রণেশ দাশগুপ্তের জন্ম ১৯১২ সালের ১৫ জানুয়ারি ভারতের ডিব্রুগড়ের সোনারং গ্রামে, মামার বাড়িতে। তাঁর বাবার নাম অপূর্বরত্ন দাশগুপ্ত। মা ইন্দুপ্রভা দাশগুপ্ত। অপূর্বরত্ন দাশগুপ্ত ছিলেন চাকুরিজীবি। তাঁদের আদি বাড়ি ছিল বিক্রমপুরের গাউপাড়া গ্রামে। তিনি বিহারের এ.জি. অফিসে কাজ করতেন। অপূর্বরত্ন যুবক বয়সে কলকাতার প্রথম শ্রেণীর ফুটবল ক্লাব ‘স্পোর্টিং ইউনিয়নে’ খেলতেন। ছাত্রাবস্থাতেই তিনি ইন্দুপ্রভা দেবীকে বিয়ে করেন। রণেশ দাশগুপ্তের জ্যাঠামশাই নিবারণচন্দ্র দাশগুপ্ত ছিলেন পাক্কা স্বদেশী। তিনি ১৯২১ সালে অসহযোগ আন্দোলন চলাকালে সরকারী চাকুরি ত্যাগ করেন। তিনি বেশকয়েক বছর ব্রিটিশের কারাগারে নির্যাতিত হন। নিবারণ চন্দ্র দাশগুপ্ত ‘মানভূমের গান্ধী’ নামে পরিচিতি লাভ করেছিলেন।
রণেশ দাশগুপ্তের পড়াশোনার শুরু পুরুলিয়ার রামপদ পণ্ডিতের পাঠশালায়। এখানে তিনি তিন বছর পড়াশোনা করেন। তারপর প্রথম বিশ্বযুদ্ধ শেষে তাঁকে আবার ফিরে আসতে হয় রাঁচিতে। রাঁচি ছিল প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের এক অপূর্ব লীলাভূমি। রণেশ দাশগুপ্ত সেই পরিবেশেই নিজেকে মগ্ন রাখেন। সেখানকার নদীর উৎস সন্ধানই তাঁর নিয়মিত পাঠক্রম হয়ে দাঁড়ায়। বাবা অপূর্বরত্ন ছিলেন স্থানীয় ফুটবল কমিটির সম্পাদক। রণেশ দাশগুপ্ত তখন বাবার ‘খাস পিয়ন’। এসময় প্রাতিষ্ঠানিক দিক থেকে লেখাপড়ায় এক ধরনের ছেদ পরে। বয়স দশ হতে চলেছে কিন্তু আর কোনো স্কুলে নাম লেখাননি তিনি। তিন বছর যে পাঠশালায় পড়েছিলেন সেই বিদ্যা নিয়েই শুরু করেন উপন্যাস পড়া।
এরপর রাঁচির ডুরান্ডে বসবাসকারী তাঁর এক বড়ভাই রণেন মজুমদার রণেশ দাশগুপ্তকে নিয়ে যান রাঁচি জেলা স্কুলে। সেখানে ভর্তি হন ষষ্ঠ শ্রেণীতে। ইংরেজি মাধ্যমে। কিন্তু স্কুল তাঁকে গ্রাস করে ফেললেও থামেনি সাহিত্যের প্রতি অদম্য আগ্রহ। বাড়িতে নিয়মিত আসত প্রবাসী, ভারতবর্ষ, বসুমতি, বিচিত্রা, কল্লোল প্রভৃতি কাগজ। সেগুলো তিনি ‘গ্রোগ্রাসে গিলতেন’। রণেশ দাশগুপ্ত স্মৃতিচারণে বলেছেন-“রান্না ঘরেই বসতো আমাদের সাহিত্যের আড্ডা। তখন পর্যন্ত প্রকাশিত বাংলা উপন্যাসের কোনোটিই তাঁর পড়ায় বাদ ছিল না।…রবীন্দ্রনাথের উপন্যাসগুলি মা মুখে মুখে বলতে পারতেন।…মা আমার সাহিত্য সাধনার বহু কথাবার্তার উত্থাপক।” এই সময়ে প্রচুর বিশ্বসাহিত্যের বইও পড়ে ফেলেন রণেশ দাশগুপ্ত। তবে বাবার তরফ থেকে খেলার যে নেশাটা পেয়েছিলেন সেটাও চালিয়ে যান। এসময় পুরোদমে ফুটবল আর লন-টেনিস খেলছিলেন তিনি।
