১৯০৫ সালে মনোরমার বয়স যখন মাত্র আট বছর তখনই আনুষ্ঠানিকভাবে স্বদেশী আন্দোলনে হাতেখড়ি হয় তাঁর। সারা ভারতবর্ষ জুড়ে বঙ্গভঙ্গরদ আন্দোলন চলার সময় যখন স্বদেশীরা রাস্তায় গান গেয়ে মিছিল নিয়ে যাচ্ছিল তখন তা দেখে খুবই আপ্লুত হন মনোরমা। সেই মিছিলেই হাতে হলুদ রাখি বেঁধে স্বদেশী আন্দোলনে দীক্ষা নেন তিনি। এরপর ১৯০৮ সালে যখন বিপ্লবী ক্ষুদিরাম বসুর ফাঁসি হয় তখন তাঁর মনে প্রবল আলোড়ন সৃষ্টি হয়। তিনি বিপ্লবী আন্দোলনে নিজেকে আরো সক্রিয় করে তোলেন। এই বছর তাঁর বাবার মৃত্যু হয়। সংসারে নানা বিশৃঙ্খল পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়। এই অবস্থাতেই মাত্র তের বছর বয়সে মনোরমার বিয়ে হয় বরিশালের বাঁকাই গ্রামের বিপত্নীক জমিদার চিন্তাহরণ বসুর সাথে।
১৯২৫ সালে মাহাত্মা গান্ধী রাজনৈতিক প্রচারণা চালাতে বরিশাল এলে তাঁকে দেখার জন্য গ্রামের মেয়েদের দলবলসহ মনোরমা বসু বরিশাল শহরে আসেন। আন্দোলনের তহবিল সংগ্রহের জন্য গান্ধী সকলের প্রতি আহ্বান জানান। গান্ধীর আবেদনে সাড়া দিয়ে সেদিন মনোরমা বসু বাড়ি থেকে যে সোনার গহনা পড়ে এসেছিলেন তা সেই তহবিলে দান করেন। বরিশালে গান্ধীর সাথে এই সাক্ষাৎ তাঁকে আরো উজ্জীবিত করে তোলে। তিনি ব্রিটিশদের শৃঙ্খল থেকে ভারতবর্ষকে মুক্ত করার জন্য বিভিন্ন আন্দোলন সংগ্রামে অংশগ্রহণ করেন এবং বিপ্লবী মনোরমা বসু মাসিমা নামে পরিচিতি লাভ করেন। তিনি শুধু ভারতবর্ষের মুক্তির জন্য আন্দোলন করেননি, মানুষের মুক্তির জন্যও আন্দোলন করে গেছেন সারাজীবন। বরিশাল শহরে নিজ বাড়িতেই গড়ে তোলেন ‘মাতৃমন্দির’ । কুমারী মা, স্বামী পরিত্যক্তা, বিপথগামী ও আশ্রয়হীনা মেয়েদের আশ্রয়স্থল এই ‘মাতৃমন্দির’। অসহায় মেয়েদের স্বাবলম্বী করতে গড়ে তোলেন ‘নারী কল্যাণ ভবন’, শিশু- কিশোরদের মানসিক বিকাশের জন্য ‘মুকুল-মিলন খেলাঘর আসর’, সাধারণ মানুষের জ্ঞানের জন্য ‘পল্লীকল্যাণ অমৃত পাঠাগার’, নারী জাগরণ ও নারী অধিকার রক্ষায় ‘নারী আত্মরক্ষা সমিতি’, ‘মহিলা সমিতি’ ও ‘মহিলা পরিষদ’সহ নানা সংগঠন।
মনোরমা রায়ের জন্ম ১৮৯৭ সালের ১৮ নভেম্বর, বরিশাল জেলার বানাড়ীপাড়া থানার নরোত্তমপুর গ্রামে। বাবা নীলকন্ঠ রায় ও মা প্রমদাসুন্দরী রায়। মনোরমা ছিলেন বাবা-মা’র পঞ্চম সন্তান। মাত্র তের বছর বয়সে মনোরমার বিয়ে হয় ।
