১৯২৭ সালের কথা। মা-বাবা বিয়ের পাত্রী ঠিক করে ফেললেন তাঁর জন্য। বিয়ের সবকিছু ঠিকঠাক। আত্মীয় স্বজন জোর করে বিয়ের পিঁড়িতে বসালেন। কিন্তু বিয়ের পিঁড়ি থেকে উঠে এলেন ২৪ বছরের যুবক মণিকৃষ্ণ সেন। কারণ বিপ্লবী মণিকৃষ্ণ সেন বেশ ভাল ভাবেই জানতেন, যে কোনদিন, যে কোনো সময়, যে কোনো স্থানে পুলিশের সঙ্গে সংঘর্ষে তাঁর মৃত্যু হতে পারে। এক জনের মেয়েকে ঘরে এনে বিধবা করে লাভ কি? আর একথাটিই মেয়ের স্বজনকে ইঙ্গিতে বুঝিয়ে দিয়ে নিজের বিয়ে নিজেই ভেঙ্গে দিলেন।
সেদিন তিনি হয়তো ঠিক সিদ্ধান্তটিই নিয়েছিলেন। কারণ পুলিশের সঙ্গে সংঘর্ষে তাঁর মৃত্যু না হলে ৮৮ বছরের জীবনে ১৯ বছর ৬ মাস তিনি জেল খেটেছেন। নিজগৃহে অন্তরীণ থেকেছেন প্রায় ৩ বছর। আত্মগোপনে ছিলেন ৭ বছর। বিধবা না হলেও সেই মেয়েটিকে যে অনেক কষ্ট আর সংগ্রামের মধ্য দিয়ে জীবন পার করতে হতো একথা নিঃসন্দেহে বলা যায়।
রংপুর কমিউনিষ্ট পার্টির অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা, ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনের সংগঠক, ঐতিহ্যবাহী তেভাগা আন্দোলনের নেতা, মহান মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম সংগঠক কমরেড মণিকৃষ্ণ সেন ১৯০৩ সালের ১ নভেম্বরে ফরিদপুরের (বর্তমান রাজবাড়ী জেলা) বেরাদী গ্রামে মামা বাড়িতে জন্মগ্রহণ করেন। বাবা বেনীমাধব সেন। মা প্রোমদা সুন্দরী সেন। মণিকৃষ্ণ সেনের বাবার বাড়ি ছিল রংপুর জেলার পীরগঞ্জ থানার কাবিলপুর গ্রামে। তাঁর বাবা কাবিলপুরের জমিদারের সেরেস্তা ছিলেন। তাঁর কাকা চন্দ্রকান্ত সেনও আরেক জমিদারের সেরেস্তা ছিলেন। জয়পুরহাটে তাঁর বাবার কিছু সম্পত্তি ছিল। সেখানে তাঁদের চালের ব্যবসা ছিল। তাঁর বয়স যখন ছয় মাস তখন তাঁর মা মণিকৃষ্ণ সেনের মামা বাড়ি থেকে কাবিলপুরে আসেন। কাবিলপুরে অতিবাহিত হয় তাঁর শৈশব জীবন। ১৯১১ সালে তাঁর বয়স যখন আট বছর তখন তাঁর বাবা মারা যান। তাঁরা ছিলেন পাঁচ ভাই ও চার বোন। ভাইদের মধ্যে তিনি ছিলেন তৃতীয়। তাঁর মেঝ ভাই শিবকৃষ্ণ সেন। তিনি কাবিলপুরের বিষয়সম্পত্তি দেখাশুনা করতেন। মণিকৃষ্ণ সেন বেড়ে উঠেছেন ভাই শিবকৃষ্ণ সেনের কাছে।
তাঁর পড়াশুনার হতেখড়ি হয় মা-বাবার কাছে। এরপর তাঁকে ভর্তি করানো হয় কাবিলপুর মাইনর স্কুলে। এই স্কুলে তিনি ৬ষ্ঠ শ্রেণী পর্যন্ত পড়াশুনা করেন। সপ্তম শ্রেণীতে ভর্তি হন ফরিদপুরের রাজবাড়ি হাইস্কুলে। সেখানে বোনের বাড়িতে থেকে পড়াশুনা করেন। অষ্টম শ্রেণীর দ্বিতীয় সাময়িক পরীক্ষার সময় তিনি ম্যালেরিয়ায় আক্রান্ত হন। সে সময় ম্যালেরিয়া ছিল দুরারোগ্য ব্যাধি। শারীরিক অসুস্থতার কারণে ১৯১৮ সালে তিনি রংপুরে পরিবারের কাছে চলে আসেন। সুস্থ হয়ে তিনি শহরের অন্যতম বিদ্যাপীঠ কৈলাশরঞ্জন উচ্চবিদ্যালয়ে নবম শ্রেণীতে ভর্তি হন।
