রবি ও মণি দু’ভাই পিঠাপিঠি, দারুণ সখ্যতা দু’জনের। ছেলেবেলা থেকেই রবি ছিলেন গরীব-মেহনতি মানুষের প্রতি সহানুভূতিশীল। আশেপাশে কোনো বস্ত্রহীন গরীব মানুষ দেখলে দু’ভাই তাঁদের মায়ের কাঠের সিন্দুক খুলে জামা কাপড় চুরি করে বিলিয়ে দিয়ে আসতেন। কিন্তু ঘটনার শেষ সেখানেই হতো না। এক ফাঁকে মনি মাকে বলে দিতেন, তোমার সিন্দুকে এই এই জিনিস নেই। সিন্দুক খুলে মা কথার সত্যতা খুঁজে পেতেন। জিনিসপত্র গেল কোথায়, কে নিলো? মনি ভাইয়ের নাম বলে দিতেন। মা তলব করামাত্র হাজির হতেন রবি। চড় চাপড় পড়তো পিঠে। অম্লান বদনে তা হজম করতেন রবি। পর মুহূর্তে দু’ভাই মিলেমিশে একাকার। কিছুদিন পরেই আবার ঘটতো একই ঘটনা।
রবির পুরো নাম রবীন্দ্র চন্দ্র নিয়োগী, যিনি ‘বিপ্লবী রবি নিয়োগী’ নামেই জন-মানুষের কাছে কিংবদন্তীতুল্য। তাঁর জন্ম বাংলা ১৩১৬ সালের ১৬ বৈশাখ, ইংরেজি ১৯০৯ সালের ২৯ এপ্রিল শেরপুরের এক বিখ্যাত জমিদার পরিবারে। (যদিও ইংরেজি তারিখটি নিয়ে একটু বিতর্ক আছে)। বাড়ির নাম ‘নিয়োগী লজ’। তাঁর পিতার নাম রমেশ নিয়োগী ও মাতা সুরবালা নিয়োগী। রবি নিয়োগীরা ছিলেন ১১ ভাইবোন। পিতা রমেশ নিয়োগী পারিবারিক কর্মকান্ড পরিচালনার পাশাপাশি শেরপুরের সাংস্কৃতিক কর্মকান্ডে ব্যাপক অবদান রাখেন। শেরপুরের একটি পাঠাগার পরিচালনায় তিনি দীর্ঘদিন অবদান রাখেন।
রবি নিয়োগীর শিক্ষা জীবনের শুরু শেরপুর ভিক্টোরিয়া একাডেমিতে। পরে তিনি সেখান থেকে গোবিন্দপুর পিস মেমোরিয়াল-এ ভর্তি হন। ১৯২৬ সালে সেখান থেকেই তিনি মেট্রিকুলেশন পাশ করেন। স্কুলে পড়ার সময় মাত্র ১১ বছর বয়সেই রবি নিয়োগী খেলাফত আন্দোলনে যুক্ত হয়ে পড়েন। তাঁর ভাই মণীন্দ্র চন্দ্র নিয়োগী, যাঁর ডাক নাম মনি। তিনি ছিলেন গোপন বিপ্লবী দল ‘অনুশীলন সমিতি’র সদস্য। অথচ তিনি এই দলের সদস্য হিসেবে এতোটাই গোপনে কাজ করতেন যে, বাড়ির কেউ-ই সে সম্পর্কে কিছুই জানত না। পরে গান্ধীর সত্যাগ্রহ আন্দোলনের সময় মণীন্দ্র নিয়োগী জামালপুরে পিকেটিং কার্যক্রমে অংশ নিতে গেলে পুলিশ তাঁকে আটক করতে যায়। তিনি উল্টো পুলিশকে লক্ষ্য করে গুলি ছুঁড়েন। পুলিশ পাল্টা ধাওয়া করলে তিনি ব্রহ্মপুত্র নদী সাঁতরে শেরপুরে পালিয়ে আসেন। পুলিশ সেখানেই তাঁকে গ্রেফতার করে। তখনই বিষয়টি প্রকাশ হয়ে পরে। এই মামলায় তিনি ছয়-সাত বছর জেল খাটেন।