মনোরমা বসু জমিদার বাড়ির বউ হলেও তাঁর রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডে বিন্দুমাত্র বাধা পড়তে দেননি। বরং তিনি গ্রামে থেকেই ভারতবর্ষের বিভিন্ন রাজনৈতিক খবরা-খবর রাখতেন এবং তাতে অংশগ্রহণ করতেন। ১৯২৫ সালে রবিশালে গান্ধীর সাথে সাক্ষাৎ হওয়ার পর তিনি ভাবলেন, রাজনৈতিক আন্দোলনে সরাসরি অংশগ্রহণ করতে হলে গ্রামে বসে খুব বেশি কাজ করা সম্ভব হবে না। এজন্য এ বছরই বরিশাল শহরের কাউনিয়া শাখা সড়কে জমি কেনে একটি বাড়ি তৈরি করেন এবং সপরিবারে সেখনে চলে আসেন। একই বছর তিনি কংগ্রেসে যোগ দেন। কাজ শুরু করেন মহিলা সমিতি গড়ে তোলার জন্য।
১৯৩০ সাল থেকে ভারতে কংগ্রেসের ডাকে শুরু হয় আইন অমান্য আন্দোলন। আইন অমান্য আন্দোলনে তখন বরিশালের প্রায় সকল নেতাই গ্রেফতার হন। মনোরমা মাসিমা এ অবস্থায় ২৬ জানুয়ারি পার্টি অফিসের ছাদে পতাকা তুলে দেন। অন্য দিকে চলতে থাকে রাজনৈতিক বন্দীদের মুক্তির দাবিতে আন্দোলন। ২ ফেব্রুয়ারি মিছিল বের করলে পুলিশ তাতে আক্রমণ চালায়। এর প্রতিবাদে ৩ ফেব্রুয়ারি বরিশালে হরতাল আহ্বান করা হয়। হরতালে নেতৃত্ব দেয়ার কারণে তাঁকে ৬ ফেব্রুয়ারি গ্রেফতার করে পুলিশ। এটাই তাঁর জীবনে প্রথম কারাবরণ। বিচারে মনোরমা মাসিমার ৬ মাসের জেল ও ১৫০ টাকা জরিমানা হয়। জেলে বসে প্রতিদিনই ভাবতেন, এইতো স্বাধীনতা এলো, এতো মানুষের রক্ত, ত্যাগ এসব কি বৃথা যাবে?
কিন্তু জেল থেকে বেরিয়ে মনোরমা মাসিমা দেখলেন উল্টো চিত্র। রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড পুরোপুরি বন্ধ হয়ে যাবার উপক্রম। নেতারা হতাশ। রাজনৈতিক আকাশে এক গোমট- অন্ধকার। জেলখাটা মনোরমা বসু এতে খুবই অবাক হলেন। কী করবেন ভেবে পেলেন না। নিজেই একে একে গিয়ে হাজির হলেন পুরানো সহকর্মীদের বাড়িতে। তাঁদেরকে আবার রাজনীতিতে সক্রিয় হবার আহ্বান জানালেন। কিন্তু কেউ-ই তাতে সাড়া দিলেন না। রাজনৈতিক হতাশায় তখন সবার মুখে একই কথা. এ জাতি দিয়ে কিছু হবে না। কেউ কেউ আবার ভবিষ্যতের জন্য অপেক্ষা করতে বললেন।
