শরীয়তপুর। পদ্মার তীর ঘেঁষে গড়ে ওঠা এক জনপদ। ফরায়েজী আন্দোলনের রূপকার হাজী শরীয়তুল্লাহর স্মৃতিধন্য এই শরীয়তপুর। ব্রিটিশ-ভারতে ও বাংলাদেশের মুক্তির সংগ্রামে শরীয়তপুরবাসীর ভূমিকা ছিল উল্লেখযোগ্য। বর্তমান শরীয়তপুর জেলাটি পূর্বে বৃহত্তর ফরিদপুর জেলায় অবস্থিত ছিল। ১৯৭৭ সালের ৩ নভেম্বর বিশিষ্ট সমাজ সংস্কারক ও ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনের নেতা শরীয়তুল্লাহর নামানুসারে শরীয়তপুর নামকরণ করা হয়। ১৯৮৪ সালে শরীয়তপুর জেলায় উন্নীত হয়।
নারিকেলবাড়িয়ায় তিতুমীরের বাঁশের কেল্লার লড়াইয়ের পর ফরিদপুরে নতুন করে গড়ে ওঠে স্বাধীকার আন্দোলন। আর এ আন্দোলনের নেতৃত্বে ছিলেন হাজী শরীয়তুল্লাহ। তিনি সরাসরি ইংরেজদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ বিগ্রহে না গিয়ে সাধারণ মুসলমানদেরকে ঈমান আকিদার প্রশ্নে একতাবদ্ধ করতে লাগলেন। তিনি জনগণকে ইসলামের মূল কর্তব্যসমূহ তথা ফরায়েজ (শরীয়তের অবশ্য পালনীয় দায়িত্ব ও কর্তব্য) শিক্ষাদানে নিজেকে নিয়োজিত করেন। এভাবে তিনি যে সংগঠন প্রতিষ্ঠা করেন তাঁর নাম ‘ফরায়েজী আন্দোলন।’ যারা এই কর্তব্যসমূহ যথাযথভাবে পালন করেন তাঁদেরকে ‘ফরায়েজী’ বলা হয়। ফরিদপুরের মানুষ ধীরে ধীরে তাঁর নেতৃত্বে এক বিশাল আন্দোলন গড়ে তোলে। ইতিহাসে এই আন্দোলনই ‘ফরায়েজী আন্দোলন’ নামে খ্যাত। তিনি ছিলেন অন্যায়ের বিরুদ্ধে সংগ্রামী মুসলিম রেনেসাঁর অগ্রপথিক।
ইসলামের সে সমস্ত ফরজ রয়েছে যেমন- মুখে কালিমা বলা, পাঁচ ওয়াক্ত নামায কায়েম করা, রমজান মাসের রোজা রাখা, যাকাত দেয়া, হজ্ব করা এবং অন্যান্য ফরজ পালন করা প্রতিটি ‘ফরায়েজী’ ভাইয়ের জন্য আবশ্যক। সাথে সাথে তিনি তাঁর অনুসারী সাধারণ মুসলমানের মধ্যে প্রচার করতে থাকেন যে, ‘লাঙ্গল যার জমিন তার’। এই ঘোষণার মাধ্যমে বাংলার নির্যাতিত কৃষকদেরকে তিনি ঐক্যবদ্ধ ও সংগঠিত করেন। তিনি ঘোষণা করেন যে, “এই জমিন আল্লাহর। সুতরাং খাজনা দিব আল্লাহকে। ব্রিটিশ অথবা তাদের সহযোগী হিন্দু জমিদারকে কোনো খাজনা দেয়া যাবে না।” তাছাড়া তিনি সরকারী খাস মহলগুলো দখলে এনে গরীব কৃষকদের মাঝে বিতরণ করতেন।
