দিনটি ছিল ১৮৫৭ সালের ২৯ মার্চ। রোববার অপরাহ্ন। বারাকপুরের সৈনিক নিবাস।
দু’জন ভারতীয় সৈনিকের মধ্যে ফিস ফিস করে কথা হচ্ছে: “সর্বনাশের আর দেরী নেই, সৈন্যভর্তি অনেকগুলো যুদ্ধ জাহাজ কলকাতা বন্দরে এসে পৌঁচেছে। তারা সব এখানে এসে আমাদের স্থান অধিকার করে নেবে। কে বললো এই কথা?”
“সকলে জানে, আর তুমি জান না? আমরা সময় থাকতে যদি কিছু না করি, তাহলে আমাদের দুর্দশার আর সীমা থাকবে না”।
“তাহলে”?
মুখে মুখে এই সংবাদ ছড়িয়ে গেল সৈনিকদের মাঝে। কিন্তু কে দেখাবে পথ?
এগিয়ে এলো এক অগ্নিতরুণ সেপাই। নাম তাঁর মঙ্গল পান্ডে।
ব্যারাকপুর প্যারেড ময়দানে অসময়ে সৈনিকদের ভিড় বাড়ছে। ৩৪ নং ইনফ্যানট্রির সিপাহীরা আজ দলে দলে জটলা বাঁধছে। চাঁপা গুঞ্জন শোনা যাচ্ছে চার দিকে। সিপাহীদের মধ্যে কেউ এসেছে খালি হাতে, কেউ এসেছে বন্দুক নিয়ে। ক্রমশই বেড়ে চলেছে সিপাহীদের ভীড়। আজ রচিত হবে এক মহান ইতিহাস। প্যারেড লাইন থেকে পঞ্চাশ কিংবা ষাট হাত দূরে উন্নত পেশল দীর্ঘ চেহারার মঙ্গল পান্ডে বন্দুক কাঁধে নিয়ে টহল দিচ্ছেন। ময়দানে উপস্থিত সবাই তাঁরই দিকে তাকিয়ে আছেন।
মঙ্গল পান্ডে প্যারেড গ্রাউন্ডের সমস্ত সেপাইদের উদ্দেশ্যে বলে ওঠেন, “ভাইসব, আর সময় নেই! যদি নিজেদের জাতীয় বৈশিষ্ট্য, ধর্ম ফিরিঙ্গীর হাতে দলিত করতে না চাও তবে এগিয়ে এস। ধর কৃপাণ!” (বিদ্রোহী ভারত: নীহাররঞ্জন গুপ্ত, পৃষ্ঠা-৭৮)।
“বেরিয়ে এসো, বেরিয়ে এসো ভাইসব। ফিরিঙ্গীর পায়ের তলায় আর কতদিন পড়ে থাকবে! ওরা আমাদের সোনার দেশ লুটেপুটে খাচ্ছে, আর আমরা না খেয়ে মরছি। ওরা আমাদের ধর্মের উপর হাত দিয়েছে, আমাদের জাতিভ্রষ্ট করছে। ভাইসব ফিরিঙ্গীদের মারো, একটা একটা করে সব ব্যাটাকে মারো; ফিরিঙ্গীদের খতম করে দেশকে স্বাধীন কর”। (মহাবিদ্র্রোহের কাহিনী: সত্যেন সেন, পৃষ্ঠা-২০)।
“কাপুরুষ! ভীরু মেষশাবক! দাঁড়িয়ে দেখছ কি? এখনো দাঁড়িয়ে আছো নির্বাক অচল কাঠের পুতুলের মত? লজ্জা কি নেই তোমাদের, ভুলে গেছো কি রানী ঝিন্দনের নির্বাসন? পাঞ্জাবের দাসত্ব? শ্রীমন্তের প্রতি নানা সাহেবের অবিচার? ভেলোরের রক্তপাত? রানী লক্ষ্মীবাঈয়ের অশ্রুমোচন? অযোধ্যার অপমান? প্রতাপের রক্ত! শিবাজীর রক্ত! ভোলেনি, ভারত ভোলেনি সে কথা। ওঠো, জাগো। জাগো হে বীর। ঋণ শোধের দিন আজ। চারিদিকে ঘনিয়ে এসেছে মহারাত্রির কালো ছায়া। আসে রাত্রি মহাবিপ্লবের। তারই অগ্নি ইশারা দিকে দিকে। অগ্ন্যুৎসবের করো আয়োজন।”(বিদ্রোহী ভারত: নীহাররঞ্জন গুপ্ত, পৃষ্ঠা-৭৯) ।
অস্থির পদে মঙ্গল পান্ডে সেনানিবাসের সামনে ঘুরে বেড়াতে বেড়াতে কথাগুলো বলছিলেন। বাকী সব সেপাইরা স্তব্ধ হয়ে তাঁর কথা শুনছিলেন। অদূরে দেখা গেল একজন ইংরেজ অফিসার। মঙ্গল পান্ডের বন্দুক গর্জে উঠলো। গড়ুম গড়ুম। গুলি লক্ষ্যভ্রষ্ট হলো। পালিয়ে গেল অফিসার। একজন ইংরেজদের দালাল হাবিলদার সংবাদ দিতে ছুটে গেল এ্যাডজুটেন্ট লে. বর্গের কাছে, “সর্বনাশ হয়েছে স্যার। শীঘ্র চলুন, মঙ্গল পান্ডে বিদ্রোহী হয়ে উঠেছে”। পান্ডেকে শায়েস্তা করার জন্য মুহূর্তের মধ্যে যোদ্ধাবেশে অশ্বারোহণে লে. বর্গ সেনানিবাসে এসে উপস্থিত হলো। কোথায়? কোথায় সে বিদ্রোহী সেপাই পান্ডে?
