স্বাধীনতার পর বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান কমরেড মণি সিংহকে তাঁর বাড়ি- ভিটা ফিরিয়ে দিতে চেয়েছিলেন। এর উত্তরে কমরেড মণি সিংহ বলেছিলেন, “টংক আন্দোলন ও বাংলাদেশের মুক্তি আন্দোলনে লক্ষ লক্ষ মানুষ তার প্রাণ বিসর্জন দিয়েছে এবং তাদের বাড়ি ঘর উচ্ছেদ হয়েছে। যতদিন পর্যন্ত এই দেশের প্রতিটি মানুষের অন্ন-বস্ত্র-বাসস্থান-শিক্ষা-চিকিৎসা ও কর্মসংস্থান না হচ্ছে ততদিন পর্যন্ত আমার বাড়ি-ভিটা ফিরিয়ে নেয়ার প্রশ্ন উঠতে পারে না। যে দিন সবার ব্যবস্থা হবে সেদিন আমারও ব্যবস্থা হবে”।
বাংলাদেশের কৃষক-শ্রমিক-মেহনতি মানুষের শোষণমুক্তির লড়াই-সংগ্রামের পুরোধা কমরেড মণি সিংহ। যে নামটির সঙ্গে জড়িয়ে আছে বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টির ইতিহাস ও ঐতিহ্য। কমিউনিস্ট পার্টির ক্ষেত্রে তিনি প্রবাদতুল্য বিপ্লবী কমরেড। তিনি এখন আর কেবল ব্যক্তি বা নাম নয়, রীতিমতো এক প্রতিষ্ঠান। মণি সিংহ এখন জীবনদর্শন আর জীবনাদর্শের প্রতিশব্দ। তিনি এখন সংগঠন ও সংগ্রামের প্রতীকী প্রতিরূপ। ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদের শাসন-শোষণের হাত থেকে ভারতের স্বাধীনতা অর্জনে তিনি ছিলেন অন্যতম বিপ্লবী। পাকিস্তানের স্বৈর- শাসন থেকে স্বাধীন বাংলাদেশ নির্মাণের জন্য স্বাধীনতা, গণতন্ত্র ও সমাজতন্ত্রের সংগ্রামের দীর্ঘ ইতিহাসের অন্যতম মহানায়কও ছিলেন তিনি। মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে পাকিস্তানি শোষণের অবসান ঘটিয়ে একটি সাম্যের সমাজ প্রতিষ্ঠার প্রত্যাশা করেছিলেন।
দীর্ঘ সাত দশক ধরে কৃষক-শ্রমিক-মেহনতি মানুষের সার্বিক মুক্তির জন্য, শোষণ- বৈষম্যহীন সমাজ নির্মাণের লক্ষ্যে এবং মানুষের চুড়ান্ত মুক্তির জন্য কমিউনিস্ট আন্দোলন ও কমিউনিস্ট পার্টি গড়ে তোলার ক্ষেত্রে যে অবদান তিনি রেখে গেছেন, তা বাংলাদেশের ইতিহাসে চিরস্মরণীয় হয়ে আছে এবং থাকবে।
মার্কসবাদী জীবনাদর্শই তাঁকে পথ দেখিয়েছে একজন বড় মাপের মানুষ হিসেবে তাঁর পরিচয় ইতিহাসে লিপিবদ্ধ করে যেতে। তিনি প্রায়ই বলতেন,”বিপ্লবী মানবতাবাদ হচ্ছে কমিউনিস্ট আদর্শের মর্মকথা। আমরা লড়াই করছি কেবল একটি শ্রেণীর মুক্তির জন্য নয়, সার্বিকভাবে মানবমুক্তির জন্যই আমাদের সংগ্রাম। ঐতিহাসিক বিচারে তাই মানুষই আমাদের সাধনার কেন্দ্রবিন্দু। সেই মানুষের প্রতি ভালোবাসা, মানবপ্রেমকেই বিপ্লবী ধারায় সমাজে সর্বজনীন করে তুলতে হবে”।
