এই উপমহাদেশের সাত দশকেরও বেশি সময়ের রাজনৈতিক-সামাজিক- সাংস্কৃতিক আখ্যানভাগের প্রত্যক্ষদর্শী তিনি। সমাজের প্রতিটি চেনা-অচেনা গলিতে হাতড়ে ফিরেছেন সভ্যতার ক্রমবিবর্তনের ধাপগুলো, যার বিণ্যাসে নতুন করে বয়ান সাজাবার চেষ্টা ছিল মানুষের মুক্তির। আজীবন সেই লড়াই-সংগ্রামে নিজেকে ব্যপ্ত রেখেছিলেন নিজের স্বকীয়তা আর বৈশিষ্ট নিয়ে। এই ভূ-খণ্ডের সব গণতান্ত্রিক আন্দোলনে তিনি ছিলেন নিরলস যোদ্ধা। মৌলিক সমাজ-সভ্যতা- সংস্কৃতিকে মনের গহীনে লালন করে সারাজীবন মানুষের জন্য রাজনীতি করে গেছেন কমিউনিস্ট পার্টির প্রবীণ নেতা অজয় রায়। কমরেড অজয় রায় নামেই যিনি পরিচিত ছিলেন রাজনৈতিক অঙ্গনে। ক্ষমতার লোভ নয়, সামাজিক দায়বোধ তাঁকে প্রতিনিয়ত তাড়িত করেছে মানবকল্যাণে। তিনি জীবনের ১৮ বছর কারাগারে কাটিয়েছেন।
কমরেড অজয় রায় ১৯২৮ সালের ৩০ ডিসেম্বর ময়মনসিংহের ঈশ্বরগঞ্জে জন্মগ্রহণ করেন। মামার বাড়ির আত্মীয়- স্বজনরা ছিলেন খুবই অবস্থাসম্পন্ন ও শিক্ষিত। অজয় রায়ের মাতামহ ছিলেন বৃটিশ আমলের নামকরা আইনজীবী। তবে তাদের পৈত্রিক বাড়ি ছিল কিশোরগঞ্জের কাটিয়াদী উপজেলার বনগ্রামে। বাবা প্রমথনাথ রায় বারানসী বিশ্ববিদ্যালয়ের বিদেশি ভাষার অধ্যাপক ছিলেন। আর মা কল্যাণী রায় ছিলেন গৃহীনী। চার ভাই-বোনের মধ্যে অজয় রায়ই ছিলেন সবার বড়। বাবার বাড়ি ও মামার বাড়ি দুই জায়গাতেই ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনের আবহ ছিল। অজয় রায়ের এক কাকা ও এক মামা ছিলেন সেই সময়ে সশস্ত্র যুগান্তর দলের সদস্য। তারা বিভিন্ন সময়ে জেলও খেটেছেন।
বাবা যেহেতু বারানসীতে থাকতেন ফলে পরিবারের অন্যান্য সদস্যরাও সেখানেই থাকতেন। বারানসীর সেই এলাকাটি ছিল কিছুটা কমিউনিস্ট প্রভাবিত। তখন সবে রুশ বিপ্লবের ঢেউ এম এন রায়ের মাধ্যমে ভারতবর্ষে এসে দোলা দিচ্ছে। ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনের সংগ্রামীদের মধ্যে কমিউনিস্ট মতাদর্শের কর্মীর সংখ্যা বাড়ছে। অজয় রায়ের পরিচিত বারানসীর অনেকেই তখন কমিউনিস্ট মতাদর্শে উদ্বুদ্ধ হন।
অজয় রায় ১৯৩৭ সালে বারানসীতে চতুর্থ শ্রেণিতে স্কুলে ভর্তি হন। পরিবারের অন্যান্য সদস্যদের সঙ্গে বারানসীতে সময়টা ভালই কাটছিল। অত্যন্ত মেধাবী ছাত্র হিসেবে পরিচিত ছিলেন স্কুল জীবন থেকেই। সময়টা ভারতবর্ষের কমিউনিস্ট আন্দোলনের জন্য সূচনাপর্বের হলেও ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনের একেবারে শেষ ধাপ। চারদিকে তখন ‘ভারত ছাড়’ আন্দোলনের তুমুল জোয়ার।