১৯২৬ সালে রবি নিয়োগী ময়মনসিংহের আনন্দমোহন কলেজে ইন্টারমিডিয়েটে ভর্তি হন। সেখানে গিয়েই তিনি পুরোদমে জড়িয়ে পড়েন সশস্ত্র বিপ্লবী দল ‘যুগান্তরে’র সাথে। শহরে অবস্থিত ধীরেণ সেনের শরীরচর্চা কেন্দ্রে গিয়ে শুরু করেন নিয়মিত শরীরচর্চা। ময়মনসিংহে তখন ‘যুগান্তর’ ও ‘অনুশীলন সমিতি’র শক্ত ঘাঁটি। একদিন আনন্দমোহন কলেজে এক তুচ্ছ ঘটনাকে কেন্দ্র করে পুলিশ বিনা কারণে ছাত্রদের গালাগালি করতে থাকে। রবি নিয়োগী ও তাঁর বন্ধুরা এতে ভীষণ ক্ষেপে যান। শেষে রেগেমেগে পুলিশকে জোড় করে ধরে এনে পুকুরে ফেলে দেন। এ ঘটনায় রবি নিয়োগীর বিরুদ্ধে পুলিশ মামলা দায়ের করে। কলেজ কর্তৃপক্ষও তাঁকে বহিস্কার করে। এদিকে ধীরেণ সেনের শরীরচর্চা কেন্দ্রে ‘অনুশীলন’ ও ‘যুগান্তরে’র সদস্যদের মধ্যে সংঘর্ষ বাধায় তিনি সেখানে যাওয়া বন্ধ করে দেন। তখন পুলিশের দায়ের করা মামলা থেকে বাঁচতে তিনি কলকাতায় পালিয়ে চলে যান। সেখানে গিয়ে ভর্তি হন বিদ্যাসাগর কলেজে। কিন্তু কলেজে ভর্তি হলেও পড়াশোনা আর হয়ে ওঠেনি। সেখানে সশস্ত্র সংগ্রামী সুরেন্দ্রনাথ ঘোষ, জীবন চ্যাটার্জি প্রমুখদের সংষ্পর্শে এসে একের পর এক রাজনৈতিক সংগ্রামেই নিজেকে আরো বেশি করে নিমগ্ন করে রাখেন রবি নিয়োগী।
বিপ্লবী রবি নিয়োগীর জন্ম কিন্তু একটি সামন্ততন্ত্রী পরিবারে। যে সামন্ততন্ত্রের জন্ম দিয়েছিল ব্রিটিশরা নিজেদের শাসন-শোষণ ব্যবস্থাকে এদেশে পাকাপোক্ত করতে। কিন্তু তাদের সেই ইচ্ছা চিরস্থায়ী হয়নি। আক্রমণ আসে সেই সামন্তবাদী পরিবারের ভিতর থেকেই। তারা প্রথমে স্বদেশী চেতনায় উদ্বুদ্ধ হয়ে ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করে। জাতীয় চেতনাই ছিল সেই বিদ্রোহের মূলে। কিন্তু সেই চেতনা থেকে সরে এসে এরা ক্রমান্বয়ে মিশে যায় মেহনতি তথা আপামর মানুষের মহামুক্তির মিছিলে। নানা ঘটনা-পরম্পরা ও অভিজ্ঞতায় পোড় খেতে খেতে তাঁদেরই একাংশ বিদ্রোহী থেকে পরিণত হন বিপ্লবীতে, জাতীয় চেতনাদীপ্ত স্বাদেশিকতাকে অতিক্রম করে হয়ে ওঠেন শ্রেণীচ্যুত আন্তর্জাতিকতাবাদী। রবি নিয়োগী তাঁদেরই একজন।
কলকাতাতে থাকাবস্থায়ই তিনি রাজনীতির মূলধারার সাথে সম্পৃক্ত হয়ে পড়েন। ১৯২৯ সালে সিদ্ধান্ত নেন শেরপুরে ফিরে আসবেন এবং ‘আইন অমান্য’ আন্দোলনকে সংঘটিত করবেন। শেরপুরে ‘আইন অমান্য’ আন্দোলন জোরদার হতে থাকে। ১৯৩০ সালের দিকে কংগ্রেস সত্যাগ্রহ আন্দোলনের ডাক দেয়। তখন তিনি সেই আন্দোলনে ঝাঁপিয়ে পড়েন। এই সময় তিনি ছিলেন নিখিল বঙ্গ কংগ্রেসের কার্যকরী কমিটির সদস্য। সত্যাগ্রহ আন্দোলনের পিকেটিং করতে গিয়েই তিনি প্রথমবার গ্রেফতার হন। ১৯৩৮ সালে নেতাজি সুভাষ চন্দ্র বসু যখন কংগ্রেসের