১৯৩৪ সালের ১২ জানুয়ারি সন্ধ্যা। চট্টগ্রাম জেলে বসে সূর্যসেন খুব সচেতনভাবেই ভাবছেন রাত ১২ টা ১ মিনিট বাজতে আর মাত্র পাঁচ ঘন্টা বাকী। এই সময়টুকু পার হওয়ার সাথে সাথে তাঁর জীবন প্রদীপ নিভিয়ে দেওয়া হবে। এক্ষেত্রে সিদ্ধান্ত পরিবর্তন হওয়ার কোনো সুযোগ নেই। রাত ১২ টা ১ মিনিটে ফাঁসির রজ্জু তাঁকে পড়তেই হবে। এটাই আইন। ব্রিটিশ সরকারের আইন। ব্রিটিশ সরকারের বিজ্ঞ জজের রায়।
সূর্যসেনের অপরাধ, দেশমাতৃকার স্বাধীনতার জন্য ব্রিটিশ শাসন-শোষণ, অন্যায়-অত্যচারের বিরুদ্ধে সংগ্রাম করেছেন, লড়াই করেছেন। এজন্য তাঁকে মরতে হবে। মাষ্টারদা সূর্যসেন পায়েচারী করছেন আর ভাবছেন দেশের স্বাধীনতার জন্য আরো অনেকটা পথ হাঁটতে হবে এবং এজন্য অনেককেই জীবন উৎসর্গ করতে হবে। তাই তিনি তাঁর সহযোদ্ধাদের উদ্দেশ্যে কিছু কথা লিখে যান।
অন্যদিকে সূর্যসেনের সহযোদ্ধারা ও ভারত উপমহাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামী বিপ্লবীরা অশ্রুসিক্ত নয়নে সূর্যসেনের কথা ভাবছেন। অনেক সহযোদ্ধার মনে নেতার সাথে তাঁদের লড়াই-সংগ্রামের অসংখ্য স্মৃতির কথা ভেসে উঠছে। রাত ১২ টা ১ মিনিটে তাঁরা তাঁদের প্রিয়নেতাকে রেড স্যালুটের মাধ্যমে বিদায় জানিয়ে স্বাধীনতার জন্য অগ্নি শপথ নিবেন। অনেকেই নেতার লাশ ছুয়ে স্বাধীনতার জন্য শপথ নিবেন বলে জেলগেটে অপেক্ষা করছিলেন। কিন্তু ব্রিটিশ সরকার সূর্যসেনের লাশ দেয়নি। কারণ তারা ভেবেছিল, সূর্যসেনের মৃতদেহ লড়াই-সংগ্রামের প্রতীক হয়ে উঠতে পারে, তাই মৃতদেহটিকে গুম করে ফেলেছিল তারা। পরে জানা যায়, মৃতদেহটি লোহার খাঁচায় ভরে সমূদ্রে ফেলে দেয়া হয়েছিল।
চট্টগ্রাম জেলে ফাঁসির ৫ ঘণ্টা পূর্বে লেখা মাস্টারদা সূর্যসেনের শেষ বাণী : “আমার শেষ বাণী- আদর্শ ও একতা। ফাঁসির রজ্জু আমার মাথার উপর ঝুলছে। মৃত্যু আমার দরজায় করাঘাত করছে। মন আমার অসীমের পানে ছুটে চলছে। এই ত সাধনার সময়। বন্ধুরূপে মৃত্যুকে আলিঙ্গন করার এই ত সময়। ফেলে আসা দিনগুলোকে স্মরণ করার এই ত সময়। কত মধুর তোমাদের সকলের স্মৃতি। তোমরা আমার ভাই-বোনেরা তোমাদের মধুর স্মৃতি বৈচিত্রহীন আমার এই জীবনের একঘেঁয়েমিকে ভেঙে দেয়। উৎসাহ দেয় আমাকে। এই সুন্দর পরম মুহূর্তে আমি তোমাদের জন্য দিয়ে গেলাম স্বাধীন ভারতের স্বপ্ন। আমার জীবনের এক শুভ মুহূর্তে এই স্বপ্ন আমাকে