“আমার জীবনের পেশা কি হবে,- সাহিত্য, না, রাজনীতি এই নিয়ে আমি পুরো ১৯১৯ সাল ভেবেছি। সত্য কথা বলতে, আমার মনের ভিতরে সাহিত্য ও রাজনীতির দ্বন্দ্ব চলেছিল। কবি আমি ছিলেম না। গল্প লেখক বা ঔপন্যাসিক হওয়ার স্বপ্ন আমি কোনোদিন দেখিনি। সেই ভাষা কোনদিন আমার আয়ত্তে ছিল না। আমার প্রবল বাসনা ছিল যে আমি একজন প্রবন্ধকার হব। আমার পরবর্তী জীবনেও, অর্থাৎ রাজনীতিক জীবনে তা হওয়ার পথে কোনো প্রতিবন্ধক ছিল বলে আমার মনে হয় না। তবুও আমি প্রবন্ধকারও হতে পারিনি, যদিও আমি খবরের কাগজ চালিয়েছি। আমার মনে যে সাহিত্য ও রাজনীতির দ্বন্দ্ব চলেছিল তাতে শেষ পর্যন্ত জয় হলো রাজনীতির। একটা কিছুতে নিজেকে যে বিলিয়ে দেব সে তো আগেই স্থির করেছিলাম। সেইজন্যই তো আমি ‘বঙ্গীয় মুসলমান সাহিত্য সমিতি’-র সব সময়ের কর্মী হতে পেরেছিলাম। ১৯২০ সালের শুরুতে আমি স্থির করে ফেললাম যে রাজনীতিই হবে আমার জীবনের পেশা। আমি রাজনীতিক সভা-সমিতি ও মিছিলে যোগ দেওয়া শুরু করেছিলাম তো ১৯১৬ সাল হতে”। (‘আমার জীবন ও ভারতের কমিউনিষ্ট পার্টি’-লেখক মুজফ্ফর আহমদ। পৃষ্ঠা-৩৯)
উপরের এই কথাগুলো বলেছেন বিশ্ববরেণ্য রাজনীতিবীদ, বিপ্লবী, ভারত উপমহাদেশের কমিউনিষ্ট পার্টি ও কমিউনিষ্ট আন্দোলনের পুরোধা ব্যক্তিত্ব মুজফফর আহমদ। তাঁর উত্তরসূরী নেতৃবৃন্দ তাঁকে ‘কাকাবাবু’ বলে ডাকতেন। এই নামে তিনি বেশ পরিচিতি পেয়েছিলেন।
মুজফফর আহমদ বাংলা ১২৯৬ সালের শ্রাবণ মাসের কোন এক সোমবার সন্দ্বীপের মুছাপুর গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁদের দরিদ্র পরিবারের কারুরই জন্মবার্ষিকী পালিত হত না। তাঁর জন্ম তারিখও কোনোদিন পালিত হয়নি। তাই জন্মের তারিখ তাঁর মনে নেই। মায়ের মুখে শুনে শুধু সাল, মাস ও বারের কথাই তাঁর মনে আটকে রয়েছে। ১২৯৬ সালের শ্রাবণ মাসের ৭, ১৪, ২১ ও ২৮ তারিখ সোমবার ছিল। খ্রিস্টীয় সনের হিসাবে এই তারিখগুলো ১৮৮৯ সালের ২২ জুলাই, ২৯ জুলাই, ৫ আগস্ট ও ১২ আগস্ট ছিল। এই চারটি তারিখের মধ্যে কোনটি ছিল তাঁর প্রকৃত জন্মদিন তা জানার আর কোন সম্ভাবনা নেই। সাধারণত আগস্ট মাসকেই তিনি তাঁর জন্মের মাস বলে থাকেন। পরে তিনি ৫ আগস্টকে নিজের জন্মদিন বলে মনস্থির করেন।
বাবা মুন্সি মনসুর আলি (১৮২৭-১৯০৫)। তিনি সন্দ্বীপের আদালতে আইন ব্যবসা করতেন। মা চুনা বিবি। চুনা বিবি মুন্সী মনসুর আলির দ্বিতীয় স্ত্রী। মনসুর আলির দুই পরিবারে ৪টি ছেলে সন্তানের জন্ম হয়। দ্বিতীয় স্ত্রী চুনা বিবির ঘরে মুজফফর আহমদের জন্ম। তিনি ছিলেন ভাইদের মধ্যে সবার ছোট।
