ভাষাসৈনিক গাজীউল হক
গাজীউল হক একজন ভাষাসৈনিক। পূর্ব-পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা বাংলার দাবিতে রাজপথে মিছিল করেন। স্লোগান দেন। এজন্য তাঁকে সরকারের রোষানলে পড়ে কারাবরণ করতে হয়েছে কয়েকবার। কিন্তু কারাবরণের ভয়ে তিনি ভীত হননি। কর্মজীবনে তিনি একজন আইনজীবী। সংস্কৃতি ক্ষেত্রে তিনি একজন লেখক, কবি, গীতিকার। রাষ্ট্রভাষা বাংলা মর্যাদা পাবার পরও উচ্চ আদালতে বাংলা ভাষা চালু না হওয়ায় তিনি ভীষণ কষ্ট অনুভব করতেন। বিভিন্ন সময় তাঁর কথা, লেখায় এই আক্ষেপ প্রকাশ পেয়েছে। উচ্চ আদালতে বাংলা ভাষা প্রতিষ্ঠার জন্য তাঁর চেষ্টার কোনো ত্রুটি ছিলনা।
জন্ম ও পারিবারিক পরিচয়
গাজীউল হক ১৯২৯ সালের ১৩ ফেব্রুয়ারি নোয়াখালী জেলার ছাগলনাইয়া থানার নিচিন্তা গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর বাবা মওলানা সিরাজুল হক ছিলেন কংগ্রেস ও খেলাফত আন্দোলনের একজন সক্রিয় কর্মী। তিনি পীর সাহেব হিসেবেও পরিচিত ছিলেন। রাজনৈতিক কারণে তাঁকে বিশের দশকে নোয়াখালী জেলা থেকে বহিষ্কার করা হয়। দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের সময় জাপানে বোমাবর্ষণ শুরু হলে তাঁর বাবা তাঁদের পরিবারের সকলকে নিয়ে বগুড়া চলে আসেন। মা নূরজাহান বেগম ছিলেন গৃহিনী। মা’র কাছে প্রথম তিনি বৃটিশ খেদাও আন্দোলন এবং বৃটিশ পণ্য বর্জনের গল্প শোনেন। তাঁর দাদা মওলানা আবদুল বারী এবং নানা মওলানা সাকরুদ্দীন পীরসাহেব ছিলেন। পাঁচ ভাই তিন বোনের মধ্যে তিনি ছিলেন তৃতীয়। বড় ভাই ফরিদউদ্দিন, ছোট তিন ভাইয়ের মধ্যে নিজাম-উল হক, গোলাম কিবরিয়া এবং কাজল। বোনেরা আফিয়া বেগম, ফিরোজা বেগম হীরা এবং আব্রু বেগম রানী।
শৈশবকাল
ছেলেবেলায় গাজীউল হক ছিলেন অনেক দুরন্ত, সাহসী এবং জেদি। হাতের কনুই দিয়ে নারকেল ভেঙ্গে ফেলতেন। একবার কোনো কাজ করার সিদ্ধান্ত নিলে তা তিনি করেই দেখাতেন। পনের/ষোল বছর বয়সে একদিন তিন বাড়ির থেকে কিছুটা দূরে এক মাঠের পাশ দিয়ে হেঁটে যাচ্ছিলেন। সঙ্গে ছিলেন তাঁর এক বন্ধু। মাঠে তাঁরা একটি ষাঁড় দেখতে পান। ষাঁড় দেখে বন্ধুটির মাথায় খেলে গেল এক দুষ্টু বুদ্ধি। তিনি গাজীউল হককে উদ্দেশ্য করে বললেন, তুই যদি ঐ ষাঁড়ের সঙ্গে লড়ে জিততে পারিস তাহলে তোকে পাঁচ টাকা পুরস্কার দেবো। গাজীউল হক আর দেরি করলেন না। দ্রুত ষাঁড়ের সঙ্গে লড়ার জন্য মাঠে নেমে যান। ষাঁড়কে কাবু করে বন্ধুর কাছ থেকে জিতে নেন পাঁচ টাকা।
শিক্ষাজীবন
গাজীউল হকের প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা যখন শুরু হয় তখন তিনি থাকতেন নোয়াখালী জেলার ছাগলনাইয়া থানার নিচিন্তা গ্রামে। বাড়ির সামনে একটি মক্তবে তাঁর পড়াশুনা শুরু হয়। মক্তবে তাঁর শিক্ষক ছিলেন জমিরউদ্দিন। শিক্ষাজীবনের প্রথম শিক্ষক সম্পর্কে বলতে গিয়ে তিনি বলেছেন, ‘এলাকা জুড়ে তার শিক্ষক জমিরউদ্দিনের সুনাম ছিল। তিনি মিথ্যা কথা বলতেন না। আর আচরণের মধ্যে একটা অদ্ভুত বিষয় ছিল-তিনি কখনও তাঁর ছাত্রদের তুমি বলতেন না। ছোট ছোট শিশুদের আপনি করে বলতেন।’ এই মক্তব পরীক্ষায় তিনি দু’টাকার বৃত্তি পান। মক্তবের পড়াশুনা শেষ করে তিনি কাশিপুর স্কুলে ভর্তি হন। তৃতীয় শ্রেণীর বার্ষিক পরীক্ষার ফলাফল বের হলে তিনি দেখলেন প্রথম হয়েছে অন্য ছাত্র। কিন্তু তাঁর দৃঢ় বিশ্বাস ছিল তিনিই প্রথম হবেন। এ কারণে নিজের ভুল খুঁজে বের করার জন্য তিনি শিক্ষকদের কাছে পরীক্ষার খাতা দেখতে চাইলেন। অংক খাতা নিরীক্ষা করে ধরা পড়ল ভুলে শিক্ষক তাঁকে অংকে নম্বর কম দিয়েছেন। তিনি অংকে একশত নম্বরই পেয়েছেন। পরে সব বিষয়ের নম্বর যোগ করে দেখা গেল তিনি প্রথম হয়েছেন। এই স্কুল থেকে তিনি উচ্চ প্রাইমারি বৃত্তি লাভ করেন।
এখান থেকে ১৯৪১ সালে গাজীউল হক বগুড়া জেলা স্কুলে ষষ্ঠ শ্রেণীতে ভর্তি হন। গাজীউল হক ছিলেন ক্লাশের একমাত্র মুসলিম ছাত্র। এর ওপরে আবার পীরের ছেলে। মুসলিম হলেও অল্পসময়ের মধ্যেই সহপাঠীদের সঙ্গে তাঁর হৃদ্যতা গড়ে ওঠে। মেধাবী হওয়ায় শিক্ষকদের কাছেও তিনি প্রিয় ছাত্র হয়ে ওঠেন। বিদ্যালয়ে ভর্তি হবার পরই ২৩ মার্চ পাকিস্তান দিবস উদযাপন করার জন্য ছাগলনাইয়ায় মিছিল বের হয়। গাজীউল হক এই মিছিলে অংশ নেয়। মিছিল এগিয়ে ছাগলনাইয়া থানা কার্যালয়ের সামনে পৌঁছলে তিনি সেখানে বৃটিশ পতাকা উড়তে দেখেন। সঙ্গে সঙ্গে তিনি বৃটিশ পতাকা ইউনিয়ন জেক নামিয়ে সেখানে পাকিস্তানি তিনকোণা পতাকা উড়িয়ে দেন। একাজে তাঁকে সহযোগিতা করেন তাঁর দুই সহপাঠী মুজিবুল হক এবং খলিলউল্লাহ। এই অপরাধে পুলিশ তাঁদের ধরে নিয়ে হাজতে চালান দেয়। মেধাবী শিক্ষার্থী হওয়ায় বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক তাঁদের কয়েক ঘন্টার মধ্যে হাজত থেকে মুক্ত করে আনেন।
এই স্কুলে পড়ার সময়েই তিনি ইতিহাস শিক্ষক সুরেন স্যারের সান্নিধ্যে আসেন এবং বৃটিশ বিরোধী মনোভাব তার ভেতরে দানা বাঁধে। এতেই থেমে রইলেন না তিনি। সে সময়ে কয়েকজন ছাত্র মিলে ‘বিদ্রোহী’ নামে একটি হাতে লেখা ম্যাগাজিন বের করতেন। গাজীউল হক ওই পত্রিকায় একটি কবিতা লেখেন। কবিতাটি জেলা প্রশাসনের নজরে পড়ে। জেলা প্রশাসন দ্রুত বিদ্যালয় কতৃর্পক্ষকে তাঁর বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণের নির্দেশ দেয়। সহকারী প্রধান শিক্ষক আবেদ আলী জেলা প্রশাসনের এই নির্দেশকে মানতে পারলেন না। তিনি সঙ্গে সঙ্গে এর প্রতিবাদ করেন। প্রতি বছরই বিদ্যালয়ে বার্ষিক পুরস্কার বিতরণী অনুষ্ঠানে একটি সাংস্কৃতিক প্রতিযোগিতার আয়োজন করা হত। একবার তিনি এই সাংস্কৃতিক প্রতিযোগিতায় বির্তক, আবৃত্তি এবং গানে অংশ নিয়ে পুরস্কার পান। আর চার লাইনের একটি ছড়া লিখে তিনি বেশি আলোচিত হন। ছড়াটি ছিল – আমি গাইব গান মুক্ত কন্ঠে, জীবন দীপের আলো জ্বেলে, সুর ছড়াবো, রং ছড়াবো, পুড়বো আমি, আলো ছড়াবো।
১৯৪৬ সালে বগুড়া জেলা স্কুল থেকে প্রথম বিভাগে ম্যাট্রিকুলেশন পাশ করেন। এরপরই তিনি বগুড়া আজিজুল হক কলেজে আইএ ভর্তি হন। কলেজে ভর্তি হয়েই তিনি অধ্যক্ষ ভাষা বিজ্ঞানী ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহর সংস্পর্শে আসেন। ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ বগুড়া কলেজের আর্থিক সাহায্যের জন্য বিভিন্ন ইছালে ছওয়াবে বক্তৃতা দিতেন। প্রায় প্রতিটি জলসায় তালেবালেম হয়ে তাঁর সঙ্গী হতেন গাজীউল হক। এ থেকে যে অর্থ পাওয়া যেতো তা সম্পূর্ণ ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ কলেজের উন্নয়ন তহবিলে দান করতেন। পাশাপাশি কলেজের কয়েকজন শিক্ষক ছাত্রদের সাংস্কৃতিক বিকাশ ও মননশীলতার অনুশীলনের জন্য ‘শিল্পায়ন’ নামে একটি পাঠচক্র গড়ে তোলেন। যে ক’জন শিক্ষক এটি গড়ে তোলার জন্য উদ্যোগ নিয়েছিলেন তাঁদের মধ্যে ছিলেন অধ্যাপক আবুল খায়ের, অধ্যাপক গোলাম রসুল ও অধ্যাপক পৃথ্বিশ দত্ত। এই পাঠচক্রে অন্যান্য ছাত্রদের সঙ্গে গাজীউল হক, কবি আতাউর রহমান, তছিকুল আলম খান, জালাল উদ্দিন আকবর প্রমুখ নিয়মিত পড়াশুনা করতেন। সপ্তাহে একদিন রোববার এই পাঠচক্রে আসর বসতো। এই আসরে ছাত্ররা গল্প, কবিতা রচনাসহ আবৃত্তি করতেন।
১৯৪৭ সালের ৬ ও ৭ সেপ্টেম্বর ঢাকায় অসাম্প্রদায়িক যুব প্রতিষ্ঠান গণতান্ত্রিক যুবলীগের দুদিনব্যাপী কমী সম্মেলনের আয়োজন করে। গাজীউল হক বগুড়ার পাঠচক্র ‘শিল্পায়নে’র সদস্যদের সঙ্গে অংশ নেন। এই সম্মেলনে নেতৃত্ব দেয় তাসাদ্দুক হোসেন, মোহাম্মদ তোয়াহা, শামসুল হক প্রমুখ। সম্মেলনে প্রস্তাব পাঠ করেন শেখ মুজিবুর রহমান। যার অন্যতম প্রস্তাব ছিল ‘মাতৃভাষাই হবে শিক্ষার বাহন, অফিস আদালতের ভাষা হবে বাংলা।’ এভাবেই তিনি ভাষা আন্দোলনের একনিষ্ঠ কমী হিসেবে কাজ করেন। অন্যদিকে এসব কাজে জড়িয়ে পড়ায় পড়াশুনার প্রচুর ক্ষতি হয়েছে। এই ক্ষতি পুষিয়ে নেওয়ার জন্য তিনি আই.এ. পরীক্ষার পনের দিন আগে ঘরের দরজা জানালা বন্ধ করে পড়াশুনা শুরু করেন। পরীক্ষার ফল বেরুলে তাঁর প্রতিবেশীদের কয়েকজন জানালেন গাজীউল হক ফেল করেছে। তাঁর বাবা ছেলের কৃতিত্ব সম্পর্কে জানতেন। তিনি তাদের কথা বিশ্বাস করলেন না। বরং ধমকে দিলেন এই বলে তাঁর ছেলে এমন ফল করতেই পারে না। অবশেষে গাজীউল নিজে কলেজে গিয়ে জানলেন তিনি স্টার মার্কস নিয়ে পাশ করেছেন।