স্কুল জীবনেই রাজনীতিতে হাতেখড়ি হয় তাঁর। ১৯২০ সালে ১৭ বছর বয়সে ভারত ছাড় আন্দোলনের সাথে যুক্ত হন। ইংরেজদের হাত থেকে দেশকে মুক্ত করার জন্য শপথ নেন। কৈলাশরঞ্জন উচ্চবিদ্যালয় থেকে ১৯২১ সালে তিনি প্রবেশিকা পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন। এরপর ভর্তি হন কারমাইকেল কলেজে। ওই সময় যুগান্তর দলের বিপ্লবীরা প্রকাশ্যে কংগ্রেসের সাথে যুক্ত ছিলেন। কংগ্রেসের নামের আড়ালে তাঁরা বিপ্লবী আন্দোলন পরিচালনা করতেন। ১৯২১ সালে মণিকৃষ্ণ সেন জাতীয় কংগ্রেসের কর্মী ছিলেন। তিনি ছিলেন গণঅভ্যুত্থানের অন্যতম সংগঠক ও যুব ভলান্টিয়ারদের প্রধান। কারমাইকেল কলেজ থেকে ১৯২৫ সালে বি.এ. এবং কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ১৯২৯ সালে এম.এ. ও বি.এল. পাশ করেন।
শরীর চর্চার প্রতি প্রবল আগ্রহের কারণে ভর্তি হয়েছিলেন ব্যামাগারে। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র অবস্থায় তিনি নিয়মিত শরীরচর্চা করতেন। শরীরচর্চার মধ্যে ব্যায়ামে তিনি দক্ষতা অর্জন করেছিলেন। কলকাতার শ্রেষ্ঠ চারজন ব্যায়ামবীরের মধ্যে তিনি ছিলেন অন্যতম। শরীরচর্চা প্রতিযোগিতায় তিনি নিয়মিত অংশগ্রহণ করতেন। পড়াশুনা শেষে কলকাতা থেকে ফিরে আসেন রংপুরে। যুক্ত হন আইনজীবী পেশায়। তবে এই পেশার প্রতি তাঁর তেমন আগ্রহ ছিলনা। তবে মাঝে মধ্যে তিনি কোর্টে যেতেন।
১৯২৮ সালে মণিকৃষ্ণ সেন যুগান্তর দলের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী কংগ্রেসে যোগদান করেন। তিনি বিপ্লববাদে বিশ্বাসী হলেও জনগণবিচ্ছিন্ন দর্শনে বিশ্বাসী ছিলেন না। তিনি বুঝতেন জনগণকে দিয়ে বিছিন্ন ও বিক্ষিপ্ত আন্দোলনের দ্বারা পরাধীনতার শৃঙ্খল থেকে স্বদেশকে মুক্ত করা যাবে না। তাই মনিকৃষ্ণসহ অসংখ্য বিপ্লবীরা কংগ্রেসে অন্তর্ভুক্ত হয়ে বিপ্লবী কর্মকাণ্ড পরিচালনা করেন।
১৯২৯ সালে বিপ্লবীরা রাজশাহীর পুঠিয়ায় মেইল ট্রেন ডাকাতির চেষ্টা চালায়। বিপ্লবীদের এই চেষ্টা সফল হয়নি। কিন্তু এতে ভীষণভাবে ক্ষিপ্ত হয় ইংরেজ সরকার। রংপুরের যুগান্তর দলের নেতা সুশীল দাশগুপ্ত এবং অনুশীলন দলের নেতা ধরনী বিশ্বাস ছিলেন মেইল ট্রেন ডাকাতি মামলার প্রধান আসামী। মেইল ট্রেন ডাকাতি মামলায় তাঁদের সাত বছর জেল হয়েছিল। এই মামলায় মণিকৃষ্ণ সেনও অভিযুক্ত হয়েছিলেন। গ্রামের বাড়ি কাবিলপুর থেকে তাঁকে গ্রেফতার করা হয়। জেল হাজতে তাঁকে থাকতে হয়েছিল চার মাস।
