১৯১১ সালে ভারতের বড়লাট লর্ড হার্ডিঞ্জ দিল্লির দরবারে ঘোষণা করেন, ১৯১২ সালে ভারতের সমস্ত প্রভাবশালী ও বিত্তবান ব্যক্তিকে নিয়ে তিনি শোভাযাত্রা করবেন। ঘোষণা অনুযায়ী ১৯১২ সালের শীত কালে একটি শোভাযাত্রার আয়োজন করা হয়। শোভাযাত্রাটি কুইন্স গার্ডেন হয়ে চাঁদনীচক দিয়ে দেওয়ান-ই-আমের দিকে অগ্রসর হচ্ছে। রাজ্যের সকল মানুষ এই শোভাযাত্রা দেখছেন। বড়লাট লর্ড হার্ডিঞ্জ সস্ত্রীক হাতির পিঠে বসে এই শোভাযাত্রায় অংশগ্রহণ করেন। সেই সময় পূর্ব পরিকল্পনানুযায়ী বিপ্লবী রাসবিহারী বসুর পাঠানো ষোড়শী ছদ্মবেশী একটি বালিকা লীলাবতী বড়লাটকে মারার জন্য মহিলাদের জন্য নির্দিষ্ট পাঞ্জাব ন্যাশনাল ব্যাংক ভবনে বোমা নিয়ে অপেক্ষা করছেন। অসংখ্য মহিলা সূরম্য পাঞ্জাব ন্যাশনাল ব্যাংক ভবনের তৃতীয় তলায় শোভাযাত্রা দেখার জন্য অপেক্ষা করছেন। লীলাবতী চাদর গায়ে মহিলাদের মাঝে মিশে গেলেন। ইতিমধ্যে শোভাযাত্রাটি ভবনের প্রায় নিকটে চলে আসে।
ন্যাশনাল ব্যাংক ভবনের সম্মুখের আরেকটি ভবনে রাসবিহারী বসু সবকিছু সর্তকতার সাথে তীক্ষ্মভাবে পর্যবেক্ষণ করছেন এবং লীলাবতীকে বোমা মারার ইঙ্গিত প্রদানের অপেক্ষায় রয়েছেন। লীলাবতীও রাসবিহারী বসুর ইঙ্গিতের জন্য অপেক্ষা করছেন। এমন সময় এক মহিলা লীলাবতীকে জিজ্ঞেস করে “তেরি নাম ক্যা বহিনী?” লীলাবতী রাসবিহারীর দিকে দৃষ্টি রেখে বলেন, “মেরী নাম লীলাবতী’। ততক্ষণে শোভাযাত্রাটি ভবনের একেবারে নিকটে চলে আসে। রাসবিহারী মহিলাদের দৃষ্টি শোভাযাত্রা অথবা তাঁর দিকে ফেরানোর জন্য জোরে বলে উঠেন, বড় আজব, সামনে দেখ বাহিনী। মহিলারা অন্যদিকে তাকানোর সঙ্গে সঙ্গে তিনি লীলাবতীকে ইঙ্গিত দেন। লীলাবতী তৎক্ষণাৎ বড়লাটকে লক্ষ্য করে বোমা নিক্ষেপ করেন। প্রচন্ড শব্দে সবাই এদিক-সেদিক দৌড়াদৌড়ি শুরু করে। পুলিশ আততায়ীকে ধরার জন্য খোঁজ শুরু করে। রাসবিহারী বসু বসন্তকুমার বিশ্বাসকে লীলাবতীর বেশ পরিবর্তন করিয়ে তাঁকে সঙ্গে নিয়ে ডেরাডুনে চলে যান। ভাগ্যক্রমে বড়লাট বেঁচে গেলেন, মারা গেল তাঁর একজন চৌকিদার (রাজদরবারের পেয়াদা)।
এই ঘটনার পর ব্রিটিশ পুলিশ এলোপাথাড়ি গ্রেফতার অভিযান চালায়। পুলিশ যাতে রাসবিহারীকে সন্দেহ না করে সে জন্য তিনি ডেরাডুনে গিয়ে বড়লাটের উপর বোমা হামলার নিন্দা জানিয়ে এক প্রতিবাদ সমাবেশ করেন।