বর্ণমালার হাতেখড়ি বাবার কাছে। তারপর মদন মোহন তর্কালঙ্কারের কাছে শিশুশিক্ষা প্রথম ভাগ শেষ করেন। ১৮৯৭ সালে তিনি গ্রামের প্রাইমারি স্কুলে ভর্তি হন। ১৮৯৯ সালে প্রাইমারি পড়াশুনা সমাপ্ত করে হরিশপুর মডেল ইংলিশ স্কুলে ভর্তি হন। কিন্তু এই স্কুলে দু’বছরের বেশি পড়াশুনা করতে পারেননি। স্কুলের বেতন বকেয়া পড়ার কারণে তাঁর নাম কাটা যায়। এ সময়ে তিনি কিছুদিন কোরান পাঠ শেখেন। পারিবারিকভাবে তিনি ফার্সি ভাষা জানতেন। কিছুদিন পর বামনির আখতারিয়া মাদ্রাসায় ভর্তি হন। এখানে পড়াশুনার সময় ১৯০৫ সালে তাঁর বাবা মারা যান। তখন তাঁর বয়স ছিল ১৬ বছর। সংসারের অভাব অনটনের মধ্যে তাঁর পড়াশুনা বন্ধ হয়ে যাওয়ার পালা। এই সময় একদিন ডেপুটি স্কুল ইন্সপেক্টর উমেশ চন্দ্র দাশগুপ্ত মুজফফর আহমদকে ইংরেজি পড়ার জন্য উৎসাহ দিলেন। তিনি মুজফফর আহমদকে আগে থেকেই চিনতেন। তাঁর পরামর্শে তিনি বরিশালের বুড়িরচর গ্রামে যান। সেখানে তিনি এক কৃষক পরিবারে শিশুদের গৃহশিক্ষক নিযুক্ত হন। উদ্দেশ্য, কিছু টাকাকড়ি সঞ্চয় করে বরিশালের কোন স্কুলে ভর্তি হওয়া। ইতিমধ্যে বড় ভাই মকবুল আলি খোঁজ-খবর নিয়ে বুড়িরচরে গিয়ে মুজফফর আহমদকে সন্দ্বীপে ফিরিয়ে নিয়ে আসেন। দীর্ঘ ৫ বছর পর বড় ভাই তাঁকে সন্দ্বীপের স্কুলে ভর্তি করে দেন।
পড়াশুনার পাশাপাশি তিনি লেখালেখি করার চেষ্টা করতেন। ১৯০৭ সালে কলকাতার সাপ্তাহিক ‘সুলতান’-এ তাঁর প্রথম লেখা প্রকাশিত হয়। তিনি সন্দ্বীপ থাকার সময় ওই পত্রিকায় স্থানীয় খবর পাঠাতেন। সম্পাদক মাওলানা মনিরুজ্জামান ইসলামাবাদী তাঁকে লেখালেখি করার জন্য উৎসাহ দিতেন।
১৯১০ সালে মুজফফর আহমদ নোয়াখালী জেলা স্কুলে ভর্তি হন। ১৯১৩ সালে ২৩ বছর বয়সে তিনি এই স্কুল থেকে দ্বিতীয় বিভাগে ম্যাট্রিক পাস করেন। এরপর তিনি হুগলি কলেজে আই.এ. ভর্তি হন। তিনি ছাত্র পড়িয়ে নিজের খরচ ও পড়াশুনার খরচ যোগাতেন। এ ছাড়া তাঁর বড় ভাই কিছু টাকা দিতেন। হুগলিতে পড়াশুনার সময় তিনি ম্যালেরিয়ায় আক্রান্ত হয়ে কলকাতা চলে যান। তারপর তিনি কলকাতার বঙ্গবাসী কলেজে ভর্তি হন। এ কলেজ থেকে আই.এ. পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন। আই.এ. পড়াশুনার সময় তিনি কলকাতায় মুসলমান সাহিত্য সমিতির সভ্য হন। ১৯১৫ সালে সমিতির সহ-সম্পাদক নির্বাচিত হন। ১৯১৬ সালে এক বছর ধরে এখানে ওখানে চাকরি করেন।
