সুভাষ চন্দ্র বসু খুব মেধাবী ছাত্র ছিলেন। সকলেই আশা করেন যে প্রবেশিকা পরীক্ষায় তিনি একটি বিশেষ স্থান অধিকার করবেন। কিন্তু পরীক্ষা শুরু হওয়ার কিছুদিন আগে থেকে তিনি পড়াশুনায় অমনোযোগী হয়ে পড়েন। ফলে পরীক্ষার ফলাফলের ব্যাপারে তাঁর পরিবারের সবাই খুব হতাশ হন। সুভাষচন্দ্র বসু তখন পরীক্ষার ফলাফলের চেয়ে শ্রীরামকৃষ্ণের বাণী- জীব শিব এবং স্বামী বিবেকানন্দের বাণী- সেবা ধর্মকেই তাঁর জীবনের সার বলে গ্রহণ করেছেন।
১৯১৩ সালে তিনি প্রবেশিকা পরীক্ষা দিলেন। কিন্তু সবার ধারণাকে ভুল প্রমাণিত করে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের সকল ছাত্র-ছাত্রীদের মধ্যে দ্বিতীয় স্থান অধিকার করলেন। সবাই তাঁর ভাল ফলাফলে খুব খুশি হলেন। ভাল ফলাফলের কারণে তিনি কুড়ি টাকা বৃত্তি পেলেন। কিন্তু এই বৃত্তির টাকা তিনি নিজে খরচ না করে দীন দুঃখীর সেবায় দান করলেন।
প্রবেশিকা পরীক্ষার পর নেতাজী তাঁর মাকে একটি চিঠি লিখেন। সেই চিঠির শেষের অংশটিতে তিনি লিখেন-“আমি যদি না পড়িয়া এ স্থান পাই তবে যাহারা লেখাপড়াকে উপাস্য দেবতা মনে করিয়া তজ্জন্য প্রাণপাত করে তাহাদের কি অবস্থা হয়? তবে প্রথম হই আর লাষ্ট হই আমি স্থিররূপে বুঝিয়াছি লেখাপড়া ছাত্রের উদ্দেশ্য নহে- বিশ্ববিদ্যালয়ের ‘চাপ্রাস’ (ডিগ্রী) পাইলে ছাত্ররা আপনাকে কৃতার্থ মনে করে কিন্তু বিশ্ববিদ্যালয়ের ‘চাপ্রাস’ (ডিগ্রী) পাইলে যদি কেহ প্রকৃত জ্ঞান না লাভ করিতে পারে- তবে সে শিক্ষাকে আমি ঘৃণা করি। তাহা অপেক্ষা মূর্খ থাকা কি ভাল নয়? চরিত্র গঠনই ছাত্রের প্রধান কর্ত্তব্য- বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা চরিত্র গঠনকে সাহায্য করে-আর কার কিরূপ উন্নত চরিত্র তাহা কার্য্যেই বুঝিতে পারা যায়। কার্য্যই জ্ঞানের পরিচায়ক। বই পড়া বিদ্যাকে আমি সর্বান্তকরণে ঘৃণা করি। আমি চাই চরিত্র-জ্ঞান-কার্য। এই চরিত্রের ভিতরে সবই যায়- ভগবদ্ভক্তি,- স্বদেশপ্রেম,- ভগবানের জন্য তীব্র ব্যাকুলতা সবই যায়। বই পড়া বিদ্যা তো তুচ্ছ সামান্য জিনিষ- কিন্তু হায় কত লোকে তাহা লইয়া কত অহঙ্কার করে।” (সুধীরকুমার মিত্র বিরচিত ‘বাংলার পাঁচ স্মরণীয় বিপ্লবী’: সম্পাদনা-দেবপ্রসাদ জানা, পৃষ্ঠা-২৬১)।
