১৯০৫-০৬ সাল। বঙ্গভঙ্গ আন্দোলনে উদ্বেলিত সারা বাংলা। ঢাকা জেলার হাইস্কুলগুলোতে সেই আন্দোলনের ঢেউ উপচে পড়ছে। ছাত্ররা এই আন্দোলনে প্রভাবিত হচ্ছে। বালক সতীশ এই আন্দোলনে যুক্ত হলেন। চিনিসপুর কালীবাড়িতে হাজার হাজার মানুষ একসঙ্গে দাঁড়িয়ে শপথ নিলেন, ‘বঙ্গভঙ্গ রদ না হওয়া পর্যন্ত আমরা প্রতিরোধ আন্দোলন করে যাব। জীবন দিয়েও এর প্রতিবিধান করব। বিলাতি জিনিস বয়কট করব আর স্বদেশী জিনিস ব্যবহার করব।’
এই স্বদেশী আন্দোলনের সময় সতীশ বসু, ব্যারিস্টার পি মিত্র, পুলিন দাস প্রমুখ ‘অনুশীলন সমিতি’ নামে ঢাকায় একটি গুপ্ত বিপ্লবী সংগঠন গড়ে তোলেন। ১৯০৭ সালে বাংলায় ‘অনুশীলন সমিতি’র এবং মহারাষ্ট্র ও পাঞ্জাবে সশস্ত্র বিপ্লববাদী কার্যকলাপ শুরু হয়। শরীর চর্চা, ব্যায়াম, লাঠি খেলা, ছোঁড়া খেলা, কুস্তি ইত্যাদির আড়ালে রাজনৈতিক শিক্ষা, বিপ্লবাত্মক প্রচার ও বিপ্লবী কর্মী তৈরী করা হতো। উদ্দেশ্য ভারতমাতাকে ব্রিটিশসাম্রাজ্যের হাত থেকে মুক্ত করা।
সতীশ যখন সপ্তম শ্রেণীর ছাত্র তখন তাঁদের পাড়া গ্রামেও ‘অনুশীলন সমিতি’ গঠিত হয়। পূর্ণ স্বাধীনতা লাভই সমিতির উদ্দেশ্য। সতীশের স্কুলের প্রায় অর্ধেক ছাত্র ‘অনুশীলন সমিতি’র সভ্য। তাঁর উপরের ক্লাসের ছাত্র ত্রৈলক্য চক্রবর্তীর (যিনি পরবর্তীকালের বিখ্যাত বিপ্লবী) সংস্পর্শে সতীশ এই সমিতির সভ্য হন।
‘সমিতির উদ্দেশ্য সিদ্ধ না হওয়া পর্যন্ত এই সমিতি হতে বিচ্ছিন্ন হব না। সর্বদা সমিতির পরিচালকের আদেশ মানিয়া চলিব’। এই অগ্নি শপথ করলেন বালক সতীশ।
সতীশ জঙ্গলাকীর্ণ আম-কাঁঠাল ও বাঁশ বাগানে বন্ধুদের সঙ্গে লাঠিখেলা ও কুচকাওয়াজ করতেন। আর স্কুল ছুটির পরে অতি সংগোপনে নোট বইয়ে লিখে রাখা লাঠি খেলার সাংকেতিক ফরমূলা (সংকেতশব্দ) মুখস্থ করতেন। কিন্তু সেই লাঠি আসলে লাঠি নয়, তলোয়ার। আর বড় লাঠি হল বন্দুক ও বেয়নেট। প্রকাশ্যে লাঠি ও ছুরি খেলার পিছনে তলোয়ার ও বন্দুকের লড়াই প্রশিক্ষণ দেয়া হত।
