পলাশী। একটি মাঠের নাম। মস্ত বড় সে মাঠ। আঁকাবাঁকা গঙ্গার তীরে অবস্থিত। এই মাঠের তিন দিক জ়ুড়ে দেড় হাজার বিঘা জমির ঊপর রয়েছে এক বিশাল আমবাগান। এর পূর্ব নাম ছিল লক্ষবাগ। ওইখানে একসময় লক্ষ লক্ষ আমগাছ ছিল। সেই কারণে কালক্রমে এর নাম হয়ে দাঁড়ায় আম্রকানন। অর্থাৎ পলাশীর আম্রকানন। যেখানে বসে ষড়যন্ত্রের মাধ্যমে আবহমান বাংলার স্বাধীনতাকে ১৭৫৭ সালে কেড়ে নেয়া হয়েছিল।
শুরু হল ইংরেজ শাসন। শাসন না বলে, বলা উচিত শোষণ, ত্রাস, নিপীড়ন ও নির্যাতন। চলতে থাকে বছরের পর বছর। যুগের পর যুগ। এভাবে পুরো এক শতাব্দী। বাংলার মানুষকে দীর্ঘস্থায়ীভাবে শোষণ করার জন্য ইংরেজরা নানা ধরনের পদক্ষেপ ও পরিকল্পনা গ্রহণ করে তা বাস্তবায়ন করতে থাকে। এজন্য ইংরেজ প্রথমে তার দালাল গোষ্ঠী তৈরী করে নেয়। এরা বেশির ভাগই ছিল সুবিধাবাদী। দালালদের নানাবিদ সুযোগ সুবিধা দিয়ে গোটা ভারতবাসীকে শাসন-শোষণ করার ভিত্তি পাকাপোক্ত করে নেয় ইংরেজ। তারা সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার বীজ বপন করে হিন্দু-মুসলমানের সম্প্রীতি ভেঙ্গে দেয়। ভাষা, সংস্কৃতি, ইতিহাস ও ঐতিহ্যকে ধ্বংস করে কেরানী বানানোর জন্য, শিক্ষানীতিসহ বিভিন্ন নীতি বাস্তবায়ন করতে থাকে।
বাংলার স্বাভাবিক অর্থনৈতিক ব্যবস্থাকে ভেঙ্গে ফেলার জন্য ইংরেজ তার স্বার্থের অর্থনীতি ও উৎপাদন ব্যবস্থা চালু করে। যে কারণে এক পর্যায়ে কৃষকরা ধান, পাট ও সব্জির পরিবর্তে নীলচাষ করতে বাধ্য হয়। কোনো কৃষক নীলচাষ করতে অবাধ্য হলে তার স্ত্রী-কন্যাকে ধরে নিয়ে ওরা নিপীড়ন, নির্যাতন ও ধর্ষণ করে মৃত্যুমুখে ছেড়ে দিত । আর যার স্ত্রী-কন্যা থাকতো না, তাকে অথবা তার ছেলেকে ধরে হাতের আঙ্গুল কেটে দিত। এ রকম শত শত পাশবিক, লোমহর্ষক, নৃশংস, জঘন্য কর্মকাণ্ড ইংরেজরা নিরীহ বাঙ্গালীর উপর চালিয়েছে।
বাঙ্গালীরা যে একশ বছরে কোনো প্রতিবাদ করেনি, বিষয়টি এমন নয়। অসংখ্যবার করেছে। তার মধ্যে প্রথম হল ‘ফকির-সন্ন্যাসী বিদ্রোহ’। এইসব বিদ্রোহে শামিল হয়েছিলেন কৃষক, কারিগর, ইংরেজ শাসনের ফলে বেকার হয়ে যাওয়া সামন্তরাজা ও জমিদারদের সৈন্য, পাইক, বরকন্দাজ এবং লাঠিয়াল বাহিনী আর তখনকার সমাজের বুদ্ধিজীবী সন্ন্যাসী-ফকিরেরা। তাঁরা কখনো স্বতন্ত্রভাবে, আবার কখনো যুক্তভাবে ইংরেজ শাসনের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ গড়ে তোলেন। এই বিদ্রোহের কেন্দ্র ছিল বিহার, গোটা উত্তরবঙ্গ, পূর্ববঙ্গের ঢাকা, ময়মনসিংহ প্রভৃতি অঞ্চল।
