১৯৫২ সালের ২৯ ফেব্রুয়ারি, দুপুরবেলা। নারায়ণগঞ্জ জেলা আদালত প্রাঙ্গণে শুধু মানুষ আর মানুষ। তাদের সবার মুখে একটিই স্লোগান- ‘মমতাজ বেগমের মুক্তি চাই’। মাত্র কয়েকদিন আগে ঢাকার রাস্তায় রাষ্ট্রভাষা বাংলার জন্য ছাত্র-জনতা প্রাণ দিয়েছে। সেই সময় মমতাজ বেগম মর্গান স্কুলের ছাত্রীদের নিয়ে রাজপথে মিছিল করেন, সমাবেশে যোগ দেন। তখন থেকেই তিনি পাকিস্তানিদের চক্ষুশূল হলেন। সেকারণেই পুলিশ তাঁকে ধরে নিয়ে এসেছে। মমতাজ বেগম মর্গান স্কুলের প্রধান শিক্ষিকা। তিনি নারায়ণগঞ্জে ছাত্র-যুবক-শ্রমিক-রাজনৈতিক কর্মীদের মধ্যে ভাষা আন্দোলনকে সংগঠিত করেছেন। ফলে সেদিন আদালতে সব শ্রেণি-পেশার মানুষের ভিড়। তারা জানে, ভাষা আন্দোলনে অংশ নেওয়ার কারণেই মমতাজ বেগমকে পুলিশ ধরে নিয়ে এসেছে। পুলিশ থানা থেকে তাঁকে আদালতে পাঠিয়েছে। এ খবর পাওয়ার পর থেকেই সব স্কুল বন্ধ করে শিক্ষক-ছাত্ররা ছুটছে আদালতের দিকে। বিভিন্ন কারখানা থেকে কাজ বন্ধ রেখে আসছে শ্রমিকরা, আসছে জনতা। তারা আদালত থেকে মমতাজ বেগমকে জামিনে মুক্ত করে নিয়ে যেতে এসেছে। আদালত প্রাঙ্গণের অবস্থা বেগতিক। পরিস্থিতি উপলব্ধি করে নারায়ণগঞ্জ জেলা প্রশাসন ঢাকা থেকে ইপিআর পাঠানোর অনুরোধ জানায়। তাতে জনতা আরো উত্তেজিত হয়ে উঠে। তারা বিনা শর্তে মমতাজ বেগমের মুক্তি দাবি করেন। যত বেলা যাচ্ছে, ততই পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যাচ্ছে প্রশাসনের। একপর্যায়ে জনতাকে শান্ত করতে মহকুমা হাকিম ইমতিয়াজি বাইরে বেরিয়ে আসেন। তিনি ঘোষণা দেন, ‘মমতাজ বেগমকে স্কুলের তহবিল তছরুফের দায়ে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। ভাষা আন্দোলনের কারণে নয়। ভাষা আন্দোলনের সঙ্গে এর কোনো সম্পর্ক নেই।’
মহকুমা হাকিমের এই ঘোষণায় সেখানে উপস্থিত রাজনৈতিক নেতারা বুঝতে পারলেন, এই আদালত মমতাজ বেগমের জামিন দেবে না। এরই মধ্যে গুজব ছড়িয়ে পড়ে নারায়ণগঞ্জের পরিস্থিতি সামাল দেওয়ার জন্য ঢাকা থেকে সেনাবাহিনী পাঠানো হচ্ছে। এটি শুনে জনতা আরো উত্তেজিত হয়ে পড়ে। তারা ঢাকার দোহারের পুলের পর থেকে পঞ্চবটি পর্যন্ত সড়কে গাছ কেটে বেরিকেড তৈরি করে।
