সত্যেন সেনের একজন সঙ্গী ছিলেন, তাঁর নাম মাহাঙ্গু বানিয়া, যাঁর ডাক নাম বাউ। তাঁর আসল বাড়ি এলাহাবাদে। দুর্ভিক্ষের সময় সত্যেন সেনের ঠাকুমা তাঁকে কাশীতে কুড়িয়ে পেয়েছিলেন। সত্যেন সেনসহ তাঁর অন্য ভাই-বোনরা সবাই এই বাউ এর কোলেই মানুষ। তিনিই প্রথম সত্যেন সেনকে ছোটদের কথামালা ও সিন্দাবাদের গল্প শুনান। সত্যেন সেনের বড়ভাই জিতেন সেন কলেজে ভর্তি হওয়ার পর বাউ সত্যেন সেনের আরও কাছে চলে আসেন। পুরনো কথামালার গল্প তাঁর ভাল না লাগায় বাউ তাঁকে নতুন ধরনের গল্প শোনান। সেই সব গল্পের মধ্যে দিয়ে তাঁর চোখের সামনে ফুটে উঠে এক নতুন জগতের ছবি । বিস্ময়কর সেই সব কাহিনী। পশুপাখি, ভূত প্রেতের গল্প নয়, একেবারে সাহসী মানুষের গল্প। যাঁরা জীবন বাজি রেখে দেশের মুক্তির জন্য কাজ করেছেন। বাউ এর মুখে ক্ষুদিরাম, সত্যেন বসু, প্রফুল্ল চাকী, কানাইলাল, বালেশাবরের বনে বাঘা যতীন, যতীশ, নীরেন চিত্তপ্রিয়ের লড়াইয়ের রোমাঞ্চকর সেইসব কাহিনী শুনতে শুনতে খুব ছোটবেলা থেকেই ব্রিটিশদের প্রতি তাঁর খুব রাগ জন্ম নেয় আর বিপ্লবীদের প্রতি জন্ম নেয় শ্রদ্ধা। তাই বড় হয়ে তিনি ছেলেবেলায় শোনা সেইসব বিপ্লবীদের মতো ব্রিটিশদের শৃঙ্খল থেকে ভারত উপমহাদেশকে মুক্ত করার জন্য জীবন বাজি রেখে আন্দোলন সংগ্রাম করেন। এজন্য তাঁকে বছরের পর বছর কারাগারের অন্ধপ্রকোষ্ঠে কাটাতে হয়েছে। কিন্তু এরপরও তিনি পিছপা হননি। যতদিন বেঁচেছিলেন ততদিন অন্যায়ের বিরুদ্ধে আর গণমানুষের অধিকার আদায়ের লক্ষ্যে লড়াই-সংগ্রাম করেছেন।
বিপ্লবী সত্যেন সেনের জন্ম ১৯০৭ সালের ২৮ মার্চ মুন্সিগঞ্জ জেলার টঙ্গীবাড়ি থানাধীন সোনারং গ্রামের ঐতিহ্যবাহী বিখ্যাত সেন পরিবারে। বাড়ির নাম ছিল ‘শান্তি কুটির’। বাবা ধরণী মোহন সেন, মা মৃণালিনী সেন। এই দম্পতির দুই পুত্র ও দুই কন্যা। যথাক্রমে-ইন্দুবালা সেন, প্রতিভা সেন, জিতেন্দ্র মোহন সেন (শঙ্কর) ও সত্যেন সেন (লঙ্কর)। সত্যেন সেন ছিলেন বাবা-মার সর্ব কনিষ্ঠ সন্তান।
সোনারং গ্রামের এই পরিবারটি ছিল শিল্প-সাহিত্যের দিক থেকে খুবই প্রাগ্রসর। পরিবারে ছিল শিক্ষা-সংস্কৃতি চর্চার অবাধ পরিবেশ। এই পরিবারে ছিল বেশ কজন বিখ্যাত সাহিত্যিক। সত্যেন সেনের দাদা ক্ষিতিমোহন সেন ছিলেন বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর প্রতিষ্ঠিত শান্তিনিকেতনের অধ্যক্ষ। সত্যেন সেনের কাকা মদনমোহন সেন ছিলেন বিখ্যাত শিশু সাহিত্যিক। আরেক খুড়তুতো ভাই মুরারীমোহন সেন ছিলেন বিশিষ্ট কবি ও সাহিত্যিক। আপন দুই বোন ইন্দুবালা সেন ও প্রতিভা সেন উভয়েই সাহিত্য চর্চা ও লেখালেখির জগতের সাথে নিবিড়ভাবে জড়িত ছিলেন। বাড়ির আলমারিগুলো কাব্য, উপন্যাস ও জীবনীর বই এ ভরা ছিল।