কিন্তু পান্ডে স্থির ও অবিচল। বন্দুকের নল লেফটেন্যান্টের দিকে সোজা তাক করে মূর্তির মতো দাঁড়িয়ে আছেন।
সরাসরি পান্ডের গায়ের উপর চড়িয়ে দেওয়ার উদ্দেশ্যে লেফটেন্যান্টের ঘোড়াটি এগুচ্ছে। মঙ্গল পান্ডের বন্দুক আবারও গর্জে উঠলো। দুড়ুম-দুড়ুম! ঘোড়াটি মাঠে লুটিয়ে পড়ল। কিন্তু ওই গুলি লক্ষ্যভ্রষ্ট হল। লেফটেন্যান্ট বর্গ সঙ্গে রাখা তলোয়ার বের করে পান্ডের দিকে এগিয়ে এলো। পান্ডেও এগিয়ে গিয়ে তলোয়ার দিয়ে লেফটেন্যান্ট বর্গকে আঘাত করতে লাগলেন। অবশেষে লেফটেন্যান্ট বর্গ পান্ডের তলোয়ারে কাটা পড়ল।
লেফটেন্যান্টের পরে পান্ডেকে শায়েস্তা করার জন্য এসেছিল সার্জেন্ট। সার্জেন্টও পান্ডের তলোয়ারের কাছে ধরাশয়ী হল। তারপর এলো পল্টু। সে ইংরেজদের দালাল সৈন্য। সে মঙ্গল পান্ডেকে পিছন থেকে দু’হাত দিয়ে জড়িয়ে ধরল। নিজেকে মুক্ত করল পান্ডে। একপর্যায়ে পল্টুও রক্ষা পেলনা পান্ডের ধারালো তরবারীর কাছে। সবাই উত্তেজিত। সিপাহীদের মধ্যে উল্লাস ধ্বনি শোনা গেল ।
শেষ বিকেলে বিদ্রোহের সংবাদ পেয়ে সেনাপতি হিয়ার্সে চলে এলো সেনা ক্যাম্পে। ততক্ষণে মঙ্গল পান্ডে ক্লান্ত হয়ে পড়েছেন। তারপরও তিনি ব্রিটিশদের হাতে মরবেন না বলে মনে মনে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন। হঠাৎ পান্ডের পিস্তল গর্জে ওঠে। অভিমানী সৈনিক আত্মহত্যা করার চেষ্টা করেন। নিজের মাথায় ঠেকিয়ে দেন পিস্তল। গুলি ফসকে গেল। ধোঁয়া, বারুদ ও অগ্নিশিখার মধ্যে আহত রক্তাক্ত দেহ লুটিয়ে পড়ল। তাঁকে চিকিৎসা করাল ব্রিটিশ সরকার। উদ্দেশ্য সুস্থ্ করে তাঁকে নির্মম শাস্তি দেয়া।
৬ এপ্রিল সেপাই মঙ্গল পান্ডের বিচার। বিচারের নামে প্রহসন মাত্র। দন্ডাদেশ – ফাঁসি। মঙ্গল পান্ডে তখনো অসুস্থ। হাসপালে শুয়ে আছে। ক্ষত স্থানগুলো ফুলে উঠেছে। বাঁচার আশা নেই বললেই চলে।
৮ এপ্রিল সকাল। অসুস্থ মুমূর্ষু সৈনিক মঙ্গল পান্ডেকে বারাকপুরে সমস্ত সৈনিকদের সামনে ফাঁসীকাষ্ঠে ঝুলিয়ে দন্ডাদেশ কার্যকর করে ইংরেজ সরকার।
১৮৫৭ সালের ২৯ মার্চ মঙ্গল পাণ্ডে ব্যারাকপুরে এভাবেই সিপাহী বিদ্রোহ শুরু করেছিলেন। যে বিদ্রোহ খুব শীঘ্রই মিরাট, দিল্লি এবং ভারতের অন্যান্য অংশে ছড়িয়ে পড়ে। এমনকি এটা সারা বাংলাদেশ জুড়ে চরম উত্তেজনা সৃষ্টি করেছিল। চট্টগ্রাম ও ঢাকার প্রতিরোধ এবং সিলেট, যশোর, রংপুর, পাবনা ও দিনাজপুরের খণ্ডযুদ্ধসমূহ তার প্রমাণ বহন করে।
