ভয় কি মরণে রাখিতে সন্তানে,
মাতঙ্গী মেতেছে আজ সমর রঙ্গে।
তাথৈ তাথৈ থৈ দ্রিমী দ্রিমী দং দং
ভূত পিশাচ নাচে যোগিনী সঙ্গে।
দানব দলনী হয়ে উন্মাদিনী,
আর কি দানব থাকিবে বঙ্গে।
সাজ রে সন্তান হিন্দু মুসলমান
থাকে থাকিবে প্রাণ না হয় যাইবে প্রাণ।
লইয়ে কৃপাণ হও রে আগুয়ান,
নিতে হয় মুকুন্দে-রে নিও রে সঙ্গে।
বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল ইসলাম মুকুন্দদাসের গান শুনে মুগ্ধ হয়ে (সরাসরি সাক্ষাতে) বলেছিলেন- ‘যারা গান বা বক্তৃতা দ্বারা দেশের জাগরণ আনতে চেষ্টা করেন তারা সকলেই চারণ। আপনি, আমি, আমরা সবাই চারণ,তবে আপনি আমাদের সম্রাট। অর্থাৎ চারণসম্রাট। বাংলা মায়ের দামাল ছেলে চারণকবি মুকুন্দদাস”।
১৯০৫ সালের অক্টোবরে বঙ্গভঙ্গরদ আন্দোলন চলার সময় বরিশালের টাউন হলে অশ্বিনী কুমার বক্তব্য দেন। বক্তব্যে তিনি বঙ্গভঙ্গ রদ আন্দোলনকে জোরদার করা প্রসঙ্গে তাঁর উপলব্দির কথা ব্যক্ত করেন। তিনি বলেন-“আমরা যে সব বক্তৃতা করে বেড়াচ্ছি, যদি কেউ তা যাত্রাপালা আকারে গ্রামে গ্রামে প্রচার করে, তাহলে তা আমাদের এরূপ সভা বা বক্তৃতার চেয়ে অনেক বেশি কার্যকর হবে”।
অশ্বিনী কুমার দত্তের এই বক্তব্য মুকুন্দদাস খুবই গুরুত্বসহকারে নিলেন। নিজেই মনে মনে চিন্তা ও প্রতিজ্ঞা করলেন গ্রামে গ্রামে যাত্রাপালা পরিবেশন করে মানুষকে সচেতন ও সংগ্রামী হিসেবে গড়ে তুলবেন, যারা দেশের স্বাধীনতার জন্য কাজ করবেন, ব্রিটিশকে ভারত উপমহাদেশ থেকে বিতাড়িত করবেন। প্রতিজ্ঞা অনুযায়ী কাজ। মাত্র ৩ মাসের মধ্যে রচনা করলেন অসাধারণ যাত্রাপালা ‘মাতৃপূজা’। মাতৃপূজার মূল বিষয় ছিল দেশপ্রেম ও দেশের স্বাধীনতা অর্জন। তাঁর এই যাত্রাপালায় ভারতকে স্বাধীন করার অনুপ্রেরণাই প্রাধান্য পেয়েছে। অল্প দিনের মধ্যে তিনি গড়ে তুললেন যাত্রা দল। নাম দিলেন স্বদেশী যাত্রা দল।
অশ্বিনীকুমার দত্তের আশির্বাদ মাথায় নিয়ে গ্রামে-গ্রামে, হাটে-মাঠে-গঞ্জে তিনি এই যাত্রাপালা পরিবেশনের মাধ্যমে সকলের মধ্যে দেশপ্রেম ও স্বাধীনতার চিন্তা-চেতনা জাগ্রত করে তুলতে শুরু করেন। ‘মাতৃপূজা’ যাত্রাপালায় তিনি তাঁর কালজয়ী জাগরণী সঙ্গীত- “ভয় কি মরণে রাখিতে সন্তানে/ মাতুঙ্গী মেতেছে আজ সমর রঙ্গে” গানটি অন্তর্ভূক্ত করেন। যা শুরুতেই দেয়া হয়েছে। এই গানটি আমরা আমাদের দুঃসময়ে নিজেদেরকে অগ্নিমন্ত্রে জাগরিত করার জন্য গেয়ে থাকি।
তিনি বাংলার বিভিন্ন এলাকায় যাত্রাপালা পরিবেশন করেন। যেখানেই গিয়েছেন, সেখানেই তাঁর অসাধারণ যাত্রাপালা ‘মাতৃপূজা’ মানুষকে স্বদেশ প্রেমের মন্ত্রে জাগরিত করেছে।