স্কুল জীবনের শেষ প্রান্তে এসে ‘স্বদেশী ভাবনায়’ উদ্বুদ্ধ হয়ে পড়েন রণেশ দাশগুপ্ত। রাঁচির হিনু পাড়ায় ছিল জিমনেসিয়াম ও থিয়েটার। সেখানে নিয়মিত যেতেন রণেশ দাশগুপ্ত। সেখানেই বিপ্লবীদের সাথে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক গড়ে ওঠে। এই কাজে তাঁকে প্রভাবিত করেন তাঁরই জেঠতুতো ভাই বিভূতিভূষণ দাশগুপ্ত । আর সেই সময় ‘রাজনৈতিক গুরু’ হিসেবে আবির্ভূত হন জিমনেসিয়ামের শিক্ষক হরিপদ দে। সবার উদ্যোগে তৈরি করা হয় ‘তরুণ সংঘ’। রণেশ দাশগুপ্ত তখনো জানতেন না এর আড়ালে আসলে তিনি সশস্ত্র বিপ্লবী সংগঠন ‘অনুশীলন সমিতি’র সাথে জড়িয়ে গেছেন। ১৯২৯ সালেই রাঁচি জেলা স্কুল থেকে মেট্রিক পাশ করেন। ইন্টারমিডিয়েট পড়ার জন্য ভর্তি হন বাঁকুড়া ক্রিশ্চিয়ান কলেজে, বিজ্ঞানের ছাত্র হিসেবে।
রণেশ দাশগুপ্ত থাকতেন কলেজ হোস্টেলে। সেখানে ছিল ‘অনুশীলন সমিতি’র শাখা। ফলে দুয়ে দুয়ে চার মিলতে বেশি সময় লাগল না। সক্রিয়ভাবে যুক্ত হয়ে গেলেন ‘অনুশীলন সমিতি’র সাথে। সমিতির সদস্যরা তখন কংগ্রেসে কাজ করতেন। ১৯৩০ সালের আইন অমান্য আন্দোলনের সময় রণেশ দাশগুপ্তের উপর দায়িত্ব পরে কলেজ হোস্টেলের শাখার কাজ পরিচালনা করার। সেখানে তাঁর নেতৃত্বে কলেজে দীর্ঘদিন ধর্মঘট সংঘটিত হয়। পরিণতিতে কলেজ থেকে রণেশ দাশগুপ্তসহ ১৬ জনকে বহিস্কার করে দেওয়া হয়।
এই অবস্থায় অন্য কোথাও ভর্তি হতে গেলে প্রয়োজন ট্রান্সফার সার্টিফিকেট। কিন্তু রণেশ দাশগুপ্তের হাতে ছিল এক্সপেলড সার্টিফিকেট । রণেশ দাশগুপ্ত ফিরে এলেন কলকাতায়। কোনোমতে সিটি কলেজে ভর্তির ব্যবস্থা করেন। থাকতেন কলেজের রামমোহন রায় হোস্টেলে। স্থান পরিবর্তন হলেও আগের পরিচিত বিপ্লবী নেতাদের সঙ্গে যোগাযোগ অক্ষুন্ন থাকে। ১৯৩১ সালে মাত্র ছয় মাস পড়াশোনা করে সিটি কলেজ থেকে আই.এস.সি. পাশ করেন।