অনুপ্রাণিত করেছিল। জীবনভর উৎসাহভরে ও অক্লান্তভাবে পাগলের মতো সেই স্বপ্নের পেছনে আমি ছুটেছি। জানি না কোথায় আজ আমাকে থেমে যেতে হচ্ছে। লক্ষ্যে পৌঁছানোর আগে মৃত্যুর হিমশীতল হাত আমার মতো তোমাদের স্পর্শ করলে তোমরাও তোমাদের অনুগামীদের হাতে এই ভার তুলে দেবে, আজ যেমন আমি তোমাদের হাতে তুলে দিয়ে যাচ্ছি। আমার বন্ধুরা- এগিয়ে চল, এগিয়ে চল- কখনো পিছিয়ে যেও না। পরাধীনতার অন্ধকার দূরে সরে যাচ্ছে। ঐ দেখা যাচ্ছে স্বাধীনতার নবারুণ। কখনো হতাশ হয়ো না। সাফল্য আমাদের হবেই। ভগবান তোমাদের আশীর্বাদ করুন।
১৯৩০ সালের ১৮ এপ্রিল চট্টগ্রাম ইস্টার বিদ্রোহের কথা কোনও দিনই ভুলে যেও না। জালালাবাদ, জুলখা, চন্দননগর ও ধলঘাটের সংগ্রামের কথা সব সময় মনে রেখো। ভারতের স্বাধীনতার বেদীমূলে যেসব দেশপ্রেমিক জীবন উৎসর্গ করেছেন, তাঁদের নাম রক্তাক্ষরে অন্তরের অন্তরতম প্রদেশে লিখে রেখো। আমাদের সংগঠনে বিভেদ না আসে- এই আমার একান্ত আবেদন। যারা কারাগারের ভেতরে ও বাইরে রয়েছে, তাদের সকলকে জানাই আমার আশীর্বাদ। বিদায় নিলাম তোমাদের কাছ থেকে।
বিপ্লব দীর্ঘজীবী হোক
বন্দেমাতরম”
চট্টগ্রামের বিপ্লবী ইতিহাসের মহানায়ক সূর্যসেন জন্মেছিলেন ১৮৯৪ সালের ২২ মার্চ। চট্টগ্রামের রাউজান থানার নোয়াপাড়া গ্রামে। তাঁর পূর্ণনাম সূর্যকুমার সেন। তাঁর বাবার নাম রাজমণি সেন। মা শশীবালা সেন। তিনি ছিলেন বাবা-মার চতুর্থ সন্তান। পাঁচ বছর বয়সে সূর্যসেনের বাবা মারা যায়। এরপর থেকে সূর্যসেন তাঁর বড় কাকা গৌরমণি সেনের কাছে লালিত-পালিত হয়েছেন। পরবর্তীতে জ্যাঠাতুতো দাদা চন্দ্রনাথ সেন তাঁর অভিভাবকের দায়িত্ব পালন করেন।
সূর্যসেনের বর্ণমালার হাতেখড়ি বাবার কাছে। তারপর তাঁর বাবা তাঁকে নোয়াপাড়া দয়াময়ী প্রাইমারী স্কুলে ভর্তি করে দেন। প্রাইমারী স্কুলের পাঠ শেষ করে সূর্যসেন নোয়াপাড়া মাইনর স্কুলে ভর্তি হন। এখানে তিনি ৪ বছর পড়েন। পড়াশুনার জন্য ভাল হওয়া সত্বেও মাইনর স্কুলের সরকারী অনুমোদন না থাকায় তাঁর চাচা গৌরমণি সেন তাঁকে চট্টগ্রাম নন্দনকাননের ন্যাশনাল স্কুলে নবম শ্রেণীতে ভর্তি করে দেন।