কমরেড মণি সিংহের জন্ম ১৯০১ সালের ২৮ জুলাই। কলকাতা শহরে। বাবা কালীকুমার সিংহ ছিলেন নেত্রোকোনা জেলার পূর্বধলার জমিদারের সন্তান। মণি সিংহের বয়স যখন আড়াই বছর তখন তাঁর বাবা মারা যান। এসময় তাঁরা কিছুদিন ঢাকায় তাঁর মামা ডেপুটি ম্যাজিস্ট্রেট সুরেন সিংহের বাড়িতে থাকেন।
মা ছিলেন তৎকালীন ময়মনসিংহ জেলার নেত্রকোণা মহাকুমার সুসং-দুর্গাপুরের জমিদার বংশের মেয়ে। মণি সিংহের বয়স যখন ৭ বছর সেই সময় থেকে তাঁরা সুসং-দুর্গাপুরে বসবাস শুরু করেন। এখানেই মণি সিংহ প্রাথমিক পড়াশুনা শুরু ও শেষ করেন। তারপর মাধ্যমিক শিক্ষার জন্য কলকাতায় যান। ওই সময় ব্রিটিশ সরকারের প্রতি ঘৃনা ও ক্ষোভ জমে যায় তাঁর চেতনায়। তাই ১৯১৪ সালে মাত্র ১৩ বছর বয়সে ব্রিটিশকে উচ্ছেদের জন্য সশস্ত্র বিপ্লববাদী দল অনুশীলনের সাথে যুক্ত হন। ধীরে ধীরে নিজের সাহস ও দৃঢ়তা দিয়ে সাংগঠনিকভাবে বিপ্লবী কর্মকাণ্ডে দক্ষতার পরিচয় দেন।
১৯২১ সালের অসহযোগ ও খেলাফত আন্দোলনের ব্যাপকতা তাঁকে সংগ্রামী মানুষে পরিণত করে। এ সময় তিনি ব্রিটিশবিরোধী সশস্ত্র জাতীয় সংগ্রামে কৃষকদের সংগঠিত করার জন্য নিজ জেলায় কৃষকদের মধ্যে কাজ শুরু করেন। বঞ্চিত হাজং কৃষকদের সন্তানদের জন্য একাধিক স্থানে তিনি পাঠশালা তৈরী করেন। ১৯২৫ সালে রুশবিপ্লবের প্রত্যক্ষদর্শী ও মার্কসবাদী বিপ্লবী গোপেন চক্রবর্তীর সাথে কমরেড মণি সিংহের সাক্ষাৎ হয়। দিনে দিনে দু’জনের মধ্যে গড়ে ওঠে মার্কসবাদী চেতনার সম্পূর্ক। এ সময় তিনি মার্কসবাদ ও লেনিনবাদের রাজনীতি, দর্শন ও আদর্শে নিজেকে নির্মাণ করেন।
শ্রমিক আন্দোলনের উপায় খুঁজে বের করার জন্য ১৯২৬ সালের শেষের দিকে মণি সিংহ কলকাতায় ক্লাইভ স্ট্রীটের গুপ্ত ম্যানশনে একটি ঘর ভাড়া নিয়ে ‘ওরিয়েন্টাল ট্রেডিং’ নাম দিয়ে একটি অফিস খোলেন। এখানে দেখা হয় গোপেন চক্রবর্তী, ধরণী গোস্বামী, নীরোদ চক্রবর্তী, নলীন্দ্র সেনসহ আরো অনেক কমিউনিস্ট বিপ্লবীর সঙ্গে। এ সময় তিনি প্রতিদিন কমরেড মুজাফফর আহমেদের হ্যারিসন রোডের অফিসে গিয়ে ‘গণবাণী’ পত্রিকা পড়তেন।
১৯২৮ সালের প্রথম দিকে গোপেন চক্রবর্তী মণি সিংহকে জানালেন শ্রমিক আন্দোলনের সুবর্ণ সুযোগ এখন। কেসি মিত্র রেলওয়ে ধর্মঘট করেছেন। সেখানে কর্মী প্রয়োজন। এসুযোগ গ্রহণ করতে হবে। পরদিন মণি সিংহ লিলুয়া রেলওয়ে গেলেন। মেটিয়াব্রুজের কেশোরাম টেক্সটাইল মিলে গিয়ে ধর্মঘটে অংশ নেন। সেখানেই শুরু করেন শ্রমিক আন্দোলন।
