১৯৩১ সালের ২০ ডিসেম্বর দীপালি সংঘের কাজ সেরে বাড়ি ফেরার পর লীলা নাগকে গ্রেপ্তার করা হয়। ১৯৩১ সালের ২০ ডিসেম্বর থেকে ১৯৩৭ সালের ৭ অক্টোবর পর্যন্ত লীলা নাগ ঢাকা, রাজশাহী, সিউড়ী, মেদেনীপুর জেল ও হিজলী মহিলা বন্দীশালায় আটক ছিলেন। ১৯৩২ সালের এপ্রিল মাসে তিনি জেলে অনশন করেন। অনশনের কারণে তাঁকে শাস্তি দিয়ে হিজলী বন্দীশালায় পাঠানো হয়। ১৯৩৬ সালের ২৮ এপ্রিল হিজলী বন্দীশালায় দ্বিতীয়বার অনশন শুরু করলে তাঁকে মেদিনীপুর সেন্ট্রাল জেলে স্থানান্তর করা হয়। এখানে তাঁকে নির্জন সেলে রাখা হয়। ১৯৩৬ সালের ৪ মে তিনি অনশন ভঙ্গ করেন। ১৯৩৭ সালের ৮ অক্টোবর তিনি মুক্তি লাভ করেন। মুক্তির পর ১৯৩৮ সালে সিলেটের বিশাল নারী সম্মেলনে লীলা নাগ সম্বর্ধিত হন এবং কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর গৌরীপুর লজ থেকে একটি চিঠি লেখেন তাঁকে।
লীলা নাগ, ব্রিটিশবিরোধী এই বিপ্লবী ভারতবর্ষের স্বাধীনতা ও মুক্তির জন্য বিপ্লবী আদর্শ ও কর্মকাণ্ডে যুক্ত ছিলেন। লীলা নাগ ভারতবর্ষে বিনা বিচারে আটক প্রথম নারী রাজবন্দী। সাধারণ মানুষের অধিকার আদায়ের জন্য জীবনের শেষদিন পর্যন্ত তিনি লড়াই-সংগ্রাম চালিয়ে গেছেন। লীলা নাগ নারী জাগরণেরও পথিকৃৎ।
লীলা নাগ জন্মেছিলেন ১৯০০ সালের ২ অক্টোবর। আসামের গোয়ালপাড়ায়। তাঁর বাবা গিরিশচন্দ্র নাগ। তিনি ছিলেন তৎকালীন আসাম সরকারের জেলা ম্যাজিস্ট্রেট। মা কুঞ্জলতা। তিনি ছিলেন একজন সাধারণ গৃহিণী। লীলা নাগের বাবার বাড়ি মৌলভীবাজার রাজনগর উপজেলা সদর থেকে ৫ কিলোমিটার উত্তরে, পাঁচগাওতে।
লীলা নাগের বর্ণমালা ও প্রাথমিক পড়াশুনার হাতেখড়ি পরিবারে। বিশেষ করে বাবার কাছে। তাঁর আনুষ্ঠানিক শিক্ষা জীবনের শুরু হয় দেওগরে। তারপর কলকাতার ব্রাহ্ম গার্লস স্কুলে। এরপর ১৯১১-১৭ সাল পর্যন্ত তিনি ঢাকার ইডেন হাইস্কুলে পড়াশুনা করেন। এই স্কুল থেকে বৃত্তি নিয়ে প্রবেশিকা পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়। ১৯১৬ সালে তাঁর বাবা অবসর গ্রহণ করার পর তিনি স্থায়ীভাবে বসবাসের জন্য আসাম থেকে ঢাকায় আসেন।
লীলা নাগ ১৯১৭ সালে কলকাতার বেথুন কলেজে আই.এ.-তে ভর্তি হন। পড়াশোনায় তাঁর গভীর মনোযোগ ছিল। তিনি খেলাধুলায়ও উৎসাহী ছিলেন। তিনি নিয়মিত টেনিস, ব্যাডমিন্টন, হাডুডু খেলতেন। কলেজের সকল অনুষ্ঠানে তিনি অংশগ্রহণ করতেন। বহুমূখী প্রতিভার কারণে সবাই তাঁকে পছন্দ করতো। শিক্ষকদের কাছে তিনি ছিলেন প্রিয় ছাত্রী। কলেজ জীবনে জনপ্রিয়তার কারণেই তিনি কলেজের ‘সিনিয়র স্টুডেন্ট’ নির্বাচিত হন।