১৯১৭ সালে যোগ দেন বেঙ্গল গভর্নমেন্ট প্রেসের সহকারী স্টোর কিপার পদে। এ কাজে তিনি এক বছর ছিলেন। মাসিক বেতন ছিল ত্রিশ টাকা। এরপর তিনি মাসিক পঞ্চাশ টাকা বেতনে গভর্নমেন্টের হোম ডিপার্টমেন্টে উর্দু থেকে বাংলা অনুবাদকের কাজ করেন। এখানে তিনি মাত্র একমাস কাজ করেন। পরবর্তী একমাস তিনি কলকাতায় স্কুল পরিদর্শকের অফিসে কাজ করেন। ১৯১৮ সালে তিনি বঙ্গীয় মুসলমান সাহিত্য সমিতির সার্বক্ষণিক কর্মী হন। তিনি উদ্যোগী হয়ে ৩২ নং কলেজ স্ট্রিটে ষাট টাকা ভাড়ায় সমিতির কার্যালয় স্থাপন করেন। এই সময় ত্রৈমাসিক ‘বঙ্গীয় মুসলমান সাহিত্য পত্রিকা’ বের হত। পত্রিকার যুগ্ম সম্পাদক হিসাবে ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ ও মোহাম্মদ মোজাম্মেল হকের নাম ছাপা হলেও সম্পাদকীয়র সব কাজ মুজফফর আহমদই করতেন। ১৯১৯ সালে জালিয়ানওয়ালাবাগের হত্যাকাণ্ডের প্রতিবাদে কলকাতায় অনুষ্ঠিত বিক্ষোভ মিছিলে তিনি অংশগ্রহণ করেন।
পত্র যোগাযোগের মাধ্যমে কাজী নজরুল ইসলামের সাথে মুজফফর আহমদ-এর বন্ধুত্ব গড়ে ওঠে। ১৯২০ সালে কাজী নজরুল ইসলাম কলকাতায় চলে আসেন। এসময় মুজফফর আহমদ ও কাজী নজরুল ইসলাম দীর্ঘদিন একসাথে বসবাস করেন।
ওই সময় শেরে বাংলা এ. কে. ফজলুল হক ছিলেন কংগ্রেস ও খেলাফতের একজন অন্যতম নেতা। মুজফফর আহমদ তাঁর কাছে একটি পত্রিকা প্রকাশের প্রস্তাব দেন। তিনি সম্মতি প্রদান করেন। তারই ধারাবাহিকতায় ১৯২০ সালের ১২ জুলাই এ. কে. ফজলুল হক প্রতিষ্ঠিত সান্ধ্য দৈনিক ‘নবযুগ’-এর যুগ্ম সম্পাদক হন মুজফফর আহমদ। আর সম্পাদক ছিলেন কাজী নজরুল ইসলাম। এই পত্রিকায় মুজফফর আহমদ শ্রমিকদের জীবন-জীবিকার সমস্যা নিয়ে প্রবন্ধ লিখতেন। ওই বছর মুজফফর আহমদ বঙ্গীয় খিলাফত কমিটির সদস্য মনোনীত হলেও তিনি তা প্রত্যাখ্যান করেন। ব্রিটিশ বিরোধী লেখা প্রকাশের জন্য ব্রিটিশ সরকার ‘নবযুগ’ পত্রিকার এক হাজার টাকা জামানত বাজেয়াপ্ত করে। মুজফফর আহমদ আবার ফজলুল হকের কাছে দু’হাজার টাকা নিয়ে জামানত দাখিল করেন। শুরুতে ‘নবযুগ’ চারহাজার কপি ছাপা হত। কাজী নজরুল ইসলামের ‘অগ্নিবীণা’র জাগরণমূলক কবিতাগুলো এ পত্রিকাতেই প্রথম প্রকাশিত হয়েছিল।
‘নবযুগ’ কৃষক-মজুরের অধিকার আদায়ের দাবি সমর্থন করত। এ ব্যাপারে ফজলুল হকের কাছে কেউ বিরূপ মন্তব্য করেন। ফলে সম্পাদকীয় নীতিমালা বেঁধে দিতে উদ্যত হন ফজলুল হক। যার কারণে ১৯২১ সালের জানুয়ারি মাসে প্রথমে কাজী নজরুল ইসলাম ও পরে মুজফফর আহমদ ‘নবযুগ’ ছেড়ে দেন। কিছুদিন পর পত্রিকাটিও বন্ধ হয়ে যায়।