১৮৫৭ সালের ১১ মে মিরাট থেকে তিনশ’ বিদ্রোহী সিপাই দিল্লি এসে ৪৯ জন ব্রিটিশ নারী, পুরুষ ও শিশুকে হত্যা করে এবং দিল্লির দখল হাতে নিয়ে বাহাদুর শাহ জাফরকে মুঘল সম্রাট হিসাবে ঘোষণা করে। সম্রাটকে তাঁরা এই বিদ্রোহের নেতৃত্ব দিতে অনুরোধ জানান। অবস্থার চাপে পড়ে তিনি রাজি হলেও কর্তৃত্ব থেকে গিয়েছিল সিপাইদের হাতে। যদিও সকল আদেশ-নির্দেশ তাঁর নামে, তাঁর সিল-মোহরসহ বেরিয়েছিল। কিন্তু কয়েক মাসের মধ্যে বিদ্রোহ ব্যর্থ হয়। ১৮৫৭ সালের ১৪ সেপ্টেম্বর ইংরেজরা দিল্লি পুনর্দখল করে।
১৮৫৭ সালের ১৮ নভেম্বর চট্টগ্রামের পদাতিক বাহিনী প্রকাশ্য বিদ্রোহে মেতে ওঠে এবং জেলখানা হতে সকল বন্দীদের মুক্তি দেয়। তারা অস্ত্রশস্ত্র এবং গোলাবারুদ দখল করে নেয়। কোষাগার লুণ্ঠন করে এবং অস্ত্রাগারে আগুন ধরিয়ে দেয়। এই বিদ্রোহ ত্রিপুরা পর্যন্ত অগ্রসর হয়।
ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শাসকরা ভারতীয় সমাজে যে জুলুম-নিপীড়ন চালায় তারই অনিবার্য প্রতিক্রিয়া ছিল এই ঐতিহাসিক সিপাহী বিদ্রোহ। যে বিদ্রোহের শুরুটা করেছিলেন মঙ্গল পান্ডে।
মঙ্গল পান্ডের জন্ম ১৮২৭ সালের ১৯ জুলাই। উত্তরপ্রদেশের বালিয়া জেলায় নাগওয়া গ্রামে। অনেকের মতে তাঁর জন্ম হয়েছিল ফৈজাবাদ জেলার সুরহুর গ্রামে। একটি ব্রাক্ষ্মণ পরিবারে। দিবাকর পান্ডের ঘরে। অর্থাৎ তাঁর বাবা ছিলেন দিবাকর পান্ডে। পড়াশুনার হাতেখড়ি পরিবারে। প্রাথমিক ও মাধ্যমিক পড়াশুনা শেষ করে মাত্র ২২ বছর বয়সে ১৮৪৯ সালে তিনি ব্রিটিশ ইস্ট-ইন্ডিয়া কোম্পানীতে সেপাই পদে চাকুরী নেন।
এখানে চাকরি করতে এসে তিনি অনেকরকম বৈষম্য আর অন্যায় দেখতে পান, যা মঙ্গল পান্ডেকে গভীরভাবে নাড়া দেয়। ভারতীয় সিপাহীরা যখন কর্মরত থাকতেন, তখন কোনো ইংরেজ সিপাহী বা অফিসার দেখলেই অস্ত্র উত্তোলন করে সম্মান দেখানোর রীতি ছিল। কিন্তু ভারতীয় সিপাহী বা অফিসারকে ইংরেজ সিপাহীরা সম্মান দেখাতো না বরং বিমাতাসূলভ আচারণ করতো। ভারতীয় সিপাহীরা যদি কোনো স্থানে কোনো কারণে মারা যেতেন, তাহলে ওই পরিবারের কোনো খোঁজ-খবর ইংরেজ বাহাদুররা নিতো না। অবশেষে ওই পরিবারটি নিঃস্ব হয়ে যেত। আর ইংরেজ সিপাহীদের ক্ষেত্রে ছিল অফুরন্ত সুযোগ-সুবিধা।