এরই মধ্যে ১০ হাজার টাকা মুচলেকার বিনিময়ে নারায়ণগঞ্জ মহকুমা আদালতে মমতাজ বেগমের জামিন আবেদন করা হয়। কিন্তু মুসলিম লীগ সরকারের সরাসরি হস্তক্ষেপে সেই জামিন বাতিল হয়ে যায়। জনতার বিক্ষোভ আরো তুঙ্গে উঠে। এ রকমটি হতে পারে আগেই জানতেন নারায়ণগঞ্জের ভাষা আন্দোলনের সংগঠকরা। ফলে তারা সেদিন উচ্চ আদালত থেকে মমতাজ বেগমের জামিন করানোর জন্য ঢাকায় লোক পাঠান। কিন্তু পাকিস্তান সরকারের হস্তক্ষেপে সেখানেও মমতাজ বেগমের জামিন নাকচ করে দেন বিচারক। এই খবর পৌঁছানোর পর পরই মানুষ নারায়ণগঞ্জ-ঢাকা মহাসড়কে অবরোধ গড়ে তোলে। সেই অবরোধ সরিয়ে বিকেলে সেনাবাহিনী নারায়ণগঞ্জ আসে। এ সময় হাজার হাজার মানুষ রাজপথে এসে অবস্থান নেয়। পুলিশ তাদের ওপর নির্বিচারে হামলা চালায়। আদালত থেকে মমতাজ বেগমকে গাড়ি করে ঢাকায় নিয়ে যাওয়ার পথে জনতা গাড়িটি চাষাড়া মোড়ে আটকে দেয়। সেখানে জনতার সঙ্গে পুলিশের সংঘর্ষ হয়। অনেকে গ্রেপ্তার হন। পরে সন্ধ্যার দিকে মমতাজ বেগমকে ঢাকায় নিয়ে যাওয়া হয়। এরপর মমতাজ বেগম প্রায় দেড় বছর কারাগারে ছিলেন। মুচলেকা দিয়ে বেরিয়ে আসার সুযোগ থাকলেও এ ভাষা সংগ্রামী তা করেননি। আর এ জন্য পরিবার ও রাষ্ট্র থেকে খুব নিষ্ঠুর আচরণের মুখোমুখি হতে হয় তাঁকে।
ভাষা আন্দোলনের ইতিহাসে এটি একটি অভূতপূর্ব ঘটনা। ঢাকার বাইরে এই ধরনের ঘটনা সে সময় ব্যাপক আলোড়ন তোলে। নারায়ণগঞ্জের মমতাজ বেগম ভাষা আন্দোলনের ইতিহাসে ভিন্ন এক চরিত্র। কিন্তু সেই চরিত্রের কথা আজ আর কজনই-বা জানে? অথচ বাংলা ভাষা আন্দোলনের অন্যতম প্রধান গবেষক বদরুদ্দীন উমর লিখেছেন, ‘ভাষা আন্দোলনে নারীদের ভূমিকা নিয়ে আজকাল কিছু লেখালেখি হয়। তাতে এমন অনেক কথা বাড়িয়ে বলা হয় যাঁদের ভূমিকা ছিল নগন্য। অবস্থা এমন দাঁড়িয়েছে যে, বস্তুত: পক্ষে যাদের কোনো অবদানই ছিল না তাঁরাও ‘নারী ভাষাসৈনিক’ হিসেবে নিজেদের প্রচার করছেন। কিন্তু আপাতদৃষ্টিতে বিস্ময়কর ব্যাপার এই যে, ১৯৪৮ ও ১৯৫২ সালের দুই পর্যায়ে ভাষা আন্দোলনে সামগ্রিকভাবে নারীদের ভাষা আন্দোলনের দিকে তাকালে যে শীর্ষ ব্যক্তির নাম সর্বাগ্রে থাকা দরকার তার বিষয়ে বিশেষ কিছুই বলা হয় না, এমনকি অনেক আলোচনায় যার কোনো উল্লেখই থাকে না তিনি হলেন মমতাজ বেগম।’
