প্রতিভা মুৎসুদ্দির জন্মদিনটি ছিল বেশ নাটকীয়। ইতিমধ্যে মুৎসুদ্দি পরিবারে পর পর দুই কন্যা এসেছে। এবার একটি পুত্র সন্তনের আকাঙ্ক্ষা। প্রতিভা যখন মায়ের গর্ভে তখন ঠাকুরদা প্যারী লাল মুৎসুদ্দি স্বপ্ন দেখলেন তাঁর মৃত জেঠামশায় বাড়িতে এসেছেন। তিনি এই স্বপ্নের অর্থ করে নিলেন, এবার তাঁর বংশে পুত্র সন্তান আসছে। ঘটনার দিন হাতে ঘড়ি পরে আকুল আগ্রহে অপেক্ষায় আছেন, ইচ্ছে সবার আগে বংশধরের মুখ দেখবেন। নবজাতকের কান্না শুনে সবাই উৎফুল্ল হলেন। ধাত্রী এসে বকশিস চাইলে ঠাকুরদা পকেটে হাত দিতেই ঠাকুরমা গিয়ে মহা বিরক্ত হয়ে বললেন,‘রেখে দাও তোমার বকশিস। ধুতির দোকানে আর যেতে হবেনা, শাড়ি গহনার দোকানে যাও।’ ঠাকুরদার বিরাট আশা ভঙ্গ হলো। তিনি মনের কষ্টে লেপ মুড়ি দিয়ে শুয়ে পড়লেন।
মায়ের কাছে এই গল্প শুনে প্রতিভা প্রশ্ন করেছিলেন, কেন মেয়েরা কী মানুষ নয়? মা বলতেন, তোমরা দেখিয়ে দাও সত্যিকারের মানুষ হলে ছেলে মেয়ে দুই-ই সমান। প্রতিভা তাঁর ঠাকুরদার প্রত্যাশা মতো বংশধর না হলেও তিনিই বংশের মুখ উজ্জ্বল করেছেন। নিরন্তর কাজ করেছেন মানুষের জন্য। বাংলাদেশে যে কজন মহীয়সী নারী শিক্ষা বিস্তারে দ্যূতি ছড়িয়েছেন আজীবন শিক্ষাব্রতী প্রতিভা মুৎসুদ্দি তাঁদের একজন।
কর্ম জীবনে তিনি সকলের কাছে ‘মিস মুৎসুদ্দি’ নামে খ্যাত আর সামাজিক পরিমন্ডলে ছোট বড় সবার কাছে ‘বড়মা’। স্বাধীনতাপূর্ব বাংলাদেশের তুখোড় ছাত্রনেতা (ছাত্র ইউনিয়ন), ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উইমেন্স (বর্তমান রোকেয়া হল) হলের প্রথম ভিপি এবং ডাকসুর প্রথম ছাত্রী মিলনায়তন সম্পাদিকা, ভারতেশ্বরী হোমসের অধ্যক্ষা,ভাষা আন্দোলনের সক্রিয় সৈনিক প্রতিভা মুৎসুদ্দি। তাঁর বর্নাঢ্য রাজনৈতিক জীবন ও মানব কল্যাণ মূলক কাজের সামাজিক পটভূমি, সর্বোপরি শিক্ষা বিস্তারে তাঁর আত্মনিবেদন যে কাউকে অনুপ্রাণিত করে। এক্ষেত্রে অবদনের জন্য পেয়েছেন ২১শে পদক, পল হ্যরিস আন্তর্জাতিক পুরস্কার সহ একাধিক সামাজিক সম্মাননা। আলোকিত মানুষ গড়ার নির্ভীক তপস্বী প্রতিভা আজ অসংখ্য ছাত্রীর আদর্শ।
প্রতিভা মুৎসুদ্দির জন্ম ১৯৩৫ সালের ১৬ ডিসেম্বর চট্টগ্রমের রাউজান থানার মহামুণি পাহাড়তলী গ্রামে। মা শৈলবালা মুৎসুদ্দি, বাবা কিরণ বিকাশ মুৎসুদ্দি। তাঁদের পাঁচ কন্যা ও চার পুত্রের মধ্যে তৃতীয় প্রতিভা।
