রাসমণির বয়স যখন ১২ বছর তখন পাঁচ মন ধান ও নগদ দশ টাকার বিনিময়ে এক নিঃস্ব টংক যুবকের সঙ্গে তাঁর বিয়ে হয়। বিয়ের অল্পদিন পরেই রাসমণি বিধবা হন। অল্পদিনে বিধবা হওয়ার কারণে গ্রামের কুসংস্কারাছন্ন লোকেরা রাসমণিকে ‘ডাইনি’ বলে ডাকত। এসময় তাঁকে অসহনীয় কষ্টের মধ্যে দিন কাটাতে হয়। একদিকে স্বামী হারানোর বেদনা, অন্যদিকে দারিদ্র্য এই দুই কষ্ট তাঁকে ঘিরে ধরে। তবু তিনি জীবন-সংগ্রামের হাল ছাড়েননি। অসীম ধৈর্য ও সাহসের সাথে জীবনযুদ্ধে অগ্রসর হয়েছেন। সহায়-সম্বলহীনা বিধবা রাসমণি পরের জমিতে ধান লাগিয়ে এবং ধান কেটে মজুরি বাবদ যে সামান্য পরিমাণ ধান পেতেন তাই দিয়ে চলতেন। ধান সিদ্ধ করে, রোদে শুকিয়ে, ঢেঁকিতে ভেঙে চাল তৈরি করে হাটে- বাজারে বিক্রি করতেন। এছাড়া তিনি কখনও বনের কাঠ কুড়িয়ে সংগ্রহ করে বিক্রি করতেন, কখনও কখনও কাপড় ও ওড়না বুনতেন, যা গরীব হাজং মেয়েদের কাছে বিক্রী করতেন।
বছর দুয়েক পর গ্রামের মানুষদের নানাধরনের অশালীন কথাবার্তার পরিপ্রেক্ষিতে রাসমণি দ্বিতীয় বিয়ে করতে বধ্য হন। এসময় তিনি দুর্গাপুর থানার কুল্লাপাড়া ইউনিয়নের আরাপাড়া গ্রামের পাঞ্জি হাজংকে বিয়ে করেন। তিনি ছিলেন নিঃসন্তান। নিজের ধর্মীয় বিশ্বাস, প্রথা ও সংস্কৃতির ওপর ভিত্তি করে তাঁদের বিয়ে হয়। বিয়ের পর তাঁরা দুজনে আরাপাড়ায় বসবাস করতেন। স্বামী পাঞ্জি হাজং একজন কবিরাজ ছিলেন। সেই সুবাদে তিনিও স্বামীর কাছ থেকে কবিরাজী বিদ্যা অর্জন করেন। তাছাড়া নিজেও কিছু তন্ত্রমন্ত্র ও ধাত্রী (দাইমা) জ্ঞানে পারদর্শী ছিলেন। তাই রাসমণি প্রতিবেশীদের ছোটখাটো কোন রোগ সারিয়ে ও সন্তান প্রসব করানোর মতো সেবা করে একসময় জনপ্রিয় হয়ে উঠেন।
রাসমণি হাজংসহ সব হাজং আদিবাসীদের পূর্বপুরুষেরা ছিলেন আসামের অধিবাসী। সুসং রাজ্যের গোড়াপত্তনের পর গাড়ো পাহাড়ের পাদদেশে সুসং জমিদারেরা হাজংদের আমদানী করে এনে বসবাসের জায়গা করে দেন। হাজংদের আমদানীর পেছনে দুটি কারণ ছিল- এক. এরা অত্যন্ত সৎ, সাহসী, দুর্ধর্ষ এবং বিশ্বস্ত। দুই. পাহাড়ী গারো ও ব্রিটিশের হামলা প্রতিরোধে এদের ব্যবহার করা সহজ ছিল।
রাসমণি হাজং ছিলেন মূলতঃ হিন্দু। হাজং নারীদের মধ্যে তিনি বেশ জনপ্রিয় ও নির্ভীক ছিলেন। তাঁর দেখাদেখি অশ্বমণি, কলাবতী, রমমণি প্রমুখ হাজং নারী সংঘবদ্ধ হন। হাজং নারীদের সাহস যোগাতেন রাসমণি।