প্রতিদিনই সভা-সমাবেশে সরগরম থাকতে দেখেছেন বাবার কর্মস্থল বারানসী বিশ্ববিদ্যালয়। স্কুলের ছাত্র থাকাকালেই ভারতীয় কমিউনিস্ট আন্দোলনের সঙ্গে জড়িয়ে পড়েন। অবিভক্ত ভারতে কমিউনিস্ট মতাদর্শে বিশ্বাসী ছাত্ররা তখন নিখিল ভারত ছাত্র ফেডারেশনে কাজ করতো। অজয় রায়ও তার সদস্য হন। বারানসী স্কুলেই তিনি ছাত্র ফেডারেশনের সংস্পর্শে আসেন এবং কমিউনিস্ট নেতাদের সঙ্গে তাঁর সম্পর্ক গড়ে উঠে। যদিও সে সময় ভারতবর্ষে কমিউনিস্ট পার্টি নিষিদ্ধ ছিলো। কমিউনিস্টরা হুলিয়া মাথায় নিয়ে কাজ করতেন তখন। ১৯৪২ সালের কংগ্রেসের উদ্যোগে ভারত ছাড়ো আন্দোলনের একপর্যায়ে স্কুল ছাত্র ধর্মঘট ডাকা হলে অজয় রায় উদ্যোগী হয়ে তা সংগঠিত করেন। ১৯৪৩ সালেই বাংলায় ভয়াবহ দুর্ভিক্ষ দেখা দেয়। এই দুর্ভিক্ষ ও মহামারী প্রতিরোধে সর্বশক্তি নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়ে কমিউনিস্ট পার্টি। বারানসীতে কমিউনিস্ট পার্টির উদ্যোগে ত্রাণ সংগ্রহ কাজে সক্রিয়ভাবে যুক্ত হন কমরেড অজয় রায়।
কমিউনিস্ট পার্টি আর ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনে সক্রিয় অংশগ্রহণের মধ্যেই বারানসীতে ১৯৪৩ সালে প্রথম বিভাগে মেট্রিক পাশ করেন তিনি। এর পর ১৯৪৫ সালে বারানসী বিশ্ববিদ্যালয় থেকেই প্রথম বিভাগে উচ্চ মাধ্যমিক (আইএসসি) পাস করেন। পরে বারানসী বিশ্ববিদ্যালয়েই ফার্মেসী বিভাগে প্রথম বর্ষে ভর্তি হন। অন্য ভাইবোনেরাও তখন স্থানীয় বিভিন্ন স্কুলে পড়াশোনা করছে। সবকিছু মিলিয়ে বেশ ভালই চলছিল অজয় রায়দের। কিন্তু বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হওয়ার এক বছরের মাথায় পরিবারে প্রথম বিপর্যয় ঘটে। বাবা প্রমথনাথ রায় মারা যান। মূলত বাবাই ছিলেন পরিবারের উপার্জনক্ষম ব্যক্তি। ফলে তিনি চলে যাওয়ায় পরিবার সঙ্কটে পড়ে। এই অবস্থার মধ্যেও অজয় রায়ের মা সন্তানদের লেখাপড়া চালিয়ে যান। এই শোক কাটিয়ে উঠতে না উঠতেই পরিবারে আরেক বিপর্যয় দেখা দেয়। স্বামী মারা যাওয়ার এক বছরের মাথায় ইহলোক ত্যাগ করেন কল্যানী রায়ও। বাবা-মা দুজনকে হারিয়ে অজয় রায়ের