গণমানুষের গান, স্বাধীনতার গান, সমাজ বদলের গান কেন গাইতে হয়! কেমন করে গাইতে হয়! কবি কেন চারণ হয়! চারণসম্রাট মুকুন্দদাসের জীবন, সময় ও সৃষ্টি জানলে ‘চারণকবি’ শব্দটির স্বরূপ-প্রকৃতি যথার্থভাবে উপলব্ধি করা যায়। সকল কবিই ‘চারণকবি’ নন। যিনি চারণ, তিনি তাঁর সৃষ্টিকর্ম দিয়ে সমাজের সকল অসঙ্গতি দূর করার জন্য গণমানুষের মধ্যে মিশে গিয়ে প্রগতি, সাম্যের বিপ্লবকে অগ্রসর করে নেন।
মাটি ও মানুষের সাথে চারণকবি মুকুন্দদাসের সম্পর্ক ছিল সুনিবিড়। তাঁর গান, যাত্রাপালা-অভিনয় এবং ভাষা, সুর, ছন্দ ও ভঙ্গি ছিল বাঙালির নিজস্ব জীবনবোধ ও সংস্কৃতির। তাঁর গান গণমানুষের অন্তরকে অতি সহজেই অনুরণিত করে তুলত। জাগরিত করত অধিকার বঞ্চিত মেহনতি মানুষকে। অনুপ্রেরণা যোগাত স্বাধীনতা সংগ্রামী বিপ্লবীদের।
চারণকবি মুকুন্দদাস দেশপ্রেম ও স্বাধীনতার প্রতীক। ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনের সফল সংস্কৃতিবিদ। তাঁর জীবনদর্শন ও সৃষ্টি মানুষকে পরাধীনতার শিকল ছিড়ে স্বাধীনভাবে বাঁচতে শেখায়, মানুষের কাঙ্খিত সাম্যের সমাজ ও পৃথিবী নির্মাণে বিপ্লবীদের আরো সাহসী করে তোলে।
চারণ বিপ্লবী মুকুন্দদাসের জন্ম ১৮৭৮ সালের ২২ ফেব্রুয়ারী। ঢাকা জেলার বিক্রমপুর পরগনার (বর্তমান মুন্সিগঞ্জ) বানরী গ্রামে। বাবা গুরুদয়াল দে। মা শ্যামসুন্দর দে। ১৮৮৫ সালে মুকুন্দদাসের বয়স যখন ৭ বছর তখন তাঁর বাবা স্ব- পরিবারে বিক্রমপুর থেকে বরিশালে চলে আসেন এবং স্থায়ীভাবে বসবাস শুরু করেন। বাল্যকালে মুকুন্দদাসের নাম ছিল যজ্ঞেশ্বর। এ সময় সকলে তাঁকে আদর করে যজ্ঞা বলে ডাকত। মুকুন্দদাসের বাবা-মা দু’জনেই ছিলেন কৃষ্ণভক্ত বৈষ্ণব। তাঁদের সুরেলা কন্ঠে সব সময় কীর্তন গান ধ্বনিত হত। এ কারণে স্বাভাবিকভাবেই মুকুন্দদাস শৈশবে বৈষ্ণব ধর্মের প্রতি আকৃষ্ট হয়ে পড়েন। একপর্যায়ে ১৮৯০ সালে শারদীয় পূজার সময় তিনি সাধু রামানন্দ ওরফে হরিবোলান্দরের কাছে বৈষ্ণব মন্ত্রে দীক্ষা গ্রহণ করেন। দীক্ষাগুরু তাঁর পৈত্রিক নাম যজ্ঞেশ্বর পরিবর্তন করে মুকুন্দদাস নামকরণ করেন। মুকুন্দদাস অর্থাৎ কৃষ্ণের দাস।
মুকুন্দদাসের বাবা বরিশালে আসার কিছু দিন পর আলেকান্দায় একটি মুদি দোকান চালু করেন। এই মুদি দোকানে বসে মুকুন্দদাসের বাবা কাজের ফাঁকে ফাঁকে সুরেলা কন্ঠে সুমধুর গান গাইতেন। তাঁর গান শুনে মুগ্ধ হয়ে বরিশালের এক ডেপুটি মেজিস্ট্রেট তাঁকে আদালতপাড়ায় আর্দালির চাকুরি দেন। এই চাকুরীর পাশাপাশি তিনি মুদি দোকানটিও চালু রাখেন। এক পর্যায়ে মুকুন্দদাস এই দোকানটি পরিচালনার ভার গ্রহণ করেন।