প্রচার কাজ চালাতে শেরপুরে আসেন তখন সেই সভাতে সভাপতিত্ব করেন বিপ্লবী রবি নিয়োগী। ১৯৩৯ সালে দ্বিতীয় যুদ্ধের সময় তাঁকে নিজ বাড়িতে দু’বছর অন্তরীণ অবস্থায় রাখা হয়। ১৯৪২ সালে তিনি কমিউনিস্ট পার্টির সদস্য পদ লাভ করেন। একই বছর তিনি ময়মনসিংহ জেলা কমিটির সদস্য হিসেবে নির্বাচিত হন। ১৯৩৭ সালে নেত্রকোনা জেলার দলার গ্রামে যে টঙ্ক প্রথার বিরুদ্ধে আন্দোলনের ডাক দেওয়া হয় তার অংশ হিসেবে ১৯৪৩ সালে নালিতাবাড়িতে প্রাদেশিক কৃষক সম্মেলন হয়। সেখানে তিনি নেতৃত্বের ভূমিকা পালন করেন। বাংলার কমিউনিস্ট আন্দোলনের ইতিহাসে এই সম্মেলনের ব্যাপক ভূমিকা রয়েছে। এই সম্মেলন সফলভাবে সমাপ্ত করার কারণেই নেতৃবৃন্দ ১৯৪৫ সালে নেত্রকোনায় সর্বভারতীয় কৃষক সম্মেলন করার সিদ্ধান্ত নেয়। নেত্রকোনা জেলার এই কৃষক আন্দোলন তখন ভারত উপমহাদেশে ব্যাপক প্রভাব ফেলেছিল।
দেশভাগের পর এদেশের অনেক কমিউনিস্ট নেতাই দেশত্যাগ করতে বাধ্য হয়েছিলেন। একের পর এক সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা তখন বাংলার রাজনৈতিক ও সামাজিক পরিবেশকে বিষিয়ে তুলেছিল। ১৯৫০ সালের দাঙ্গার সময় রবি নিয়োগী ও তাঁর স্ত্রী জ্যোৎস্না নিয়োগী উভয়েই ময়মনসিংহ জেলে ছিলেন। তখন রবি নিয়োগীর মা-বাবা ও অন্যান্য ভাইবোনেরা দেশত্যাগ করতে বাধ্য হন। কিন্তু তিনি দেশত্যাগ করতে নারাজ। তাঁর সোজা কথা-“যেতে হয় তোমরা চলে যাও। এদেশ ছেড়ে আমি কোথাও যাব না। মরতে হয় এদেশেই মরব।” তিনি আর দেশত্যাগ করেননি। অথচ শেষবার যখন স্বৈরাচার এরশাদ সরকার আশি বছর বয়সে গ্রেফতার করে জেলখানায় পাঠায় তখন তাঁর বিরুদ্ধে অভিযোগ পত্রে বলা হয়েছিল-‘তিনি ব্রিটিশ আমল থেকে শুরু করে পাকিস্তান আমল এমনকি স্বাধীন বাংলাদেশেও ধ্বংসাত্মক কাজে লিপ্ত এবং সেজন্য ওইসব আমলেও তিনি বারবার গ্রেফতার হয়েছেন।’ স্বাধীন দেশেও রবি নিয়োগী নির্যাতনের শিকার হয়েছেন।
সমাজতন্ত্রের প্রতি রবি নিয়োগীর বিশ্বাস অবিচল ছিল চিরকাল। এজন্য কমিউনিস্ট পার্টির সঙ্গে তাঁর সম্পর্ক ছিল নিরবচ্ছিন্ন। তিনি কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন। শেরপুর জেলার নেতৃত্ব দিয়েছেন জীবনের শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত। নব্বইয়ের দশকে সোভিয়েত ইউনিয়নের বিপর্যয় ঘটলে এদেশে অনেকেই কমিউনিস্ট পার্টি ছেড়ে চলে যান। কিন্তু রবি নিয়োগী তখন আরো শক্ত হাতে পার্টির লাল পতাকা উর্ধ্বে তুলে ধরেন। এ সম্পর্কে একদিন তাঁর এক সহকর্মী তাঁকে