পরিবার বারানসীতে বিপদের মধ্যে পড়ে যান। পরিবারের অন্য সদস্যরা ছোট। ফলে অজয় রায়ের উপরই দায়িত্ব ছিল বেশি। তিনি নিজের বাড়ি ও মামার বাড়ির সঙ্গে যোগাযোগ করে কিশোরগঞ্জে ফিরে আসার সিদ্ধান্ত নেন। এই সময়টা ভারতীয় রাজনীতির ইতিহাসের জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ। ব্রিটিশরা দেশ ছেড়ে যাচ্ছে। ধর্মের নামে ভারত ও পাকিস্তান নামে আলাদা দুটি রাষ্ট্র হচ্ছে। পাকিস্তান থেকে বিচ্ছিন্ন একটি অংশ পূর্ব পাকিস্তান। কলকাতা, ঢাকাসহ বড় বড় শহরে তখন দাঙ্গা, রক্তারক্তি চলছে। এই অবস্থার মধ্যেই বারানসী বিশ্ববিদ্যালয়ের লেখাপড়ায় ইতি দিয়ে ভাইবোনদের নিয়ে কিশোরগঞ্জে ফিরে আসেন অজয় রায়। কিন্তু তখন তিনি কমিউনিস্ট মতাদর্শের একজন একনিষ্ট অনুসারী। রুশ বিপ্লবের অনুপ্রেরণায় ভারতবর্ষের মানুষের মুক্তির লড়াই তাঁর প্রতিটি কর্মে-চিন্তায়। বিগত শতাব্দীর দ্বিতীয় দশকের পর থেকেই ময়মনসিংহ অঞ্চলের গারো পাহাড়ের পাদদেশে টঙ্গ আন্দোলন ও কিশোরগঞ্জ অঞ্চলে কৃষক আণ্দোলন নানাভাবে দানা বাঁধে। বৃহত্তর ময়মনসিংহ জুড়ে এই সময়টায় নানা আন্দোলন চলছিল কমরেড মণি সিংহ, কমরেড খোকা রায়দের নেতৃত্বে। ফলে এসব আন্দোলন সারা ভারত জুড়েই বেশ প্রভাব ফেলে। এই অবস্থার মধ্যে বাড়িতে ফিরে অজয় রায় ময়মনসিংহের ঈশ্বরগঞ্জে মামাবাড়িতে অন্য ভাইবোনদের পড়াশোনার ব্যবস্থা করেন। আর নিজে চলে যান মুন্সিগঞ্জে। সেখানে গিয়ে বি.কম ভর্তি হন হরগঙ্গা কলেজে।
এর আগে অজয় রায় ১৯৪৬ সালের নির্বাচনে কিশোরগঞ্জ, নেত্রকোনা এবং ময়মনসিংহের ফুলপুর, ঈশ্বরগঞ্জ ও নান্দাইল থানা নিয়ে গঠিত আসনে কমিউনিস্ট পার্টির প্রার্থী হিসেবে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেন। নির্বাচনের আগে-পরে কিশোরগঞ্জ ও মুন্সীগঞ্জে কমিউনিস্ট পার্টি ও ছাত্র ফেডারেশনের সংগঠন গড়ে তোলার কাজে আত্মনিয়োগ করেন এবং কমিউনিস্ট পার্টির ঢাকা জেলা সাব কমিটির সদস্য মনোনীত হন। সেই সময় থেকে কমিউনিস্ট পার্টি ছিল তাঁর ধ্যান- জ্ঞান। তাঁর কাজ ছিল সার্বক্ষণিক কমিউনিস্ট পার্টিকে ঘিরে।