শৈশবের কথা উঠলেই বেশ সহজ ভঙ্গিতে তিনি বলেন- ‘দুটো কি তিনটে জামা পরেই কেটে যেতো সারা বছর। বিনোদন বলতে দিগন্ত জোড়া সবুজ মাঠে ছুটে বেড়িয়ে খেলাধুলা আর বই পড়া। ছিলাম ছোট খাটো নাদুস নুদুস। আদরে শাসনে দিদিদের নয়নের মণি। পড়াশুনা আর স্কুল জীবনের শুরুটাও দিদিদের হাত ধরে। চট্টগ্রাম শহরের পাথরঘাটা স্কুলেও সবাই আদর করতেন। ছিল টিফিন খাওয়ার ব্যাবস্থা। খুব আনন্দ করে স্কুলে যেতাম। ১৯৪৩ সালে বাবা হঠাৎ করে আমাদের গ্রামের বাড়িতে পাঠিয়ে দিলেন নিরাপত্তার জন্য। কারণ দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ। বাবা শহরে আইন ব্যবসা করতেন। মহামুণি পাহাড়তলী আমার জন্মস্থান। প্রত্যন্ত গ্রাম। বৌদ্ধ সম্প্রদায় অধ্যূষিত সে গ্রামে অন্যান্য সংস্কার থাকলেও লেখাপড়ার ব্যাপারে মোটামুটি সকলের উৎসাহই ছিল।
একটি মাত্র পাঠশালা – মহামুণি মডেল প্রাইমারি স্কুল। আমার জেঠামশাই ভূবন মুৎসুদ্দি, তিনিই পাঠশালার প্রধান, তিনিই সহকারী। হাতে থাকতো লম্বা এক বেত। আবার হৃদয়ে ছিল অফুরন্ত স্নেহ-মমতা। ক্লাসে ঘন্টা পড়েনা। নামতা পড়ান সুর করে দুলে দুলে। সেই একই কায়দায় কবিতা। আমার ভাল লাগতোনা। আমার জেঠতুতো বোনের মেয়ে আরতি, সে পড়তো অন্য এলাকায় ‘মহামুণি এ্যাংলো পালি ইনিস্টিটিউসনে।’ চলে গেলাম তার সাথে। ওরই সাথে চতুর্থ শ্রেণিতে গিয়ে বসলাম। শিক্ষক হাজিরা খাতায় নাম তুলে নিলেন। এখানে ছেলে-মেয়ে উভয়ই পড়তো।’
প্রতিভা পড়াশুনায় বরাবরাই ভাল ছিলেন। সপ্তম শ্রেণি পাশ করার পর পাড়ার মুরব্বিরা বাবাকে পরামর্শ দিলেন ছেলেদের সাথে পড়ালেখা ঠিক নয়। চরিত্র খারাপ হয়ে যাবে। অতএব পড়া বন্ধ। বাবা বিষয়টা মেনে নিলেন না। যে মেয়ে মেধার জোরে ক্লাসে প্রথম – দ্বিতীয় হয় তার পড়া বন্ধ করা সমুচীন মনে করলেন না তিনি।
১৯৪৮ সালে অষ্টম শ্রেণির ছাত্রী প্রতিভাকে কেন্দ্র করে ছাত্রী সংসদ গঠন করা হয় স্কুলে। এ বয়স থেকেই মন ও মস্তিষ্ক তৈরি হয়ে উঠেছিল দেশাত্মবোধে। লক্ষ্য স্থির হয়েছিল – সমাজের অচলায়তন ভাঙ্গার। সরাসরি রাজনীতিতে জড়িয়ে পড়েন তিনি।