কিন্তু মনোরমা বসুর তো বসে থাকলে চলবে না। তাঁর অপেক্ষা করারও সময় নেই। তিনি হাত দেন তাঁর স্বপ্নের মাতৃমন্দির প্রতিষ্ঠার কাজে। এই মাতৃমন্দির মনোরমা মাসিমার নামের সাথে পরিপূরকভাবে জড়িয়ে আছে। মাতৃমন্দির আর মনোরমা যেন একে অপরের আত্মা। একটিকে বাদ দিয়ে অন্যটির আলোচনা চলে না। এর সঙ্গেই জড়িয়ে আছে তাঁর সারা জীবনের সকল ভালবাসা। তিনি নিজের বাড়িতে পাড়ার ও নিজের ছেলেমেয়েদের নিয়ে গড়ে তোলেন মাতৃমন্দির সরকারী আদর্শ প্রাথমিক বিদ্যালয়। মাত্র ছয়জন ছাত্র-ছাত্রী নিয়ে যাত্রা শুরু করে মাতৃমন্দির। তার মধ্যে একজন ছিল তাঁর নিজের মেয়ে ভজনা। প্রথমে বারান্দায় বসে শুরু হয় লেখাপড়ার কাজ। পরে নিজের ঘরে জায়গা নিতে হয়। এভাবে ছাত্রী বাড়তে থাকলে একপর্যায়ে তাদের বসার জায়গা করে দিতে পাশের বাড়ির আরো একটা ঘর ভাড়া নেন তিনি। প্রথমে মনোরমা বসু একাই পড়াতেন পরে আরো দু’জন শিক্ষয়িত্রী নিয়োগ করতে হয়। দেখতে দেখতে জেলখাটা রাজনৈতিক-স্বদেশী মেয়ে মনোরমার নতুন ভূমিকার কথা ছড়িয়ে পড়ল। অনেকেই তাঁর তৈরি করা স্কুল দেখতে এলেন।
এই মাতৃমন্দিরের বিষয়ে প্রখ্যাত বিপ্লবী ও সাহিত্যিক সত্যেন সেন লিখেছেন, “এবার বাড়ি তৈরি করবার আয়োজন শুরু হয়ে গেল। শহরের উকিল, শিক্ষক এবং অন্যরা চাঁদা করে ৩০০ টাকা তুলে দিলে মাসিমা তাঁর গলার হার বিক্রি করে ২৫০ টাকা সংগ্রহ করলেন। এই ৫৫০ টাকা পুঁজি করে বিদ্যালয়ের বাড়ি তোলার কাজে হাত দেয়া হল।…নতুন বাড়ি তৈরি করার পর ছাত্রী সংখ্যা একশোর উপর উঠে গেলে এবার আরো দু’জন শিক্ষয়িত্রীকে নিয়োগ করতে হল।…কিন্তু বিদ্যালয়ের খরচ চলবে কী করে? ছাত্রীদের কাছ থেকে বেতন নেয়া হত না। …এই আর্থিক সমস্যার সমাধানের জন্য মাসিমা বাড়িতে বাড়িতে মুষ্টি-ভিক্ষার ঘট বসালেন। প্রতি রবিবার মাসিমা এবং অন্য শিক্ষয়িত্রিরা বাড়ি বাড়ি ঘুরে এই মুষ্টি- ভিক্ষার চাল সংগ্রহ করতেন। এ থেকেই শিক্ষয়িত্রীদের বেতন দেয়া হত।” এখানে মেয়েরা যে শুধু পড়াশোনা করত তা নয়, তারা লণ্ঠণের ফিতা, সুতার কাজ এবং নানারকম কুটির শিল্পের কাজও শিক্ষা করত। এছাড়াও মাতৃমন্দির বিদ্যালয়ে মেয়েদের নিয়মিত শরীরচর্চা করা হত। কালে কালে এই মাতৃমন্দিরের পরিধি আরো বেড়েছে।
মাতৃমন্দিরের এই কঠিন কাজ করার পাশাপাশি মনোরমা বসু রাজনৈতিক কাজেও কঠোর পরিশ্রম করেন এসময়। বরিশালে তখন কমিউনিস্ট ও কৃষক নেতা অমৃত নাগ ঘরে ঘরে পরিচিত নাম। অমৃত নাগ তাঁরও আত্মীয় ছিলেন। ফলে খুব সহজেই তিনি অমৃত নাগের সাথে যোগাযোগ স্থাপন করেন। তাঁর প্রভাবেই তিন কমিউনিস্ট মন্ত্রে দীক্ষিত হন। পরে অবশ্য এই কৃষক নেতাকে ১৯৫০ সালের সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার সময় হত্যা করা হয়। মনোরমা এই অমৃত নাগের স্মৃতিকে চিরস্মরণীয় করে রাখতে তাঁর পাঠাগারের নাম রাখেন ‘পল্লীকল্যাণ অমৃত পাঠাগার’।