সোনারং গ্রামের স্কুলে সত্যেন সেনের লেখাপড়ার শুরু। ১৯২১ সালে তিনি যখন অষ্টম শ্রেণীতে পড়েন তখন প্রথম টংগীবাড়িতে যান একটি রাজনৈতিক সভায়। বাউ তাঁকে নিয়ে যায় কংগ্রেসের সেই সভায়। সেদিনের সেই রাত্রিটি ছিল সত্যেন সেনের জীবনে খুবই তাৎপর্যপূর্ণ। বক্তার বজ্র আহ্বান তিনি যেন বারবার শুনতে পাচ্ছিলেন ঘর-ফিরতি পথে। এই সভা থেকে ফেরার কিছুদিন পরই তিনি কংগ্রেসের হয়ে কাজ শুরু করেন। ১৯২৪ সালে সত্যেন সেন সোনারং স্কুল থেকে মেট্রিক পাশ করেন। ইন্টারমিডিয়েট পড়ার জন্য চলে যান কলকাতায়। সেখানে যাওয়ার পর তিনি বিপ্লবী দল যুগান্তরের সাথে সক্রিয়ভাবে যুক্ত হয়ে পড়েন। তাঁদের দলের সংগঠক ছিলেন জীবন চ্যাটার্জি। স্বদেশী বিপ্লবী কাজে তাঁকে উৎসাহ যোগাতেন তাঁর মেজদি। তাঁর সাহিত্য চর্চাও শুরু হয় এই সময় থেকেই। এই সময় ‘নবশক্তি’ পত্রিকাতে তাঁর কিছু কবিতা ছাপা হয়।
কলেজে পড়ার সময় ১৯৩১ সালে তিনি প্রথম কারাভোগ করেন। তিন মাসের জেল হয় তাঁর। এই জেল জীবনই পাল্টে দেয় সত্যেন সেনের রাজনৈতিক ভাবনা। জেলখানার নিরিবিলি পরিবেশে পড়াশুনা করার ও সুস্থ মনে চিন্তা করার অবকাশ ও সুযোগ পেলেন তিনি। এর মধ্য দিয়েই সমাজতন্ত্রবাদের সঙ্গে পরিচয় ঘটল এবং তাকে আদর্শ বলে গণ্য করলেন তিনি।
বাংলায় তখন এক বিপ্লবী রাজনৈতিক পরিবর্তন চলছিল। বিশেষত রুশ বিপ্লবের প্রভাব তখন বিপ্লবীদের মধ্যে বেশ ভালভাবেই জেঁকে বসেছে। ফলে সশস্ত্র বিপ্লবীদের অনেকেই সশস্ত্র পথ ত্যাগ করে কমিউনিস্ট পার্টিতে নাম লিখিয়ে কৃষক-শ্রমিক আন্দোলন গড়ে তোলায় সচেষ্ট হন। এই অবস্থায় সত্যেন সেন কিছুদিন শান্তি নিকেতনে তাঁর বড়দা বীরেন সেনের বাড়িতে আত্মগোপন অবস্থায় কাটান। তাঁর মা বেরিবেরি রোগে আক্রান্ত হওয়ায় সত্যেন সেন আত্মগোপনে থাকা অবস্থায় মায়ের সেবা করেন। মায়ের অসুখের চিঠি গিয়ে পড়ে পুলিশের হাতে, পুলিশ ১৯৩২ সালে সত্যেন সেনকে কলকাতা থেকে দ্বিতীয়বারের মতো গ্রেফতার করে।