এবছরেই দারুণ খরায় আক্রন্ত হয়ে কৃষকেরা স্বউদ্যোগে চট্টগ্রামের মাদরসার টেক খনন করতে গেলে তদানীন্তন ডেপুটি ম্যাজিস্ট্রেটের আদেশে গুলি বর্ষণ করা হয়। এতে ১৮ কৃষকের অমূল্য জীবন মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়ে। বহু সংখ্যক কৃষক আহত হয়। মাহবুব আলম চৌধুরীর নেতৃত্বে ১৮টি লাশ নিয়ে চট্টগ্রাম শহরে তীব্র প্রতিবাদ মিছিল হয় এবং খুনিদের বিচার দাবি করা হয়। এ সংবাদ ছড়িয়ে পড়ার সাথে সাথে মহামুণি এ্যংলো পালি স্কুলের ছাত্র-ছাত্রীরা শ্রেণিকক্ষ থেকে বেরিয়ে প্রতিবাদ মিছিল করে। এ মিছিলে নেতৃত্ব দেন প্রতিভা ও তাঁর সাথীরা। কৃষক আন্দোলনে সক্রিয় অংশ নেয়ার জন্য শাস্তিস্বরূপ প্রতিভা মুৎসুদ্দিসহ তিন ছাত্রীকে রাষ্ট্রদ্রোহী বলে স্কুল থেকে বহিষ্কার করা হয়। তাঁর বাবা ছিলেন প্রচন্ড রাগী। এঘটনায় প্রতিভার লেখাপড়া প্রায় বন্ধ হবার দশা । রাগ কিছু কমলে তিনি মেয়েকে নিয়ে ডা.খাস্তগীর সরকারী স্কুলে ভর্তি করে দেন। এখানে রাজনীতি করার কোন সুযোগ না থাকলেও সীমাবদ্ধ পরিসরে মত প্রকাশের যে ক্ষেত্রটি ছিল – সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান ও দেয়াল পত্রিকায় লেখা প্রাণের কথা জানাবার ছোট্ট জমি, সেখানেই প্রতিভা বীজ বপন করে ছিলেন নিজেকে তৈরি করার। দশম শ্রেণিতে পড়ার সময় স্কুলে শ্রেষ্ঠ ছাত্রী হিসেবে পুরস্কৃত হন।
১৯৫১ সালে প্রতিভা মুৎসুদ্দি প্রথম বিভাগে মেট্রিক পাস করেন এবং সরকারী বৃত্তি লাভ করেন। এতে তাঁর প্রতি বাবার যে রাগ ছিল তা সম্পূর্ণ উবে যায়। তিনি খুব উৎসাহ নিয়ে মেয়েকে ভর্তি করে দিলেন চট্টগ্রাম সরকারী কলেজে।
১৯৪৮ সাল, ২১শে মার্চ – মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ ঢাকার রেসকোর্স ময়দানে এক বিশাল জনসভায় ঘোষনা করেন,“একথা আপনাদের পরিষ্কার ভাবে বলে দেয়া দরকার যে, পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা হবে উর্দূ, অন্য কোন ভাষা নয়।” এ ঘোষনার পর প্রবল প্রতিবাদ শুরু হয়। জুন মাসে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাবর্তনে তিনি রেসকোর্স ময়দানের সেই কথার পুনরাবৃত্তি করেন। সেখানেও এই বক্তব্যের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ ও বিক্ষোভ প্রদর্শিত হয়। সেই প্রতিবাদের আগুন ছড়িয়ে পড়ে দেশময়। চট্টগ্রামের মহান ভাষা আন্দেলন ও বিপ্লবী কর্মকান্ডের নায়ক ছিলেন মাহবুব আলম চৌধুরী। তাঁর নেতৃত্বে প্রতিভা ও তাঁর সাথীরা আন্দোলন করেন ভাষার দাবীতে।
