একজন কয়েদি তিনি। কারাগারের নিউ জেল বিল্ডিং ভবনে বন্দি। সেই শৃঙ্খলিত চত্বরে পচা নর্দমা ভরাট করে বানানোর ইচ্ছা ফুলের বাগান, তাই ফুল গাছ লাগানোয় ব্যস্ত। নিজ হাতে মাটি ভাগ করে, আপন তত্ত্বাবধানে রোপন করে চলেছেন শত ফুলের চারাগাছ। পরিচর্যার জন্য গোবর সার আনিয়েছেন বাড়ি থেকে। তাঁর হাতের মমতামাখা স্পর্শে চারাগুলো যেন স্নাত হয় সঞ্জীবনী ধারায়। তাঁর অনুপস্থিতিতেও বেড়ে উঠবে, বিকশিত হবে, ফুল ফুটবে সেগুলোয়। তাঁর স্পর্শধন্য চারাগুলো এ প্রতিজ্ঞাই শোনায় কানে কানে আর তা বিশ্বাস করেই যেন তন্ময় হয়ে, নিজের আশা আকাঙ্ক্ষার চারাই রোপন করে চলেছেন তিনি।
রাত। এবার কারাগারের কক্ষে তিনি। বাইরে নিথর থকথকে অন্ধকার। হঠাত্ খুলে যায় কারাগারের মূল ফটক। চত্বরে প্রবেশ করে কালো পোশাকধারীর নেতৃত্বে অস্ত্রধারী ৪ জন সৈন্য।
বেজে ওঠে পাগলা ঘন্টা।
বেজে ওঠে ডিআইজি প্রিজনের টেলিফোন।
টেলিফোনের অপর প্রান্ত থেকে ভেসে আসে এক দাম্ভিক দানবীয় কন্ঠস্বর।
– ‘Let them do whatever they want.’
ডিআইজির হাত ঘুরে জেলারের হাতে ধরিয়ে দেয়া তালিকা অনুযায়ী একই ঘরে সমবেত করা হয় তিন সহযাত্রীসহ তাঁকে।
এবার পরিচয়ের পালা।
ইনি…
থমকে যায় বক্তা।
পরিচিতির প্রথম শব্দ উচ্চারণের সাথে সাথে গর্জে ওঠে ঘাতকের হাতের স্বয়ংক্রিয় অস্ত্র। ৬০ রাউন্ড গুলির পর সব কিছু স্তব্ধ।
সুনশান।
নীরব।
মৃত্যুই শুধু যেন নীরবতাকে ধারণ করার স্পর্ধা রাখে।
তিন সহযাত্রী নেতাসহ খুন হন, স্বাধীন বাংলাদেশের ধাত্রী।
তাজউদ্দীন আহমদ।
শীতলক্ষ্যা নদীর পাড়ের, গজারি বনের ছায়া ঢাকা, গ্রাম বাংলার অন্যান্য গ্রামের মতোই, ঢাকার অদূরে কাপাসিয়ার দরদরিয়া গ্রাম। মধ্যবিত্ত মুসলিম পরিবারের মৌলবি ইয়াসিন খান আর মেহেরুন্নেসা খানম দম্পতির এক পুত্র সন্তানের জন্ম হয় ১৯২৫ সালের ২৩ জুলাই তারিখে। পুত্রের নাম রাখা হয়, তাজউদ্দীন আহমদ।
৪ ভাই, ৬ বোনের মাঝে ৪র্থ তাজউদ্দীন আহমদের পড়াশোনা শুরু বাবার কাছে আরবি শিক্ষার মাধ্যমে, একই সময়ে ১ম শ্রেণীতে ভর্তি হন বাড়ির দুই কিলোমিটার দূরের ভূলেশ্বর প্রাথমিক বিদ্যালয়ে। ১ম ও ২য় শ্রেণীতে ১ম স্থান অর্জন করেন। ৪র্থ শ্রেণীতে ভর্তি হন বাড়ি থেকে প্রায় ৫ কিলোমিটার দূরের কাপাসিয়া মাইনর ইংলিশ স্কুলে। মা’র প্রচেষ্টা ছিল ছেলেকে ইংরেজি মাধ্যম স্কুলে লেখাপড়া করানোর। সফল হন তিনি। এরপর বিদ্যালয় পরিবর্তনের