প্রথম বিশ্বযুদ্ধ শেষে সারা পৃথিবীতে একটা নব জাগরণ সৃষ্টি হয়। এর প্রভাব ভারতবর্ষেও পড়ে। এসময় মৌলানা আবুল কালাম আজাদ কলকাতা টাউন হলে পরপর তিন দিন ছয় ঘন্টা করে বক্তৃতা করেন। মুজফফর আহমদ সেই বক্তৃতা শুনে প্রভাবিত হন। ১৯১৭ সালে রাশিয়ায় যে বিপ্লব হয়, তাও তাঁকে প্রভাবিত করে। রুশ বিপ্লবের কিছু কিছু তথ্য, প্রচারমূলক বই ও মার্কসবাদী সাহিত্য গোপন পথে এদেশে আসতে শুরু করে। মুজফফর আহমদ তা পাঠ করে মার্কসবাদের প্রতি আগ্রহী হয়ে ওঠেন। জনগণের দুঃখ-দুর্দশা লাঘব করার মতাদর্শের সন্ধান পেয়ে তিনি সেই পথের অভিযাত্রী হয়ে যান।
১৯২০ সালের ১৭ অক্টোবর তাসখন্দে প্রথম ভারতের কমিউনিস্ট পর্টি প্রতিষ্ঠিত হয়। উদ্যোক্তা ছিলেন এম. এন. রায়। এই সময় মুজফফর আহমদ আন্তর্জাতিক কমিউনিস্ট আন্দোলনের সাথে যোগাযোগ স্থাপন করেন এবং বিদেশ থেকে অনেক পত্রপত্রিকা সংগ্রহ করতে থাকেন।
১৯২১ সালে এ পার্টি কমিউনিস্ট ইন্টারন্যাশনাল এর অনুমোদন পায়। এই প্রবাসী পার্টির কাজ জার্মানিতেও সম্প্রসারিত হয়। জার্মানি থেকে ১৯২২ সালের ১৫ মে পার্টির পত্রিকা প্রকাশিত হয়। এ পত্রিকা ডাকযোগে ভারতের বিভিন্ন স্থানে বিভিন্ন ব্যক্তির নামে পাঠানো হত। এক সময় এ পত্রিকা পুলিশের হাতে পড়ে। মুজফফর আহমদ তখন পত্রিকার নাম পরিবর্তনের জন্যে এম. এন. রায়কে লেখেন। এম. এন. রায় পত্রিকাটির নতুন নামকরণ করেন।
১৯২১ সালের শেষ দিকে কমিউনিস্ট সংগঠনের সঙ্গে তাঁর যোগাযোগ হয়। একই সময় ভারতবর্ষের বিভিন্ন এলাকায় আরো কয়েকজন মার্কসবাদে আকৃষ্ট হন। তাঁদের সাথেও মুজফফর আহমদের যোগাযোগ হয়। তাঁরা হলেন, মুম্বাই- এর শ্রীপদ অমৃত ডাঙ্গে, মস্কো থেকে কাবুলে আগত মোহাম্মদ আলি, পেশোয়ার ইসলামকি কলেজের অধ্যাপক গোলাম হোসেন প্রমুখ। এছাড়া ১৯২২ সালের শেষ দিকে মস্কো থেকে কলকাতায় প্রত্যাগত শওকত ওসমানির সাথেও মুজফফর আহমদের পরিচয় হয়। এসময় ভারতবর্ষে যাঁরা কমিউনিজম নিয়ে চিন্তা-ভাবনা করতেন তাঁদের সাথে মুজফফর আহমদের যোগাযোগ স্থাপিত হয়।
১৯২১ সালের নভেম্বর মাসে মাদ্রাজ, বোম্বাই ও পাঞ্জাবের বিভিন্ন কমিউনিস্ট গ্রুপের সঙ্গে মুজফফর আহমদ যোগাযোগ করার কাজ শুরু করেন। ১৯২১ সালের ডিসেম্বর মাসে ভারতের কমিউনিস্ট পার্টির প্রথম মুদ্রিত ইশতেহার প্রচার করা হয়। আহমেদাবাদে অনুষ্ঠিত জাতীয় কংগ্রেসের অধিবেশনের প্রতিনিধিদের সম্বোধন করে পূর্ণ স্বাধীনতার ডাক দিয়ে এই ইশতেহার রচিত হয়।