১৯৩৭ সালের শেষের দিকে এই প্রতিবাদী নারী কমরেড মণি সিংহের আহ্বানে টংক আন্দোলনের সাথে নিজেকে সম্পৃক্ত করেন। তখন থেকে মূলত রাসমণির রাজনৈতিক সংগ্রামী জীবনের শুরু হয়। তিনি নিজে টংক আন্দোলনের ভলান্টিয়ার বাহিনীর সদস্য হন এবং তাঁর পরিচিত সাহসী ও প্রতিবাদী হাজং নারীদেরকেও ভলান্টিয়ার বাহিনীতে নিয়ে আসেন।
রাসমণি হাজং জন্মেছিলেন ১৮৯৭ সালের মে মাসে। ময়মনসিংহ জেলার সুমঙ্গ পরগনার ভেদিপুরা অঞ্চলের বগাবারী গ্রামের এক গরিব হাজং পরিবারে। গরীব পরিবারে জন্মেছিলেন বলে বর্ণমালা শিক্ষা ছাড়া তাঁর প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা গ্রহণের সুযোগ হয়নি। তবে ছোটবেলা থেকেই তিনি খুব কৌতূহলী; প্রতিবাদী ও স্বাধীনচেতা ছিলেন।
টংক আন্দোলন ব্রিটিশ-ভারতের সর্বশেষ গণআন্দোলন। বৃহত্তর ময়মনসিংহ এলাকার গারো পাহাড়ের পাদদেশে সুসং-দুর্গাপুর এলাকায় সংগঠিত হয়েছিল টংক আন্দোলন। দীর্ঘ ১২ বছর ধরে এই টংক আন্দোলনে পুলিশের গুলিতে অনেক নারী-পুরুষ- শিশুকে প্রাণ দিতে হয়েছে। কৃষকদের শতশত বাড়ি-ঘর ধুলিসাৎ ও গ্রাম পুড়িয়ে ছারখার করা হয়েছে। পাকিস্তান আমলেও বেশ কিছুদিন এই আন্দোলন অব্যাহত ছিল। টংক আন্দোলনের নেতৃত্বে ছিলেন সুসং-দূর্গাপুরের জমিদার সন্তান মণি সিংহ। এ আন্দোলন সংগঠিত করেন আদিবাসী হাজং জনগোষ্ঠী। টংক আন্দোলনের কারণে ব্রিটিশ আমলে মণি সিংহকে কয়েক বার জেলে যেতে হয়। পাকিস্তান আমলে মুসলিম লীগ সরকার মণি সিংহের বাড়ি ভেঙ্গে ভিটায় হালচাষ করায় এবং তাঁর স্থাবর সম্পত্তি নিলাম করে দেয়। টংক আন্দোলনে যে সমস্ত লড়াকু শহীদ হন, তাঁদের মধ্যে রাসিমণি হাজং অন্যতম। তিনিই টংক আন্দোলনের প্রথম শহীদ। তিনি টংক ও কৃষক আন্দোলনের অন্যতম নেত্রীও ছিলেন। টংক আন্দোলনে মণি সিংহের পর যাঁর নাম চলে আসে তিনি হলেন রাসমণি। তারপর কুমুদিনী হাজং।
টংক মানে ধান কড়ারী খাজনা। ধান হোক বা না হোক জমিদারকে কড়ায় গণ্ডায় ধান দিতে হবে। মাঠে ফসল ফলা বা না ফলার ওপর টংক ব্যবস্থা নির্ভরশীল ছিল না। টংক জমির ওপর কৃষকদের কোন স্বত্ব ছিল না। ময়মনসিংহ জেলার উত্তরে কলমাকান্দ, সুসং-দূর্গাপুর, হালুয়াঘাট, নালিতাবাড়ি, শ্রীবর্দি প্রভৃতি থানাগুলোতে এই প্রথা প্রচলিত ছিল। বিশেষ করে সুসং- জমিদারি এলাকায় এর প্রচলন ছিল ব্যাপক। কেন টংক নাম হল তা জানা যায় না, তবে এটা স্থানীয় নাম। এই প্রথা বিভিন্ন নামে ওই সময়ের পূর্ববঙ্গে