আকাশ পথে উড়িয়ে নিয়ে আসা হচ্ছে ছেলে কামরুজ্জামানকে। হেলিকপ্টারে। বাবা অপেক্ষায়। ছেলে আসছে। আবেগ ভর করে বাবার মাঝে। ছেলের সাথে জড়িয়ে থাকা টুকরো টুকরো স্মৃতির মেঘেরা এসে ভিড় জমায়, ঝাপটা দিয়ে যায়, বাবার হৃদয় আকাশে। ছেলে এসে পৌঁছেছে। কিন্তু না, তিনি দেখা করবেন না। দৃঢ় সংকল্প করেছেন তিনি। অভিমান নয়, ভয়। কারণ তিনি চাননা, প্রায় ৪৯ বছর ধরে ছেলের যে মুখশ্রী তাঁর চোখে আটকে আছে, আজ কফিনের মাঝের কালো, কেমন যেন সবুজ হয়ে যাওয়া চেহারা, ফুলে যাওয়া মুখ, গুলিতে ফুটো হয়ে যাওয়া ডান কপাল, কালো কম্বল জড়ানো ঝাঁঝরা হয়ে যাওয়া বুক বাবার চোখে আটকে থাকা ছেলের সেই মুখশ্রীকে ভেঙে দিক; টুকরো টুকরো করে দিক। বাবা চান ৪৯ বছর ধরে ছেলের যে মুখশ্রী তাঁর চোখে আটকে আছে সেটিই স্থায়ী হয়ে থাক তাঁর মনে।
মৃতদেহের দিকে তাকিয়ে কামরুজ্জামানের স্ত্রী ভাবেন, ‘আহা লোকটা তো খুব নরম ছিল। ওর জন্য একটা গুলিই তো যথেষ্ট ছিল।’ তবে গুলির সংখ্যার কেন এ বাহুল্য।
নাটোর মহকুমার বাগাতীপাড়া থানার মালঞ্চী রেলস্টেশন সংলগ্ন নূরপুর গ্রামে মামার বাড়িতে ১৯২৬ সালের ২৬ জুন জন্মগ্রহণ করেন এ.এইচ.এম. কামরুজ্জামান।
… প্রমত্তা পদ্মার জল যেখানে খেলা করে আপন আনন্দে, সেখানে নদীর সাথে নিয়ত প্রবাহমান স্থানীয় মানুষের জীবন প্রবাহ। অবিভক্ত ভারত বর্ষের বৃহত্তর রাজশাহী জেলা। সেই রাজশাহী জেলার কাদিরগঞ্জ মহল্লায় কামরুজ্জামানের পৈতৃক বাড়ি। বনেদি এক পরিবারের ছেলে তিনি। পিতামহ হাজি লাল মোহাম্মদ সরদার (১৯৪৮-১৯৩৬) গুলাই-এর জমিদার ছিলেন। ছিলেন খ্যাতিমান সমাজ সেবক ও রাজনীতিবিদ। পিতা আব্দুল হামিদ মিয়া আর মা জেবুন নেসার ১২ পুত্র-কন্যার প্রথম কামরুজ্জামান। দাদি আদর করে তাঁর ডাক নাম রাখেন ‘হেনা’। হাসনাহেনা ফুলের সৌরভ ছড়ানোর প্রত্যাশায়।
লেখাপড়ার শুরু রাজশাহীর ঐতিহ্যবাহী বিদ্যালয় রাজশাহী কলেজিয়েট স্কুলে। বিশিষ্ট সাংবাদিক, সাহিত্যিক ও সমাজ সেবক আব্দুস সামাদ ছিলেন তাঁর লেখাপড়ার প্রেরণার উত্স। রাজশাহী কলেজিয়েট স্কুলের শিক্ষক ছিলেন তাঁর এক ফুপা। তিনি রাজশাহী থেকে চট্টগ্রামে বদলী হয়ে যাবার সময় কামরুজ্জামান হেনাকেও সাথে করে নিয়ে যান এবং চট্টগ্রাম কলেজিয়েট স্কুলে ভর্তি করে দেন। সেখান থেকেই ১৯৪২ সালে তিনি মাধ্যমিক পাশ করেন। এরপর রাজশাহী কলেজ থেকে ১৯৪৪ সালে উচ্চ মাধ্যমিক