মুকুন্দদাস তাঁর সুরেলা কন্ঠটি মা-বাবার কাছ থেকে পেয়েছেন। মা-বাবাকে অনুসরণ-অনুকরণ করে ছোটবেলা থেকেই তিনি মুখে মুখে গান বাঁধতেন এবং নিজে সুর করে গাইতেন। কিন্তু পড়াশুনা তাঁর ভাল লাগতো না। স্কুলে যাওয়ার কথা বলে পাড়ামহল্লার ছেলেদের সাথে ঘুরে বেড়াতেন। কখনো কখনো চলে যেতেন গ্রামের মধ্যে। মাছ ধরা, জঙ্গলের মধ্যে ঘুরে বেড়ানোসহ নানারকম খেলাধূলায় মেতে থাকতেন। কিন্তু সবকিছুর সাথে তাঁর মুখে সবসময় গান থাকত। বরিশালের ব্রজমোহন বিদ্যালয়ে ৬ বছর পড়াশুনা করে প্রবেশিকা পরীক্ষায় কৃতকার্য হতে পারেননি। ব্রজমোহন বিদ্যালয়ে একজন ছাত্রের এ ধরনের অবনতি দেখে অশ্বিনীকুমার দত্ত অত্যন্ত ব্যাথিত হন। তিনি মুকুন্দদাসের গান শুনে মুগ্ধ হন। তিনি বুঝতে পারেন ছেলেটি অসাধারণ প্রতিভাবান। মুকুন্দদাসকে তিনি দিনের পর দিন বাড়িতে ডেকে এনে আদর স্নেহ ভালবাসা দিয়ে এক নতুন মানুষ হিসেবে গড়ে তোলেন।
১৯০১ সালে কীর্তন গান রচনা ও পরিবেশনার মাধ্যমে মুকুন্দদাসের শিল্পী জীবনের শুরু। এই গানের মাধ্যমে তখন তিনি বেশ পরিচিতি পান। যে পরিচিতির মধ্য দিয়ে তিনি বরিশালের সংস্কৃতিমনা মুক্ত চিন্তার মানুষের সান্নিধ্য ও ভালবাসা পান।
১৯০৪ সালে মুকুন্দদাস বিপ্লবী রাজনৈতিক চেতনায় উজ্জীবিত বরিশালের সোনাঠাকুরের সাথে পরিচিত হন। ধীরে ধীরে তিনি সোনাঠাকুরের বিপ্লবী রাজনৈতিক চেতনায় দারুণভাবে আকৃষ্ট হয়ে পড়েন। এসময় সোনাঠাকুরের কালী বাড়িতে অশ্বিনীকুমার, জগদীশ মুখোপাধ্যায়, সেবাব্রতী, কালীদাস চন্দসহ অনেক শিক্ষাবিদ, রাজনীতিবিদ, সাংবাদিক, বুদ্ধিজীবী ও সমাজসেবকরা আড্ডা জমাতেন। মুকুন্দদাস প্রায়ই এই আড্ডায় যোগ দিতেন। এঁদের সংস্পর্শে আসার ফলে মুকুন্দদাস ক্রমশ সমাজ ও রাজনীতি সচেতন হয়ে ওঠেন। ফলে তিনি বিপ্লবী রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডে জড়িত হন। একপর্যায়ে তিনি সশস্ত্র বিপ্লববাদী দলে যুক্ত হন। তিনি ‘স্বদেশবান্ধব সমিতি’তেও যুক্ত হন।
১৯০৬ সালের জুন মাসে বরিশালে স্বদেশী উৎসবের সময় তিনি ‘মাতৃপূজা’ যাত্রাপালা পরিবেশন করেন। এসময় বরিশালের রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ মুকুন্দদাসকে উচ্চ প্রশংসা জানিয়ে আশির্বাদ করেন। অক্টোবর মাসে তিনি যাত্রাপালা পরিবেশনের জন্য মাদারীপুরে যান। এখান থেকে বিভিন্ন এলাকায় যাত্রা গান পরিবেশন শেষে ১৯০৭ সালের এপ্রিলে বরিশালে আসেন। ১৬ এপ্রিল মুকুন্দদাস রাজবাহাদুরের হাবেলিতে যাত্রা গান পরিবেশন করেন। দর্শকরা সবাই মুগ্ধ, আবেগে আপ্লুত। মাঝে মাঝে ‘বন্দেমাতরম, বন্দেমাতরম’ শ্লোগান চলছে। গান শেষে অশ্বিনীকুমার আবেগে আপ্লুত হয়ে মুকুন্দদাসকে বুকে জড়িয়ে ধরেন।