মায়ের কাছে লেখা চিঠির কথাগুলোকে তিনি তাঁর নিজের জীবনের ক্ষেত্রে অক্ষরে অক্ষরে পালন করেছেন। আর তাইতো পড়াশুনার মাধ্যমে তিনি প্রকৃত জ্ঞান লাভ করেছেন। শুধু নিজের স্বার্থের কথা চিন্তা না করে দেশ ও মানুষের কথা চিন্তা করেছেন সবসময়। মানুষের দুঃখ, কষ্টগুলোকে তিনি অনেক বড় করে দেখেছেন। আর সেকারণেই ব্রিটিশদের শোষণ ও নির্যাতন থেকে দেশ ও দেশের মানুষকে মুক্ত করার জন্য আজীবন লড়াই-সংগ্রাম করেছেন। ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদকে ভারতবর্ষ থেকে বিতাড়িত করার জন্য যে সকল মহান ব্যক্তি, বিপ্লবী, লড়াকু যোদ্ধা জীবন উৎসর্গ করেছেন, নেতাজী সুভাষ চন্দ্র বসু তাঁদের মধ্যে অন্যতম।
অহিংসায় নয়, উদারতায় নয়, শক্তি প্রয়োগ করেই ব্রিটিশকে ভারত থেকে তাড়াতে হবে- এই মন্ত্রকে ধারণ করে তিনি ব্রিটিশ শাসন-শোষণের বিরুদ্ধে আমৃত্যু লড়াই-সংগ্রাম চালিয়েছেন । ভারতের যুব সম্প্রদায়কে নেতাজী বলেছিলেন “তোমরা আমাকে রক্ত দাও, আমি তোমাদের স্বাধীনতা দেব”। ভারত উপমহাদেশে সশস্ত্র বিপ্লববাদীদের সংগঠক হিসেবেও তিনি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন। যে কারণে বিপ্লবী যোদ্ধারা তাঁকে নেতাজী বলে সম্বোধন করতেন। তিনি এ উপমহাদেশের স্বাধিকার আন্দোলনেরও অন্যতম প্রবক্তা ছিলেন।
নেতাজী সুভাষ চন্দ্র বসু জন্মগ্রহণ করেন ১৮৯৭ সালের ২৩ জানুয়ারী। উড়িষ্যার কটক শহরে এক বাঙালি পরিবারে। তবে তাঁদের পৈতৃক নিবাস ছিল চব্বিশ পরগণা জেলার অন্তর্গত কোদালিয়া গ্রামে। নেতাজীর বাবা জানকীনাথ বসু। তিনি ঊনবিংশ শতাব্দীর শেষে বাংলা ছেড়ে কটকে চলে যান। সেখানে তিনি অইনজীবী হিসাবে কর্মজীবন শুরু করেন। এ পেশায় তিনি অল্পদিনের মধ্যে বিশেষ সুনাম অর্জন করেন। তিনি জ্ঞানী ও সুপণ্ডিত ব্যক্তি ছিলেন। তিনি কটক মিউনিসিপ্যালিটি ও কটক জেলা বোর্ডের সভাপতি ছিলেন। নেতাজীর মায়ের নাম প্রভাবতী দেবী। তিনি কলকাতার হাটখোলার প্রসিদ্ধ দত্ত পরিবারের মেয়ে ছিলেন। অভিজাত সমাজে তাঁদের বিশিষ্ট স্থান ছিল। তিনি ছিলেন গৃহিণী ও ধর্মপ্রাণ মানুষ। গরীব-দুঃখী মানুষের সেবা করা ছিল তাঁর সহজাত স্বভাব। নেতাজী ছিলেন বাবা-মার নবম সন্তান ও ষষ্ঠ পুত্র।
১৯০২ সালে পাঁচ বছর বয়সে সুভাষ চন্দ্র বসু খ্রীষ্টান পাদ্রীদের দ্বারা পরিচালিত কটক প্রোটেষ্ট্যান্ট ইউরোপীয়ান স্কুলে ভর্তি হন। এই স্কুলে তিনি ৭ বছর পড়াশুনা করেন। এই স্কুলে বাংলা ছাড়া অন্য সকল বিষয় পড়ানো হতো। ছেলেবেলা থেকে তিনি মেধাবী ও বুদ্ধিমান ছিলেন। এজন্য শিক্ষকরা তাঁকে খুব পছন্দ করতেন এবং ভালবাসতেন।
১৯০৮ সালে তিনি কটকের রাভ্যেনশ কলেজিয়েট স্কুলে চতুর্থ শ্রেণীতে ভর্তি হন। এই স্কুলে পড়ার সময় তিনি নিজ উদ্যোগে বাংলা ও সংস্কৃত ভাষা খুব ভাল করে শিখে নেন। পড়াশুনার পাশাপাশি তিনি নিয়মিত ব্যায়াম চর্চা করতেন। বাগানে তরিতরকারি ও ফুল গাছের প্রতি তাঁর খুব ঝোঁক ছিল। প্রতিদিন তিনি বাড়ির মালিদের সাথে গাছে পানি দিতেন। তিনি প্রকৃতির অপরূপ সৌন্দর্য দেখে মুগ্ধ হতেন।