ভাষা সৈনিক মমতাজ বেগমের জন্ম ১৯২৩ সালে ভারতের ভূপালে। তাঁর প্রকৃত নাম কল্যানী রায় চৌধুরী। পরিবারের সবাই তাঁকে মিনু নামে ডাকত। তাদের পূর্বপূরুষরা রাজশাহী অঞ্চলের জমিদার ছিলেন। তাঁর বাবা রায়বাহাদুর ছিলেন কলকাতার হাইকোর্টের বিচারপতি। আর মা মাখন মতি দেবী ছিলেন স্কুলশিক্ষিকা। মাখন মতি দেবী ছিলেন প্রখ্যাত সাহিত্যিক প্রমথনাথ বিশির বোন। সেই সময় হিন্দু সমাজের রক্ষণশীলতার মধ্যেও কল্যাণী রায় ভালবেসেছিলেন কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের ছাত্র গোপালগঞ্জের আবদুল মান্নাফকে। পরে তারা বিয়ে করে পূর্ব পাকিস্তানে চলে আসেন। বিয়ের পরই কল্যাণী রায় ‘মমতাজ বেগম’ হয়ে উঠেন। আবদুল মান্নাফ খাদ্য বিভাগে সরকারি চাকরি করতেন। তিনি ঢাকা জেলা খাদ্য বিভাগের উর্ধ্বতন কর্মকর্তা ছিলেন। তাদের একটি কন্যাসন্তান ছিল। মমতাজ বেগম কলকাতা থেকে ১৯৩৮ সালে এন্ট্রান্স (প্রবেশিকা পরীক্ষা) পাস করেন। ১৯৪২ সালে বেথুন কলেজ থেকে বিএ এবং পরে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ১৯৫৮ সালে বিএড এবং ১৯৬৩ সালে এমএড ডিগ্রি লাভ করেন। বিএ পরীক্ষা দেওয়ার পর পরই মমতাজ বেগম চাকরি জীবন শুরু করেন স্টেট ব্যাংক অব ইন্ডিয়ার মাধ্যমে। দেশবিভাগের পর থেকেই স্বাধীনচেতা মমতাজ বেগম বাঙালির ভাষা আন্দোলনের সঙ্গে জড়িয়ে পড়েন। এর আগে তিনি ময়মনসিংহের বিদ্যাময়ী স্কুলে সহকারী শিক্ষিকা হিসেবে সাত মাস কাজ করেন। পরে তিনি ১৯৫১ সালে নারায়ণগঞ্জের ঐতিহ্যবাহী মর্গান হাই স্কুলে প্রধান শিক্ষিকা হিসেবে যোগ দেন। ভাষা আন্দোলনে অংশ নেওয়ার কারণে সেখান থেকে চাকরি চলে যায় তার। পরে ১৯৫৪ সালে আনন্দময়ী গার্লস স্কুলে প্রধান শিক্ষিকা হিসেবে যোগ দেন এবং সবশেষে কিছু সময়ের জন্য আহমেদ বাওয়ানি জুট মিল স্কুলে প্রধান শিক্ষিকার কাজ করেন। এ ছাড়া শিক্ষা বিস্তারের জন্য তিনি ‘শিশু নিকেতন’ নামে একটি স্কুল প্রতিষ্ঠা করেন।
১৯৪৭ সালে দ্বিজাতিতত্ত্বের ভিত্তিতে ভারত ও পাকিস্তান নামে দুটি দেশের জন্ম হয়। এ দুটি দেশের মূল ভিত্তি ছিল ধর্মীয় পরিচয়। পাকিস্তানের আবার দুটি অংশ পূর্ব পাকিস্তান আর পশ্চিম পাকিস্তান। মূলত পশ্চিম পাকিস্তানের শাসকগোষ্ঠীর হাতেই ছিল দেশ পরিচালনার মূল নিয়ন্ত্রণ। দেশভাগের পরই পাকিস্তানের রাষ্ট্র ভাষা কী হবে এ নিয়ে সমস্যা দেখা দেয়। পশ্চিম পাকিস্তানের শাসকগোষ্ঠী উর্দুকে একমাত্র রাষ্ট্রভাষা করার উদ্যোগ নিলে