ধারাবাহিকতায় পড়েছেন কালিগঞ্জ সেন্ট নিকোলাস ইনস্টিটিউশন, ঢাকার মুসলিম বয়েজ হাই স্কুল ও সেন্ট গ্রেগরিজ হাই স্কুলে। এসময় একজন স্কাউট হিসেবে স্কাউট আন্দোলনের সাথে যুক্ত হন। পরবর্তী কর্মজীবনে যা তাঁর প্রেরণা ও কাজ করার ক্ষমতা জুগিয়েছে। এসম্পর্কে তিনি বলেছেন – ‘স্কাউট হিসেবে শিক্ষা, স্বাধীনতা সংগ্রামে আমাকে অমানুষিক পরিশ্রম করতে প্রেরণা ও ক্ষমতা জুগিয়েছে।’ এছাড়া দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় সিভিল ডিফেন্স-এর ট্রেনিং নিয়েছিলেন তিনি।
এম.ই. স্কলারশিপ পরীক্ষায় ঢাকা জেলায় প্রথম স্থান লাভ করেন। শুধু তাই নয় প্রতিভার স্বাক্ষর রাখেন মেট্রিকুলেশন পরীক্ষায়। ১৯৪৪ সালে এই পরীক্ষায় অবিভক্ত বাংলায় দ্বাদশ স্থান লাভ করেন তিনি। এ সময়ই জড়িয়ে পড়েন মুসলিম লীগের রাজনীতির সাথে। হয়ে ওঠেন পার্টির সক্রিয় সদস্য। এবছর নির্বাচনে বঙ্গীয় মুসলিম লীগের কাউন্সিলর নির্বাচিত হন। যদিও মুসলিম লীগের গণবিচ্ছিন্ন রাজনীতির প্রতিবাদে, পরবর্তীতে দলের সাথে সম্পর্ক ত্যাগ করেছিলেন। একই বছর কলকতায় শেখ মুজিবুর রহমানের সাথে পরিচয় হয় তাঁর। ভালো পড়াশোনার ধারাবাহিকতা বজায় ছিল উচ্চ মাধ্যমিকেও। ঢাকা বোর্ডে অর্জন করেন ৪র্থ স্থান এবং ভর্তি হন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে। উচ্চ শিক্ষায় তাঁর বিষয় ছিল অর্থনীতি। এমনই মেধা-উজ্জ্বল শিক্ষা জীবনের ধারক ছিলেন এ অনন্য ব্যক্তিত্ব।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাজনৈতিক পরিবেশে ছিল এদেশীয় রাজনীতির প্রতিফলন। এ পরিবেশ তাজউদ্দীন আহমদকে দেশ ও রাজনীতি নিয়ে ভাবতে প্ররোচিত করে। জড়িয়ে যান সক্রিয় রাজনীতিতে। যদিও চিন্তাধারায় দেশ ও রাজনীতির বীজ রোপিত হয়েছিল অনেক আগেই সেই কাপাসিয়াতে। সেইসময় এই কাপাসিয়াতেই নির্বাসিত হয়েছিলেন ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলনের তিন বিপ্লবী রাজেন্দ্র নারায়ণ চক্রবর্তী, বিরেশ্বর বন্দ্যাপাধ্যায় ও মনীন্দ্র শ্রীমানী। তিনি তখন কাপাসিয়া মাইনর স্কুলের ছাত্র। তাজউদ্দীনের প্রখর মেধার পরিচয় পান এই বিপ্লবীরা এবং তাঁকে ভূগোল, অর্থনীতি, রাজনীতি ও মনীষীদের জীবনী সম্পর্কে জানতে সাহায্য করেন তাঁরা। তাঁদের কাছ থেকে নিয়ে পড়ে ফেলেন প্রায় ৫০/৬০ খানা বই। বিপ্লবীরা তাঁর চেতনার মাঝে রোপন করেদেন শোষণ ও বঞ্চনাহীন সমাজ আর অধিকার আদায়ের রাজনীতির বীজ। এক সময় বিপ্লবীরা চলে যান।
