হাতেম আলী খানের পূর্বপুরুষদের বসবাস ছিল সিরাজগঞ্জের তেবাড়িয়ায়। ১৮৫৩ সালে তাঁর দাদা ঝোমর আলী খান সিরাজগঞ্জের তেবাড়িয়া ছেড়ে টাঙ্গাইলের গোপালপুর উপজেলার বেলুয়া গ্রামে বসবাস শুরু করেন। নিজের বুদ্ধিমত্তা ও কঠোর পরিশ্রমের ফলে পাঁচ-ছয় বছরের মধ্যে ঝোমর আলী খান প্রায় একশ একর জমির মালিক হন এবং বেলুয়া গ্রামের একজন প্রভাবশালী ব্যক্তি হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করেন।
হাতেম আলী খানের বাবা নায়েব আলী খানও বাবার মতো বুদ্ধিমান ও পরিশ্রমী ছিলেন। তিনি জমিদারী ব্যবস্থার মাধ্যমে বহু সম্পত্তির মালিক হন। হাতেম আলী খানের সময় তাঁদের জমির পরিমাণ দাঁড়ায় চারশ একরে। জমিদারের সন্তান হাতেম আলী খান জন্মের পর থেকে ঐশ্বর্য আর প্রাচুর্যের মধ্যে বড় হয়েছেন।
হাতেম আলী খান ছোটবেলা থেকে বাড়ির কর্মচারীদেরকে ভালোবাসতেন। তাঁর মধ্যে কখনো জমিদারী অহংকার ছিল না। কারণ শুধুমাত্র হাতেম আলী খানের ক্ষেত্রে তাঁর বাবা ও দাদা খুব উদার ছিলেন। তাঁরা হাতেম আলী খানকে মুক্ত শিক্ষা ও সংস্কৃতির মধ্য দিয়ে বড় করে তোলেন। মুক্তবুদ্ধি ও মুক্তচিন্তার কারণে জমিদারের সন্তান হওয়া সত্বেও একপর্যায়ে তিনি শ্রমজীবী ও কৃষকদের কাতারে চলে আসেন। প্রজা শোষণ-নির্যাতনের জন্য জমিদার বাবার বিরুদ্ধে শ্রমজীবী ও কৃষকদেরকে ঐক্যবদ্ধ করেন। তাঁদেরকে জমিদার বাবার দেয়া দাদন টাকা পরিশোধ করতে নিষেধ করেন। ছেলেকে শ্রমজীবী ও কৃষকদের কাছ থেকে ফিরিয়ে আনার জন্য তাঁর বাবা নানাভাবে চেষ্টা করেছেন। কিন্তু ফেরাতে পারেননি। সারাটা জীবন শ্রমজীবী আর কৃষকদের অধিকার আদায়ের জন্য তিনি লড়াই-সংগ্রাম করেছেন, হয়ে উঠেছেন কিংবদন্তি কৃষক নেতা হাতেম আলী খান।
টাঙ্গাইলের গোপালপুর উপজেলার বেলুয়া গ্রামে ১৯০৪ সালের ২৪ নভেম্বর হাতেম আলী খান জন্মগ্রহণ করেন। হাতেম আলী খানের পড়াশুনার হাতেখড়ি হয় পরিবারে। বাবার কাছে বর্ণমালা শেখার পর পারিবারিক মক্তবে আনুষ্ঠানিকভাবে তাঁর প্রাথমিক পড়াশুনা শুরু হয়। ১৯১৪ সালে মক্তবের পড়াশুনা শেষ হওয়ার পর তাঁর বাবা তাঁকে হেমনগর উচ্চ বিদ্যালয়ে ভর্তি করান। স্কুলে ভর্তি হওয়ার কিছুদিন পরে প্রথম বিশ্বযুদ্ধ শুরু হয়। ভারত উপমহাদেশেও এই যুদ্ধের প্রভাব পড়ে। ভারত মিত্রশক্তিকে সহযোগিতার জন্য এ যুদ্ধে অংশগ্রহণ করে। তখন ভারত সরকার সেনাবাহিনীতে যোগদানের জন্য যুব সমাজকে আহ্বান করে।