মুকুন্দদাসের ‘মাতৃপূজা’ পালার জনপ্রিয়তা বৃদ্ধিতে সেইসময় কয়েকটি পত্রিকা বিশেষভাবে ভূমিকা পালন করে। অরবিন্দ ঘোষের ‘বন্দেমাতরম’, বারীণ ঘোষ ও ভূপেন দত্তের ‘যুগান্তর’, মনোরঞ্জন গুহঠাকুরতার ‘নবশক্তি’, অশ্বিনীকুমার দত্তের ‘স্বদেশ বান্ধব সমিতি’ রামান্দ চট্টপাধ্যায়ের ‘প্রবাসী’ ও ‘মর্ডান রিভিউ’ উল্লেখযোগ্য।
এই ‘মাতৃপূজা’ পালার মাধ্যমে ব্রিটিশ সরকারের বিরুদ্ধে গণমানুষের জাগরণ সৃষ্টি হতে থাকে। ব্রিটিশ সরকার পূর্ব- বাঙলার জাগরণ সম্পর্কে চিন্তিত হয়ে পড়ে। সরকারের পক্ষ হতে পূর্ব-বাংলার জেলাগুলোতে ‘শান্তিভঙ্গের কারণ’ দেখিয়ে মুকুন্দদাসের গানের উপর নিষেধাজ্ঞা জারি করা হয়। ফলে দ্বিতীয় ও তৃতীয় বছরে মুকুন্দদাস সরকারী বাধার সম্মুখীন হন। যেখানে তিনি গান করতে যেতেন, সেখান থেকেই পুলিশ তাঁকে বিতাড়িত করে দিত। এভাবে এক এলাকায় নিষেধাজ্ঞা হলে অন্য এলাকায় তিনি গান করতে চলে যেতেন।
১৯০৮ সালে তিনি আইনের চোখকে ফাঁকি দিয়ে খুলনার কিছু অঞ্চলে গান করার পর বাগেরহাট গান করতে গেলে পুলিশ তাঁর উপর চড়াও হয় এবং পালা পরিবেশন বন্ধ করে দেয়। ওই সময় মুকুন্দদাস গ্রেফতারী পরোয়ানা এড়িয়ে তাঁর দলবল নিয়ে গোপনে বরিশালে চলে আসেন। তিনি আইনের চোখকে ফাঁকি দিয়ে তাঁর যাত্রাপালা অব্যাহত রাখেন। ১৯০৮ সালের ১১ আগষ্ট ক্ষুদিরাম বসুকে ব্রিটিশ সরকার ফাঁসিতে ঝুলিয়ে হত্যা করে। বিপ্লবী ক্ষুদিরামের আত্মত্যাগের প্রতিচ্ছবি চেতনার আয়নায় চিত্রায়ন করে, একটি রচনা করেছিলেন বাঁকুড়ার লোককবি পীতাম্বর দাস।
‘একবার বিদায় দে-মা ঘুরে আসি/হাসি হাসি’।
এসময় তিনি পালা পরিবেশনের শুরুতে ও শেষে বিপ্লবী ক্ষুদিরাম বসু সম্পর্কে বক্তৃতাও গান করেন। যে বক্তৃতা শুনে উপস্থিত জনতা ব্রিটিশকে উৎখাত করার জন্য অগ্নিশপথ গ্রহণ করেন।
বরিশালে অশ্বিনীকুমারের নেতৃত্বে যে বঙ্গভঙ্গ আন্দোলন গড়ে উঠে তা বাংলার সর্বত্র ছড়িয়ে পড়ে। এমন কি বাংলার বাইরেও অনেক প্রদেশে এই আন্দোলনের প্রভাব পড়ে। বয়কট আন্দোলনকে সফল করার জন্য অশ্বিনী কুমারের নেতৃত্বে স্বদেশবান্ধব সমিতি শহরে ও গ্রামে স্বেচ্ছাসেবকের কাজ করত। ফলে ভীত হয়ে ১৯০৮ সালের ১৩ ডিসেম্বর ব্রিটিশ সরকার অশ্বিনী কুমার দত্তসহ পূর্ব ও পশ্চিম বঙ্গের ৯ জন নেতাকে গ্রেফতার করে বিনা বিচারে জেলখানায় আটক করে রাখে।