লোকমান্য তিলকের মৃত্যুদিবস উদযাপনকে কেন্দ্র করে কলেজ অধ্যক্ষার সাথে তাঁর সংঘাত বাধে। ফলে তিনি ছাত্র-ধর্মঘটের আহ্বান জানান। বড়লাট পত্নীকে নতজানু হয়ে অভিবাদন জানানোর প্রথা উচ্ছেদের সংগ্রামেও তিনি নেতৃত্ব দেন।
১৯২১ সালে কলকাতার বেথুন কলেজ থেকে মেয়েদের মধ্যে প্রথম স্থান অধিকার করে বি.এ. পাস করে তিনি ‘পদ্মাবতী স্বর্ণপদক’ লাভ করেন। ১৯২১ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠিত হয়। নতুন বিশ্ববিদ্যালয়ে সহ-শিক্ষার ব্যবস্থা ছিল না। কিন্তু লীলা নাগের অনমনীয় দৃঢ়তা, স্বচ্ছ একাগ্রতা দেখে উপাচার্য ড. হার্টগ তাঁকে মাষ্টার্স ক্লাশে ভর্তির সুযোগ করে দেন। তখন তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ইংরেজি বিষয়ে এম.এ. ভর্তি হন। এরপর থেকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে সহশিক্ষা চালু হয়। ওই বছর তিনি নিখিলবঙ্গ নারী ভোটাধিকার কমিটির সহ-সম্পাদক নির্বাচিত হন। নারীদের ভোটাধিকারের দাবি ও অন্যান্য সমানাধিকারের দাবিতেও লীলা নাগ সোচ্চার ছিলেন। ১৯২৩ সালে তিনি এম.এ. ডিগ্রী অর্জন করেন। তিনিই ছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম এম.এ. ডিগ্রীধারী নারী।
এম.এ. পাশ করার পর লীলা নাগ বাংলার নারী সমাজের অন্ধকারাচ্ছন্ন অভিশপ্ত জীবনে জ্ঞানের আলো বিস্তারের জন্য ১২ সংগ্রামী সাথীকে নিয়ে ‘দীপালি সংঘ’ নামে একটি সংগঠন গড়ে তোলেন। লীলা নাগ ও তাঁর সাথীদের মধ্যে অনেকেই ‘দীপালি সংঘ’ গঠনের পূর্বেই গোপন বিপ্লবী দলের সদস্য ছিলেন। ছাত্রী থাকাকালীন লীলা নাগ কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ, আচার্য প্রফুল্ল চন্দ্র ও ঋষি রামানন্দের সান্নিধ্যে আসেন।
‘দীপালি সংঘ’ স্থাপনের পর তিনি এই সংঘের কার্যক্রম বিস্তৃত করার দিকে মনোযোগ দেন। পাড়ায় পাড়ায় এর শাখা স্থাপনের কাজ শুরু করেন। এই কার্যক্রমের ধারাবাহিকতায় ও লীলা নাগের আপ্রাণ চেষ্টায় গড়ে ওঠে নারী শিক্ষা মন্দিরসহ ১২টি অবৈতনিক প্রাথমিক স্কুল এবং শিল্প শিক্ষা ও বয়স্ক শিক্ষা কেন্দ্র।
১৯২৪ সাল থেকে শুরু হয় দীপালি প্রদর্শনী। এ প্রদর্শনী বাংলার নারীমুক্তি সংগ্রামের এক নব দিগন্তের দ্বার উন্মোচন করে। ১৯২৬ সালে লীলা নাগ গঠন করেন ‘দীপালি ছাত্রী সংঘ’। এর মধ্য দিয়ে ছাত্রীরা জাগরিত হয়। ওই বছর তিনি গঠন করেন ‘মহিলা আত্মরক্ষা সমিতি’। এখানে বিপ্লবী পুলিন দাসের তত্ত্বাবধানে মেয়েরা অস্ত্র চালনা প্রশিক্ষণ ও লাঠি খেলা শেখেন।