প্রচলিত ছিল, যেমন চুক্তিবর্গা, ফুরন প্রভৃতি। ওই সময়ে পশ্চিবঙ্গেও এই প্রথা প্রচলিত ছিল। সুসং জমিদার এলাকার যে টংক ব্যবস্থা ছিল তা ছিল খুবই কঠোর। সোয়া একর জমির জন্য বছরে ধান দিতে হত সাত থেকে পনের মন। অথচ ওই সময়ে জোত জমির খাজনা ছিল সোয়া একরে পাঁচ থেকে সাত টাকা মাত্র। ওই সময়ে ধানের দর ছিল প্রতিমন সোয়া দুই টাকা। ফলে প্রতি সোয়া একরে বাড়তি খাজনা দিতে হত এগার টাকা থেকে প্রায় সতের টাকা। এই প্রথা শুধু জমিদারদের ছিল তা নয়; মধ্যবিত্ত ও মহাজনরাও টংক প্রথায় লাভবান হতেন। একমাত্র সুসং-জমিদাররাই টংক প্রথার মাধ্যমে দুই লক্ষ মন ধান আদায় করতেন। এটা ছিল এক জঘন্যতম সামন্ততান্ত্রিক শোষণ।
সুসং-জমিদাররা গারো পাহাড়ের অধিকার হতে বঞ্চিত হয়ে মনে হয় এই প্রথা প্রবর্তন করেন। জোত স্বত্বের জমির বন্দোবস্ত নিতে হলে প্রতি সোয়া একরে একশ টাকা থেকে দুইশ টাকা নজরানা দিতে হত। গরীব কৃষক ওই নজরানার টাকা সংগ্রহ করতে সমর্থ ছিলেন না। টংক প্রথায় কোন নজরানা লাগত না। কাজেই গরীব কৃষকের পক্ষে টংক নেওয়াই ছিল সুবিধাজনক। টংকের হার প্রথমে এত বেশি ছিল না। কৃষকরা যখন টংক জমি নেওয়ার জন্য এগিয়ে আসলেন, তখন প্রতি বছর ওই সব জমির হার নিলামে ডাক হত। ফলে হার ক্রমে বেড়ে যেত। যে কৃষক বেশী ধান দিতে কবুল করত তাঁদেরই অর্থাৎ পূর্বত বেশি ডাককারী কৃষকের নিকট থেকে জমি ছাড়িয়ে হস্তান্তর করা হত। এইভাবে নিলাম ডাক বেড়ে গিয়ে ১৯৩৭ সাল থেকে হার সোয়া একরে পনের মন পর্যন্ত উঠে যায়।
১৯৩৮ সালে টংক প্রথার বিরুদ্ধে হাজং সম্প্রদায় ধীরে ধীরে জেগে উঠতে থাকে। হাজং সম্প্রদায়কে ঐক্যবদ্ধকরণে কুমুদিনী হাজং ও রাসমণি হাজং অবিস্মরণীয় ভূমিকা পালন করেন। ১৯৩৯ সালে মণি সিংহের নেতৃত্বে ময়মনসিংহ এলাকায় কৃষকরা টংক প্রথার বিরুদ্ধে সংগঠিত হতে শুরু করেন। হাজংদের মধ্যে রাজনৈতিক সচেতনতা বাড়ে। গারো পাহাড়ি অঞ্চলে জমিদার, মহাজনদের সৃষ্ট টংক প্রথার শর্তানুসারে জমিতে ফসল হোক বা না হোক চুক্তি অনুসারে টংকের ধান জমিদার- মহাজনদের দিতেই হতো। সহজ কথায় হাজং সম্প্রদায়ের কাছে অধিক শ্রম কেড়ে নেওয়ার জন্য জমিদাররা টংক প্রথা নামে ফাঁদ পেতেছিল। এতে হাজংরা ক্রমেই জমি বাড়ি হারিয়ে নিঃস্ব হতে থাকে। ফলে বাধ্য হয়ে তাঁরা এই প্রথা বিলুপ্তির জন্য আরো বেশি সংগঠিত হওয়ার লক্ষ্য নিয়ে কাজ করে যায়। মণি সিংহেরে নেতৃত্বে ১৯৪০ সালে আন্দোলনের তীব্রতা ক্রমশঃ বৃদ্ধি পায়। ফলে ওই বছর সরকার সার্ভে করে টংকের পরিমাণ কমিয়ে দেয়। একই বছর নভেম্বর মাসে মণি সিংহ কৃষকদের নিয়ে আন্দোলনের মাধ্যমে তিনি তাঁদের জমিদারী টংক প্রথা বিলুপ্ত ঘোষণা করেন। ১৯৪১ সালে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ ও এই যুদ্ধকালে কমিউনিস্ট পার্টি আন্তর্জাতিক ফ্যাসিবাদ বিরোধী ‘জনযুদ্ধের’ নীতি গ্রহণ করায় টংক আন্দোলন কিছু দিনের জন্য বন্ধ থাকে। এক পর্যায়ে ব্রিটিশ সরকার টংক প্রথার সংস্কার করলেও প্রথাটি একবারে উচ্ছেদ হলো না। আন্দোলনে নেতৃত্বদানকারী সংগঠন কৃষক সভা টংক প্রথা পুরোপুরি উচ্ছেদ করার জন্য আন্দোলন অব্যাহত রাখলো।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর ফ্যাসীবাদবিরোধী গণসংগ্রামের সময় রাসমণি ‘মহিলা আত্মরক্ষা সমিতি’তে যোগ দেন। এই সমিতির হয়ে রাসমণি তেরোশো পঞ্চাশের মন্বন্তরে লঙ্গরখানা খুলে তিনটি গ্রামের গরীব মানুষের মুখে অন্ন জোগানোর ভার নেন। তাঁর নেতৃত্বে খাদ্য সংগ্রহকারী দল সারা পরগনা ঘুরে ধান, চাল, অর্থ ও বস্ত্র সংগ্রহ করতেন। হাজং চাষীদের দল চোরা ব্যবসায়ী মজুতদারদের গোপন খাদ্যের গুদাম খুঁজে বের করে সেই খাদ্য লঙ্গরখানার জন্য নিয়ে আসতেন।
https://gunijan.org.bd/wp-admin/media-upload.php?post_id=6507&type=image&TB_iframe=1
হাজং অঞ্চলে দুর্ভিক্ষ প্রতিরোধ করার জন্য যে ‘বেশি খাদ্য ফলাও’, ‘কাটা, বাঁধ বাঁধা’ আন্দোলন শুরু হয় তার পুরোভাগে ছিলেন রাসমণি। ‘মহিলা আত্মরক্ষা সমিতি’র নির্দেশে রাসমণি নিজের গ্রামে ধর্মগোলা (যেখানে ফসল ওঠার সময় সকলে উদ্বৃত্ত ধান জমা দিত এবং প্রয়োজনের সময় সেখান থেকে ধান নিত) এবং মেয়েদের জন্য নানা কুটির শিল্পের কেন্দ্র স্থাপন করেন। রাসমণি বুঝতে পারেন, জমিদার, তালুকদার এবং মহাজনদের হাতে হাজং চাষীদের শোষিত হওয়ার প্রধান কারণ তাদের অশিক্ষা-কুশিক্ষা। সেই সমস্যা দূর করার জন্য তিনি একটি নৈশ বয়স্ক বিদ্যালয় খোলার উদ্যোগ নেন। হাজং পল্লীতে এই বিদ্যালয় খোলা হলে তিনিই হন তার প্রথম ছাত্রী। এই নৈশ বিদ্যালয়ে পড়াশোনার পাশাপাশি চলতো রাজনৈতিক আলোচনা। কিছুদিনের মধ্যেই লাঞ্ছিত ও অনগ্রসর হাজং ঘরের মেয়ে রাসমণি গণচেতনায় উদ্বুদ্ধ এক বিপ্লবী দল গড়ে তোলেন। এভাবে তিনি ময়মনসিংহের সীমান্ত এবং পার্বত্য অঞ্চলের নারী আন্দোলনের নেত্রী হয়ে উঠেন।