সেই আহ্বানে সাড়া দিয়ে হাতেম আলী খান ১৯১৬ সালে সেনাবাহিনীতে যুক্ত হওয়ার জন্য প্রস্তুতি নেন। হেমনগর স্কুলের সহকারী শিক্ষক তাঁকে বুঝিয়ে সেনাবাহিনীতে যোগদান থেকে বিরত রাখেন। এরপর শিক্ষকদের কথামত পড়াশুনায় মনোযোগ দেন তিনি। এই সময় হাতেম আলী খানের বড় ভাইয়ের বন্ধু মাখম চন্দ দেব তাঁকে সশস্ত্র বিপ্লবী দলের সদস্য হতে উৎসাহিত করেন। তিনি সশস্ত্র বিপ্লবী সংগঠন ‘অনুশীলন সমিতি’র সদস্য হন। পড়াশুনার পাশাপাশি প্রকৃত বিপ্লবী হয়ে ওঠার জন্য বিপ্লবী কর্মকাণ্ডে মনোনিবেশ করেন। ১৯২০ সালে হেমনগর উচ্চবিদ্যালয় থেকে হাতেম আলী খান মাধ্যমিক পাশ করেন।
মাধ্যমিক পাশ করার পর তিনি কলকাতার রিপন কলেজে উচ্চমাধ্যমিক ভর্তি হন। ১৯১৭ সালে সোভিয়েত ইউনিয়ন সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্র হিসেবে প্রতিষ্ঠা লাভ করার ফলে বিশ্ব রাজনীতিতে এক নব যুগের সূচনা হয়। পৃথিবীর বিভিন্ন দেশ তখন ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলন-সংগ্রামে উত্তাল। আর এরকম সময় হাতেম আলী খান কলকাতার রিপন কলেজে অধ্যায়নরত। ব্রিটিশবিরোধী উত্তাল সংগ্রাম তাঁকে প্রবলভাবে আকৃষ্ট করে। ক্ষুদিরাম, প্রফুল্ল চাকীর বিপ্লবী আত্মত্যাগ সেই শৈশব থেকে তাঁকে আলোড়িত করে আসছিল। সবকিছু মিলিয়ে তিনি ধীরে ধীরে রাজনৈতিক আন্দোলন-সংগ্রামে জড়িয়ে পড়েন। রাজনৈতিক আন্দোলন-সংগ্রামের ধারাবাহিকতায় এক সময় পড়াশুনা আর রাজনীতি হয়ে উঠে তাঁর জীবনসঙ্গী।
১৯২০ সালে অসহযোগ আন্দোলনের শুরুতে হাতেম আলী খান রিপন কলেজে পড়াশুনার সময় প্রতিদিন কলেজ স্কোয়ার, বিডন স্কোয়ার, হারিশ পার্ক, ওয়েলিংটন স্কোয়ারের সকল রাজনৈতিক সমাবেশে অংশগ্রহণ করেন। এইসময় তাঁর সাথে পরিচয় হয় বাংলার বিভিন্ন বামপন্থী নেতৃবৃন্দের সাথে। আব্দুল হালিম, আব্দুল্লাহ রসুল, সূর্যসেন, সত্যেন সেন, মুজফফর আহমদ, কাজী নজরুল ইসলাম ও জিতেন ঘোষের মতো সংগ্রামী নেতৃত্বের সাথে তাঁর অন্তরঙ্গ সম্পর্ক গড়ে উঠে। এরপর তিনি এলাকায় এসে বিলেতী পণ্য বর্জন ও জমিদারী দাদন টাকা পরিশোধ না করার জন্য জনগণকে উদ্ধুদ্ধ করেন।
১৯১৪-৩০ সাল পর্যন্ত বাংলায় সংগঠিত হয় প্রজা ও কৃষক আন্দোলন। ১৯২০ সাল থেকে হাতেম আলী খান এই আন্দোলনের সাথে যুক্ত ছিলেন। প্রজা ও কৃষকদের সচেতন করে সংগঠিত করার ক্ষেত্রে তাঁর ভূমিকা ছিল অনন্য। ১৯২১ সালে বিভিন্ন অঞ্চলে প্রজা আন্দোলন জোরদার হয়ে উঠার পর তিনি বেলুয়ায় চলে আসেন। তিনি বিভিন্ন এলাকার কৃষকদের সংগঠিত করে জমিদার ও সুদখোর মহাজনদের বিরুদ্ধে জোরালো আন্দোলন গড়ে তোলেন। হাতেম আলী খানের নেতৃত্বে ওই এলাকার কৃষকরা জমিদারের খাজনা, মহাজনদের দাদন ও বর্গা জমির ফসল প্রদান করা বন্ধ করে দেন। ১৯২০-৩০ সাল পর্যন্ত বাংলায় সংগঠিত প্রজা ও কৃষক আন্দোলনে তাঁর গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা ছিল।