সম্মিলিত হিন্দু সন্ন্যাসী এবং ধার্মিক ফকিরদের একটা বৃহৎ গোষ্ঠী যাঁরা পবিত্রস্থান দর্শনের উদ্দেশ্যে উত্তর ভারত থেকে বাংলার বিভিন্নস্থান ভ্রমণ করতেন। যাওয়ার পথে এসব সন্ন্যাসী-ফকিরগণ গোত্রপ্রধান, জমিদার অথবা ভূস্বামীদের কাছ থেকে ধর্মীয় অনুদান গ্রহণ করতেন যা তখন রেওয়াজ হিসেবে প্রচলিত ছিল। কিন্তু যখন ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানী ক্ষমতা লাভ করে তখন থেকে করের পরিমাণ বহুলাংশে বৃদ্ধি পায়। ফলে স্থানীয় ভূস্বামী ও গোত্রপ্রধানগণ সন্ন্যাসী-ফকিরদেরকে ধর্মীয় অনুদান প্রদানে অসমর্থ হয়ে পড়ে। উপরন্তু ফসলহানি, দুর্ভিক্ষ দেখা দেয়। যাতে প্রায় এক কোটি মানুষ প্রাণ হারায়। এই কারণে সন্ন্যাসী-ফকিরেরা ঐক্যবদ্ধ হতে থাকে এবং যার ধারাবাহিকতায় গড়ে উঠে ‘ফকির-সন্ন্যাসী বিদ্রোহ’।
ফকির-সন্ন্যাসী বিদ্রোহের প্রধান নায়ক ও সংগঠক ছিলেন ফকির মজনু শাহ। এই বিদ্রোহের অন্যান্য নেতৃত্বের মধ্যে ছিলেন তাজশাহ, চেরাগ আলী শাহ, মুছা শাহ, পরাগল শাহ, করম শাহ প্রমুখ। তাঁদের সঙ্গে যোগ দেন সন্ন্যাসী বিদ্রোহের নায়ক ভবানী পাঠক। ১৭৬০ সালে বাংলা বিহার উড়িষ্যার পুতুল নবাব মীর জাফর আলী খানকে সরিয়ে গভর্নর জেনারেল ওয়ারেন হেস্টিংস মীর জাফর আলী খানের জামাতা মীর কাসেম আলী খানকে বাংলার নবাবের গদিতে বসান। পলাশী যুদ্ধের (১৭৫৭) তিন বছর পর বাংলায় ইংরেজদের বিরুদ্ধে মজনু শাহ- এর নেতৃত্বে ১৭৬০ সালে ফকির বিদ্রোহ শুরু হয়। উত্তরবঙ্গে, বিশেষ করে রংপুরে এ বিদ্রোহ কালক্রমে ব্যাপক রূপ ধারণ করে।
কোম্পানির শোষণ ও অপশাসনের হাত থেকে মুক্তির লক্ষ্যে সনাতন অধিকার ও সুবিধাবঞ্চিত মানুষের সমন্বয়ে জ্বলে ওঠে এই ফকির সন্ন্যাসী বিদ্রোহের আগুন। টমাস ব্রস্টনের তথ্য মতে, হিন্দু-মুসলিম নারী-পুরুষের সমন্বয়ে গড়ে ওঠে ফকির সন্ন্যাসীদের দল। এরা এদেশের স্থায়ী অধিবাসী এবং ধর্ম সম্প্রদায় হিসেবে জীবনযাপন করলেও জীবিকার্জনে নির্দিষ্ট পেশা ছিল তাঁদের। কোম্পানির শাসনের ফলে তাঁদের স্বাধীন চলাচল বাধাপ্রাপ্ত হয়। ক্ষুন্ন হয় তাঁদের ধর্মপালনের