১৯৩০ সালে মাস্টারদা সূর্য সেনের নেতৃত্বে চট্টগ্রামে অস্ত্রাগার লুটের ঘটনায় ব্রিটিশ শাসক পাগলা কুকুরের মতো ক্ষিপ্ত হয়ে নির্বিচারে গ্রেফতারের হিড়িক চালায়। শত শত বিপ্লবীকে গ্রেফতার করে। ৯ মে কলকাতায় গ্রেফতার হন মণি সিংহ। টানা ৫ বছর বিভিন্ন জেল-ক্যাম্প ঘুরিয়ে এনে ১৯৩৫ সালে সুসং-দুর্গাপুরে নিজ গ্রামের বাড়িতে নজরবন্দী করে তাঁকে রাখা হয়। এখানে সাধারণ প্রজাদের ন্যায্য অধিকার আদায়ের জন্য আন্দোলন গড়ে তোলেন তিনি। যার কারণে মণি সিংহকে তিন বছরের কারাদণ্ডে যেতে হয়। আপিলে করলে এ সাজা দেড় বছর কমে আসে।
১৯২৫ সালে কমিউনিস্ট পার্টির আদর্শে অর্থাৎ মার্কসবাদ-লেনিনবাদের দীক্ষা নেন এবং ১৯২৮ সাল থেকে সর্বক্ষণের কর্মী হয়ে যান তিনি। তখন পার্টিতে সভ্যপদ খুবই সংকীর্ণ ভিত্তিতে দেয়া হত। কাজেই একনিষ্টভাবে শ্রমিক আন্দোলনের কাজ করলেও পার্টির সভ্যপদ তখনও পাননি তিনি। তবে কমরেড মোজাফ্ফর আহমদ ১৯২৮ সালে তাঁকে ‘ওয়ার্কার্স এন্ড পিজেন্টস’ পার্টিতে নিয়ে নেন । কিন্তু কমিউনিস্ট পার্টির কথা তিনি বলেননি। ১৯৩৭ সালে জেল থেকে বের হওয়ার পর পার্টির সভ্য বলে তাঁকে জানানো হয়।
কমরেড মণি সিংহ এ প্রসঙ্গে ‘জীবন-সংগ্রাম’ বই-এ লিখেছেন, “আমি ১৯৩৭ সালের মাঝামাঝি করিমপুর থানা, নদীয়ার জেল থেকে মুক্তি পাই। আমি মুক্তি পেয়ে কলকাতায় গেলাম কিন্তু বন্ধু কমিউনিস্টদের কারও দেখা পেলাম না। ঐ সময়ে কলকাতা ছাড়া আর কোথাও কমিউনিস্ট পার্টি ছিল না। সেই কমিউনিস্ট পার্টিও ছিল আত্মগোপনে। আমার কাছে যে রেলওয়ে পাস ছিল- ঐ পাস নিয়ে ঐ দিনই- আমার গ্রামের বাড়ির উদ্দেশ্যে রওনা হলাম- মায়ের সাথে দেখা করার জন্য। গ্রামে আসার ২/৩ দিনের মধ্যেই মুসলিম কৃষকরা আমার সাথে দেখা করতে এলেন। ৮/১০ জন বয়স্ক মুসলিম কৃষক আমার বাড়িতে এসে বললেন, “খোদার রহমতে আপনে খালাস পাইছেন- আমরা খুব খুশি হইছি। এহন আপনে টংকটা লইয়া লাগুইন। আমরা আর টংকের জ্বালায় বাঁচতাছি না”। আমি তাঁদের বললাম, “আমি কলকাতায় শ্রমিক আন্দোলন করি, মাকে দেখার উদ্দেশ্যে সাতদিনের জন্য বাড়ি এসেছি, কাজেই আমি ফিরে যাবো”। তাঁরা বললেন, “এডা হয় না। দেশের ছাওয়াল দেশে থাকিয়া টংক লাইয়া লাগুইন। আমরা যাতে বাঁচি তার চেষ্টা করুইন। খোদা আপনার ভালা করব”।আমি তাঁদের বুঝিয়ে- সুঝিয়ে ফেরত পাঠিয়ে দিলাম। কিন্তু প্রতিদিন তাঁরা এসে আমাকে টংক আন্দোলন করার জন্য অনুরোধ করতে থাকলেন।”