বাঙালিরা তার তীব্র প্রতিবাদ করে। বাঙালিদের দাবি ছিল, বাংলাকেও পাকিস্তানের অন্যতম রাষ্ট্রভাষা হিসেবে স্বীকৃতি দিতে হবে। ভাষাকেন্দ্রিক পূর্ব পাকিস্তানের রাজনীতির প্রথম ভাগটা কিন্তু ঢাকাকেন্দ্রিকই ছিল। তবে ঢাকার সংলগ্ন এলাকা হিসেবে নারায়ণগঞ্জেও শুরু থেকেই ভাষা আন্দোলন দানা বাঁধতে থাকে। ভাষা আন্দোলনের গোড়াতেই মফিজ উদ্দিন আহম্মদকে আহ্বায়ক এবং আজগর হোসেন ভূঁইয়াকে যুগ্ম-আহ্বায়ক করে সংগ্রাম পরিষদ গঠিত হয়।
১৯৫২ সালের শুরু থেকে ভাষা আন্দোলন গুরুত্বপূর্ণ মোড় নিতে থাকে। পাশাপাশি পাকিস্তানের রাজনৈতিক সংকটও ঘনীভূত হয়। পূর্ব পাকিস্তানের অর্থনৈতিক অবস্থারও অবনতি ঘটে। পূর্ব পাকিস্তানের জনগণ ভাবতে থাকে, ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদকে বিদায় দিয়ে তারা মুসলমানের জন্য আলাদা একটি রাষ্ট্র গড়ে তুলেছে। কিন্তু সেখানেও আরোপিত হয়েছে নতুন ধরনের আরেক উপনিবেশবাদ। এর ফলে এখানকার মানুষ, ক্রমাগতই মুসলিম লীগের প্রতি আস্থা হারাতে থাকে। এই অবস্থার মধ্যেই ১৯৪৯ সালে মাওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানীর নেতৃত্বে গঠিত হয় নতুন রাজনৈতিক দল আওয়ামী লীগ মুসলিম লীগ। শেখ মুজিবুর রহমানও এর নেতা ছিলেন। এই সংগঠনটি প্রতিষ্ঠার প্রথম পর্যায়ে নারায়ণগঞ্জের ভাষা আন্দোলনের অন্যতম সংগঠক এ কে এম শামসুজ্জোহা ওতোপ্রতোভাবে জড়িত ছিলেন।
এরকম একটি পরিস্থিতিতে নারায়ণগঞ্জের ঐতিহ্যবাহী মর্গান স্কুলে প্রধান শিক্ষিকা হিসেবে যোগদান করেন মমতাজ বেগম। স্বামী আব্দুল মান্নাফ তখন পাকিস্তান সিভিল সার্ভিসের কর্মকর্তা হিসেবে ঢাকা জেলা খাদ্য পরিদর্শকের পদে নিয়োজিত ছিলেন। ভাষা আন্দোলনের সে সময়ের কর্মী খাজা মহিউদ্দিনসহ বেশ কয়েকজন উল্লেখ করেছেন, নারায়ণগঞ্জ আসার পর মমতাজ বেগম এখানকার প্রগতিশীল রাজনৈতিক ঘরানার নেতাদের সঙ্গে যোগাযোগ করেন। তাদের সঙ্গে ভাষা আন্দোলন সংগঠনের কাজে অংশ নেন। এমনকি কেউ কেউ এমন তথ্যও দিয়েছেন যে, সে সময় মমতাজ বেগম নারায়ণগঞ্জের শিল্প শ্রমিকদের মধ্যেও রাষ্ট্রভাষা বাংলার দাবিকে জোরদার করার জন্য সভা-সমাবেশ ও বৈঠক করেছেন। ঢাকার পাশে নারায়ণগঞ্জ যে সে সময় ভাষা আন্দোলনের প্রতিটি মুহূর্তের সঙ্গেই যুক্ত ছিল, সেটি স্পষ্ট।