এই সময় বেণীমাধব দাস নামক এক পণ্ডিত রাভ্যেনশ কলেজিয়েট স্কুলের প্রধান শিক্ষক ছিলেন। তাঁর সরল অমায়িক ব্যবহারের কারণে ছাত্ররা তাঁকে শ্রদ্ধা করত। এই শিক্ষকের প্রভাব সুভাষ চন্দ্রের উপর পড়ে। মা প্রভাবতী দেবী এবং শিক্ষক বেণীমাধব দাসের নৈতিক আদর্শ তাঁর জীবনকে সুন্দরভাবে গড়তে সহায়তা করে।
সুভাষ চন্দ্র বসুর বয়স যখন ১৩/১৪ বছর তখন তাঁদের এক আত্মীয় কটকে তাঁদের বাড়ীতে বেড়াতে আসেন। তিনি তাঁদের বাড়ীর নিকটেই থাকেন। নেতাজী একদিন তাঁর বাড়ীতে বেড়াতে যান এবং তাঁর ঘরে স্বামী বিবেকানন্দের অনেকগুলো বই দেখতে পান। তিনি স্বামীজীর বইগুলো তাঁর কাছ থেকে আনেন এবং পড়েন। এভাবে স্বামী বিবেকানন্দ ও তাঁর গুরুদেব শ্রীরামকৃষ্ণ পরমহংসদেবের প্রতি তিনি আকৃষ্ট হন। স্বামীজীর বক্তৃতা ও চিঠিপত্রগুলো তাঁকে বিশেষভাবে উদ্বুদ্ধ করে।
স্বামীজীর বক্তৃতাবলী ও শ্রীরামকৃষ্ণের উপদেশ পাঠ করার পর তিনি পড়াশোনায় অমনোযোগী হয়ে পড়েন। আধ্যাত্মিক উন্নতি করার জন্য যোগ অভ্যাস শুরু করেন। কয়েকজন বন্ধুকে নিয়ে দরিদ্রনারায়ণের সেবায়, রুগ্নের শুশ্রূষায় এবং দুঃস্থের দুঃখ মোচনে অধিকাংশ সময় ব্যয় করতেন। কি করে স্বামীজীর আদর্শকে তাঁর জীবনে সফল করবেন, ইহাই তখন নেতাজীর একমাত্র চিন্তা।
প্রবেশিকা পাশ করার পর তিনি কলকাতা প্রেসিডেন্সী কলেজে আই.এ ভর্তি হন। এই কলেজে পড়ার সময় তিনি স্বামী বিবেকানন্দের আদর্শ ও ধর্ম চর্চায় আরও বেশী মন দেন। আই.এ. পড়ার একপর্যায়ে মানব সেবার উদ্দেশ্যে তিনি গৃহ ত্যাগ করেন। এসময় তিনি ভারতবর্ষের বিভিন্ন তীর্থস্থান ঘুরে বেড়ান। কয়েক মাস পর বাড়িতে ফিরে আসেন। বাড়িতে আসার পর তিনি টাইফয়েডে আক্রান্ত হয়ে অনেক দিন ভোগেন। সুস্থ হওয়ার পর বার্ষিক পরীক্ষার পূর্বে তিনি পড়াশুনায় মনোযোগ দেন।
১৯১৫ সালে সুভাষ চন্দ্র বসু আই.এ. পরীক্ষায় মেধাস্থান অর্জন করে প্রথম বিভাগে উত্তীর্ণ হন। ওই বছরই তিনি দর্শনে অনার্স নিয়ে প্রেসিডেন্সী কলেজে বি.এ. ভর্তি হন। প্রেসিডেন্সি কলেজে পড়ার সময় অধ্যাপক ওটেন বাঙালী ছাত্রদের প্রতি অপমানজনক ব্যবহার করায় তিনি তাঁর ওপর খুব ক্ষিপ্ত হন এবং অধ্যাপক ওটেনকে প্রহার করেন। এই ঘটনার কারণে তাঁকে প্রেসিডেন্সী কলেজ থেকে বহিষ্কার করা হয়। ফলে বাধ্য হয়ে তাঁকে প্রেসিডেন্সি কলেজ পরিত্যাগ করতে হয়। কলেজ জীবন থেকেই তাঁর মধ্যে স্বদেশপ্রেম ও বাঙালী জাতীয়তাবোধ গভীরভাবে বিকশিত হতে থাকে।