রাজনীতির প্রতি ছেলের আগ্রহ পিতা অপূর্বরত্নকে ভাবিয়ে তোলে। তিনি রণেশ দাশগুপ্তকে রাজনীতি থেকে দূরে রাখার জন্য বরিশালে পাঠিয়ে দেন। সেখানে আশ্রয় মিলে কবি জীবনানন্দ দাশের পরিবার-‘সর্বানন্দ ভবনে’। এই বাড়িতেও ছিল লেখাপড়ার অপূর্ব পরিবেশ। পরিবারের অনেকেই কবিতা লেখেন। রণেশ দাশগুপ্ত নিজেও কবিতা লেখেন। স্থানীয় পত্র- পত্রিকায় তা ছাপাও হয়। তিনি ব্রজমোহন কলেজে ইংরেজিতে অনার্স নিয়ে বি.এ.-তে ভর্তি হন। কিন্তু কিছুদিনের মধ্যেই রণেশ দাশগুপ্তের ঘরটি বিপ্লবীদের যোগাযোগ কেন্দ্রে পরিণত হয়। ‘সর্বানন্দ ভবনের’ কয়েকজন ব্রিটিশ সরকারের উচ্চপদে চাকরি করতেন। তাঁদের কাছে গোয়েন্দা রিপোর্ট গেল। ফলে সেই বাড়ি ছেড়ে তাঁকে চলে যেতে হল বিএম কলেজের হোস্টেলে। নিয়মিত যাতায়াত করতেন রামকৃষ্ণ মিশন ও শঙ্কর মঠে। কলেজে অন্য অনেক বিপ্লবী বন্ধুদের সহায়তায় একটি মার্কসীয় গ্রুপ তৈরি করেন। এই গ্রুপের পত্রিকার নাম ছিল ‘জাগরণী’। এই ‘জাগরণী গোষ্ঠী’ই পরে ভারতীয় কমিউনিস্ট পার্টির বরিশাল জেলা কমিটির শাখা হিসেবে পরিণত হয়।
ত্রিশের দশকে বাংলার বিপ্লবী আন্দোলনে একটা বড় ধরনের রাজনৈতিক পরিবর্তন ঘটে। বিপ্লবীরা সশস্ত্র সংগ্রামের পথ ছেড়ে দীক্ষা নেন মার্কসবাদ-লেনিনবাদের প্রতি। অনেকেই তখন সোভিয়েত বিপ্লব ও তার সাহিত্য দ্বারা প্রভাবিত হন। রণেশ দাশগুপ্ত বরিশালে তিন বছর কাটিয়ে ফিরে আসেন ঢাকায়। তখন তাঁর পরিবারও ঢাকায় চলে এসেছে। সাতবোনের মধ্যে বড় বোনের বিয়ে হয়ে যায় এবং দুই বোন মারা যায়। বাকি চার বোন, চার ভাই ও বাবা-মাকে নিয়ে গড়ে উঠলো তাঁদের নতুন সংসার। বাবার পেনশনের টাকায় সংসার মোটামুটি চলছিল। কিন্তু পরিবারের বড় ছেলে হিসেবে রণেশ দাশগুপ্ত কোনো সাহায্য করতে পারছিলেন না। ফলে রাজনীতির অঙ্গ হিসেবে শুরু করেন সাংবাদিকতা। ১৯৩৮ সালে ২৬ বছর বয়সে ঢাকার ‘সোনার বাংলা’ সাপ্তাহিকের সহকারী সম্পাদকরূপে সাংবাদিকতা পেশায় হাতেখড়ি হয় রণেশ দাশগুপ্তের। বেতন ছিল ২৫/৩০ টাকা। পত্রিকার সম্পাদক নলিনীকিশোর গুহ ছিলেন ‘অনুশীলন সমিতি’র সদস্য। তিনি তখনো ‘বিপ্লবী সন্ত্রাসবাদী’ পথেই রয়ে গেছেন। আর রণেশ দাশগুপ্ত তখন পাক্কা কমিউনিস্ট। ফলে আদর্শের দ্বন্দ্ব ধরেই সেই পত্রিকার সঙ্গে বিচ্ছেদ ঘটে। পরে সাংসারিক প্রয়োজনেই চাকুরি নেন একটি ইন্সুরেন্স কোম্পানিতে। সেই চাকুরিতে যুক্ত ছিলেন ১৯৪৮ সাল পর্যন্ত।