প্রথমে সত্যেন সেনকে কিছুদিন আলিপুর জেলে রাখা হয়। পরে পাঠিয়ে দেয়া হয় বহরমপুর জেলে। এবার তাঁকে একটানা পাঁচ বছর জেলের অন্ধকারে কাটাতে হয়। কিন্তু এই জেল জীবন ছিল সত্যেন সেনের জীবনের এক গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায়। প্রথম যখন তিনি জেলে ছিলেন তখন বি.এ. পাশ করেছিলেন। পরে ইতিহাসে এম.এ. করার প্রস্তুতি নেন কিন্তু জেলে ওই বিষয়ের বই না থাকায় তিনি বাংলায় এম.এ. পরীক্ষা দেন। জেলে থাকাকালীন সত্যেন সেনের মা মারা যান। ফলে তিনি সাজার মেয়াদ শেষ হবার আগেই তিনি জেল থেকে মুক্তি পান ১৯৩৮ সালে। শর্ত ছিল কাকা ক্ষিতিমোহন সেনের সাথে ভাষাতত্ত্বে গবেষণার কাজ করবেন। কিন্তু সত্যেন সেন গবেষণা না করে চলে এলেন নিজ গ্রাম সোনারং-এ। সেখানে প্রখ্যাত কৃষক নেতা জীতেন ঘোষের সাথে কৃষক আন্দোলন গড়ার কাজ শুরু করেন। পাশাপাশি কৃষক আন্দোলন গড়ে তোলার জন্য তিনি ঢাকা, রায়পুরা, নরসিংদী, মুন্সিগঞ্জ, বগুড়া, রংপুর ও দিনাজপুর প্রভৃতি অঞ্চলে কাজ করেন। এ প্রসঙ্গে সহযোদ্ধা জীতেন ঘোষ লিখেছেন, “সত্যেন সেন সারা বিক্রমপুর চষে বেড়াতেন। বিশ-পঁচিশ মাইল রাস্তা তিনি অনায়াসেই হেঁটে চলে যেতেন। তাঁর অমায়িক ও নিরহঙ্কার চরিত্র, নির্মল বন্ধুপ্রেমই তাঁকে বিক্রমপুরের কর্মীদের কাছে প্রিয় করে রেখেছে। তাঁর ত্যাগোদীপ্ত চরিত্র একমাত্র তাঁরই বৈশিষ্ট্য। মানবপ্রেম এবং গণশক্তিতে বিশ্বাসই তাঁর সমস্ত শক্তির উৎস।”
তবে সত্যেন সেন শুধু কৃষক আন্দোলনের সাথেই এসময় জড়িত ছিলেন না। তিনি একই সাথে ঢাকেশ্বরী কটন মিল, লক্ষীনারায়ণ কটন মিল, চিত্তরঞ্জন কটন মিল ও ঢাকা নারায়ণগঞ্জের বিভিন্ন পাটকলে ট্রেড ইউনিয়ন আন্দোলন গড়ে তোলেন এবং শ্রমিক শ্রেণীকে তাদের ন্যায্য মজুরি, দাবি-দাওয়া আদায়ের লক্ষ্যে সংগঠিত করার কাজে আত্মনিয়োগ করেন। এছাড়াও এই সময় তিনি জড়িত হয়ে পড়েন সাংস্কৃতিক আন্দোলনের সাথে।
১৯৪০ সালে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় প্রথম দিকে কমিউনিস্টরা এই যুদ্ধকে সাম্রাজ্যবাদী শক্তির যুদ্ধ হিসেবে আখ্যায়িত করেন। তখন কোনো ভারতীয় যেন যুদ্ধের প্রেক্ষাপটে ব্রিটিশ বাহিনীতে যোগ না দেয় সেকারণে তাঁরা শ্লোগান তোলে ‘নয় এক পাই,নয় এক ভাই’। এই শ্লোগান ব্রিটিশদের খুবই ক্ষিপ্ত করে তোলে। ব্রিটিশ সরকার সারাদেশে কমিউনিস্টদের গ্রেফতার করার এক আদেশ জারি করে। তখন খোকা রায় আত্মগোপনে চলে যান। কিন্তু নাৎসি জার্মানি যখন সোভিয়েত ইউনিয়ন আক্রমণ করে তখন যুদ্ধের পরিস্থিতি পুরো পাল্টে যায়। সোভিয়েত ইউনিয়ন, বৃটেন, ফ্রান্স