ফরায়েজি আন্দোলন ধর্মীয় সংস্কারের উদ্দেশ্যে সূচিত হলেও পরবর্তীতে এটি কৃষকদের অধিকার আদায়ের আন্দোলনে রূপ লাভ করে। শরীয়তুল্লাহ ফরিদপুর ও তার আশে-পাশের অঞ্চলে এ আন্দোলন সংগঠিত করেন এবং এর নেতৃত্ব দেন। ধর্মীয় সংস্কারের পাশপাশি জমিদার, নীলকরদের অত্যাচার ও শোষণ হতে কৃষকদেরকে মুক্ত করা ছিল এই আন্দোলনের মূল লক্ষ্য।
শরীয়তুল্লাহর জন্ম ১৭৮১ সালে। বর্তমান শরীয়তপুর জেলার শিবচর উপজেলার শ্যামাইলের বাহাদুরপুর গ্রামের তালুকদার পরিবারে। তাঁর বাবার নাম আবদুল জলিল তালুকদার। তিনি ছিলেন একজন ভদ্র, দয়ালু ও একজন প্রজাবৎসল জমিদার। এ কারণে সবাই তাঁকে ভালোবাসতো। অন্যান্য জমিদারদের মতো তিনি সাধারণ প্রজাদের ওপর জুলুম-নির্যাতন করতেন না। সাধারণ প্রজাদের সুখ-দুঃখ, হাসি-কান্না তিনি ভাগাভাগি করে নিতেন। সাহায্য করতেন সাধ্যমতো। এজন্যে তাঁর নামটি ছড়িয়ে পড়েছিলো অনেক দূর পর্যন্ত।
আবদুল জলিল তালুকদার চেয়েছিলেন তাঁর ছেলে একজন শিক্ষিত, আদর্শবান এবং সৎ মানুষ হিসেবে গড়ে উঠবে। সাধারণ মানুষের সেবায় নিজেকে উৎসর্গ করবে। বাবা আবদুল জলিল তালুকদারের এই স্বপ্ন শরীয়তুল্লাহ পূরণ করতে সক্ষম হয়েছিলেন। কিন্তু তাঁর বাবা তা দেখে যেতে পারেননি। শরীয়তুল্লাহর বয়স যখন আট বছর তখন তিনি (১৭৮৯ সালে) মারা যান। তিনি তখন তাঁর চাচা মুহাম্মদ আজিম ও তাঁর স্ত্রীর আশ্রয়ে বড় হতে থাকেন। মুহাম্মদ আজিমের কোনো সন্তান ছিলনা। শরীয়তুল্লাহ’র মা (নাম জানা যায়নি) তাঁর বাবার আগে মারা যান।
শরীয়তুল্লাহর পড়াশুনার হাতেখড়ি তাঁর পরিবারে। বিশেষ করে বাবার কাছে। তারপর গ্রামের মক্তবে। ১২ বছর বয়সে চাচার সাথে রাগ করে ১৭৯৩ সালে তিনি কলকাতা চলে যান। কলকাতায় গিয়ে শরীয়তুল্লাহ বিখ্যাত আলেম ও কোরান শিক্ষক মাওলানা বাশারত আলীর সাক্ষাত পান। বালক শরীয়তুল্লাহর শিক্ষার প্রতি আগ্রহ দেখে মাওলানা বাশারত আলী তাঁকে কোরান শিক্ষা ক্লাশে ভর্তি করিয়ে নেন। অত্যন্ত আন্তরিকতা ও স্নেহের সাথে তিনি শরীয়তুল্লাহকে কোরান শিক্ষা দেন। তারপর তিনি শিক্ষকের পরামর্শে হুগলী জেলার ফুরফুরায় যান। ফুরফুরাতে আরবী ও ফার্সী ভাষা শিক্ষাগ্রহণ করেন।
এরপর তিনি তাঁর আরেক চাচা আশিক মিয়ার কাছে যান। তিনি মুর্শিদাবাদের কোর্টে কর্মরত ছিলেন। সেখানে গিয়ে শরীয়তুল্লাহ আরবী ও ফার্সী ভাষা অধ্যয়ন অব্যাহত রাখেন। এখানে এক বছর অবস্থান করার পর তিনি তাঁর চাচা আশিক মিয়ার সাথে নিজ গ্রামে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেন। তাঁর চাচা গ্রামে