ধীরে ধীরে কংগ্রেসের সাথে মনোরমা বসুর দূরত্ব বাড়তে থাকে। তিনি যাতে কমিউনিস্টদের সাথে না যেতে পারেন তার জন্য তাঁর পূর্বতন কংগ্রেসের সহকর্মীরা যথাসাধ্য বাধা দেন। কিন্তু মনোরমার পথ আগলে দাঁড়ানোর ক্ষমতা কারও ছিল না। তিনি ১৯৪২ সালে কমিউনিস্ট পার্টির সদস্য পদ লাভ করেন। ১৯৪৩ সালে কলকাতা শহরের মতো বরিশালেও মহিলা আত্মরক্ষা সমিতি গড়ে তোলেন মনোরমা বসু। তিনি এর প্রথম নির্বাচিত সম্পাদক হন। এসময় বাংলায় ব্যাপক দুর্ভিক্ষ দেখা দেয়। মাসিমা নিরন্ন মানুষের মুখে খাবার তুলে দেয়ার জন্য কয়েকটি স্থানে লঙ্গরখানা চালু করেন। এই বছরের ৮ মে কলকাতায় অনুষ্ঠিত হয় মহিলা আত্মরক্ষা সমিতির প্রথম সম্মেলন। সেই সম্মেলনে তিনি বরিশাল জেলার প্রতিনিধিত্ব করেন। এরই ধারাবাহিকতায় মনোরমা বসুর নেতৃত্বে ও আগ্রহে পরবর্তী বছর বরিশালেই অনুষ্ঠিত হয় মহিলা আত্মরক্ষা সমিতির দ্বিতীয় সম্মেলন। ১৯৪৫ সালে কলকাতায় অনুষ্ঠিত সংগঠনটির তৃতীয় সম্মেলনে তিনি এর কেন্দ্রীয় কার্যকরী কমিটির সদস্য নির্বাচিত হন। এসময় নোয়াখালীতে যে দাঙ্গা হয়েছিল সেখানে একনাগাড়ে প্রায় নয় মাস কাজ করেন তিনি। তাঁর সঙ্গে ছিলেন ইলা মিত্র, আবদুল্লাহ রসুল, ডা. রমেশ ব্যানার্জী, বিভা দাসগুপ্ত ও নৃপেন সেন।
১৯৪৭ সালে দেশ বিভাগের পর কমিউনিস্ট পার্টি আবার নিষিদ্ধ হয়ে যায় এবং কমিউনিস্টদের উপর নেমে আসে প্রচণ্ড দমন-পীড়ন। এদেশের অনেক কমিউনিস্ট নেতা তখন দেশ ছেড়ে ভারতে চলে যেতে বাধ্য হন। কিন্তু মনোরমা বসু কোথায় যাবেন? এখানে তিনি গড়ে তুলেছেন তাঁর স্বপ্নের ‘মাতৃমন্দির’। এই বিশাল কর্মযজ্ঞ রেখে তিনি কোথাও গিয়ে শান্তি পাবেন না। ফলে আত্মীয়-স্বজন, সহযোদ্ধাদের অনেকেই দেশ ছেড়ে চলে গেলেও মনোরমা তখন এদেশেই থেকে যান। বরং সেসময় তিনি কলকাতায় অনুষ্ঠিত কমিউনিস্ট পার্টির সভায় গিয়ে সিদ্ধান্ত জানিয়ে দিয়ে আসেন তিনি বরিশালে থেকেই কাজ করে যাবেন। দেশভাগের পর ‘নারী কল্যাণ সমিতি’ উঠে যায়, তখন গঠন করা হয় ‘পূর্ব পাকিস্তান মহিলা সমিতি’। এর প্রথম সম্মেলন হয় ময়মনসিংহ শহরে, সেখানে তিনি