অধিকার। এই অবস্থা থেকে পরিত্রাণ পেতে তাঁরা বিদেশি শাসনের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ান। ফকিরদের নেতা ফকির মজনু শাহ গড়ে তোলেন দুর্বার ফকির বিদ্রোহ এবং ভবানী পাঠকের নেতৃত্বে সন্ন্যাসী বিদ্রোহ গড়ে ওঠে। ১৭৬০ থেকে ১৮০০ সাল পর্যন্ত দীর্ঘ চার দশকে অবিভক্ত বাংলার নানা স্থানে এই বিদ্রোহের আগুন জ্বলতে থাকে। বিশেষ করে ঢাকা, ময়মনসিংহ, রাজশাহী, দিনাজপুর, রংপুর বগুড়া, মুর্শিদাবাদ, বীরভূম, মালদহে ফকির সন্ন্যাসীদের বিদ্রোহ বেগবান হয়ে ওঠে’।
ফকির মজনু শাহ সম্বন্ধে মুয়ায্যম হুসায়ন খান লিখেছেন, “He (ফকির মজনু শাহ) organised the sufi saints and the yogi sannyasis under a common platform, reported to have moved frequently between the western part of Bihar and the eastern extremity of Bengal mobilising the scattered fakirs and sannyasis and floating the spontaneous support of the professional classes and the common people of Bengal in his fight against the east india company“. (বাংলাপিডিয়া)
ফকির মজনু শাহের জন্ম তারিখ জানা যাননি। তিনি মীরাটের অধিবাসী ছিলেন। তাঁর জন্ম দিল্লীর কাছাকাছি হলেও আমৃত্যু তাঁর কর্মক্ষেত্র ছিল বাংলায়। ফকির মজনু শাহ ছিলেন মাদরিয়া সম্প্রদায়ের সূফিসাধক বা ফকির। তাঁর বংশ ও পরিচয় প্রায় অজ্ঞাত। তাঁর আসল নামও অজ্ঞাত। কখন মজনু শাহ বুরহানা বা মজনু ফকির নামে পরিচিত হলেন সেটাও জানা যায়নি। তবে তিনি ফকির মজনু শাহ নামেই সমাধিক পরিচিত ছিলেন বলে জানা যায়। বাংলার মাদরিয়া সূফিসাধক সুলতান হাসান সুরিয়া বুরহানার মৃত্যুর পর তিনি মাদরিয়া তরিকা গ্রহণ করেন। মজনু শাহ সাধারণত দিনাজপুর জেলার বালিয়াকান্দিতে বসবাস করতেন।
বগুড়া জেলার বারো মাইল দক্ষিণে গোয়াইল নামক স্থানের নিকট সদরগঞ্জ ও মহাস্থানগড় ছিল তাঁর কাজের প্রধান কেন্দ্র। বিহারের পশ্চিম প্রান্ত থেকে বাংলার পূর্ব প্রান্ত পর্যন্ত ঘুরে ঘুরে তিনি বিচ্ছিন্ন কৃষক ও কারিগর বিদ্রোহীদের ঐক্যবদ্ধ করে একটা কেন্দ্রীয় নেতৃত্বের পরিচালনাধীনে আনবার চেষ্টা করেছিলেন। এই বিদ্রোহে তিনি কখনও সৈন্য সংগ্রহকারী, কখনও প্রধান সেনাপতি হিসেবে আবার কখনও সমগ্র বঙ্গদেশ ও বিহারের বিচ্ছিন্ন বিদ্রোহীদের সংঘবদ্ধ করতে ব্যস্ত ছিলেন।