১৯৪৫ সালের ৪-৫ এপ্রিল নেত্রকোণায় দু’দিনব্যাপী এক ঐতিহাসিক কৃষক সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। এতে লক্ষ লোকের সমাবেশ ঘটে। এ সম্মেলনের বেশ কিছু দিন আগে হাজং নারীদের মধ্যে প্রচার কাজ চালাতে কলকাতা থেকে আসেন কমিউনিস্ট নেত্রী যুঁইফুল রায় ও নির্মলা স্যানাল। এ সম্মেলনে রাসমণিসহ বিপুল সংখ্যক আদিবাসী নারী অংশগ্রহণ করেন। ভারতবর্ষের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে প্রতিনিধি হয়ে আসেন পি.সি. যোশী, ভবানী সেন, বঙ্কিম মুখার্জী, কৃষ্ণবিনোদ রায়, সোমনাথ লাহিড়ি, গুরুমুখ সিং, হরকিষণ সিং, সুরজিৎ ভাগ সিংহ, চন্দ্রভান সিংহ, গাড়োয়ান গোদাবরী পারুলেকর, নান্ধুদ্রিপাদ, সুন্দরায়া, কেরোলিয়ান, ড. জেড. এ আহমদ, যদুনন্দন শর্মা, নীলমণি, বড় ঠাকুর, ইরাবত সিংহ, মণিপসুর, বিষ্ণুরাতা ও কল্পনা যোশী (দত্ত)।
সম্মেলনের দ্বিতীয় দিনে পল্লীগানের ওপর ভিত্তি করে একটি সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান হয় । এ সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে অংশ নেন বিনয় রায়, নির্মলেন্দু চৌধুরী, অখিল চক্রবর্তী, হেমাঙ্গ বিশ্বাস ও হেনা দাসসহ অন্যান্যরা। এ সম্মেলন থেকে আওয়াজ ওঠে-
১। টংক প্রথার উচ্ছেদ চাই
২। টংক জমির স্বত্ব চাই
৩। জোত স্বত্ব নিরিখমত টংক জমির খাজনা ধার্য করা চাই
৪। বকেয়া টংক মওকুফ চাই
৫। জমিদারী প্রথা উচ্ছেদ চাই
৬। সাম্রাজ্যবাদ ধ্বংস হোক
এ আন্দোলনের ফলে ১৯৪০ সালের টংক প্রথায় কিছুটা সংশোধনী আসে। এ সংশোধনীতে ছিল ৮টি কিস্তিতে টংক পরিশোধ এবং টংক পরিশোধ করতে পারলে জমিতে কৃষকের স্বত্ব স্থাপিত হবে।
ইংরেজদের শোষণ-উৎপীড়নের বিরুদ্ধে হাজং কৃষকরা বিদ্রোহে ফেটে পড়েন। জমিতে কৃষকের স্বত্বের দাবিতে হাজং কৃষকদের এই আন্দোলন ছড়িয়ে পড়ে উত্তর ময়মনসিংহের পাঁচটি থানার সুদীর্ঘ নব্বই মাইলের মধ্যে প্রায় তিনশত গ্রাম জুড়ে। কৃষকদের ঐক্যবদ্ধ সভা, মিছিল, বক্তৃতা, হাট-প্রচার ও গ্রাম-বৈঠকের মাধ্যমে আন্দোলন সংগঠিত করার কাজ চলতে থাকে। এই সমস্ত সভায় এবং মিছিলের পুরোভাগে নারী বাহিনীর নেতৃত্ব দিতেন রাসমণি। প্রচারবাহিনী নিয়ে তিনি গ্রাম থেকে গ্রামান্তরে ঘুরে ঘুরে হাজং নারীদের মৃত্যুপণ সংগ্রামের জন্য উদ্বুদ্ধ করেন। ভীত-সন্ত্রস্ত জমিদার-তালুকদার মহাজনরা ইংরেজ শাসকের কাছে তাদের রাজত্ব রক্ষার জন্য আবেদন জানায়।