১৯৫২ সালের ২১শে ফেব্রুয়ারি সমগ্র চট্টগ্রামের স্কুল কলেজে ধর্মঘট পালিত হয়। প্রতিভা মুৎসুদ্দিরা একটি ট্রাকে করে প্রতিবাদ মিছিল নিয়ে প্রথমে খাস্তগীর স্কুলে যান। স্কুল গেইটে গিয়ে স্লোগান দিলে হালিমা(ভাষা সৈনিক) খাতুনের নেতৃত্বে কিছু ছাত্রী বেরিয়ে আসেন। এরপর নন্দন কানন স্কুল, কুসুম কুমারী স্কুল ও আরো কয়েকটি স্কুল ঘুরে তাঁরা কলেজে ফিরে আসেন। দুপুরের দিকে বের হয় ছাত্র-জনতার বিশাল মিছিল। এই মিছিলে শ্রমিক শ্রেণি বিশেষ করে রেল ও দোকান শ্রমিক কর্মচরী যোগদান করে। ঢাকার রাজপথে বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায় বিকাল তিনটার দিকে গুলি চলে ছাত্রদের উপর। সে খবর চট্টগ্রামসহ গোটা দেশে প্রচার হতে সময় লাগেনি। ছাত্র হত্যার সংবাদ তাঁরা জানতে পারলেন শ্রমিকনেতা হারুণ অর রশিদের বক্তৃতায়। লালদিঘি ময়দানে সেদিন শ্রমিকদের পূর্বনির্ধারিত জনসভা হবার কথা। শেষ পর্যন্ত শ্রমিক সভা পরিনত হয়েছিল বিক্ষুদ্ধ ও উত্তাল জনসমুদ্রে এবং স্লোগানে স্লোগানে প্রতিবাদ মুখর। এসময়ে মাহবুব আলম চৌধুরী জল বসন্তে আক্রান্ত হন। তাঁর কাছে পৌঁছাল সেই নির্মম সংবাদ। রোগ শয্যা থেকে তিনি লিখলেন ২১শে ফেব্রুয়ারি গুলি বর্ষণের প্রতিবাদে জলন্ত লাভার মতো এক দীর্ঘ কবিতা – ‘কাঁদতে আসিনি ফাঁসির দাবী নিয়ে এসেছি।’ সকল আন্যায়ে প্রতিবাদ মুখর ছিলেন নির্ভীক সৈনিক মাহবুব উল আলম চৌধুরী। তাঁর সহযোদ্ধা সুচরিত চৌধুরী। তাঁদের সম্পাদনায় মাসিক সীমান্ত পত্রিকাকে কেন্দ্র করে চট্টগ্রাম থেকে প্রবাহিত সাহিত্য-সংস্কৃতি-রাজনীতির যে বেগবান ধারা তা দেশব্যাপী বিস্তৃত হয়েছিল। সে কর্মকান্ডের সঙ্গে প্রতিভা মুৎসুদ্দি জড়িয়ে ছিলেন আষ্টে পৃষ্টে।
প্রতিভা মুৎসুদ্দির কন্ঠে ঝরে পড়ে আজো সেই সেদিনের সংগ্রাম মুখর দ্রোহের ঝাঁজ। তিনি বলেন, ‘আমাদের মানস পট তৈরি করে ছিলেন মাহবুব ভাই – ধর্ম নিরপেক্ষতা, গণতন্ত্র, সমাজতন্ত্রের মন্ত্রে। তখন আমরা পুরোপুরি কমিউনিস্ট ভাবধারার পথিক। ঘরের টান অনুভব করিনা। সত্য, সুন্দর ও ন্যায়ের পথে চলার যে দৃঢ়তা ও আত্মবিশ্বাস তা তৈরি হয়েছিল তখনই।’