যাওয়ার জন্য একটি ছোট নৌকা ভাড়া করেন। নৌকা চলছে গঙ্গা নদীতে। হঠাৎ শুরু হলো প্রচন্ড ঝড়। ঝড়ের কবলে পড়ে মুহূর্তেই নৌকাটি ডুবে যায়। সেই ঝড় আর ঢেউকে উপেক্ষা করে শরীয়তুল্লাহ সাঁতরিয়ে কূলে উঠে দাঁড়ালেন। প্রাণে বেঁচে গেলেন তিনি। কূলে উঠে গঙ্গার দিকে তাকিয়ে কোথাও খুঁজে পেলেন না চাচা, চাচী এবং সেই নৌকাটিকে। এই দুর্ঘটনায় শরীয়তুল্লাহ বেঁচে গেলেও তাঁর চাচা ও চাচি মারা যান। চাচা-চাচি মারা যাওয়ার শোকে তিনি গ্রামে যাওয়ার আগ্রহ হারিয়ে ফেলেন। গ্রামে না গিয়ে তিনি কলকাতায় ফিরে আসেন। তাঁর পুরানো শিক্ষক মাওলানা বাশারত আলীর সাথে দেখা করেন এবং এই দুর্ঘটনার কথা তাঁকে বলেন। তিনি সব শুনে ব্যথিত হন এবং তাঁকে সান্ত্বনা দিলেন।
ওই সময় মাওলানা বাশারত আলী ব্রিটিশ শাসনের প্রতি বীতশ্রদ্ধ হয়ে মক্কায় চলে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেন। শরীয়তুল্লাহও শিক্ষকের সঙ্গে মক্কায় যাওয়ার জন্য মত প্রকাশ করেন। ১৭৯৯ সালে দু’জন মিলে মক্কায় যান। মক্কায় তিনি বাঙ্গালী মাওলানা মুরাদের কাছে আরবী সাহিত্য ও ইসলামী আইন শিক্ষা গ্রহণ করেন। এসময় তিনি মাওলানা মুরাদের বাসগৃহে ছিলেন।
এরপর শরীয়তুল্লাহ হানাফী আইনজ্ঞ মওলানা তাহের সোম্বলের কাছে শিক্ষাগ্রহণ করেন। ফরায়েজীদের মতে মওলানা তাহের সোম্বল ‘ছোট আবু হানিফা’ নামে খ্যাত ছিলেন। এই জ্ঞানীর সংস্পর্শে এসে শরীয়তুল্লাহ ধর্মীয় বিজ্ঞানের সকল শাখায় জ্ঞান অর্জন করতে সক্ষম হন। একই সঙ্গে তিনি সুফিবাদ সম্পর্কে বিস্তর জ্ঞান লাভ করেন। এসময় তিনি সুফিতত্বের কাদেরিয়া তরীকার একজন একনিষ্ঠ অনুসারী হন।
এরপর তিনি কায়রো শহরের বিখ্যাত আলআজাহার বিশ্ববিদ্যালয়ে আরবী সাহিত্য, হাদীস, আফসীর, ফিকাহ্ ও ইসলামী শিক্ষা শাস্ত্র সম্পর্কে পড়াশুনা করেন।
হাজী শরীয়তুল্লাহ সুদূর মক্কাতেও একজন উচ্চশিক্ষিত আলেম হিসাবে বিশেষ খ্যাতি লাভ করেন। তাঁর পাণ্ডিত্যে মুগ্ধ হয়ে সেখানকার মানুষ তাঁকে শিক্ষক হিসাবে নিযুক্ত করেন। হাজী শরীয়তুল্লাহ মক্কায় বিশ বছর অবস্থান করার সময়ে শিক্ষকতার পেশা বেছে নেন।