১৯৪৮ সালে তিনি বগুড়া কলেজ থেকে আই.এ. পাশ করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ইতিহাস বিষয়ে অর্নাসে ভর্তি হন। এরপরই সলিমুল্লাহ মুসলিম হলের আবাসিক ছাত্র হন। লেখাপড়ার পাশাপাশি ভাষা আন্দোলনে অংশ নেন। বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করার দাবিতে কারাবরণ করেন। ১৯৪৯ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের নিম্ন-বেতন কর্মচারিগণ ধর্মঘট আহবান করলে ছাত্রনেতাদের সঙ্গে তিনিও এর সমর্থন করেন। এই ধর্মঘট আন্দোলনে কেন্দ্রীয়ভাবে কার্যক্রম ও সিদ্ধান্ত নেওয়া হতো সলিমুল্লাহ মুসলিম হলের ১৬ নং কক্ষ থেকে। এই কক্ষটি গাজীউল হকের নামে বরাদ্দ ছিল। এখানে আসতেন ছাত্রনেতা অলি আহাদ, আবদুল হামিদ চৌধুরী, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান, আবদুর রহমান চৌধুরী, তাজউদ্দীন আহমদ প্রমুখ। ‘৪৯ এর এই ধর্মঘট আন্দোলনে নেতৃত্ব দেয়ার জন্যই বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে তাঁর ঘনিষ্ঠতা ও নিবিড় সম্পর্ক গড়ে ওঠে।
১৯৫১ সালে অর্নাস পাশ করে এম.এ.-তে ভর্তি হন। এবার তিনি ফজলুল হক হলের আবাসিক ছাত্র হন। বিশ্ববিদ্যালয়ের হলের উপস্থিত বক্তৃতা, আবৃত্তি, বির্তক প্রভৃতি প্রতিযোগিতায় অংশ নিয়ে খ্যাতি অর্জন করেন। গান গেয়েও গানের আসরকে মাতিয়ে তুলতেন। ১৯৫২ সালে তিনি এম.এ. পাশ করেন। কিন্তু ভাষা আন্দোলনে নেতৃত্ব দানের জন্য বিশ্ববিদ্যালয়ের কর্তৃপক্ষ তাঁর এম.এ. ডিগ্রি কেড়ে নেয়। পরবতীতে ছাত্রনেতা ইশতিয়াক (ব্যারিস্টার), মোহাম্মদ সুলতান, জিল্লুর রহমান (আওয়ামী লীগের নেতা) প্রমুখের প্রচণ্ড আন্দোলনের চাপে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ তাঁর এম.এ. ডিগ্রি ফেরত দিতে বাধ্য হয়।
১৯৫৩ সালে তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে আইন শাস্ত্রে ভর্তি হন। এ বছরের ১৪ এপ্রিল তাঁকে চার বছরের জন্য ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বহিষ্কার করে কারাগারে পাঠানো হয়। তবে ছাত্র আন্দোলনের চাপে কারাগারে থাকতেই তাঁর বহিষ্কারাদেশ প্রত্যাহার করে নেওয়া হয়। তবে বহিষ্কারাদেশের কারণে তিনি কারাগারে বসে আইন পরীক্ষা দেওয়ার সুযোগ পাননি। পরবতীতে বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য ড. জেংকিন্স ও রেজিষ্টার হাদী তালুকদারের আন্তরিক সহযোগিতায় ১৯৫৬ সালে তিনি একসঙ্গে ১১ পেপার আইন পরীক্ষা দেন। এরপরও তিনি কৃতিত্বের সঙ্গে কৃতকার্য হন। এরপরই তাঁর ছাত্রজীবনের পরিসমাপ্তি ঘটে।
পারিবারিক জীবন
গাজীউল হকের বাবা-মা, ভাই-বোনদের মধ্যে সম্পর্ক ছিল বন্ধুর মতো। বাবার সঙ্গে তিনি পড়াশুনা নিয়ে যেমন আলোচনা করতেন, তেমনি রাজনীতি নিয়েও আলোচনা করতেন। ভাইবোনদের পড়াশুনার প্রতি খেয়াল রাখতেন। শুধু তাই নয় পরিবারের সদস্যদের মধ্যে সাংস্কৃতিক আবহ গড়ে তোলেন। তিনি যেমন ভালো সেতার বাজাতে পারতেন, তেমনি ছোট বোন হীরা ও নিজাম ভাল গান গাইতেন। মাঝে মাঝে বাড়িতে ঘরোয়া জলসার আয়োজন করা হতো। সেই জলসায় তাঁর মা হারমোনিয়াম বাজিয়ে দরুদ শরীফ করতেন। তাঁর ছোট বোনের বিয়ে নিয়ে এক মজার ঘটনা আছে। তাঁর বড় ভাই ফরিদউদ্দিন সাকী ছোট বোন রানীর বিয়ে ঠিক করেন এক মৌলভীর সঙ্গে।
গাজীউল হক এ বিয়েতে অমত প্রকাশ করলেন। তাঁর অমতের কথা বাবাকে জানালেন। সেখানেই থেমে রইলেন না। বন্ধু মোজাহারুল ইসলাম আবুর সঙ্গে বোনের বিয়ের প্রস্তাব নিয়ে আবুর বাবার কাছে গেলেন। আবুর বাবা গাজীউল হকের প্রস্তাব সানন্দে গ্রহণ করলেন। কয়েকদিনের মধ্যে মোজাহারুলের সঙ্গে ধুমধামে বোনের বিয়ে দেন। বিয়ের পর মাঝে মাঝে বোন বোনের জামাইসহ তাঁদের বাড়িতে বেড়াতে আসতেন। তিনি আগে থেকে তাঁদের আসার খবর জানতে পারলে সেতার নিয়ে বাজাতে বসতেন। আর মজা করে বলতেন, ‘তোমরা আসবে জেনেই এই আগমনী সুর বাজাচ্ছি।’
তাঁদের বাড়ির খুব কাছেই ছিল কাটনাপাড়ার নামাযগড়। এখানে তাঁর এক রাজনৈতিক বন্ধু বাস করতেন। নাম আবু মুসা জহুরুল হক। আবু মুসার বাবা ছিলেন আইনজীবী। বগুড়াতেই তিনি প্র্যাকটিস করতেন। তিনি তাঁর তৃতীয় কন্যা জাহানারা বেগম এলিনার বিয়ের জন্য পাত্রের খোঁজ করছেন। এলিনা সবে বগুড়ার আজিজুল হক কলেজ থেকে বি.এ. পরীক্ষা দিয়েছেন। একদিন কথা প্রসঙ্গে এলিনার বড় ভাই আবু মুসা গাজীউল হককে বলেন, ‘গাজী তুই কী আমার বোনকে বিয়ে করবি?’ তিনি কনে না দেখেই তত্ক্ষনাত্ হ্যাঁ করেন। তখনি বন্ধু আবু মুসা বলেন, ‘আমার বোনকে দেখবি না?’ গাজীউল হক প্রতি-উত্তরে বলেন, ‘তোর বোন কানা হোক, ন্যাংড়া হোক, আমি বিয়ে করব। আমি যখন বলছি, তাহলে বিয়ে করব।’
১৯৫৭ সালের ২৫ মার্চ ছিল গাজীউল হকের বাবার মৃত্যুবার্ষিকী। এ উপলক্ষে বাড়িতে ওরস হচ্ছে। ওরস চলাকালীন সময়ে তাঁর মা হঠাত্ করে অজ্ঞান হয়ে যায়। এদিকে তাঁকে দেখাশোনা করার কেউ নেই। এসব দেখে আত্মীয়-স্বজন সবাই বিচলিত হয়ে ওঠেন। তখনই তাঁরা সিদ্ধান্ত নেয় বাচ্চুকে (গাজীউল হকের ডাক নাম) বিয়ে করাতে হবে। গাজীউল হকের চাচা সে সময়ে ওরসে উপস্থিত ছিলেন। তখনই তাঁরা নিজেদের মধ্যে প্রাথমিক কথাবার্তা আলোচনা করে আবু মুসাকে বিয়ের দিন ঠিক করার পরামর্শ দেন। তিন দিনের মাথায় ২৮ মার্চ জাহানারা বেগম এলিনার সঙ্গে গাজীউল হকের বিয়ে হয়। তাঁদের চার মেয়ে, এক ছেলে।
১৯৫৮ সালের শেষ দিকে তিনি তাঁর স্ত্রীকে নিয়ে ঢাকায় স্ত্রীর বড় বোনের বাসায় বেড়াতে আসেন। তাঁর জেঠাস জাহেরা বেগম পেশায় চিকিত্সক ছিলেন এবং তাঁর স্বামী কামরুল ইসলাম ছিলেন আইনজীবি। তাঁরা থাকতেন সুত্রাপুর থানার রূপচাঁদ লেনের একটি বাড়িতে। বাড়ির ছাদে বসে বিকেলবেলা সবাই মিলে গল্প করছেন। গল্পের রেশ ধরেই গাজীউল হক বারবার হেসে উঠছিলেন। তাঁর হাসির শব্দ অনেক দূর থেকে শোনা যাচ্ছিল। এই বাড়ির কয়েকটি বাড়ির পরে একটি বাসায় রণেশ দাশ গুপ্ত এবং সত্যেন সেন বেড়াতে এসেছেন। তাঁরা গাজীউল হকের হাসির শব্দ শুনে চিনে ফেলে এখানেই কাছের কোনো বাড়িতে গাজীউল হক আছে। এটিতো গাজীউল হকের হাসির শব্দ। তাঁরা দেরি করলেন না খোঁজে বেরিয়ে পরলেন। খুঁজতে খুঁজতে তাঁকে আবিষ্কার করলেন কামরুল ইসলামের বাসায়।
বড় মেয়ের বয়স যখন নয় মাস তখন তিনি জেলে যান। স্ত্রী এলিনা শাশুড়ি ও মেয়েকে নিয়ে মাঝে মাঝে জেলখানায় গাজীউল হকের সঙ্গে দেখা করতে যেতেন। তিনি জেলখানায় মেয়েকে দেখামাত্র ছোট্ট হাতে একটা চকোলেট ও একটা ফুল তুলে দিতেন। একবার ঘটল অন্যরকম ঘটনা। ছোট্ট নতুনা একটু একটু করে হাঁটতে শিখেছে। শাশুড়ি ও নতুনাকে নিয়ে স্ত্রী তাঁর সঙ্গে বগুড়া কেন্দ্রীয় কারাগারে দেখা করতে যান। গাজীউল হক সেদিন একটি বিশেষ কারণে চিন্তিত ছিলেন। জেলার তাঁকে বন্ড দেবার জন্য চাপ দিচ্ছে। বন্ডে লিখতে হবে তিনি আর রাজনীতি করবেন না। বন্ড না দিলে তারা তাঁকে ছাড়বে না। তিনিও কিছুতেই বন্ড দেবেন না। এই বিষয়টি তিনি সিগারেটের চিকচিক কাগজের মধ্যে ছোট্ট একটু চিরকুট লিখেছেন। তিনি চিরকুটে এক শিক্ষকের নাম উল্লেখ করে লিখেছেন, ‘তোমরা তাঁর কাছে যাও। তিনি হয়তো জেল থেকে আমার বের হওয়ার একটা ব্যবস্থা করে দিতে পারবেন যাতে এই বন্ডটা না দিতে হয়।’ এজন্য তিনি স্ত্রীকে দেখা করতে ডেকেছেন। এই চিরকুটটা তিনি স্ত্রীকে দিবেন। কিন্তু কীভাবে? একটি বড় টেবিলের এককোণে বসেছেন গাজীউল হক। অন্যকোণায় জেলার। আর একপাশে স্ত্রী এবং অন্যপাশে মা। নার্ভাসে তাঁর কপাল জুড়ে ঘাম জমতে থাকে। এ কারণে তিনি সেদিন মেয়ের জন্য চকোলেট ও ফুল আনতে ভুলে গেছেন। প্রতিদিনের অভ্যাস মতো নতুনা বাবার কাছ থেকে চকোলেট ও ফুল না পাওয়ায় বারবার কাছে গিয়ে বায়না ধরে। তাঁর ভেতর অস্থিরতা কাজ করছিল এই ভেবে চিরকুটটি স্ত্রীকে দেবার সময় যদি জেলারের কাছে ধরা পড়ে যায় তাহলে তাঁকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড ভোগ করতে হতে পারে। অস্থিরতায় বারবার রুমাল দিয়ে মুখের ঘাম মুছেন। এলিনা স্বামীর আচরণ দেখে উদ্বিগ্ন হন। তিনি সেদিন একটি নতুন শাড়ি পড়ে গিয়েছিলেন। এর আগে গাজীউল স্ত্রীকে এই শাড়িটি কখনো পরতে দেখেননি।এই সুযোগটি তিনি পুরোপুরি কাজে লাগালেন। শাড়ি দেখার ভঙ্গীতে তিনি একটু কাত হয়ে চিরকুটটি স্ত্রীর কোলে ফেলে দেন। এলিনা চিরকুটটি দেখতে পেয়ে হাতের মধ্যে নিয়ে স্বামীর দিকে তাকিয়ে একটু হাসেন। স্ত্রীর মুখে হাসি দেখে তিনি এবার স্বস্তি পান। গাজীউল হক জেলখানায় বেশিরভাগ সময় থাকার পরও তাঁদের দুজনের মধ্যে এমনি একটি সমঝোতা ছিল।