ব্রিটিশ শাসনের কবল থেকে দেশমাতৃকাকে মুক্ত করার জন্য সতীশ পাকড়াশী স্কুলে পড়ার সময় থেকে এভাবেই বিপ্লবী কর্মকাণ্ডে যুক্ত হয়ে পড়েন এবং সারা জীবন বিপ্লবী কর্মযজ্ঞে নিয়েজিত ছিলেন। ক্ষমতালাভ বা কোনো প্রকার ব্যক্তিস্বার্থের ধ্যান-ধারণা তাঁর মধ্যে ছিল না। আদর্শের রাজনীতি বাস্তবায়নের জন্য কীভাবে লড়াই করতে হয় তার দৃষ্টান্ত স্থাপন করে গেছেন তিনি। এসব আন্দোলন সংগ্রামের কারণে তিনি বহু বছর জেলে কাটিয়েছেন এবং আত্ম গোপনে ছিলেন।
সতীশ পাকড়াশীর পুরো নাম সতীশ চন্দ্র পাকড়াশী। তিনি জন্মেছিলেন ১৮৯১ সালে। নরসিংদি জেলার মাধবদি গ্রামে। তাঁর বাবা জগদীশ চন্দ্র পাকড়াশী আর মা মৃণালিনী পাকড়াশী। পড়াশুনার হাতেখড়ি পরিবারে, বাবার কাছে। তারপর প্রাথমিক পড়াশুনা শেষে ঢাকার সাটিরপাড়া হাইস্কুলে ভর্তি হন।
এই স্কুলে পড়ার সময় কিশোর বয়সেই ঘর-বাড়ি ছেড়ে দেশমাতৃকার শৃঙ্খল মোচনের উদ্দেশ্যে সশস্ত্র সংগ্রামের বিপদ সঙ্কুল পথ বেছে নেন তিনি। ১৯১১ সালের মাঝামাঝি সময় ‘অনুশীলন সমিতি’র নেতা নরেন সেন প্রায় দশ মাইল দূর থেকে ৪৫০ বোরের রিভলবার, কার্তুজ নিয়ে আসার জন্য সতীশকে দায়িত্ব দেন। সেগুলো আনতে গিয়ে তিনি ধরা পড়ে যান। তখন তাঁর বয়স সতের বছর। এসময় তাঁর এক বছরের সশ্রম কারাদণ্ড হয়।
১৯১২ সালে জেল থেকে মুক্তি পেয়ে তিনি মাধবদিতে নিজ গ্রামের বাড়িতে আসেন। সেখান থেকে গুপ্ত সমিতি তাঁকে মাদারিপুর মহকুমায় বিপ্লবী সংগঠন গড়ে তোলার জন্য পাঠায়। তিনি পালং থানার ভড্ডাগ্রামের মধ্যে ইংরাজি স্কুলের শিক্ষকরূপে যোগদান করেন। এই স্কুলে চাকুরী নেওয়ার পিছনে তাঁর আসল উদ্দেশ্য ছিল গোপনে গোপনে বিপ্লবী দলে সদস্য যুক্ত করা। মাদারিপুর মহকুমায় বিপ্লবী সংগঠন গড়ে তোলার পর ১৯১৩ সালে তাঁকে ঢাকা থেকে নাটোরে পাঠানো হয়। সেখানেও তিনি বিপ্লবী সংগঠন গড়ে তোলেন। এরপর তাঁকে রংপুর জেলার কুড়িগ্রাম মহকুমার সংগঠকের দায়িত্ব দেয়া হয়। কুড়িগ্রাম থেকে তাঁকে কলকাতার সংগঠনের দায়িত্বে পাঠানো হয়।