১৯৫৩ সালে চট্টগ্রম সরকারী কলেজ থেকে তিনি সাধারণ বৃত্তিসহ প্রথম বিভাগে আই এ পাশ করেন। তখন চট্টগ্রামে ভাল কোন কলেজ বা বিশ্ববিদ্যালয় না থাকায় এই কলেজেই তিনি অর্থনীতি বিষয়ে সম্মান শ্রেণিতে ভর্তি হন। স্বপ্ন ছিল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশুনা করার কিন্তু তখন ঢাকা আসার সাহস পান নি। ভাইরা ছোট। অভিভাবক বলতে তেমন কেউ ছিলেন না, যিনি সেই দায়িত্ব নিতে পারতেন। তাই সেই স্বপ্ন চাপা দিয়ে চট্টগ্রামেই থেকে যান।
১৯৫১-৫৪ সালে বিশিষ্ট কবি সাহিত্যিক সংস্কৃতি কর্মীরা চট্টগ্রাম, কুমিল্লা ও ঢাকায় সাহিত্য সম্মেলন করেন। এইসব সম্মেলনে পাকিস্তান ও ভারতের প্রগতিশীল প্রখ্যাত সাহিত্যিকরা যোগ দিয়ে ছিলেন। নেতৃত্ব দিয়েছিলেন বাংলার মনীষী ড.মো. শহীদুল্লাহ, কবি সুফিয়া কামাল, বোরহানউদ্দিন খান জাহাঙ্গীর, মাহবুব উল আলম চৌধুরী প্রমুখ। সকল বক্তা ভাষা আন্দোলন, বাংলা ভাষার উৎকর্ষতা ও শহীদদের আত্মদান সবিস্তারে আলোচনা করেন, সেই সাথে বাংলা ভাষার মর্যাদা রক্ষায় সর্বশক্তি প্রয়োগের অঙ্গীকার করেন। চট্টগ্রাম ও ঢাকা সম্মেলনে সরব উপস্থিতি ছিল প্রতিভা মুৎসুদ্দির।
১৯৫৪ সালে পাকিস্তান সরকার নির্বাচন ঘোষনা করে। মুসলিম লীগ সরকারের অপশাসন উৎপীড়নে অতিষ্ট রাজনীতিবিদরা যুক্তফ্রন্ট গঠন করেন সরকার উৎখাতের উদ্দেশ্যে। প্রতিভা মুৎসুদ্দির নেতৃত্বে চট্টগ্রাম কলেজের ছাত্র-ছাত্রীরা যুক্তফ্রন্টের পক্ষে প্রচারণা চালায়। তদানীন্তন সময়ে চট্টগ্রাম শহরে মহিলাদের শোভাযাত্রা অকল্পনীয় হলেও প্রতিভাদের কারণেই মা-বোনদের ঘরের বাইরে আনা সম্ভব হয়েছিল। এই নির্বাচনে যুক্তফ্রন্ট নিরঙ্কুশ সংখ্যা গরিষ্ঠতা অর্জন করে সরকার গঠন করে। এর পর পরই প্রতিভা মুৎসুদ্দি ঢাকায় চলে আসেন। ভর্তি হন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে অর্থনীতি বিভাগে সম্মান দ্বিতীয় বর্ষে। তখন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রীদের কোন হল ছিলনা। ছাত্রীরা থাকতেন চামেলী হাউসে যার নাম Dhaka University women students residence. মুসলিম ছাত্রীরা সলিমুল্লাহ হল বা ফজলুল হক হলে আর হিন্দু, বৌদ্ধ ও খ্রীস্টান ছাত্রীরা ঢাকা হলে এ্যাটাস্ট থাকতেন। প্রতিভা এ্যাটাস্ট ছিলেন ঢাকা হলে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে এসে তিনি ছাত্র ইউনিয়নের সঙ্গে আরো ঘনিষ্ঠ ভাবে জড়িয়ে পড়েন। এ সময়ের স্মৃতিচারণ করে তিনি বলেন, ‘তখন মজলুম জননেতা মওলানা আব্দুল হামিদ খান ভাসানী বর্ধমান হাউসে (বর্তমান বাংলা একাডেমি) প্রগতিশীল ছাত্র-ছাত্রীদের নিয়ে সভা করতেন। পাকিস্তানী স্বৈরশাসনের বিরুদ্ধে ও বাংলা ভাষার পক্ষে আমাদের দিক নির্দেশনা দিতেন। আমরা তা অনুসরণ করে কাজ করতাম।’
১৯৫৫ সাল। প্রতিভার সাবসিডারি পরীক্ষা। ইসকেন্দর মির্জা ইতোমধ্যে কেন্দ্রীয় সরকারের স্বরাষ্ট্র মন্ত্রী। সুতরাং নির্যাতন-দমন- দলন চলবেই এতে কোন সন্দেহ নেই। আর এদিকে ভাষা আন্দোলন সংগ্রাম পরিষদের সিদ্ধান্ত হয়, যথারীতি কার্যক্রম চলবে। ২১শে ফেব্রুয়ারি আমতলায় মিটিং কিন্তু পরীক্ষার্থীরা মিটিংএ যাবেনা এটাই ঠিক হলো। আগের রাতেই হলে হলে কলো পতাকা উত্তোলন করা হয়। সেদিনও বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায় ১৪৪ ধারা দিয়ে রেখেছে খুনি সরকার। পুলিশ হলগুলি ঘিরে রেখেছে। চলে পুলিশি তল্লাশি, লাঠিচার্জ, গ্রেফতার। তবু সেই ভোর বেলাতেই ‘রাষ্ট্রভাষা বাংলা চাই’, ‘শহীদ স্মৃতি অমর হোক’- দৃপ্ত কন্ঠের স্লোগানে মুখর হয়ে ওঠে ভোরের নিস্তব্ধতা।
প্রতিভা বলেন-“যতটা নির্দয় পুলিশ তার চেয়ে শতগুণ সাহসী হয়ে উঠেছিলাম আমরা। ছাত্র-যুব সমাজই ছিল ভাষা আন্দোলনের প্রধান চালিকা শক্তি। হলে বসেই খবর পেলাম সকালে মিডফোর্ড ও মেডিকেল কলেজের কয়েকজন ছাত্রীকে পুলিশ গ্রেফতার করেছে। এ খবরে তখন আমাদের মধ্যে বিদ্রোহের আগুন জ্বলে উঠে। আমি ও কামরুন নাহার লাইলী একটা দল নিয়ে হল থেকে শোভাযাত্রা করে এগিয়ে দেখি রাস্তার দুধারে হেলমেট পরা বন্দুকধারী মিলিটারী সারীবদ্ধ দাঁড়িয়ে। তাদের মাঝখান দিয়ে আমরা আমতলায় সমবেত হলাম। এক ছাত্রনেতা আগুনঝরা বক্তব্য দিচ্ছিলেন। হঠাৎ পুলিশের লাঠিচার্জ। যে যেদিকে পারছে ছুটছে। আমার গায়েও পড়ল কয়েক ঘা লাঠি। পড়ে গেলাম মাটিতে। দুজন ছাত্র আমাকে ধরাধরি করে এগিয়ে দিল লাইব্রেরির সামনের বারান্দায়। আমরা কোন রকমে দোতলায় ছাত্রী কমনরুমে গেলাম। সেখান থেকেই