১৯২৫ সালে তিনি ঢাকার শ্রীসংঘের সাথে যুক্ত হন। শ্রীসংঘের সাথে যুক্ত ছিল তখনকার ঢাকার একটি বিপ্লবী দল। সশস্ত্র বিপ্লববাদী ‘যুগান্তর’ ও ‘অনুশীলন দল’কে নিষিদ্ধ করার পর উভয় দলের নেতা-কর্মীরা বিভিন্ন সংগঠনের মাধ্যমে দেশের স্বাধীনতার জন্য কাজ করতেন। যে কারণে এই সশস্ত্র বিপ্লববাদীরা তখন ‘শ্রীসংঘ’ নামে একটি সংগঠন দাঁড় করিয়ে তাঁদের কার্যক্রম পরিচালনা করেন। আর ‘দীপালী সংঘ’ ছিল ‘শ্রীসংঘে’র মহিলা শাখা সংগঠন।
১৯২৬ সালের ৮ ফেব্রুয়ারি ঢাকায় ‘দীপালি সংঘে’র সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। এ সম্মেলনে কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর উপস্থিত ছিলেন। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর তাঁর বক্তৃতায় বলেন, “এশিয়ায় এতো বড় মহিলা সমাবেশ আর কখনও দেখি নাই”। রবীন্দ্রনাথ লীলা নাগকে শান্তিনিকেতনে কাজের ভার নিতে বলেন। কিন্তু লীলা নাগ কবিগুরুর অনুরোধ রক্ষা করতে পারেননি। তাঁর পথ আলাদা। তিনি মেয়েদের প্রতি অন্যায় অবিচার, অসম্মানের বিরুদ্ধে এবং মাতৃভূমির স্বাধীনতার জন্য জীবনপণ লড়ে যাওয়ার সংকল্প নেন। এ সময় ‘দীপালি সংঘে’র কার্যক্রম আসাম পর্যন্ত বিস্তার লাভ করে।
১৯২৮ সালে কলকাতা কংগ্রেস ও বাংলার বিপ্লবী দলগুলো সুভাষচন্দ্রের সংস্পর্শে সংগঠিত হতে থাকে। সহকর্মীদের সাথে অনিল রায় ও লীলা নাগ সেখানে উপস্থিত হন। লীলা নাগ তখনও বিপ্লবী দলের নেপথ্যে কাজ করেন। নিখিল ভারত মহিলা সম্মেলনে বাংলার নারী আন্দোলনের ইতিহাস উপস্থাপন করেন লীলা নাগ। কয়েক বছরের মধ্যে ‘দীপালি সংঘে’র বৈপ্লবিক রূপান্তর ঘটে। দলে দলে মেয়েরা এর পতাকাতলে সমবেত হতে থাকেন। বিপ্লবী নেত্রী লীলা নাগের কাছে দলের ছেলেরাও আসেন নানা আলোচনার বিষয় নিয়ে। নেত্রী হিসেবে তাঁর সঙ্গে গণ আন্দোলনের সম্পর্ক ছিল। ‘দীপালি সংঘ’ ছাড়াও লীলা নাগ যুক্ত ছিলেন অনিল রায়ের ‘শ্রীসংঘে’র সাথে। ‘শ্রীসংঘে’ যোগদানের পর বিপ্লবী আন্দোলনেও তিনি অল্প সময়ের মধ্যে পৌছে যান প্রথম সারিতে। এ দুই প্রকৃতির আন্দোলনের সাথে যুক্ত থেকে তিনি এগিয়ে চলেন মাতৃভূমির স্বাধীনতার জন্য। শহীদ যতীন দাসের লাহোর জেলে ৬৩ দিন অনশনে আত্মহুতির সশ্রদ্ধ স্মরণে, কলকাতার মনুমেন্টের পাদদেশে সুভাষচন্দ্রের ওপর লাঠিচার্জের প্রতিবাদে, লীলা নাগের নেতৃত্বে ঢাকায় জন সমুদ্রের শোভাযাত্রা অনুষ্ঠিত হয়। যা ছিল সেদিনকার ভারতবর্ষের অতুলনীয় ইতিহাস।