১৭৬৩ সালে মজনু শাহ এবং ফকিরদের নেতৃত্বে ইংরেজ কোম্পানীর ব্যবসা-বাণিজ্যের বিরুদ্ধে সশস্ত্র বিদ্রোহ ব্যাপক আকার ধারণ করে। তাঁর সঙ্গে ভবানী পাঠকের নেতৃত্বে হিন্দু সন্ন্যাসীগণও যোগ দেয়ায় এ বিদ্রোহ ব্যাপকতর রূপ লাভ করে। ১৭৬৩ সালে ফকির বিদ্রোহীরা বরিশাল এবং ঢাকায় ইংরেজদের কোম্পানীর কুঠি আক্রমণ করে দখল করে নেন। ১৭৬৩, ১৭৬৪ সালে ফকির সিপাহীগণ রাজশাহীর রামপুর বোয়ালিয়ায় ইষ্ট ইন্ডিয়া কোম্পানীর বাণিজ্য কুঠি আক্রমণ করে। এ বাণিজ্য কুঠিগুলো শুধুমাত্র জিনিসপত্র ক্রয়-বিক্রয়ের বাজার ছিল না, এগুলো ছিল অস্ত্রের কেল্লাও। ওই সময় থেকে ঢাকাসহ বরিশাল, বগুড়া, ময়মনসিংহ, রংপুর, মুর্শিদাবাদ, মালদহ, দিনাজপুর, রাজশাহী, জলপাইগুড়ি, পুর্ণিয়া, কুমিল্লা, চট্টগ্রাম, বর্ধমান, বীরভূম, মেদিনীপুর ও যশোর জেলায় ফকির-সন্ন্যাসীদের আক্রমণের তীব্রতা ছিল মারাত্মক। ১৮০০ সাল পর্যন্ত তা চলে প্রায় অব্যাহতভাবে। ঢাকা জেলায় ফকির-সন্ন্যাসীদের আন্দোলন বা বিদ্রোহ শুরু হয় ১৭৬৩ সাল থেকে। ১৭৭১ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে ঢাকার স্থানীয় প্রশাসন হয়ে পড়ে প্রায় অবরুদ্ধ। ১৭৭১ সালের ২৮ মার্চ এক যুদ্ধের মাধ্যমে ফকির-সন্ন্যাসীর হাত থেকে ঢাকা মুক্ত হয়। ঢাকায় ফকির-সন্ন্যাসীদের বড় আক্রমণ পরিচালিত হয় ১৭৭৩ সালের ১০ ফেব্রুয়ারি। ঢাকা কালেক্টর জানান হনুমানগিরির নেতৃত্বে বহু সংখ্যক বিদ্রোহী সন্ন্যাসী ঢাকার পাকুল নামক স্থানে জড়ো হয় এবং তাঁরা জনৈক জমিদারের গোমস্তা রামলোচন বসুকে অপহরণ করে। এ সময় তাঁরা রামলোচন বসুর কাছ থেকে ৪,২০০ টাকা ছিনিয়ে নেয়। কিন্তু কোম্পানির সৈন্যবাহিনীর উপস্থিতি টের পেয়ে দ্রুত জঙ্গলের ভেতর দিয়ে ময়মনসিংহের দিক তাঁরা চলে যান। ঢাকায় ফকির-সন্ন্যাসীদের সর্ববৃহৎ আক্রমণ পরিচালিত হয় ১৭৭৩ সালের মার্চ মাসে। তখন দলবদ্ধ আক্রমণে ক্যাপ্টেন এডওয়ার্ডকে তাঁরা হত্যা করেন।
১৭৬৯ সালে ফকিররা রংপুর আক্রমণ করেন। সেনাপতি লেফটেনেন্ট কিং সৈন্যসহ বিদ্রোহীদের দমন করার জন্য রংপুর গমন করেন। যুদ্ধে কোম্পানীর সৈন্য পরাজিত হয় এবং সেনাপতি লেফটেনেন্ট কিং নিহত হন। ১৭৭১ সালে মজনু শাহের নেতৃত্বে আড়াই হাজার বিদ্রোহী সৈন্য (ফকির) বিরাট ইংরেজ বাহিনীর সঙ্গে যুদ্ধে পরাস্ত হলে তিনি মহাস্থানগড়ের সুরক্ষিত দুর্গে আশ্রয় নেন। পরে বিদ্রোহের প্রয়োজনে বিহার যান। ১৭৭১ সালে ১৫০ জন ফকিরকে হত্যা করা হয় দৃশ্যত বিনা কারণে। যা প্রচন্ড ক্ষোভের সৃষ্টি করে এবং এ ক্ষোভ পরবর্তীকালে ভয়াবহ রূপ নেয়।