অবশেষে স্যার আশুতোষ মুখোপাধ্যায়ের (স্কটিশ চার্চ কলেজের অধ্যক্ষ) সহযোগিতায় তিনি কলকাতার স্কটিশ চার্চ কলেজে ভর্তি হন। স্কটিশ চার্চ কলেজ থেকে ১৯১৯ সালে তিনি ডিস্টিংশনসহ দর্শন শাস্ত্রে অনার্স ডিগ্রী অর্জন করেন এবং ওই পরীক্ষায় কলেজে দ্বিতীয় স্থান অধিকার করেন। ১৯২০ সালে তিনি ইন্ডিয়ান সিভিল সার্ভিস এ-পরীক্ষা দেন এবং চতুর্থ স্থান অধিকার করেন। ওই বছর তিনি ইন্ডিয়ান সিভিল সার্ভিসে (আইসিএস) যোগ দেন। ১৯২১ সালের এপ্রিল মাসে তিনি ইন্ডিয়ান সিভিল সার্ভিস থেকে পদত্যাগ করে ভারতের জাতীয় কংগ্রেসে যোগদান করেন। ভারতকে ব্রিটিশদের হাত থেকে স্বাধীন করার জন্য তিনি সরকারি চাকুরি ত্যাগ করেন। ১৯২১ সালের ১০ ডিসেম্বর আইন অমান্য আন্দোলনের অভিযোগে চিত্তরঞ্জন দাস ও সুভাষ চন্দ্র বসুকে ব্রিটিশ পুলিশ গ্র্রেফতার করে। ১৯২২ সালে তিনি মুক্তি পান।
গান্ধীজির সাথে সাক্ষাতের মধ্য দিয়ে তাঁর রাজনৈতিক জীবন শুরু হয়। কিন্তু গান্ধীজির অহিংস আন্দোলনের প্রতি তাঁর কোনো আগ্রহ ছিল না। তাই গান্ধীজিকে ছেড়ে তিনি আসেন দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন দাশের নিকট। তাঁর সান্নিধ্যে থেকে তিনি নিজেকে রাজনীতিতে আরো পরিপক্ক করে গড়ে তোলেন। এরপর নেতাজী স্বাধীনতা সংগ্রামী চিত্তরঞ্জন দাসের সাথে রাজনীতি শুরু করেন। ১৯২৪ সালের এপ্রিল মাসে তিনি কলকাতা কর্পোরেশনের চিফ এগজিকিউটিভ অফিসার হিসাবে নিযুক্ত হন। চিত্তরঞ্জন দাস তখন কলকাতা কর্পোরেশনের মেয়র ছিলেন। সুভাষ চন্দ্র বসুর মাসিক বেতন ছিল ৩০০০ টাকা। কিন্তু তিনি সিদ্ধান্ত নেন মাসে ১৫০০ টাকা বেতন নিবেন। ওই বছর অক্টোবর মাসে নেতাজীকে স্বদেশী বিপ্লবীদের সাথে জড়িত থাকার অভিযোগে গ্রেফতার করা হয়। ব্রিটিশরা তাঁকে বার্মার কারাগারে পাঠিয়ে দেয়। ১৯২৫-২৭ সাল পর্যন্ত তিনি মান্দালয়সহ বিভিন্ন কারাগারে ছিলেন।
১৯২৭ সালে তিনি জেল থেকে মুক্তি পান। ১৯২৮ সালে কলকাতায় সর্বভারতীয় কংগ্রেসের সাধারণ অধিবেশন অনুষ্ঠিত হয়। এ সময় তিনি ‘বেঙ্গল ভলান্টিয়ার্স’ বাহিনী গড়ে তোলেন। যার চরিত্র ছিল সামরিক। ‘হিন্দুস্থান সেবক দল’ নামে আরেকটি বাহিনী সেসময় তৈরী হয়েছিল। কিন্তু সে দলের সাথে এ দলের পার্থক্য হল ‘বেঙ্গল ভলান্টিয়ার্স’ বাহিনীতে নারী ও পুরুষ বিপ্লবী ছিল। ‘বেঙ্গল ভলান্টিয়ার্স’ বাহিনীকে সামরিক মানসিকতায় শিক্ষা প্রদান করা হয় এবং এ বাহিনীর প্রতিটি সদস্যকে স্বাধীনতার জন্য যে কোনো ত্যাগ স্বীকারে মানসিক ভাবে প্রস্তুত করা হয়। পরবর্তী কালে আজাদ হিন্দ ফৌজ গড়ার ক্ষেত্রে নেতাজী এই ‘বেঙ্গল ভলান্টিয়ার্স’ বাহিনী থেকে প্রেরণা পান। ১৯২৯ সালে পাকিস্তানের লাহোরে অনুষ্ঠিত কংগ্রেসে তিনি ও বিপ্লবীরা ব্রিটিশ সরকারের পাশাপাশি একটি প্যরালাল সরকার গঠন করার প্রস্তাব করেন।