১৮১৮ সালে তিনি দেশে ফিরে এলেন। দেখলেন তাঁর একমাত্র জীবিত চাচা মুহাম্মদ আজিম তালুকদার ভীষণ অসুস্থ। সেই পরিচিত মুখগুলোর মধ্যে অনেককেই আর দেখতে পেলেন না। ব্যথিত হলেন তিনি। এর চেয়ে বেশি মর্মাহত হলেন মুসলমানদের দুর্দশা দেখে। তিনি আঁতকে উঠলেন। কুসংস্কার, অশিক্ষা, কুশিক্ষা, দারিদ্র্য আর শোষণ নির্যাতনের বাস্তব চিত্র। ইংরেজদের শোষণ আর অত্যাচারে অতিষ্ঠ গ্রাম-শহরের মানুষ। সবখানে চলছে অত্যাচারী জমিদার, মহাজন আর নীলকরদের একচেটিয়া শোষণ-নির্যাতন। এ অবস্থা হতে পরিত্রাণের পথ খুঁজতে থাকলেন তিনি।
সেখানকার মুসলমানরা তখন রোযা-নামাযসহ আল্লাহর ইবাদাত ছেড়ে, আপন সংস্কৃতি ভুলে গিয়ে কুসংস্কারের সংস্কৃতিকে গ্রহণ করেছে। দীর্ঘকাল হিন্দুদের দ্বারা প্রভাবিত হবার কারণে হিন্দুয়ানী আচার অনুষ্ঠান ও হিন্দু সংস্কৃতিতে তারা গা ভাসিয়ে দিয়েছে। তাদের এই অধঃপতন দেখে খুবই মর্মাহত হলেন শরীয়তুল্লাহ। তিনি মানুষকে ইসলামের মর্মকথা শুনাতে শুরু করলেন। কিন্তু গ্রামের মুসলমানরা এতোটাই অন্ধকারে ডুবেছিলো যে, হাজী শরীয়তুল্লাহর শত আহ্বানেও তারা সাড়া দেয়নি। আপন গ্রামের মানুষকে সত্যের পথে ডেকে যখন তিনি তাদের কোনো সাড়া পেলেন না, তখন কিছুটা হতাশ হয়ে আবারো মক্কার উদ্দেশ্যে রওয়ানা হলেন।
মক্কা যাবার পথে প্রথমে তিনি বাগদাদে যান। সেখানে তিনি নবীজীর আদরের নাতি ইমাম হুসাইনের পবিত্র মাজার জিয়ারত করেন এবং বড়পীর আব্দুল কাদের জিলানী, ইমামে আযম হানীফা, ইমাম বাকের সাদিকের কবর জিয়ারত করেন। এরপর তিনি বাইতুল মাকদিস ও মিসর সফর শেষে পৌঁছে যান পবিত্র মক্কায়। পথে তিনি মিশরের বিশ্ব বিখ্যাত শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ‘জামিয়ায়ে আল-আযহারে’ ভর্তি হয়ে হাদীস, তাফসির ফিকাহ ও দর্শন শাস্ত্রে এক বছর ধরে গবেষণা করে জ্ঞান অর্জন করেন। তাঁর প্রচন্ড মেধা দেখে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ শিক্ষক হিসেবে নিয়োগ দেন। মাত্র কিছুদিন শিক্ষকতা করার পর সেখানে তিনি ব্যাপক সুনাম অর্জন করেন। মক্কায় পৌঁছে হাজী শরীয়তুল্লাহ পুনরায় খোঁজ করেন তাঁর প্রিয় শিক্ষক মওলানা তাহের আলীকে। তাঁর সাথে সাক্ষাতের পর তিনি আবারো হজ পালন করেন। তারপর রওনা হন মদীনার পথে। এরপর মদীনায় গিয়ে নবীজীর মাজার জিয়ারত করতে মদীনায় যান। রাসূলের (সা:) পবিত্র রওজা মুবারকে দাঁড়িয়ে হাজী শরীয়তুল্লাহ স্বদেশের মুসলমানদের বিপর্যয়ের কথা স্মরণ করে তাদের মুক্তি ও হিদায়েতের জন্যে বিশেষভাবে দোয়া করেন।