১৯৬০-৬১ সালের ঘটনা। গাজীউল হককে বগুড়া জেল থেকে রাজশাহী জেলে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে। জেলার ছিলেন বাঙালি। তিনি গাজীউল হকের বাড়িতে লোক মারফত সংবাদ পাঠালেন স্টেশনের একটি হোটেলে তাঁকে নাশতা খাওয়াতে নিয়ে যাওয়া হবে। তাঁরা সাক্ষাত্ করতে চাইলে দ্রুত এসে দেখা করে যেতে পারেন। স্ত্রী এলিনা খবর পাওয়ামাত্র যেভাবে ছিলেন সেভাবেই শাশুড়িকে নিয়ে স্বামীর সঙ্গে দেখা করতে ঐ হোটেলে আসেন। মা স্ত্রী সন্তানকে পাঁচ মিনিট সময়ের জন্য চোখের দেখা তাঁকে অনেকটা শান্তি দেয়।
বড় মেয়ের বয়স যখন তিন বছর তখন তিনি কারাগার থেকে বেরিয়ে আসেন। বড় মেয়েকে বগুড়া ভি এম গার্লস স্কুলে ভর্তি করাতে গিয়ে তিনি এক নতুন অভিজ্ঞতার সম্মুখীন হন। তিনি মেয়ের নাম রাখেন নতুনা হক। ইসলামি নাম না হওয়ায় বিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের এই নাম পছন্দ হলো না। প্রধান শিক্ষক সরাসরি বললেন, ‘এটি বাংলা নাম। বাংলা নামে আপনার মেয়েকে ভর্তি করাব না। নাম বদলে আসলে আমরা ভর্তি করাতে পারি।’ গাজীউল হক বিদ্যালয় কর্তৃপক্ষকে পাল্টা জবাব দেন, ‘আমার মেয়ে যদি এই নামে ভর্তি হতে পারে তাহলে ভর্তি হবে। তা না হলে আমার মেয়ে বাসায় পড়াশুনা করবে। আমার মেয়েকে এই বিদ্যালয়ে পড়াব না।’ এই কথা বলে তিনি মেয়েকে নিয়ে বাড়ি চলে এলেন। পরবতীতে ভিএম গার্লস স্কুলের প্রধান শিক্ষিকা বাসায় লোক মারফত খবর পাঠালেন তারা মেয়েকে ভর্তি করাবেন।
মুক্তিযুদ্ধের পর তিনি সপরিবারে ঢাকায় এসে বসবাস শুরু করেন। বড় মেয়ে নতুনা হক, মেজ মেয়ে সুজাতা হক, তৃতীয় মেয়ে সুতনুকা হক ও ছোট মেয়ে সুমনিকা হক আর একমাত্র ছেলে রাহুল গাজী।
রাজনীতি, আইন ব্যবসা নিয়ে তাঁর ব্যস্ত সময় কাটলেও সন্তানদের তিনি সময় দিতেন। ছেলেমেয়েদের নিয়ে ঈদের কেনাকাটা করতে বেরুতেন। সুন্দর সুন্দর জামাকাপড় কিনে দিয়েই কেনাকাটা শেষ করতেন না। ঈদে সাজার জন্য চুড়ি, ফিতে, ক্লিপ, নেলপলিশ যার যেটা পছন্দ তা কিনে দেবার জন্য ছেলেমেয়েদের সঙ্গে করে নিয়ে দোকানে ছেড়ে দিতেন। তারা যেন তাদের পছন্দমতো জিনিসটি কিনতে পারে। ছেলেমেয়েরাও মহোল্লাসে যা পছন্দ হতো তাই কিনে নিতো। বাড়তি জিনিস কিনে ছেলেমেয়েরা টাকা অপচয় করেছে এ নিয়ে তিনি কখনও ভাবতেন না। বরং সন্তানদের খুশি দেখেই তিনি আনন্দিত হতেন।
রাজনৈতিক জীবন
গাজীউল হক ১৯৪১ সালে ছাগলনাইয়া স্কুল থেকেই রাজনীতি অঙ্গনে প্রবেশ করেন। এর পরের বছর পারিবারিক কারণে বগুড়ায় এসে বসবাস শুরু করেন। ফলে কয়েকদিনের মধ্যেই বগুড়ার রাজনীতিতে তাঁর প্রবেশ ঘটে। বগুড়া আজিজুল হক কলেজে ভর্তি হবার সময় অধ্যক্ষ হিসেবে পান ড. মুহাম্মদ শহীদুল্লাহকে। তাঁর সংস্পর্শে এসে গাজীউল হক বাম রাজনীতিতে জড়িয়ে পড়েন। ১৯৪৪ সালে তিনি বঙ্গীয় মুসলিম ছাত্রলীগ বগুড়া জেলা শাখার যুগ্ম সম্পাদক নিযুক্ত হন। একই বছর কুষ্টিয়ার নিখিল বঙ্গ মুসলিম ছাত্রলীগের কনফারেন্সে তিনি যোগ দেন। এখানেই বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সাথে তাঁর প্রথম পরিচয় হয়।
১৯৪৬ সালে তিনি ধুবড়িতে অনুষ্ঠিত আসাম মুসলিম লীগ কনফারেন্সে যোগ দেন। এখানে তিনি মাওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানীর ব্যক্তিত্ব, বাগ্মীতা এবং নেতৃত্বে আকৃষ্ট হন। এর ছয় মাস পর বাহাদুরাবাদ ঘাটে অনুষ্ঠিত মুসলিম লীগের অপর একটি সম্মেলনে তিনি অংশ নিলে মাওলানা ভাসানীর সঙ্গে তাঁর ব্যক্তিগতভাবে পরিচয় ও ঘনিষ্ঠতার সূত্রপাত হয়। পাকিস্তান হওয়ার পর অধিকাংশ মুসলিম ছাত্র বাম রাজনীতির সঙ্গে জড়িয়ে পড়েন। গাজীউল হকও সেই রাজনীতিতে অংশ নেয়৷। ১৯৪৭ সালে তিনি পূর্ব পাকিস্তান গণতান্ত্রিক যুব লীগের ঈশ্বরদী কনফারেন্সে উত্তরবঙ্গ শাখার যুগ্ম-সম্পাদক নির্বাচন হন।
১৯৪৮ সালে পূব-পাকিস্তান মুসলিম ছাত্রলীগের বগুড়া জেলা শাখার সভাপতি হন। এ বছরই প্রথম বাংলা ভাষার দাবিতে প্রদেশব্যাপী আন্দোলনের ডাক দেওয়া হয়। ড. মুহাম্মদ শহীদুল্লাহ তাঁকে বগুড়ার ছাত্রদের ভাষা আন্দোলনে সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণে নেতৃত্বদানের জন্য উদ্বুদ্ধ করেন। বগুড়াতে কবি আতাউর রহমানকে আহ্বায়ক করে একটি ‘বাংলা ভাষা সংগ্রাম কমিটি’ গঠন করা হয়। এই কমিটিতে শিক্ষক ও ছাত্র ছাত্রী প্রতিনিধি ছিলেন। বগুড়ায় দু’জন ছাত্রী রহিমা খাতুন ও সালেহা খাতুন এই কমিটিতে ছিলেন। ১১ মার্চ গাজীউল হক বগুড়া কলেজ থেকে ছাত্রদের মিছিল নিয়ে বগুড়া শহরের দিকে এগিয়ে যান। তখন ড. শহীদুল্লাহ রিকশায় চড়ে কলেজের দিকে আসছিলেন। গাজীউল হক ছাত্রদের নিয়ে তাঁর রিকশা থামিয়ে তাঁকে মিছিলে নেতৃত্ব দিতে অনুরোধ করেন। ড. শহীদুল্লাহ ছাত্রদের এই অনুরোধে সম্মতি জানিয়ে রিকশা থেকে নেমে মিছিলে অংশ নেন। সঙ্গে সঙ্গে মিছিলে অংশগ্রহণকারী কর্মীরা তুমুল করতালির মধ্য দিয়ে তাঁকে অভিনন্দন করেন। তিনি গাজীউল হকের দিকে তাকিয়ে তাঁর স্বভাবসুলভ ঢঙ্গে বলেন, ‘মানে কি যে অ্যাঁ আমাকে কি করতে হবে?’ গাজীউল হক বললেন, ‘স্যার, আপনাকে মিছিলের নেতৃত্ব দিতে হবে এটা আমাদের দাবি।’ তিনি কিছুক্ষণ ভাবলেন এরপর একটু হেসে তাঁর চিরপরিচিত সেই ব্যাগটি গাজীউল হকের হাতে দিয়ে বললেন, ‘মানে কি যে আঁওপীর সাহেব, তাহলে তুমি আমার বোঝাটা নাও আর আমি তোমার বোঝাটা নিয়ে নিলুম।’
বগুড়া জেলা স্কুল ময়দানে সেদিনের সভার সভাপতি ছিলেন ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ। সভাপতি হিসেবে বাংলাকে রাষ্ট্র্রভাষা করার দাবির স্বপক্ষে দীর্ঘ সময়ব্যাপী যুক্তি ও তথ্য নির্ভর ভাষণ দেন। এই ভাষণ সেদিন জনসমাবেশকে বিমোহিত করে। প্রদেশব্যাপী বামপন্থী প্রগতিশীল আন্দোলন যখন দানা বেঁধে উঠেছিল, সেই সময়ে বগুড়া থেকে গাজীউল হক, আবু মো. মজাহারুল ইসলাম, আতাউর রহমান (বগুড়া), তাছিকুল আলম খান (সম্পাদক অগত্যা মাসিক), জামালউদ্দিন আকবর প্রমুখ ঢাকায় ডেমোক্রেটিক ইকুথ লীগ কনভেশনে যোগ দেন। তত্কালীন প্রধানমন্ত্রী নূরুল আমিন প্রকাশ্যে পাবলিক হলে ডেমোক্রেটিক ইয়ুথ লীগের কনভেশন করতে বাধা দেওয়ায় অনুষ্ঠানটি ইয়ার মোহাম্মদ খানের বাসায় অনুষ্ঠিত হয়। এখানে ডেমোক্রেটিক ইয়ুথ লীগ গঠিত হয়। তিনি কমিউনিস্ট পার্টির কয়েকজন প্রথম সারির নেতা মনি সিং, খোকা রায়, আবদুল কাদের চৌধুরী, আলতাফ হোসেন, রণেশ দাশ গুপ্ত প্রমুখের সঙ্গে গোপনে যোগাযোগ করে কর্মকাণ্ড চালিয়ে যান।
ওই সময়ে বগুড়ার যুব ছাত্রলীগের ভেতরে প্রগতিশীল আন্দোলনকে চাঙ্গা করার জন্য আরেকটি সংগঠন গড়ে উঠেছিল। তার নাম ‘প্রগতিশীল লেখক ও শিল্পী সংঘ’। এর বৈঠক হতো বগুড়া কলেজের ইসলামিক ইতিহাসের অধ্যাপক আবুল খায়ের আহম্মদ-এর বাসায়। এই আসরে গাজীউল হক, কবি আতাউর রহমান, ব্যঙ্গ লেখক তাছিকুল আলম খান, জালালউদ্দিন আকবর, কমিউনিস্ট আবদুল মতিন, শ্যামাপ্রসাদ সেন, মমতাজ উদ্দীন তরফদার প্রমুখ তাঁদের স্বরচিত লেখা পাঠ করতেন।