১৯৩০ সালের ২৩ জানুয়ারি ব্রিটিশ আইনের বিরুদ্ধে এক পদযাত্রায় প্রধান ভূমিকা পালন করার জন্য তাঁকে আবার আটক করা হয়। ওই বছর জেল থেকে বেরিয়ে ২৫ সেপ্টেম্বর তিনি কলকাতার মেয়র হিসাবে নিযুক্ত হন। মেয়র নির্বাচিত হওয়ার পর তিনি স্বাধীনতা আন্দোলনের মহিরুহ হিসেবে আত্মপ্রকাশ করেন। ১৯৩১ সালে নেতাজীর নেতৃত্বে কলকাতায় শোভাযাত্রা চলাকালে ব্রিটিশ পুলিশ তাঁকে আবার গ্রেফতার করে। এসময় তিনি ৬ মাস পর মুক্তি পান। মুক্তির পরও বিপ্লববাদী সশস্ত্র আন্দোলনের জন্য ব্রিটিশ সরকার নেতাজীকে তাঁর বাড়িতে নজর বন্দি করে রাখে। ১৯৩২ সালে তিনি আইন অমান্য আন্দোলনের নেতৃত্ব প্রদানের মাধ্যমে ওই আন্দোলনের পুরোধা ব্যক্তি হয়ে উঠেন। এসময় তাঁকে আবার ব্রিটিশ সরকার কারাগারে প্রেরণ করে। কিন্তু জনতার আন্দোলনের মুখে ব্রিটিশ সরকার তাঁকে ছেড়ে দিতে বাধ্য হয়। বারবার কারা নির্যাতনের কারণে তিনি অসুস্থ হয়ে পড়েন।
১৯৩৩ সালের মাঝামাঝি সময় তিনি ব্রিটিশ সরকারের চোখে ধুলো দিয়ে ইউরোপে চলে যান। ১৯৩৩ থেকে ১৯৩৬ সাল পর্যন্ত তিনি ইউরোপের বহু রাজনৈতিক নেতা ও মহান ব্যক্তিদের সংস্পর্শে আসেন। কারণ তিনি উপলব্ধি করেন, ভারতমাতাকে ব্রিটিশ সরকারের হাত থেকে স্বাধীন করতে হলে বাইরের দেশের সেনা ও রাজনৈতিক নেতাদের সহযোগিতা দরকার হবে। এ সময় তিনি সমগ্র ইউরোপ ঘুড়ে বেড়ান এবং ভারতের স্বাধীনতার জন্য তীব্র প্রচার চালান।
তিনি ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে প্রাগে, বার্লিনে, মিউনিখে, মিলানে ও রোমে সভা সমাবেশ করেন। ভারতের স্বাধীনতার পক্ষে বিশ্বজনমত সংগ্রহ করেন এবং ভারতীয়দের সংগঠিত করেন। ১৯৩৬ সালের ৮ এপ্রিল দেশে আসার পর ব্রিটিশ সরকার তাঁকে আবার গ্রেফতার করে। এই গ্রেফতারের প্রতিবাদে নিখিল ভারত ‘সুভাষ দিবস’ পালন করে। ১৯৩৭ সালে তিনি মুক্তি পান। ওই বছর তিনি তাঁর ব্যক্তিগত সচিব এমিলিকে সহধর্মীনী করেন। ১৯৪২ সালে তাঁদের কন্যা সন্তান অনিতার জন্ম হয়।