১৯১৩ সালে রাজাবাজার বোমা মামলার ষড়যন্ত্রকারী হিসেবে তাঁর ও আরো কয়েকজন বিপ্লবীর নামে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি হয়। এসময় তাঁরা বরানগরে আশ্রয় নেন। এখানে আত্মগোপনকালে তিনি রাসবিহারী বসুর সান্নিধ্যে আসেন। এসময় তিনি বরানগরে গোপনে বিপ্লবী দলের সাথে মিলিত হন। ওই সময় তিনি খুব কষ্টে দিন কাটিয়েছেন। একটি রুটি কিনে খেয়ে সারাদিন কাটিয়েছেন। অনেক দিন না খেয়েও বিপ্লবী দলের কর্মকান্ড চালিয়েছেন। এসময় তিনি ম্যালেরিয়া জ্বরে আক্রান্ত হন। একটু সুস্থ হওয়ার পর তাঁকে দিনাজপুরের বিপ্লবী সংগঠনের কাজে পাঠানো হয়। ওই সময় অসুস্থ মহারাজ ত্রৈলক্য চক্রবর্তীর সাথে তিনি পুরী, ভুবনেশ্বরে যান এবং উভয়ে চিকিৎসা নেন। ভুবনেশ্বরে থাকার সময় ১৯১৪ সালের ৪ আগস্ট প্রথম বিশ্বযুদ্ধ শুরু হয়। এই সংবাদ শুনে তাঁরা সেখান থেকে দিনাজপুরে ফিরে আসেন। সতীশ পাকড়াশী উত্তরবঙ্গের দিনাজপুরে বিপ্লবী কাজ শুরু করেন। এরপর দিনাজপুর থেকে তাঁকে মালদহে দলের কাজে পাঠানো হয়।
১৯১৪ সালে বিপ্লবী দলের একটি ‘এ্যাকশন’-এ যোগদানের জন্য তিনি কলকাতা মুসলমানপাড়া লেনে যান। সেখানে সতীশ পাকড়াশীসহ বিপ্লবী দলের ৪/৫ জন সদস্য ২৫ নভেম্বর আইবি পুলিশের ডেপুটি সুপারিনটেনডেন্টকে হত্যা করার দায়িত্ব নেন। পরিকল্পনা অনুযায়ী সুপারিনটেনডেন্টের বৈঠকখানায় বোমা নিক্ষেপ করা হয়। কিন্তু একটু ভুলের কারণে তাঁদের নিক্ষিপ্ত বোমায় তাঁরা নিজেরাই আহত হন। সতীশ পাকড়াশী গুরুতরভাবে আহত হন। রাজশাহী সায়েন্স কলেজের ছাত্ররা তাঁকে তাঁদের হোস্টেলে আশ্রয় দেন এবং চিকিৎসার ব্যবস্থা করেন। তাঁর নামে ব্রিটিশ সরকার গ্রেপ্তারী পরোয়ানা জারি করে।
১৯১৫ সালে বিপ্লবী কাজকর্মের জন্য প্রচুর অর্থের প্রয়োজন দেখা দেয়। অর্থ সংগ্রহের জন্য বিভিন্ন স্থানে বিপ্লবীরা ডাকাতি করে অর্থ সংগ্রহের চেষ্টা চালায়। সতীশ পাকড়াশীসহ বিপ্লবী দলের সদস্যরা নাটোর মহকুমার ধারাইল গ্রামে ধনী সুদখোর মহাজনের বাড়ি থেকে ডাকাতি করে ২৫ হাজার টাকা সংগ্রহ করেন। এরপর স্বদেশীরা একে একে কলকাতার কর্পোরেশন স্ট্রিট, নদিয়ার শিবপুর, গ্রাগপুর, ত্রিপুরার হরিপুর ও বারতলা, ময়মনসিংহের চন্দ্রকাণা, রংপুরের কুরুল (১৯১৫), ত্রিপুরার গণ্ডোয়া ও নাটঘর, ফরিদপুরের ধাত্রুকটি, ময়মনসিংহের সাইদল (১৯১৬), ঢাকার আবদুল্লাপুর (১৯১৭), ত্রিপুরার ললিতেশ্বর (১৯১৬) সহ বিভিন্ন জায়গায় ডাকাতি সংগঠিত করে।