অন্যদিকে মুকুন্দদাস গ্রামে গঞ্জে যাত্রাপালা পরিবেশনের সময় এই গ্রেফতারের তীব্র প্রতিবাদ করেন। যে প্রতিবাদের কারণে পূর্ববঙ্গের হাজার হাজার জনতা সংগঠিত হয়ে ৯ নেতার মুক্তির জন্য আন্দোলন জোরদার করেন। এভাবে স্বদেশবাসীকে জাগাতে এবং রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দের মুক্তির জন্য মুকুন্দদাস গ্রামে গঞ্জে যাত্রাপালা পরিবেশন অব্যাহত রাখেন।
১৯০৯ সালে মুকুন্দদাস তাঁর যাত্রা দল নিয়ে বরিশালের পূর্বাঞ্চল উত্তর শাহাবাজপুরের দিকে রওনা হন। অন্ধকার রাত। মাঝ নদীতে নৌকায় বসে মুকুন্দদাস তাঁর দল নিয়ে জোরগলায় গান ধরেন – ‘মায়ের নাম নিয়ে ভাসান তরী, যে দিন ডুবে যাবে’। হঠাৎ একটি ইঞ্জিন চালিত নৌকার শব্দ (টলার) শোনা যায়। কিছুক্ষণ পরই ওই নৌকাটি তাঁদের নৌকার কাছাকাছি চলে আসে। নৌকার ভেতর থেকে দুজন ইংরেজ পুলিশ বলে ওঠে, নৌকা থামাও। তারা নৌকায় উঠে এসে মুকুন্দদাস ও তাঁর সহযোগী সকলকে গ্রেফতার করে নিয়ে যায় বরিশাল। পরের দিন আদলতে তাঁদের জামিন মঞ্জুর করা হয় এবং মামলার পরবর্তী তারিখ ধার্য করা হয়।
জামিন পাওয়ার ক’দিন পর মুকুন্দদাসকে ‘দেশের গান’ সংকলন প্রকাশ করার জন্য রাজদ্রোহের অভিযোগে গ্রেফতার করা হয়। এই মামলায় আদালত তাঁকে ৩ বছরের সশ্রম কারাদণ্ড দেয়। এ মামলায় তাঁর ৩ জন সহযোগী বিভিন্ন মেয়াদে শাস্তি ভোগ করেন। জেলখানার মধ্যে মুকুন্দদাস কয়েদীদের গান শুনাতেন। তাঁদেরকে দেশপ্রেমের মন্ত্রে জাগরিত করতেন।
১৯১২ সালের মার্চ মাসে তিনি কারাগার থেকে মুক্তি পান। মুক্তি পেয়েই শুনতে পান, তাঁর স্ত্রী শতদলবাসিনী কলেরা রোগে মারা গেছেন। মুকুন্দদাসের অপরাধের জন্য তাঁর বাবাকে গ্রেফতার করে কারাগারে রাখা হয়েছে। অর্থের অভাবে মুদি দোকানটি বিক্রি করে দেওয়া হয়েছে। এ সব শুনে মুকুন্দদাস খুবই ভেঙ্গে পড়েন। এ অবস্থায় অশ্বিনী কুমার দত্তসহ অনেকেই মুকুন্দদাসকে নানাভাবে সহযোগিতা করেন। সকলে আর্থিক সহযোগিতাও করেন। যে অর্থ দিয়ে মুকুন্দদাস শহরের কালীবাড়ি রাস্তায় একটি মুদি দোকান চালু করেন। অভাব, দারিদ্র ও দুঃখ-কষ্টে জর্জরিত হয়েও তিনি কখনো তাঁর আদর্শ ও দেশপ্রেম থেকে বিন্দু পরিমাণ বিচ্যুত হননি।