১৯২২ সালে কলেজ ছুটির সময় কলকাতা থেকে নিজ এলাকায় চলে আসেন। বাড়িতে আসার পর বেশ কিছুদিন ধরে জমিদার বাবার বিরুদ্ধে কৃষক ও শ্রমজীবী মানুষকে সংগঠিত করেন। বাবা তাঁর উপর অসন্তুষ্ট হয়ে পড়াশুনার খরচ দেয়া বন্ধ করে দেন। কারণ তিনি ভাবলেন খরচ দেয়া বন্ধ করলে হয়তো ছেলে তাঁর বিরুদ্ধে আন্দোলন করার সাহস পাবে না। কিন্তু বাবার সব ধারণা ও চেষ্টা ব্যর্থ করে দিয়ে হাতেম আলী খান জমিদার পরিবার ছেড়ে কৃষক ও শ্রমজীবী মানুষের সাথে বসবাস শুরু করেন।
এ সময় হাতেম আলী খান নিজের চলা ও পড়াশুনার টাকা সংগ্রহের জন্য কাপড় বিক্রির ব্যবসা শুরু করেন। কাপড় বিক্রির কাজ আর পড়াশুনার ফাঁকে ফাঁকে কৃষকদের সচেতন ও সংগঠিত করতে থাকেন। মাঝে মাঝে জমিদার বাবার পাইক-পেয়াদার সাথে জমির খাজনা, দাদন নিয়ে সংঘর্ষ বাধে। পাইক-পেয়াদারা কৃষক ও শ্রমজীবী মানুষদেরকে আঘাত করতে গিয়ে দেখতে পান তাঁদের সাথে জমিদারের ছেলেও আছেন। তখন কৃষকদের কাছ থেকে জমির খাজনা, দাদন নিতে ব্যর্থ হয় তারা। এভাবে এক বছর চলার পর তিনি কৃষক ও শ্রমজীবী মানুষের অনুরোধে কলকাতায় গিয়ে পুনরায় পড়াশুনায় মন দেন এবং ছাত্রাবাসে থাকা শুরু করেন। ছেলে পড়াশুনায় মনোযোগ দেয়ার কারণে বাবা আবার তাঁকে পড়াশুনার খরচ দিতে শুরু করেন।
১৯২৪ সালে তিনি উচ্চমাধ্যমিক পাশ করেন। ওই বছরই তিনি বি.এ.-তে ভর্তি হন। ভর্তি হওয়ার অল্প কিছুদিন পরে আবার গ্রামে ফিরে আসেন তিনি। চলে যান কৃষকদের কাতারে। এসময়ও তিনি জমিদার বাবার বিরুদ্ধে শ্রমজীবী, কৃষকদের ঐক্যবদ্ধ ও সংগঠিত করেন। তাঁদেরকে জমিদার বাবার দেয়া দাদন টাকা পরিশোধ করতে নিষেধ করেন। ফলে ১৯২৪ সালে নায়েব আলী খানের ৯০ হাজার টাকা (আসল) ও এই টাকার দাদন প্রায় লক্ষাধিক টাকা ভেস্তে যায়। কিছুদিন পর আবার তিনি কলকাতায় ফিরে গিয়ে পড়াশুনায় মন দেন।
ছাত্রাবাসে উঠার পর তাঁর সঙ্গে শান্তিপুরের নূর মোহাম্মদ, দিল্লীর অতুল চন্দ্র ও মধ্যপ্রদেশের এ কে এম মাহমুদের সাথে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক গড়ে উঠে। তাঁদের সান্নিধ্যে এসে তিনি এসময় সশস্ত্র বিপ্লববাদী সংগঠনের সাথে যুক্ত হন। অসহযোগ আন্দোলন প্রত্যাহার করে নেয়ার পর বিপ্লবীরা সশস্ত্রভাবে দেশের স্বাধীনতা অর্জনের জন্য সংগঠিত হতে থাকেন। তিনি শান্তিপুরের নূর মোহাম্মদ ও দিল্লীর অতুল চন্দ্র শীলের সাথে মিলে “ন্যাশনাল লীগ” নামে একটি গুপ্ত সংগঠন (সশস্ত্র