পাশ করেন। তিনি এরপর উচ্চশিক্ষার জন্য যান কলকাতা এবং বিখ্যাত প্রেসিডেন্সি কলেজ থেকে ১৯৪৬ সালে অর্থনীতিতে অনার্সসহ স্নাতক পাশ করেন। তিনি ছিলেন পারিবারিকভাবেই রাজনীতি সংশ্লিষ্টতার উত্তরাধিকারী। দাদা হাজি লাল মোহাম্মদ সরদার ১৯২৪ সাল থেকে ১৯২৬, আর ১৯৩০ থেকে ১৯৩৬ সাল পর্যন্ত দু’বার অবিভক্ত বাংলার লেজিসলেটিভ কাউন্সিলের সদস্য (এম.এল.সি.) নির্বাচিত হয়েছিলেন। চরকার প্রচলনে বিশ্বাসী হাজি লাল ছিলেন গান্ধিবাদী।
কামরুজ্জামানের পিতা আব্দুল হামিদ মিয়া (১৮৮৭-১৯৭৬) ছিলেন রাজশাহীর একজন বিশিষ্ট রাজনীতিবিদ ও সমাজ সেবক। তিনি ১৯৪৬ সাল থেকে ১৯৫৪ সাল পর্যন্ত অবিভক্ত বাংলাদেশ ও পরে পূর্ববঙ্গ আইন পরিষদের সদস্য (এম.এল.এ.) ছিলেন।
পারিবারিক রাজনীতি সংশ্লিষ্টতার ধারাবাহিকতায় স্কুলে পড়ার সময়ই কামরুজ্জামান জড়িয়ে যান দেশীয় রাজনীতিতে। ছাত্র অবস্থাতেই রাজনীতির খুঁটিনাটি বিষয়ে ছিল তাঁর প্রখর সচেতনতা। তিনি বঙ্গীয় মুসলিম ছাত্র লীগের রাজশাহী জেলা শাখার সম্পাদক হন ১৯৪২ সালে। বঙ্গীয় মুসলীম ছাত্র লীগের নির্বাচিত সহ সভাপতি ছিলেন ১৯৪৩-১৯৪৫ সাল পর্যন্ত।
কামরুজ্জামান বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হন ১৯৫১ সালে, বগুড়া জেলার দুপচাচিয়া থানার চামরুল গ্রামের প্রখ্যাত জোতদার পরিবারের আশরাফ্উদ্দিন তালুকদারের মেয়ে জাহানারার সাথে। তিনি ৬ ছেলেমেয়ের জনক।
কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের পড়াশোনার পাঠ শেষ করে তিনি চলে এসেছিলেন নিজ শহর রাজশাহীতে। চলতে থাকে রাজনীতি। পুনরায় ভর্তি হন রাজশাহী কলেজে। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতিতে স্নাতক ছেলেটি এবার পড়াশুনা শুরু করেন আইন নিয়ে। রাজশাহী কলেজ যে বছর আইন বিভাগ খোলে, সে বছর প্রথম ব্যাচেই অর্থাত্ ১৯৫৬ সালে, তিনি এখান থেকেই লাভ করেন বি.এল. ডিগ্রী। শুরু করেন আইন পেশা। প্রসার লাভ করেন আইন পেশায়।
ষাটের দশকের মধ্যবর্তী সময়ে আওয়ামী লীগকে পুনরুজ্জীবিত করার এক সাহসী পদক্ষেপ হাতে নেন শেখ মুজিবুর রহমান। এ অনুযায়ী কর্মকাণ্ড এগিয়ে নিতেও সক্ষম হয়েছিলেন তিনি। ১৯৫৬ সালে কামরুজ্জামান আওয়ামী লীগে যোগ দেন।