মিলে জার্মান বাহিনীকে ঐক্যবদ্ধভাবে রুখার জন্য বিশ্ববাসীর প্রতি আহ্বান জানায়। তখন ভারতের কমিউনিস্ট পার্টি এই যুদ্ধকে ‘জনযুদ্ধ’ হিসেবে আখ্যা দিয়ে সোভিয়েত বাহিনীকে সহযোগিতার ঘোষণা দেয়। ফলশ্রুতিতে ভারতের কমিউনিস্ট পার্টির উপর থেকে ব্রিটিশ সরকার নিষেধাজ্ঞা উঠিয়ে নেয়। ১৯৪২ সালে ভারতীয় কমিউনিস্ট পার্টি বৈধ বলে গণ্য হয়।
চল্লিশের দশকে অনন্য কীর্তি ছিল ঢাকায় ‘প্রগতি লেখক সংঘে’র শাখা প্রতিষ্ঠা করা। এ সম্পর্কে লিখতে গিয়ে তাত্ত্বিক খোকা রায় লিখেছেন, “পূর্ববঙ্গের বিভিন্ন জেলায়ও ‘গণনাট্য সংঘ’ ও ‘প্রগতিশীল লেখক ও শিল্পী সংস্থা’র শাখা গড়ে উঠেছিল। ‘প্রগতিশীল লেখক ও শিল্পী সংস্থা’ বিশেষ জোরদার ছিল ঢাকাতে। প্রখ্যাত সাহিত্যিক রণেশ দাশগুপ্ত, সত্যেন সেন ও তরুণ কবি-সাহিত্যিক সোমেন চন্দ ছিলেন ঢাকার ঐ সাংস্কৃতিক সংস্থার নেতৃস্থানীয়।” ১৯৪২ সালে ঘাতকদের হাতে সোমেন চন্দ নিহত হবার পর সত্যেন সেন এই সংগঠনের প্রধান সংগঠকের ভূমিকায় অবতীর্ণ হন। সংগঠকের ভূমিকা পালন করলেও সত্যেন সেন এই সময় সাহিত্য রচনার দিকেও ঝুঁকে পড়েন। ১৯৪২ সালে ঢাকা জেলা কমিউনিস্ট পার্টির প্রচার সপ্তাহ উপলক্ষে তিনি প্রথম গান রচনা করেন, ‘লীগ-কংগ্রেস এক হও।’ এই গান সেসময় বাংলাদেশের সর্বত্র গাওয়া হত এবং তা ব্যাপক জনপ্রিয়তা অর্জন করেছিল।
১৯৪৩ সালে বাংলায় এক ভয়াবহ দুর্ভিক্ষ দেখা দেয়। সরকারী শাসন ও শোষণ ব্যবস্থা, খাদ্যনীতি, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধকালীন চন্ডনীতি, মূল্যবৃদ্ধি, কালোবাজারি এবং মজুদদারি এসবের সম্মিলিত ফল ছিল বাংলার এই দুর্ভিক্ষ। এই সময় দুমুঠো ভাতের ফেনের জন্য বাংলার গ্রামের মানুষ শহরে ভীড় জমায়। এই অবস্থার মধ্যেই সত্যেন সেন শ্রমিক-কৃষকদেরকে সাথে নিয়ে নিরন্ন মানুষের জন্য লঙ্গরখানা খুলে খাদ্যের ব্যবস্থা করেন। সত্যেন সেন তাঁর ‘মেহনতি মানুষের’ রচনায় লিখেছেন, “সেই দুর্দিনে তারা নিজেরাও সংকটের মধ্যে ছিল। তবু তারা নিজেদের মধ্যে চাঁদা তুলে, ভিক্ষা করে, মিল ও সরকারী কর্তৃপক্ষের নিকট থেকে সাহায্য আদায় করে বুভুক্ষু গ্রামবাসীদের জন্য লঙ্গরখানা খুলেছিলেন। এভাবে মাসের পর মাস ধরে পাঁচটা মিলের শ্রমিকদের উদ্যোগে পাঁচটা লঙ্গরখানা খোলা হয়েছিল।”