বিপ্লবী সংগঠন) গড়ে তোলেন। এই সংগঠনটি বছর খানেকের মধ্যে বেশ শক্তিশালী ও জনপ্রিয় হয়ে উঠে। এই সংগঠনের কর্মীদের সশস্ত্র বিপ্লবী ভাবধারায় তৈরী করার জন্য হাতেম আলী খান ভারতের বিভিন্ন স্থানে পাঠাগার ও ব্যায়ামাগার প্রতিষ্ঠা করেন। পাঠাগার ও ব্যায়ামাগারে বসে শরীর চর্চা, বিপ্লবী বই পড়ানো, অস্ত্র চালানো এবং বোমা বানানোর প্রশিক্ষণ দেয়া হতো।
সশস্ত্র বিপ্লবী হওয়ার খবর জমিদার বাবার কাছে পৌছলে তিনি ছেলের উপর অসন্তুষ্ট হয়ে আবার পড়াশুনার খরচ দেয়া বন্ধ করে দেন। সশস্ত্র বিপ্লববাদী সংগঠনের কাজ থেকে ফিরে আসার জন্য ছেলেকে একের পর এক চাপ দিতে থাকেন। এসময় তিনি বাবাকে সন্তুষ্ট করার জন্য কিছুদিন পড়াশুনায় মনোযোগ দেন। তাঁর বাবা সেই সুযোগে তাঁকে বিলেতে পাঠানোর সিদ্বান্ত নেন এবং ব্যর্থ হন।
১৯২৬ সালে রিপন কলেজ থেকে হাতেম আলী খান বি.এ. পাশ করার পর জমিদার বাবা তাঁকে বিয়ে দিয়ে সংসারী করার উদ্যোগ নেন। অবশ্য তাঁকে বিয়ে দেয়ার চেষ্টা বি.এ. পাশের পূর্বেই শুরু করেন তিনি। র্দীর্ঘ ৩ বছর চেষ্টার পর ছেলেকে বিয়েতে রাজি করাতে সক্ষম হন। ১৯২৭ সালে হাতেম আলী খান কসিমুন্নেসা খানমকে বিয়ে করেন। কসিমুন্নেসা ছিলেন আব্দুল করিম খানের মেয়ে। বিয়ের কিছুদিন পর তাঁর বাবা জমিদার নায়েব আলী খান মারা যান।
কয়েক মাস পর তিনি কলকাতায় গিয়ে এম.এ. পড়াশুনায় মনোযোগ দেন। ১৯২৮ সালে তিনি রিপন কলেজ থেকে এম এ পাশ করেন। পড়াশুনা শেষ করার পর তিনি কলকাতা থেকে একটি সাপ্তাহিক পত্রিকা প্রকাশ করার সিদ্ধান্ত নেন। পত্রিকা প্রকাশের খরচ জোগাড় করার জন্য তিনি বাড়িতে আসেন এবং স্ত্রীকে না জানিয়ে তাঁর ৭০ ভরি স্বর্ণালংকার বিক্রি করেন। এরপর কলকাতায় ফিরে গিয়ে ‘র্সবহারা’ নামে একটি সাপ্তাহিক পত্রিকা প্রকাশ করেন। উচ্চমাধ্যমিক পড়ার সময় থেকেই বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল ইসলাম ও কমরেড মুজফফর আহমদের সাথে হাতেম আলী খানের যোগাযোগ ছিল। তাঁরাই পত্রিকার নাম ঠিক করে দিয়েছিলেন-‘সর্বহারা’। তাঁর রাজনৈতিক চিন্তাভাবনা বিকাশে এ দুজনের গুরুত্বর্পূণ ভূমিকা রয়েছে। ‘সর্বহারা’ পত্রিকাটি ৬ মাস প্রকাশ হওয়ার পর নানাকারণে বন্ধ হয়ে যায়।
কিছুদিন পর আবার হাতেম আলী খান পত্রিকা প্রকাশের উদ্যোগ গ্রহণ করেন। তবে এবার পত্রিকার মাধ্যমে সমাজতন্ত্র ও সাম্যবাদের কথা মানুষের মাঝে প্রচার করার উদ্দেশ্যে ‘চাষীমজুর’ ও ‘দিনমজুর’ নামে দুটি পত্রিকা প্রকাশ করেন। কিছুদিন পর টাকার অভাবে পত্রিকা দুটি বন্ধ হয়ে যায়।