১৯২৭-২৮ সালে নির্যাতিত, অবহেলিত ও নিগৃহীত নারীদের আশ্রয় ও সাহায্যার্থে লীলা নাগ ‘নারী আত্মরক্ষা ফান্ড’ খোলেন। এখানে মহিলাদের আত্মরক্ষামূলক শিক্ষাদানের ব্যবস্থা ছিল। ১৯৩০ সালের প্রথম দিকে লীলা নাগের সম্পাদনায় ‘জয়শ্রী’ নামক একটি পত্রিকা বের হয়। এটিতে নারীমুক্তি ও স্বাধীনতা আন্দোলন প্রধান্য পেত।
১৯৩০ সালে লীলা নাগের নেতৃত্বে গঠিত ‘মহিলা সত্যাগ্রহ কমিটি’র উদ্যোগে ঢাকার নারীরা লবণ সত্যাগ্রহ আন্দোলনে যোগ দেন। এ আন্দোলনে তাঁর ঘনিষ্ঠ সহযোগী ছিলেন আশালতা সেন। পুলিশের চোখে ধুলো দিয়ে প্রকাশ্য গণসংগ্রামের আড়ালে লীলা নাগ বৈপ্লবিক সংগ্রামের দায়িত্বে নিয়োজিত ছিলেন।
১৯৩০ সালের ১৮ এপ্রিল মাষ্টারদা সূর্যসেনের নেতৃত্বে চট্টগ্রাম অস্ত্রাগার দখলের মতো দুর্ধর্ষ বৈপ্লবিক অভিযানের পর বাংলার সকল বিপ্লবী দলের নেতৃস্থানীয়দের ইংরেজ সরকার গ্রেপ্তার করে। এ সময় ‘শ্রীসংঘে’র নেতা অনিল রায় ও তাঁর এক সহকর্মী গ্রেপ্তার হন। কেউ কেউ আবার আত্মগোপনে চল যান। তখন ‘শ্রীসংঘে’র সর্বময় নেতৃত্বের দায়িত্ব নেন লীলা নাগ।
নারী শিক্ষা মন্দিরের ঊষা রায়, লীলা নাগের সহযোগী ছিলেন। তাঁর ওপরও ‘শ্রীসংঘে’র কাজের দায়িত্ব চলে আসে। লীলা নাগ ও ঊষা রায়ের কাজের সহায়ক ছিলেন দুই আত্মগোপনকারী সহকর্মী অনিল দাস ও অনিল ঘোষ।
লীলা নাগ দলের নেতৃত্বভার গ্রহণ করার পর দলে দলে ‘দীপালি সংঘে’র মেয়েরা শ্রীসংঘে আসতে শুরু করেন। ঢাকার ইডেন স্কুল ও কলেজ এবং কলকাতার ১১ গোয়াবাগানে প্রতিষ্ঠিত ‘ছাত্রীসংঘ’ এবং ‘ছাত্রীভবন’ই ছিল ‘শ্রীসংঘে’র মেয়ে সদস্য পাওয়ার উৎসভূমি। এ মেয়েরাই পরে ‘শ্রীসংঘে’র সংগঠকের ভূমিকা পালন করেন।
‘শ্রীসংঘে’র এসকল সদস্যরা সশস্ত্র বিপ্লব পরিচালনা করার জন্য অস্ত্রসংগ্রহ ও বোমা তৈরি করেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রসায়ন বিভাগের অনার্সের ছাত্র অনিল দাস (পরে শহীদ হন) ও শৈলেশ রায় (পরে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রাণী রসায়ন বিভাগের প্রধান) বোমার ফর্মূলা নিয়ে কাজ করেন। ক্ষীতিশ রায় করেছেন সহায়তা। বোমার খোল তৈরি করেন বীরেন পোদ্দার। বোমার খোলের ভাল নমুনা সংগ্রহ করেছিলেন অনিল রায়। বোমার ফলাফল নিয়ে আলোচনা করতেন লীলা নাগ। বোমার ফর্মূলা প্রয়োগের সাথে যুক্ত ছিলেন সুবেশ কর, বঙ্গেশ্বর রায়, বিনয় বসু, অমল রায়, রেনু সেন ও নৃপেন চক্রবর্তী। এদের নিয়ে অস্ত্র সংগ্রহের লক্ষ্যে লীলা নাগ নিজেও বার বার কলকাতা আসা যাওয়া করতেন।