১৯৪৭ সালের আগষ্ট মাসে দেশবিভাগ সম্পন্ন হয় । ভারতবর্ষ ভেঙ্গে ভারত ও পাকিস্তান নামে দু’টি স্বতন্ত্র দেশ প্রতিষ্ঠিত হয়। পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পর থেকেই কমিউনিস্টদের ওপর নেমে আসে জুলুম- অত্যাচার। সত্যেন সেন তখন আত্মগোপনে চলে যান। বাঙালির জাতীয় ও সাংস্কৃতিক সত্তাকে ধ্বংস করে দেবার গভীর ষড়যন্ত্র শুরু হয়। প্রথম আঘাতটা আসে ভাষার ওপর। ১৯৪৮ সালেই পূর্ব পাকিস্তানের সংখ্যাগরিষ্ঠ বাঙালিরা মাতৃভাষা বাংলার দাবিতে রাজপথে নামে। এই ভাষা আন্দোলনকে কেন্দ্র করেই বাঙালির পাকিস্তান মোহ কিছুটা কাটতে থাকে। এ অবস্থায় পাকিস্তান সরকার ১৯৪৯ সালে সত্যেন সেনকে ঢাকা বনগ্রাম এলাকা থেকে গ্রেফতার করে। এবার একনাগাড়ে প্রায় চার বছর তিনি কারাগারের অন্ধপ্রকোষ্ঠে কাটান। প্রথমে তাঁকে রাজশাহী সেন্ট্রাল জেলে বন্দি রাখা হয়। পরে ঢাকা জেলে স্থানান্তরিত করা হয়। ১৯৫৩ সালে তিনি মুক্তি পান। জেল থেকে বেরিয়েই চলে যান নিজের গ্রামে। কিন্তু সেখানে গিয়ে দেখেন বিরাণ ভূমি। যেন নিজের গ্রাম নিজেই চিনতে পারছেন না। এক এক করে প্রায় সবাই দেশ ত্যাগ করে চলে গেছেন। সহযোদ্ধাদের কাউকে আর খুঁজে পেলেন না। নিজের পরিবারের সদস্যরাও চলে গেছেন। গ্রামের অনেকেই সত্যেন সেনকে পরামর্শ দিলেন আত্মীয়দের কাছে ভারত চলে যাবার জন্য। কিন্তু সত্যেন সেন দৃঢ়চিত্তে সেই প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করে নিজের কর্তব্য স্থির করে নিলেন। নিজের গ্রাম দিয়েই আবার শুরু করলেন কৃষক ও শ্রমিক সংগঠন গড়ে তোলার কাজ। পাকিস্তানী শাসক গোষ্ঠীর রক্তচক্ষুকে উপেক্ষা করেই কাজ করতে লাগলেন। আর এ কারণেই পাকিস্তান আমলের ২৪ বছরের ১৮ বছরই সত্যেন সেনকে কাটাতে হয় জেলে আর বাকি সময়টা আত্মগোপনে। ১৯৫৪-৫৫ সালে, পরবর্ত্তীতে ১৯৫৮-৬৩ সালে তিনি নিরাপত্তা বন্দী হিসেবে কারাগারে কাটান। ১৯৬৫ সালে দেশরক্ষা আইনে তাঁকে আবার গ্রেফতার করে পাকিস্তানি শাসকেরা। ১৯৬৮ সাল পর্যন্ত আটক রাখা হয় তাঁকে।
পরিণত বয়সে এসেই সত্যেন সেন সাহিত্য কর্ম শুরু করেন। তাঁর কাছে সাহিত্যই ছিল সংস্কৃতির প্রাণ। সেই সংস্কৃতিকে মানুষের কাছে পৌঁছে দেবার জন্যই তিনি আশ্রয় নেন সাহিত্যের। সেই দিক থেকে বাংলা সাহিত্যের জনজীবনমুখী, সমাজতান্ত্রিক বাস্তবতার সাহিত্য নির্মাণের অগ্রপথিক ছিলেন সত্যেন সেন। সত্যেন সেনের নিজের ভাষায়, “মানুষের কাছে যে কথা বলতে চাই, সে কথা অন্যভাবে বলতে পারবো না, সে জন্যই সাহিত্যের আশ্রয়।” এই সময় তিনি পুরুটাই মগ্ন থাকেন সাহিত্য সৃজনে। শুধুমাত্র ১৯৬৯ সালেই তিনি রচনা করেন ছয়টি গ্রন্থ ও ১৯৭০ সালে তাঁর এগারটি গ্রন্থ প্রকাশিত হয়। ১৯৬৯ সালে ‘পাপের সন্তান’ উপন্যাসের জন্য তিনি ‘আদমজী সাহিত্য পুরস্কার’ ও ১৯৭০ সালে তিনি সাহিত্য কর্মের জন্য ‘বাংলা একাডেমি পুরস্কার’ পান। ১৯৮৬ সালে তাঁকে ‘একুশে পদক (মরণোত্তর)’ দেয়া হয়।