রাসবিহারী বসু। ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামে অগ্নিযুগের সশস্ত্র বিপ্লবীদের একজন অন্যতম বিপ্লবী। ব্রিটিশ শাসনের কবল থেকে দেশমাতৃকাকে মুক্ত করার জন্য তিনি সারা জীবন বিভিন্ন দেশ হতে অস্ত্র, অর্থ সরবরাহ ও বিপ্লবী কর্মী তৈরীর কর্মযজ্ঞে নিয়োজিত ছিলেন। তিনি ভারতবর্ষের স্বাধীনতা ও মুক্তির জন্য জীবনের শেষদিন পর্যন্ত বিপ্লবী আদর্শ ও কর্মকাণ্ডে যুক্ত ছিলেন। রাসবিহারী বসুর জন্ম ১৮৮০ সালের ২৫ মে। পশ্চিমবঙ্গের বর্ধমানের সুবলদহ গ্রামে। বাবা বিনোদবিহারী বসু। তিনি ছিলেন ভারত সরকারের প্রেসে একজন উচ্চ পদস্থ কর্মচারী। তিনি চন্দননগরে বসবাস করতেন আর চাকরি করতেন সিমলায়। এজন্য তাঁকে ছয় মাস কলকাতায় ও ছয় মাস সিমলায় থাকতে হতো। তিনি ছিলেন মানবদরদী ও সমাজহিতৈষী ব্যক্তি। স্বাধীনতা সংগ্রামী বিপ্লবীদের নানাভাবে তিনি সহযোগিতা করতেন।
পড়াশুনার হাতেখড়ি পরিবারে। তারপর পাঠশালায়। প্রাথমিক পাঠ শেষ করে চন্দননগরের ডুপ্লে কলেজের প্রবেশিকা বিদ্যালয়ে ভর্তি হন। কিন্তু শৈশবে রাসবিহারী বসুর পড়াশুনার প্রতি তেমন মনোযোগ ছিল না। তবে ইংরেজী-ফার্সী ভাষার প্রতি তাঁর অনুরাগ ছিল। ভারতবর্ষে শুধু ফার্সী ভাষা শিখলে চলবে না, তাই তাঁর বাবা তাঁকে কলিকাতা মটন স্কুলে ভর্তি করান। এই স্কুলে পড়াশুনার সময় তিনি ইংরেজী ভাষা শিক্ষা, খেলাধুলা ও ব্যায়ামের প্রতি আগ্রহী হন।
বাল্যকাল থেকে তিনি ইংরেজী ভাষায় প্রবন্ধ রচনা করতেন যা তৎকালীন পত্র-পত্রিকায় ছাপা হত। তিনি প্রবেশিকা পরীক্ষায় পাশ করতে পারেননি। কিন্তু সুন্দরভাবে ইংরেজী বলতে ও লিখতে পারতেন। স্কুলে পড়াশুনার সময় চন্দননগরের মতিলাল রায়ের সাথে রাসবিহারী বসুর সৌহার্দ গড়ে উঠে। বন্ধু মতিলাল রায়ের মাধ্যমে তিনি অরবিন্দ ঘোষের সাথে পরিচিত হন। শ্রী অরবিন্দের সংস্পর্শে তিনি যোগতত্ত্বের (দেশমাতৃকার তরে জীবন উৎসর্গ করা) সন্ধান পান। তখন থেকেই রাসবিহারী বসু দেশমাতৃকার সেবায় নিজেকে নিয়োজিত করার সিদ্বান্ত নেন। ১৯০৮ সালে বড়লাটকে মারার জন্য ক্ষুদিরাম বসু ও প্রফুল্ল চাকী বোমা নিক্ষেপ করে। এই ঘটনার পর পুলিশ মানিকতলা মুরারীপুকুর উদ্যানে তল্লাশি চালায়। এসময় পুলিশ রাসবিহারীর হাতে লেখা দু’টি চিঠি পায়। ওই বছর রাসবিহারী বসুকে ‘আলীপুর বোমা বিস্ফোরণ মামলা’য় গ্রেফতার করে বেশ কিছুদিন কারাগারে রাখা