‘ছাত্রীভবনে’র মাসিমা কুমুদিনী সিংহের যুগীপাড়া বাইলেনের বাড়িটি বিপ্লবীদের মিলন ক্ষেত্র ছিল। ‘শ্রীসংঘে’র সদস্য-সমর্থকরা যোগাযোগ রক্ষার্থে এ বাড়িটি ব্যবহার করতেন। ‘ছাত্রীভবনে’র সদস্যরা অস্ত্র সংগ্রহ, অর্থ সংগ্রহ ও রক্ষণাবেক্ষণের কাজ করতেন। চট্টগ্রাম অস্ত্রাগার দখল মামলার জন্য লীলা নাগ ঢাকা থেকে চট্টগ্রামের ইন্দুমতি সিংহকে প্রচুর অর্থ সংগ্রহ করে দেন। সূর্যসেনের পরামর্শে অবিভক্ত ভারতের প্রথম নারী বিপ্লবী প্রীতিলতা ‘দীপালি সংঘে’র সদস্য হয়ে বিপ্লবী জীবনের পাঠ নিয়েছিলেন লীলা নাগের কাছে।
বাংলাদেশের বিভিন্ন অঞ্চলে দলের বিপ্লবীরা আগ্নেয়াস্ত্রের দাবি নিয়ে হাজির হতেন লীলা নাগের কাছে। এসময় বড়লাট লর্ড ইউলিংডনের ট্রেনে বোমা নিক্ষেপের পরিকল্পনা করেন অতীশ বসু ও তাঁর সহযোগীরা। বোমার ফর্মুলার প্রয়োগ নিয়ে আলোচনা করেন সংশ্লিষ্ট বন্ধুরা। একই সাথে অ্যাকশনের পরিকল্পনা করেন কমলাকান্ত ঘোষ। শুরু হয় ব্রিটিশ কর্মকর্তা নিধনের প্রস্তুতি পর্ব।
ঢাকার বিভিন্ন পল্লীতে অস্ত্রের ঘাঁটির রক্ষক ছিলেন মেয়েরা। ঢাকার বকসীবাজার, চাঁদনিঘাট, আজিমপুর, কায়েতটুলী, টিকাটুলি, উয়ারী, ঠাটারিবাজার, বনগ্রাম, তাঁতিবাজার, সঙ্গতটোলা, বাংলাবাজার, গেন্ডারিয়া, ফরাসগঞ্জ, লক্ষ্মীবাজার, সিদ্ধেশ্বরী ছিল বিপ্লবীদের অস্ত্রের ঘাঁটি। এসব জায়গা থেকে পূর্ববাংলার সর্বত্র অস্ত্র সরবরাহ করা হতো। কলকাতার সরবরাহ কেন্দ্র ছিল ‘ছাত্রীভবন’ এবং ৩১ কানাইধর লেন। কানাইধর লেনে ‘শ্রীসংঘে’র সদস্যদের পরস্পরের মিলন কেন্দ্র ছিল। ‘শ্রীসংঘ’ দ্বিধাবিভক্তির পর দলের যাঁরা ‘বেঙ্গল ভলান্টিয়ার্স’-এ (বি.ভি.) যোগ দিয়ে বৈপ্লবিক কর্মে জড়িত ছিলেন তাঁদের অনেকেই এ বাড়িতে অস্ত্র বিনিময় ও সহযোগিতার জন্যে আসতেন।
‘শ্রীসংঘে’র নেপাল নাগ, অশোক সেন (পরে ভারতের আইন মন্ত্রী) সত্যভূষণ গুহ বিশ্বাস, বিধুভূষণ গুহ বিশ্বাস, অসিত ঘোষ, জ্যোৎস্না সরকার এ ঘাঁটিতে নিয়মিত আসা-যাওয়া করতেন। বি.ভি. থেকে আসতেন সুপতিরায়, মনোরঞ্জন সেন, শশাঙ্ক দাশগুপ্ত প্রমুখ বিপ্লবীরা।