১৯৪৬ সালের পহেলা জানুয়ারী থেকে দ্বিতীয় দফায় টংক আন্দোলন শুরু হয়। আন্দোলনকে জোরদার করার জন্য সুসং- দুর্গাপুর স্কুলের মাঠে এক বিশাল জনসভা হয়। এ সভায় বল্লভী বকসীর নেতৃত্বে হাজার পাঁচেক কৃষকদের এক জঙ্গী মিছিল সকল প্রতিবন্ধকতা দূর করে সভাস্থলে এসে পৌঁছায়। এ মিছিলে রাসমণি হাজংসহ প্রায় একশত হাজং নারী সংঘবদ্ধভাবে অংশগ্রহণ করেন।
এ সভার উদ্দেশ্য ছিল-
১। পুনরায় টংক উচ্ছেদের পক্ষে আন্দোলন শুরু।
২। ময়মনসিংহ শহরে ভিয়েতনাম দিবসে পুলিশের গুলিতে নিহত ছাত্রনেতা অমলেন্দু রায়ের হত্যার প্রতিবাদ করা।
এই সম্মেলনের খবর পৌঁছে যায় ময়মনসিংহের পুলিশ দপ্তরে। পুনরায় মাথা চাড়া দিয়ে ওঠা টংক আন্দোলনের গতিকে থামিয়ে রাখার লক্ষ্যে সরকারি সশস্ত্র পুলিশবাহিনী তৎপর হয়ে ওঠে। ওই দিনই ময়মনসিংহের পুলিশ দপ্তর দুর্গাপুর থানার বিরিশিরিতে একজন ম্যাজিস্ট্রেটের নেতৃত্বে ইস্টার্ন ফ্রন্টিয়ার রাইফেল বাহিনীর সশস্ত্র ক্যাম্প স্থাপন করে। বিরিশিরির সেই ক্যাম্প থেকে প্রতিদিন বিভিন্ন গ্রামে হানা দিয়ে টংক প্রথার বিরুদ্ধে আন্দোলনকারী হাজংদের দমন করার চেষ্টা চালানো হতো। বিভিন্ন গ্রামের হাজং পরিবারগুলো প্রতিদিনই সশস্ত্র বাহিনীর নির্মম অত্যাচারের শিকার হতো।
১৯৪৬ সালের ৩১ জানুয়ারি সকাল ১০ টার দিকে বিরিশিরি থেকে ৪ মাইল উত্তর-পশ্চিমে বহেরাতলী গ্রামে হাজং ও গারো আদিবাসী এলাকায় পাঁচজন সশস্ত্র পুলিশ অকস্মাৎ তল্লাসী চালায়। তারা হাজং মা-বোনদের ওপর পাশবিক অত্যাচার শুরু করে। নারীরা বিপদ সংকেত হিসেবে শিঙ্গা বাজিয়ে সংকেতের মাধ্যমে গ্রামবাসীকে জানিয়ে দেয়। সেই অত্যাচারিতা নারীদের আর্তনাদ শুনে রাসমণি তাঁর বাহিনী নিয়ে এগিয়ে আসেন। রাসমণির নেতৃত্বে হাজং নারীরা সবাই দা হাতে নিয়ে ঘর ছেড়ে বেরিয়ে এসে পুলিশদের তাড়া করেন। নারীদের এ জঙ্গী রূপ দেখে পুলিশরা পিছু হটে পালিয়ে বাঁচে। পরে এ পাঁচজন পুলিশ ক্যাম্পে ফিরে যায়। পরবর্তীতে একজন ম্যাজিস্ট্রেটের নেতৃত্বে পঁচিশজনের একটি পুলিশ দল (ইস্টার্ন ফ্রন্টিয়ার রাইফেল বাহিনী) আবার বাহেরাতলী গ্রামে আসে। এ দলটি লংকেশ্বর হাজং-এর বাড়িতে হানা দেয়। টংক আন্দোলনের মাঠ পর্যায়ের নেতা লংকেশ্বর হাজং ও তাঁর ভাইদের গ্রেফতার করাই ছিল পুলিশ বাহিনীর উদ্দেশ্য। পুলিশ বাহিনীর বহেরাতলীর দিকে আসার সংবাদ পেয়েই লংকেশ্বর হাজং ও তাঁর তিন ভাই আত্মগোপন করেন