১৯৪৯ সালে তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র। এসময় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় নিম্ন কর্মচারীরা ধর্মঘট আহ্বান করে। বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রসমাজ কর্মচারীদের এই ধর্মঘটের সমর্থনে ধর্মঘট করে। মার্চ মাসের দ্বিতীয় সপ্তাহের প্রথম দিকে আবদুর রহমান চৌধুরীর সভাপতিত্বে বিশ্ববিদ্যালয় প্রাঙ্গণে একটি সভা হয়। এই সভায় বিশ্ববিদ্যালয় নিম্ন কর্মচারীদের দাবি-দাওয়া পূরণ না হওয়া পর্যন্ত উপাচার্যের বাসভবনে অবস্থান ধর্মঘটের সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়। এই সিদ্ধান্ত অনুযায়ী অবস্থান ধর্মঘট চলতে থাকে। এই কারণে ১০ মার্চ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কতর্পক্ষ ১১ মার্চ থেকে বিশ্ববিদ্যালয় অনির্দিষ্ট কালের জন্য বন্ধ করে দেয়। এসময় গাজীউল হক সলিমুল্লাহ মুসলিম হলের দোতলায় পূর্ব দিকে ১৬ নং কক্ষের আবাসিক ছাত্র। এই কক্ষে দুটি সিট ছিল। একটি গাজীউল হকের অন্যটি আলী আশরাফের। বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধ ঘোষণা করায় আলী আশরাফ হল ছেড়ে চলে যান। তাঁর সিট দখল করেন শেখ মুজিবুর রহমান। তাঁরা দুজনে ১৬ নং কক্ষে থেকেই আন্দোলনে অংশ নেন।
১৯৪৯ সালের অক্টোবরে দেশে দুর্ভিক্ষ দেখা দেয়। এ মাসের ১১ তারিখে ঢাকার আরমানিটোলা ময়দান থেকে মাওলানা ভাসানীর নেতৃত্বে একটি ভুখা মিছিল বের হয়। এই মিছিলে গাজীউল হকও শরিক হন। মাওলানা ভাসানীর সঙ্গে তিনি প্রথম সারিতে ছিলেন। মিছিল থেকে মাওলানা ভাসানী ও বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে গ্রেফতার করা হয়। ১৯৫০ দশকে তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাম আন্দোলনে জড়িয়ে পড়েন। যদিও তিনি কমিউনিস্ট পার্টির সদস্য ছিলেন না।
গাজীউল হক ১৯৫৪ সালের যুক্তফ্রন্টের নির্বাচনী প্রচারণায় অংশ নিয়ে বগুড়ার মুসলিম লীগকে পূর্ব বাংলার সবচেয়ে শক্তিশালী ঘাঁটিতে পরিণত করেন। শুধু তাই নয় কাগমারী সম্মেলনে ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি গঠনে আওয়ামী লীগের সর্বাঙ্গীন প্রতিকূলতা প্রতিরোধে ভাসানীর ঘনিষ্ঠ সহকর্মী হিসেবে কাজ করেন এবং এই পার্টি গঠনে তাঁর ভূমিকা ছিল অতুলনীয়।
কর্মজীবন
১৯৫৭ সালে আইনজ্ঞ সৈয়দ নওয়াব আলীর অধীনে বগুড়া বারে যোগদানের মধ্য দিয়ে তাঁর কর্মজীবন শুরু হয়। ১৯৬৩ সালের মার্চ মাসে পূর্ব-পাকিস্তান ঢাকা হাই কোর্টে আইন ব্যবসায়ের সনদ লাভ করেন। ১৯৭২ সালে তিনি বাংলাদেশ সুপ্রীম কোর্টে যোগদান করেন। সর্বোচ্চ আদালতে একজন আইনজীবী হিসেবে দক্ষতার সঙ্গে আইন ব্যবসা পরিচালনা করেন।
সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা প্রতিরোধে অংশগ্রহণ
১৯৫০ সালের ফেব্রুয়ারি মাসের ১০ তারিখে ঢাকার নবাবপুর, ইসলামপুর, পাটুয়াটুলি, লক্ষ্মীবাজার, বনগ্রাম এলাকায় দাঙ্গা ভয়াবহ আকার নেয়। এ দাঙ্গায় বহু হিন্দু নিহত হয়। এই দাঙ্গার প্রথম দিনেই বিশ্ববিদ্যালয় এলাকা থেকে একটি দাঙ্গা বিরোধী মিছিল বের হয়। খালেক নেওয়াজ খানের নেতৃত্বে ‘পূর্ব পাকিস্তান মুসলিম ছাত্র লীগে’র কয়েকজন ছাত্র রাস্তায় বের হয়। মেডিকেল কলেজের অধিকাংশ ছাত্র ড. গোলাম মওলার নেতৃত্বে শান্তি মিছিলে যোগ দেন। ফজলুল হক মুসলিম হল থেকেও কয়েকজন ছাত্র মোশাররফ হোসেন, আবদুল মোমিনের নেতৃত্বে মিছিলে যোগ দেন। সলিমুল্লাহ মুসলিম হল থেকে গাজীউল হক, সৈয়দ মোহাম্মদ আলী, রুহুল আমিন কায়সার, গোলাম কিবরিয়া, খন্দকার গোলাম মোস্তফা, সাদেক খান, নাজির হোসেনসহ কয়েকজন ছাত্র দাঙ্গা বিরোধী মিছিলে যোগ দেবার জন্য বের হতেই পূর্ব-পাকিস্তান মুসলিম ছাত্রলীগের কিছু ছাত্র রুহুল আমিন কায়সারকে হিন্দুর দালাল বলে মারধর করতে উদ্যত হয়। গাজীউল হকের হস্তক্ষেপেই রুহুল আমিন রক্ষা পান।
প্রচণ্ড বাধা সত্ত্বেও তাঁরা একটি দাঙ্গা প্রতিরোধ কমিটি গঠন করেন। সেই সঙ্গে একটি শান্তি কমিটিও গঠন করা হয়। এই শান্তি কমিটির সভাপতি হন ড. কাজী মোতাহার হোসেন। ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ, অধ্যাপক মাহমুদ, ড. নূরুল হুদা, অধ্যাপক নাজমুল করিম এবং আরো অনেকেই এ কমিটিতে ছিলেন। শান্তি কমিটির উদ্যোগে ১২ ফেব্রুয়ারি বিশ্ববিদ্যালয় প্রাঙ্গণে ড. কাজী মোতাহার হোসেনের সভাপতিত্বে একটি সভা অনুষ্ঠিত হয়। সভা চলাকালীন সময়ে বক্তারা যখন দাঙ্গার বিরুদ্ধে বক্তৃতা দেন তখন একজন শান্তিনিকেতনী কবির নেতৃত্বে নিখিল পূর্ব পাকিস্তান মুসলিম ছাত্রলীগের কিছু ছাত্র এই সভায় আক্রমণ চালায়। গাজীউল হক কয়েকজন ছাত্র নিয়ে দাঙ্গাকারীদের প্রতিহত করার জন্য পাল্টা আক্রমণ চালায়। এই পরিস্থিতিতে টিনের চোঙ্গা নিয়ে কবি হাসান হাফিজুর রহমান দাঙ্গাকারীদের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়েন। অন্যদিকে ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ দাঙ্গা সমর্থকদের হটিয়ে দেবার পর টেবিলের ওপর দাঁড়িয়ে বলেন, ‘আমি কোরান হাদিস পড়েছি, আমি চ্যালেঞ্জ করছি কেউ যদি কোরান কিংবা হাদিস থেকে দেখাতে পারে যে নিরীহ এবং নিরস্ত্র হিন্দুদেরকে হত্যা করা পুণ্যের কাজ তবে আমি তার দাসত্ব স্বীকার করবো।’ গাজীউল হক ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহর দৃঢ়তা দেখে অভিভূত হয়ে যান।
১৯৫১ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে আরও একটি ঘটনা ঘটে। এই বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ডক্টর পি সি চক্রবতীকে সরকার পূর্ববঙ্গ থেকে বহিষ্কারের নোটিশ প্রদান করে। এর প্রতিবাদে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্ররা একটি মিছিল বের করে। এই মিছিলে গাজীউল হকও অংশ নেন। মিছিল শেষে বিশ্ববিদ্যালয়ে হাবিবুর রহমান শেলীর সভাপতিত্বে একটি সভা হয়। উক্ত সভায় শিক্ষকদের ওপর সরকারি হামলার নিন্দা করা হয়। কিন্তু পরবতীতে পিসি চক্রবতীকে দেশ ছেড়ে যেতে সরকার বাধ্য করেন। গাজীউল হকসহ অন্যান্য ছাত্ররা তা ঠেকাতে পারেননি।
বায়ান্নো’র ভাষা আন্দোলন
১৯৫০ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করার দাবিতে বিশ্ববিদ্যালয় রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম কমিটি নামে একটি কমিটি গঠন করা হয়। আবদুল মতিনকে এই কমিটির আহ্বায়ক নিযুক্ত করা হয়। বিশ্ববিদ্যালয় রাষ্ট্রভাষা কমিটির উদ্যোগে ১৯৫০ সালের ১১ মার্চ রাষ্ট্রভাষা দিবস ঘোষণা করা হয়। ১৯৫২ সালের ২৬ জানুয়ারি পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী খাজা নাজিমউদ্দীন ঢাকায় এসে পল্টনের জনসভায় মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ ঘোষণা দেন ‘উর্দু এবং উর্দুই হবে পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা’। এর প্রতিবাদে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতিটি ছাত্র হলে ছাত্রসভা অনুষ্ঠিত হয় এবং ৩০ জানুয়ারি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্র ধর্মঘট ঘোষণা করা হয়। ঘোষণানুযায়ী বিশ্ববিদ্যালয়ের আমতলায় এক ছাত্রসভা অনুষ্ঠিত হয়। গাজীউল হকও সেই সভায় অংশ নেয়। সভা শেষে ছাত্ররা মিছিল নিয়ে ফুলার রোড হয়ে পূর্ব পাকিস্তানের মুখ্য মন্ত্রী নূরুল আমীনের বাসভবনের সামনে (বর্তমান বাংলা একাডেমী ) বিক্ষোভ প্রদর্শন করে।
এদিনই ঢাকা মোক্তার বার লাইব্রেরিতে সর্বদলীয় রাষ্ট্রভাষা কর্মপরিষদ গঠন করা হয়। এতে আওয়ামী মুসলিম লীগ, খেলাফতে রাব্বানী, তমদ্দুন মজলিস, পূর্ব-পাকিস্তান যুবলীগ, পূর্ব-পাকিস্তান মুসলিম ছাত্রলীগ প্রভৃতি দল থেকে দু’জন করে প্রতিনিধি এবং প্রতিটি হল থেকে দু’জন করে হল ইউনিয়নের সভাপতি এবং সাধারণ সম্পাদক এ পরিষদের সদস্য নির্বাচিত হন।