এই অবস্থার মধ্যেই ১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি কেন্দ্রীয় রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদ পূর্ব পাকিস্তানে হরতাল ও বিক্ষোভ সমাবেশের ডাক দেয়। পাকিস্তানের মুসলিম লীগ সরকার এই আয়োজনকে বানচাল করতে ১৪৪ ধারা জারি করে। সংগ্রাম পরিষদের নেতারা আগের দিন সন্ধ্যায় ১৪৪ ধারা ভঙ্গ করার সিদ্ধান্ত নেন। এর পরের অংশটুকু তো শুধুই ইতিহাস।
সেদিন ছাত্রছাত্রীরা পাঁচ-সাতজন করে ছোট ছোট দলে ‘রাষ্ট্রভাষা বাংলা চাই’ স্লোগান দিয়ে রাস্তায় বেরিয়ে পড়লে পুলিশ তাদের উপর লাঠিচার্জ করে। ছাত্রছাত্রীরা পুলিশের দিকে ইট-পাটকেল ছোড়া শুরু করলে পুলিশ কাঁদানে গ্যাস ব্যবহার করে। বিক্ষুব্ধ ছাত্রদের সামলাতে ব্যর্থ হয়ে গণপরিষদ ভবনের দিকে অগ্রসররত মিছিলের উপর পুলিশ গুলি চালায়। গুলিতে রফিক, জব্বার, বরকত, সালাম, অহিউল্লাহ নিহত হয়। আহত হয় অনেকে। এই খবর নারায়ণগঞ্জ আসতে বেশি সময় লাগেনি। সেদিন বিকেলেই নারায়ণগঞ্জে প্রতিবাদ সমাবেশ হয়। এ ঘটনার বর্ণনা দিতে গিয়ে নারায়ণগঞ্জের ভাষা আন্দোলনের কর্মী খাজা মহিউদ্দিন বলেন, “২১ ফেব্রুয়ারি বিকেলে নারায়ণগঞ্জের রহমতুল্লা মুসলিম ইনস্টিটিউটে এক বিশাল সমাবেশ অনুষ্ঠিত হয়। এর প্রধান অতিথি ছিলেন মুসলিম লীগের সাধারণ সম্পাদক আবুল হাশেম। ওই সমাবেশে মর্গান গার্লস স্কুলের প্রধান শিক্ষিকা মমতাজ বেগমের নেতৃত্বে বিপুল সংখ্যক ছাত্রী ও নারী মিছিল নিয়ে স্লোগান দিতে দিতে ওই সমাবেশে যোগ দেন। নারায়ণগঞ্জে তখনকার দিনে ঘোড়াগাড়ি ও রিকশায় পর্দা টানিয়ে নারীরা চলাফেরা করতেন। মমতাজ বেগমের নেতৃত্বে ‘রাষ্ট্রভাষা বাংলা চাই’ স্লোগান দিতে দিতে এই প্রথম নারীরা রাস্তায় নেমে আসেন। বিপ্লবী মমতাজ বেগমের সাহসী নেতৃত্বের সবাই ভূয়সী প্রশংসা করেন। ওই সভায় ছাত্র জনতা জানতে পারে, ঢাকায় চারজন ছাত্রকে পুলিশ গুলি করে হত্যা করে। এই সংবাদ শোনার সঙ্গে সঙ্গে মমতাজ বেগমের নেতৃত্বে নারায়ণগঞ্জ শহরে বিক্ষিপ্ত মিছিল হয়।”