‘৬০-এর দশকে জেনারেল আইয়ুব খান তার শাসনামলে মৌলিক গণতন্ত্র নামে একটি স্বল্পকাল স্থায়ী স্থানীয় সরকার পদ্ধতির প্রবর্তন করেন। পাকিস্তানের রাষ্ট্রপতি জেনারেল আইয়ুব এ নতুন পদ্ধতির মাধ্যমে গণতন্ত্রকে তৃণমূল পর্যায়ে ছড়িয়ে দেয়ার লক্ষ্যে মৌলিক গণতন্ত্র অধ্যাদেশ ১৯৫৯ জারি করেন। পূর্ব পাকিস্তানের রাজনৈতিক দলগুলো এ বিষয়টি মোটেই ভালো চোখে দেখেনি। তারা এ অধ্যাদেশের আড়ালে জেনারেল আইয়ুব খান এবং তার সহযোগী কায়েমী স্বার্থবাদী ক্ষমতা লোভী গোষ্ঠীর ক্ষমতা কুক্ষিগত করার সুনিপুণ কৌশলকেই দেখতে পায়।
এ মৌলিক গণতন্ত্র ব্যবস্থায় ১৯৬২ সাল ও ১৯৬৬ সালে পরপর দু’বার এ.এইচ.এম. কামরুজ্জামান পাকিস্তান জাতীয় পরিষদের সদস্য নির্বাচিত হন। ১৯৬৬ সালে ঐতিহাসিক ৬ দফার সময় তিনি ৬ দফা আন্দোলনে আত্মনিয়োগ করেন। পরের বছর ১৯৬৭ সালে নিখিল পাকিস্তান আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক এবং বিরোধী দলীয় উপনেতা নির্বাচিত হন। আইয়ুব সরকারের নির্যাতনের প্রতিবাদে এবং ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের ১১ দফা দাবির সমর্থনে ১৯৬৯ সালে তিনি পাকিস্তান জাতীয় পরিষদের সদস্য পদ থেকে পদত্যাগ করেন। সমস্যা জটিল আকার ধারণ করে। আইয়ুব খান সমস্যা উত্তরণের পথ হিসেবে রাওয়ালপিন্ডিতে এক গোলটেবিল বৈঠকের আহ্বান করেন। এ সময় কামরুজ্জামান আওয়ামী প্রতিনিধি দলের সদস্য হিসেবে এ বৈঠকে অংশ নেন এবং সক্রিয় ভূমিকা পালন করেন।
১৯৭০ সালের নির্বাচনে পুনরায় তিনি রাজশাহী থেকে জাতীয় পরিষদের সদস্য নির্বাচিত হন। ১৯৭০ সালে সারা দেশে রাজনৈতিক উন্মাতাল পরিবেশ বিরাজ করতে থাকে। সকল আলোচনা-আন্দোলন যখন অনিবার্যভাবে একটি সংঘাতময় যুদ্ধের দিকে যাচ্ছে তার আগেই শেখ মুজিব দলীয় হাই কমান্ড গঠন করেন। ৫ জনের হাই কমান্ডের একজন গুরুত্বপূর্ণ নেতা ছিলেন কামরুজ্জামান।
১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ রাত। বাঙালি জাতির উপর নেমে আসে পাকিস্তানি বাহিনীর নারকীয় বীভত্স খড়গ হস্ত। এ শত্রুবাহিনী বাঙালি নিধনযজ্ঞে মেতে ওঠে। এ অবস্থায় বঙ্গবন্ধুর নির্দেশ মতো তিনি শেখ ফজলুল হক মনি, তোফায়েল আহমেদ ও আরও কয়েকজন নেতাকে নিয়ে বগুড়া হয়ে কলকাতা চলে যান। চোখেমুখে ক্লান্তি, কিন্তু বুকে অদম্য সাহস আর স্পৃহা। ১৯৭১ সালের ১৭ এপ্রিল মুজিবনগরে স্বাধীন বাংলাদেশ সরকারের মন্ত্রিসভায় স্বরাষ্ট্র, ত্রাণ ও পুনর্বাসন মন্ত্রীর দায়িত্ব গ্রহণ করেন কামরুজ্জামান। শত প্রতিকূলতার মাঝেও তিনি চালিয়ে যেতে থাকেন কর্মকাণ্ড। কিন্তু এ সরকারের মাঝেই ছিল বিভিন্ন বিরোধের ভূত। এসব বিরোধকে দূরে ঠেলে সকলে ঐক্যবদ্ধভাবে এগিয়ে নিতে থাকেন এ সরকারকে। তিনি যুদ্ধকালীন চষে বেড়িয়েছেন বাংলাদেশের প্রান্ত সীমাসমূহ। দেশ স্বাধীনের পর ৩০ ডিসেম্বর তিনি দেশে ফিরে আসেন।