দু’বছর মক্কা ও মদীনা সফর করার পর ১৮২০ সালে হাজী শরীয়তুল্লাহ দেশে ফিরে আসার জন্য রওয়ানা দেন। এবার দেশে ফিরে দেখেন অন্য অবস্থা। চারদিকে জেগে উঠেছে মজলুম জনতা। হিন্দু জমিদার এবং ইংরেজ শাসনের বিরুদ্ধে আন্দোলনে নেমেছে সংগ্রামী জনতা। এসব দেখে তিনি অত্যন্ত খুশী হলেন।
তিনিও এই আন্দোলনে শরীক হলেন। হিন্দু জমিদার এবং ইংরেজ শাসনের বিরুদ্ধে জনগণকে আরো সচেতন করে তোলার জন্য তিনি নানা কাজ শুরু করেন। অধঃপতিত মুসলমানদেরকে অন্ধকার থেকে আলোর পথে তুলে আনার জন্যে তিনি ব্যাপকভাবে দীন দাওয়াতের কাজ শুরু করলেন। সাধারণ মুসলমানদেরকে নৈতিক শিক্ষায় তিনি উদ্বুদ্ধ করে তোলেন। একইসাথে তিনি ইংরেজ এবং অত্যাচারী জমিদার হিন্দুদের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ানোর জন্যও আহবান জানালেন। দেশে ফেরার পর লোকেরা জ্ঞান ও আধ্যাত্মিকতার কারণে তাঁকে ‘কুতুবুল বাঙ্গাল’ উপাধি দেন।
ওই সময় ইংরেজদের পাশাপাশি তাদের অধীনস্ত হিন্দু জমিদারদের জুলুম-নির্যাতনের শিকার হত মুসলমানরা। এসব অত্যাচার দেখে শরীয়তুল্লাহ মর্মাহত হলেন। এই অত্যাচার হতে তাদের বাঁচানোর জন্য তিনি প্রতিজ্ঞাবদ্ধ হলেন। অন্যদিকে ঘুমন্ত জনতাও জেগে ওঠেছে। বিদ্রোহের আগুন ছড়িয়ে পড়ছে চারদিকে। শরীয়তুল্লাহ ঝাঁপিয়ে পড়েন মুক্তি আন্দোলনে। বাংলার গ্রামে গ্রামে ঘুরে ফিরে নির্যাতিত মুসলমানদের মাঝে তিনি ইসলামের শিক্ষা ও আদর্শ প্রচার করেন। তাদেরকে নিয়ে গড়ে তোলেন ফরায়েজী আন্দোলন। ওই আন্দোলনের লক্ষ্য ছিল, অত্যাচারী জমিদার ও ব্রিটিশ শাসকদের হাত থেকে মুসলিম জাতিকে রক্ষা করা। হাজী শরীয়তুল্লাহর এই আন্দোলনের নাম ছিল ‘ফরায়েজী আন্দোলন’। আরবী ‘ফরজ’ শব্দের বহুবচন হচ্ছে, ‘ফরিজাহ’। আর যারা আল্লাহর নির্দেশিত অবশ্য কর্তব্যসমূহ পালনের অঙ্গীকার করে তাদেরকেই ‘ফরায়েজী’ বলা হয়। যারা ইসলামের ফরজসমূহ পালন করতে রাজি তারাই কেবল ‘ফরায়েজী আন্দোলনে’র সদস্য হতে পারতো।
হাজী শরীয়তুল্লাহ খুব অল্প সময়ের মধ্যে বিপুল সংখ্যক মুসলমানকে এই আন্দোলনের সদস্য করে তুলেছিলেন। ফরায়েজী সদস্য এবং সাধারণ মুসলমানকে ধর্মের সাথে কর্মের মিল রাখার জন্যে তিনি কঠোরভাবে নির্দেশ দিলেন। হাজী শরীয়তুল্লাহর আন্দোলন সম্পর্কে জেমস টেইলার বলেন, “কুরআনকে অক্ষরে অক্ষরে পালন করাই ছিলো ফরায়েজী আন্দোলনের উদ্দেশ্য।” অন্যদিকে জেমস ওয়াইজের মতে, ‘শিরক ও বিদআত থেকে স্থানীয় মুসলমানদের রক্ষা করার ক্ষেত্রে হাজী শরীয়তুল্লাহই পূর্ববঙ্গের ইসলামের প্রথম সংস্কারক ও প্রচারক।’