এরপর তিনি গ্রামের নিরক্ষর মানুষকে লেখাপড়া শেখানোর উদ্দেশ্যে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান গড়ার উদ্যোগ গ্রহণ করেন। ১৯৩৯ সালে ময়মনসিংহের ভালুকা থানার বাটাজোর গ্রামে স্থানীয়দের নিয়ে একটি স্কুল প্রতিষ্ঠা করেন। ওই এলাকায় স্কুলের প্রধান শিক্ষক না পাওয়ার কারণে তিনিই প্রতিষ্ঠালগ্ন থেকে প্রধান শিক্ষকের দায়িত্ব নেন। পাশাপাশি তিনি ওই এলাকায় কৃষকদের সংগঠিত করার উদ্দেশ্যে কৃষক সংগঠন গড়ে তোলেন। ১৯৩৮ সালে রংপুর কৃষক সমিতির প্রথম সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। এই সম্মেলনে তিনি কৃষকদের সংগঠিত করার ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন। একই বছর সারা ভারতের কৃষক সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয় নেত্রকোনায়। এতেও তিনি যুক্ত ছিলেন।
তিনি অক্লান্ত পরিশ্রম করে ৩ বছরের মধ্যে স্কুলটিকে মডেল হাইস্কুলে রূপান্তরিত করেন। এটি ১৯৪২ সালে বোর্ডের মঞ্জুরী পায়। স্কুলটি বোর্ডের মঞ্জুরী পেলে তিনি বেলুয়ার ভূয়াপুর স্কুলে সহকারী প্রধান শিক্ষক হিসেবে যোগদান করেন। বেলুয়াতেও তিনি ‘জনতা উচ্চ বিদ্যালয়’ নামে একটি স্কুল প্রতিষ্ঠা করেন। সাথে সাথে অব্যাহত রাখেন কৃষক সংগঠনের কাজ। হাতেম আলী খান একে একে বলরামপুর, নলিন ও ধূবলিতে হাইস্কুল প্রতিষ্ঠা করেন। এই স্কুলগুলোতে উপযুক্ত প্রধান শিক্ষক না পাওয়ায় তিনি নিজেই একই সাথে ৩টি স্কুলের প্রধান শিক্ষক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। দরিদ্র ছাত্রদের পড়াশুনার খরচ তিনি বহন করতেন। পিছিয়ে পড়া ছাত্রদেরকে নিয়ে আলাদাভাবে কোচিং ক্লাশ করাতেন। ছেলেমেয়েদেরকে স্কুলে পাঠানোর জন্য অভিভাবকদেরকে তিনি উদ্ধুদ্ধ করতেন। তাঁর অক্লান্ত প্রচেষ্টায় বৃহত্তর রংপুর, দিনাজপুর অঞ্চলে শিক্ষার বিস্তার ঘটে। শিক্ষা বিস্তারের পাশাপাশি তিনি কৃষক সমিতির সংগঠন ও আন্দোলন গড়ে তোলার কাজও চালিয়ে যান। ১৯৪৩ সালে সুসং দূর্গাপুরে কৃষক সম্মেলন এবং ময়মনসিংহের নালিতাবাড়িতে প্রাদেশিক কৃষক সমিতির সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। এ সকল সম্মেলনে কৃষকদের সংগঠিতকরণে তাঁর যথেষ্ট ভূমিকা ছিল।
১৯৪৩-৪৪ সালে বাংলার মানুষের জীবনে নেমে আসে এক ভয়াবহ দুর্ভিক্ষ ও বিপর্যয়। তখন দুর্ভিক্ষ প্রতিরোধ এবং অনাহারে মৃত্যুপথযাত্রী মানুষকে বাঁচানোই ছিল কমিউনিস্ট পার্টির সদস্যদের প্রধান কাজ। এই দুর্ভিক্ষ ও বিপর্যয় মোকাবেলায় হাতেম আলী খান জীবনবাজী রেখে কাজ করেন।