১৯৭২ থেকে ১৯৭৪ সাল পর্যন্ত বিভিন্ন মন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন কামরুজ্জামান। শেখ মুজিবুর রহমান ১৯৭৩ সালে নির্বাচন দিলে এ সাধারণ নির্বাচনে তিনি রাজশাহীর দু’টি সদর গোদাগাড়ি ও তানর আসন থেকে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন। ১৯৭৪ সালের জানুয়ারি মাসের ১৮ তারিখে তিনি মন্ত্রী পরিষদ থেকে পদত্যাগ করেন। এ সময় তিনি বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের সভাপতি নির্বাচিত হন। ১৯৭৫ সালে নতুন মন্ত্রিসভায় তিনি শিল্প মন্ত্রীর দায়িত্ব প্রাপ্ত হন। এ সময় দেশের আভ্যন্তরীণ অবস্থার বিবেচনায় শেখ মুজিবুর রহমান বাংলাদেশ কৃষক শ্রমিক লীগ (বাকশাল) গঠন করার সিদ্ধান্ত নিলে তিনি বাকশালের কার্যনির্বাহী কমিটির সদস্য হন। বাকশাল বিভিন্ন মুখী প্রতিক্রিয়ার জন্ম দেয়। ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট সেনাবাহিনীর কতিপয় বিপথগামী সৈন্য কর্তৃক শেখ মুজিবুর রহমান নিহত হন। বাঙালী জাতির জীবনে ঘটে আর এক লজ্জাজনক নির্মম বেদনাবিধুর ঘটনা। এর পরে তিন জাতীয় নেতাসহ তাঁকে গ্রেফতার করা হয়। ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে তাঁকেসহ অন্য নেতাদের আটক রাখা হয়।
অত্যন্ত হাসিখুশি মানুষ ছিলেন কামরুজ্জামান। আভিজাত্য, রাজনৈতিক উচ্চাসনের পদমর্যাদার অহংকার তাঁকে স্পর্শ করেনি কখনও। রাজশাহী আওয়ামী লীগ অফিসে ঢুকেই তিনি মুখে পুরে দিতেন পান। ভালোবাসতেন পান খেতে। গানও গাইতেন গুনগুনিয়ে, কবিতা লিখতেন, পড়তেন। ভালোবাসতেন সুকান্তের কবিতা। কখনও কবি হয়ে নিজেই লিখেছেন-
‘অভিমানী বন্ধু আমার
কবিতারে দিয়ে ছুটি
তুমি যে নিলে মহাছুটি
অন্তিম চিতায় শুয়ে
একাই কি পুড়িলে শুধু
সুকান্ত বিদ্রোহী সুকান্ত
মরমী বন্ধু আমার।’ (১১-০৯-১৯৭৪)
আবার লিখেছেন-
‘জীবনের ন্যূনতম নিশ্চয়তা আমার নাই
এদশের কোন মানুষেরই নাই
আমার স্ফুলিঙ্গসম কর্মীরা হতবাক
আমি বলতে পারিনা
আমি তাদের চাইতেও বেশী অসহায়।’
জীবন নিয়ে শংকা কি প্রকাশ পায়না এখান থেকে?