স্বদেশী ও সশস্ত্র বিপ্লববাদীদের দমন করার জন্য ১৯১৭ সালে হাজার হাজার যুবককে ইংরেজ সরকার ভারতরক্ষা আইনে গ্রেপ্তার করে। দেশব্যাপী খানাতল্লাসি ও গ্রেপ্তার চলতে থাকে অব্যাহতভাবে। উত্তরবঙ্গের গোপন ডেরা থেকে সতীশ পাকড়াশী ও তাঁর সঙ্গীরা আসামের গৌহাটিতে গোপন আস্তানা গড়ে তোলেন। গৌহাটি শহরের আটগাঁও ফ্যান্সিবাজারের গোপন আস্তানায় ও আরনক্যই পাহাড়ে তাঁরা বিভিন্ন দলে বিভক্ত হয়ে সাধারণ ব্যবসায়ীরূপে বাস করতে থাকেন। কিন্তু গোয়েন্দারা খবর পেয়ে যায়। সশস্ত্র পুলিশ বাহিনী বিপ্লবীদের বাড়ি ঘিরে ফেলে। পুলিশ ও বিপ্লবীদের মধ্যে খণ্ডযুদ্ধ শুরু হয়। পুলিশ ও বিপ্লবীদের গুলি ফুরিয়ে গেলে হাতাহাতি যুদ্ধ শুরু হয়। বিপ্লবীরা পিস্তলের বাট দিয়ে পুলিশদের আঘাত করে। ঐ সময় বিপ্লবী নলিনী বাগচী, সতীশ পাকড়াশী, প্রবোধ দাশগুপ্ত পুলিশ বেষ্টনি ভেদ করে সরে পড়তে সক্ষম হন। নলিনী বিহারে এবং সতীশ পাকড়াশী কলকাতায় ফিরে আসেন। সতীশ পাকড়াশী কলকাতায় আত্মগোপন অবস্থায় চার বছর অতিক্রান্ত করেন। নলিনী বাগচী বিহার থেকে কলকাতায় এলেন মহামারী রোগ বসন্তে আক্রান্ত হয়ে। মুমূর্ষু অবস্থায় নলিনী আশ্রয়হীন হয়ে কলকাতার গড়ের মাঠে ধুঁকছিলেন। সেসময় শহরের মধ্যস্থলে সুবিস্তীর্ণ গড়ের মাঠ ছিল বিপ্লবীদের আশ্রয়ভূমি। সতীশ পাকড়াশী নলিনী দাসকে সেখান থেকে উদ্ধার করে সুস্থ করে তোলেন এবং নলিনী দাস ঢাকার দলের দায়িত্বভার নিয়ে চলে আসেন। ১৯১৮ সালের জুন মাসে কলকাতা বাজারের সংঘর্ষে বিপ্লবী তারিনী মজুমদার নিহত হন এবং সশস্ত্র পুলিশের সাথে সম্মুখ যুদ্ধে মারাত্মক আহত হন নলিনী বাগচী। তিনি একদিন পরে মারা যান। অন্যদিকে ফেরারী বিপ্লবীরা কলকাতার বরানগরে বাড়ি ভাড়া করেন কিন্তু পুলিশের নজরে পড়ায় সতীশ পাকড়াশীসহ তাঁর সঙ্গীরা বাগবাজারের কুলি বস্তিতে মজুর সেজে বসবাস করেন। আত্মগোপনে থাকার পর সতীশ পাকড়াশী ১৯১৮ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে কলকাতা হাইকোর্টের সামনে ধরা পড়ে যান। তাঁকে গ্রেফতার করার পর ইলিসিয়াম রো স্পেশাল ব্রাঞ্চ অফিসে এনে নির্যাতন করা হয়। তাঁকে ৪/৫ দিন শুধু একটি