দেখতে পেলাম মিলিটারী মধুর ক্যান্টিন, কমার্স বিল্ডিং ও একতলা থেকে ছাত্রদের ধরে নিয়ে যাচ্ছে। কেউ কেউ মেডিকেল কলেজ ক্যাম্পাসে ঢুকে আত্মরক্ষার চেষ্টা করছে। আমরা সাতজন-কামরুন নাহার লাইলী, হোসনে আরা, ফরিদা বারি মালিক, লায়লা নূরসহ আরো দুজন বেশ ক‘ঘন্টা সেখানে গা ঢাকা দিয়ে থেকে পরে লাইব্রেরির দিকে যাই। লাইব্রেরিতে ঢুকতেই লাইব্রেরিয়ান ব্যাপার বুঝতে পেরে কার্ড ছাড়াই আমাদের বই দিলেন।
তখন সন্ধ্যা প্রায়। লাইব্রেরি থেকে বের হলেই ধরা পড়ার সম্ভাবনা তাই আমরা ঠিক করলাম সবাই এক সাথে ধরা দেবো। এরপর আমরা যখন বিশ্ববিদ্যালয় গেইটে পৌঁছাই সেখানে ওত পেতে ছিল মিলিটারী। তারা আমাদের ভ্যানে উঠতে বলল। আমরা তখন স্লোগান দিতে আরম্ভ করলাম – ‘রাষ্ট্রভাষা বাংলা চাই’, ‘শহীদ স্মৃতি অমর হোক।’ স্লোগান শুনে যারা ক্যাম্পাসে আত্মগোপন করে ছিল তারা বেরিয়ে এল। তাদেরও মিলিটারী ভ্যানে তুললো। প্রথমে আমাদের নিয়ে গেল লালবাগ থানায়। শত শত ছাত্র ছাত্রী, একে একে সবার নামে ওয়ারেন্ট লেখা হলো। তারপর রাত ৯.৩০টার দিকে সবাইকে পাঠানো হলো কেন্দ্রীয় কারাগারে। পরদিন হোস্টেল থেকে ছাত্রী বন্ধুরা আমাদের জন্যে কাপড় চোপড়, খাবার ও বই পত্র পাঠিয়ে দিল। দু’দিন পর খাবার পাঠানো বন্ধ। কেননা হোস্টেলের সভাপতি সে সময়ের ভিসি ড.জেনকিন্সের স্ত্রী মিসেস জেনকিন্স বলেছেন, ওরা রাষ্ট্রদ্রোহী-ওদের জন্য কিছু পাঠানো যাবেনা। প্রায় দু‘সপ্তাহ পর ছাড়া পেলাম। পরের বছর ১৯৫৬ সালে সরকার নীতিগত ভাবে স্বীকার করলো পাকিস্তানের অন্যতম রাষ্ট্রভাষা হবে বাংলা। এরপর ২১শে ফেব্রুয়ারি শহীদ দিবস পালনে আর বাধা রইলনা।’
১৯৬৩ সালে প্রতিভা দানবীর রণদা প্রসাদ সাহা প্রতিষ্ঠিত ভারতেশ্বরী হোমসে অর্থনীতির প্রভাষিকা হিসেবে যোগদান করেন। এখান থেকেই তাঁর এক নতুন জীবনের পথ চলা শুরু হয়। তিনি স্নেহময় সান্নিধ্য পেলেন অধ্যক্ষা জয়া পতির। জয়া পতি দানবীর রণদা প্রসাদ সাহার কনিষ্ঠ কন্যা। তিনি কন্যা সমতুল্য স্নেহ-মমতা পেয়েছেন রণদা প্রসাদ সাহার। রণদা প্রসাদ প্রতিভা মুৎসুদ্দিকে ‘মা’ সম্বোধন করতেন। অনুঢ়া প্রতিভা আজীবন লালন করেছেন সেই মাতা–পুত্রের সম্পর্ক।