৩ নভেম্বর ১৯৭৫। রাত। কারাগার চত্বরে নিথর থকথকে অন্ধকার কেমন গা ছমছমে। কারাগারের নিউ জেল বিল্ডিং এর ২নং রুমে বন্দি এ.এইচ.এম. কামরুজ্জামান। হঠাত্ ডি.আই.জি’র ফোন বেজে ওঠে। ফোনের ওপারের কন্ঠস্বর আর কথা শুনে বিহ্বল ডিআইজি। কারাগারে প্রবেশ করে অস্ত্রধারী সৈন্য। জেলারের হাতে ধরিয়ে দেয়া হয় চারটি নাম লেখা এক টুকরো কাগজ। এক রুমে এনে বসানো হয় তালিকায় থাকা নামের চার নেতাকে। এর পরের ঘটনা নৃসংশতার পুরোনো দৃশ্যকল্প। স্বয়ংক্রিয় অস্ত্রের দমকে থমকে দেয়া হয় অন্য তিন জাতীয় নেতাসহ এ.এইচ.এম. কামরুজ্জামানের কন্ঠস্বর। কিন্তু পেরেছে কি?
আজও কি বাংলার বাতাসে কান পাতলে চার জাতীয় নেতার হৃৎস্পন্দন শোনা যায় না? আজও কি কামরুজ্জামানের দৃঢ় কন্ঠস্বর মুক্তি ও শান্তিপ্রবণ মানুষের মনে সাহসের বাঁধ ভাঙা প্লাবন নিয়ে আসেনা? আজও আমরা নত হই স্বাধীনতা পূর্ব ও পরবর্তী এই বীর সেনানীর স্মৃতির প্রতি সম্মান জানিয়ে।
সংক্ষিপ্ত জীবনী:
নাম:আবুল হাসনাত মোহাম্মদ কামরুজ্জামান।
জন্ম: নাটোর মহকুমার বাগাতীপাড়া থানার মালঞ্চী রেলস্টেশন সংলগ্ন নূরপুর গ্রামে মামার বাড়িতে ১৯২৬ সালের ২৬ জুন জন্মগ্রহণ করেন এ.এইচ.এম. কামরুজ্জামান।
লেখাপড়া: লেখাপড়ার শুরু রাজশাহীর ঐতিহ্যবাহী বিদ্যালয় রাজশাহী কলেজিয়েট স্কুলে। বিশিষ্ট সাংবাদিক, সাহিত্যিক ও সমাজ সেবক আব্দুস সামাদ ছিলেন তাঁর লেখাপাড়ার প্রেরণার উত্স। রাজশাহী কলেজিয়েট স্কুলের শিক্ষক ছিলেন তাঁর এক ফুপা। তিনি রাজশাহী থেকে চট্টগ্রামে বদলী হয়ে যাবার সময় কামরুজ্জামান হেনাকেও সাথে করে নিয়ে যান এবং চট্টগ্রাম কলেজিয়েট স্কুলে ভর্তি করে দেন। সেখান থেকেই ১৯৪২ সালে তিনি মাধ্যমিক পাশ করেন। এরপর রাজশাহী কলেজ থেকে ১৯৪৪ সালে উচ্চ মাধ্যমিক পাশ করেন। তিনি এরপর উচ্চশিক্ষার জন্য যান কলকাতা এবং বিখ্যাত প্রেসিডেন্সি কলেজ থেকে ১৯৪৬ সালে অর্থনীতিতে অনার্সসহ স্নাতক পাশ করেন। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের পড়াশোনার পাঠ শেষ করে তিনি চলে এসেছিলেন নিজ শহর রাজশাহীতে। চলতে থাকে রাজনীতি। পুনরায় ভর্তি হন রাজশাহী কলেজে। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতিতে স্নাতক ছেলেটি এবার পড়াশোনা শুরু করেন আইন নিয়ে। রাজশাহী কলেজ যে বছর আইন বিভাগ খোলে, সে বছর প্রথম ব্যাচেই অর্থাত্ ১৯৫৬ সালে, তিনি এখান থেকেই লাভ করেন বি.এল. ডিগ্রী। শুরু করেন আইন পেশা। প্রসার লাভ করেন আইন পেশায়।