পড়াশুনার পাশাপশি ন্যাশনাল স্কুলের প্রতিষ্ঠাতা ও শিক্ষক হরিশ দত্তের কথাগুলো সূর্যসেনের সবসময় মনে পড়ে, “সত্যিকারের একটা মানব সন্তান চাই, মন দিয়ে লেখাপড়া শিখবে, মানুষের মতো মানুষ হওয়া চাই”। এই স্কুলে ভর্তি হওয়ার বেশ কিছুদিন পর সূর্যসেন ছাত্র পড়ানো শুরু করেন। এতদিন জ্যাঠার সাথে ছিলেন। এখন টিউশনি করে যে টাকা পান তা দিয়ে নিজে চলেন এবং মাকেও কিছু পাঠান। পড়াশুনা আর মানুষের মতো মানুষ হওয়ার চিন্তায় মগ্ন থাকেন তিনি।
ওই সময় বঙ্গভঙ্গ রোধকল্পে যে আন্দোলন সংগঠিত হয়েছিল তার ঢেউ বাংলার প্রান্তে প্রান্তে ছড়িয়ে পড়ে। এই বঙ্গভঙ্গ-বিরোধী আন্দোলনের মূল বিষয় সূর্যসেন না বুঝলেও মাষ্টার মশাইয়ের কাছে শুনে মোটাদাগে এর অনেক কিছু বুঝেছিলেন। এ আন্দোলন তাঁর মাঝে রেখাপাত করে।
১৯১০ সালে সূর্যসেনের মা মারা যান। মা মারা যাওয়ার পর কিছুদিন ভীষণ মন খারাপ ছিল তাঁর। মনের কিছুটা স্বাভাবিক অবস্থা ফিরে এলে তিনি গুপ্ত সমিতিতে নাম লেখান। দেশমাতাকে মা করে নেওয়ার দীক্ষা নেন। দেশমাতাকে ব্রিটিশদের হাত থেকে মুক্ত করার কাজে যুক্ত হন তিনি। ১৯১২ সালে ওই স্কুল থেকে অংকে লেটারসহ প্রথম বিভাগে এন্ট্রান্স পাশ করেন।
এরপর তিনি চট্টগ্রাম কলেজে আই.এ.-তে ভর্তি হন। এই কলেজে পড়ার সময় কলেজের অধ্যাপক শতীশ চক্রবর্তীর সংস্পর্শে তিনি বৈপ্লবিক চেতনায় উদ্বুদ্ধ হয়ে ‘অনুশীলন সমিতি’তে যুক্ত হন। ‘অনুশীলন সমিতি’ ছিল ব্রিটিশবিরোধী সশস্ত্র বিপ্লবী সংগঠন। শিক্ষক শতীশ চক্রবর্তী ক্লাস থেকে বেছে বেছে ছাত্রদের নিয়ে আলোচনায় বসতেন। তাদেরকে ধীরে ধীরে বিপ্লবী দলে যুক্ত করতেন।
চট্টগ্রাম কলেজ থেকে আই.এ. পাশ করার পর সূর্যসেন পশ্চিমবঙ্গের বহরমপুর কৃষ্ণনাথ কলেজে বি.এ. ভর্তি হন। এই কলেজে পড়ার সময় তিনি বিপ্লবী ‘যুগান্তর’ দলে যোগ দেন। বহরমপুর কৃষ্ণনাথ কলেজ থেকে ১৯১৮ সালে তিনি বি.এ. পাস করেন। এরপর তিনি চট্টগ্রামে চলে আসেন এবং গণিতের শিক্ষক হিসেবে সেখানকার ওরিয়েন্টাল স্কুলে যোগ দেন।
প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সময় চট্টগ্রাম বিপ্লবী দলের (গুপ্ত সমিতি) দু’একজন ছাড়া প্রায় সকলকেই ব্রিটিশ সরকার গ্রেফতার করে। ফলে সূর্যসেনের কাঁধে বিপ্লবী দল ও আন্দোলন সংগঠিত করার দায়িত্ব এসে পড়ে। সূর্যসেন ও অম্বিকা চক্রবর্তী শহরের দেওয়ানবাজার দেওয়ানজী পুকুর পাড়ে শান্তি আশ্রম প্রতিষ্ঠা করে সেখানেই থাকেন এবং বিপ্লবী দল গোছানোর চেষ্টা করেন। বিশ্বযুদ্ধের শেষের দিকে বিপ্লবীদের সাংগঠনিক শক্তি মতাদর্শিক পার্থক্যের কারণে চারুবিকাশ দত্ত তাঁর সঙ্গীদের নিয়ে ‘অনুশীলন সমিতি’তে যোগ দেন। এর কিছুদিন পর সূর্যসেন ‘যুগান্তর’ দলের সভাপতি হন।