চার পাঁচদিন পর একদিন রাত্রিবেলায় শুয়ে শুয়ে তিনি চিন্তা করলেন, তিনি কি ট্রেড ইউনিয়ন কাজের জন্য কলকাতা যেতে উদগ্রীব? ঐ সময়ে মেটিয়াবুরুজে একটি ট্রেড ইউনিয়নের বেস সৃষ্টি হয়েছিল, কারণ মনি সিংহরা প্রতিটি শ্রমিক সংগ্রামে জয়লাভ করেছিলেন। এখানে টংক আন্দোলন করা জটিল ও কঠিন ব্যাপার। কারণ যাদের বিরুদ্ধে টংক আন্দোলন করতে হবে, তাঁরা সবাই তাঁর আত্মীয়। কেবল তাই নয়, তাঁর নিজ পরিবারেও টংক জমি আছে। কাজেই তাঁকে সংগ্রাম করতে হবে সকলের বিরুদ্ধে । হয়ত এই সব ভেবেই তিনি পিছিয়ে যাচ্ছেন। এই কথা যখন তাঁর মনে উদয় হল, তখন তাঁর মধ্যে একটি দ্বন্দ্ব সৃষ্টি হল। ট্রেড ইউনিয়ন না টংক আন্দোলন?
টংক মানে ধান কড়ারী খাজনা। হোক বা না হোক কড়ার মত ধান দিতে হবে। টংক জমির ওপর কৃষকদের কোন স্বত্ব ছিল না। ময়মনসিংহ জেলার উত্তরে কলমাকান্দ, সুসং-দূর্গাপুর, হালুয়াঘাট, নালিতাবাড়ি, শ্রীবর্দি থানায় এই প্রথা প্রচলিত ছিল। বিশেষ করে সুসং-জমিদারি এলাকায় এর প্রচলন ছিল ব্যাপক। কেন টংক নাম হল তা জানা যায় না, এটা স্থানীয় নাম। এই প্রথা বিভিন্ন নামে ঐ সময়ের পূর্ববঙ্গে প্রচলিত ছিল, যেমন চুক্তিবর্গা, ফুরন প্রভৃতি। ঐ সময় পশ্চিমবঙ্গেও ঐ প্রথা প্রচলিত ছিল। সুসং জমিদার এলাকার যে টংক ব্যবস্থা ছিল তা ছিল খুবই কঠোর। সোয়া একর জমির জন্য বছরে ধান দিতে হত সাত থেকে পনের মন। অথচ ঐ সময়ে জোত জমির খাজনা ছিল সোয়া একরে পাঁচ থেকে সাত টাকা মাত্র। ঐ সময় ধানের দর ছিল প্রতিমন সোয়া দুই টাকা ফলে প্রতি সোয়া একরে বাড়তি খাজনা দিতে হত এগার টাকা থেকে প্রায় সতের টাকা। এই প্রথা শুধু জমিদারদের ছিল তা নয়; মধ্যবিত্ত ও মহাজনরাও টংক প্রথায় লাভবান হতেন। একমাত্র সুসং-জমিদাররাই টংক প্রথায় দুই লক্ষ মন ধান আদায় করতেন। এটা ছিল এক জঘন্যতম সামন্ততান্ত্রিক শোষণ।
সুসং-জমিদাররা গারো পাহাড়ের অধিকার হতে বঞ্চিত হয়ে মনে হয় এই প্রথা প্রবর্তন করেন। জোত স্বত্বের জমির বন্দোবস্ত নিতে হলে প্রতি সোয়া একরে একশ টাকা থেকে দুইশ টাকা নজরানা দিতে হত। গরীব কৃষক ঐ নজরানার টাকা সংগ্রহ করতে সমর্থ ছিলেন না। টংক প্রথায় কোন নজরানা লাগত না। কাজেই গরীব কৃষকের পক্ষে টংক নেওয়াই ছিল সুবিধাজনক। টংকের হার প্রথমে এত বেশি ছিল না। কৃষকরা যখন টংক জমি নেওয়ার জন্য এগিয়ে আসলেন, তখন প্রতি বছর ঐ সব জমির হার নিলামে ডাক হত। ফলে হার ক্রমে বেড়ে যায়।