মনি সিংহের গোপন আস্তানায়। লংকেশ্বর হাজং ও তাঁর ভাইদের ধরতে না পেরে পুলিশ ক্ষিপ্ত হয়ে ওঠে। এক পর্যায়ে লংকেশ্বর হাজং এর সদ্য বিবাহিতা স্ত্রী কুমুদিনী হাজংকে দেখে পুলিশ লংকেশ্বর হাজং কোথায় আছে জানতে চায়। টংক আন্দোলনের নেত্রী কুমুদিনী হাজং সঠিক উত্তর না দিয়ে ‘জানিনা’ বলে জবাব দেন। এতে পুলিশ আরো ক্ষিপ্ত হয়ে কুমুদিনী হাজংকে ধরে নিয়ে রওয়ানা দেন। কুমুদিনী হাজং এর বাড়ির লোকজন পাশের বাড়িসহ গ্রামের অন্যান্য বাড়িতে দৌড়ে গিয়ে কুমুদিনী হাজংকে ধরে নিয়ে যাওয়ার সংবাদ দেন।
রাসমণি এই খবর পেয়ে সাথে সাথে দিস্তামনি হাজং, বাসন্তি হাজংসহ ১২ জনের একটি মহিলা সশস্ত্র (দা-কাস্তে-কুড়াল নিয়ে) দলকে সঙ্গে নিয়ে কুমুদিনী হাজংকে ছাড়িয়ে নেয়ার জন্য গেলে সশস্ত্র পুলিশ নৃশংসভাবে তাঁদের ওপর গুলি চালায়। এতে রাসমনি হাজং গুলিবিদ্ধ হয়ে মাটিতে লুটিয়ে পড়েন। এ নৃশংস হত্যাকান্ড দেখে পেছনের পুরুষ দলের নেতা সুরেন্দ্র হাজং রাসমণিকে ধরতে গেলে তাঁকেও নির্দয়ভাবে গুলি করে হত্যা করে পুলিশ বাহিনী। এ ঘটনায় অন্যান্য হাজং নারী-পুরুষ ক্ষিপ্ত হয়ে ওঠেন এবং সশস্ত্র পুলিশের উপর বল্লম ও রামদা দিয়ে হামলা চালান। পুলিশ বাহিনীর দু’জন ঘটনাস্থলেই মারা যায়। বাকি পুলিশ দৌড়ে পালায়।
কবি রফিক আজাদ তাঁর ‘মাতা রাসমণি’ কবিতায় লিখেছেন-
রাসমণি একটি নাম, জীবন-সমান দীর্ঘ নাম;
দেশবাসী, জানাও তোমরা তাঁকে সহস্র প্রণাম।
রাসমণি এই বিশাল বাংলায় একবারই জন্মানঃ
অন্যায়ের প্রতিবাদ করতে গিয়ে গর্বিত শহীদ।
নারী হয়ে নারীর সম্ভ্রম রক্ষার্থে জীবন দিয়ে রাসমণি আজ হাজংদের কাছে হাজংমাতা হিসেবে পরিচিত। তাঁর স্মৃতি রক্ষার্থে ২০০৪ সালের ৩১ জানুয়ারি বহেরাতলী গ্রামে তাঁর মৃত্যু সংলগ্ন স্থানে নির্মিত হয়েছে ‘শহীদ হাজংমাতা রাসমণি স্মৃতিসৌধ’ যা হাজং বিদ্রোহের অন্যতম সাক্ষী হিসেবে পরিচয় বহন করছে।
তথ্য ও ছবিসূত্র:
১। গণমানুষের মুক্তির আন্দোলন: মাহফুজা খানম/তপন কুমার দে, প্রকাশকাল ২০০৯।
২। বাংলার মুক্তি সন্ধানী: সব্যসাচী চট্টপাধ্যায় ও রাখী চট্টপাধ্যায়। প্রকাশকাল ২০০৫, কলকাতা।
৩। মুক্তি মঞ্চে নারী: ড. নিবেদিতা দাশপুরকায়স্ত, রচনাকাল ১৯৯৪-৯৭ সাল।
৪। রাসমণি হাজং এবং টঙ্ক আন্দোলন: সোহেল হাজং। সোমবার, ৩১ জানুয়ারী ২০১১, ১৮ মাঘ ১৪১৭ জনকন্ঠ।
ছবিটি টংক স্মৃতি স্তম্ভের।
লেখক : রফিকুল ইসলাম (শেখ রফিক)