১৯৩০ সালে রংপুর জেলার আইন অমান্য আন্দোলন পরিচালনার জন্য কংগ্রেস নেতৃত্বের পক্ষ থেকে তাঁকে ‘ডিরেক্টর’ মনোনীত করা হয়। সে সময় কংগ্রেস ছিল নিষিদ্ধ। গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে কংগ্রেসের রাজনৈতিক কার্যকলাপ পরিচালনার সুযোগ ছিল না। এজন্য একজন ‘ডিরেক্টর’ গ্রেফতার হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে আরেকজনকে মনোনীত করা হতো। ওই বছর আইন অমান্য আন্দোলনের এক পর্যায়ে তিনি গ্রেফতার হন। এ সময় তিনি রাজশাহী ও বহরমপুর জেলে ছয়মাস কারাভোগ করেন।
১৯৩২ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে বেঙ্গল অর্ডিন্যান্সে পুলিশ তাঁকে গ্রেফতার করে। মেদিনীপুরের হিজলী স্পেশাল ক্যাম্পে তিন মাস রাখার পর তাঁকে বিনাবিচারে আটক রাখা হয় দেউলী বন্দিশিবিরে। দেউলী রাজপুতানার মরুভূমির নির্জন স্থানে অবস্থিত। সন্ত্রাসবাদী কার্যকলাপের জন্য পাঁচ বছরের বেশি সাজাপ্রাপ্তদের পাঠানো হতো আন্দামানে। অন্যান্যদের পাঠানো হতো দেউলীতে।
দেউলীতে তাঁকে সুদীর্ঘ ছ’বছর আটক রাখা হয়। ১৯৩৮ সালের গ্রীষ্মকালে অন্যান্য রাজবন্দীদের সাথে তিনি মুক্তিলাভ করেন। দেউলী বন্দীশিবিরে আটকের মেয়াদ উত্তীর্ণ হওয়ার শেষ পর্যায়ে বাঁকুড়া থানার হেফাজতে তিন মাস এবং যশোরের অভয়নগরে ছয় মাস রাখা হয় । মুক্তিলাভের পর রংপুরের মূলাটোলের শিবকৃষ্ণ বাসভবনে অন্তরীণ রাখা হয়। অন্তরীণ থাকা অবস্থায় তাঁকে সকাল-সন্ধ্যা মিউনিসিপ্যাল এলাকায় যাতায়াত করতে দেয়া হত।
১৯৩৮ সালে মণিকৃষ্ণ সেন কমিউনিস্ট পার্টিতে যুক্ত হন। ১৯৩৯ সালে কমিউনিস্ট পার্টির সদস্যপদ অর্জন করেন। একই সময় তাঁকে জেলা কংগ্রেস নেতা ও সম্পাদক হিসেবে কাজ করতে হয়। ১৯৩৯-৪৫ সাল পর্যন্ত তিনি রংপুর জেলা কংগ্রেসের সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করেন।
১৯৪১ সালের ১ ডিসেম্বর বৃহত্তর রংপুর জেলা কমিউনিস্ট পার্টির প্রথম জেলা সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। কমরেড শচীন ঘোষ, মণিকৃষ্ণ সেন, শিবদাস লাহিড়ী, রথীন গাঙ্গুলী, বিভূতি লাহিড়ী, রবি মজুমদার ও সুধীর মুখার্জীকে নিয়ে গঠিত হয় রংপুর জেলা কমিটি।
পঞ্চাশের মন্বন্তরের (১৯৪৩ সাল) অনুষঙ্গ হিসেবে দেখা দেয় মহামারী। জেলার বিভিন্ন অঞ্চলে ব্যাপকভাবে ছড়িয়ে পড়ে বসন্ত রোগ। পীড়িতদের সেবায় আত্মনিয়োগ করেন মণিকৃষ্ণ সেন। এই প্রসঙ্গে কমরেড শংকর বসু বলেন, “দুর্ভিক্ষ ও মহামারী পীড়িত মানুষকে বাঁচানোর জন্য সে সময়ে পার্টি ও তাঁর (মণিকৃষ্ণ সেন) নেতৃত্বে পরিচালিত ত্রাণ ও পুনর্বাসনের কাজ সারা জেলায় দারুণ প্রভাব ফেলেছিল এবং রংপুরে কমিউনিস্ট পার্টির ব্যাপক গণভিত্তি সৃষ্টিতে সহায়ক হয়েছিল।”