যে কৃষক বেশী ধান দিতে রাজী হত তাঁদেরই অর্থাৎ পূর্বত বেশি ডাককারী কৃষকের নিকট থেকে জমি ছাড়িয়ে হস্তান্তর করা হত। এইভাবে নিলাম ডাক বেড়ে গিয়ে ১৯৩৭ সাল থেকে হার সোয়া একরে পনের মন পর্যন্ত উঠে যায়।
মনি সিংহ ভাবতে লাগলেন, তিনি যদি মার্কসবাদ-লেনিনবাদে বিশ্বাসী হন, যদি মার্কসবাদ-লেনিনবাদ গ্রহণ করে থাকেন, তবে সেখানে তাঁর এবং তাঁর পরিবারের স্বার্থ নিহিত থাকা সত্বেও আদর্শের জন্য তাঁর বিরুদ্ধে আন্দোলন গড়ে তোলা তাঁর কর্তব্য। যা অন্যায়, যা সামন্ততান্ত্রিক অবশেষে তাঁর বিরুদ্ধে সংগ্রাম করা উচিত। সাম্রাজ্যবাদ ও সামন্তবাদের বিরুদ্ধে চেতনা উদ্দীপিত করা ও তাঁদের সংগঠিত করা একান্ত প্রয়োজন। এইভাবেই দেশকে স্বাধীনতা সংগ্রামে অগ্রসর করে নেয়া সম্ভব। এটা তাঁর আদর্শের সাথে সংগতিপূর্ণ। এখানে তাঁর ব্যক্তিগত ও পারিবারিক স্বার্থ নিহিত আছে বলে তিনি ঐ আন্দোলন হতে কখনোই নিজেকে দূরে সরিয়ে রাখতে পারেন না। তাঁর স্বার্থ আছে বলেই তাঁকে কৃষকদের নিয়ে এগিয়ে যেতে হবে। কৃষকদের এই সংগ্রামে সাথী হয়ে যদি এই সংগ্রাম গড়ে তুলতে পারেন, তবেই তাঁর সঠিক পথে যাত্রা শুরু হবে। এটা তাঁর জীবনের মূল পরীক্ষা। এই পরীক্ষায় তাঁকে উত্তীর্ণ হতেই হবে। এই দ্বন্দ্ব তাঁর মধ্যে চলতে লাগল।
তাঁর যতটুকু মার্কসবাদ-লেনিনবাদের জ্ঞান ছিল, আর যেটুকু শ্রমিক আন্দোলনের অভিজ্ঞতা হয়েছিল তাকেই ভিত্তি করে সমস্ত দ্বিধাদ্বন্দ্ব কাটিয়ে মনি সিংহ এই সিদ্ধান্তে উপনীত হলেন যে, টংক আন্দোলনে তিনি সর্বতোভাবে শরিক হবেন। এভাবে মণি সিংহ টংক আন্দোলনের সাথে জড়িত হলেন এবং কালক্রমে এ আন্দোলনের অবিসংবাদিত নেতায় পরিণত হলেন।
আন্দোলনের তীব্রতা ক্রমশ: বৃদ্ধি পেলে ১৯৪০ সালে সরকার সার্ভে করে টংকের পরিমাণ কমিয়ে দেয়। ওই বছর নভেম্বর মাসে কৃষকদের নিয়ে আন্দোলনের মাধ্যমে তিনি তাঁদের নিজ জমিদারী টংকপ্রথা বিলুপ্ত ঘোষণা করেন। এ সময় তিনি নিজ বংশ থেকে সম্পর্কচ্যুৎ হন। দীর্ঘদিন এ আন্দোলন চলছিল। ১৯৪১ সালের জানুয়ারী মাসে গভর্নর টংক এলাকার অবস্থা সচক্ষে দেখতে এলে পূর্বাহ্নে কয়েকজন সহকর্মীসহ মণি সিংহকে গ্রেপ্তার করে ১৫ দিন আটক রাখে। ছাড়া পেয়ে পরিস্থিতি বুঝে তিনি আত্মগোপন করেন। ওই বছর দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ ও এই যুদ্ধেকালে কমিউনিস্ট পার্টি আন্তর্জাতিক ফ্যাসিবাদ বিরোধী ‘জনযুদ্ধের’ নীতি গ্রহণ করায় টংক আন্দোলন কিছু দিনের জন্য বন্ধ থাকে। এক পর্যায়ে ব্রিটিশ সরকার টংক প্রথার সংস্কার করলেও প্রথাটি একবারে উচ্ছেদ হলো না। আন্দোলনে নেতৃত্বদানকারী সংগঠন কৃষক সভা টংক প্রথার পুরোপুরি উচ্ছেদ চাইলো।