এসময় তিনি নাটোরের রানী ভবানীকে চিঠি লিখে তাঁকে ইংরেজ শাসনের বিরুদ্ধে জনগণের এই বিদ্রোহে যোগদানের আবেদন জানান। এই আবেদনে কোনও ফল হয়নি। পত্রটি নিম্নরূপ : “আমরা বাংলাদেশে সফর করে বেড়াই এবং জনসাধারণের কাছ থেকে খয়রাত ভিক্ষা পেয়ে থাকি। আমরা বহুদিন ধরে মসজিদে, মন্দিরে বিভিন্ন ধর্মস্থানে ও বেদীতে খোদার উপাসনা করে আসছি। আমরা কখনও কাউকে নিন্দা করিনি। কাউকে নির্যাতন করিনি। ডাকাতি বা লুণ্ঠন করিনি।তবুও গত বছর একশ’ পঞ্চাশ জন ফকিরকে বিনা কারণে হত্যা করা হয়েছে। ইংরেজরা আমাদেরকে ধর্মস্থান বা অন্যান্য জায়গা সফরে বাধা দেয়। তাদের এই কাজ যুক্তিযুক্ত নয়। আপনি দেশের শাসক। আমরা ফকির। আমরা সর্বদা আপনার মঙ্গলের জন্য প্রার্থনা করে থাকি। আমরা আমাদের সংগ্রামে আপনার সাহায্যের অপেক্ষা করে রয়েছি।”
১৭৭২ সালের জানুয়ারি মাস থেকে নাটোর অঞ্চলে মজনু শাহের নেতৃত্বে বিদ্রোহীরা সক্রিয় হয়ে ওঠেন। তাঁরা এই অঞ্চলের অত্যাচারী ধনী ও জমিদারদের এবং ইংরেজ শাসকের অনুচরদের ধনসম্পদ দখল করে নিতেন এবং তা কৃষকদেরকে দিতেন। এভাবে তাঁরা কৃষকের উপর ইংরেজদের অত্যাচারের প্রতিশোধ নেন। ১৭৭২ সালের ৩০ জুন রংপুরের শ্যামগঞ্জে ১৫০০ ফকির বিদ্রোহী জমায়েত হন। ফকির সন্ন্যাসীরা একত্রে প্রতিরোধ গড়ে তোলেন। বর্শা, তরবারি, বন্দুক, ত্রিশূল, গাদা বন্দুক, পিতলের বাঁটঅলা লাঠি এসবই ছিল তাঁদের প্রধান অস্ত্র।
তাঁদেরকে দমন করার জন্য ক্যাপ্টেন টমাস একদল সৈন্য নিয়ে শ্যামগঞ্জ আসেন। ফকির বিদ্রোহীদের সঙ্গে যুদ্ধে কোম্পানীর সৈন্যরা পরাজিত হয় এবং ক্যাপ্টেন টমাস নিহত হয়। ময়মনসিংহের শেরপুরে ফকির করম শাহ এবং তাঁর পুত্র টিপু শাহের নেতৃত্বে শেরপুরের কৃষকেরা ইংরেজদের আধিপত্য অস্বীকার করে বিদ্রোহ করে। গারো ও হাজং উপজাতীয়রাও এই যুদ্ধে ফকিরদের সহযোগিতা করে।