চেয়ারে বসিয়ে রাখা হয় এবং তন্দ্রা এলেই চুলের মুঠি ধরে উল্টোদিকে হেঁচকা টান মারা হত। ইতর ভাষায় গালাগালি এবং বুকে বুটের লাথি মারা হয়। ১৯১৮ সালের মার্চ মাসে তাঁকে বিনা বিচারে প্রেসিডেন্সি জেলের চুয়াল্লিশ নম্বর সেলে আবদ্ধ রাখা হয়। তালাবদ্ধ নির্জন কক্ষে পড়াশুনা করার জন্য কোন আলো ছিল না। দেশমাতৃকার স্বাধীনতার চিন্তায় তাঁর সময় কেটেছে।
কিছুদিন পর তাঁকে রাজশাহী জেলে আনা হয়। ৩ বৎসর পর ১৯২১ সালের জানুয়ারিতে তিনি মুক্তি পান। মুক্তি পাওয়ার পর ১৯২১ সালে তিনি বরিশাল জেলা কংগ্রেসের কাজে যুক্ত হন। কিন্তু যখন অহিংস সংগ্রামে বিশ্বাস করার নীতি স্বীকার করে প্রতিজ্ঞাপত্রে সই করে স্বেচ্ছাসেবক হওয়ার জন্য নির্দেশ এল তিনি তখন কংগ্রেস ত্যাগ করেন। এই সময় বিপ্লবী পার্টিগুলো সাপ্তাহিক মুখপত্র প্রকাশ করে। ‘শঙ্খ’, ‘বিজল’, ‘স্বরাজ্য’, ‘সারথি’ পত্রিকাগুলো ছিল বিপ্লবীদের পরিচালিত প্রগতিশীল পত্রিকা। সতীশ পাকড়াশী তাঁদের পার্টির মুখপত্র ‘শঙ্খ’তে প্রায়ই প্রবন্ধ লিখতেন।
১৯২৩ সালে সোভিয়েত রাশিয়া থেকে আগত অবনী মুখার্জীর সাথে তাঁকে রাশিয়ায় পাঠানোর চেষ্টা করা হয়, কিন্তু তা ব্যর্থ হয়। ১৯২৩ সালের সেপ্টেম্বর মাসে তিনি আবার গ্রেপ্তার হন এবং স্টেট প্রিজনার হিসেবে পাঁচ বৎসর জেল খাটেন। এই সময় তিনি আলিপুর, মেদিনীপুর, ঢাকা, মহারাষ্ট্রের যারবেদা এবং কর্ণাটকের বেলগাঁও জেলে আটক থাকেন। জেলে বসে সতীশ পাকড়াশী ‘আয়ারল্যন্ডের স্বাধীনতা সংগ্রামের ইতিহাস’ লেখেন। কিন্তু পরবর্তীকালে বাড়িতে আগুন লেগে বইটির ৭০০ পৃষ্ঠার পাণ্ডুলিপি পুড়ে যায়। এছাড়া তাঁর বিখ্যাত রচনা ‘অগ্নিযুগের কথা’।
মেদিনীপুর জেলে থাকাকালীন তাঁর সাথে ছিলেন বিপ্লবী সূর্য সেন। জেল থেকে ছাড়া পেয়ে সতীশ পাকড়াশী ঢাকা জেলা স্বাধীনতা সংঘের সম্পাদক হন। তিনি, নিরঞ্জন সেন প্রমুখ ‘অনুশীলন সমিতি’তে ‘রিভোল্ট গ্রুপ’ বলে পরিচিত ছিলেন। রংপুরে প্রাদেশিক রাষ্ট্রীয় সম্মেলনে নিরঞ্জন সেন, সতীশ পাকড়াশী, অম্বিকা চক্রবর্তী, যতীন দাস, বিনয় রায় এই পাঁচ জন বিপ্লবী মিলে বিদ্রোহের ছক আঁকেন। স্থির হয় ঢাকা, কলকাতা ও চট্টগ্রামে তিনটি জায়গায় অস্ত্রাগার দখল করা হবে। একমাত্র চট্টগ্রাম অস্ত্রাগার দখলের অভ্যুত্থান সফল হয়। অন্য দুটি সংঘটিত করা যায়নি।