তেভাগা আন্দোলন, টংক আন্দোলন, নানকার আন্দোলন, নাচোলের কৃষক বিদ্রোহ এ সমস্ত আন্দোলন-সংগ্রামে কৃষকদের সংগঠিত করতে হাতেম আলী খান প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে ভূমিকা পালন করেন। ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলনে তিনি ভূমিকা পালন করেন। তিনি ওই সময় কমিউনিস্ট পার্টি থেকে টাঙ্গাইলে ভাষা আন্দোলনের নেতৃত্ব দেন।
যুক্তফ্রন্ট নির্বাচনে টাঙ্গাইলের গোপালপুর থেকে হাতেম আলী খান মুসলিম লীগের প্রার্থী প্রিন্সিপাল ইব্রাহিম খাকে বিপুল ভোটে হারিয়ে পূর্ব পাকিস্তান আইন সভার সদস্য হন। ১৯৫৪ সালের ৩০ মে মুসলিম লীগ সরকার যুক্তফ্রন্ট মন্ত্রীসভা ভেঙ্গে দেয়। ১৯৫৪ সালের ৪ জুলাই ৯২(ক) জারী করে মুসলিম লীগ সরকার সন্ত্রাসের রাজত্ব কয়েম করে। এ সময় কমিউনিস্ট পার্টিকে নিষিদ্ধ করা হয়। জাতীয় নেতৃবৃন্দকে গ্রেফতার করে কারাগারে পাঠানো হয়। এর মধ্যে কৃষক নেতা হাতেম আলী খানও ছিলেন। সোহরাওয়ার্দী মন্ত্রিসভা গঠনের পর ১৯৫৬ সালের সেপ্টেম্বর মাসে পূর্ববাংলার জাতীয় নেতৃবৃন্দ ছাড়া পান।
১৯৫৭ সালের মার্চ মাসে কৃষকদের নিয়ে ঢাকায় একটি গুরুত্বপূর্ণ বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। এই বৈঠকে ভাসানীর নেতৃত্বে প্রাদেশিক কৃষক সমিতি গঠন করা হয়। এ সময় হাতেম আলী খান কৃষক সংগঠন গড়ে তোলার জন্য অন্যান্য নেতৃবৃন্দের সাথে অক্লান্ত পরিশ্রম করেন। ওই বছর ডিসেম্বর মাসে ভাসানীর নেতৃত্বে কৃষক সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। সম্মেলনে মাওলানা ভাসানীকে সভাপতি করে এবং হাতেম আলী খানকে সাধারণ সম্পাদক করে কৃষক সমিতি পুনর্গঠন করা হয়।
১৯৫৮ সালে পাকিস্তান সরকারের রোষানলে পড়ে হাতেম আলী খান আত্মগোপনে যান। ১৯৬৩ সালের প্রথম দিকে তিনি প্রকাশ্যে আসেন। ওই বছর কৃষক নেতা জিতেন ঘোষ জেল থেকে মুক্তি পান। জিতেন ঘোষ ও হাতেম আলী খান একত্রে মিলে ওসমান গনি রোডে কৃষক সমিতির কার্যক্রম পরিচালনা করেন। ১৯৬৪ সালে কাশ্মীরের হযরতবাল মসজিদ থেকে ইসলাম ধর্মের স্মৃতিচিহ্ন চুরি হয়ে যায়। এই ঘটনাকে কেন্দ্র করে ঢাকা ও খুলনাতে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা শুরু হয়। যার ফলে ওসমান গনি রোডে কৃষক সমিতির কার্যক্রম বন্ধ হয়ে যায়। কিছুদিন পর টাঙ্গাইল যাওয়ার পথে গোয়েন্দা পুলিশ হাতেম আলী খানকে গ্রেফতার করে পুলিশ সদরে নিয়ে যায় এবং অমানষিক নির্যাতন করে। সাত দিন তাঁকে নির্যাতন করা হয়। ফলে তিনি গুরুতর অসুস্থ হয়ে পড়েন। এই অসুস্থতা তাঁকে জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত বহন করতে হয়েছে।