১৯৪৭ সালে ভারত বিভাগ ও পাকিস্তান সৃষ্টি হয়। ১৯৪৮ সালে অজয় রায় বি. কম পরীক্ষা দেন। ১৯৪৮ সালেই কমিউনিস্ট পার্টি সশস্ত্র সংগ্রামের সিদ্ধান্ত নিলে সেই স্লোগানের ভিত্তিতে ওই বছরের ডিসেম্বরে ছাত্র সম্মেলন করতে গিয়ে অজয় রায় গ্রেফতার হন। অজয় রায়ের নিজের জবানিতে ‘১৯৪৮ সালে ভারতের কমিউনিস্ট পার্টির দ্বিতীয় কংগ্রেসের পর তা শুরু হলো। এসবের আগে কমিউনিস্ট পার্টির একটা বুকলেট বের হলো ‘স্বাধীন সুখী পাকিস্তান গড়ে তুলুন’। তখন তো একটাই পাকিস্তান ছিল। আমিও রংপুরে রাস্তায় দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে এটা বিক্রি করেছি ছাত্রদের কাছে। অনেক বিক্রি হয়েছে। কারণ, সেটা ছিল জাতীয় আকাঙ্ক্ষার সঙ্গে সংগতিপূর্ণ। যেই উল্টোটা হয়ে গেল, অর্থাৎ সমাজতন্ত্রের জন্য সশস্ত্র বিপ্লবের সিদ্ধান্ত হয়ে গেল-সবকিছুর বদল ঘটে গেল।’
জেলে থাকাকালে রাজবন্দীদের বিশেষ মর্যাদা কেটে দিয়ে সাধারণ হাজতির পর্যায়ে নামিয়ে দেবার প্রতিবাদে অন্য রাজবন্দীদের সাথে অজয় রায় ৭ দিন, ২০ দিন ও ৪০ দিন করে তিনবার অনশন করেন। চতুর্থবার অনশন চলাকালে ১৯৪৯ সালের ডিসেম্বরে তিনি জেল থেকে মুক্তি পান। মুক্তি পেয়ে মুন্সীগঞ্জের চাঁপাতলী স্কুলে প্রধান শিক্ষকের কাজে যোগ দেন।
দেশ বিভাগের কিছুদিনের মধ্যেই পাকিস্তানের মানুষের মধ্যে মোহভঙ্গ হতে শুরু করে। তারা ধীরে ধীরে বুঝতে পারে, ব্রিটিশের গোলামি থেকে মুক্ত হয়ে পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠীর যাঁতাকলে আটকে পড়ে যাচ্ছে। অজয় রায় জেলে থাকাকালীন সময়েই বাঙলা ভাষার দাবিতে আন্দোলন শুরু হয়ে যায়।
১৯৫০ সালে অজয় রায় মুন্সীগঞ্জের রামপাল হাইস্কুলে শিক্ষকতার কাজে যোগ দেন। ওই বছরের সেপ্টেম্বরে আবার তিনি গ্রেফতার হন। টানা প্রায় চার বছর জেলে ছিলেন। ১৯৫৪ সালের জানুয়ারিতে মুক্তি দিয়ে তাঁকে ময়মনসিংহ মিউনিসিপ্যাল এলাকায় অন্তরীণ রাখা হয়। সেখানে তিনি কমিউনিস্ট পার্টির ময়মনসিংহ জেলা কমিটির সাথে যুক্ত হন।
১৯৫৪ সালের যুক্তফ্রন্ট নির্বাচনের আগে রাজনৈতিক পরিস্থিতির কিছুটা উন্নতি হয়। তখন কমিউনিস্টরা আত্মগোপন থেকে ধীরে ধীরে বেরিয়ে আসতে শুরু করেন। এই নির্বাচনকে কেন্দ্র করেই ময়মনসিংহে কমিউনিস্ট পার্টির প্রকাশ্য কার্যালয় খোলা হলে অজয় রায় তার দায়িত্ব নেন। কিন্তু নির্বাচনের আগে আগে তিনি আবারও গ্রেফতার হন। তবে নির্বাচনে যুক্তফ্রন্টের অভূতপূর্ব বিজয় হয়। যুক্তফ্রন্ট সরকার গঠনের পর পরই তিনি ছাড়া পান। কিন্তু যুক্তফ্রন্ট সরকার বেশিদিন টেকেনি। ফলে