১৯৬৫ সালে প্রতিভা মুৎসুদ্দি স্বনামধন্য ভারতেশ্বরী হোমসের অধ্যক্ষা হিসেবে দায়িত্ব ভার গ্রহণ করেন। দীর্ঘ চৌত্রিশ বছর এই দায়িত্ব পালন শেষে বর্তমানে তিনি কুমুদিনী ওয়েলফেয়ার ট্রাষ্ট অব বেঙ্গল (বিডি) লি: এর পরিচালক।
আশিউর্ধ্ব জীবনে প্রতিভা মুৎসুদ্দি কাজ করছেন বয়সের ভারকে বহন করা অভ্যাসে পরিনত করে। তাঁর সাদাসিধে জীবনে খাদ্যাভ্যাস সম্পূর্ণ নিরামিষ। নিরামিষ খাদ্যাভ্যাসের পেছনে একটি ঐতিহাসিক কারণ লুকিয়ে আছে। তিনি জানালেন, “১৯৪৮ সালের ৩০শে জানুয়ারি। রেডিওতে মহাত্মা গান্ধীর নাথুরাম গডসের হাতে নিহত হবার সংবাদ প্রচারিত হবার সাথে সাথে স্কুল কলেজ, অফিস আদালত সব বন্ধ হয়ে গেল। আমাদের গ্রামটি ছিল নানা দিক থেকে আলোকিত। গান্ধীজির হিন্দু মুসলমান ভাই ভাই এবং অহিংসা নীতি সম্বন্ধে আনেকেই জানতেন। শত কোটি গুণমুগ্ধর হৃদয়ে তিনি মহাত্মা, ভক্তদের কাছে বাপুজি। তাঁকে কেউ গুলি করে মারতে পারে সেটা ছিল কল্পনার অতীত। মহাত্মা গান্ধীর জন্য প্রায় প্রতিদিনই শোকসভা হত। প্রথম সভায় চট্টগ্রামের বিখ্যাত গায়ক তেজেন সেন গাইলেন — রবীন্দ্রনাথের গান ‘তোমার আসন শূন্য আজি, হে বীর পূর্ণ কর।’ তাঁর কন্ঠে কথা ও সুরের মূর্ছনায় আমরা প্রতিটি শ্রোতা ফুঁপিয়ে কেঁদে ছিলাম। পাড়ায় পাড়ায় শোক সভার আয়োজন হয়েছিল। আমার দুই বান্ধবীসহ আমাদের বাড়িতেই মহাত্মার জন্য আলোচনা শোক সভার আয়োজন করি। সেই সভায় মহাত্মার জীবন, স্বাধীনতা সংগ্রাম ও মানব সেবায় তাঁর অবদান সম্পর্কে আলোচনা করা হয়। সেসময় ‘আমার জীবনই আমার বাণী’ গন্ধীজীর এই বাণী থেকে তাঁর অহিংসা নীতিতে দেশ ও দেশের মানুষের সেবার মন্ত্রে দীক্ষিত হই। আমরা শপথ করি, দেশের আপামর জণগনের কল্যাণ সাধনই হবে আমাদের জীবনের ব্রত, এখন থেকে আমরা নিরামিষ ভোজী হব।’
প্রতিভা মুৎসুদ্দির জীবনে এখনও সেই মন্ত্র মিলেমিশে আছে। সত্যাগ্রহী গান্ধীজি তাঁর আত্মকথায় বলেছিলেন ‘সত্য ছাড়া অন্য কোন ঈশ্বর আছেন তা আমি অনুভব করি না। সত্যময় হবার যাত্রা পথে অহিংসা একটি অবলম্বন।’ প্রতিভা মুৎসুদ্দি তাঁর জীবনে এই সত্যময় পথটি আঁকড়ে ধরেছিলেন কৈশোরেই। সে পথেই আজীবন অবিচল।
তথ্যসূত্র: ২০১৬ সালে লেখক কর্তৃক প্রতিভা মুৎসুদ্দির সরাসরি সক্ষাৎকার থেকে জীবনীটি তৈরী করা হয়েছে।
লেখক: হেনা সুলতানা, শিক্ষক, ভারতেশ্বরী হোমস