ইংরেজ আমলে হিন্দু জমিদাররা গরু কুরবানী নিষিদ্ধ করেছিল। কিন্তু হাজী শরীয়তুল্লাহ এই নিষেধ অমান্য করে গরু কুরবানী দিলেন। এরপর তিনি অন্যান্য মুসলমানকেও গরু কুরবানী দিতে বললেন। সে সময় কেউ দাড়ি রাখলে জমিদারদের কর দিতে হতো। শরীয়তুল্লাহ তাও দিতে নিষেধ করলেন। ওই সময় হিন্দু জমিদাররা মুসলমান কৃষকদের কাছ থেকে কালীপুজা, দুর্গা পুজা প্রভৃতি অনুষ্ঠানে কর আদায় করতো, শরীয়তুল্লাহ তা দিতেও মানা করলেন।
খোয়াজ খিজিরের নামে কলা গাছের ভেলা ভাসানো, বিবি ফাতেমার পূজা, দশেরা ও রথযাত্রা, চড়ক পূজা, হাসান-হোসাইন উপলক্ষে রক্ত ঝরানো, বুক চাপড়ানো ও হিন্দু ধাত্রীসহ অনেক কিছু তিনি নিষিদ্ধ করেন। তিনি আব্দুল কাদের জিলানী (রা.)-এর তাসাউফের অনুসারী ছিলেন।
তিনি মুসলিম সমাজের অস্পর্শ্যতা, জমিদার, পাঠান ও জোলাসহ অন্যান্য উপাধি নিষিদ্ধ করে সকল মুসলমানকে ভাই ভাই হিসেবে আখ্যায়িত করেন। তিনি মুসলমানদেরকে ধুতি পরা নিষেধ করে লুঙ্গি-পায়জামা পরার নির্দেশ দিয়েছেন। দৈনিক দুইবার জিকির করা ও ওয়াজ মাহফিল এবং মসজিদ-মাদ্রাসা নির্মাণ করার প্রতি উদ্বুদ্ধ করেন। এ সময় তিনি বুঝলেন, কেবল একটি ধর্মের নাম মাত্র নয় বরং একটি পরিপূর্ণ জীবন ব্যবস্থার নাম -ইসলাম।
হাজী শরীয়তুল্লাহর এই সাহসী তৎপরতায় ক্ষেপে গেলো অত্যাচারী হিন্দু জমিদার এবং ইংরেজরা। ফরায়েজীদের উপর শুরু হয় ইংরেজ ও হিন্দু জমিদারদের অত্যাচার। তাঁদের সাথে বহু জায়গায় সংঘর্ষ হলো। কিন্তু পিছু হটলেন না ফরায়েজীর কর্মীরা। তাঁরা শরীয়তুল্লাহর নেতৃত্বে সংঘর্ষ মোকাবেলা করতে শুরু করলেন। যতোই বাধা আসতে থাকলো, ততোই বিদ্যুৎগতিতে ছড়িয়ে পড়তে থাকলো ফরায়েজী আন্দোলনের তীব্রতা।
শরীয়তুল্লাহর এই ফরায়েজী আন্দোলন-সংগ্রাম অল্প কয়েক বছরের মধ্যেই চারদিকে ছড়িয়ে পড়ে। ছড়িয়ে পড়ে বৃহত্তর ফরিদপুরের গ্রামে গ্রামে। এমনকি এক সময় এই আন্দোলন দক্ষিণ বাংলার অধিকাংশ জায়গায় ছড়িয়ে পড়ে। ফরিদপুর, বরিশাল, খুলনা, যশোর, কুষ্টিয়া, ঢাকা, ময়মনসিংহ, ত্রিপুরা প্রভৃতি জেলায়ও এই ফরায়েজী আন্দোলন ছড়িয়ে পড়ে। আর এই সংগ্রামে যুক্ত হয়েছিলো সমাজের দরিদ্র কৃষক শ্রেণী। যারা হিন্দু জমিদার ও ইংরেজদের অত্যাচার, শোষণ ও নির্যাতনের শিকার হয়েছিলো। হাজী শরীয়তুল্লাহর এই সাহসী আন্দোলন ছিলো সত্যের পক্ষে আর অন্যায়ের বিরুদ্ধে।