১৯৩১ সালের অক্টোবর মাসে ঢাকার ম্যাজিস্ট্রেট ডুরনোর উপর গুলিবর্ষণের মামলায় গ্রেপ্তার হন সুনীল দাস। দু’মাস পর তিনি কারামুক্ত হন। কারামুক্তির পর লীলা নাগের নির্দেশে তিনি কলকাতায় দলের সাংগঠনিক কাজ তদারকি করতে আসেন। কলকাতায় আসার পর লীলা নাগের নির্দেশে ঢাকা নিয়ে যাবার জন্য একটি আগ্নেয়াস্ত্র অশোক সেনের হাতে তুলে দেন সুনীল দাস। ওই সময় ‘যুগান্তর’ এবং অন্যান্য বিপ্লবী গোষ্ঠীর সহযোগে কলকাতায় একটি গোপন কো-অর্ডিনেশন বোর্ড তৈরি হয়। এ বোর্ড গঠনে লীলা নাগ যথেষ্ট সহায়তা করেন। তাঁরই নির্দেশে সেই বোর্ডের সদস্য হিসেবে ‘শ্রীসংঘে’র কান্তি ঘোষ মনোনয়ন পান।
১৯৩১ সালে ঢাকা শহরে ডুরনোর ওপর দিনের বেলায় গুলিবর্ষণের অভিযোগে ৩৩টি বাড়িতে পুলিশের অভিযান ও সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড চলে। ঢাকার অতিরিক্ত পুলিশ সুপার কোটাম, লীলা নাগের বাড়ি পেট্রোল ঢেলে আগুন লাগিয়ে পুড়িয়ে দেন। লীলা নাগ এসময় অস্ত্র ও অর্থ সংগ্রহের কাজে কলকাতায় ছিলেন।
১৯৩০ সালের ৮ ডিসেম্বর বিনয়-বাদল-দীনেশের দুর্ধর্ষ ‘রাইটার্স বিল্ডিং’ অভিযানের পর বিপ্লবীদের কার্যকলাপ আরো জোরদার হয়। ১৯৩১ সালের এপ্রিলে বি.ভি.’র সদস্যদের গুলিতে পরপর তিনজন জেলা ম্যাজিস্ট্রেট এবং আলিপুরের জেলা জজ গার্লিক ও কুমিল্লার জেলা ম্যাজিষ্ট্রেট সিটভেন্সর নিহত হন।
১৯৩১ সালের ২০ ডিসেম্বর লীলা নাগকে গ্রেপ্তার করা হয়। ১৯৩৭ সালের ৮ অক্টোবর তিনি মুক্তি পান। ১৯৩৫ সালে ব্রিটিশ সরকার ‘জয়শ্রী’ পত্রিকাটি নিষিদ্ধ করার পর ১৯৩৮ সালের জুলাই মাসে কলকাতার ২২ সি অশ্বিনী দত্ত রোড থেকে দ্বিতীয় পর্যায়ে তা আবার প্রকাশিত হয়। রেনু সেনের উদ্যোগে ঢাকা থেকে কলকাতায় ‘জয়শ্রী’র দপ্তর বদল করেন লীলা নাগ।
১৯৩৮ সালের ৩ আগষ্ট অনিল রায় মুক্তি পান। স্বাধীনতা, গণতন্ত্রের জন্য এগিয়ে যেতে হবে এ লক্ষ্যে অনিল রায় ও লীলা নাগের নেতৃত্বে ‘শ্রীসংঘ’ রূপান্তরিত হয় আদর্শভিত্তিক রাজনৈতিক গোষ্ঠীতে। এ গোষ্ঠীকে নিয়ে তাঁরা কংগ্রেসে যোগ দেন। অল্পদিনের মধ্যে রাজনৈতিক সংগ্রামে সুভাষচন্দ্রের ঘনিষ্ঠ সহকর্মীরূপে পরিচিত হন তাঁরা। রাজনীতি লীলা নাগের প্রধান কর্মক্ষেত্র হয়ে দাঁড়ালেও নারীমুক্তি সংগ্রাম, শিক্ষাবিস্তার এবং অন্যান্য গঠনমূলক কাজের দিকে তাঁর দৃষ্টি ছিল সবসময়। ঢাকায় নারী শিক্ষা মন্দির (বর্তমানে শেরেবাংলা স্কুল ও কলেজ), শিক্ষাভবন পুনর্গঠিত হয়। অনিল রায়ের মাতুলালয়ে মানিকগঞ্জের রায়রা গ্রামে মুসলিম সম্প্রদায়ভুক্ত কৃষক সন্তানদের জন্য একটি হাইস্কুল স্থাপন করেন তাঁরা।