সত্যেন সেনের জীবনের একটি বড় অংশ কেটেছে সাংবাদিকতায়। তিনি পেশাগত জীবনে দৈনিক সংবাদ পত্রিকায় যুক্ত ছিলেন। সেখানে তিনি নিয়মিত কলাম লিখতেন ও অনুসন্ধানী প্রবন্ধ লিখতেন। এ পত্রিকায় যুক্ত থাকাকালেই তিনি বাংলাদেশের আনাচে-কানাচে ঘুরে কৃষক আন্দোলনের অনেক তথ্য সমৃদ্ধ কাহিনী জানতে পারেন। যা পরে তাঁর বিভিন্ন বই রচনায় কাজে লাগিয়েছেন।
১৯৬৮ সাল সত্যেন সেনের জীবনে এক বিশেষ তাৎপর্যময় সময়। এ সময় তিনি প্রতিষ্ঠা করেন তাঁর স্বপ্নের সংগঠন ‘বাংলাদেশ উদীচী শিল্পীগোষ্ঠী’। শিল্পী সাইদুল ইসলামের নারিন্দার বাসায় সত্যেন সেনসহ মাত্র ছয়জনকে নিয়ে শুরু হয় এই সংগঠনের যাত্রা। সত্যেন সেন প্রগতিশীল সাংস্কৃতিক পরিমন্ডলকে বিকশিত করার লক্ষ্যেই এই সংগঠন গড়ে তোলেন। তিনি ছিলেন এর প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি। এখনো পর্যন্ত উদীচী সেই লক্ষ্যকেই সামনে রেখে নিরবচ্ছিন্নভাবে কাজ করে যাচ্ছে।
১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধ শুরুর সময় সত্যেন সেন ছিলেন মুন্সিগঞ্জের বিক্রমপুরে। শারীরিকভাবে তিনি এসময় কিছুটা কাবু ছিলেন। হাঁপানি আর চোখের অসুখ তাঁকে অনেকটাই নিস্তেজ করে দিয়েছিল। কিন্তু মনের দিক থেকে তিনি ছিলেন একেবারেই সতেজ। এর মধ্যেই সহযোদ্ধাদের সহযোগিতায় তিনি কলকাতা যান । সেখানে গিয়ে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে জনমত তৈরির কাজে আত্মনিয়োগ করেন। বিভিন্ন শিবিরে ঘুরে ঘুরে তিনি সংগ্রহ করেন গণহত্যা ও প্রতিরোধ যুদ্ধের নানা কাহিনী। সেসব নিয়েই পরে বের হয় ‘প্রতিরোধ সংগ্রামে বাংলাদেশ’ নামক গ্রন্থ। এক পর্যায়ে তাঁর চোখের অবস্থা আরো খারাপ হয়ে পরলে তিনি চিকিৎসার জন্য সোভিয়েত ইউনিয়নে যান। কিন্তু ডাক্তাররা তাঁর চোখ সম্পর্কে হতাশা ব্যক্ত করেন।