প্রশ্ন করেন-“দাদা, সোভিয়েতে এসব কী হচ্ছে? মৌলিকত্ব ঠিক রেখে সংস্কার বড় কঠিন কাজ, সাম্রাজ্যবাদীরা সক্রিয়, মূল সমাজতন্ত্রই শেষ পর্যন্ত মারা যাবে না তো?” তখন রবি নিয়োগী সেই প্রশ্নের উত্তরে বলেছিলেন-“আরে না, না, সমাজতন্ত্রের বিকল্প নাই। সমাজতন্ত্র বাদ দিয়া করবাডা কী? ধনতন্ত্র? কাড়াকাড়ি, মারামারি? ওই ব্যবস্থায় কিচ্ছু হবো না, সমাজতন্ত্র থাকবই।…এরা পারবো না, কয়দিন বুং-বাং করবো আরকি। হ্যাঁ? কেমনে পারবো? পরবো না, সমাজতন্ত্র একটা বিজ্ঞান। এর কোনো বিকল্প নাই। মানুষ বাঁচাইতে হইলে, সভ্যতা টিকাইতে হইলে এছাড়া আর কোনো পথ নাই, এখানে আসতেই হবে।” রবি নিয়োগী শুধু রাজনৈতিক সংগঠন নয়, শিশু-কিশোর, সাংস্কৃতিক সংগঠনকেও সংগঠিত করতে ব্যাপক ভূমিকা রাখেন। মুক্ত জীবনের বাইরে রবি নিয়োগীর বাকী সবটাই ছিল জেল জীবন। কিন্তু সেই জেল জীবনও ছিল সংগ্রামমুখর।
১৯৩০ সালের দিকে শেরপুরে সত্যাগ্রহের সময় গাঁজা-মদের দোকান ভাঙ্গা আন্দোলনে যোগ দিতে গিয়ে তিনি প্রথম কারাবরণ করেন। গ্রেফতারের পর প্রথমে তাঁকে জামালপুর ও পরে ময়মনসিংহ জেলে আটক রাখা হয়। জেলেও তিনি রাজবন্দীদের মর্যাদার জন্য আন্দোলন করেন। জেলে আন্দোলনের কারণেই জেল কর্তৃপক্ষ তাঁকে দমদম জেলে পাঠিয়ে দেয়। সেখান থেকে প্রায় একবছর পর মুক্তি পান। জেল থেকে মুক্তি পেয়ে আবার সশস্ত্র আন্দোলনে যোগ দেন। অস্ত্র কেনার টাকা সংগ্রহ করার জন্য কলকাতা থেকে চলে আসেন ময়মনসিংহে। ১৯৩১ সালে শেরপুর ঢোকার মুখে পুলিশ তাঁকে গ্রেফতার করে। তখনকার ‘গুদারাঘাট শুটিং কেইস’ মামলায় রবি নিয়োগীর সাত বছর জেল হয়। এসময় তিনি ময়মনসিংহ ও রাজশাহী জেলে বেশ কিছুদিন বন্দি ছিলেন। কিন্তু রাজশাহী জেলে থাকাবস্থায় জেলের সুপারিনটেন্টকে গুলি করে হত্যা প্রচেষ্টার জন্য তাঁকে শাস্তি হিসেবে আন্দামানে পাঠিয়ে দেয়া হয়। আন্দামান তখন কালাপানির দ্বীপ। রবি নিয়োগী সেখানে যান ‘মহারাজ জাহাজ’-এ করে। রবি নিয়োগী যখন আন্দামানে যান, তখন সেটি ছিল দ্বিতীয় ব্যাচ। এর আগেও ২৫ জনের একটি বিপ্লবী দলকে সেখানে পাঠানো হয়েছিল। ১৯৩৩ সালে আন্দামান সেলুলার জেলে থাকাবস্থায় সেখানকার বন্দিরা জেল জীবনের দুঃসহ জীবনের প্রতিবাদে চিফ কমিশনারের কাছে তিনদফা দাবীনামা পেশ করেন। এই তিন দফা দাবির মধ্যে ছিল-ভালো খাদ্য প্রদান, জেলে আলোর ব্যবস্থা করা এবং বই ও পত্রিকা পড়ার সুযোগ দেয়া। কিন্তু কর্তৃপক্ষ সে দাবি না মানলে বিপ্লবীরা অনশন শুরু করেন। অনশন অবস্থায় তিনজন বিপ্লবীকে জোর