লীলা নাগ বঙ্গীয় প্রাদেশিক কংগ্রেস কমিটিতে ‘কংগ্রেস মহিলা সংঘ’ স্থাপনের প্রস্তাব আনেন। এ প্রস্তাব সমর্থন করেন সুভাষচন্দ্র। দলমত নির্বিশেষে বাংলায় সব নারীকর্মী এ সংগঠনের অন্তর্ভুক্ত হন। জাতীয় সংগ্রামের সাথে নারী সমাজকে সংহত করার নেতৃত্বে ছিলেন লীলা নাগ। পরবর্তীকালে এ উদ্যোগের অনুসরণেই জন্মলাভ করে কংগ্রেস মহিলা সাব-কমিটিগুলো। ১৯৩৯ সালের জানুয়ারিতে ত্রিপুরা কংগ্রেসের পূর্বে জলপাইগুড়িতে অনুষ্ঠিত রাজনৈতিক সম্মেলনে জাতীয় দাবি সম্পর্কিত চরমপত্র প্রস্তাবের উত্থাপক সুভাষচন্দ্র এবং সমর্থক ছিলেন লীলা নাগ।
১৯৩৯ সালের ১৩ মে লীলা নাগ ও অনিল রায়ের বিবাহ হয়। বিয়ের পর সামাজিক প্রথানুসারে লীলা নাগের নাম হয় লীলা রায়। ওই মাসে তাঁরা দু’জন প্রতিষ্ঠাতা সদস্যরূপে ফরোয়ার্ড ব্লকে যোগদান করেন। সুভাষচন্দ্রকে নিয়ে ঢাকা, মানিকগঞ্জ সফর করেন তাঁরা। ১৯৪০ সালের ২৭ জুন নাগপুরে ফরোয়ার্ড ব্লকের দ্বিতীয় বার্ষিক সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। এ সম্মেলনের সভাপতি ছিলেন সুভাষচন্দ্র। মূল প্রস্তাব উত্থাপক ছিলেন লীলা রায়। প্রস্তাবে স্বাধীনতা সংগ্রামে ঝাঁপিয়ে পড়ার আহ্বান ছিল। সম্মেলনের সিদ্ধান্ত ছিল হলওয়েল মনুমেন্ট অপসারণ করা।
হলওয়েল মনুমেন্ট অপসারণ আন্দোলনে ১৯৪০ সালের ৯ জুলাই অনিল রায়কে এবং ১০ জুলাই লীলা রায়কে পুলিশ গ্র্রেফতার করে। ওই বছর ২৯ আগষ্ট স্বামী ও স্ত্রী মুক্তি পান। জেল থেকে মুক্তি পেয়ে সুভাষচন্দ্রের অনুরোধে সুভাষ বসু কর্তৃক প্রতিষ্ঠিত ও সম্পাদিত ইংরেজী সাপ্তাহিক ‘ফরোয়ার্ড ব্লক’ সম্পাদনার ভার নেন লীলা রায়।
১৯৪১ সালের আগষ্ট মাসে ঢাকার শিক্ষাভবন স্কুল প্রাঙ্গনে ‘দীপালি সংঘে’র অনুসরণে লীলা রায় একটি মহিলা সংগঠন ‘নাইনটিন ফরটিওয়ান’ ক্লাব ও ‘যুগদাবি চক্র’ স্থাপন করেন। ওই বছর ১১ ডিসেম্বর ভারতরক্ষা আইনে শরৎচন্দ্র বসু বন্দী হন। তাঁর এ গ্রেপ্তারের প্রতিবাদে হাজরা পার্কে অনুষ্ঠিত প্রতিবাদ সভায় লীলা রায় ও অনিল রায় তীব্র নিন্দা জানান। এ অপরাধে তাঁদেরকে রাজবন্দীরূপে ১৯৪৬ সালের জুন পর্যন্ত আটক থাকতে হয়।
মুক্তি পাওয়ার পর ওই বছর হিন্দু-মুসলমান দাঙ্গার সময় লীলা রায় ও অনিল রায় বিপন্ন মানুষকে উদ্ধার করে নিরাপদ আশ্রয়ে পৌছে দেন। ১৯৪৬ সালের অক্টোবরে নোয়াখালীর দাঙ্গার পর সেখানকার সবচাইতে বিপর্যস্ত এলাকা রামগঞ্জ থানায় গান্ধীজীর আগে লীলা রায় ও অনিল রায় তাঁদের কর্মীবাহিনী নিয়ে পৌছেন। ক্যাম্প খুলে ৬ দিনে ৯০ মাইল ঘুরে অবরুদ্ধ নারীদের উদ্ধার করেন। নোয়াখালীর উপদ্রুত অঞ্চলে ‘ন্যাশনাল সার্ভিস ইনস্টিটিউট’ নামে ১৭টি ক্যাম্প খুলে দীর্ঘদিন সেবা ও সাহায্যের ব্যবস্থা করেন।