বিদ্রোহ দমন করার জন্য ইংরেজরা নতুন নতুন আইন প্রবর্তন করে। বিদ্রোহীদের গোপন সংগঠন, গোপন যোগাযোগ ব্যবস্থা ও চলাচল সম্পর্কে সংবাদ সংগ্রহের জন্য জমিদারদের এমনকি কৃষকদেরও আইন দ্বারা বাধ্য করা হয়েছিল। ইংরেজ শাসনের প্রথম থেকেই, সন্ন্যাসী ও ফকিরদের তীর্থ ভ্রমণের ওপর নানারকম কর বসিয়ে তাঁদের ধর্মানুষ্ঠানে বাধা দেওয়া হত। ইংরজে শাসকরা এমন কতকগুলো আইন তৈরি করে যার ফলে তীর্থভ্রমণ সম্পূর্ণভাবে বন্ধ হয়ে যায়। বিদ্রোহীরা যাতে বিপদের সময় পাশের ভুটান রাজ্যে আশ্রয় না নিতে পারেন সেজন্য ১৭৭৪ সালে ভুটানের রাজার সঙ্গে ইংরেজরা একটি চুক্তি করে। এতে বলা হয় ইংরেজ শাসকরা যাদের শত্রু বলে মনে করবে তাদের ভুটানে আশ্রয় দেওয়া চলবে না। প্রয়োজনে ইংরেজ বাহিনী ভুটানে প্রবেশ করে পলাতক বিদ্রোহীদের বন্দী করতে পারবে।
১৭৭৪ সালের শেষ ভাগ থেকে কয়েকটি অঞ্চলের বিদ্রোহী দলগুলি বিভিন্ন স্থানে ছোটখাটো আক্রমণ শুরু করলেও প্রকৃত সংগ্রাম আরম্ভ হয় ১৭৭৬ সালের শেষ দিক থেকে। এই সময় মজনু শাহ উত্তরবঙ্গে ফিরে এসে ছত্রভঙ্গ বিদ্রোহীদের আবার সঙ্ঘবদ্ধ করার ও নতুন লোক সংগ্রহের চেষ্টা করেন। দিনাজপুর জেলায় মজনু শাহের উপস্থিতির খবরে ইংরেজ শাসক এতই ভীত হয়েছিল যে, অবিলম্বে জেলার সব জায়গা থেকে রাজস্বের সংগৃহীত অর্থ দিনাজপুর শহরের সুরক্ষিত ঘাঁটিতে স্থানান্তরিত করে রাজকোষের রক্ষীবাহিনীর শক্তি বাড়ানো হয়। অন্যদিকে মজনু শাহ বগুড়া থেকে তাঁর বিরুদ্ধে একটা প্রকাণ্ড ইংরেজবাহিনীর আগমনের খবর পেয়ে আপাতত যুদ্ধ এড়াবার জন্য করতোয়া নদী এবং ময়মনসিংহ জেলার সীমান্ত পার হয়ে ব্রহ্মপুত্র নদের তীরে ঘাঁটি স্থাপন করেন।
১৭৭৬ সালের ১৪ নভেম্বর একটি ইংরেজ সৈন্যদলের সঙ্গে মজনু শাহ’র বাহিনীর প্রচণ্ড যুদ্ধ হয়। ইংরেজদের গুলির হাত থেকে বাঁচতে মজনু শাহ সদলবলে জঙ্গলের মধ্যে পালাতে বাধ্য হন। শত্রুরা তাঁদের পিছু নিলে বিদ্রোহীরা হঠাৎ পিছন ফিরে ইংরেজ সৈন্যদলের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়েন। এই আক্রমণে কয়েকজন ইংরেজ সেনা নিহত হন এবং সেনাপতি লেফটেনান্ট রবার্টসন গুলির আঘাতে পঙ্গু হয়ে পড়েন। এরপর মজনু শাহ সদলে জঙ্গলে আত্মগোপন করেন।