পাকিস্তান সরকার অল্প কিছুদিনের মধ্যেই ৯২-ক ধারা জারি করে। এর ফলে তিনি আবার আত্মগোপনে চলে যান। আত্মগোপন থাকা অবস্থায়ই তিনি কমিউনিস্ট পার্টির ময়মনসিংহ জেলা সম্পাদকমণ্ডলীর সদস্য নির্বাচিত হন। হুলিয়া প্রত্যাহার হলে তিনি প্রকাশ্যে এলে অল্প কিছুদিনের মধ্যে আবার গ্রেফতার হন। বছরখানেক আটক থাকার পর ১৯৫৬ সালে পূর্ব বাংলায় আওয়ামী লীগ-কংগ্রেস মন্ত্রিসভা গঠিত হলে তিনি মুক্তি পান।
১৯৫৭ সালে আওয়ামী লীগ ভেঙে যায়। আওয়ামী লীগের মধ্য থেকে একদল প্রগতিশীল নেতা বেরিয়ে এসে ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি (ন্যাপ) গঠন করে। অজয় রায় তখন ন্যাপে যোগ দেন এবং ময়মনসিংহ জেলা কমিটির সহসম্পাদক নির্বাচিত হন। ১৯৫৮ সালে আইয়ুব খান সামরিক শাসন জারি করলে তিনি আবারও আত্মগোপনে যান। কিন্তু ১৯৬০ সালে টাংগাইল থেকে গ্রেফতার হন তিনি। এই যাত্রায় প্রায় পাঁচ বছর কারাগারে থেকে মুক্তি পান ১৯৬৫ সালের জুলাই মাসে। ওই বছর পাক-ভারত যুদ্ধ শুরু হলে সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ভুক্ত রাজনৈতিক ও সামাজিক নেতৃবৃন্দকে গ্রেফতার করা শুরু হয়। তখন অজয় রায় দেশরক্ষা আইনে আবারও গ্রেফতার হন। ১৯৬৫ সালে কারাগার থেকে পরীক্ষা দেন তিনি এবং অর্থনীতি বিষয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের এম. এ ডিগ্রি অর্জন করেন। ১৯৬৯ সালের গণঅভ্যুত্থানের সময় তিনি মুক্তি পান। কিন্তু সে বছর ইয়াহিয়া খানের সামরিক শাসন জারি হলে নভেম্বর মাসে অজয় রায় আবারও গ্রেফতার হন।
১৯৭১ সালের ২৬ মার্চ স্বাধীনতা ঘোষণার পর ২৮ মার্চ ময়মনসিংহে ইপিআর ছাউনি ঘেরাও করে জনগণ ছয়জন পাঞ্জাবি সৈনিককে জেলে ঢুকিয়ে অজয় রায়কে মুক্ত করে আনেন। সারা বাংলা তখন জ্বলছে। চারদিকে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী গণহত্যায় মেতে উঠেছে। ময়মনসিংহ ও তারপাশের এলাকাও হানাদার বাহিনীর দখলে। এই অবস্থার মধ্যে মুক্তি পেয়েই অজয় রায় ওই অঞ্চলে মুক্তিযুদ্ধ সংগঠনের কাজে আত্মনিয়োগ করেন। ময়মনসিংহ শহরের মহাখালী স্কুলে, পরে কিশোরগঞ্জকে ভিত্তি করে মুক্তিযোদ্ধাদের সংগঠিত করতে থাকেন। কিন্তু পাকিস্তানি সেনাবাহিনী আরো আগ্রাসী হয়ে উঠলে জুলাই মাসের শেষভাগে আগরতলা সীমান্ত দিয়ে ভারতে চলে যান তিনি। আগেই কমিউনিস্ট পার্টির অনেক