১৯১৯ সালের মে মাসের মাঝামাঝি সূর্যসেনের দাদা-বৌদি তাঁর বিয়ের আয়োজন করেন। বিয়ে না করার কথা দাদা-বৌদিকে জানিয়ে দেন সূর্যসেন। কিন্তু কোনো আবেদনই তাঁরা শুনলেন না। অবশেষে তিনি বিয়েতে রাজী হলেন। পাত্রী চট্টগ্রামের কানুনগো পাড়ার নগেন্দ্রনাথ দত্তের কন্যা পুষ্পকুন্তলা দেবী। বিয়ের আসরে বসেই সূর্যসেন খবর পান, তাঁর সহযোগিরা নতুন করে স্বাধীনতা সংগ্রাম শুরু করার অঙ্গীকার ব্যক্ত করেছেন। তাঁরা বলেছেন, সূর্যসেনকেই এ সংগঠনের দায়িত্ব নিতে হবে।
তাই বিয়ের রাত্রেই পুষ্পকুন্তলা দেবীর কাছে নিজের জীবনের লক্ষ্য এবং ব্রহ্মচর্য পালনের সিদ্ধান্ত তুলে ধরে ক্ষমা চাইলেন এবং সেই রাতেই বাড়ি ছেড়ে চলে গেলেন। এরপর আত্মনিয়োগ করলেন বিপ্লবী আন্দোলনে।
১৯২০ সালে অসহযোগ আন্দোলনে সূর্যসেন এবং তাঁর দল সক্রিয় অংশগ্রহণ করেন। ১৯২০-২১ সালে অসহযোগ আন্দোলনের সময় স্থানীয় জনগণের সহযোগিতায় একটি জাতীয় বিদ্যালয় গড়ে ওঠে। তখন সূর্যসেন এই বিদ্যালয়ে শিক্ষকতা শুরু করেন। এটি উমাতারা স্কুল নামে পরিচিত হয়। এই সময় তিনি ‘মাস্টারদা’ নামে পরিচিত হতে থাকেন। তিনি ছাত্রদেরকে স্নেহ-ভালোবাসা দিয় জয় করতেন। আর তাই ছাত্ররাও তাঁকে অত্যন্ত ভক্তি-শ্রদ্ধা করত। এক সময় এই স্কুলই তাঁর বিপ্লবী কর্মকাণ্ডের গুরুত্বপূর্ণ কেন্দ্র হয়ে ওঠে। ছাত্রদের সামনে তিনি তুলে ধরতেন স্বাধীনতার আহ্বান।
১৯২২ সালের শুরুতেই গান্ধী অসহযোগ আন্দোলন প্রত্যাহার করে নেয়ায় চট্টগ্রামের বিপ্লবীরা হতাশা আর স্থবিরতার আঘাত সামলে গণআন্দোলন এগিয়ে নিয়ে যাবার উদ্যোগ নিলেন। তাঁরা অর্থ, অস্ত্র সংগ্রহের পাশাপাশি সশস্ত্র অভ্যুত্থানের সব রকম প্রস্তুতি নিতে থাকেন। নগেন সেন বা জুলু সেন প্রথম বিশ্বযুদ্ধে বেঙ্গল রেজিমেন্টে হাবিলদার পদে উন্নীত হয়েছিলেন। তাঁর নেতৃত্বে শুরু হল বিপ্লবীদের সামরিক প্রশিক্ষণ। এ সময় বিপ্লবীরা অর্থসংগ্রহের জন্য ডাকাতির আশ্রয়ও নিয়েছিলেন। প্রথম ডাকাতি সংগঠিত হয়েছিল আনোয়ারা থানার জমিদার সরসী বাবুর বাড়িতে। এ ডাকাতি থেকে নগদ ১৫/২০ হাজার টাকা ও সোনা-গহনা সংগ্রহ করা হয়।
১৯২৩ সালের ২৪ ডিসেম্বর দিনের বেলায় প্রকাশ্য রাস্তায় সূর্যসেনের নেতৃত্বে রেলওয়ে কর্মচারিদের বেতন বাবদ নিয়ে যাওয়া ১৭,০০০ টাকা ছিনতাই করা হয়। পুলিশ গোপন সূত্রে খবর পেয়ে বিপ্লবীদের আস্তানায় হানা দেয়। পুলিশের সঙ্গে খণ্ডযুদ্ধ শুরু হয়। এই যুদ্ধ ‘নাগরথানা পাহাড়খণ্ড যুদ্ধ’ নামে পরিচিত। এই যুদ্ধের পর সূর্যসেন ও অম্বিকা চক্রবর্তী ধরা পড়েন। কিন্তু মামলায় তাঁদের বিরুদ্ধে যথেষ্ট প্রমাণ উপস্থিত করতে না পারায় তাঁরা ছাড়া পান। জেল থেকে বেরিয়ে এক মুহূর্তও সময় নষ্ট করলেন না সূর্যসেন। আবার শুরু হল সশস্ত্র অভ্যুত্থানের প্রস্তুতি।
১৯২৪ সাল। ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলন ছড়িয়ে পড়ছে সারা ভারত উপমহাদেশে। সর্বত্র সংগঠিত হচ্ছে সশস্ত্র বিপ্লববাদী সংগঠন। চট্টগ্রামে রেলওয়ে ডাকাতি, বঙ্গের বিভিন্ন জায়গায় রাজনৈতিক ডাকাতি ও বিপ্লববাদীদের সশস্ত্র কার্যকলাপের কারণে বঙ্গীয় প্রাদেশিক পরিষদে ব্রিটিশ সরকার “১ নং বেঙ্গল অর্ডিনেন্স” নামে এক জরুরি আইন পাশ করে। এই আইনের উদ্দেশ্য ছিল – রাজনৈতিক কার্যকলাপের জন্য সন্দেহভাজনদের বিনা বিচারে আটক রাখা। ১৯২৪ সালের ৫ সেপ্টেম্বর চট্টগ্রামের নোয়াপাড়ায় একটি অস্ত্রলুটের ঘটনায় মাস্টারদা জড়িত ছিলেন। এই অপরাধে চট্টগ্রাম থেকে সূর্যসেন, অম্বিকা চক্রবর্তীসহ অনেককেই এই আইনে আটক করা হয়েছিল। তাঁরা কিছুদিন পরে মুক্তি পান।
এই বেঙ্গল অর্ডিনেন্স ঘোষণা করে ব্রিটিশ সরকার সারা বাংলায় বিপ্লবীদেরকে ব্যাপকভাবে গ্রেফতার শুরু করে। শুধু ১৯২৪ সালের ২৫ অক্টোবর বাংলার বিভিন্ন জেলা থেকে প্রায় ২০০ বিপ্লবী নেতা-কর্মীকে গ্রেফতার করা হয়। গ্রেফতার হন নেতাজী সুভাষ চন্দ্র বসু, অনিলবরণ রায় প্রমুখ নেতারাও। চট্টগ্রামের বিপ্লবীরা পুলিশের চোখকে ফাঁকি দিতে কলকাতায় আশ্রয় নেন। ওই সময় তাঁরা কলকাতার দক্ষিণেশ্বরে বোমা তৈরির প্রশিক্ষণ নিতেন এবং থাকতেন শোভাবাজারে।
১৯২৫ সালের ১০ নভেম্বর শোভাবাজারে বিপ্লবীদের আস্তানায় পুলিশ হানা দেয়। তখন সূর্যসেন কৌশলে সেখান থেকে পালিয়ে যান। এরপর কিছু দিন আত্মগোপনে থেকে বিপ্লবী সংগঠনের কাজ সেরে কলকাতায় চলে যান।