হয়। তাঁর বিরুদ্ধে অভিযোগ প্রমাণ না হওয়ায় তিনি মুক্তি পান। ওই সময় শশীভূষণ রায় চৌধুরী নামে এক দেশপ্রেমিক ডেরাডুনে শিক্ষকতা করতেন। তিনি রাসবিহারীর বিপদ দেখে নিজের চাকরিটি তাঁকে দিয়ে ডেরাডুনে পাঠিয়ে দেন। ডেরাডুনে শিক্ষকতা করার সময় রাসবিহারী বসু বাংলা, উত্তর প্রদেশ ও পাঞ্জাবের বিপ্লবীদের মধ্যে সম্পর্ক গড়ে তোলেন। তবে ছুটি পেলেই তিনি চন্দনগরে চলে আসতেন। এই চন্দননগরেই বাল্য বয়সে তাঁর সশস্ত্র বিপ্লববাদী রাজনৈতিক জীবনের হাতেখড়ি হয়েছিল।
বছর দেড়েক শিক্ষকতা করার পর তিনি ডেরাডুনে বন বিভাগের গবেষণাগারে কেরানির চাকরি নেন। ১৯১০ সালে তিনি বন গবেষণা ইনস্টিটিউটের হেডক্লার্ক হয়েছিলেন। এসময় তিনি গোপনে বিপ্লবীদের সাথে যুক্ত হয়ে কাজ করেন।
ভারতীয় স্বাধীনতা আন্দোলনের প্রধান কেন্দ্রস্থল ছিল কলকাতা এবং হুগলি জেলার চন্দননগর। চন্দননগরকে গুপ্ত সশস্ত্র কর্মকাণ্ড, আগ্নেয়াস্ত্রের লেনদেন এবং বোমা তৈরির কেন্দ্রস্থল হিসেবে গড়ে তুলেছিলেন বিপ্লবী রাসবিহারী বসু। বাইরে তাঁর বেশবাস সরকারি চাকরিজীবী ভদ্রলোকের মতো হলেও গোপনে তিনি ব্রিটিশদের নিদ্রাহরণকারী ভয়ানক বিপ্লবী ছিলেন।
১৯১২ সালে রাসবিহারী বসু দিল্লীতে ভাইসরয় লর্ড হার্ডিঞ্জকে হত্যার পরিকল্পনা গ্রহণ করেন, যার বর্ণনা শুরুতেই দেয়া হয়েছে। রাসবিহারী বসুর একান্ত অনুগত শিষ্য কিশোর বসন্তকুমার বিশ্বাস লীলাবতীর বেশ ধরে বোমা নিক্ষেপকারীর দায়িত্ব গ্রহণ করেন। কয়েক মাস পর বসন্ত কুমার বিশ্বাসসহ ১০ জন পুলিশের হাতে গ্রেপ্তার হন। ১৯১৫ সালের ১১ মে ব্রিটিশ সরকার এই মামলায় বসন্ত কুমার বিশ্বাসসহ ৩ জনকে অবৈধভাবে গোলাবারুদ বহনের অপরাধে ফাঁসিতে ঝুলিয়ে হত্যা করে।
এই ষড়যন্ত্রের ঘটনা ফাঁস হয়ে যাওয়ার কারণে মূল পরিকল্পক রাসবিহারী বসুর উপর ব্রিটিশ পুলিশ গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারিসহ তাঁর মাথার মূল্য ১২ হাজার রুপী পুরস্কার স্বরূপ ঘোষণা করে। অনেক চেষ্টা করেও পুলিশ তাঁকে ধরতে ব্যর্থ হলে পরে পুরস্কারের অর্থের সঙ্গে আরও ৫ হাজার রুপী যোগ করা হয়। কিন্তু বিপ্লবী রাসবিহারীকে কেউ ধরিয়ে দিতে পারেনি। তিনি এই ঘটনার পর বারাণসী (বেনারস) শহরে গিয়ে আশ্রয় গ্রহণ করে গুপ্ত রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড চালিয়ে যেতে থাকেন। কিন্তু তিনি বাইরে বেরুতে পারতেন না। কেননা তাঁর ছবিসহ পোস্টার ছড়িয়ে দেয়া হয়েছিল সর্বত্র।