নেতাকর্মী ভারতে গিয়ে আশ্রয় নিয়েছিলেন। অজয় রায় আগরতলায় গিয়ে তাঁদের সঙ্গে যোগাযোগ করেন। পরে কলকাতা হয়ে মেঘালয়ের বারেংগাপাড়ায় স্থাপিত ক্যাম্পকে ভিত্তি করে মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করেন। এ সময় তিনি ন্যাপ- কমিউনিস্ট পার্টি-ছাত্র ইউনিয়ন যৌথ গেরিলা বাহিনী ক্যাম্পে দায়িত্ব পালন করেন।
স্বাধীনতার পর ১৯৭২ সালে কমরেড অজয় রায় ময়মনসিংহে ফিরে আসেন এবং পুনরায় কমিউনিস্ট পার্টির কাজে যুক্ত হন। সে সময় তিনি ট্রেড ইউনিয়ন কেন্দ্রের জেলা সভাপতি নির্বাচিত হন। ১৯৭৩ সালে বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টির দ্বিতীয় কংগ্রেসে তিনি কেন্দ্রীয় সম্পাদকমণ্ডলীর সদস্য নির্বাচিত হন। এ সময় তিনি ঢাকায় বসবাস শুরু করেন। তিনি কমিউনিস্ট পার্টির অর্থনীতি, বিজ্ঞান ও সংস্কৃতি বিভাগের দায়িত্ব পালন করেন। কিছুদিন তিনি সাপ্তাহিক একতা পত্রিকার সম্পাদকের দায়িত্বও পালন করেন। এই সময়ে তিনি রাশিয়াসহ পূর্ব ইউরোপের অনেক কমিউনিস্ট দেশ ভ্রমণ করেন।
বিগত শতাব্দীর আশির দশকের শেষ দিকে পূর্ব ইউরোপের দেশগুলোতে সমাজতান্ত্রিক সরকারের পতন হতে শুরু করে। একপর্যায়ে নব্বই দশকে এসে সোভিয়েত ইউনিয়নের পতন হয়। বিশ্বে নেমে আসে সমাজতন্ত্রের বিপর্যয়। এর ঢেউ এসে বাংলাদেশের সমাজতান্ত্রিক আন্দোলনেও লাগে। সমাজতান্ত্রিক মতাদর্শ ত্যাগ করে এখানকার কমিউনিস্ট পার্টির নেতারা বিভিন্ন দলে চলে যান।
অজয় রায়ও কমিউনিস্ট পার্টি ত্যাগ করেন। কিন্তু অন্য নেতাদের মতো সমাজতন্ত্র ত্যাগ করেননি। সমগ্র জীবন অজয় রায় মানুষের জন্য কল্যাণের জন্য কাজ করে গেছেন। সোভিয়েত ইউনিয়নের পতনের পর তাঁর দীর্ঘদিনের স্বপ্ন ভেঙে যায়। কিন্তু তিনি হতাশ না হয়ে, বিকল্প পথ বেছে নিয়েছিলেন। ১৯৯২ সালের বিশেষ কংগ্রেসের পর কমিউনিস্ট পার্টি থেকে বেরিয়ে এসে কমরেড অজয় রায় ‘কমিউনিস্ট কেন্দ্র’ নামে একটি রাজনৈতিক দল গঠন করেন। তাঁর দল এদেশের গণতান্ত্রিক আন্দোলনের জন্য কাজ শুরু করে। বামপন্থী ও প্রগতিশীল গণতান্ত্রিক রাজনৈতিক দলগুলোর মোর্চা ১১ দলীয় জোট গঠনেও তিনি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন। এর পাশাপাশি তিনি বিভিন্ন সামাজিক ইস্যুতে আন্দোলন গড়ে তোলার লক্ষ্যে সম্মিলিত সামাজিক আন্দোলন নামে একটি সংগঠন গড়ে তোলেন। তিনি এর সভাপতি ছিলেন। এ ছাড়া সাম্প্রদায়িকতা-জঙ্গিবাদবিরোধী মঞ্চের সমন্বয়ক হিসেবেও দায়িত্ব পালন করেন তিনি।