১৯২৯ সালের ১৯ ডিসেম্বর ২২/৩ মেছুয়া বাজার স্ট্রিটের বাড়িতে সতীশ পাকড়াশী, নিরঞ্জন সেন প্রমুখ বোমা বানাবার সাজ-সরঞ্জাম ও ফর্মুলাসহ ধরা পড়েন। সুধাংশু দাশগুপ্তও ওই বাড়িতে এসে ধরা পড়েন। মোট ৩২ জনের নামে ‘মেছুয়া বাজার ষড়যন্ত্র মামলা’ দায়ের করা হয়। নিরঞ্জন সেনগুপ্ত ও সতীশ পাকড়াশীর ৭ বৎসর, সুধাংশু দাশগুপ্তদের ৫ বৎসর সাজা হয়। আলিপুর জেলে তাঁদের উপর প্রচণ্ড নির্যাতন চালানো হয়। আলিপুর জেল থেকে সতীশ পাকড়াশীকে রাজশাহী জেলে এবং পরে হাজারিবাগ জেলে নিয়ে যাওয়া হয়। হাজারিবাগ জেল থেকে তাঁকে আন্দামান দ্বীপান্তরে পাঠানো হয়। হাতে হাতকড়া, পায়ে পাঁচ সের ওজনের বেড়ি পরে তিনি, নিরঞ্জন সেন ও ডাক্তার নারায়ণ রায় স্টিমারে আন্দামান সেলুলার জেলে পৌঁছেন।
আন্দামান সেলুলার জেল ছিল ব্রিটিশদের তৈরী করা দ্বিতীয় মৃত্যুকূপ। খোপ খোপ করা বিশাল এক কারাগার। দুর্ধর্ষ, সশস্ত্র বিপ্লববাদী বন্দীদের পিষে মারার জন্য এখানে পাঠানো হতো। ব্রিটিশ শাসকগোষ্ঠী ভারত উপমহাদেশের মানুষকে শাসন করার জন্য শুরু থেকেই নানারকমের দমননীতির আশ্রয় নেয়। এর মধ্যে জেলখানাগুলো ছিল তাদের এই দমননীতির প্রধান হাতিয়ার। আর আন্দামান সেলুলার জেল ছিল সবচেয়ে ভয়ংকর জেল। এক কথায় বলা যায়, মৃত্যুফাঁদ।
১৯৩৫ সালের ২৬ এপ্রিল সেলুলার জেলে কমিউনিস্ট কনসলিডেশন গঠিত হয়। ১ মে, মে দিবসের কর্মসূচিতে ওই কনসলিডেশনে ৩৫ জন যুক্ত হয়। ১৯৩৬ সালে সুধীন্দ্র রায় (খোকাদা), রবি নিয়োগীসহ আরো কয়েক জন দেশে ফিরে যান। কমিউনিস্ট কনসলিডেশন আন্দামান সেলুলার জেলের রাজবন্দীদের নিয়ে বিপ্লবী নিকেতন গড়ে তোলে। সেলুলার জেলকে বিপ্লবীদের বিশ্ববিদ্যালয়ে পরিণত করার জন্য শুরু হয় পড়াশুনা। সকাল ৯টা থেকে সাড়ে ১১টা পর্যন্ত এবং বেলা ১টা থেকে ৩টা ৩০ মিনিট পর্যন্ত পড়াশুনার নিয়মিত ক্লাস শুরু হয়। সমাজতন্ত্র- সাম্যবাদ, রাজনীতি, অর্থনীতি, সমাজবিজ্ঞান, ইতিহাস ও দর্শন বিষয়ে বিস্তারিত আলোচনা হয়। কার্ল মার্ক্সের সাম্যবাদের ইশতেহার, লেনিনের পার্টিতত্ত্ব, স্টালিনের লেখাসহ বিভিন্ন বিষয়ে বিপ্লবীরা জ্ঞান অর্জন করেন। স্টালিনের লেখা ‘লেনিনবাদের ভিত্তি’র উপর ক্লাস নিতেন নিরঞ্জন সেনগুপ্ত। আন্দামানে সতীশ পাকড়াশী কমিউনিস্ট কনসলিডেশনের সভ্য হন।