নানা চড়াই-উৎরাই পার হয়ে ১৯৬৬ সালে ন্যাপ সোভিয়েতপন্থী ও চীনাপন্থী হিসেবে দুই ভাগে বিভক্ত হয়। এমন পরিস্থিতিতে কুলাউড়ায় কৃষক সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। এ সম্মেলনে দু’টি প্যানেল হয়। চীনাপন্থীরা ভাসানীকে সভাপতি ও আব্দুল হককে সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত করে। সোভিয়েতপন্থীরা আমজাদ হোসেনকে সভাপতি ও হাতেম আলী খানকে সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত করে। কৃষক সমিতি দ্বিধাবিভক্ত হওয়ায় কৃষক আন্দোলন ক্ষতিগ্রস্ত হয়। ফলে হাতেম আলী খান ব্যথিত হন। তবু হাল ছাড়লেন না। আবার শুরু করলেন কৃষকদের সংগঠিত করার কাজ। ১৯৬৭ সালে ঢাকায় কৃষক সমাবেশের আয়োজন করেন। এই সমাবেশ থেকে পুলিশ তাঁকে গ্রেফতার করে রাষ্ট্রদ্রোহী মামলা দেয়। এসময় তিনি আড়াই বছর কারাগারে ছিলেন। ১৯৬৯ সালে গণ অভ্যূত্থানের সময় মুক্তি পান।
মুক্তিযুদ্ধের সময় তিনি টাঙ্গাইলে ছিলেন। শারিরীক অসুস্থতার কারণে সরাসরি মুক্তিযুদ্ধে সৈনিকের ভূমিকা পালন করতে পারেননি। কিন্তু মুক্তিযুদ্ধে তরুণদের উৎসাহ প্রদান, মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য অর্থ, খাবার সংগ্রহের কাজ তিনি জীবনবাজী রেখেই করেছেন। দেশ স্বাধীন হওয়ার পর তিনি আবার পুরোদমে কৃষক সমিতির কাজ শুরু করেন। ১৯৭২ সালের মার্চ মাসে নরসিংদীর বেলাবোতে এক কৃষক সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। এতে প্রায় একলক্ষ কৃষকের সমাবেশ ঘটেছিল। এই সম্মেলনে মনিসিংহ সভাপতি ও হাতেম আলী খান সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হয়েছিলেন। ১৯৭৩ সালে তিনি সোভিয়েত কমিউনিষ্ট পার্টির আমন্ত্রণে সোভিয়েত ইউনিয়নে যান। ১৯৭৪ সালে দ্বিতীয় কৃষক সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। এই সম্মেলনে হাবিবুর রহমান সভাপতি ও আমজাদ হোসেন সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হয়েছিলেন।
শারিরীক অসুস্থতার কারণে হাতেম আলী খান এই সম্মেলনের সিনিয়র সহ-সভাপতি নির্বাচিত হন। ১৯৭৪ সালে তৃতীয় কৃষক সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। এই সম্মেলনে হাতেম আলী খান সভাপতি ও ফজলুল হক খন্দকার সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হন। দীর্ঘদিন লড়াই-সংগ্রাম শেষে ১৯৭৭ সালের ২৪ অক্টোবর তিনি মৃত্যুবরণ করেন।
তথ্য ও ছবিসূত্র: অগ্নিযুগের পঁাচ বিপ্লবী – উৎপল সাহা, প্রকাশকাল : ২০১০
লেখক : রফিকুল ইসলাম (শেখ রফিক)