কিছু দিনের মধ্যে মুকুন্দদাস তাঁর যাত্রাদলকে পুনর্গঠিত করে আবার যাত্রাপালা পরিবেশন শুরু করেন। নতুন যাত্রাপালা লিখেন। তিনি জীবদ্দশায় ৫টি যাত্রাপালা লিখেন। ১৯১২-২৫ সাল পর্যন্ত তিনি পল্লীসেবা, ব্রক্ষ্মচারিণী, সমাজ ও পথ যাত্রাপালাগুলো পরিবেশন করেন। ব্রিটিশ সরকারের জেল, জলুম, হুলিয়া মাথায় নিয়ে জনগণকে সচেতন করে তোলেন। যাতে জনগণ সঙ্ঘবদ্ধ হয়ে ব্রিটিশ সরকারকে উৎখাত করে। অবশেষে জনগণ তাই করেছিল।
১৯২১ সালে মহাত্মা গান্ধীর নেতৃত্বে সমস্ত ভারতব্যাপী অসহযোগ আন্দোলন শুরু হয়। এই আন্দোলনে যাত্রাপালা পরিবেশনের মাধ্যমে তিনি সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ করেন। ১৯২৩ সালে এই আন্দোলন প্রত্যাহার করা হয়। এ সময় মুকুন্দদাস তাঁর দল নিয়ে কলকাতায় চলে যান। ওই সময় ‘মাতৃপূজা’ যাত্রাপালাটি নিষিদ্ধ করে ব্রিটিশ সরকার। মুকুন্দদাস তখন সরাসরি ব্রিটিশ বক্তব্য বাদ দিয়ে সামাজিক সমস্যাবলী নিয়ে রচিত যাত্রাপালা পরিবেশন করেন। ব্রিটিশ সরকার মুকুন্দদাসের এই অভিনব কৌশল বুঝতে পেরে ১৯৩২ সালে তাঁর সকল যাত্রাপালা নিষিদ্ধ করে।
১৯২৬ সালে দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন দাস তাঁর মেয়ের বিয়েতে গান গাইবার জন্য মুকুন্দদাসকে কলকাতায় নিয়ে যান। অনেক খ্যাতনামা ব্যক্তিদের সামনে তিনি সঙ্গীত পরিবেশন করেন। সকলেই তাঁর গান ও যাত্রাপালার আকর্ষণীয় অভিনয়, বক্তব্য শুনে মুগ্ধ হন। ওই সময় প্রখ্যাত কবি প্রিয়ংবদা দেবী মঞ্চে উঠে তাঁকে সোনার সেফটিপিন উপহার দেন।
১৯৩৪ সালে পালাগানের বায়না পেয়ে দল নিয়ে কলকাতায় যান। ছোট একটি বাসা ভাড়া নেন। সেখানে বসবাস করেন। বিভিন্ন অঞ্চল থেকে গানের বায়না আসতে থাকে। এ সময় মুকুন্দদাস শারীরিকভাবে অসুস্থ হয়ে পড়েন। অসুস্থ শরীর নিয়ে গান গেয়ে যান। কারণ গান না গাইলে সাথীদেরকে বেতন দিবেন কি করে। ওই বেতনে তাঁদের সংসার চলে।
১৯৩৪ সালের ১৭ মে তিনি তাঁর এক বন্ধুর বাড়িতে নিমন্ত্রণ রক্ষা করতে যান। গভীর রাতে বাসায় ফেরেন। দলকে ১ ঘন্টা তালিম দিলেন পরের দিন গান গাইবার জন্য। এরপর তিনি ঘুমাতে গেলেন। এটিই ছিল তাঁর শেষ ঘুম। আর জাগলেন না তিনি।
তথ্য ও ছবিসুত্র:
১। জীবনী গ্রন্থমালা মুকুন্দদাস: স্বরোচিষ সরকার। প্রকাশক বাংলা একাডেমী। প্রকাশকাল-নবেম্বর, ১৯৯৯।
২। চারণকবি মুকুন্দদাস: জয়গুরু গোস্বামী। বিশ্বাবানী প্রকাশনী, কলকাতা। প্রকাশকাল-১৯৭৮।
৩। মুকুন্দদাস রচনাসমগ্র: সম্পাদক- শেখ রফিক। প্রকাশক: র্যামন পাবলিসার্স, বাংলাবাজার, ঢাকা। প্রকাশকাল- ২০০৮।
৪। স্বাধীনতা সংগ্রামে বরিশাল: হীরালাল দাশগুপ্ত। সাহিত্য সংসদ, কলকাতা। প্রকাশকাল, ডিসেম্বর-১৯৯৭।
লেখক: রফিকুল ইসলাম (শেখ রফিক)