সভায় সিদ্ধান্ত অনুসারে ৪ ফেব্রুয়ারি সারা ঢাকা শহরে ছাত্র ধর্মঘট অনুষ্ঠিত হয়। বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠান থেকে দলে দলে ছাত্র মিছিল করে বিশ্ববিদ্যালয়ের আমতলায় এসে সমবেত হয়। এই সভার সভাপতিত্ব করেন গাজীউল হক। এর পেছনেও একটি মজার ঘটনা রয়েছে। মিছিলবিরোধী পূর্ব-পাকিস্তান মুসলিম ছাত্রলীগের সদস্যগণ যাতে কোনো রকম সুযোগ না পায় এজন্য যুবলীগ ও অন্যান্য প্রগতিশীল ছাত্ররা বেশ তত্পর ছিলেন। মধুদার ক্যান্টিন থেকে বিশ্ববিদ্যালয়ের আমতলায় একটি ছোট টেবিল আনা হয়। মধুদার ক্যান্টিন থেকে টেবিল আনার পর চেয়ারের জন্য অপেক্ষা করতে থাকেন খালেক নেওয়াজ খান। তাঁর সঙ্গে পূর্ব-পাকিস্তান মুসলিম ছাত্রলীগের অন্যান্য কমীরাও অপেক্ষা করছেন।
চেয়ার এসে সভাস্থলে পৌঁছানোর আগেই এম আর আখতার মুকুল টেবিলের ওপর লাফিয়ে উঠে সভাপতি হিসেবে গাজীউল হকের নাম প্রস্তাব করেন। এরপরেই কমরুদ্দীন শহুদ পায়ের আঙ্গুলের ওপর ভর করে উচুঁ হয়ে হেঁড়ে গলায় প্রস্তাবটি সমর্থন করেন। এম আর আখতার মুকুল টেবিল থেকে নেমে পড়ার সঙ্গে সঙ্গে গাজীউল হক টেবিলের ওপর লাফিয়ে উঠে দু’মিনিট বক্তৃতা করেই মিছিলের কর্মসূচি ঘোষণা করেন। সভা শেষে ১০ সহস্রাধিক ছাত্র-ছাত্রীর এক বিরাট শোভাযাত্রা ঢাকা শহর প্রদক্ষিণ করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বেলতলায় সমবেত হয়। এখানে সভার সভাপতি হিসেবে গাজীউল হক বিশ্ববিদ্যালয় রাষ্ট্রভাষা কমিটির পক্ষ থেকে বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করার দাবিতে প্রদেশব্যাপী ২১ ফেব্রুয়ারি সারা পূর্ব-পাকিস্তান ছাত্র ধর্মঘট পালনের আহবান জানান। সবদলীয় রাষ্ট্রভাষা কর্মপরিষদ প্রদেশব্যাপী ছাত্র ধর্মঘটের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে।
২০ ফেব্রুয়ারি বেলা ৩টায় পূর্ব পাকিস্তান সরকারের পক্ষ থেকে ঢাকায় ১৪৪ ধারা জারি করে। সরকার কর্তৃক ২১ ফেব্রুয়ারিতে সভা মিছিল বন্ধ করে ১৪৪ ধারা জারির ঘোষণায় ঢাকায় ছাত্র সমাজ বিক্ষুব্ধ হয়ে ওঠে। সেদিন প্রতিটি ছাত্রাবাসে ১৪৪ ধারা জারিকে নিন্দা করে প্রস্তাব গ্রহণ করা হয়। সন্ধ্যার পর ৯৪ নং নবাবপুর রোডে সর্বদলীয় রাষ্ট্রভাষা কর্মপরিষদের এক সভা আবুল হাশিমের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত হয়। অধিকাংশ সদস্য ১৪৪ ধারা ভঙ্গের বিরুদ্ধে মত প্রদান করলে প্রস্তাবটি ভোটের মাধ্যমে সিদ্ধান্তের ব্যবস্থা করা হয়। ১৫ জন সদস্যের মধ্যে মোহাম্মদ তোয়াহা ১৪৪ ধারা ভঙ্গের পক্ষে বক্তব্য রাখলেও কোন পক্ষকেই ভোট দানে বিরত থাকেন। ১৫ জন সদস্যের মধ্যে ৪ জন সদস্য ১৪৪ ধারা ভঙ্গের পক্ষে ভোট দেন। তাঁরা হলেন- অলি আহাদ, আবদুল মতিন, ডা. গোলাম মওলা ও শামসুল আলম।
ভোটাধিক্যে ১৪৪ ধারা ভঙ্গের প্রস্তাব নাকচ হয়ে যাওয়ার সংবাদ বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায় পৌঁছলেই গাজীউল হক কয়েকজন ছাত্রের মাধ্যমে ১০ জন ছাত্রনেতাকে ডেকে আনেন। ফজলুল হক মুসলিম হল এবং ঢাকা হলের মধ্যবতী পুকুরের পূবদিকের ঘাটে মিলিত হয়ে অবস্থার পর্যালোচনা করে ২১ ফেব্রুয়ারি ১৪৪ ধারা ভঙ্গের সিদ্ধান্ত নেয়। এই সভায় উপস্থিত ছিলেন গাজীউল হক, এম আর আখতার মুকুল, মোহাম্মদ সুলতান, এস এ বারী এটি, কমরুদ্দিন শহুদ, আনোয়ারুল হক খান, জিল্লুর রহমান, আবদুল মোমিন, আনোয়ার হোসেন, ডা. মঞ্জুর, হাবিবুর রহমান শেলী। এই এগারজন সদস্যের মধ্যে গাজীউল হকসহ কয়েকজনের নামে ওয়ারেন্ট ইস্যু হওয়ার কারণে এই সভায় সিদ্ধান্ত হয় যে, গাজীউল হক ২১ ফেব্রুয়ারির সভায় সভাপতিত্ব করবেন। কোনো কারণে তিনি যদি গ্রেফতার হয়ে সভায় উপস্থিত হতে না পারেন তাহলে এম, আর আখতার মুকুল সভাপতি হবেন। তিনিও যদি উপস্থিত হতে না পারেন তাহলে কমরুদ্দিন শহুদ সভাপতিত্ব করবেন।
আর একটি প্রস্তাব গৃহীত হয় যে সত্যাগ্রহের মাধ্যমে ১৪৪ ধারা ভঙ্গ করা হবে এবং প্রথম দলটির নেতৃত্ব দেবেন হাবিবুর রহমান শেলী। রাতে পুকুর পাড়ে এই বৈঠক শেষ হবার পর আবদুল মোমিন গাজীউল হককে ফজলুল হক হলে অবস্থান না করে বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে গিয়ে রাত যাপন করতে বলেন। কেননা তিনি যদি হলে থাকার কারণে গ্রেফতার হন, তাহলে পরদিনের সভায় উপস্থিত হতে পারবেন না। এতে অত্যন্ত ক্ষতিকর পরিস্থিতির সৃষ্টি হতে পারে। এই সিদ্ধান্তানুযায়ী গাজীউল হক রাতে হলে অবস্থান না করে বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে অবস্থান করেন। সেখানে রাত কাটিয়ে ২১ ফেব্রুয়ারি সকালে মধুর ক্যান্টিনে চলে আসেন। এখানে মধুদার দেওয়া চা নাশতা খেয়ে সভাস্থলে উপস্থিত হন। দলে দলে বিভিন্ন স্কুল কলেজের শিক্ষাথীরা বিশ্ববিদ্যালয় প্রাঙ্গণে সমবেত হতেই গাজীউল হকের সভাপতিত্বে সভা শুরু হয়। প্রথমে বক্তৃতা করেন শামসুল হক। তিনি তাঁর বক্তৃতায় ছাত্রদের ১৪৪ ধারা ভঙ্গ না করার নির্দেশ দেন। কিন্তু সমবেত ছাত্রসমাজ তাঁর বক্তব্য প্রত্যাখ্যান করে। এরপর বিশ্ববিদ্যালয় রাষ্ট্রভাষা কমিটির আহ্বায়ক আবদুল মতিন ১৪৪ ধারা ভঙ্গ করার পক্ষে যুক্তি প্রদর্শন করে বক্তব্য দেন। এর পরপরই গাজীউল হক সংক্ষিপ্ত অথচ জ্বালাময়ী বক্তব্য প্রদান করে ১৪৪ ধারা ভঙ্গের পক্ষে রায় ঘোষণা করেন। আবদুস সামাদ আজাদের প্রস্তাব মতে ১০ জন ১০ জন করে ছাত্র সত্যাগ্রহের মাধ্যমে ১৪৪ ধারা ভঙ্গ করার সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়।
মোহাম্মদ সুলতান একটি খাতা নিয়ে বিশ্ববিদ্যালয় ফটকে বসে সত্যাগ্রাহীদের নাম লেখেন। প্রথম দলটির নেতৃত্ব দেন হাবিবুর রহমান শেলী। দ্বিতীয় দলের নেতৃত্ব দেন আবদুস সামাদ, তৃতীয় দলের নেতৃত্ব দেন ইব্রাহীম তাহা। সত্যাগ্রহীদের পুলিশ গ্রেফতার করে ভ্যানে তুলতে থাকে। চতুর্থ দলের নেতৃত্ব দেন এস. এ. বারী এটি। এরপর মেয়েদের একটি দল সত্যাগ্রহ করে বিশ্ববিদ্যালয় ফটক দিয়ে বেরিয়ে এলে পুলিশ তাদের ওপর লাঠিচার্জ করে। বিক্ষুব্ধ ছাত্রসমাজ পুলিশের প্রতি ইট পাটকেল নিক্ষেপ করে মেয়েদের পুলিশের হাত থেকে উদ্ধারের সাহায্য করতে গেলে পুলিশ বেধড়ক লাঠিচার্জ করে। টিয়ার গ্যাসে সারা বিশ্ববিদ্যালয় আচ্ছন্ন করে ফেলে। গাজীউল হক টিয়ার গ্যাসে আহত হয়ে পড়েন। তত্ক্ষণাত্ তাঁকে ধরাধরি করে বিশ্ববিদ্যালয় চিকিত্সা কেন্দ্রে নিয়ে যাওয়া হয়। এখান থেকে তিনি ফুলবাড়িয়া রেলস্টেশনে চলে যান। সেখান থেকে তিনি আত্মগোপনে চলে যান। দীর্ঘদিন আত্মগোপনে থেকে বগুড়ায় ফিরে যান।
১৯৫৩ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রাঙ্গণ থেকে মিছিল শুরু হয়। ভোর বেলাতেই আতাউর রহমান, শেখ মুজিবুর রহমান প্রমুখ নেতৃবৃন্দ বিশ্ববিদ্যালয় প্রাঙ্গণে এসে সমবেত হন। গাজীউল হকও সেই মিছিলে শরিক হন। মিছিলের সামনে আতাউর রহমান খান, শেখ মুজিবুর রহমান, ইমাদুল্লাহ। মিছিলের সামনে কালো পতাকাটি কখনো গাজীউল হক কখনো বা আবদুল ওদুদ পাটোয়ারী বয়ে নিয়ে যায়। সারা ঢাকা শহর প্রদক্ষিণ করে মিছিল এসে আরমানিটোলা ময়দানে সমবেত হয়। আরমানিটোলা ময়দানের সভায় সভাপতিত্ব করেন আতাউর রহমান খান। প্রতিটি ছাত্র সংগঠন থেকে একজন করে এ সভায় বক্তৃতা করেন। সভায় শেখ মুজিবুর রহমানের অনুরোধে তিনি ভাষা আন্দোলনের ওপর তাঁর স্বরচিত একটি গান গেয়ে শোনান। এরপর থেকেই ১৯৫৩-৫৪-৫৫ সাল পর্যন্ত গাজীউল হকের লেখা গান গেয়ে প্রভাতফেরি করা হতো। গানটির কথা ছিল ‘ভুলবো না, ভুলবো না, ভুলবো না/ এই একুশে ফেব্রুয়ারি ভুলবো না/ লাঠি বুলেট টিয়ার গ্যাস/ মিলিটারী আর মিলিটারী ভুলবো না / রাষ্ট্রভাষা বাংলা চাই/ এই দাবিতে ধর্মঘট/ বরকত সালামের খুনে/ লাল ঢাকা রাজপথ / স্মৃতিসৌধ ভাঙ্গিয়াছ/ জেগেছে পাষাণে প্রাণ/ মোরা কি ভুলিতে পারি/ খুনে রাঙা লাল নিশান পরবতীকালে আবদুল গাফফার চৌধুরী রচিত এবং শহীদ আলতাফ মাহমুদ সুরারোপিত গানটি এ দেশের মানুষ গ্রহণ করে।