করে খাওয়াতে গিয়ে হত্যা করে জেল কর্তৃপক্ষ। এই খবর বাংলায় ছড়িয়ে পড়লে প্রবল আন্দোলন গড়ে ওঠে জেলের ভিতরে ও বাইরে। বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ও মহাত্মা গান্ধীসহ অনেক দেশবরেণ্য নেতাই বিপ্লবীদের অনশন থামানোর জন্য আপ্রাণ চেষ্টা করেন। একটানা ৪৬ দিন অনশন করার পর বিপ্লবীদের দাবি মেনে নেয় কর্তৃপক্ষ।
আন্দামানকে তখন বলা হত বিপ্লবীদের মার্ক্সবাদী বিশ্ববিদ্যালয়। সেখানেই মূলত বিপ্লবীরা সশস্ত্র সংগ্রামের পথ ছেড়ে রাজনৈতিকভাবে শ্রেণী-সংগ্রামের ভিত্তিতে আন্দোলন গড়ে তোলায় সচেষ্ট হন। তারই ফলশ্রুতিতে ১৯৩৩ সালেই তাঁরা ৩২ জন বিপ্লবী জেলখানায় কমিউনিস্ট কনসলিডেশন গড়ে তোলেন। জেলখানাতে এটিই ছিল কমিউনিস্ট পার্টির প্রথম শাখা। ১৯৩৭ সালের ২৫ জুলাই আন্দামান জেলের বন্দিরা পুনরায় তিন দফা দাবিতে অনশন শুরু করেন। এবারের তিন দফা দাবি ছিল-সকল রাজবন্দিদের মুক্তি, আন্দামান বন্দিদের অবিলম্বে দেশে ফিরিয়ে আনা এবং মুক্তি না পাওয়া পর্যন্ত সব রাজনৈতিক বন্দিকে কমপক্ষে ডিভিশন ‘টু’-র বন্দি হিসেবে গণ্য করা। এতে বিভিন্ন জেলের অন্যান্য বন্দিরাও অংশ নেন। একটানা ৩৭ দিন অনশন-আন্দোলনের এক পর্যায়ে বন্দিরা দেশে ফেরার নিশ্চিত প্রতিশ্রুতি আদায় করেন।
বিপ্লবী রবি নিয়োগী আন্দামানের বন্দিদশা থেকে যেদিন মুক্তি পান তার পরদিনই আবার দিনাজপুরে গ্রেফতার হয়ে যান। এবং দিনাজপুরের ঘোড়াঘাট থানায় প্রেরিত হন। ১৯৩৮ সালে ছাড়া পেয়ে সেখানেই কমিউনিস্ট পার্টিকে সংগঠিত করার কাজে নেমে পড়েন। ১৯৩৯ সালে তিনি আবার গ্রেফতার হন। এবার ছাড়া পান ১৯৪১ সালে। ১৯৪১ সালেই আবার ‘না এক ভাই, না এক পাই’ অর্থাৎ ‘যুদ্ধে যাব না’ শ্লোগান দেয়ার অপরাধে রবি নিয়োগী নিরাপত্তা আইনে তিন মাসের জন্য আটক থাকেন। পাকিস্তান আমলে তাঁর জেল জীবনের সূচনা ঘটে স্বাধীনতার মাত্র এক বছরের মাথায়। এসময় বৃহত্তর ময়মনসিংহে কৃষকরা টংক প্রথার বিরুদ্ধে তীব্র আন্দোলন গড়ে তোলেন। এই আন্দোলনে যুক্ত থাকার কারণে তিনি ১৯৪৮ সালে পাকিস্তান সরকার কর্তৃক গ্রেফতার হন। ছাড়া পান ১৯৫৩ সালে। এসময় তাঁর স্ত্রী জোৎস্না নিয়োগীও ঢাকা ও ময়মনসিংহ জেলে বন্দি ছিলেন। ১৯৫৪ সালে যুক্তফ্রন্টের নির্বাচনী প্রচার কাজে জড়িত থাকার অভিযোগে রবি নিয়োগীকে গ্রেফতার করা হয়। পুলিশ ধর্মঘটে জড়িত থাকার অভিযোগে ১৯৫৫ সালে আবার গ্রেফতার হন তিনি। কিছুদিন পর তিনি ছাড়া পান। কিন্তু একই বছর খাদ্য আন্দোলনে নেতৃত্ব দেয়ার কারণে