১৯৪৩ সালের মে মাসে অনুষ্ঠিত হয় ভারতের কমিউনিস্ট পার্টির প্রথম কংগ্রেস। এই কংগ্রেসে রংপুর জেলা থেকে ডেলিগেট হিসেবে তাঁকে এবং কৃষক কমরেড যোগেশ সিকদারকে নির্বাচিত করা হয়। ১৯৪৬ সালের মার্চ মাসে অবিভক্ত বাংলাদেশে অনুষ্ঠিত হয় সাধারণ নির্বাচন। এ নির্বাচনের দায়িত্বে মুখ্য ভূমিকা পালন করেন মণিকৃষ্ণ সেন।
তেভাগা আন্দোলনের মূল দাবি ছিল উৎপাদিত ফসলের তিন ভাগের দুই ভাগ কৃষকের এবং একভাগ জোতদারের। উত্তরবঙ্গের দিনাজপুরে ও রংপুরে সামন্তবাদী শোষণের বিরুদ্ধে গড়ে উঠা কৃষকের তেভাগা আন্দোলনে তাঁর ভূমিকা ছিল অনন্য।
তেভাগা আন্দোলনের প্রস্তুতিপর্বে স্থানীয় পার্টি ও কৃষক সমিতিকে সাহায্য করার উদ্দেশ্যে তাঁকে ও কমরেড মোকসেদকে জেলা কমিটির নির্দেশমালাসহ ডিমলা (রংপুরের প্রধান তেভাগা অঞ্চল) পাঠানো হয়। তেভাগা সংগ্রাম চলাকালে অস্ত্রসজ্জিত জোতদারের লোকদের হামলায় গুরুতর আহত হন তিনি।
১৯৪৮ সালের ২২-২৯ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত কলকাতার মোহাম্মদ আলী পার্কে অনুষ্ঠিত হয় কমিউনিস্ট পার্টির দ্বিতীয় কংগ্রেস। এতে তিনি রংপুরের প্রতিনিধি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন। ১৯৫০ সালে পার্টির সিদ্ধান্ত অনুযায়ী তিনি আত্মগোপনে চলে যান । রংপুর জেলার কালীগঞ্জের (বর্তমানে লালমনিরহাট জেলা) কমলবাড়ি গ্রামে আত্মোগোপনে ছিলেন। কিছুদিন যেতে না যেতে পুলিশ তাঁকে গ্রেপ্তার করতে মরিয়া হয়ে উঠে। কিন্তু শেষ পর্যন্ত তাঁকে গ্রেফতার করতে সক্ষম হয়নি।
১৯৫০ সালের সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার সময় শাসকগোষ্ঠীর নির্যাতনের কারণে সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের বিপুল সংখ্যক নেতা ও কর্মী দেশত্যাগ করে ভারতে চলে যেতে বাধ্য হন। ওপার বাংলায় জীবনের নিরাপত্তা ও নানাবিধ সুযোগ-সুবিধা থাকা সত্ত্বেও মণিকৃষ্ণ সেন নিজ দেশের মাটি আর মানুষকে ছেড়ে যাননি। ১৯৫১ সালে তিনি জেলা পার্টির সম্পাদক নির্বাচিত হন।
জেলা পার্টির সিদ্ধান্ত অনুযায়ী তিনি ঢাকায় আত্মগোপনে থেকে ভাষা আন্দোলনের জন্য কাজ করেন। এ সময় তিনি পার্টির প্রাদেশিক কমিটির শিক্ষা কার্যক্রম পরিচালনার সাথেও যুক্ত ছিলেন। আত্মগোপনে থাকা অবস্থায় শুধু রংপুরে নয় খুলনা ও চট্টগ্রামে গিয়েও পার্টির সদস্য ও কর্মীদের রাজনৈতিক ক্লাস নিতেন।