১৯২২ সালের শেষের দিকে আব্দুল হালিমের সঙ্গে মুজফফর আহমদের দেখা হয়। দু’জনে মিলে ভারতের কমিউনিস্ট পার্টি গড়ার কাজ শুরু করেন। প্রথম যুগে এঁদের সঙ্গে ছিলেন আব্দুর রেজ্জাক খান।
১৯২২ সালের ১৫ মে পার্টির প্রথম পত্রিকা প্রকাশিত হয়। নাম ছিল ‘দি ভ্যানগার্ড অব দি ইন্ডয়ান ইন্ডিপেন্ডেন্স’। পুলিশের নজর পড়ায় নাম বদলে হয় ‘অ্যাডভান্স গার্ড’। তারপর ভারতের কমিউনিস্ট পার্টির মুখপত্র হিসেবে ‘দি ভ্যানগার্ড’ প্রকাশিত হয়। এই সময়কালেই নজরুল ইসলাম সম্পাদিত ‘ধুমকেতু’ পত্রিকায় দ্বৈপায়ন ছদ্মনামে দেশের রাজনৈতিক সমস্যা এবং কৃষক ও শ্রমিকদের সমস্যা নিয়ে মুজফফর আহমদ বিশ্লেষণাত্মক রচনা লেখেন।
ভারতবর্ষের ভিতরে কমিউনিস্ট পার্টি গঠন প্রসঙ্গে মুজফফর আহমদ বলেন, “আগে পরে চার জায়গায় ভারতে কমিউনিস্ট পার্টি গড়ার কাজ আরম্ভ হয়েছিল। উদ্যোক্তারা একত্রে মিলিত হয়ে আলোচনা করে যে এই সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন তা নয়, প্রত্যেক জায়গায় পৃথক পৃথকভাবে উদ্যোক্তারা কাজ শুরু করেছিলেন। তাদের একজনের সঙ্গে আরেকজনের পরিচয় ছিল না। ভারতবর্ষ একটি বিশাল দেশ। প্রথম চারটি জায়গা হলো কলকাতা, বোম্বে, লাহোর ও মাদ্রাজ। এক জায়গা হতে অন্য জায়গার দূরত্ব এক হাজার মাইলেরও অনেক বেশি। এত দূরে থেকেও আমরা সারা ভারতের পার্টি গড়ার কাজে নেমেছিলাম। কারণ কমিউনিস্ট আন্দোলন আন্তর্জাতিক। আমাদের সকলের মধ্যে বিন্দু ছিল কমিউনিস্ট ইন্টারন্যাশনাল। তার কেন্দ্র ছিল বহু হাজার মাইল দূরে মস্কোতে। কমিউনিষ্ট ইন্টারন্যাশনালই কোন কোন ক্ষেত্রে আমাদের একজনের সঙ্গে অপরের পরিচয় ঘটিয়ে দিয়েছিলেন”।
১৯২৩ সাল থেকে মুজফফর আহমদ ট্রেড ইউনিয়ন কংগ্রেসের সঙ্গে যুক্ত হন এবং বিভিন্ন স্থানে শ্রমিক আন্দোলনে অংশগ্রহণ করেন। পূর্বে জড়িত হয়েছিলেন ইন্ডিয়ান সীমান্ত এসোসিয়েশনের সঙ্গে। তখন থেকেই গোয়েন্দা বিভাগের লোকেরা তাঁর গতিবিধির উপর নজর রাখতে শুরু করে। ১৯২৩ সালের ১৭ মে পুলিশ তাঁকে গ্রেপ্তার করে রাজবন্দী হিসেবে কারাগার আটকে রাখে। ওই সময় ভারতবর্ষের পেশোয়ারে প্রথম কমিউনিস্ট ষড়যন্ত্র মামলা চলছিল। ওই মামলায় মুজফফর আহমদকে জড়ানোর চেষ্টা হয়েছিল। কিন্তু প্রমাণাভাবে তা সম্ভব হয়নি। তবে ১৯২৪ সালের মার্চ মাসে ‘কানপুর বলশেভিক ষড়যন্ত্র মামলা’য় মুজফফর আহমদ, শ্রীপদ আমৃত ডাঙ্গে, শওকত ওসমানি ও নলিনী গুপ্তের চার বছর করে সাজা দেয়া হয়। যক্ষ্মা রোগে আক্রান্ত হওয়ার কারণে ১৯২৫ সালের ১২ সেপ্টেম্বর তাঁকে মুক্তি দেওয়া হয়।