রাজনীতি: তিনি বঙ্গীয় মুসলিম ছাত্র লীগের রাজশাহী জেলা শাখার সম্পাদক হন ১৯৪২ সালে। বঙ্গীয় মুসলিম ছাত্র লীগের নির্বাচিত সহ সভাপতি ছিলেন ১৯৪৩-১৯৪৫ সাল পর্যন্ত। ১৯৫৬ সালে কামরুজ্জামান আওয়ামী লীগে যোগ দেন। ১৯৬২ সাল ও ১৯৬৬ সালে পরপর দু’বার এ.এইচ.এম. কামরুজ্জামান পাকিস্তান জাতীয় পরিষদের সদস্য নির্বাচিত হন। ১৯৬৬ সালে ঐতিহাসিক ৬ দফার সময় তিনি ৬ দফা আন্দোলনে আত্মনিয়োগ করেন। পরের বছর ১৯৬৭ সালে নিখিল পাকিস্তান আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক এবং বিরোধী দলীয় উপনেতা নির্বাচিত হন। আইয়ুব সরকারের নির্যাতনের প্রতিবাদে এবং ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের ১১ দফা দাবির সমর্থনে ১৯৬৯ সালে তিনি পাকিস্তান জাতীয় পরিষদের সদস্য পদ থেকে পদত্যাগ করেন। ১৯৭০ সালের নির্বাচনে পুনরায় তিনি রাজশাহী থেকে জাতীয় পরিষদের সদস্য নির্বাচিত হন। ১৯৭১ সালের ১৭ এপ্রিল মুজিবনগরে স্বাধীন বাংলাদেশ সরকারের মন্ত্রিসভায় স্বরাষ্ট্র, ত্রাণ ও পুনর্বাসন মন্ত্রীর দায়িত্ব গ্রহণ করেন কামরুজ্জামান। ১৯৭২ থেকে ১৯৭৪ সাল পর্যন্ত বিভিন্ন মন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন কামরুজ্জামান। শেখ মুজিবুর রহমান ১৯৭৩ সালে নির্বাচন দিলে এ সাধারণ নির্বাচনে তিনি রাজশাহীর দু’টি সদর গোদাগাড়ি ও তানর আসন থেকে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন। ১৯৭৪ সালের জানুয়ারি মাসের ১৮ তারিখে তিনি মন্ত্রী পরিষদ থেকে পদত্যাগ করেন। এ সময় তিনি বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের সভাপতি নির্বাচিত হন। ১৯৭৫ সালে নতুন মন্ত্রিসভায় তিনি শিল্প মন্ত্রীর দায়িত্ব প্রাপ্ত হন।
মৃত্যু: ১৯৭৫ সালের ৩ নভেম্বর মধ্যরাত্রিতে অন্য চার জাতীয় নেতার সাথে তাঁকে হত্যা করা হয়।
তথ্যসূত্র :
১. সাপ্তাহিক ২০০০, কামরুজ্জামানের প্রকাশিত কবিতা।
২. বাংলা পিডিয়া।
৩. মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতি : আমীর-উল-ইসলাম।
৪. সাক্ষাত্কার – কামরুজ্জামানের ছেলে এ.এইচ.এম. খায়রুজ্জামান, মেয়র, রাজশাহী।
৫. সাক্ষাত্কার – ভাষা সৈনিক সাঈদ উদ্দীন আহমদ, রাজশাহী।
৬. মুক্তিযুদ্ধের প্রেক্ষাপটে ব্যক্তির অবস্থান- এ.এস.এম. সামছুল আরেফিন।
লেখক : রাজিত আলম পুলক