দিল্লীতে লর্ড হার্ডিঞ্জ-হত্যা পরিকল্পনা ছিল বিপ্লবীদের প্রথম সশস্ত্র বিপ্লবের পদক্ষেপ কিন্তু সেটা ব্যর্থ হওয়ার পর দ্বিতীয় সুযোগ তাঁরা খুঁজে পেলেন লাহোরে। বিপ্লবী শচীন্দ্রনাথ সান্যালের গুপ্তদলের সঙ্গে যৌথভাবে ১৯১৩ সালে রাসবিহারী বসু পাঞ্জাবের ক্যাপ্টেন গর্ডনকে হত্যা করার পরিকল্পনা নেন। এজন্য চন্দননগর হতে কয়েকটি বোমা আনেন। ১৩ মে লাহোরের লরেন্স পার্কে গর্ডন সাহেবের আসার কথা ছিল। রাসবিহারী বসন্তগুপ্ত নামক এক বালককে এই হত্যায় নিয়েজিত করেন। ওই দিন সন্ধ্যার সময় বসন্তগুপ্ত লরেন্স পার্কে সভামঞ্চস্থলের কাছের রাস্তায় একটি বোমা রেখে আসেন। কিন্তু বোমাটি গর্ডন সাহেব চলে যাওয়ার পর বিস্ফোরিত হওয়ার কারণে তিনি বেঁচে যান। এতে মারা যান রাম নামক এক ব্যক্তি।
লাহোরে এই ঘটনার পর পুলিশের নজরদারী আরো বহুগুণে বেড়ে যায়। বারাণসীও অনিরাপদ হয়ে ওঠে। ওই বছর রাসবিহারী সন্ন্যাসীর বেশে তাঁর সহযোদ্ধাদের নিয়ে কাশী চলে যান। সেই সময় শচীন্দ্রনাথ সান্যাল কাশীতে ঢাকা ‘অনুশীলন সমিতি’র একটি শাখা স্থাপন করেছিলেন। কিন্তু দিল্লী ও লাহোর ষড়যন্ত্রের পর ব্রিটিশ সরকার ‘অনুশীলন সমিতি’কে নিষিদ্ধ করে। যার কারণে শচীন্দ্রনাথ সান্যাল ‘অনুশীলন সমিতি’র নাম পরিবর্তন করে ‘ছাত্র-যুব সঙ্ঘ’ নামকরণ করেন। রাসবিহারী কাশীতে এসে এই ‘ছাত্র-যুব সঙ্ঘ’-এর সাথে যুক্ত হন এবং এক পর্যায়ে এই সঙ্ঘের নেতৃত্বের দায়িত্ব নেন। তিনি এই সঙ্ঘের সদস্যদের অস্ত্র চালানো ও বোমা নিক্ষেপ প্রশিক্ষণ দিতেন। তিনি কাশীতে থাকাকালীন দিনে বের হতেন না। তিনি নানা নামে নানা পরিচয়ে চলাফেরা করতেন। এসময় তিনি সুরেন্দ্রনাথ দত্ত ও নরেন্দ্র সেন নামে অমৃতবাজার পত্রিকায় কয়েকটি প্রবন্ধ লিখেন।
কাশীতে বিষ্ণু গনেশ পিঙ্গলু নামে মুম্বাই প্রদেশের দুই মারাঠী দেশপ্রেমিক ও বিনায়ক রাও কাপলের সাথে রাসবিহারীর পরিচয় ঘটে। যারা আমেরিকায় ছিলেন দীর্ঘদিন। তাঁরা রাসবিহারী বসুকে জানান, গদার পার্টির চার হাজার সদস্য আমেরিকা থেকে বিদ্রোহের জন্য ভারতে এসেছেন। বিদ্রোহ শুরু হলে আরো ২০ হাজার সদস্য ভারতে আসবে। আমরাও দেশের জন্য, মানুষের জন্য কাজ করতে চাই। ইতিমধ্যে আমেরিকা থেকে সত্যেন্দ্রনাথ বসু ভারতে এসে তাঁর সাথে যোগাযোগ করেন।