১৯৩৮ সালে ভারতবাসী তাঁকে কংগ্রেসের প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত করেন। ১৯৩৯ সালে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শুরু হলে সুভাষ চন্দ্র বসু গান্ধীজীর অহিংস নীতির বিরোধিতা করে ইংরেজ সরকারকে ৬ মাসের মধ্যে স্বাধীনতা প্রদানের জন্য এক চরমপত্র পাঠানোর প্রস্তাব করেন। কিন্তু জাতীয় কংগ্রেস সহিংস সংগ্রাম শুরু করার পক্ষে ছিলেন না। গান্ধীজী ওই বিপদের সময় ইংরেজ সরকারকে বিব্রত করতে চাননি। এ প্রশ্নে তীব্র মতবিরোধ দেখা দিলে সুভাষ বসু পদত্যাগ করতে বাধ্য হন এবং তিনি ‘ফরওয়ার্ড ব্লক’ নামে আরেকটি দল গঠন করেন। কলকাতায় প্রবল জনমত সৃষ্টি করলে ইংরেজ সরকার ভীত হয়ে ১৯৪০ সালের ২ জুলাই নেতাজিকে গ্রেফতার করে এবং কলকাতার প্রেসিডেন্সি জেলে তাঁকে আটকে রাখে। ১৯৪১ সালের জানুয়ারি মাসে তিনি গৃহবন্দি অবস্থায় পলায়ন করে আফগানিস্তান হয়ে রাশিয়ার পথে যাত্রা করেন। সেখানে তিনি ভারতের স্বাধীনতার জন্য সোভিয়েত শক্তির সমর্থন চান। কিন্তু স্টালিন সুভাষ চন্দ্র বসুর আবেদন প্রত্যাখ্যান করেন।
দেশে ফিরে সুভাষ বসু সরকারি গোয়েন্দাদের নজরদারি এড়ানোর জন্য মৌনব্রত ও নির্জনবাসের ঘোষণা দেন ও তাঁর ভাতিজা অমিয় বোসের অনুমোদন ছাড়া কারো সঙ্গে দেখা করতেন না। ওই সুযোগে তিনি মৌলভী জিয়াউদ্দীনের মতো দাড়ি রাখেন ও তাঁর মতোই পোশাক পরে গোয়েন্দাদের চোখ ফাঁকি দিয়ে ১৯৪১ সালের ২৮ মার্চ পালিয়ে আফগানিস্তান ও মস্কো হয়ে জার্মানির বার্লিন পৌঁছেন। তিনি জার্মান থেকে সাবমেরিনযোগে জাপান পৌঁছেন। জাপান-অধিকৃত সিঙ্গাপুরে রাসবিহারী বসুর তত্ত্বাবধানে ভারতীয় উপমহাদেশের যুদ্ধবন্দীদের নিয়ে ‘আজাদ- হিন্দু ফৌজ’ গঠন করেন এবং এর সর্বাধিনায়ক হন।
১৯৪২ সালে ব্রিটিশ সরকার ‘ফরওয়ার্ড ব্লক’ দলকে বেআইনি ঘোষণা করে। সমগ্র ভারত জুড়ে ‘ফরওয়ার্ড ব্লক’ দলের সব পার্টি অফিস বন্ধ করে দেওয়া হয়। ১৯৪৩ সালে নেতাজি জাপানে যান। ১৯৪৩ সালের ৪-৭ জুলাই সিঙ্গাপুরস্থ মহাএশিয়া মিলনায়তনে ভারতীয় স্বাধীনতা লীগের প্রধান নেতৃবৃন্দের মহাসভা অনুষ্ঠিত হয়। প্রেসিডেন্ট বিপ্লবী রাসবিহারী বসু দাঁড়িয়ে সভায় একজন চমৎকার নতুন অতিথি হিসেবে সুভাষচন্দ্র বসুকে পরিচয় করিয়ে দেন। সেই সঙ্গে লীগের নতুন প্রেসিডেন্ট হিসেবে সুভাষ বসুকে স্থলাভিষিক্ত করার জন্য নিজের ইচ্ছের কথা ব্যক্ত করেন। তিনি বলেন, “ইতিমধ্যে টোকিওতে আমাদের মধ্যে বিস্তারিত আলোচনা হয়েছে এবং তিনি দায়িত্ব গ্রহণে সম্মত হয়েছেন।” শারীরিক অসুস্থতা এবং বার্ধক্যজনিত কারণে বর্তমান পদ তাঁর পক্ষে ধরে রাখা সম্ভব হচ্ছে না বলে জানান রাসবিহারী বসু । এরপর সভার সকল নেতৃবৃন্দ এবং সদস্য প্রাণবন্ত করতালি দিয়ে সুভাষ বসুকে স্বাগত জানান। রাসবিহারী বসু প্রবাসে ভারতীয় স্বাধীনতা আন্দোলনের সম্মানিত পরিচালক নির্বাচিত হওয়ার কারণে সুভাষ বসুকে ‘নেতাজি’ উপাধি ঘোষণা করেন। রাসবিহারী বসুর প্রতি কৃতজ্ঞতা জানিয়ে এই মহাসভায় সুভাষ চন্দ্র বসু দু’ঘন্টাব্যাপী এক জ্বালাময়ী বক্তৃতা দেন।