১৯২৬ সালের ৮ অক্টোবর কলকাতার এক মেস থেকে পুলিশ তাঁকে গ্রেফতার করে। তাঁদের বিরুদ্ধে দায়ের করা হয় ‘মুরারিপুকুর ষড়যন্ত্র মামলা’ ও টেগার্ট হত্যা প্রচেষ্টা মামলা। মাস্টারদা যখন জেলে তখন প্রকাশিত হয় শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের সাড়া জাগানো উপন্যাস ‘পথের দাবী’। ব্রিটিশ সরকার এ বইটি বাজেয়াপ্ত করলেও বিপ্লবীরা গোপনে নানা উপায়ে তা সংগ্রহ করতেন এবং গভীর মনোযোগের সাথে পড়তেন। ‘পথের দাবী’ উপন্যাসটি সূর্যসেন ও তাঁর সাথীদের মনে ব্যাপক নাড়া দেয়।
১৯২৮ সালের শেষের দিকে তিনি মুক্তি পান। স্ত্রী পুষ্পকুন্তলার অসুস্থতার খবর পেয়ে সূর্যসেন তাঁকে দেখতে যান। যেদিন তিনি বাড়ি পৌঁছলেন, পুষ্পকুন্তলা সেদিনই মৃত্যুবরণ করেন। অবসান ঘটল তাঁদের ৯ বছরের বিবাহিত জীবনের। স্ত্রীর মৃত্যুশোক কাটতে না কাটতেই সূর্যসেন আক্রান্ত হলেন টাইফয়েডে। তিন মাস শয্যাশায়ী থাকলেন। এরই মধ্যে একদিন ইংরেজ ম্যাজিস্ট্রেট এসে হাজির। প্রস্তাব দিলেন রাজনীতি থেকে সরে দাঁড়ানোর । শুধু তাই নয়, বন্ড সই দিলে সংসারের খরচও ব্রিটিশ সরকার চালাবে বলে জানানো হল। সূর্যসেন চুপ করে রইলেন। এরপর একদিন অকস্মাৎ উধাও হয়ে গেলেন তিনি।
চলে গেলেন আত্মগোপনে। কিন্তু বিপ্লবীরা তাদের কাজকর্ম প্রকাশ্যে পরিচালনার নানা উদ্যোগ গ্রহণ করলেন। চট্টগ্রাম শহরে অনন্ত সিংহ ও লোকনাথ বলের পরিচালনায় একটি ব্যায়ামাগার স্থাপন করা হল। নাম দেয়া হল ‘সদরঘাট ক্লাব’। ওই ক্লাবই পরিণত হল বিপ্লবীদের মিলনক্ষেত্রে। এবার তাঁরা ডাকাতির আশ্রয় না নিয়ে নিজেদের বাড়ি থেকে চুরি করে ও পরিচিতজনদের কাছ থেকে চাঁদা তুলে অর্থ সংগ্রহ করা শুরু করলেন। ইতিমধ্যে মাস্টারদা সূর্যসেন প্রকাশ্যে চলে এলেন।
১৯২৯ সালের প্রথম দিকে তিনি চট্টগ্রাম জেলা কংগ্রেসের সম্পাদক নির্বাচিত হন। এই বছরের মে মাসে সূর্যসেন দলের উদ্যোগে চট্টগ্রামে চারটি সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। ১৯৩০ সালের শুরু থেকেই তাঁর উদ্যোগে ভবিষ্যৎ সশস্ত্র আন্দোলনের ব্যাপক পরিকল্পনা শুরু হয়। ১৯৩০ সালের ১৮ এপ্রিল সশস্ত্র অভ্যুত্থান করার উদ্দেশ্যে চট্টগ্রাম অস্ত্রাগার দখল করেন তাঁরা। অস্ত্রাগার দখলের প্রধান কারণ অস্ত্র সংগ্রহ। ১৮ এপ্রিল চট্টগ্রাম অস্ত্রাগার লুণ্ঠনের ঘটনাকে রমেশচন্দ্র মজুমদার ‘ভারতের বিপ্লবী কর্মকাণ্ডের সবচেয়ে সাহসিকতাপূর্ণ কাজ’ হিসাবে চিহ্নিত করেছেন। যা ছিল দেড়শত বছরের ইতিহাসের মধ্যে ইংরেজদের জন্য খুবই অপমানজনক ঘটনা। এটি ছিল এদেশের মানুষের কাছে ইংরেজ বাহিনীর প্রথম পরাজয়।