১৯১৪ সালে যুদ্ধসংক্রান্ত ব্যস্ততার সুযোগ নিয়ে ভারতীয় বংশোদ্ভূত সৈন্যবাহিনীর মধ্যে সশস্ত্র বিদ্রোহের জাগরণ সৃষ্টি করতে অবিরত কাজ করেন রাসবিহারী বসুসহ অন্যান্য বিপ্লবীরা। গোপনে গোপনে সেনাবাহিনী এইসব সদস্যদের সঙ্গে যোগাযোগ স্থাপন করেন রাসবিহারী বসু। দেশ-বিদেশ থেকে বিপ্লবী গদার পার্টির হাজার হাজার সশস্ত্র সদস্যের অংশগ্রহণও নিশ্চিত হয়। সংগ্রহ করা হয় বিপুল পরিমাণ গোলাবারুদ। ১৯১৫ সালে রাসবিহারী ‘ছাত্র-যুব সঙ্ঘে’র একটি সভা করে দলের সভ্যদেরকে ‘দেশের জন্য মৃত্যুবরণ করার প্রস্তুতি নিতে বলেন’। তিনি সমগ্র ভারত নিয়ে একটি বিপ্লবের চিন্তা করেন। তিনি শচীন্দ্রণাথ সান্যালের সহযোগিতায় বেনারস, দানাপুর, সিকোল, এলাহাবাদ, জব্বলপুর, মীরাট, দিল্লী, রাওয়ালপিন্ডি, লাহোর, আম্বালা, পাঞ্জাব প্রভৃতি স্থানের সৈন্যদের ‘জাতীয় অভ্যুত্থানের’ জন্য অনুপ্রাণিত করে তাঁদেরকে প্রস্তুতি নিতে বলেন।
১৯১৫ সালের জানুয়ারি মাসের শেষ দিকে সকল প্রস্তুতি সম্পন্ন হয়। বিদ্রোহ ঘটানোর দিন ধার্য করা হয় ১৯ ফেব্রুয়ারি। প্রধান লক্ষ্যস্থল পাঞ্জাব প্রদেশের লাহোর। সেইসঙ্গে বারাণসী ও জব্বলপুর সেনা ঘাঁটিও প্রস্তুতি নিয়ে অধীর হয়ে অপেক্ষা করে। রাসবিহারী বসু লাহোর শহরের ৪টি গুপ্তস্থানে এই সশস্ত্র বিপ্লবী বাহিনীর প্রধান গুপ্ত দপ্তর স্থাপন করেন। অবাঙালি বিপ্লবী রামশরণ দাসের বাড়িতে বিদ্রোহের আদেশ প্রদানের সময়টুকুর প্রতীক্ষায় ছিলেন তাঁরা। কিন্তু বিদ্রোহের ঠিক ৪ দিন পূর্বে এই ষড়যন্ত্রের খবর ফাঁস করে দেয় রামশরণ দাস। ব্রিটিশ কর্তৃপক্ষ সৈন্য পাঠিয়ে যেখানে যেখানে সম্ভব ভারতীয় সৈন্যদেরকে অস্ত্রহীন করে এবং ১৯ ফেব্রুয়ারি ৪ প্রধান দপ্তরের একটিতে অকস্মাৎ হামলা চালায়। বিপ্লবীদের একটি দল ১৯ তারিখ সন্ধ্যেবেলায় লাহোরে নিযুক্ত ব্রিটিশ সেনানিবাসে হামলা চালিয়ে আগুন জ্বালিয়ে দেয়। এই সশস্ত্র হামলায় দুপক্ষের অনেক লোক মারা যায়। দ্রুত সমস্ত লাহোরব্যাপী এই ঘটনার সংবাদ ছড়িয়ে পড়ে। প্রশাসন সমস্ত শক্তি দিয়ে এই সশস্ত্র বিদ্রোহের ষড়যন্ত্র দমন করতে সক্ষম হয়।