১৯৩৮ সালের ২৫ জুলাই আমরণ অনশন শুরু হয়। বার বার অনশন এবং প্রথম অনশনের জন্য ৩ জন বিপ্লবীর মৃত্যুর ফলে কিছু দাবিদাওয়া পূরণ হয়। বন্দীরা পড়াশুনার সুযোগ পেলেন। ‘বিপ্লবী বিশ্ববিদ্যালয়’ স্থাপন করে তাঁরা পড়াশুনায় গভীর মনোযোগ দেন। এই আমরণ অনশনে যুক্ত ছিলেন কমিউনিস্ট মতাদর্শের বিপ্লবীরা। এই অনশনের মূল দাবি ছিল আন্দামান সেসুলার জেলের সকল বন্দীকে দেশে ফিরিয়ে নিয়ে যেতে হবে এবং সকলকে নিঃশর্তভাবে মুক্তি দিতে হবে। এক পর্যায়ে এই অনশনে সকল বন্দীরা যোগ দেন।
অন্যদিকে অনশনকারীদের সমর্থনে ভারতব্যাপী উত্তাল আন্দোলন গড়ে ওঠে। এই আন্দোলনের নেতৃত্বে ছিল ‘যুগান্তর’, ‘অনুশীলন সমিতি’ ও কমিউনিস্ট নেতৃবৃন্দ। ফলে ১৯৩৮ সালের ১৯ জানুয়ারী ব্রিটিশ সরকার চাপের মুখে আন্দামান বন্দীদের দেশে ফিরিয়ে আনতে বাধ্য হয়। এই মৃত্যু ফাঁদের সকল সহযাত্রীর সাথে সতীশ পাকড়াশী একদিন দেশে ফিরে আসেন। ১৯৩৮ সালে মুক্তি পাওয়ার পর তিনি সরাসরি কমিউনিস্ট পার্টির সাথে যুক্ত হয়ে শোষণ-বৈষম্যহীন সমাজ প্রতিষ্ঠার লড়াই-সংগ্রামে নিজেকে নিয়োজিত করেন।
১৯৪১ সালে ঢাকায় ‘প্রগতি লেখক সংঘে’র শাখা স্থাপিত হয়। যাঁরা ‘প্রগতি লেখক সংঘে’র প্রয়োজন অনুভব করেছিলেন, তাঁদের মধ্যে সবচেয়ে তরুণ বয়সী ছিলেন সোমেন চন্দ, আর সবচেয়ে বয়োজ্যেষ্ঠ ছিলেন অগ্নিযুগের সতীশ পাকড়াশী।
পঞ্চাশের মন্বন্তরের (১৯৪৩ সাল) অনুষঙ্গ হিসেবে দেখা দেয় মহামারী। জেলার বিভিন্ন অঞ্চলে ব্যাপকভাবে ছড়িয়ে পড়ে বসন্ত রোগ। পীড়িতদের সেবায় আত্মনিয়োগ করেন সতীশ পাকড়াশী।
১৯৪৬ সালের মার্চ মাসে অবিভক্ত বাংলাদেশে অনুষ্ঠিত হয় সাধারণ নির্বাচন। এ নির্বাচনে তিনি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন।