১৯৫৩ সালে ঘটে আরেকটি ঘটনা। বিশ্ববিদ্যালয়ে রাজনীতি এবং সভা সমিতিকে নিষিদ্ধ করে একটি ঘোষণা দেয়া হয়। এই ঘোষণা প্রত্যাহারের জন্য বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র নেতৃবৃন্দের তরফ থেকে একটি স্মারকলিপি পেশ করা হয়। ১৪ এপ্রিল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টরের বাসার সামনে প্রক্টর ডক্টর মযহারুল হকের সঙ্গে গাজীউল হকের দেখা হয়। হাতে ইশারা দিয়ে তিনি গাজীউল হককে কাছে ডেকে নেন। তাঁর কাছে যেতেই তিনি তাঁকে বলেন, ‘আমার কিছুই করার ছিল না। আমরা একটা অন্যায় করেছি।’ কথাগুলো বলেই তিনি ভেতরে চলে যান।
স্মারকলিপিতে যাঁরা স্বাক্ষর করেছিলেন তাঁরা প্রত্যেকেই বিকেলের দিকে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের কাছ থেকে একটি হুকুমনামা পান। গাজীউল হক (আইনের এম.এ.-এর ছাত্র), খন্দকার গোলাম মোস্তফা ( এম.এ. শেষ পর্বের ছাত্র), জিল্লুর রহমান (আইনের ছাত্র), শামসুল হক (এম.এ. শেষ পর্বের ছাত্র)-কে চার বছরের জন্য বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বহিষ্কার করা হয়। এর প্রতিবাদে বিকেলে প্রতিটি হলে সভা হয়। বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের এ অন্যায় আদেশের বিরুদ্ধে ছাত্ররা প্রতিবাদমুখর হয়ে উঠে। পরদিন সকালেই বিভিন্ন হলের নেতৃবৃন্দ এবং ছাত্ররা মিলে সংগ্রাম কমিটি গঠন করে। সংগ্রাম কমিটির ডাকে ছাত্ররা ধর্মঘট করে ক্লাশ বর্জন করে, পরীক্ষা বর্জন করে। এর পরদিনই ১৬ তারিখে সংগ্রাম কমিটির পক্ষ থেকে বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রসভা ঘোষণা করা হয় এবং ১৭ তারিখে পল্টন ময়দানে জনসভা ডাকা হয়। জনসভার প্রচারের জন্য গাজীউল হক মাইক ব্যবহারের অনুমতি চাইলে তা প্রত্যাখ্যান করা হয়।
১৭ এপ্রিল বিকেল ৪টায় পল্টন ময়দানে জনসভার উদ্দেশ্যে গাজীউল হক এবং ইসতিয়াক আহমদ দু’জনে একসঙ্গে রওনা দেন। কথা প্রসঙ্গে ইসতিয়াক বলেন, ‘গাজী ভাই, দেখবেন মাঠ হয়তো একেবারেই ফাঁকা।’ তিনি এর প্রত্যুত্তরে বলেন, ‘ফাঁকা মাঠেও বক্তৃতা দেবার অভ্যেস আমার আছে।’ কিন্তু পল্টন ময়দানে পৌঁছে দেখেন ৪টার আগেই সেখানে কয়েক হাজারেরও বেশি শ্রোতা সমবেত হয়েছেন। মাইক ছাড়া কিভাবে এতো জনগণের মাঝে বক্তব্য পৌঁছাবেন সেই চিন্তায় পড়ে গেলেন গাজীউল হক। সভার মাঝখানে একটি টেবিল রাখা হলো। এই টেবিলের ওপর দাঁড়িয়ে গাজীউল হক ও অন্যান্য বক্তারা বক্তব্য রাখেন। সভা শেষে বিশ্ববিদ্যালয়ের কর্তৃপক্ষের বিরুদ্ধে ছাত্র বহিষ্কার এবং ছাত্র নির্যাতনের প্রতিবাদে ছাত্ররা স্লোগান দেয়। তাতে সাধারণ জনগণও শামিল হয়ে কন্ঠ মেলায়।
কারাজীবন
১৯৫৩ সালের ১৮ এপ্রিল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধ ঘোষণা করে। মে মাসে গাজীউল হক এবং খন্দকার গোলাম মোস্তফাকে গ্রেফতার করা হয়। তাঁদের গ্রেফতারের প্রতিবাদে ছাত্ররা ধর্মঘট শুরু করে। বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ এবং সরকার ছাত্রদের প্রলোভন দেখিয়ে ধর্মঘট বানচাল করার জন্য প্রাণপণ চেষ্টা চালায়। কিন্তু মে মাসের শেষের দিকে বিশ্ববিদ্যালয় খুললেও শিক্ষার্থীরা ক্লাশে যোগ দেয় না, প্রতিদিন ছাত্রসভা, মিছিলে অংশ নেয়। আর এর নেতৃত্ব দেন সৈয়দ ইসতিয়াক আহমদ, কামরুজ্জামান, মোহাম্মদ সুলতান প্রমুখ। এদের নেতৃত্বে ছাত্ররা তদানীন্তন মুখ্যমন্ত্রী নূরুল আমিনের বাসভবন ঘেরাও করে। অবশেষে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ এবং পূর্ব-পাকিস্তান সরকার সংগ্রাম কমিটির সঙ্গে মীমাংসায় আসতে বাধ্য হন। ফলে গাজীউল হক এবং খন্দকার গোলাম মোস্তফার বিরুদ্ধে বহিষ্কারের আদেশ প্রত্যাখ্যান করে। কারাগার থেকে বেরিয়ে গাজীউল বগুড়া চলে যান। ১৯৫৪ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি পালন বন্ধের জন্য সরকার ধরপাকড় শুরু করে। ১৯ ফেব্রুয়ারি গাজীউল হকসহ কয়েকজন নেতাকর্মীকে বগুড়া থেকে গ্রেফতার করা হয়। এবার দীর্ঘদিন কারাগারে থাকতে হলো তাঁকে। আড়াই বছর।
২০ তারিখ সকালে কারাগারে বসেই তিনি সংবাদ পান শুধু বগুড়াতেই নয় সারা পূর্ব পাকিস্তানে ধর পাকড় শুরু হয়েছে। সাধারণ কর্মীদের বাড়ি বাড়ি পুলিশী তল্লাশি চালিয়ে বগুড়াতে আনুমানিক ৭০ থেকে ৮০ জনকে গ্রেফতার করা হয়েছে। ২১ ফেব্রুয়ারি বিকেলে বগুড়া জেলে বসে গাজীউল হক মিছিলের স্লোগান শুনতে পান ‘রাষ্ট্রভাষা বাংলা চাই’, ‘রাজবন্দীদের মুক্তি চাই’, ‘পুলিশী নির্যাতনের অবসান চাই’। বগুড়া জেলে কিছুদিন রাখার পর সেখান থেকে তাঁকে রাজশাহী জেলে নিয়ে আসা হয়। কয়েকদিন পর তাঁকে ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে নিয়ে এসে পুরনো হাজতে রাখা হয়। এখানে তাঁর পরিচয় হয় চট্টগ্রামের বিখ্যাত কবিয়াল রমেশ শীলের সঙ্গে। রমেশ শীল তাঁর কবি গানের মাধ্যমে এ দেশের গণতান্ত্রিক আন্দোলন, সাম্রাজ্যবাদ বিরোধী আন্দোলন গড়ে তোলায় যথেষ্ট সহায়তা করেছিলেন। ফলে ২৫ মে’র পরে তাঁকেও গ্রেফতার করে পুরনো হাজতে রাখা হয়। এখানে এসে গাজীউল হক পান মুনীর চৌধুরী, অধ্যাপক অজিত গুহ, রণেশ দাশগুপ্ত, সত্যেন সেন, বাবু চন্দ্রশেখর, অমূল্য কাঞ্চন রায়, চাখার কলেজের অধ্যক্ষ রফিক, বাবু নারায়ণ বিশ্বাস, অমিয় দাশগুপ্ত, এস এ বারি এটি, লতিফ, জুলমত আলী খান প্রমুখকে।
১৯৫৫ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি বিকেলবেলা দলে দলে ছাত্রদের গ্রেফতার করে জেলখানায় নিয়ে আসা হয়। জেলখানায় স্থান সংকুলান না হওয়ায় ১ ও ২ খাতাতে যাঁরা রাজবন্দি ছিলেন তাঁদের সরানোর ব্যবস্থা করা হয়। ৩ ও ৪ খাতা থেকে কয়েদিদের সরিয়ে নেয়া হয়। এমন সময় জেলার গাজীউল হকসহ কয়েকজন বন্দিকে পুরনো হাজত ছেড়ে দিতে অনুরোধ জানায়। গাজীউল হক জেল কর্তৃপক্ষের কাছে তার কারণ জিজ্ঞেস করায় তিনি জানান অনেক মেয়েকে গ্রেফতার করে কারাগারে নিয়ে আসা হয়েছে। তাঁদের রাখার জায়গা নেই। এই সুযোগটা গাজীউল হক পুরোপুরি ব্যবহার করলেন। জেলারকে শর্ত জুড়ে দিলেন ১ ও ২ খাতার রাজবন্দিদের সঙ্গে তাঁদের এক জায়গায় রাখতে হবে। কিন্তু সরকারি নির্দেশ মতে তাঁরা অপর রাজবন্দির সঙ্গে মিশতে পারবে না। কিন্তু স্থানের অভাবে জেল কর্তৃপক্ষ তাঁদের দাবি মৌখিকভাবে মেনে নেন। তারা জানালেন, গাজীউল হকের মতো বন্দিরা এবং রাজবন্দিরা এক এলাকায় থাকবেন, একসাথে খেলাধুলাও করবেন। তবে তাঁদের এক রাজবন্দির সঙ্গে অপর রাজবন্দি বা বন্দির যে কথাবার্তা হবে তা জেলারের অগোচরে হতে হবে। তাঁরা এ ব্যবস্থায় রাজি হয়ে গেলেন।
ফলে তিনি সকল পুরনো রাজবন্দি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান, মোহাম্মদ তোয়াহা, খাজা আহমদ, প্রসূনকান্তি রায়, সরদার ফজলুল করিমের সাক্ষাত্ পান। খাজা আহমদ ও সরদার ফজলুল করিমকে দ্বিতীয় শ্রেনির রাজবন্দি হিসেবে দেখতে পেয়ে খুবই মর্মাহত হন। লজ্জায় গাজীউল হকের মাথা নত হয়ে আসে।
ভাষা আন্দোলনের গ্রেফতারকৃত ছাত্রছাত্রী বন্দিদের সঙ্গে দেখা করার জন্য গাজীউল হক অসুখের ভান করে জেল হাসপাতালে যান। কিন্তু সেখানে গিয়ে দেখেন অসুস্থ হয়ে যে ক’জন ছাত্র জেল হাসপাতালে ভর্তি হয়েছে তাঁদের কাউকেই তিনি চেনেন না। তাঁকে দেখে একজন ছাত্র এগিয়ে এসে নিজের পরিচয় দেয়। জ্বরে তাঁর গা পুড়ে যাচ্ছে। ছেলেটির নাম মোকাম্মেল হক। সে ছিল বিশ্ববিদ্যালয়ের সেরা ছাত্রদের একজন। এদের মধ্যে ছিল পগোজ স্কুলের অষ্টম শ্রেণির ছাত্র ওবায়দুর রহমান। অল্প কিছুক্ষণের মধ্যেই গাজীউল হকের সঙ্গে সকলের আলাপ জমে ওঠে। এর পরদিন ভোরে ডক্টর আলিমকে জেল হাসপাতালে নিয়ে আসা হয়। ডক্টর আলিম এবং গাজীউল হক আলোচনা করে সিদ্ধান্ত নেয়, যেভাবেই হোক ছেলেদের মনোবলকে দৃঢ় রাখার চেষ্টা করবে। বিকেলে আলিম ডিসচার্জ হয়ে কারাগারে চলে যান। যাওয়ার সময় তিনি বলে যান ৩ ও ৪ খাতায় যেসব বন্দি আছে, তাঁদের সঙ্গেও এ বিষয়ে আলাপ আলোচনা করবেন এবং এ বিষয়ে লিখে জানাবেন।
এদিকে মোকাম্মেলের বাবা কবি মোজাম্মেল হক কারাগারে ছেলেকে দেখতে এসে যখন শোনেন ছেলে অসুস্থ তখন তিনি উদ্বিগ্ন হয়ে পড়লেন। তাঁর উদ্বিগ্নতা দেখে পুলিশের আই বি বিভাগের অফিসাররা তাঁর বাবাকে বোঝালেন মোকাম্মেল খুব ভালো ছাত্র। অসুস্থ অবস্থায় বন্ড দিলে তাঁর কোনো ক্ষতি হবে না। জেলগেট থেকে একজন কর্মচারি গাজীউল হককে এই সংবাদ জানান। সংবাদ শুনেই মোকাম্মেল গাজীউল হককে ডেকে বলল, ‘গাজী ভাই, আপনি এখান থেকে যাবেন না। আমি কিছুতেই বন্ড দেবো না।’