১৮ থেকে ২১ এপ্রিল এই চারদিন চট্টগ্রামে ইংরেজ শাসন কার্যত অচল ছিল। পরাধীন জাতির ইতিহাসে বিপ্লবীদের এ বিজয় ছিল গৌরবগাঁথা। ২২ এপ্রিল ভোর ৪টা থেকে সাড়ে ৪টার মধ্যে চট্টগ্রাম নাজিরহাট শাখা রেললাইনের ঝরঝরিয়া বটতলা স্টেশনে একটি সশস্ত্র ট্রেন এসে থামে। বিপ্লবীদের তখন বুঝতে বাকি রইল না যে তাঁদের সম্মুখযুদ্ধের ক্ষণ আসন্ন। ওইদিন ব্রিটিশ সরকার সূর্যসেন, নির্মল সেন, অম্বিকা চক্রবর্তী, গণেশ ঘোষ, অনন্ত সিংহ ও লোকনাথ বলকে ধরিয়ে দিতে পাঁচ হাজার টাকা করে পুরস্কার ঘোষণা করে।
২২ এপ্রিল সকালে বিপ্লবীরা যখন জালালাবাদ পাহাড়ে বসে বিশ্রাম নিচ্ছিলেন তখন কয়েকজন কাঠুরিয়া ওই পাহাড়ে জ্বালানি কাঠ সংগ্রহ করতে যায়। খাকি পোশাকে রাইফেলধারী কিছু যুবককে সেখানে দেখে তারা দ্রুত লোকালয়ে ফিরে গিয়ে লোকজনের কাছে বলে দেয়, স্বদেশীরা ওই পাহাড়ে আছে। এই খবর পুলিশের কাছে পৌছার পর সেনাবাহিনীর সশস্ত্র রেল গাড়ি জালালাবাদ পাহাড়ের কাছে এসে থামে।
জালালাবাদ পাহাড়ে তখন বিপ্লবীরা কেউ রাইফেল পরিষ্কার করছে কেউ বা ভবিষ্যৎ কর্মপন্থা নিয়ে আলোচনায় ব্যস্ত। গাছের ডালে পাহারারত বিপ্লবীরা দেখতে পায় সামরিক ট্রেনটি কোন স্টেশন না থাকা সত্ত্বেও অদূরে রেললাইনের উপর থেমে গেল। ঝোপের আড়াল থেকে বিপ্লবীদের ছোঁড়া হঠাৎ গুলির আঘাতে সৈন্যদল বিভ্রান্ত হয়ে পিছিয়ে যেতে থাকে। সৈন্যরা এরপর জালালাবাদ পাহাড়ের পূর্ব দিকে ছোট্ট একটি পাহাড়ের উপর লুইসগান বসিয়ে বিপ্লবীদের দিকে গুলিবর্ষণ করে। দেশপ্রেম আর আত্মদানের গভীর আগ্রহে তরুণ বিপ্লবীরা পাহাড়ের বুকের উপর শুয়ে সৈন্যদের লুইসগানের গুলিবর্ষণের জবাব দিচ্ছিলেন। তিন প্রধান নেতা সূর্যসেন, নির্মল সেন এবং অম্বিকা চক্রবর্তী সঙ্গে থেকে ঘন ঘন তাঁদের উৎসাহিত করছেন, গুলি এগিয়ে দিচ্ছেন। জীবিত বিপ্লবীরা শহীদদের মৃতদেহ পাশাপাশি শুইয়ে রেখে সামরিক কায়দায় শেষ অভিবাদন জানায়। পাহাড়ে সুর্যসেনের নেতৃত্বে কয়েকশ পুলিশ আর সেনা বাহিনীর সাথে বিপ্লবীদের সম্মুখযুদ্ধ হয়। যুদ্ধে ব্রিটিশ বাহিনীর ৮০ জন এবং বিপ্লবী বাহিনীর ১২ জন বিপ্লবী শহীদ হন। যুদ্ধের এক পর্যায়ে ব্রিটিশ বাহিনী পালিয়ে যেতে বাধ্য হয়।