১৯৪৭ সালে দেশ স্বাধীন হওয়ার পর কংগ্রেসী শাসকগোষ্ঠী কমিউনিষ্ট পার্টিকে নিষিদ্ধ ঘোষণা করে এবং অসংখ্য কমিউনিষ্ট নেতাকে গ্রেফতার করে বিনা বিচারে আটক রাখে। এই সময় সতীশ পাকড়াশীকেও আটক রাখা হয়। দু’বছর পরে জনগণের আন্দোলনের মুখে কংগ্রেস শাসকগোষ্ঠী এসমস্ত বন্দীদের মুক্তি দেয়। এসময় অন্যান্য নেতৃবৃন্দের সাথে সতীশ পাকড়াশী মুক্তি পান।
১৯৪৮ সালের ২২-২৯ ফেব্রুয়ারি কলকাতার মোহাম্মদ আলী পার্কে অনুষ্ঠিত হয় কমিউনিস্ট পার্টির দ্বিতীয় কংগ্রেস। এই কংগ্রেসে তিনি আত্মগোপন অবস্থায় কাজ করেন। ‘তেভাগা’র প্রস্তুতিপর্বে পার্টি ও কৃষক সমিতিকে সাহায্য করার উদ্দেশ্যে তিনি বাংলার বিভিন্ন অঞ্চলে কাজ করেছেন।
১৯৫০ সালে তিনি পার্টির সিদ্ধান্তে আত্মগোপনে চলে যান। আত্মোগোপনে থেকে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা মোকাবেলার জন্য আপ্রাণ চেষ্টা চালান। ১৯৫৪ সালে ২৪ পরগনা জেলায় ‘দুর্ভিক্ষ প্রতিরোধ কমিটি’ গঠিত হলে তিনি ঐ কমিটির কোষাধ্যক্ষ নির্বাচিত হন। এসময় তিনি উদ্বাস্তু সংগঠন ‘ইউসিআরসি’র সহ-সভাপতি ছিলেন। ১৯৬৪ সালে মার্কসবাদী কমিউনিস্ট পার্টির রাজ্য কমিটির সদস্য হন। তিনি ‘পিপলস রিলিফ কমিটি’র দায়িত্বও পালন করেন। তিনি আমৃত্যু ‘বাংলাদেশ শহীদ স্মৃতি কমিটি’র সভাপতি ছিলেন।
১৯৭৩ সালের ৩০ ডিসেম্বর কলকাতার এসএসকেএম হাসপাতালে ৮১ বছর বয়সে তিনি মৃত্যুবরণ করেন।
তথ্য ও ছবিসূত্র:
১। আমাদের পূর্বসূরিরা: সম্পাদক-তন্ময় ভট্টাচার্য। ন্যাশনাল বুক এজেন্সি প্রাইভেট লিমিটেড, কলকাতা। প্রকাশকাল, মার্চ ২০০৮।
২। ব্রিটিশবিরোধী বিপ্লবীদের জীবনকথা: তপন কুমার দে। জাগৃতি প্রকাশনী, আজিজ সুপার মার্কেট, শাহবাগ, ঢাকা। প্রকাশকাল ফেব্রুয়ারী ২০০৫।
৩। অগ্নিযুগের ইতিহাস: ব্রজেন্দ্রনাথ অর্জুন। প্রকাশক: মুক্তধারা। প্রকাশকাল; ডিসেম্বর ১৯৭৯।(ছবি)
৪। বাংলার বিপ্লব প্রচেষ্টা: হেমচন্দ্র কানুনগো। চিরায়ত প্রকাশনী, কলকাতা। প্রকাশকাল: জুন, ১৯২৮।
৫। স্বাধীনতা সংগ্রামে সশস্ত্র বিপ্লবীদের ভূমিকা: সুধাংশু দাশগুপ্ত, ন্যাশনাল বুকস এজেন্সি কলকাতা।
৬। বাংলার মুক্তি সন্ধানী: সব্যসাচী চট্টপাধ্যায় ও রাখী চট্টপাধ্যায়। প্রকাশকাল ২০০৫, কলকাতা।
লেখক: রফিকুল ইসলাম (শেখ রফিক)