১৯৪৪ সালে মণি সিংহ সারা বাংলার কৃষাণ সভার প্রেসিডিয়ামের সভ্য নির্বাচিত হন। ১৯৪৫ সালে নেত্রকোনায় অনুষ্ঠিত নিখিল ভারত কৃষাণ সভার ঐতিহাসিক সম্মেলনের অভ্যর্থনা কমিটির চেয়ারম্যান হিসাবে মণি সিংহ ছিলেন সম্মেলনের অন্যতম প্রধান সংগঠক। এ সম্মেলনে নেত্রকোণা শহরের নাগড়ার মাঠে একলক্ষ লোকের সামবেশ ঘটে। এ সম্মেলনে উপস্থিত ছিলেন কমরেড মোজাফ্ফর আহমদ, পিসি যোসিসহ ভারত বিখ্যাত কমিউনিস্ট নেতৃবৃন্দ। ১৯৪৭ সালে অনুষ্ঠিত ভারতের সাধারণ নির্বাচনে তিনি নেত্রকোণা জেলার নিজ এলাকা থেকে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেছিলেন।
পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পরও টংক আন্দোলন চলতে থাকে এবং তা সশস্ত্র আন্দোলনে রূপ নেয়। সে সময় প্রচলিত গল্প ছিল যে, কমরেড মণি সিংহ একটি সাদা ঘোড়ায় সওয়ার হয়ে সশস্ত্র কৃষক বিদ্রোহের নেতৃত্ব দিয়েছিলেন। ১৯৫০ সালে টংকের পরিবর্তে টাকায় খাজনা প্রবর্তিত হয় এবং জমিতে কৃষকের স্বত্ব স্বীকৃত হয়। দীর্ঘ ১২ বছর ধরে এই টংক আন্দোলনে পুলিশের গুলিতে নারী-পুরুষ-শিশুসহ অনেক মানুষকে প্রাণ দিতে হয়েছে। কৃষকদের শতশত বাড়ি ধুলিসাৎ ও গ্রাম পুড়িয়ে ছারখার করা হয়েছে। এই আন্দোলনের মধ্য দিয়ে এলাকায় কৃষক সভা ও কমিউনিস্ট পার্টির শাক্তিশালী তৃণমূল সংগঠনও গড়ে উঠেছিল। পাকিস্তানের প্রথম মুসলিম লীগ সরকার মণি সিংহের বাড়ি ভেঙ্গে হালচাষ করে এবং তাঁর স্থাবর সম্পত্তি নিলাম করে দেয়।
‘১৯৪৭ সালে পাকিস্তান প্রতিষ্ঠিত হবার পরে পূর্ণ গণতন্ত্র ও শোষণমুক্ত সমাজের আদর্শকে যাঁরা সামনে এনেছেন মণি সিংহ তাদের একজন। বাংলার মেহনতী মানুষের সর্বাঙ্গীন মুক্তি সংগ্রামে অন্যতম শ্রেষ্ঠ সংগঠক প্রিয় নেতাকে কায়েমী স্বার্থের রক্ষকেরা দমন করার সব রকম চেষ্টাই করেছেন’।—সত্যেন সেন।