সত্যেন সেন স্বাধীনতা যুদ্ধের পর পরই দেশে ফিরে আসেন। এসে দেশ পুনর্গঠনে যথাসাধ্য কাজ করেন। কিন্তু মূলত সময় ব্যয় করতেন নিজের লেখালেখিতেই। এক পর্যায়ে শরীরের অবস্থা আরো খারাপ হলে তিনি তাঁর সেজদি প্রতিভা সেনের কাছে শান্তিনিকেতনে চলে যান। শারীরিক সমস্ত প্রতিবন্ধকতাকে উপেক্ষা করে তিনি লেখার কাজ চালিয়ে যান। সেসময়ের স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে প্রতিভা সেন লিখেছেন, “পুরানো বন্ধুদের ছাড়িয়া আসিলেও এরই মধ্যে এখানে তার আরো অনেকদিন আগের বন্ধুদের অনেককে পাইয়াছিল এবং আরো অনেক নতুন বন্ধু সংগ্রহ করিয়াছিল। এত ভালবাসায় ভরা ছিল তার প্রাণ…যার সঙ্গেই পরিচিত হইত, কেহই তাকে ভুলিতে পারিত না। বাংলাদেশের বন্ধুরাও সর্বদা তার খবর নিতে ও দেখিতে আসিত। সকলের সঙ্গেই তার যোগাযোগ ছিল।…তখন ভোর ৩/৪ টাতে উঠিয়া বেড়াইতে বাহির হইত। বেড়াইয়া আসিয়া নানা পত্রিকার জন্য ডিক্টেশনে প্রবন্ধ লিখিত।…সকাল ৮টা হইতে দশটা, তারপর আবার ২টা হইতে ৪টা পর্যন্ত এইসব করিত।” এই সেজদি’র শান্তিনিকেতনের বাড়িতেই সত্যেন সেন ১৯৮১ সালের ৫ জানুয়ারি শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন।
সত্যেন সেনের রচিত সাহিত্য কর্মের মধ্যে রয়েছে: উপন্যাস – ভোরের বিহঙ্গ (১৯৫৯); রুদ্ধপ্রাণ মুক্তদ্বার (১৩৯৩); অভিশপ্ত নগরী (১৯৬৯); পাপের সন্তান (১৯৬৯); সেয়ানা (১৯৬৯); পদচিহ্ন (১৯৬৯); পুরুষমেধ (১৯৬৯); আল বেরুনি (১৯৭০) ; সাত নম্বর ওয়ার্ড (১৯৭০) ; বিদ্রোহী কৈবর্ত (১৯৭০); কুমারজীব (১৯৭০); অপরাজেয় (১৯৭০); মা (১৯৭০) ; উত্তরণ (১৯৭০); একুল ভাঙ্গে ওকুল গড়ে (১৯৭১)। এছাড়াও ইতিহাস আশ্রিত অন্যান্য গ্রন্থের মধ্যে রয়েছে- মহাবিদ্রোহের কাহিনী (১৯৫৮); গ্রামবাংলার পথে পথে (১৯৬৬); পাতাবাহার (১৯৬৮); আমাদের পৃথিবী (১৯৬৮); মসলার যুদ্ধ (১৯৬৯); এটমের কথা (১৯৭০); অভিযাত্রী (১৯৭০); মানব সভ্যতার উষালগ্ন (১৯৭১); মনোরমা মাসিমা (১৯৭১); প্রতিরোধ সংগ্রামে বাংলাদেশ (১৯৭১); বিপ্লবী রহমান মাস্টার (১৯৭৩); শহরের ইতিকথা ; ইতিহাস ও বিজ্ঞান; ব্রিটিশ বিরোধী স্বাধীনতা সংগ্রামে মুসলমানদের ভূমিকা (১৯৮৮); সীমান্ত সূর্য আবদুল গাফফার (১৯৭১); জীববিজ্ঞানের নানা কথা (১৯৭৭) প্রভৃতি প্রধান।
তথ্যসূত্র: লেখাটি তৈরির জন্য ‘সত্যেন সেন-মহাজীবনের রূপকার’ পুস্তিকার সাহায্য নেয়া হয়েছে। এই পুস্তিকাটি সত্যেন সেনের জন্মশতবর্ষে উদীচী চট্টগ্রাম জেলা কমিটি কর্তৃক প্রকাশিত হয়; শ্রদ্ধাঞ্জলি, সত্যেন সেনের শততম জন্মদিবস,সত্যেন সেন জন্মশতবর্ষ উদযাপন জাতীয় কমিটি, ২৮ মার্চ ২০০৬। ছবিও এই গ্রন্থ থেকে নেয়া হয়েছে।
লেখক: চন্দন সাহা রায়