১৯৫৪ সালে যুক্তফ্রন্ট নির্বাচনে রংপুর জেলায় কমিউনিস্ট পার্টির দুজন প্রার্থী ছিলেন অভয় বর্মণ ও অমর রায়। অপর একজন প্রার্থী কান্তেশ্বর বর্মণকে পার্টি সমর্থন প্রদান করেছিল। তিনজন প্রার্থীই নির্বাচিত হন। প্রার্থীদের নির্বাচন পরিচালনার মূল দায়িত্বে ছিলেন মণিকৃষ্ণ সেন। ১৯৫৫ সালে পার্টির প্রাদেশিক কমিটির সদস্য ছিলেন তিনি। ১৯৫৬ সালে মওলানা ভাসানীর নেতৃত্বে কৃষক সমিতিকে পুনর্গঠিত করার চেষ্টা গ্রহণ করা হলে রংপুরের প্রগতিশীল রাজনৈতিক নেতা ও কর্মীদের নেতৃত্ব দান করেন তিনি।
১৯৫৭ সালে রংপুরে দেখা দেয় গুটি বসন্ত। চারদিকে ছড়িয়ে পড়ে মহামারী। এ সময় তিনি আর্তমানবতার সেবায় এগিয়ে আসেন। ১৯৪৩ সালের অভিজ্ঞতা তিনি কাজে লাগান।
১৯৫৭ সালে মওলানা ভাসানীর নেতৃত্বে ন্যাপ গঠিত হওয়ার সময় মণিকৃষ্ণ সেন গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন। রাজনৈতিক প্রজ্ঞার অধিকারী হওয়ায় শুধু রংপুর জেলা কিংবা পূর্ব পাকিস্তান ন্যাপেরই নয় পাকিস্তান ন্যাপের কেন্দ্রীয় কমিটিরও সদস্য নির্বাচিত হয়েছিলেন মণিকৃষ্ণ সেন।
১৯৫৮ সালের ৮ অক্টোবর পাকিস্তান পুলিশ তাঁকে ও শিবেন মুখার্জীকে গ্রেপ্তার করে। মণিকৃষ্ণ সেনকে প্রথমে রাজশাহী জেলে ও পরে ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে বিনা বিচারে আটক রাখা হয়। ১৯৬৩ সালে দু’জনই মুক্তি পান।
১৯৬৪ সালে তিনি পূর্ব পাকিস্তান কমিউনিস্ট পার্টির কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য নির্বাচিত হন। ১৯৬৫ সালের ৭ সেপ্টেম্বর পাকিস্তান পুলিশ তাঁকে আবারো গ্রেপ্তার করে। এ সময় তিনি প্রথমে রংপুর ও পরে ঢাকায় কারাবন্দী ছিলেন।
১৯৬৮ সালের অক্টোবরে অনুষ্ঠিত হয় পূর্ব পাকিস্তান কমিউনিস্ট পার্টির প্রথম কংগ্রেস। এ সময় কমরেড মণিকৃষ্ণ সেন ছিলেন কারাগারে। ১৯৬৯ সালের ২২ ফেব্রুয়ারি জননেতা শেখ মুজিবুর রহমান, মণি সিংহসহ ও আরো অনেকের সঙ্গে তিনি মুক্তি পান।
১৯৭০ সালে রংপুর জেলায় অবস্থিত শ্যামপুর চিনিকলে আখচাষীদের ধর্মঘট হয়। রংপুর টাউনহলে কৃষকদের সম্মেলন আহ্বান করা হয়। সরকারি নিষেধাজ্ঞা অমান্য করে কৃষকরা সম্মেলনে যোগ দেয়। এই আন্দোলনে তিনি সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ করেন।
১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধে তিনি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন। তাঁর মূল্যায়ন প্রসঙ্গে কুচবিহারের তুফানগঞ্জ থেকে প্রকাশিত ‘ঝড়-তুফান’ পত্রিকা-সম্পাদক জীবন দে বলেন, “১৯৭১ সালে বাংলাদেশ মুক্তিসংগ্রামে কমরেড সেন (মণিকৃষ্ণ সেন) ছিলেন মুক্তিযোদ্ধাদের এক বড় সহায়। তুফানগঞ্জে, কুচবিহার দিনহাটা থেকে শীতলকুচি কলকাতায় তিনি ছিলেন সদা তৎপর।” কুচবিহারের তুফানগঞ্জেও মুক্তিযোদ্ধাদের একটি শিবির ছিল। এই শিবিরও পরিচালনা করতেন মণিকৃষ্ণ সেন।