এটাই ঐতিহাসিক ‘লাহোর ষড়যন্ত্র’ নামে পরিচিত। এই ষড়যন্ত্রের ব্যর্থতায় অনেক বিপ্লবী গ্রেপ্তার এবং মৃত্যুদণ্ডে দণ্ডিত হন। এই সময় তিনি কাশী থেকে চলে আসেন কলকাতায়। তারপর চন্দননগর, নবদ্বীপ প্রভৃতি স্থানে খুব সর্তকতার সাথে ঘুরে ঘুরে অবস্থা পর্যবেক্ষণ করেন। পুলিশের চোখকে ফাঁকি দিতে তিনি কখনো নারী বেশে, কখনো দারোয়ান, কাজের লোক, সন্ন্যাসি বেশে চলাফেরা করতেন। তিনি এমনভাবে চলতেন যাতে কেউ কোন ধরনের সন্দেহ না করতে পারে। এরপর সশস্ত্র বিপ্লবকে সফল করার উদ্দেশ্যে বেছে নেন জাপান দেশটিকে।
১৯১৫ সালের মার্চ মাসের শেষের দিকে সন্ন্যাসীর বেশে কলকাতাগামী ট্রেনে জাপানের উদ্দেশ্যে রওয়ানা দেন। স্টেশনে স্টেশনে তাঁর ছবিসহ পোস্টার লাগানো থাকায় রাসবিহারী বসু নানা কৌশল অবলম্বন করে ভিন্ন ভিন্ন পথ অবলম্বন করে জাপানে পৌঁছেন। ১৯১৫ সালের মাঝামাঝি সময়ে ভারতের পত্রপত্রিকায় এশিয়ার প্রথম নোবেল বিজয়ী কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর জাপান ভ্রমণে যাচ্ছেন এরকম সংবাদ প্রকাশিত হওয়ার পর সেটা দেখে রাসবিহারী বসু জাপানে থাকার সিদ্ধান্ত নেন এবং রবীন্দ্রনাথের সচিব হিসেবে (মতান্তরে আত্মীয়) পি. এন. ঠাকুর (প্রিয়নাথ ঠাকুর) নাম ধরে জাপানে বসবাস শুরু করেন।
জাপানে এসে তিনি জানতে পারেন চীনা জাতীয়তাবাদী বিপ্লবী-নেতা ড. সান-ইয়াৎ সেন জাপানে অবস্থান করছেন। তিনি তাঁর সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন। ড. সান-ইয়াৎ সেন এবং প্যান্-এশিয়ানিজমের অন্যতম প্রধান উদ্গাতা তোয়ামা মিৎসুরুর শিষ্যত্ব গ্রহণ করেন। গুরু তোয়ামা এই বিপ্লবীকে জাপানে আশ্রয় এবং সর্বপ্রকার সহযোগিতার আশ্বাস দেন। তোয়ামা এসময় গুপ্ত সমিতি ‘কোকুরিউকাই’ এর প্রধান পরিচালক কুজো য়োশিহিসা ও প্রধান কর্মকর্তা উচিদাকে রিয়োহেইকে-এর সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিয়ে তাঁদের ওপর এই বিপ্লবীর রক্ষণাবেক্ষণের ভার অর্পণ করেন। সেদিন থেকে জাপান তথা বিদেশে বিপ্লবী রাসবিহারী বসুর নতুন রাজনৈতিক জীবনের সূচনা হয়।
জাপানে রাসবিহারী বসু তোয়ামা মিৎসুরুর তত্ত্বাবধানে একটি বাণিজ্য প্রতিষ্ঠানের মালিকের বড় কন্যা সোমা তোশিকোকে বিয়ে করেন। তাঁদের পরিবারে এক ছেলে ও এক মেয়ে সন্তানের জন্ম হয়। তাঁর স্ত্রী তোশিকো বসু দীর্ঘদিন রোগে ভোগার পর ১৯২৫ সালের ৪ঠা মার্চ মাত্র ২৬ বছর বয়সে মারা যান। ওই বাণিজ্য প্রতিষ্ঠানের দেখভাল করা আর সেইসঙ্গে অক্লান্তভাবে স্বদেশের স্বাধীনতার জন্য কাজ করেন তিনি।