পাকিস্তান সরকার সে সময় প্রচার চালানোর চেষ্টা করে ভারত থেকে হিন্দুরা এসে এই ‘বিশৃঙ্খলা‘ তৈরি করছে। ভাষা আন্দোলনকে দমানোর জন্য অন্য অনেকগুলো কৌশলের এটাও ছিল একটা। মমতাজ বেগম যেহেতু আগে হিন্দু ছিলেন, ফলে তার বিরুদ্ধেও এ অপ্রচার চালানো হয়। ভাষা সংগ্রামী অধ্যাপক রফিকুল ইসলামের সাক্ষাতকারেও বিষয়টি এসেছে, তিনি বলেন, “নারায়ণগঞ্জ মর্গান স্কুলের হেডমিস্ট্রেস ছিলেন মমতাজ বেগম। তিনি ভাষা আন্দোলনের কর্মী ছিলেন। তাকে পুলিশ যখন গ্রেপ্তার করে নিয়ে আসে, তখন চাষাড়া রেলগেটে গাছ ফেলে জনতা বাধা দেয় এবং সেখানে সারা দিন জনতা আর পুলিশের মধ্যে সংঘর্ষ চলে। মমতাজ বেগমকে ওরা দেড় বছর জেলে আটকে রেখেছিল। নুরুল আমিন আর একটা শয়তানি করেছিল, নারায়ণগঞ্জে নিজেরা গুলি চালিয়ে এক পুলিশকে মেরে, একটা আনসারকে আহত করে সেটার দোষ ভাষা আন্দোলনকারীদের উপরে দিয়ে ওদের ঢাকায় এনে রাষ্ট্রীয় মর্যাদায় দাফন করে। ওদের পরিবারকে ক্ষতিপূরণ দেয়। নারায়ণগঞ্জে নাকি ভারতের পক্ষে স্লোগান দেয় এবং এরা ভারতের অনুচর এটা প্রমাণ করার জন্য একটা পুলিশকে ওরা মেরে ফেললো। নারায়ণগঞ্জের এই দু’টি ঘটনা—মমতাজ বেগমকে গ্রেপ্তার নিয়ে যে প্রতিবাদ আর পুলিশ হত্যা এটা বলতেই হবে। হ্যাঁ, ওরা দেখাতে চেয়েছে ভারতীয়রা এসে এটা করেছে? পাকিস্তান সরকারের প্রেসনোটেও বিষয়টা ছিল। তারপর মর্নিং নিউজেও তো একথাই লিখছিল যে, কোলকাতা থেকে মেয়েরা এসে এখানে এসব করেছে। সব মিথ্যা প্রচারণা। ”
মমতাজ বেগম প্রায় দেড় বছর কারাগারে ছিলেন। এই সময় মুচলেকা দিয়ে বেরিয়ে আসার জন্য স্বামী আবদুল মান্নাফ চাপ দেন। কিন্তু দৃঢ়চেতা মমতাজ বেগম সেটি উপেক্ষা করেন। আর এ কারণেই স্বামী তাঁকে তাগ করেন। সংসার ভেঙে যায় মমতাজ বেগমের। স্বামী আবদুল মান্নাফ একমাত্র সন্তানকে নিয়ে পরবর্তীকালে পশ্চিম পাকিস্তানে চলে যান। ১৯৫৩ সালের শেষ দিকে কারাগার থেকে মুক্তি পান মমতাজ বেগম। কিন্তু মুক্তিলাভের পর পরই তিনি জনসমক্ষে আসতে পারেননি। নারায়ণগঞ্জ পৌর এলাকায় তাকে অন্তরীণ করে রাখা হয়।
ভাষা আন্দোলনে অংশ নেওয়ার কারণে মর্গান স্কুল থেকে মমতাজ বেগমের চাকরি চলে গেলেও ১৯৫৩ সালে সেই স্কুলেই নারায়ণগঞ্জের প্রথম শহীদ মিনার স্থাপন করা হয়। এরপর ১৯৫৪ সালে নারায়ণগঞ্জ হাই স্কুলে শহীদ মিনার প্রতিষ্ঠা করা হয়।
ভাষা সৈনিক মমতাজ বেগম মাত্র ৪৪ বছর বয়সে ১৯৬৭ সালের ৩০ মার্চ মৃত্যুবরণ করেন।
তথ্য সহায়ক: অলি আহাদের ভাষা আন্দোলনের ইতিহাস। নারায়ণগঞ্জের ভাষা আন্দোলন ও মহিয়সী মমতাজ বেগম- রফিউর রাব্বী।
লেখক: চন্দন সাহা রায়