যৌবনের সূচনালগ্নে একটি শোষণ, বৈষম্য ও বঞ্চনামুক্ত অসাম্প্রদায়িক গণতান্ত্রিক সমাজব্যবস্থা ও রাষ্ট্রকাঠামো বিনির্মাণের স্বপ্ন নিয়ে অজয় রায় রাজনীতিতে সক্রিয় হয়েছিলেন। সেই নিজস্ব বোধ ও লক্ষ্যকে সমুন্নত রেখে তিনি আজীবন কাজ করে গেছেন। যে কারণে শেষ পর্যন্ত তিনি বিশ্বাসে ছিলেন স্থির। তিনি বলেছিলেন, ‘যদি কোনো মতবাদে বিশ্বাস থেকে থাকে-বিশেষ করে ইতিহাসের বিবর্তন সম্পর্কে কার্ল মার্ক্সের যে বক্তব্য, সমাজবিকাশের বিষয়ে যে বক্তব্য, সেই জায়গায় মার্ক্সবাদের ওপর আমার ধারণা-বিশ্বাস অবশ্যই আছে। সেটা আক্ষরিক অর্থে নয়, তাঁর মূল যে বিষয়, সেখানে বিশ্বাস অবশ্যই আছে।’
কমরেড অজয় রায়ের দীর্ঘ রাজনৈতিক জীবনে সর্বমোট ১৮ বছর জেল খেটেছেন এবং স্বাধীনতার আগে-পরে পাঁচ বছরের বেশি সময় আত্মগোপনে কাটিয়েছেন। তিনি ‘বাঙলা ও বাঙালি’, ‘বাংলাদেশের অর্থনীতির অতীত ও বর্তমান’, ‘বাংলাদেশের ভূমি ব্যবস্থার সংকট ও সমাধান’, ‘বাংলার কৃষক বিদ্রোহ’, ‘শিক্ষানবিশীর হাতেখড়ি’, ‘রাজনীতির অ আ ক খ’, ‘পুঁজিবাদী অর্থনীতি’, ‘গণআন্দোলনের এক দশক’, ‘আমাদের জাতীয় বিকাশের ধারা’, ‘বাংলাদেশের বামপন্থী আন্দোলন’সহ অনেকগুলো গ্রন্থ রচনা করেছেন। তিনি বিভিন্ন জাতীয় দৈনিকে নিয়মিত কলাম লিখেছেন।
১৯৭১ সালে তিনি শ্রীমতী জয়ন্তী দেবীর সঙ্গে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হন। এই দম্পতির দুই মেয়ে ও এক ছেলে। ছেলেমেয়েরা সবাই প্রতিষ্ঠিত। তাঁর বড় মেয়ে অনিন্দিতা সুইজারল্যান্ডে এবং ছেলে অমিতাভ ও ছোট মেয়ে অদিতি যুক্তরাষ্ট্রে বসবাস করেন। ছেলে অমিতাভ পদার্থবিজ্ঞানী।
কমরেড অজয় রায় ২০১৫ সাল থেকেই বার্ধক্যজনিত নানা রোগে ভুগছিলেন। অবশেষে ২০১৬ সালের ১৭ অক্টোবর ভোর ৫টায় রাজধানীর ধানমণ্ডিতে নিজ বাসায় তিনি শেষ নি:শ্বাস ত্যাগ করেন। তাঁর শেষ ইচ্ছে ছিল বাংলার মাটিতে মিশে যাওয়ার। তাঁর শেষ ইচ্ছা অনুযায়ী তাঁকে কটিয়াদী উপজেলার বনগ্রাম ইউনিয়নের নন্দীপাড়া পারিবারিক শশ্মানে সমাধিস্ত করা হয়।
তথ্যসূত্র: ২০১৬ সালে অজয় রায়ের স্ত্রী জয়ন্তী রায়ের সরাসরি সাক্ষাৎকার নিয়ে জীবনীটি তৈরী করা হয়েছে।
লেখক: চন্দন সাহা রায়