ভারতীয়দেরকে সংঘবদ্ধ করার উদ্দেশ্যে ১৯২১ সালে রাসবিহারী বসু জাপানে সর্বপ্রথম ‘ভারতীয় স্বাধীনতা সংঘ’ প্রতিষ্ঠা করেন এবং এই সংঘের প্রেসিডেন্টের দায়িত্ব গ্রহণ করেন।
১৯২৬ সালের ১ আগস্ট রাজনৈতিক দল ‘সেইয়ুকাই’ এর প্রধান সাংসদ ইমাজাতো জুনতারো এর উদ্যোগে নাগাসাকি শহরে প্রথম এশিয়া জাতিগোষ্ঠী সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। এই সম্মেলনে ভারতীয় প্রতিনিধি হিসেবে রাসবিহারী বসু উপস্থিত ছিলেন। এই সম্মেলন জাপানে এশিয়ার শীর্ষনেতাদের প্রথম সম্মেলন হিসেবে পরিচিত।
১৯৩২ সালে ইংরেজ-বিরোধী সশস্ত্র আন্দোলন বৃটিশদের পক্ষে অসহনীয় হয়ে উঠে। কাজেই তারা সুযোগ খুঁজছিল কিভাবে পলাতক বিপ্লবীদেরকে গ্রেপ্তার করা যায়। রাসবিহারী বসু জাপানে বিয়ে করে জাপানি নাগরিকত্ব গ্রহণ করার ফলে সে সুযোগ নস্যাৎ হয়।
১৯৪১ সালে বহু বছরের পরাধীন ব্রিটিশ উপনিবেশ ভারতবর্ষের মুক্তির সুযোগ সৃষ্টি হয়। রাসবিহারী বসু বিশ্বস্ত এম. এন. রায়কে মাঞ্চুরিয়াতে দূত হিসেবে পাঠিয়ে ভারতীয়দেরকে সংগঠিত করার দায়িত্ব দেন। ওই বছর রাসবিহারী বসুর উদ্যোগে টোকিও, য়োকোহামা, ওসাকা, কোবে, নাগাসাকি প্রভৃতি জায়গায় বসবাসরত ৭০ জনেরও বেশি ভারতীয় জড়ো হয়ে ‘ভারতীয় স্বাধীনতা সংঘ’র মহাসভা আহবান করেন এবং লীগের পতাকা উত্তোলন করেন।
১৯৪২ সালের জানুয়ারি মাসের ১৫ তারিখে রাসবিহারী বসুর উদ্যোগে টোকিওতে ‘ভারতীয় স্বাধীনতা সংঘ’র আয়োজনে একটি মহাসভা অনুষ্ঠিত হয়। সভার শিরোনাম ছিল: ‘আমেরিকা-বৃটেন ধ্বংস করো।’ সম্মেলনের পর রাসবিহারী বসু রাজকীয় সেনা বাহিনীর দপ্তরে উপস্থিত হয়ে কর্তৃপক্ষকে ভারতীয় স্বাধীনতা অর্জনের উপায় বিস্তারিতভাবে ব্যাখ্যা করার জন্য অনুরোধ জানান।
১৯৪৩ সালের ৪-৭ জুলাই সিঙ্গাপুরস্থ মহাএশিয়া মিলনায়তনে ‘ভারতীয় স্বাধীনতা সংঘ’র প্রধান নেতৃবৃন্দের মহাসভা অনুষ্ঠিত হয়। শারীরিক অসুস্থতা এবং বার্ধক্যজনিত কারণে এই মহাসভায় রাসবিহারী বসু ‘ভারতীয় স্বাধীনতা সংঘ’র নতুন প্রেসিডেন্ট হিসেবে সুভাষচন্দ্র বসুকে স্থলাভিষিক্ত করেন।
এ সম্মেলনের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী ‘আজাদ হিন্দ ফৌজ’ গঠিত হয়। বস্তুত ‘আজাদ হিন্দ ফৌজ’ গঠনে রাসবিহারি বসুর অবদান অপরিসীম। পরে তিনি নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসুর সঙ্গে মিলিত হন। ১৯৪৩ সালের অক্টোবর মাসের ২৪ তারিখে সুভাষচন্দ্রের নেতৃত্বাধীনে ‘স্বাধীন ভারত সরকার’ গঠিত হলে সেই সরকারের প্রধান উপদেষ্টা নিযুক্ত হন রাসবিহারি বসু।