১৮৩১ সালের ২৯ এপ্রিল ঢাকা-জালালপুরের ফৌজদার আইন সম্পর্কিত রিপোর্ট (রুবকারী) অনুযায়ী দেখা যায়, ধর্মীয় বিষয়ে শরীয়তুল্লাহ’র অনুসারী এবং রামনগর গ্রামের অধিবাসীদের মধ্যে ১৮৩১ সালে সহিংসতা দেখা দিয়েছে।
১৮৩১ সালে ‘ফরায়েজী আন্দোলনে’র কর্মীরা একদিকে রক্ষণশীল মুসলমানদের সঙ্গে এবং অন্যদিকে হিন্দু জমিদারদের সঙ্গে প্রবল সংঘাতে জড়িয়ে পড়ে। এরপর সময় যত গড়াতে থাকে ততোই সংঘাত বাড়তে থাকে। এভাবে সংঘাত ও সনাতনপন্থীদের বিরোধের পরও ফরায়েজীগণ শক্তিশালী ধর্মীয় ভ্রাতৃত্ববোধের মাধ্যমে একটি সম্প্রদায়ে পরিণত হয়।
হিন্দু জমিদার ও রক্ষণশীল মুসলমান এবং ব্রিটিশ সরকারের রোষানলে পড়ে অসংখ্য বার ফরায়েজী আন্দোলনের কর্মীরা নির্যাতনের শিকার হন। ১৮২২-৩৯ সাল পর্যন্ত হাজী শরীয়তুল্লাহকে ব্রিটিশ পুলিশ বহুবার গ্রেফতার করে। কয়েকবার তাঁর উপর অমানুষিক নির্যাতনও চালোনো হয়।
ব্রিটিশ পুলিশ তাঁকে বার বার আটক করলেও তাঁর বিরুদ্ধে কোনো অপরাধ প্রমাণ করতে পারেনি। যে কারণে তাঁকে বেশী দিন থানা হাজতে আটকিয়ে রাখা সম্ভব হয়নি। তিনি সবসময়ই নিজেকে একজন ধর্মীয় সংস্কারক হিসাবে প্রমাণ করেছেন।
১৮৩৭ সালে তাঁর এই সংগ্রামী আন্দোলনের সদস্য সংখ্যা ছিলো বারো হাজার। এই বিপুল সংখ্যক সদস্যের বাইরেও ছিলো একটি বিশাল জনশক্তি, যাঁরা তাঁর আন্দোলনকে সকল সময় সমর্থন ও সহযোগিতা করতেন। ‘ফরায়েজী আন্দোলন’ ধর্মীয় সংস্কারের উদ্দেশ্যে সূচিত হলেও পরবর্তিতে এটি কৃষকদের আন্দোলনে রূপ নেয়। শরীয়তুল্লাহ শুধু ধর্মীয় সংস্কারক ছিলেন না, বরং তিনি কৃষক, তাঁতি এবং অন্যান্য শ্রমজীবী মানুষকে অন্যায়-অত্যচার ও শোষণের হাত থেকে মুক্ত করার জন্য এই সংস্কার আন্দোলন পরিচালনা করেছিলেন। হাজী শরীয়তুল্লাহ ১৮৪০ সালের ২২ জানুয়ারী মৃত্যুবরণ করেন। মৃত্যুর সময় তাঁর বয়স হয়েছিলো ৫৯ বছর।
তথ্য ও ছবিসূত্র:
১. বাংলার কৃষক আন্দোলন-আমজাদ হোসেন
২. বাংলার মুক্তি-সন্ধান – রাখী চট্টোপাধ্যায় ও সব্যসাচী চট্টোপাধ্যায়; প্রকাশকাল : ২০০৫, কলকাতা।
৩. ব্রিটিশ ভারতীয় নথিতে তিতুমীর ও তার অনুসারীরা – ড. মুঈনউদ্দীন আহমদ খান; প্রকাশকাল : জুন, ১৯৯৯।
৪. www.dcfaridpur.gov.bd
লেখক : রফিকুল ইসলাম (শেখ রফিক)