পুনরায় আটক হন। ছাড়া পান ১৯৫৬ সালে। ১৯৫৮ সাল থেকে পাকিস্তানের সামরিক সরকার আইয়ুব খান ১৯৬৩ সাল পর্যন্ত রবি নিয়োগীকে কারাগারে আটক রাখে। পাকিস্তান-ভারত যুদ্ধ শুরু হলে ১৯৬৫ সালে রবি নিয়োগীকে নিরাপত্তা আইনে বন্দি করা হয়। একই বছরের শেষ দিকে তিনি একবার ছাড়া পেলেও পরে আবার গ্রেফতার হয়ে যান। ছাড়া পান ১৯৬৯ সালে। ১৯৭০ সালে ইয়াহিয়া খান পাকিস্তানের ক্ষমতার মসনদ দখল করলে রবি নিয়োগী বন্দি হন। ছয় মাসের জন্য জেল খাটেন। মুক্তিযুদ্ধে তিনি সংগঠকের ভূমিকা পালন করেন। স্বাধীনতা যুদ্ধকালে ডালু, নালিতাবাড়ি, হালুয়াঘাট, মহেন্দ্রগঞ্জ সীমান্তের বিভিন্ন শরণার্থী শিবিরে ও মুক্তিযোদ্ধা মোটিভেশন ক্যাম্পে নিরলসভাবে কাজ করে গেছেন। এসময় পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী তাঁর শেরপুরের বাড়িটি আগুন দিয়ে পুড়িয়ে দেয়। দেশ স্বাধীন হলে তিনি দেশ গড়ার কাজে আত্মনিয়োগ করেন। এই সময় তিনি বেশ ভালোভাবেই মুক্তাবস্থায় থেকে কাজ করেন মানুষের জন্য। ১৯৭৫ সালের ১৫ আগষ্ট জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে সপরিবারে হত্যার পর থেকেই পাল্টে যেতে থাকে দেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতি। আবার কমিউনিস্ট পার্টি নিষিদ্ধ হয়ে যায়। এই অবস্থায় ১৯৭৫ সাল থেকে ১৯৭৭ সাল পর্যন্ত রবি নিয়োগী নিরাপত্তা আইনে কারাগারে আটক থাকেন। এরশাদের স্বৈরশাসনামলে ১৯৮৮ সালে শেষ বারের মতো বৃদ্ধ বয়সে আবার কারারুদ্ধ হন রবি নিয়োগী।
রবি নিয়োগী তাঁর বিরানব্বই বছরের জীবনে ৩৪ বছর জেলে কাটিয়েছেন। পাকিস্তান আমলে চব্বিশ বছরের মধ্যে ২০ বছর তিনি জেলেই ছিলেন। আত্মগোপনে কেটেছে আরো প্রায় দুই যুগ। একবার নিজের এই জেল জীবন নিয়ে বলতে গিয়ে বলেছিলেন, “ব্রিটিশ আমল থেকে শুরু করে আজ পর্যন্ত শুধু বঙ্গবন্ধু সরকার ছাড়া সব সরকারই আমাকে জেলে নিয়েছে। আমি কি ওদের জন্য এতই ভয়ঙ্কর? মানুষের মুক্তির কথা বলি, এরচেয়ে বেশি তো নয়।”
রবি নিয়োগী ১৯৪১ সালে বিক্রমপুরের যোগেশ মুজমদারের কন্যা জ্যোৎস্না রানী নিয়োগীকে বিয়ে করেন। তখন রবি নিয়োগীর বয়স ৩১ বছর। তিনি ছিলেন রবি নিয়োগীর যোগ্য সহধর্মিনী। জ্যোৎস্না নিয়োগী রবি নিয়োগীর ঘরে এসেছিলেন একজন সাধারণ মেয়ে হিসেবে। কিন্তু কালে কালে তারা একই বৃন্তের দু’টি ফুল হয়ে ফুটে উঠেছিলেন। জ্যোৎস্না নিয়োগী ছিলেন এদেশের নারী মুক্তি আন্দালনের অন্যতম সংগঠক। তিনি শুধু নারী মুক্তি নয়, এদেশের শ্রমিক ও মেহনতি মানুষের