একটু পরেই এ্যাংলো সার্জেন্টের সঙ্গে মোকাম্মেলের বাবা এলেন হাসপাতালে। গাজীউল হক কবিকে সালাম দিয়ে পাশে দাঁড়ান। মোকাম্মেলের বাবা ছেলের হাত ধরে ছেলেকে বোঝানোর চেষ্টা করতেই মোকাম্মেল হঠাত্ বলে উঠলো, ‘আব্বা, আমি বন্ড দেবো না। আমার কেমন লাগছে, গাজী ভাই, আমাকে একটু পানি দেন।’ গাজীউল হক তাড়াতাড়ি সামনে এগিয়ে এসে এ্যাংলো সার্জেন্টকে কড়া ধমকে সরিয়ে দিয়ে মোকাম্মেলের মাথায় পানি ঢালতে থাকেন। এতে কাজ হল। মোকাম্মেলকে কারাগারে রেখেই তাঁর বাবা চলে গেলেন। এ্যাংলো সার্জেন্ট জেল কতৃপক্ষকে রির্পোট দিলেন গাজীউল হক একটি বিশেষ উদ্দেশ্য নিয়েই জেল হাসপাতালে গিয়েছে। তাহলো ভাষা আন্দোলনে ছাত্রবন্দিদের সঙ্গে সাক্ষাত্ করা। অসুস্থ মোকাম্মেলের বন্ড না দেওয়ার সংবাদ চিঠির মাধ্যমে গাজীউল হক হাসপাতাল ত্যাগ করার আগেই ডাক্তার আলিম, তোয়াহা এবং অন্যান্যদের জানিয়ে দেন। এতে কাজও হয় স্কুল কলেজ বিশ্ববিদ্যালয়ের কোনও ছাত্রই আর বন্ড দেয়নি। শত চাপের মুখেও সরকারের কাছে তারা নতি স্বীকার করেনি।
জেলে থাকা অবস্থায় তিনি এক দুঃসংবাদ পান। তাঁর বাবা ১৯৫৬ সালের ২৫ মার্চ মারা গেছেন। এর কিছুদিন পরই জেল থেকে মুক্তি পেলেন তিনি। জেল থেকে মুক্ত হয়েও বছর দুয়েক গৃহে অন্তরীণ রইলেন। ১৯৭৫ সালে বঙ্গবন্ধুকে হত্যার পর তাঁকে গ্রেফতার করে কারাগারে পাঠানো হয়। অনেক নির্যাতন করার পর ১৯৭৬ সালে তাঁকে মুক্তি দেয়া হয়।
মুক্তিযুদ্ধ
বগুড়ায় ১৯৬৯ সালের ১১ দফা আন্দোলনের মূল চাবিকাঠি ছিল বিড়ি শ্রমিক ও মজদুরগণ। গাজীউল হকও ১১ দফা আন্দোলনে অংশ নেন। ‘৬৯ এর ৪ মার্চ বগুড়ার সাতমাথায় পুলিশ লাঠিচার্জ ও টিয়ার গ্যাস ছুঁড়লে ক্রুদ্ধ জনতা তখন বগুড়ার জামিল বিল্ডিং এ আগুন ধরিয়ে দেয়। বগুড়ার প্রশাসন কারফিউ জারি করে। এ সময় গাজীউল হক জামিল পরিবারের সদস্যগণকে ভয়ানক বিপদ থেকে রক্ষা করেন।
১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ সন্ধ্যায় বগুড়া শহরে গুজব রটে আড়িয়া ক্যান্টনমেন্ট থেকে পাকিস্তানি সেনারা বগুড়া দখল করার জন্য রওয়ানা দিয়েছে। সংবাদ শোনামাত্র মুক্তিযোদ্ধরা ফটকি ব্রিজ অবরোধ করে। ঐদিন রাতেই গাজীউল হক মাত্র ২৭ জন যুবকসহ পাকিস্তানি সৈন্যদের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তোলার সিদ্ধান্ত নেন। সেই মোতাবেক গাজীউল হক, ডা. জাহিদুর রহমান অন্যান্য যুবকদের নিয়ে বগুড়া থানার আঙ্গিনায় জড়ো হন। থানার দারোগা নিজামউদ্দীন, নুরুল ইসলাম, স্পেশ্যাল ব্রাঞ্চের মকবুলসহ কয়েকজন কনস্টেবল সবাই হতভম্ব হয়ে যান। পরক্ষণেই ঘটনাটি তাঁদের বোধগম্য হয়। সঙ্গে সঙ্গে পুলিশ এবং ৩৯ জন ইপিআর মুক্তিযোদ্ধাদের সঙ্গে যোগ দেন। এতে তাঁদের প্রতিরোধ শক্তি আরো বেড়ে যায়। এসময় আওয়ামী লীগ, ন্যাপ ভাসানী ও কমিউনিস্ট নেতৃবৃন্দদের নিয়ে যুদ্ধ পরিচালনার জন্য পাঁচ সদস্য বিশিষ্ট একটি হাই কমান্ড গঠন করা হয়। এই হাই কমান্ডের সদস্য ছিলেন গাজীউল হক, মাহমুদুল হাসান খান (এম,পি,এ , প্রশাসন), ডা. জাহিদুর রহমান (এম,এন,এ, খাদ্য এবং যোগাযোগের দায়িত্বে নিয়োজিত), মোখলেসুর রহমান (সদস্য), আবদুল লতিফ (সদস্য)। পরে মোশারফ হোসেন মন্ডলকে এই হাই কমান্ডে অন্তর্ভুক্ত করা হয়। যুদ্ধ পরিচালনার দায়িত্ব পড়ে গাজীউল হকের উপর।
২৭ মার্চ ৬০ জন পুলিশের একটি দল পাকসেনাদের সঙ্গে লড়ার জন্য এগিয়ে আসে। তাঁরা পাঁচদিন একনলা বন্দুক, দোনলা বন্দুক এবং টুটু বোর রাইফেল দিয়ে যুদ্ধ করে পাকসেনাদের ঠেকিয়ে রাখে। ৩১ মার্চ রাতে রংপুর থেকে আগত পাকসেনাদের আক্রমণ করলে তারা পিছু হটে। পরে বগুড়ার সীমান্ত পার করে রংপুর জেলার শঠিবাড়ি পর্যন্ত তাদের তাড়িয়ে নিয়ে যাওয়া হয়। পুনরায় ১ এপ্রিল পাকিস্তানি সেনাবাহিনী আকাশপথে বগুড়ায় বোমাবর্ষণ শুরু করে। আকাশপথে পাকসেনাদের আক্রমণকে উপেক্ষা করে গাজীউল হকের নেতৃত্বে মুক্তিযোদ্ধরা আড়িয়া ক্যান্টনমেন্ট প্রায় চার ঘন্টা অবরোধের পর পাকসেনাদের ওপর আক্রমণ চালায়। আড়িয়া ক্যান্টনমেন্ট দখল করার সময় মাসুদ নামে একজন মুক্তিযোদ্ধা শহীদ হন। মুক্তিযোদ্ধারা ক্যাপ্টেন নূরসহ ৬৯ জন পাক সেনাকে বন্দি করেন। মুক্তিযোদ্ধারা এই ক্যান্টনমেন্ট থেকে ৫৮ ট্রাক গোলাবারুদ উদ্ধার করেন। আড়িয়ার এই যুদ্ধকে মরিচের যুদ্ধও বলা হয়। কারণ যুদ্ধক্ষেত্রে মুক্তিযোদ্ধারা মরিচের গুড়াকে অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করে। প্রচণ্ড বাতাস থাকায় মুক্তিযোদ্ধারা ক্যান্টনমেন্টের দক্ষিণ দিকের উচুঁ উচুঁ গাছ থেকে মরিচের গুঁড়া শুন্যে ছেড়ে দেয়। মরিচের গুঁড়া উড়ে গিয়ে পাকসেনাদের চোখে লাগালে তীব্র জ্বালায় তারা বিব্রত বোধ করে। এর ফলে তারা আত্মসমর্পণ করতে বাধ্য হয়। আড়িয়া দখলের পর তা উত্তরাঞ্চলের ঘাঁটি হিসেবে ব্যবহৃত হয়।
১৬ এপ্রিল গাজীউল হক অস্ত্র সংগ্রহ এবং অস্থায়ী সরকারের সঙ্গে উত্তরাঞ্চল যুদ্ধের পরিস্থিতি নিয়ে আলোচনার উদ্দেশ্যে ভারত গমন করেন। ভারত থেকে বগুড়া আসার পথে যখন তিনি জানতে পারেন পাকিস্তানি সেনাবাহিনী বগুড়া দখল করেছে, তখন তিনি দ্রুত এ সংবাদ অস্থায়ী সরকারের কাছে রিপোর্ট করেন। হিলিতে পাকসেনাদের বিরুদ্ধে একটি খণ্ড যুদ্ধে অংশগ্রহণের পর কলকাতায় ফিরে গিয়ে তিনি মুক্তিযুদ্ধের মুখপাত্র ‘জয়বাংলা’ পত্রিকার বিক্রয় বিভাগের দায়িত্বসহ আকাশ বাণী ও স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র থেকে রণাঙ্গনের সংবাদ প্রচারের দায়িত্ব পালন করেন।
সম্মাননা, স্বীকৃতি ও সংবর্ধনা
গাজীউল হক তাঁর কাজের স্বীকৃতি স্বরূপ অনেক পুরস্কারে ভূষিত হনর এগুলো-
১৯৭৭ সালে পান পাবনা থিয়েটার পুরস্কার।
১৯৭৯ সালে বগুড়া জিলা স্কুলের ১৫০ তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী উপলক্ষে ‘বন্ধন’-এর পক্ষ থেকে ভাষাসৈনিক গাজীউল হককে ক্রেষ্ট উপহার দেওয়া হয়।
১৯৮৮ সালের ফেব্রুয়ারি ‘সড়ক’-এর পক্ষ থেকে তাঁকে শ্রদ্ধার্ঘ্য জানানো হয়।
১৯৮৯ সালের ২৬ ফেব্রুয়ারি ‘কমিটি ফর ডেমোক্রেসি ইন বাংলাদেশ- নিউইর্য়ক’ তাঁকে শ্রদ্ধাঞ্জলি জানায়।
১৯৯৩ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি মহান ভাষা আন্দোলনে অসাধারণ নেতৃত্বের জন্য বাংলাদেশ জাতীয় ব্যক্তিত্ব গবেষণা কেন্দ্র তাঁকে রাষ্ট্রভাষা পুরস্কার পদক ও সম্মান স্মারক প্রদান করে।
১৯৯৭ সালে অন্নদা শংকর রায় কলকাতার পক্ষ থেকে তাঁকে শ্রদ্ধাঞ্জলি জ্ঞাপন করে।
১৯৯৭ সালে বছর বগুড়া প্রেস ক্লাব ভাষাসৈনিকদের সংবর্ধনা দেয়। তাঁকেও সংবর্ধনা প্রদান করা হয়।
১৯৯৭ সালে চট্টগ্রাম ইয়ুথ কয়ার-এর পক্ষ থেকে ৭ মার্চ তিনি ভাষাসৈনিক পদক পান।
১৯৯৭ সালে বগুড়ার ভাষাসৈনিক ও মুক্তিযোদ্ধা বঙ্গবন্ধু পরিষদ সোনালী ব্যাংকের পক্ষ থেকে তাঁকে অর্পণ নামে একটি ক্রেষ্ট উপহার দেয়।
১৯৯৯ সালের ২৬ নভেম্বর সামাজিক, সাংস্কৃতিক ও প্রগতিশীল গণতান্ত্রিক আন্দোলনের ক্ষেত্রে জীবনব্যাপী নিষ্ঠা ও কৃতিত্বপূর্ণ অবদানের জন্য বাংলা একাডেমী থেকে সম্মানসূচক ফেলোশিপ অর্জন করেন। তিনি সিপাপ জাতীয় স্বর্ণপদক পান।
১৯৯৯ সালের ১৩ ফেব্রুয়ারি আমরা সূর্যমুখী-এর পক্ষ থেকে তাঁর ৭১তম জন্মদিনে নাগরিক সম্মাননা দেওয়া হয়। কারক নাট্য সম্প্রদায়-এর ১২ বছর পূর্তিতেও তাঁকে সংবর্ধনা দেওয়া হয়।
২০০০ সালের ১৯ ফেব্রুয়ারি বায়ান্নোর ভাষা আন্দোলনে গৌরবময় ভূমিকার জন্য সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোট তাঁকে সকৃতজ্ঞ অভিনন্দন জানায়।