১৯৪৪ সালের ২১ মার্চ ‘আজাদ হিন্দ ফৌজ’ ভারত ভূমির মনিপুরে প্রবেশ করে। এই ফৌজের কার্যাবলী খুব দ্রুত ভারতব্যাপি ছড়িয়ে পড়ে। তখন রাসবিহারি বসু খুবই আনন্দিত হন। কিন্তু যক্ষ্মা রোগে আক্রান্ত অসুস্থ রাসবিহারী বসু ১৯৪৫ সালের ২১ জানুয়ারি টোকিওর নিজগৃহে মারা যান।
১৯৪৫ সালে ১৫ আগস্ট দ্বিতীয় মহাযুদ্ধ শেষ হয়েছে কিন্তু ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলন তখনও চূড়ান্ত পর্যায়ে। নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসু হিন্দ ফৌজকে ভেঙ্গে দিয়ে অদৃশ্য হয়ে যান । কেউ জানে না কোথায় আছেন তিনি। তন্ন তন্ন করে খুঁজছে তাঁকে বৃটিশ সরকার (কিছুদিন পর জানা যায় নেতাজি বিমান দুর্ঘটনায় মারা যান)। এ সময় কর্নেল ভোঁসলে ঘোষণা করেন, নেতাজি না থাকলেও, জাপানিরা হেরে গেলেও আজাদ হিন্দ ফৌজ শেষ রক্তবিন্দু পর্যন্ত লড়াই করে যাবে। কয়েক হাজার ভারতীয় সেনা নিহত হওয়ার পরও কোহিমা পর্যন্ত অগ্রসর হয়েছিল আজাদ হিন্দ বাহিনীর কোনো কোনো দল। বৃটিশদের আর কোনো শক্তি ছিল না ভারতীয়দেরকে দাবিয়ে রাখার। শেষ পর্যন্ত ১৯৪৭ সালে বৃটিশ শাসক পাক-ভারত ভাগের মধ্য দিয়ে লেজ গুটায়। অর্জিত হয় বহুকাঙ্খিত ভারতের স্বাধীনতা, যে স্বাধীনতার জন্য রাসবিহারী বসুসহ অসংখ্য বিপ্লবী জীবন বিপন্ন করে লড়াই- সংগ্রাম করেছেন।
কিন্তু বহুকাঙ্খিত স্বাধীন ভারতকে দেখার সৌভাগ্য না হলেও রাসবিহারী বসুর আজন্মলালিত স্বপ্ন বাস্তবায়িত হয়েছে একথা ভেবেই সমগ্র ভারতবর্ষের জনগণ শান্তি লাভ করে।
তথ্য ও ছবিসূত্র :
১। বাংলার পাচ স্মরণীয় বিপ্লবী: সম্পাদনা-দেবপ্রসাদ জানা, দীপ প্রকাশন-কলকাতা। প্রকাশকাল ৫ জানুয়ারী ২০০৮ সাল।
২। স্বাধীনতা সংগ্রামে সশস্ত্র বিপ্লবীদের ভূমিকা: সুধাংশু দাশগুপ্ত, ন্যাশনাল বুকস এজেন্সি কলকাতা। প্রকাশকাল ২০০৯ সাল।
৩। বাংলার মুক্তি সন্ধানী: সব্যসাচী চট্টপাধ্যায়/ রাখী চট্টপাধ্যায়, কলকাতা। প্রকাশকাল মে ২০০৫ সাল।
৪। অগ্নিবিপ্লবী হেরাম্বলাল গুপ্ত এবং ভারতের স্বাধীনতা: প্রবীর বিকাশ সরকার, উইকলি বেঙ্গলী’তে ধারাবাহিকভাবে প্রকাশিত হয়, প্রকাশকাল ২০০৯-২০১০ সাল।
লেখক : রফিকুল ইসলাম (শেখ রফিক)