১৯৩০ সালের ১ ও ২ সেপ্টেম্বর কলকাতার নিকটবর্তী চন্দন নগরের ফরাসি কলোনিতে অবস্থিত বিপ্লবীদের ঘাঁটিতে পুলিশ হানা দেয়। পুলিশী হামলায় শহীদ হন জীবন লাল ঘোষ। আর গ্রেফতার হন গণেশ ঘোষ, লোকনাথ বল ও আনন্দ গুপ্ত। সূর্যসেনকে ধরার জন্য ইংরেজ সরকার প্রচুর টাকা পুরস্কার ঘোষণা করে। এ সময় তাঁকে বেশ কিছু দিনের জন্য আত্মগোপনে থাকতে হয়। ১৯৩১ সাল জুড়ে আত্মগোপনে থাকেন তিনি।
১৯৩২ সালের ১৩ জুন। পটিয়ার ধলঘাটে সাবিত্রী দেবীর বাড়িতে বিপ্লবীরা মিলিত হলেন এক গোপন বৈঠকে। হঠাৎ ক্যাপ্টেন ক্যামেরনের নেতৃত্বে একদল ইংরেজ সিপাহী সেখানে হানা দিল। তারা বাড়িটি ঘিরে ফেলল। ব্রিটিশ সৈন্যদের ঠেকিয়ে রাখার দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে শহীদ হন নির্মল সেন ও অপূর্ব সেন (ভোলা)। ক্যাপ্টেন ক্যামেরনও নিহত হলেন বিপ্লবীদের হাতে।
১৯৩৩ সালের ১৬ ফেব্রুয়ারি চট্টগ্রাম থেকে ১০ মাইল দূরে পটিয়া থানার গৈরিলা গ্রামের ক্ষীরোদপ্রভা বিশ্বাসের বাড়িতে সূর্যসেন আত্মগোপন করে ছিলেন। তাঁর সঙ্গে ছিলেন ব্রজেন সেন, কল্পনা দত্ত ও মনি দত্ত। নগেন সেন নামের এক বিশ্বাসঘাতক এ খবর পৌঁছে দিল ব্রিটিশ পুলিশের কাছে। পুলিশ-বাহিনী বাড়িটি ঘিরে ফেলে। শুরু হয় লড়াই। অবশেষে পুলিশ গ্রেফতার করে মাস্টারদা ও ব্রজেন সেনকে। কল্পনা দত্ত ও মনি দত্ত পুলিশের বেষ্টনী ভেদ করে পালিয়ে যেতে সক্ষম হলেন। গ্রেফতারের পর মাস্টারদা ও ব্রজেন সেনের ওপর চালানো হয় বর্বর অত্যাচার। হাত-পা শিকলে বেঁধে মাস্টারদাকে তারা নিয়ে যায় চট্টগ্রামে। ২০ ফেব্রুয়ারি তাঁদেরকে জেলে পাঠানো হয়। ব্রিটিশ শাসক মাস্টারদার ফাঁসির হুকুম জারি করে।
১৯৩৪ সালের ১২ জানুয়ারি। বিপ্লবী মাস্টারদা সূর্যসেন হাসি মুখে ফাঁসির রজ্জুতে জীবন বিসর্জন দেন।
তথ্য ও ছবিসূত্র:
১। প্রথম দিনের সূর্যসেন: শামসুল আলম সাঈদ, সাহিত্য প্রকাশ-জানুয়ারি ২০০৩।
২। স্বাধীনতা সংগ্রামে চট্টগ্রাম: পূর্ণেন্দু দস্তিদার,প্রকাশকাল ১৩৭৪ বাংলা, প্রকাশক: চট্টগ্রাম বই ঘর
৩। স্বাধীনতা সংগ্রামে সশস্ত্র বিপ্লবীদের ভূমিকা: সুধাংশু দাশগুপ্ত, প্রকাশকাল ১৯৯০ সাল, কলকাতা
৪। অবিস্মরণীয় চট্টগ্রাম যুববিদ্রোহ এবং মহানায়ক মাস্টারদা সূর্যসেন: আবু নাঈম, ‘সামহোয়ারইন’ ব্লগে ধারাবাহিকভাবে ২০০৯ সালে প্রকাশিত হয়।
৫। সূর্যসেন স্মৃতি: বিপ্লবতীর্থ চট্টগ্রাম স্মৃতিসংস্থা, কলকাতা।
৬। বসুমতী, ১৫ আগস্ট ১৯৪৭; উদ্ধৃত : সংবাদপত্রে উপমহাদেশের স্বাধীনতা, আতোয়ার রহমান, বাংলা একাডেমী
লেখক : রফিকুল ইসলাম (শেখ রফিক)