মুক্তির আন্দোলনেরও এক অসামান্য অগ্রসৈনিক। তাঁর জীবনের প্রায় বারো বছর কেটেছে জেল ও আত্মগোপনে। এমনকি নবজাত শিশু কাজল নিয়োগীকে কোলে নিয়ে এক পর্যায়ে জ্যোৎস্না নিয়োগী কারা নির্যাতন ভোগ করেন। সংসারের কাজ ও রাজনীতির মাঠ তিনি সামলেছেন অসাধারণ দক্ষতায়। সাহিত্যের প্রতি ছিল তাঁর প্রচন্ড ঝোঁক। এসব কারণেই আরেক বিপ্লবী চারণ সাহিত্যিক সত্যেন সেন জ্যোৎস্না নিয়োগীকে অভিহিত করেছিলেন ‘আশ্চর্য মেয়ে’ হিসেবে। রবি নিয়োগী ও জ্যোৎস্না নিয়োগীর তিন ছেলে ও এক মেয়ে। ছেলেমেয়েরা হলেন-রণজিৎ নিয়োগী, মঞ্জুশ্রী নিয়োগী দাশগুপ্তা, কাজল নিয়োগী ও সজল নিয়োগী। রণজিৎ নিয়োগী কবি ও চিত্রশিল্পী, মঞ্জুশ্রী দাশগুপ্তা স্বাধীন বাংলা বেতারের সঙ্গীতশিল্পী ও উদীচী কেন্দ্রীয় কমিটির নেত্রী, সজল নিয়োগী শিক্ষকতার পেশার সাথে জড়িত আর কাজল নিয়োগী প্রকৌশলী।
রবি নিয়োগী দীর্ঘদিন সাংবাদিকতা করেছেন এবং এই পেশার উন্নতির জন্য সংগঠন গড়ে তুলেছেন। ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধের সময় তিনি বিভিন্ন রণাঙ্গণ থেকে রিপোর্ট করতেন। এসব রিপোর্ট ভারতের কলকাতার ‘কালান্তর’ পত্রিকায় নিয়মিত ছাপা হত। তিনি ছিলেন ‘দৈনিক সংবাদের’ অবৈতনিক সংবাদাদাতা। দেশ স্বাধীন হবার পর ১৯৭৩ সালের ১৬ ডিসেম্বর তিনি শেরপুরে ‘সাংবাদিক সমিতি’ গঠন করেন। এবং তিনি এই সংগঠনের সভাপতি নির্বাচিত হন। ১৯৯৬ সালে শেরপুর জেলা প্রেসক্লাবের তিনি আজীবন সভাপতি হিসেবে মনোনীত হন।
বিপ্লবী রবি নিয়োগী তাঁর বিপ্লবী জীবনের স্বীকৃতিস্বরূপ অনেক সংবর্ধনা পেয়েছেন। তার মধ্যে রয়েছে; ১৯৮৯ সালে ডালু গণহত্যা দিবস সম্মাননা; ১৯৯১ সালের ২৫-২৮ ফেব্রুয়ারি মুম্বাই বীর সাভারকর স্মৃতি ট্রাস্ট রাষ্ট্রীয় স্মারক সম্মাননা; ১৯৯১ সালে পুণার তিলক ট্রাস্ট সম্মাননা ও মহানগর পালিকা সম্মাননা; ১৯৯৪ সালে জিতেন ঘোষ কল্যাণ ট্রাস্ট সম্মাননা; ১৯৯৫ সালে মাস্টারদা সূর্যসেন পরিষদ কর্তৃক সম্মাননা; ১৯৯৬ সালে তেভাগা সম্মাননা; ১৯৯৬ সালে শহীদ ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত সম্মাননা; ১৯৯৯ সালে বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টি-সিপিবি’র সূবর্ণ জয়ন্তী উৎসবে সম্মাননা; নকলা-নালিতাবাড়ি একাডেমি সম্মাননা; বৃহত্তর ময়মনসিংহ সাংস্কৃতিক ফোরাম সম্মাননা।
তথ্য ও ছবিসূত্র: ‘বিপ্লবী রবি নিয়োগী ও জ্যোৎস্না নিয়োগী স্মারক গ্রন্থ, সম্পাদক – ড. সুধায়ম দাস, অক্টোবর, ২০০৬ সাল ।
লেখক: চন্দন সাহা রায়