১৯৪৭ সালে দেশ বিভাগের পর লীলা রায় অন্যান্য সংখ্যালঘুদের দুঃখ বঞ্চনার অংশীদার হয়ে পূর্ব বাংলায় বসবাস করার সিদ্ধান্ত নেন। কিন্তু মুসলিম লীগ শাসকেরা লীলা রায় ও অনিল রায়ের জীবন দূর্বিসহ করে তোলে। ১৯৪৮ সালে তাঁদেরকে দেশত্যাগে বাধ্য করা হয়।
১৯৪৯-৫১ সাল পর্যন্ত লীলা রায় সংখ্যালঘু হিন্দু, মুসলিমসহ অন্যান্য ধর্মাবলম্বী যারা ভারতবর্ষে উদ্ধাস্তু হয়েছিলেন তাঁদের জন্য ত্রাণ ও পুনর্বাসনের ব্যবস্থা করেন। ১৯৫০ সালে লীলা রায় ও তাঁর সহকর্মীরা সীমান্তবর্তী এলাকায় পূর্ববঙ্গ সংখ্যালঘু কেন্দ্রীয় কল্যাণ কমিটির পক্ষ থেকে আশ্রয় কেন্দ্র স্থাপন করেন। ১৯৫১ সালে উদ্বাস্তু উচ্ছেদের বিল আনেন সরকার। এ বিলের প্রতিবাদে নিষেধাজ্ঞা অমান্য করার কারণে গ্রেপ্তার হন লীলা রায় ও সৌমেন্দ্রনাথ ঠাকুর। ফলে পশ্চিমবঙ্গ সরকার বিলের উপযুক্ত পরিবর্তন করেন।
১৯৫২ সালে লীলা রায়ের স্বামী অনিল রায় ক্যান্সারে মৃত্যুবরণ করেন। জীবন সাথীকে হারিয়ে নিঃসঙ্গ হয় পড়েন তিনি। কিছুদিন পর তিনি আবার সমাজ বিপ্লবের সংগ্রামকে জোরদার করার কাজ শুরু করেন। ১৯৫৩ সালে তিনি জয়প্রকাশ নারায়ণের সমাজবাদী শিবিরে যোগদান করেন। সমাজবাদী শিবিরের সর্বভারতীয় সম্মেলনে লীলা রায় জাতীয় কর্ম পরিষদের সদস্য নির্বাচিত হন। ১৯৬০ সালের আগষ্ট মাসে সারা আসামের উপদ্রুত অঞ্চল ঘুরে দ্ব্যর্থহীনভাবে বাঙালী বিদ্বেষের সমালোচনা করেন।
১৯৬৪ সালের ২৫ মার্চ ‘পূর্ববাংলা বাঁচাও কমিটি’র উদ্যোগে অনুষ্ঠিত আন্দোলনে নেতৃত্ব দেবার সময় আইনভঙ্গ করার অপরাধে কলকাতায় তাঁকে গ্রেপ্তার করা হয়।
১৯৬৬ সাল থেকে তাঁর স্বাস্থ্যের অবনতি হতে থাকে। ১৯৬৮ সালের ৪ ফেব্রুয়ারি সকালবেলা সংজ্ঞাহীন অবস্থায় তাঁকে পি.পি. হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। ২৩ দিন পর সংজ্ঞা ফিরে এলেও তাঁর বাকশক্তি ফিরে আসেনা। ডানদিক সম্পূর্ণ অচল হয়ে যায়। এভাবে আড়াই বছর অসুস্থ থাকার পর ১৯৭০ সালের ১১ জুন তিনি মৃত্যুবরণ করেন।
তথ্য ও ছবিসূত্র:
১। মুক্তি মঞ্চে নারী: ড. নিবেদিতা দাশপুরকায়স্ত, রচনাকাল ১৯৯৪-৯৭ সাল
২। গণমানুষের মুক্তির আন্দোলন: মাহফুজা খানম/তপন কুমার দে, প্রকাশকাল ২০০৯।
৩। বাংলার মুক্তি সন্ধানী: সব্যসাচী চট্টপাধ্যায়, রাখী চট্টপাধ্যায়, প্রকাশকাল ২০০৫, কলকাতা।
৪। বাংলাপিডিয়া
৫। দৈনিক আমার দেশ, জুন ৩০ ২০০৭ সাল
লেখক : রফিকুল ইসলাম (শেখ রফিক)