ত্রিশের দশকের শেষ দিকে ঢাকা শহরে গোপন কমিউনিস্ট পার্টির বিভিন্ন শাখা গড়ে উঠতে থাকে। নেতারা মূলত কাজ করতেন শ্রমিকদের সাথে। ঢাকেশ্বরী কটন মিলে শ্রমিকদের মধ্যে লিফলেট বিতরণের মধ্যে দিয়ে রণেশ দাশগুপ্ত শ্রমিক আন্দোলনে প্রবেশ করেন। পরে তিনি দায়িত্ব পান ঢাকার দিনমজুরদের সংগঠন গড়ে তোলার। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের প্রেক্ষিতে ভারতবর্ষে আবার কমিউনিস্ট পার্টি প্রকাশ্যে কাজ করার সুযোগ পায়। তখন রণেশ দাশগুপ্ত ব্যাংক ও ইন্সুরেন্স কোম্পানির কর্মচারীদের দাবি-দাওয়া নিয়ে গড়ে তোলেন একটি ইউনিয়ন। তিনি সেই ইউনিয়নে বেশ কয়েক বছর সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করেন।
চল্লিশের দশকে রণেশ দাশগুপ্তের অনন্য কীর্তি ছিল ঢাকায় প্রগতি লেখক সংঘের শাখা প্রতিষ্ঠা করা। এ সম্পর্কে লিখতে গিয়ে তাত্ত্বিক খোকা রায় লিখেছেন, “পূর্ববঙ্গের বিভিন্ন জেলায়ও গণনাট্য সংঘ ও প্রগতিশীল লেখক ও শিল্পী সংস্থার শাখা গড়ে উঠেছিল। প্রগতিশীল লেখক ও শিল্পী সংস্থা বিশেষ জোরদার ছিল ঢাকাতে। প্রখ্যাত সাহিত্যিক রণেশ দাশগুপ্ত, সত্যেন সেন ও তরুণ কবি-সাহিত্যিক সোমেন চন্দ ছিলেন ঢাকার ঐ সাংস্কৃতিক সংস্থার নেতৃস্থানীয়।” রণেশ দাশগুপ্ত ছিলেন এই সংস্থার ‘ফ্রেন্ড, ফিলসফার অ্যান্ড গাইড’। এসময় তিনি একটি নবাগত লেখকদের জন্য ‘প্রগতি সাহিত্যের মর্মকথা’ নামে একটি পুস্তিকাও রচনা করেন। ১৯৪২ সালে ঢাকায় ‘প্রগতি লেখক সংঘে’র সম্পাদক সোমেন চন্দকে নির্মমভাবে হত্যা করা হয়। একই সময়ে জগন্নাথ কলেজের ছাত্র-কমরেড প্রদ্যুৎ সরকার ও ১৯৪৪ সালে কচি নাগ নামে আরো দু’জনকে হত্যা হয়। ফলে ঢাকায় ১৯৪৬ সালে দাঙ্গার পর ‘প্রগতি লেখক সংঘে’র কার্যক্রম কিছুটা স্তিমিত হয়ে আসে। তবে নানা বাধা বিঘ্ন সত্ত্বেও এই সংস্থার কার্যক্রম ১৯৫০-৫১ সাল পর্যন্ত চালু ছিল।
১৯৪৭ সালের আগষ্ট মাসে দ্বিজাতিতত্ত্বের ভিত্তিতে দেশভাগ সম্পন্ন হয়। রণেশ দাশগুপ্তের নিকটজনেরা পরিবারিক ও রাজনৈতিকভাবে দায়বদ্ধ হওয়া সত্ত্বেও ঘর-বাড়ি ছাড়তে বাধ্য হন। কিন্তু তিনি সপরিবারে থেকে যান ঢাকাতেই। বাঙালি মুসলমান যে আশা-আকাঙ্খা নিয়ে পাকিস্তানের সৃষ্টি করেছিল, তাদের সেই মোহ কাটতে খুব বেশি সময় লাগল না। অচিরেই তারা বুঝে ফেলে পশ্চিম পাকিস্তানী শাসকগোষ্ঠী সংখ্যাগরিষ্ঠ বাঙালি মুসলমানকে মূলত শোষণের হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করছে। তাদের সেই ধারণা আরো বেশি জোর পায় যখন পাকিস্তানের শাসকগোষ্ঠী বাঙালির উপর উর্দু ভাষা চাপিয়ে দেয়ার উদ্যোগ নেয়। সারা বাংলায় বাংলাকে অন্যতম রাষ্ট্রভাষা করার দাবিতে আন্দোলন গড়ে ওঠে। কমিউনিস্ট পার্টি তখন নিষিদ্ধ। ঢাকায় কমিউনিস্টরা তখন আত্মগোপনে কাজ করত। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভাষা আন্দোলনে অংশগ্রহণকারী ছাত্রদের মধ্যে কমিউনিস্ট পার্টির ছাত্র-কমরেডরাও ছিলেন। রণেশ দাশগুপ্ত কমিউনিস্ট পার্টির ডাকে একটি শ্রমিক ধর্মঘটে অংশগ্রহণ করতে গিয়ে ১৯৪৮ সালের ১১ মার্চ গ্রেফতার হন। ছাড়া পান কয়েকদিন মধ্যেই। কিন্তু পরে একই বছরের ৭ জুলাই আবার তাঁকে আটক করা হয়। এবং বিনা বিচারে ১৯৫৫ সালের অক্টোবর মাস পর্যন্ত কারান্তরালে কাটান। দীর্ঘ ৭ বছর ৮ মাসের কারাবাসে রণেশ দাশগুপ্ত চারটি অনশনে অংশ নেন। প্রথম অনশন ১৯৪৮ সালে ঢাকা জেলে ১১-১৫ মার্চ, দ্বিতীয় অনশন মে-জুন মাসে ৪০ দিন এবং তৃতীয় অনশন হয় সরকারের ‘আশ্বাস না রাখার’ কারণে। চতুর্থবার অনশন করেন রাজশাহী কারাগারে। এর মধ্যে তাঁকে রাজশাহী ও যশোর জেলে বদলি করা হয়। ইতিমধ্যে তাঁর পরিবারও ঢাকা ছেড়ে কলকাতায় চলে যায়। জেল থেকে বেরিয়ে একেবারে একা হয়ে পড়েন তিনি। পরিবারের কেউ নেই, নেই রাজনৈতিক সহকর্মীরা। এই অবস্থায় চাকুরি নেন ‘ইত্তেফাকে’। দুই বছর সেখানে ফ্রি-ল্যান্সার হিসেবে কাজ করেন।
১৯৫৭ সালে ঢাকা সিটি কর্পোরেশনের নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। সেই নির্বাচনে গোপন কমিউনিস্ট পার্টির প্রার্থী হিসেবে নির্বাচন করেন রণেশ দাশগুপ্ত। তিনি শাঁখারিবাজার, তাঁতীবাজার, ইসলামপুর এলাকা থেকে নির্বাচিত হন। এসময় ঢাকার ৩৫টি আসনের ৩৪টিতেই জয়লাভ করেছিল মুসলিম লীগের প্রার্থীরা। একমাত্র ব্যতিক্রম ছিলেন রণেশ দাশগুপ্ত। ১৯৬২ সালের ফেব্রুয়ারিতে তিনি আবার গ্রেফতার হন। অন্য কয়েকজন বামপন্থী কর্মীর সাথে ১৯৬৩ সালের সেপ্টেম্বর মাসে তিনি জেল থেকে ছাড়া পান । জেল থেকে বেরিয়েই যোগ দেন সংবাদ অফিসে। তিনি তখন রবিবাসরীয় পাতার দায়িত্বে ছিলেন। মূলত এখান থেকেই নিজেকে মেলে ধরতে থাকেন সাংবাদিকতা ও রাজনৈতিক সংগঠকের ভূমিকায়। সংবাদে তখন কাজ করতেন কমিউনিস্ট পার্টির নেতা শহীদুল্লাহ কায়সার। গোপন কমিউনিস্ট পার্টির আরো অনেকে মিলে তখন ‘সংবাদ-কমিউন’ গঠন করেন। এখান থেকেই রণেশ দাশগুপ্ত চালিয়ে যান পার্টির কাজ, সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ড, আর লেখালেখি তো আছেই।