যাবার সময় দেখা হয়নি কিন্তু তাঁর বিছানায় রেখে যাওয়া গোলাপের তোড়ায় মাখা ছিল আগামী দিনের রাজনৈতিক শুভকামনার সুবাস। তাজউদ্দীন আহমদ সেই সুবাসকে ঠিকই ধারণ করেছিলেন নিশ্বাসে। আর তাই তো ১৯৪৮ এ প্রতিষ্ঠিত পূর্ব বাংলা ছাত্রলীগের অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা হয়েছিলেন তিনি। ছিলেন আওয়ামী মুসলিম লীগ গঠনের উদ্যোক্তাদের একজন।
শুধুমাত্র অধিকার প্রতিষ্ঠা আর আবাস ভূমির জন্যই নয়, বাঙালীকে আন্দোলন করে রক্ত ঝরাতে হয়েছে মুখের ভাষার দাবিতেও। ভাষা আন্দোলনেও তাজউদ্দীন ছিলেন সোচ্চার কন্ঠ। ১৯৪৮-এর ১১ এবং ১৩ মার্চ সর্বদলীয় সংগ্রাম পরিষদের গুরুত্বপূর্ণ সদস্য হিসেবে ধর্মঘট-কর্মসূচি ও বৈঠক করেন। ২৪ মার্চ মোহাম্মদ আলী জিন্নাহর সাথে রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদের নেতারাসহ তিনি বৈঠক করেন। যদিও জিন্নাহর অসহিষ্ণু আচরণের কারণে এ বৈঠক কোনো সুফল বয়ে আনেনি।
১৯৫৩ সাল। ‘আওয়ামী মুসলীম লীগ’ দলের কাউন্সিলে আনুষ্ঠানিকভাবে ‘মুসলিম’ শব্দটি দলের নাম থেকে বাদ দেবার সিদ্ধান্ত নেয়। শেখ মুজিবুর রহমান দলের সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হন। এ সময়ই আওয়ামী লীগে সক্রিয়ভাবে যোগ দেন তাজউদ্দীন আহমদ। এ বছরই তিনি ঢাকা জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক হন। রাজনৈতিক কর্মকান্ডের কারণে শেখ মুজিবুর রহমান ও তাঁর মাঝে সহজ ও বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক গড়ে ওঠে। দেশীয় রাজনীতিতে বাড়তে থাকে আওয়ামী লীগের প্রভাব।
১৯৫৪ সালের নির্বাচনে ঢাকা উত্তর-পূর্ব আসনে যুক্তফ্রন্ট প্রার্থী হন তাজউদ্দীন। প্রতিপক্ষ মুসলিম লীগের পূর্ব পাকিস্তান শাখার সাধারণ সম্পাদক প্রবীণ নেতা ফকির আব্দুল মান্নানকে ১৩ হাজার ভোটের ব্যবধানে হারিয়ে দেন। তখন তাঁর বয়স মাত্র ২৯ বছর। এ নির্বাচনী প্রচারণায় হাতির পিঠে চড়ে তাঁর জন্য ভোট সংগ্রহ করেছেন জননেতা আব্দুল হামিদ খান ভাসানী।
১৯৫৯ সালের ২৬ এপ্রিল সৈয়দা জোহরা খাতুন লিলির সাথে পরিণয় সূত্রে আবদ্ধ হন তিনি। বিয়ের অলংকার ছিল বেলী ফুলের মালা। তাঁর স্নিগ্ধ চেতনা আর মানসিকতার সুগন্ধই বহন করছিল মালার শুভ্র বেলী ফুলগুলো।