বরিশালের প্রতিনিধি হিসেবে যোগ দেন। ১৯৪৮ সালে তাঁর মেয়ে বাসনা যক্ষা রোগে আক্রান্ত হয়ে মৃত্যুবরণ করেন। বাসনা নিজেও রাজনৈতিক দলের কর্মী ছিলেন। তিনি ১৯৩৯ সালে ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলনের সময় গ্রেফতার হয়েছিলেন। মেয়ের মৃত্যুর পর ভগ্ন মনোরথে মনোরমা বসু আবার ফিরে আসেন তাঁর নিজের কর্মস্থল বরিশালে। কিন্তু কোনো শোক প্রকাশ করার অবকাশ সেদিন তাঁর ছিল না। কারণ বরিশালে এসেই তাঁকে জড়িয়ে পড়তে হয়েছিল রাজনৈতিক ঝামেলায়।
১৯৪৮ সালে সারা পূর্ব পাকিস্তান জুড়ে দেখা দিল দ্রব্যমূল্যের উর্ধ্বগতি। চাল- ডাল-তেলের দাম মানুষের নাগালের বাইরে চলে যায়। এই বছরের ৫ জুন মনোরমা বসু মহিলা সমিতির ব্যানারে বুভুক্ষু মেয়েদের নিয়ে বরিশালে মিছিল বের করেন। দ্রব্যমূল্যের উর্ধ্বগতির প্রতিকার চেয়ে এবং সস্তায় খাদ্যদ্রব্য সরবরাহের আবেদন জানিয়ে মিছিল গিয়ে পৌঁছে জেলা ম্যাজিস্ট্রেট কার্যালয়ে। কিন্তু ম্যাজিস্টেট কোনো কথা শুনতে নারাজ। ফলে ভূখা মিছিলের মেয়েরা সেই স্থানেই দাঁড়িয়ে শ্লোগান দিতে থাকে। সেদিন ছিল হাটবার। খাদ্য সমস্যা নিয়ে আন্দোলন। সমস্যা সকলেরই। ফলে খুব অল্প সময়েই সেখানে জড়ো হয়ে যায় হাজার-হাজার মানুষ। তাদের মধ্যে অনেকেই মেয়েদের সাথে গলা মিলিয়ে শ্লোগান দিতে থাকে। একপর্যায়ে ম্যাজিস্টেট মিছিলকারীদের সবাইকে জেলা চত্বর থেকে বের করে দেয়ার জন্য আইন-শৃঙ্ঘলা বাহিনীকে নির্দেশ দেন। আইন-শৃঙ্ঘলা বাহিনী তখন লাঠিচার্জ শুরু করে। লাঠিচার্জের খবর পেয়ে স্কুল ও কলেজ থেকে ছুটে আসে ছাত্র-ছাত্রীরা। তারাও এসে যোগ দেয় বুভুক্ষু মানুষের মিছিলে। পুলিশ তখন তাদের উপরেও লাঠিচার্জ করে। সেদিন পুলিশের হামলায় অনেক লোক আহত হয়। মহিলা সমিতির ৪ জন নেত্রীসহ ৮ জন ছাত্রকে গ্রেফতার করে পুলিশ। গ্রেফতারকৃতদের মধ্যে মনোরমা বসু ও তাঁর মেয়ে ভজনাও ছিলেন। তাঁরা প্রায় ১০ মাস বিনাবিচারে কারাগারে আটক ছিলেন। পরে বিচারে তাঁদের এক বছর কারাদণ্ড দেয়া হয়। কারাদণ্ডের মেয়াদ শেষ হলে অন্য সবাইকে ছেড়ে দেওয়া হল কিন্তু মনোরমা বসু ও তাঁর মেয়েকে জেলগেটেই আটক করা হয় নিরাপত্তা আইনে। এবার ৪ বছরের জেল। বন্দী অবস্থায় প্রথমে দুই বছর তাঁকে সিলেট ও পরে রাজশাহী জেলে বদলি করা হয়। এসময় জেলে তাঁর সঙ্গী ছিলেন ইলা মিত্র, নলিনী