন্ন তাদেরকে বৈজ্ঞানিক সমাজতন্ত্রের পথে নিয়ে যাওয়ার জন্য প্রতিজ্ঞাবদ্ধ হন।
১৯২৮ সালের ৮-৯ সেপ্টেম্বর ‘হিন্দুস্থান রিপাবলিকান এসোসিয়েশন’ সমগ্র ভারতের বিভিন্ন বিপ্লবীদের নিয়ে দিল্লীতে একটি সভা অনুষ্ঠিত করে। এই সভার সভাপতিত্ব করেন ভগৎ সিং। ওই সমাবেশে তিনি বলেন, ‘অবশ্য আমাদের প্রথম লক্ষ্য দেশকে স্বাধীন করা। কিন্তু মূল লক্ষ্য হলো, ভারতে শোষণহীন সমাজ ব্যবস্থা গড়ে তোলা। সমাজতান্ত্রিক ভারতবর্ষই আমাদের স্বপ্ন। বিপ্লবের চেতনা নিয়ে আমরা সেই পথে এগিয়ে যাব।’ এই সভায় ‘হিন্দুস্থান রিপাবলিকান এসোসিয়েশন’ এর নাম পরিবর্তন করে ‘হিন্দুস্থান সোসালিস্ট রিপাবলিকান এসোসিয়েশন’ নাম দেয়া হয়।
ওই বছর স্যার জন সাইমনের অধীনে ব্রিটিশ সরকার একটি কমিশন গঠন করে ভারতের রাজনৈতিক পরিস্থিতির উপর রিপোর্ট প্রদানের জন্য সেটিকে ভারতে প্রেরণ করে। কিন্তু কমিশনে কোনো ভারতীয় না থাকায় ভারতের সকল রাজনৈতিক দল তা প্রত্যাখ্যান করে এবং সারা দেশে এটির বিরুদ্ধে বিক্ষোভ গড়ে উঠে। যার ধারাবাহকিতায় ১৯২৮ সালের ৩০ অক্টোবর লাহোরে লালা লাজপত রায়ের নেতৃত্বে একটি নীরব অহিংস পথযাত্রার উপর পুলিশ লাঠি চার্জ করে। এসময় লালা লাজপত রায় পুলিশের নৃশংস লাঠি চার্জের শিকার হয়ে গুরুতর অসুস্থ হয়ে পড়েন এবং একপর্যায়ে মারা যান। ভগৎ সিং এই পথযাত্রায় ছিলেন। তিনি এই ঘটনার প্রতিশোধ নেওয়ার জন্য মরিয়া হয়ে উঠেন। বিপ্লবী ভগৎ সিং, রাজগুরু, সুখদেব ও জয় গোপাল একত্রে মিলিত হয়ে ওই ঘটনার নেতৃত্বদানকারী পুলিশ প্রধান স্কটকে হত্যার পরিকল্পনা করেন। জয় গোপালকে দায়িত্ব দেয়া হয়, স্কটকে সনাক্ত করার পর ভগৎ সিং-কে গুলি করার সংকেত প্রদান করবেন। জয় গোপাল ডেপুটি পুলিশ সুপারিনটেন্ডেন্ট J.P Saunders কে দেখে পুলিশ প্রধান স্কট ভেবে ভগৎ সিং-কে গুলি করার সংকেত দেন। ফলশ্রুতিতে Saunders গুলিবিদ্ধ হয়ে মারা যায়। সামান্য ভুলের কারণে বেঁচে যান পুলিশ প্রধান স্কট। ভগৎ সিং পুলিশের হাত থেকে বাঁচার জন্য আত্মগোপনে চলে যান। পুলিশ যাতে তাঁকে চিনতে না পারে সেজন্য তিনি চুল-দাঁড়ি কেটে ফেলেন। কিছু দিন পর তিনি কলকাতায় চলে আসেন। এখানে এসে বাংলার বিপ্লবী যতীন দাসের আশ্রয়ে একটি হোস্টেলে উঠেন। খুব সতর্কতার সাথে বিপ্লবীদের সাথে যোগাযোগ করে পার্টির কাজ অব্যাহত রাখেন।
অন্যদিকে ব্রিটিশ সরকার বিপ্লবীদেরকে দমনের জন্য পুলিশকে অধিক ক্ষমতা প্রদান করে ভারত প্রতিরক্ষা আইন পাশ করার সমস্ত প্রক্রিয়া চুড়ান্ত করে। ১৯২৯ সালের ৮ এপ্রিল সেন্ট্রাল লেজিসলেটিভ অ্যাসেম্বলিতে আইনটির অধ্যাদেশ পাশ হবার সিদ্ধান্ত হয়। এই আইনকে রুখে দেওয়ার জন্য ভগৎ সিং এর ‘হিন্দুস্থান সোসালিস্ট রিপাবলিকান এসোসিয়েশন’ প্রস্তুতি গ্রহণ করে। দলের নেতা ভগৎ সিং এর নেতৃত্বে সিদ্ধান্ত হয় ৮ এপ্রিল সেন্ট্রাল লেজিসলেটিভ অ্যাসেম্বলিতে এর প্রতিবাদে বোমা নিক্ষেপ করা হবে। উদ্দেশ্যটা রক্তপাত ঘটানো ছিল