ষাটের দশকের মধ্যবর্তী সময়ে আওয়ামী লীগকে পুনরুজ্জীবিত করার এক সাহসী পদক্ষেপ নিয়ে সে অনুযায়ী কর্মকান্ড এগিয়ে নিতে সক্ষম হয়েছিলেন শেখ মুজিবুর রহমান। এসময় জেনারেল আইয়ুবের স্বৈরতান্ত্রিক শাসনামলে (১৯৫৮-১৯৬৯) আওয়ামী লীগ স্বায়ত্বশাসন আন্দোলনে অগ্রপথিক হিসেবে ভূমিকা পালন করে এবং শেখ মুজিবুর রহমান দলের অবিসংবাদিত নেতা হয়ে ওঠেন। এ রাজনৈতিক পুনরুজ্জীবন ও অগ্রগামিতার আন্দোলনে, রাজনৈতিক বলিষ্ঠ পদক্ষেপের জন্য তাজউদ্দীন আহমদ ক্রমে হয়ে উঠতে থাকেন ভবিষ্যতের দৃপ্ত সারথী।
চলতে থাকে রাজনীতি। গ্রেফতার হন ১৯৬২ সালে। ১৯৬৪ সালে সাংগঠনিক সম্পাদক হন আওয়ামী লীগের। ৬ দফার ঐতিহাসিক ১৯৬৬ সালে হন সাধারণ সম্পাদক। ৬ দফা আন্দোলনের কারণে দেশরক্ষা আইনে ১৯৬৬ সালের ৮ মে পুনরায় গ্রেফতার হয়ে কারাবরণ করেন তাজউদ্দীন। মুক্ত হন ১৯৬৯-এর ১২ ফেব্রুয়ারি। ইয়াহিয়া-ভুট্টোর সাথে শেখ মুজিবের আলোচনায় তিনি ছিলেন ফাইলপত্র নিয়ে নিয়মিত হাজির হওয়া গুরুত্বপূর্ণ সহযোগী, যিনি তাঁর দাবির ব্যাপারে ছিলেন অনড়। ইয়াহিয়া তাজউদ্দীনকে ভয় করতেন। কারণ আলোচনার টেবিলে তিনি ছিলেন খুবই কঠোর, কোনো ছিটেফোঁটা আবেগও তাঁর মাঝে কাজ করত না।
সব আলোচনা-আন্দোলন যখন অনিবার্যভাবে একটি সংঘাতময় যুদ্ধ পরিস্থিতির দিকে যাচ্ছে, তার আগেই শেখ মুজিব দলীয় হাই কমান্ড গঠন করেন। ৫ জনের হাই কমান্ডের একজন গুরুত্বপূর্ণ নেতা ছিলেন তিনি।
১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ রাত। বাঙালী জাতির উপর নেমে আসে পাকিস্তানি বাহিনীর নারকীয়, বীভত্স, খড়গ হস্ত। এ বাহিনী নিরীহ বাংলাদেশিদের নিধনযজ্ঞে মেতে ওঠে। গ্রেফতার হন শেখ মুজিব। তাজউদ্দীন তাঁর সহযাত্রী ব্যারিস্টার আমীর-উল-ইসলামকে নিয়ে ভারতের উদ্দেশ্যে রওনা হন। মহম্মদ আলী ছদ্মনাম নিয়ে, গ্রেফতার এড়িয়ে, শত্রু সেনার চোখ এড়িয়ে তিনি অবশেষে হাজির হন ভারতীয় সীমান্তে।
দীর্ঘ পথ শ্রমে ক্লান্ত। সীমান্ত থেকে সামান্য দূরে বৃটিশ আমলে তৈরি কালভার্টের উপর শরীর এলিয়ে দেন। তাঁর অবসন্ন চোখের পাতায় নেমে আসতে চায় রাজ্যের ঘুম। না, তিনি ঘুমিয়ে পড়েননি। তিনি ঘুমিয়ে গেলে তো চলবেনা। দেশ স্বাধীন করতে, স্বাধীন দেশকে ভূমিষ্ঠ করাতে তিনি তো নিজে ধাত্রী। তাঁর চোখে তো ঘুম শোভা পায়না। তাঁর ভাষায়, ‘আমি সেদিন সাড়ে সাত কোটি বাঙালীর স্বার্থে যে সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম তা হলো : একটি স্বাধীন সরকার প্রতিষ্ঠা করে বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রাম পরিচালনার জন্য কাজ শুরু করা।’ (তাজউদ্দীন আহমদ-ইতিহাসের পাতা থেকে। পৃষ্ঠা-২৯১)।