মুক্তি পাওয়ার পর তিনি কৃষকদের মাঝে কাজ শুরু করেন। সংগঠিত করেন কৃষকদের। ১৯২৫ সালের পয়লা নভেম্বর কলকাতায় ‘লেবার স্বরাজ পার্টি’ গঠিত হয়। ১৯২৬ সালে কৃষ্ণনগরে অনুষ্ঠিত কৃষক সম্মেলন তাঁর উদ্যোগে হয়েছিল। ওই সম্মেলনে ‘মজুর-কৃষক পার্টি’ গঠিত হয়। প্রথমে ‘লাঙল’ নামে ‘মজুর-কৃষক পার্টি’র পক্ষ থেকে পত্রিকা প্রকাশিত হয়। পরে ১৯২৬ সালের ১২ আগস্ট থেকে ‘গণবাণী’ সাপ্তাহিক প্রকাশিত হতে থাকে। এই পত্রিকার সম্পাদনার দায়িত্ব পড়ে মুজফফর আহমদের উপর।
১৯২৭ সালে কলকাতায় ডক-মজুর ধর্মঘট, মেথর ধর্মঘট, চটকল মজুর ধর্মঘট ইত্যাদিতে তিনি প্রত্যক্ষ ভূমিকা পালন করেন। ১৯২৭ ও ১৯২৮ সালে ভারতের বিভিন্ন স্থানে শ্রমিকদের আন্দোলন জোরদার হয়। এসব আন্দোলনে কমিউনিস্ট পার্টি ও ‘মজুর-কৃষক পার্টি’ একযোগে কাজ করে।
১৯২৭ সালের ৩১ মে বোম্বেতে কমিউনিস্টদের এক সম্মেলনে মুজফফর আহমদ যোগদান করেন। ১৯২৮ সালের ২২-২৩ ডিসেম্বর কলকাতায় সর্বভারতীয় ‘ওয়ার্কার্স অ্যান্ড পিজেন্টস পার্টি’র সম্মেলন অনুষ্ঠানের প্রধান উদ্যোক্তা ছিলেন তিনি। এর তিন দিন আগে ঝরিয়ায় অনুষ্ঠিত আইটিইউসি’র অধিবেশনে প্রতিনিধিদের ভোটে মুজফফর আহমদসহ তিনজন কমিউনিস্ট সভাপতি নির্বাচিত হন।
১৯২৯ সালের ২০ মার্চ ব্রিটিশ সরকার বিভিন্ন এলাকা থেকে কমিউনিস্ট নেতাদের গ্রেফতার করে। এসময় মুজফফর আহমদকেও গ্রেফতার করা হয়। তাঁর বিরুদ্ধে ‘মীরাট কমিউনিস্ট ষড়যন্ত্র মামলা’ দায়ের করা হয়। এই মামলায় অভিযুক্ত করা হয় ৩১ জনকে। ৪ বছর ধরে চলে এ মামলা। ১৯৩৩ সালের ৯ জানুয়ারি মামলার রায় হয়। মুজফফর আহমদকে যাবজ্জীবন কারাদন্ড দেওয়া হয়। পরে আপিলে এ সাজা কমিয়ে ৩ বছর করা হয়। এই তিন বছর তিনি মীরাট, নৈনি, আলজোড়া, দার্জিলিং, বর্ধমান এবং ফরিদপুর জেলে ছিলেন।
জেল থেকে মুক্ত হবার পর তাঁকে নজরবন্দিতে রাখা হয়। প্রথমে ফরিদপুর, পরে নিজের গ্রামের বাড়ি সন্দ্বীপে ও মেদিনীপুরের এক গ্রামে তাঁকে অন্তরীণ রাখা হয়। ব্রিটিশ সরকার সশস্ত্র বিপ্লববাদীদের দমনের জন্য ‘বেঙ্গল অর্ডিনান্স’ আইন চালু করেছিল, সেই আইনে তাঁকে গ্রেপ্তার করা হয়েছিল। ১৯৩৬ সালের ২৫ জুন তিনি মুক্তি পান।