ইতিমধ্যে পাকিস্তানের রাজনৈতিক পরিবেশ আবার ভয়াবহ হতে থাকে। ১৯৬৫ সালে শুরু হয় ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধ। গ্রেফতার করা হতে থাকে পূর্ব পাকিস্তানের বামপন্থী রাজনীতিবিদ ও জাতীয়তাবাদী নেতাদের। এই বছরের সেপ্টেম্বরে রণেশ দাশগুপ্ত গ্রেফতার হন। জেলের বাইরে রাজপথে বঙ্গবন্ধুর ছয় দফা আন্দোলন অভূতপূর্ব জাগরণ তৈরি করে। এবার জেল থেকে ছাড়া পান ১৯৬৮ সালের প্রথম দিকে। আবার সংবাদে কলাম লেখক হিসেবে যোগ দেন। উনসত্তরের গণঅভ্যূত্থানের সময় সাংস্কৃতিক আন্দোলন গড়ে তোলার ক্ষেত্রে তাঁর ভূমিকা ছিল অনন্য।
জাতীয়তাবাদী আন্দোলনের সোপান হিসেবেই আসে মুক্তিযুদ্ধ। ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চের কালো রাত্রিতে পাকিস্তানি হায়েনার দল ঝাঁপিয়ে পড়ে নিরীহ ঘুমন্ত বাঙালির উপর। রণেশ দাশগুপ্ত তখন পুরান ঢাকার বাসিন্দা। প্রথম কিছুদিন তিনি ঢাকাতেই আত্মগোপন করে থাকেন। পরে চলে যান নরসিংদীর রায়পুরায়। সেখান থেকে পার্টির অন্যান্য নেতৃবৃন্দের সাথে ভারতের আগরতলাতে আশ্রয় নেন। সেখান থেকে চলে যান কলকাতায়। রণেশ দাশগুপ্ত কলকাতায় সভা-সমিতিতে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে বক্তৃতা করেন। মাঝে মাঝে অংশ নিতেন স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের অনুষ্ঠানমালাতেও। দেশ স্বাধীন হবার পর ১৯৭২ সালের ফেব্রুয়ারিতে তিনি ঢাকায় ফিরে আসেন। ততদিনে রণেশ দাশগুপ্ত বাংলাদেশের অসাধারণ এক সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্বে পরিণত হয়েছেন, যেন তিনি নিজেই একটি প্রতিষ্ঠান। রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক কাজে ঘুরে বেরিয়েছেন সারা দেশ। এই সময়ে পার্টির সাথেও তাঁর দূরত্ব বৃদ্ধি পেতে থাকে। ১৯৭৫ সালে বাকশাল গঠনের সময় সংবাদ বন্ধ হয়ে গেলে তাঁর সাংবাদিক জীবনে ছেদ পরে। তিনি কমিউনিস্ট পার্টির বাকশালে যোগদানের বিরোধী ছিলেন।