দাস, ভানু চ্যাটার্জি প্রমুখ। জেলে বসেও তিনি তাঁর কাজ করেছেন নির্বিঘ্নে। সেখানে কয়েদি মেয়েদের স্কুল খোলেন তিনি। সেইসব মেয়েদের তিনি রাজনৈতিক শিক্ষা ও নারী অধিকার সম্পর্কেও জ্ঞান দিতেন। জেলে বসে এসময় তিনি বেশ কিছু কবিতাও লেখেন। মেয়ে ভজনারও ৪ বছরের জেল হয়। জেল থেকে তাঁরা ছাড়া পান ১৯৫২ সালের ২৫ এপ্রিল।
ইতিমধ্যে বাংলার রাজনৈতিক আকাশে অনেক পরিবর্তন হয়ে গেছে। বাঙালি ভাষার জন্য আন্দোলন করেছে। ১৯৫৪ সালে গঠিত হয় যুক্তফ্রন্ট সরকার। কিন্তু কিছুদিন পরই তা বাতিল করে ৯২ (ক) ধারা জারি করা হয়। পাকিস্তানের রাজনৈতিক মঞ্চে আসন গেড়ে বসে মেজর জেনারেল ইস্কান্দার মীর্জা। সারা দেশে আবার রাজনৈতিক কর্মীদের উপর নেমে আসে অসহনীয় নির্যাতন। এদিকে ঘরবাড়ি সব ভেঙ্গে পড়েছে। স্থবির হয়ে পড়েছে মাতৃমন্দিরের কাজ।
এই সময় একটি বড় দুর্ঘটনা ঘটে যায় মনোরমা বসুর জীবনে। তাঁর স্বামী চিন্তাহরণ বসু প্রজাদের সাথে দেখা করার জন্য গিয়েছিলেন মফস্বলে, সেখানে হঠাৎ করে তিনি মৃত্যুবরণ করেন। এ এক বিরাট শোক মাসিমার জন্য। কারণ দীর্ঘ তেতাল্লিশ বছরের সংসার তাঁদের। চিন্তাহরণ বসু কোনোদিন মনোরমার রাজনৈতিক কাজে বাধা দেননি বরং নানাভাবে সহযোগিতা করেছেন। সাহস যুগিয়েছেন রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডে। মনোরমা বসুর স্বপ্নের মাতৃমন্দির গড়ে তোলায় তাঁর অবদান ছিল অনন্য। কিন্তু সেই শোক প্রকাশের ভাষা কই? কারণ তাঁর উপর ঝুলছে মুখ্যমন্ত্রী আবু হোসেন সরকারের গ্রেফতারি পরোয়ানা। সব কেমন যেন এলোমেলো হয়ে যায়। নেতারা সবাই এক এক করে গ্রেফতার হয়ে যাচ্ছেন। তিনি কী করবেন?
সিদ্ধান্ত নিলেন কোনো অবস্থাতেই গ্রেফতার হওয়া যাবে না। বাইরে থেকেই যতটুকু পারা যায় কাজ চালিয়ে নিতে হবে। একদিন বৃষ্টি-রাতের আঁধারে শুধুমাত্র বিধবার থান পড়ে বেরিয়ে এলেন রাস্তায়। কোথায় যাবেন, কীভাবে যাবেন কিছুই জানেন না। কিন্তু পালাতে হবে শুধু এটাই জানতেন। সেই সময়ের অভিজ্ঞতা বলতে গিয়ে বলেন, “লুকিয়ে থাকতে সাহায্য করল গ্রামের সাধারণ মানুষ। চাষীর বাড়িতে থেকেছি, গোয়াল বউ তার গোয়ালে লুকিয়ে রেখেছে। এক গ্রাম থেকে আর এক গ্রামে যাই-পালিয়ে পালিয়ে বেড়াই। এই সময় যোগাযোগ হয় গৃহস্থ ঘরের বউ-মেয়েদের সঙ্গে। নানান কথাবার্তা হত। কিন্তু সভা সমিতিতে আসা, মিছিল