১৯৪৪ সালের ২১ মার্চ ‘আজাদ হিন্দ ফৌজ’ ভারতভূমির মনিপুরে প্রবেশ করে। এই ফৌজের কার্যাবলী খুব দ্রুত ভারতব্যাপি ছড়িয়ে পড়ে। কিন্তু জাপান ১৯৪৫ সালের শুরুতে ‘আজাদ হিন্দ ফৌজ’কে সহযোগিতা করার যে প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল তা প্রত্যাখান করে নেয়।
১৯৪৫ সালে ১৫ আগস্ট দ্বিতীয় মহাযুদ্ধ শেষ হয়েছে কিন্তু ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলন তখনও চূড়ান্ত পর্যায়ে। নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসু হিন্দ ফৌজকে ভেঙ্গে দিয়ে অদৃশ্য হয়ে যান । কেউ জানে না কোথায় আছেন তিনি। তন্ন তন্ন করে খুঁজছে তাঁকে বৃটিশ সরকার। এ সময় কর্নেল ভোঁসলে ঘোষণা করেন, নেতাজি না থাকলেও, জাপানিরা হেরে গেলেও ‘আজাদ হিন্দ ফৌজ’ শেষ রক্তবিন্দু পর্যন্ত লড়াই করে যাবে। কয়েক হাজার ভারতীয় সেনা নিহত হওয়ার পরও কোহিমা পর্যন্ত অগ্রসর হয়েছিল আজাদ হিন্দ বাহিনীর কোনো কোনো দল। বৃটিশদের আর কোনো শক্তি ছিল না ভারতীয়দেরকে দাবিয়ে রাখার। শেষ পর্যন্ত ১৯৪৭ সালে বৃটিশ শাসক পাক-ভারত ভাগের মধ্য দিয়ে লেজ গুটায়। অর্জিত হয় বহুকাঙ্খিত ভারতের স্বাধীনতা, যে স্বাধীনতার জন্য নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসুসহ অসংখ্য বিপ্লবী জীবন বিপন্ন করে লড়াই- সংগ্রাম করেছেন।
ধারণা করা হয় নেতাজী সুভাষ চন্দ্র বসু ১৯৪৫ সালের ১৯ আগষ্ট টোকিও যাবার পথে তাইওয়ানে এক বিমান দুর্ঘটনায় নিহত হন। তবে তাঁর মৃত্যুর সঠিক তারিখ ও স্থান সম্পর্কে এখনো বিতর্ক রয়েছে। তাঁর দেহাবশেষ কোনোদিনও উদ্ধার করা যায়নি।
তথ্য ও ছবিসূত্র:
১। বাংলার পাঁচ স্মরণীয় বিপ্লবী: সম্পাদনা-দেবপ্রসাদ জানা, দীপ প্রকাশন- কলকাতা। প্রকাশকাল ৫ জানুয়ার ২০০৮ সাল।
২। আমি সুভাষ বলছি: শ্রীশৈলেশ দে। রবীন্দ্র লাইব্রেরী, কলকাতা। প্রকাশকাল- রথযাত্রা-১৩৮১ প্রথম খন্ড, রথযাত্রা -দ্বিতীয় খণ্ড ১৩৮৪, রথযাত্রা -তৃতীয় খণ্ড ১৩৮৯।
৩। বাংলা ছোটদের সুভাষ চন্দ্র: কালীপদ দাস। সাহিত্যমালা প্রকাশনী। প্রকাশকাল ১৯৯৫ সাল।
৪। আধুনিক ভারত: প্রণবকুমার চট্টোপাধ্যায়। দ্বিতীয় খণ্ড (১৯২০- ১৯৪৭) পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য পুস্তক পর্ষৎ, কলকাতা, ১৯৯৯।
লেখক: রফিকুল ইসলাম (শেখ রফিক)