ভারতীয় সিপাহীদের বেতন মোটেও আকর্ষণীয় ছিল না। পদাতিক বাহিনীর একজন ভারতীয় সিপাহী মাসে বেতন পেতেন ৭ রুপি। আর একজন ইংরেজ সেপাহী মাসিক বেতন পেতেন চল্লিশ রুপি। ভারতের মোট সৈন্য সংখ্যা ছিল ৩,১৫,৫২০ জন। এদের পেছনে খরচ হত ৯,৮০২, ৮৩৪ পাউন্ড। এর মধ্যে ৫১, ৩১৫ জন ইউরোপীয় সৈন্য এবং অফিসারের পেছনে খরচ হতো ৫,৬৬৮, ১১০ পাউন্ড। ইউরোপীয় সৈন্যদের তেমন কোন কাজ করতে হতো না। তাদের থাকা, খাওয়া, মাইনে তোলা সম্পর্কে দেশীয় সিপাহীরা কিছুই জানতো না। এই বৈষম্য ও বৈপরীত্য সিপাহিদের মনে কতটা বিরূপ প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করেছিল তা সহজেই অনুমেয়।
ব্রিটিশ সরকার ১৮৫৩ সালে তৈরি করেছিল ৫৫৭ ক্যালিবার এনফিল্ড (পি/৫৩) রাইফেল। এই রাইফেল ভারতীয় সিপাহীদের হাতে তুলে দেয় তারা। রাইফেল গুলোর কার্তুজ গরু ও শুকরের চর্বি দিয়ে তৈরী হতো। সৈন্যদেরকে রাইফেলের কার্তুজ লোড করার সময় তা দাঁত দিয়ে খুলে লাগাতে হতো। গরু ও শুকরের চর্বি মুখে দেয়া হিন্দু- মুসলিম সৈন্যদের জন্য অধার্মিক ও গর্হিত কাজ। ১৮৫৭ সালের ফেব্রুয়ারীতে সিপাহীরা (ব্রিটিশ সেনাবাহিনীতে ভারতীয় সৈন্য) নতুন কার্তুজ ব্যবহার করতে অস্বীকার করেছিল। ভারতীয় সৈন্যদের চাপের মুখে নতুন কার্তুজ প্রতিস্থাপন করার প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল ব্রিটিশ সরকার। কিন্তু তারা প্রতিশ্রুতি না রেখে ভারতীয় সৈন্যদেরকে ৫৫৭ ক্যালিবার এনফিল্ড (পি/৫৩) রাইফেল ব্যবহারে বাধ্য করে।
এই আগ্নেয়াস্ত্র তুলে দেয়ার জন্য ব্রিটিশ শোসকগোষ্ঠীকে চরম মূল্য দিতে হয়েছিল। সম্মুখীন হতে হয়েছিল সিপাহী বিপ্লবের। আর এই বিপ্লবের শুরুটা করেছিল মঙ্গল পান্ডে। ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলন-সংগ্রামের সূচনা ইতিহাসের নক্ষত্র হল মঙ্গল পান্ডে।
তথ্য ও ছবিসূত্র:
১। বিদ্রোহী ভারত: নীহাররঞ্জন গুপ্ত। মিত্র ও ঘোষ পাবলিশার্স প্রা: লি:- কলকাতা, প্রকাশকাল: অগ্রহায়ণ- ১৩৯১।
২। মহাবিদ্র্রোহের কাহিনী: সত্যেন সেন। মুক্তধারা প্রকাশনী, প্রকাশকাল- ২০০২, অষ্টম সংস্করণ।
৩। ভারতের বৈপ্লবিক সংগ্রামের ইতিহাস: সুপ্রকাশ রায়। ডিএনবিএ ব্রাদার্স- কলকাতা। প্রকাশকাল-১৯৮০, দ্বিতীয় সংস্করণ।
লেখক: রফিকুল ইসলাম (শেখ রফিক)