পঞ্চাশের দশক থেকে শুরু করে ষাটের দশকের শেষ পর্যন্ত টানা ২০ বছর তাঁকে বাধ্য হয়ে আত্মগোপনে থাকতে হয়। এ সময় আইয়ুব সরকার তাঁকে ধরিয়ে দেওয়ার জন্য ১০ হাজার টাকা পুরস্কার ঘোষণা করে। ১৯৫৫ সালে আবু হোসেন সরকারের সময় মাত্র ১ মাস প্রকাশ্যে থাকতে পেরেছিলেন। জেলে থাকা অবস্থায় তিনি ১৯৬৮ সালের অক্টোবরে অনুষ্ঠিত পার্টির চতুর্থ সম্মেলনে কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য নির্বাচিত হন। ১৯৬৯ সালে জাতীয় অনেক নেতৃবৃন্দের সাথে কমরেড মণি সিংহকেও গ্রেফতার করা হয়। তবে ১৯৬৯ সালেই ঐতিহাসিক গণঅভ্যুত্থানের পর ২২ ফেব্রুয়ারি সকলের সাথে তিনিও মুক্তি পান।
১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধের সময় কমরেড মণি সিংহ গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখেন । মুক্তিযুদ্ধের শুরুতে তিনি জেলে বন্দী ছিলেন। যুদ্ধ শুরু হলে ১৯৭১ সালের এপ্রিল মাসে বন্দীরা রাজশাহী কারাগার ভেঙ্গে তাঁকে মুক্ত করে। জেল থেকে বেরিয়ে তিনি ভারতে যান। তাঁর প্রচেষ্টায় গড়ে উঠেছিল ন্যাপ-কমিউনিস্ট পার্টি-ছাত্র ইউনিয়নের যৌথ গেরিলা বাহিনী। যে বাহিনী মূলত যুদ্ধের কৌশলী বাহিনী ছিল।
মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে আন্তর্জাতিক রাজনৈতিক শক্তির সমর্থন আদায়ে তিনি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন। তাঁর কারণে সোভিয়েত ইউনিয়ন মুক্তিযুদ্ধে সর্বাত্মক সহযোগিতা করে। আন্তর্জাতিক অঙ্গনে আমাদের মহান মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে সমাজতান্ত্রিক শিবিরের রাজনৈতিক, কুটনৈতিক সমর্থন ও সাহায্য সহযোগিতা আদায়ে কমরেড মণি সিংহের নেতৃত্বে কমিউনিস্ট পার্টির অবদান ছিল গুরুত্বপূর্ণ। কমরেড মণি সিংহ ভারতের প্রয়াত প্রধানমন্ত্রী ইন্দ্রিরা গান্ধীর সাথে দেখা করে কমিউনিস্ট পার্টি ও ন্যাপের সম্মিলিত মুক্তিবাহিনী সংগঠিত করার কাজে সমর্থন আদায়ে সক্ষম হন। যুদ্ধের সময় মুজিবনগর সরকারকে পরামর্শ দেয়ার জন্য গঠিত উপদেষ্টা পরিষদের অন্যতম প্রধান সদস্য ছিলেন মণি সিংহ।
১৯৭৩ সালের দ্বিতীয় কংগ্রেসে ও ১৯৮০ সালের তৃতীয় কংগ্রেসে তিনি পার্টির সভাপতি নির্বাচিত হন। ১৯৭৫ সালে বঙ্গবন্ধু হত্যার পর কমিউনিস্ট পার্টি আবারও বেআইনী ঘোষিত হয়। ঐ সময় আজীবন সংগ্রামী এ নেতা আবার রাজনৈতিকভাবে নির্যাতনের শিকার হন ও কারাবরণ করেন। জিয়াউর রহমান যখন ক্ষমতায় ছিলেন তখন ১৯৭৭ সালের মাঝামাঝি সময় একদিন কমরেড মণি সিংহকে গ্রেপ্তার করে বিনা বিচারে ছয় মাস অন্তরীণ রাখা হয়। সেই সময়ে তাঁর বয়স হয়েছিল ৭৭ বছর।