মুক্তি পাওয়ার পর পার্টিকে সংগঠিত করার কাজে নিজেকে নিয়োজিত করেন। যেসব বিপ্লবী কর্মী কারামুক্ত হয়ে আসেন, তিনি তাঁদের সাথে যোগাযোগ করে বিভিন্ন জেলায় পার্টি গঠনের ব্যবস্থা করেন। ১৯৩৮ থেকে ১৯৪০ সালের মধ্যে যুক্তবঙ্গের ২৮টি জেলাতেই কমিউনিস্ট পার্টি গড়ে ওঠে। এতটুকু সময়ের মধ্যে পার্টির সভ্য সংখ্যা আড়াই থেকে তিন হাজারে উন্নীত হয়।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শুরু হবার পর ১৯৪০ সালে ব্রিটিশ সরকার আবারও কমিউনিস্টদের প্রতি সন্দেহ পোষণ করে। এ সময় কলকাতার শ্রমিকদের মাঝে মুজফফর আহমদের খুব প্রভাব ছিল। যার কারণে সরকার ওই বছর ফেব্রুয়ারী মাসে তাঁকে কলকাতা ছেড়ে যাবার আদেশ দেয়। আদেশ অমান্য করায় তাঁর এক মাসের জেল হয়। মুক্তিলাভের পর আবারও তাঁকে কলকাতা ছাড়ার আদেশ দেওয়া হয়। এবার তিনি প্রকাশ্যে কলকাতা ত্যাগ করে চলে যান। কিন্তু ১৯৪০ সালের ২৩ জুন গোপনে কলকাতায় ফিরে আসেন। তখন থেকে ১৯৪২ সালের ২৩ আগস্ট পর্যন্ত গোপনে পার্টির কাজ চালিয়ে যান।
১৯৪৫ সালে ময়মনসিংহের নেত্রকোণা নিখিল ভারত কৃষক সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। তিন দিনব্যাপী এ সম্মেলনে মুজফফর আহমদ সভাপতিত্ব করেন। ১৯৪৮ সালে কলকাতায় ভারতের কমিউনিস্ট পার্টির একক কংগ্রেস অনুষ্ঠিত হয়। এই কংগ্রেস ছাড়া (কারণ দেশভাগের পর তথাকথিত পূর্ব পাকিস্তানের নেতারা তাঁকে অবাঞ্চিত ঘোষণা করে) প্রত্যেকটি পার্টি কংগ্রেসে তিনি কেন্দ্রীয় কমিটিতে নির্বাচিত হন। দেশ বিভাগের পূর্বে তিনি বঙ্গীয় পার্টির সম্পাদক ছিলেন। তিনি জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য ছিলেন। এই সম্মেলনে ভারত ও পাকিস্তান কমিউনিস্ট পার্টি আলাদা আলাদা ভাবে কাজ চালানোর সিদ্ধান্ত নেয়।
১৯৪৮ সালের ২৫ মার্চ কমিউনিস্ট পার্টি বেআইনি ঘোষিত হলে ভারত সরকার এই আইনে মুজফফর আহমদকে গ্রেপ্তার করে। ১৯৫১ সালের ২৭ এপ্রিল তিনি মুক্তি পান। ওই বছর তিনি রাজ্য পার্টির সম্পাদক হন। ১৯৫৭ সালে তিনি শারীরিক অসুস্থতার কারণে পার্টির সম্পাদক পদ ছেড়ে দেন। তখন জ্যোতিবসু সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করেন।
ওই সময় সোভিয়েত ইউনিয়ন ও চীনের কমিউনিস্ট পার্টির মতভেদ ভারতের কমিউনিস্ট পার্টির উপর প্রভাব ফেলে। যার ফলে ১৯৬৮ সালে ভারতের কমিউনিস্ট পার্টি দুই ভাগে বিভক্ত হয়ে যায়। মুজফফর আহমদের নেতৃত্বাধীন অংশের নাম দেওয়া হয় সিপিআই (এম) বা ভারতের কমিউনিস্ট পার্টি (মার্কসবাদী)। এরা ছিল সোভিয়েত পন্থী।
১৯৬৯ সালে সশস্ত্র কৃষক অভ্যুত্থানের মাধ্যমে ক্ষমতা দখলের ঘোষণা দিয়ে গঠিত হয় সিপিআই (এম-এল) বা ভারতের কমিউনিস্ট পার্টি (মার্কসবাদী-লেনিনবাদী)। এরা প্রধানত মাও সে তুং (মাও জে ডং) ও চীনের অনুসারী। মুজফফর আহমদ এই সময়েও মস্কো ও পিকিং-এর অন্ধ অনুসরণের বিরোধীতা করেন।