১৯৭১ সালের অক্টোবর মাস। জনগণের সহায়তায় রংপুর জেলের গরাদ ভেঙে অসংখ্য কারাবন্দী মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণের জন্য পশ্চিমবঙ্গে চলে যান। তাঁরা যোগাযোগ করেন মণিকৃষ্ণ সেনের সঙ্গে। ১৯৭২ সালে কমিউনিস্ট পার্টি মুক্তিযুদ্ধে ক্ষতিগ্রস্তদের পুনর্বাসন কর্মসূচি গ্রহণ করে । মণিকৃষ্ণ সেনের নেতৃত্বে পুনর্বাসন কর্মসূচি বাস্তাবায়নে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন পার্টির নেতা ও কর্মীগণ।
১৯৭৩ সালের ৪-৮ ডিসেম্বর পর্যন্ত ঢাকায় অনুষ্ঠিত হয় পার্টির দ্বিতীয় কংগ্রেস। এ কংগ্রেসেও তিনি কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য নির্বাচিত হন। ওই বছর দুর্ভিক্ষ নেমে আসে বাংলার বুকে। চারদিকে শুরু হয় মৃত্যুর বিভীষিকা। দুর্ভিক্ষপীড়িত অসহায় মানুষের প্রাণ বাঁচাতে এগিয়ে আসে কমিউনিস্ট পার্টি। এতে নেতৃত্ব প্রদান করেন মণিকৃষ্ণ সেন।
বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডের পর ১৯৭৫ সালের ৪ নভেম্বর মণিকৃষ্ণ সেন কলকাতায় যান এবং সেখানে অসুস্থ হয়ে পড়েন। দীর্ঘ দিন অসুস্থ থাকার পর ১৯৭৯ সালে কলকাতা থেকে দেশে ফিরে আসেন।
১৯৮০ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে কমিউনিস্ট পার্টির তৃতীয় কংগ্রেস অনুষ্ঠিত হয়। পার্টির সভাপতি পদে কমরেড মণি সিংহ ও সম্পাদক পদে কমরেড মোহাম্মদ ফরহাদ নির্বাচিত হন। এ সময় কমরেড মণিকৃষ্ণ সেন নির্বাচিত হন অন্যতম সদস্য। ১৯৮১ সালে আবারো কমিউনিস্ট পার্টি নিষিদ্ধ হয়। মণিকৃষ্ণ সেনকে সামরিক বাহিনী গ্রেপ্তার করে। দুমাস রংপুর কারাগারে থাকার পর তিনি স্ট্রোক করেন। চিকিৎসার জন্য তাঁকে কলকাতায় পাঠানো হয়। কলকাতা থেকে ফিরে এসে তিনি রংপুরে শহরের নিকটবর্তী রাজেন্দ্রপুর গ্রামে আত্মগোপন করেন।
১৯৮৫ সালের ২০ সেপ্টেম্বর তিনি তাঁর প্রয়াত মার নামে প্রতিষ্ঠা করেন ‘প্রমোদা সুন্দরী সেন কল্যাণ ট্রাস্ট’। ঐ বছরই তাঁর প্রয়াত বাবার নামে তিনি ‘বিষ্ণুপুর হাইস্কুলে’র নামকরণ করেন ।
১৯৮৭ সালের ৭-১১ এপ্রিলে অনুষ্ঠিত হয় কমিউনিস্ট পার্টির চতুর্থ কংগ্রেস। এই কংগ্রেসে কমরেড মণিকৃষ্ণ সেন কমিউনিস্ট পার্টির কন্ট্রোল কমিশনের সদস্য নির্বাচিত হন। তাঁর এই সুদীর্ঘ আন্দোলন- সংগ্রামের অবসান হয় ১৯৯১ সালের ২৮ অক্টোবর। কারণ এই দিনে তিনি পৃথিবী থেকে চিরবিদায় নেন।
তথ্য ও ছবিসূত্র:
১. কমরেড মণিকৃষ্ণ সেন জীবন ও সংগ্রাম – মোতাহার হোসেন সুফী; প্রকাশকাল : ১৯৯৭
২. কমরেড মণিকৃষ্ণ সেনের সাক্ষাৎকার : সাপ্তাহিক একতা, ১৯৮৮
৩. তেভাগা আন্দোলনের ইতিহাস – ধনঞ্জয় রায়
৪. কৃষক আন্দোলনের ইতিহাস – আমজাদ হোসেন
লেখক : রফিকুল ইসলাম (শেখ রফিক)