এই সময় সন্ন্যাসী ও ফকিরদের আত্মকলহ সশস্ত্ররূপ ধারণ করে ১৭৭৭ সালে বগুড়া জেলায় একদল সন্ন্যাসীর সঙ্গে মজনু শাহের ফকির সম্প্রদায়ের প্রচণ্ড সংঘর্ষ হয়। এরপর প্রায় তিনবছর ধরে পূর্ববঙ্গের বিভিন্ন অঞ্চল ঘুরে মজনু শাহ সন্ন্যাসী ও ফকিরদের আবার সংঘবদ্ধ করার চেষ্টা করেন এবং সঙ্গে সঙ্গে বিদ্রোহের জন্য অর্থ সংগ্রহের উদ্দেশে বগুড়া, ঢাকা এবং ময়মনসিংহের বহু অঞ্চলের জমিদারদের কাছ থেকে ‘কর’ আদায় ও বহু স্থানে ইংরেজ সরকারের কোষাগার লুট করেন। অনুচরদের ওপর তাঁর কঠোর নির্দেশ ছিল, তাঁরা যেন জনসাধারণের ওপর কোন প্রকার অত্যাচার বা বলপ্রয়োগ না করেন এবং জনগণের স্বেচ্ছার দান ছাড়া কোনও কিছুই গ্রহণ না করেন। ইংরেজদের বিদ্রোহ দমনের বিপুল আয়োজন সত্ত্বেও তিনি ও তাঁর অনুচররা সমগ্র উত্তরবঙ্গ, ময়মনসিংহ ও ঢাকা জেলার বিভিন্ন জায়গায় প্রবল বিক্রমে কাজ চালিয়ে যান।
১৭৮৬ সালের ২৯ ডিসেম্বর সৈন্যসহ বগুড়া জেলা থেকে পূর্ব দিকে যাত্রা করার পথে কালেশ্বর নামক স্থানে মজনু শাহ ইংরেজ বাহিনীর সম্মুখীন হন। এই যুদ্ধে মজনু শাহ মারাত্মকভাবে আহত হন। এই আঘাতের যন্ত্রণা থেকে তিনি আর মুক্তি পাননি। ১৭৮৭ সালের জানুয়ারি মাসে বিহারের মাখনপুর গ্রামের এক গোপন ডেরাতে সন্ন্যাসী বিদ্রোহের এই নায়কের কর্মময় জীবনের অবসান ঘটে।
১৭৮৭ সালে ফকির মজনু শাহ মৃত্যুবরণ করার পর মুসা শাহ, চেরাগ আলী শাহ, সোবহান শাহ, মাদার বকস, করিম শাহ প্রমুখ ফকির নেতা প্রাণপণ চেষ্টা করেও ইংরেজদের সঙ্গে যুদ্ধে জয়ী হতে পারেননি। যে কারণে ফকির আন্দোলনের সমাপ্তি ঘটে। ফকির সন্ন্যাসীদের এই সশস্ত্র বিদ্রোহ জন্মভূমিতে বিদেশি শোষকশক্তিকে উৎখাত করতে না পারলেও কিছুটা হলেও তাদের সন্ত্রস্ত করে রেখেছিল। তাঁদের এই বিদ্রোহ মূলত উপমহাদেশে প্রথম ব্রিটিশবিরোধী প্রতিবাদ আন্দোলন হিসেবে পরিচিত।
তথ্যসূত্র:
১। প্রথম স্বাধীনতা সংগ্রামী মজনু শাহ: এ.জেড.এম. শামসুল আলম। লেখক: সাবেক সচিব। Al Islah web -এ তিনি এই প্র বন্ধটি লিখেছেন।
২। ভারতবর্ষের ইতিহাসে সন্ন্যাসী যোদ্ধা’ (মূল শিরোনাম: Warrior Ascetics in Indian History) । আমেরিকান ওরিয়েন্টাল সোসাইটি কর্তৃক প্রকাশিত সাময়িকী. ৯৮ (১): পৃ. ৬১৭-৭৫। প্রকাশক: ক্যামব্রিজ ইউনিভার্সিটি প্রেস। (ক্যামব্রিজ, যুক্তরাজ্য)।
৩। বাংলার মুক্তি সন্ধানী: সব্যসাচী চট্টপাধ্যায়, রাখী চট্টপাধ্যায়, প্রকাশকাল ২০০৫, কলকাতা।
৪। বিদ্রোহী ভারত: নীহাররঞ্জন গুপ্ত। মিত্র ও ঘোষ পাবলিশার্স প্রা: লি:- কলকাতা, প্রকাশকাল: অগ্রহায়ণ-১৩৯১।
লেখক: রফিকুল ইসলাম (শেখ রফিক)