১৯৭৫ সালেই ঘটে রক্তাক্ত পনের আগষ্ট। তিনি তখন ‘খেলাঘরে’র একটি অনুষ্ঠানে আমন্ত্রিত হয়ে ঢাকার বাইরে ছিলেন। বিপদ বুঝে আমন্ত্রণকারীরা তাঁকে তখন আর ঢাকায় আসতে দিলেন না। কয়েকদিন পর ঢাকায় ফিরে অক্টোবরে ‘ভাই- বোনদের দেখার জন্য’ কলকাতায় চলে যান। এর পর থেকে বাংলাদেশের রাজনীতিতে ঘটতে থাকে নাটকীয় রাজনৈতিক পরিবর্তন। আর কোনোদিন তাঁর বাংলাদেশে আসা হয়ে ওঠেনি। যখন তিনি কলকাতায় যান তখন তাঁর বয়স ছিল ৬৩ বছর। বেঁচে ছিলেন ৮৫ বছর বয়স পর্যন্ত। বাকী বাইশ বছর ছিল রণেশ দাসগুপ্তের জীবনে ‘প্রবাস জীবন’। সেখানে প্রথম আট বছর কাটান ৪/৩-এ ওরিয়েন্ট রোডে অবস্থিত ভারতীয় কমিউনিস্ট পার্টির কমিউনে। পরে ‘৮৩ সালে চলে যান বি-৪৩ সুন্দরীমোহন এভিনিউতে। এটি একসময় ‘কালান্তর’ পত্রিকার অফিস ছিল। পরে সরকার এটিকে ‘বিপদজনক’ বলে চিহ্নিত করে। রণেশ দাশগুপ্ত ‘বিপদজনক’ ঘরেই বসবাস করতেন। তাঁকে দেখাশোনা করতেন পার্টিরই এক তরুণ কমরেডের পরিবার। ধীরে ধীরে তাঁর শারীরিক অবস্থা খারাপ হতে থাকে। ১৯৯৭ সালের ১ অক্টোবর শারীরিক অসুস্থতার কারণে তাঁকে নিয়ে আসা হয় কলকাতার এক বামপন্থী সাংস্কৃতিক কর্মীর বাসায়। সেখানে কিছুটা সুস্থ হলে ৩১ অক্টোবর তাঁকে কলকাতার পিজি হাসপাতালে ভর্তি করানো হয়। সেখানে তাঁর পেসমেকার স্থাপন করা হয়। অবশেষে ১৯৯৭ সালের ৪ নভেম্বর তিনি শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন।
রণেশ দাশগুপ্ত অনেক গ্রন্থের প্রবক্তা। গ্রন্থগুলো হল- ১৯৪২-৪৩ সালে কিশোর উপযোগী নাটক ‘জানালা’; ১৯৫৬ সালে কার্ল মার্কসের জীবনী; ১৯৬৫ সালে মাও সে তুং-এর ‘শতফুল ফুটতে দাও’- এর অনুবাদ; ১৯৫৯ সালে ‘উপন্যাসের শিল্পরূপ’; ১৯৬১ সালে ‘জিজ্ঞাসা’; ১৯৬২ সালে ‘আলজেরিয়ার মুক্তিসংগ্রাম’; ১৯৬৬ সালে ‘শিল্পীর স্বাধীনতার প্রশ্নে’; ১৯৬৯ সালে ফয়েজ আহমেদ ফয়েজের কবিতার অনুবাদ; ১৯৬৯ সালে জীবনানন্দ দাশের কাব্য সম্ভার সম্পাদনা; ১৯৭০ সালে ‘ল্যাটিন আমেরিকার মুক্তি সংগ্রাম ও আলো দিয়ে আলো জ্বালা’; ১৯৭৩ সালে ‘স্বাধীনতা সাম্য বিপ্লবের কবিতা’; ১৯৮৪ সালে ‘রহমানের মা ও অন্যান্য গল্প’; ১৯৮৬ সালে ‘আয়ত দৃষ্টিতে আয়ত রূপ’; ১৯৮৭ সালে ‘কলাম-সংকলন মনে মনে প্রকাশ’; ১৯৮৮ সালে ‘সাজ্জাদ জহীর প্রমুখ’; ১৯৮৯ সালে ‘মুক্তিধারা’; ১৯৯৪ সালে ‘সাম্যবাদী উত্থান প্রত্যাশা’।
লেখাটি তৈরির সময় ‘রণেশ দাশগুপ্ত স্মারক গ্রন্থের’ সাহায্য নেয়া হয়েছে। স্মারক গ্রন্থটি সম্পাদনা করেছেন সৈয়দ মোহাম্মদ শাহেদ ও বিশ্বজিৎ ঘোষ। গ্রন্থটি আগামী প্রকাশনী কর্তৃক ২০০২ সালের নভেম্বরে (বাংলা ১৪০৯, কার্তিক) প্রথম প্রকাশিত হয়। ছবিও এই গ্রন্থ থেকে নেয়া হয়েছে।
লেখক: চন্দন সাহা রায়