ব্যক্তিগত জীবনে কমরেড মণি সিংহ ছিলেন অনাড়ম্বর সাদামাটা জীবনের অধিকারী। কমরেড অণিমা সিংহ ছিলেন মণি সিংহের সহধর্মিনী। সিলেটে মেডিকেল স্কুলের ছাত্রী থাকা অবস্থায় অণিমা সিংহ বৃটিশ বিরোধী আন্দোলন ও কমিউনিস্ট আন্দোলনে যুক্ত হন। তিনি কৃষক নেত্রী ছিলেন। টংক আন্দোলনের সময় তিনি ঐ আন্দোলনে যোগদান করেন। পঞ্চাশ ও ষাটের দশকে তিনি কমরেড মণি সিংহের সাথে আত্মগোপন অবস্থায় ছিলেন। আত্মগোপনে থাকা অবস্থায় তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ইতিহাসে এম.এ ডিগ্রী অর্জন করেন। স্বাধীনতার পর তিনি কৃষক সমিতির কেন্দ্রীয় কমিটির সাংগঠনিক সম্পাদিকা নির্বাচিত হন। ১৯৮০ সালের ১ জুলাই মাত্র ৫২ বছর বয়সে এক সড়ক দুর্ঘটনায় তিনি মারা যান।
১৯৮৪ সালের ২৩ ফেব্রুয়ারী কমরেড মণি সিংহ গুরুতর অসুস্থ হয়ে পড়েন। তখন থেকে দীর্ঘ ৬ বছর অসুস্থ থাকার পর ১৯৯০ সালের ৩১ ডিসেম্বর তিনি মৃত্যুবরণ করেন।
বাংলাদেশের স্বাধীনতা ও মুক্তিযুদ্ধে কৃতিত্বপূর্ণ অবদানের স্বীকৃতি স্বরূপ প্রয়াত কমরেড মণি সিংহকে ‘স্বাধীনতা পুরস্কার ২০০৪ (মরণোত্তর)’ প্রদান করা হয়।
শান্তি, গণতন্ত্র ও সমাজ প্রগতির সংগ্রামে এবং সোভিয়েত ইউনিয়ন ও বাংলাদেশের জনগণের মধ্যে মৈত্রী সুদৃঢ়করণের ক্ষেত্রে অবদানের স্বীকৃতিস্বরূপ মণি সিংহকে সোভিয়েত ইউনিয়ন সরকার ‘অর্ডার অব ফ্রেন্ডশিপ অব পিপলস’ পদকে ভূষিত করে। কেবল সোভিয়েত ইউনিয়ন নয় বুলগেরিয়া এবং চেকোশ্লোভাকিয়া সরকারও তাঁকে বিশ্বশান্তি প্রতিষ্ঠায় অবদানের স্বীকৃতি প্রদান করে।
তথ্য ও ছবিসূত্র:
১। কমরেড মণি সিংহ স্মারকগ্রন্থ: সম্পাদনা-এম এম আকাশ, এ এন রাশেদা। জাতীয় সাহিত্য প্রকাশনী, ঢাকা। প্রকাশকাল, ২০০৯।
২। জীবন-সংগ্রাম: কমরেড মণি সিংহ। জাতীয় সাহিত্য প্রকাশনী, ঢাকা। প্রকাশকাল, ২৮ জুলাই ১৯৮৩।
৩। জননেতা কমরেড মণি সিংহ: মণি সিংহের সংক্ষিপ্ত জীবনী, গ্রন্থনা: কমরেড মণি সিংহ মেলা উদযাপন কমিটি, ২৬ ডিসেম্বর ২০০২। ( বি.দ্র: এই পুস্তিকাটি তৈরী করা হয়েছে: বজলুর রহমান লিখিত ‘শেখ মুজিব ও মণি সিংহের ঐতিহাসিক বৈঠক’ (সংবাদ ২৮ জুলাই ২০০১), সত্যেন সেন রচিত ‘জননেতা কমরেড মণি সিংহ’ (জানুয়ারী ১৯৬৯) ও কমরেড মণি সিংহের লিখিত ‘জীবন সংগ্রাম’ বই থেকে সংকলিত।)
৪। গণমানুষের মুক্তির আন্দোলন: মাহফুজা খানম/তপন কুমার দে, প্রকাশকাল ২০০৯।
৫। ছবি: কমরেড মণি সিংহ স্মারকগ্রন্থ ।
লেখক : রফিকুল ইসলাম (শেখ রফিক)