এছাড়া ২০০০ সালে ভাষা আন্দোলনের পঞ্চাশ বত্সর পূর্তি উপলক্ষে সিলেট ভাষাসৈনিক সংবর্ধনা পরিষদ তাঁকে ভাষাসৈনিক সংবর্ধনা দেয়। এবছরই তিনি বাংলাদেশ জার্নালিস্ট এ্যাসোসিয়েশন এর উপদেষ্টা হিসেবে বিশেষ সম্মাননা স্মারক পান। ১২ ফেব্রুয়ারি বঙ্গবন্ধু আইনজীবী পরিষদও তাঁকে সম্মাননা প্রদান করে। ভাষা আন্দোলনের স্থপতি সংগঠন তমদ্দুন মজলিস-এর পক্ষ থেকে মাতৃভাষা পদক পান। দি ইনস্টিটিউট অব চার্টাড এ্যাকাউন্ট্যান্টস অব বাংলাদেশ তাঁকে ২১ ফেব্রুয়ারিতে ভাষা আন্দোলনের স্বীকৃতি স্বরূপ ক্রেষ্ট উপহার দেয়।
২০০০ সালের ১২ ফেব্রুয়ারি ভাষা আন্দোলন ও সামাজিক মূল্যবোধ প্রতিষ্ঠায় অসাধারণ অবদানের জন্য আমরা সূর্যমুখী-এর পক্ষ থেকে তাঁকে ৭৩তম জন্মবার্ষিকীতে নাগরিক সম্মাননা দেয়। মাতৃভাষা সৈনিক পরিষদ-এর পক্ষ থেকে তাঁকে সম্মাননা প্রদান করা হয়।
২০০০ সালের ২০ ফেব্রুয়ারি গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার তাঁকে একুশে পদক পুরস্কারে ভূষিত করেন।
২০০০ সালের ১০ জুলাই পান বিশ্ব বাঙালি সম্মেলন পুরস্কার।
২০০১ সালে ফেনী সমিতির পক্ষ থেকে তাঁকে ‘ফেনীর কৃতি সন্তান’ হিসেবে গুণীজন সংবর্ধনা দেওয়া হয়। ২০০১ সালেই একাত্তরের ঘাতক দালাল নিমূল কমিটির পক্ষ থেকে ‘জাহানারা ইমাম পদক’ পান।
২০০২ সালে সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোট ভাষা আন্দোলনের সুবর্ণ জয়ন্তী উপলক্ষে তাঁকে একটি ক্রেষ্ট উপহার দেয়। এ বছর বাংলাদেশ জাতীয় জাদুঘর ১৬ ফেব্রুয়ারি তাঁকে সম্মাননা স্মারক প্রদান করে।
২০০৩ সালে বঙ্গবন্ধুর আদর্শ বাস্তবায়নে আইনের শাসন প্রতিষ্ঠার প্রত্যয়ে বঙ্গবন্ধু আইনজীবী পরিষদের পক্ষ থেকে বঙ্গবন্ধু পদক পান।
২০০৪ সালে পান শের-ই-বাংলা জাতীয় পুরস্কার।
২০০৫ সালে শিক্ষা ও সংস্কৃতি ক্ষেত্রে অবদান রাখার জন্য মার্কেন্টাইল ব্যাংক পুরস্কার পান।
২০০৬ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাস বিভাগ এ্যালামনাই এ্যাসোসিয়েশন-এর ৭ম পুনর্মিলনী অনুষ্ঠানে তাঁকে ক্রেষ্ট উপহার দেয়।
প্রকাশনা
গাজীউল হকের লেখালেখির শুরুটা ছাত্রজীবনে। কারাগারে বসে তিনি অনেক কবিতা, গান রচনা করেন। কর্মজীবনে শত ব্যস্ততার মাঝেও তাঁর লেখালেখি থামেনি। সময় সুযোগ পেলেই তিনি লিখতেন। তাঁর চিন্তা চেতনাকে প্রকাশ করতেন লেখনীর মাধ্যমে। এই লেখাগুলো পরবতীতে বই আকারে প্রকাশিত হয়। তাঁর বইয়ের সংখ্যাও নেহাত কম নয়।
‘জেলের কবিতা’ গাজীউল হকের একটি সম্পাদনা কাব্যগ্রন্থ। বগুড়া থেকে ১৩৬৩ সনের ১লা বৈশাখ বইটি বের হয়। এই বইটিতে রণেশ দাশ গুপ্তের ৬টি অনুবাদ কবিতা, সুধীর মুখাজীর ১টি এবং তাঁর নিজের ৬টি কবিতা সংকলিত হয়েছে। তিনজন কবিই জেলে থাকাকালীন সময়ে কবিতাগুলো লেখেন। বইটিতে- ‘একটি কাহিনী’ কবিতাটি খুলনার কিষাণ কমী হীরালাল বায়েনের জীবন কাহিনী। ‘আজ তুমি কেঁদোনা মা’ – রাজশাহী জেলে উনিশ শ’ পঞ্চাশ সালের চব্বিশে এপ্রিল গুলিতে যে সাতটি বন্ধু মারা যান, তাঁদের মধ্যে সবচেয়ে সুন্দর এবং শুভ্র আনোয়ারের দুঃখিনী মাকে উত্সর্গ করেছেন এই কবিতাটি।
‘একটি কাহিনী’ (বিষু চ্যাটার্জীকে) উত্সর্গ করে লেখা তাঁর একটি কবিতা : তোমার পত্র পেয়েছি, বাসনা/ আবেগে উচ্ছ্বল লিপিকাখানি।/ নোতুন কথা চেয়েছ জানতে-/ যেমন তোমায় জানাই প্রতিবারে,/ স্মৃতির বৃন্ত থেকে কথা চয়ন করে।/ কিন্তু, আজ কী শোনাবো বলো,/ সোনার খাঁচাটি শূন্য পড়ে আছে/ কথাগুলো গেছে উড়ে।/ ভাবলেম;
‘BANGLADESH UNCHAINED’ ১৯৭১ সালের ডিসেম্বর-এ Indian Associated Publishing Co. Private Ltd. থেকে বের হয়েছে। বইটিতে ১৮৫৭ সালের বৃটিশ শাসন, গভর্ণর জেনারেল লর্ড কার্জন, ১৯০৫ সালের বঙ্গভঙ্গ, বাংলার রাজনীতি, হিন্দু ও মুসলমানের একে অপরের মধ্যে বিরোধিতাকে কেন্দ্র করে বাংলা বিভাগ ইত্যাদি বিষয়গুলোকে তুলে ধরেছেন।
‘এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম’ বইটি ১৯৭১ সালে কলকাতার ইণ্ডিয়ান এ্যাসোসিয়েটেড প্রেস লিমিটেড থেকে বের হয়। বইটির প্রথম সংস্করণ হয় ১৯৯৪ সালে। প্রকাশক সন্ধানী প্রকাশন। মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন সময়ে লেখক বইটি লেখা শুরু করেন। বইটি যখন বের হয় বঙ্গবন্ধু তখন পাকিস্তানের কারাগারে বন্দি। তাঁর স্বচক্ষে দেখা বাংলাদেশের প্রতিটি সংগ্রামের চিত্র তিনি সহজ সরল ভাষায় বইয়ে উপস্থাপন করেছেন। তিনি বইয়ে উল্লেখ করেছেন ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ পৃথিবীর ইতিহাসে এক স্মরণীয় দিন। কারণ বাংলাদেশের অবিসংবাদিত মহান নেতা শেখ মুজিবুর রহমান জাতির উদ্দেশ্যে তাঁর নির্দেশ পাঠান। ইথার তরঙ্গে তাঁর ঘোষণা ও নির্দেশ ভেসে এলো : ‘বিদেশী শত্রুসৈন্য বাংলাদেশ আক্রমণ করেছে গভীর রাতের অন্ধকারে। ঢাকা, খুলনা, কুষ্টিয়ায় তারা লক্ষাধিক ঘুমন্ত লোককে হত্যা করেছে। এই বর্বর আক্রমণ এবং নির্মম গণহত্যার কথা বিশ্বের সমস্ত রাষ্ট্রকে জানিয়ে দাও। বাংলার সন্তান যে যেখানে আছো, হাতের অস্ত্র নিয়ে রুখে দাঁড়াও, বিদেশী শত্রুর পশুশক্তির বিরুদ্ধে; হানাদারদের প্রতিহত করো।’
‘মোহাম্মদ সুলতান’ জীবনীগ্রন্থটি বাংলা একাডেমী বের করেছে। প্রকাশ কাল ১৯৯৪ সাল।
‘বাংলাদেশের গণমাধ্যম আইন ও বিধিমালা তাঁর একটি সংকলিত গ্রন্থ। বইটি বের করেছে এশিয়ান মিডিয়া ইনফরমেশন এন্ড কম্যুনিকেশন সেন্টার ও ইউনিভার্সিটি প্রেস লিমিটেড। প্রকাশ কাল ১৯৯৬। বইটি কয়েকটি অধ্যায়ে সন্নিবেশিত করা হয়েছে। ক অংশে বাংলাদেশের গণমাধ্যম আইন ও বিধিমালা নির্দেশিকা, খ অংশে গণমাধ্যম আইন ও শিল্পনীতিমালা সম্পর্কিত ভাষ্য, গ অংশে গণমাধ্যম সম্পর্কিত সংবিধানের বিধান, আইন ও বিধি এবং পরিশিষ্ট। বইটিতে বাংলাদেশের গণমাধ্যম আইনের দ্রুত প্রয়োগ, পরিবর্তন কিংবা সংশোধন যে একটি দেশের জন্য মঙ্গলকর নয় তা তিনি এই বইয়ে তুলে ধরেছেন।
‘আমার দেখা আমার লেখা’ বইটি প্রকাশ করেছে মেরী প্রকাশন। ২০০০ সালের সেপ্টেম্বর মাসে বইটি বের হয়। লেখক বইটিতে ১৯৪৭ থেকে ‘৭৯ সাল পর্যন্ত তাঁর রাজনৈতিক জীবনে ঘটে যাওয়া ঘটনাপ্রবাহ ধারাবাহিকভাবে লিপিবদ্ধ করেছেন।
‘উচ্চ আদালতে বাংলা’ বইটি বের করেছে সুষমা প্রকাশন। প্রকাশ কাল ২০ জুন ২০০৩। লেখক উচ্চ আদালতে বাংলা ভাষা প্রচলনের গুরুত্বপূর্ণ কয়েকটি দিক তুলে ধরেছেন এই বইয়ে। ১৯৮৬ সালের ১ ফেব্রুয়ারি লেখক ভাষা সৈনিকদের সম্মেলন শেষে শহীদ মিনারের বেদীমূলে দাঁড়িয়েছিলেন। এমন সময় শহীদ রফিকের মা তাঁকে প্রশ্ন করেছিলেন, ‘তোমরা উচ্চ আদালতে বাংলা বলো কি?’ লেখক তাত্ক্ষণিক উত্তর দিতে পারেননি এই শহীদ জননীকে। কারণ রাষ্ট্রভাষা বাংলা হলেও সর্বস্তরে এখনো বাংলার প্রচলন হয়নি। সুতরাং এ লজ্জা ঢাকতেই তিনি সেদিন চুপ করে থাকাই শ্রেয় মনে করেছেন। তবে উচ্চ আদালতে বাংলা ভাষা চালু করার জন্য প্রথম থেকে এডভোকেট শামসউদ্দিন আহমদ সংগ্রাম করেছেন তা লেখক এই বইয়ে তুলে ধরেছেন। এমনকি ব্যারিস্টার সৈয়দ ইশতিয়াক, ড. কামাল হোসেন, সবিতারঞ্জন পালসহ অনেক আইনজীবী ইংরেজিতে সওয়াল জবাব করতে করতে একসময় আদালতে বাংলা ভাষার কথা বলতে শুরু করতেন এবং এজন্যে ভুল করেছেন বলে তাঁদের মনে কোনোরকম গ্লানিবোধ জন্মায়নি এই বিষয়টি সহজ সরল ভাষায় লেখক বইয়ে উপস্থাপন করেছেন।
‘এখানে ও সেখানে’ গাজীউল হকের একটি কবিতা গ্রন্থ। বইটি বের করেছে সুষমা প্রকাশন। প্রকাশ কাল ২০ অক্টোবর ২০০৩।
গাজীউল হক ২০০৯ সালের ১৭ জুন মৃত্যুবরণ করেন।
তথ্যসূত্র
১. ভাষাসৈনিক গাজীউল হক, মো. নুরুল হক নুরু, প্রকাশক : উমার আল ফারুক প্রকাশকাল : ২১ ফেব্রুয়ারি ১৯৯৭।
২. আমার দেখা আমার লেখা, গাজীউল হক, প্রকাশক : মেরী প্রকাশন, ২৯/এ, পাটুয়াটুলী, অনন্যা প্লাজা, ঢাকা – ১১০০। প্রকাশকাল : সেপ্টেম্বর ২০০০।
৩. এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম, গাজীউল হক, সন্ধানী প্রকাশন, ৬৮/২, পুরানা পল্টন, ঢাকা – ১০০০। প্রকাশকাল : প্রথম সংস্করণ ফেব্রুয়ারি ১৯৯৪।
৪. সাক্ষাত্কার : জাহানারা বেগম এলিনা, ঠিকানা : হাজীপাড়া, ঢাকা। তারিখ : ৩১.০১.০৭।
৫. সাক্ষাত্কার : সুজাতা হক, ঠিকানা : বাংলাদেশ প্রেস ইন্সটিটিউট, ঢাকা। তারিখ : ০২.০৩.০৭।
লেখক : রীতা ভৌমিক