না; তাঁরা চেয়েছিলেন, ভগৎ সিং এর ভাষায় ‘বধিরের কানের কাছে আওয়াজ তুলতে’। সিদ্ধান্ত অনুযায়ী ভগৎ সিং ও বটুকেশ্বর দত্ত বোমা নিক্ষেপ করবেন আর দলের অন্যরা তাঁদেরকে ঘটনাস্থল থেকে সরিয়ে নিবেন। ৮ এপ্রিল যথাসময়ে ‘বধিরের কানের কাছে আওয়াজ পৌঁছানোর’ জন্য ভগৎ সিং ও বটুকেশ্বর বোমা নিক্ষেপ করে ‘ইনকিলাব জিন্দাবাদ’, ‘সাম্রাজ্যবাদ নিপাত যাক’, ‘দুনিয়ার মজদুর এক হও’ শ্লোগান দেন, যে-আওয়াজ ওইভাবে এর আগে কখনো শোনা যায়নি। পলায়নের চেষ্টা না-করে তাঁরা নির্ভয়ে ইস্তাহার বিলি করতে থাকেন। এসময় পুলিশ তাঁদের গ্রেফতার করে।
এই ইস্তাহার হিন্দুস্তান রিপাবলিকান আর্মির নামে প্রকাশিত হয়েছিল এবং তাতে মার্কসবাদের প্রতি সংগঠনের অঙ্গীকার অভিব্যক্ত হয়েছিল, বলা হয়েছিল নতুন একটি মানবিক সমাজ গড়বার প্রয়োজনে তাঁরা যে কোনো শাস্তি সানন্দে গ্রহণ করবেন। তাঁরা ঘোষণা করেছিলেন যে, তাঁদের পথটা গণআন্দোলনের। মামলায় ভগৎ সিং ও বটুকেশ্বর দত্ত উভয়েই যাবজ্জীবন দীপান্তর দণ্ডে দণ্ডিত হন। কিন্তু তাঁদের দু’জনকে পুলিশ ইনসপেক্টর সান্ডার্সকে হত্যা মামলায় অভিযুক্ত করা হয়। এই মামলায় প্রমাণাভাবে বটুকেশ্বর দত্ত অব্যাহতি পান। কিন্তু ভগৎ সিং, সুখদেব ও রাজগুরুকে খুনের অভিযোগে দোষী সাব্যস্ত করে জেলে প্রেরণ করা হয়।
জেলে বন্দী থাকাকালে ভগৎ সিং ব্রিটিশ ও ভারতীয় বন্দীদের সমানাধিকারের দাবিতে ৬৩ দিন অনশন করেন। সে সময় ভারতীয় বন্দীদের চেয়ে ব্রিটিশ চোর ও খুনিদের প্রতি অধিকতর ভাল আচরণ করা হত। ৬৩ দিন অনশনের ফলে ব্রিটিশ সরকার নতি স্বীকার করতে বাধ্য হয়। ভগৎ সিং জেলে থাকার সময় ডায়রী লিখতেন। তিনি প্রচুর বই পড়তেন। যে কথাগুলো ভালো লাগত, সেগুলো টুকে রাখতেন নিজের ডায়েরিতে। ১৯৩০-৩১ সালে জেলের মধ্যে ফাঁসির অপেক্ষায় যখন ভগৎ সিং এর দিন কাটছিল সে সময় তিনি ‘why I am An Atheist’ প্রবন্ধটি লিখেছিলেন। ফাঁসির কয়েক মাস পরে ‘The People’ (Lahore, 27 Sept. 1931) নামক পত্রিকায় প্রবন্ধটি প্রকাশিত হয়।
১৯৩০ সালের ৭ অক্টোবর। তিন ব্রিটিশ বিচারকের সমন্বয়ে গঠিত এক বিশেষ ট্রাইব্যুনাল ভগৎ সিং, সুখদেব ও রাজগুরুকে অপরাধী সাব্যস্ত করে এবং ফাঁসিতে ঝুলিয়ে মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করার রায় প্রদান করে। অবশেষে ১৯৩১ সালের ২৩ মার্চ সন্ধ্যা ৭ টায় এই তিন বিপ্লবীকে ফাঁসিতে ঝুলিয়ে মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করা হয়।
তথ্য ও ছবিসূত্র :
১। আমাদের ভগৎ : বিশ্বনাথ গঙ্গোপাধ্যায়। র্যাডিক্যাল প্রকাশনী, কলকাতা। প্রকাশকাল: জানুয়ারী ২০১১ সাল। ছবি এই বই থেকে নেয়া।
২। অগ্নিযুগের ইতিহাস: ব্রজেন্দ্রনাথ অর্জুন। প্রকাশক: মুক্তধারা। প্রকাশকাল; ডিসেম্বর ১৯৭৯।
৩। স্বাধীনতা সংগ্রামে সশস্ত্র বিপ্লবীদের ভূমিকা: সুধাংশু দাশগুপ্ত, ন্যাশনাল বুকস এজেন্সি কলকাতা।
৪। উইকিপিডিয়া।
লেখক: রফিকুল ইসলাম ( শেখ রফিক)