করা এটা তখনো ঠিক সবাই মেনে নিতে পারেনি। তবে আমার উপর ভরসা রেখেছে।” অবশেষে ১৯৫৬ সালে পাকিস্তান সরকার সকল নেতাদের উপর থেকে গ্রেফতারি পরোয়ানা প্রত্যাহার করে নেয়। মনোরমা বসু প্রকাশ্যে আসেন। আবার ঝাঁপিয়ে পড়েন মাতৃমন্দির আর রাজনৈতিক কাজে। ১৯৫৮ সালে আবার কমিউনিস্ট পার্টি নিষিদ্ধ হলে তিনি মাতৃমন্দিরে কাজের সুবিধার জন্য গড়ে তোলেন ‘মুকুল-মিলন খেলাঘর’ ও ‘পল্লীউন্নয়ন অমৃত পাঠাগার’। ১৯৭০ সালে তিনি মহিলা পরিষদ বরিশালের সভানেত্রী নির্বাচিত হন। এবছর দেশের দক্ষিণ উপকূল জুড়ে প্রলয়ঙ্করী ঘূর্ণিঝড় হয়। মনোরমা দেশের নানাস্থানে গিয়ে ত্রাণ সংগ্রহ করেন এবং তা সন্দ্বীপ ও পটুয়াখালির নিম্নাঞ্চলে বন্যার্ত মানুষের মাঝে বিতরণ করেন।
মুক্তিযুদ্ধ শুরু হলে মনোরমা বসু প্রথমে দেশেই আত্মগোপন করে থাকেন। পরে জুন মাসে চলে যান ভারতে। সেখানে গিয়েও তিনি মুক্তিযুদ্ধের সপক্ষে প্রচারণা, অর্থ সংগ্রহ, নারীদের সংঘটিত করা ইত্যাদি কাজে নিজেকে নিয়োজিত রাখেন। দেশ স্বাধীন হলে জানুয়ারি মাসেই তিনি দেশে ফিরে আসেন। দেশ পুনর্গঠনের কাজে নিয়োজিত হন। মহিলা পরিষদের উদ্যোগে বয়স্কা মহিলাদের জন্য কালীবাড়ি রোডের চন্ডীসদনে স্থাপন করেন বৈকালিক স্কুল। ১৯৭৪ সালে তিনি সোভিয়েত নারী কমিটির আমন্ত্রণে বাংলাদেশ মহিলা পরিষদের প্রতিনিধি হিসেবে রাশিয়া ভ্রমণ করেন। ১৯৮৩ সাল থেকেই তিনি বার্ধক্য আর নানা জড়ায় পীড়িত হতে থাকেন। অবশেষে এই মহিয়সী নারী ১৯৮৬ সালের অক্টোবরে মৃত্যুবরণ করেন তাঁরই প্রতিষ্ঠিত মাতৃমন্দিরে। মনোরমা বসুর মৃত্যুর পর বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টি তাঁকে ১৯৯২ সালের ১১ মার্চ মরণোত্তর সম্মাননা প্রদান করে। পরে ১৯৯৭ সালে শেরেবাংলা পদক (মরণোত্তর), ১৯৯৮ সালে মহিলা পরিষদ কর্তৃক সম্মননা (মরণোত্তর), ১৯৯৯ সালে বাংলাদেশ সরকার কর্তৃক বেগম রোকেয়া পুরস্কার (মরণোত্তর) প্রদান করা হয়। তাঁর রেখে যাওয়া যাবতীয় সম্পত্তি নিয়ে ২০০১ সালে গঠন করা হয় ‘মনোরমা বসু মাসিমা স্মৃতি ট্রাস্ট’।
তথ্যও ছবিসূত্র:
১। বদিউর রহমান রচিত ‘মনোরমা বসু মাসিমা’, প্রকাশক-আগামী প্রকাশনী, প্রথম প্রকাশ ২০০৩, ফেব্রুয়ারি (ছবি)।
২। মনোরমা বসু স্মৃতি ট্রাস্ট কর্তৃক প্রকাশিত পুস্তিকা ‘এক আলোর শিখা’ প্রথম প্রকাশ ২০০৭।
লেখক: চন্দন সাহা রায়