১৯৭১ সালে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধকে সিপিআই (এম) পূর্ণ সমর্থন দেয়। ঐ দিনগুলোতে পার্টি মুখপত্র ‘গণশক্তি’র দৈনন্দিন সংবাদ সমালোচনা ও সম্পাদকীয়তে তার স্বাক্ষর মেলে। মুজাফফর আহমদের ভাষায়, “পশ্চিম পাকিস্তানের অত্যাচার হতে মুক্ত হবার জন্য বাংলাদেশের মানুষেরা যেভাবে সংগ্রাম চালিয়েছেন, তার তুলনা দুনিয়ার ইতিহাসে কম। আমি বাংলাদেশের মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য নিজেকে গৌরবান্বিত মনে করি। আমি একজন অক্ষম অসমর্থ বৃদ্ধ, যদি আমার শরীরে শক্তি থাকত, তা হলে আমিও বাংলাদেশের মুক্তি ফৌজে যোগ দিতাম”।
দীর্ঘ ৫২ বছর মুজফফর আহমদ কর্মীদের মার্কসবাদী সাহিত্য অধ্যয়ন, প্রকাশ ও প্রচারের তাৎপর্য ব্যাখ্যা করেছেন। ১৯৩৬ সালে ‘গণশক্তি’ পুনঃপ্রকাশ করেন এবং এরপর ‘আগে চলো’ পত্রিকা প্রকাশ করেন। ১৯৪৫ সালের ডিসেম্বরে বাংলা ও হিন্দিতে দৈনিক ‘স্বাধীনতা’ এবং সাপ্তাহিক ‘মতামত’ প্রকাশ করেন। ১৯৩৯ সালে সুরেন দত্তের সহায়তায় ‘ন্যাশনাল বুক এজেন্সি’ প্রকাশনাকে পার্টির আওতায় আনেন। সুনীল বসু (কাটু) প্রমুখকে সঙ্গে নিয়ে ১৯৪২ সাল থেকে ‘ন্যাশনাল বুক এজেন্সি’কে সুন্দর ও সুষ্ঠুভাবে গড়ে তোলার কাজে তাঁর নাম অবিস্মরণীয় হয়ে আছে। গোপন ছাপাখানার কর্মী কালী চৌধুরী ও সমীর দাশগুপ্তকে নিয়ে তিনি ১৯৫২ সালে ‘গণশক্তি’ প্রিন্টার্স প্রতিষ্ঠা করেন।
মুজফফর আহমদের জীবনের বেশিরভাগ সময় কেটেছে পার্টি অফিসে, কারাগারে কিংবা গোপন আস্তানায়। এ ছাড়া পার্টি কর্তৃক ভাড়া করা ঘরে অথবা কর্মস্থলে। নিজের আর্থিক নিরাপত্তার জন্য বা ব্যক্তিগত সম্পত্তি হিসেবে কিছু করেননি। তিনি অবিবাহিত ছিলেন। জীবনের শেষ দিনগুলোতে পার্টি কর্তৃক নিয়োজিত একজন কর্মী তাঁর দেখাশুনা করতেন। মৃত্যুর আগে প্রায় সাত মাস তিনি কলকাতায় একটি নার্সিং হোমে ভর্তি ছিলেন। ১৯৭৩ সালের ১৮ ডিসেম্বর তিনি মারা যান।
তথ্য ও ছবিসূত্র :
১। আমার জীবন ও ভারতের কমিউনিষ্ট পার্টি: মুজফফর আহমদ (অখণ্ড)। ন্যাশনাল বুক এজেন্সি প্রাইভেট লিমিটেড, কলকাতা। প্রকাশকাল ২০০৬।
২। আমাদের পূর্বসূরিরা: সম্পাদক-তন্ময় ভট্টাচার্য। ন্যাশনাল বুক এজেন্সি প্রাইভেট লিমিটেড, কলকাতা। প্রকাশকাল, মার্চ ২০০৮।
৩। ছোটদের মুজফফর আহমদ: দীপঙ্কর গৌতম। জাতীয় সাহিত্য প্রকাশনী, পুরানা পল্টন, টাকা। প্রকাশকাল ফেব্রুয়ারী ২০০৯।
লেখক : রফিকুল ইসলাম (শেখ রফিক)