যথাযোগ্য মর্যাদায়, স্বাধীন দেশের প্রতিনিধি হিসেবে ভারতে প্রবেশ করে তিনি ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর সাথে দেখা করেন। ভারত সহযোগিতার আশ্বাস দেয়। জরুরি হয়ে পড়ে একটি সরকার গঠন। শেখ মুজিবুর রহমানকে রাষ্ট্রপতি করে, সৈয়দ নজরুল ইসলামকে শেখ মুজিবের অনুপস্থিতিতে অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি আর নিজে প্রধানমন্ত্রী হিসেবে ১০ এপ্রিল সরকার গঠন করেন ও ১৭ এপ্রিল মেহেরপুরের বদ্যিনাথ তলার আম্রকাননে শপথ গ্রহণ করেন।
শত বাধা বিপত্তির মাঝে তিনি প্রবাসী সরকার চালিয়ে যেতে থাকেন। গঠন করেন প্রশাসনিক কাঠামো, এমনকি আগামী পাঁচ বছরের পরিকল্পনা। তিনি ছিলেন প্রধানমন্ত্রী, একই সাথে প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বপ্রাপ্ত মন্ত্রী। তাই যুদ্ধের সাংগঠনিক পরিকল্পনাও করতে হচ্ছিল তাঁকে। দেশ থেকে চলে আসার সময় পরিবার পরিজনের সাথে সাক্ষাত্ করতে না পেরে শুধু একটি চিরকুট পাঠিয়েছিলেন স্ত্রীকে- ‘সাড়ে সাত কোটি মানুষের সাথে মিশে যেও।…’ প্রবাসে ও যতদিন দেশ স্বাধীন না হবে ততদিন পারিবারিক জীবন-যাপন না করার সিদ্ধান্ত নিয়ে ৮নং থিয়েটার রোডের প্রবাসী সরকারের প্রধানমন্ত্রীর অফিস কক্ষের পেছনে লাগোয়া একটি কক্ষে রাতে থাকতেন। যুদ্ধকালীন ঘুরে বেড়িয়েছেন বাংলাদেশের বিভিন্ন এলাকা। মুক্তিবাহিনীকে, সাধারণ মানুষকে সাহস জুগিয়েছেন তিনি। শেখ মুজিবের ছিল নেতৃত্বের ক্যারিশমা আর তাজউদ্দীন আহমদের ছিল সাংগঠনিক দক্ষতা। মূলত তাঁর সুনিপুণ দক্ষতার গুণেই যুদ্ধ সঠিক পথে এগোতে থাকে। ড. আনিসুজ্জামানের ভাষায়- ‘মুক্তিযুদ্ধের সাফল্যের পশ্চাতে তাঁর কৌশলগত চিন্তা, সাংগঠনিক দক্ষতা ও দূরদর্শিতার ভূমিকা খুব বড় ছিল।’
যুদ্ধের সময় দলের অভ্যন্তর থেকে বিভিন্ন সমস্যার মুখোমুখি হয়েছেন। কিন্তু তিনি দক্ষতার সাথে সেসব মোকাবেলাও করেছেন। এসময় উপদেষ্টা পরিষদ গঠনের ইস্যুকে কেন্দ্র করে আওয়ামী লীগের কার্যকরী কমিটির বৈঠকে, প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদের বিরুদ্ধে একটি অনাস্থা প্রস্তাব উত্থাপন করা হয়। যুদ্ধকালীন গঠিত সরকারের মাঝেই ছিল বিভিন্ন বিরোধের ভূত। তিনি সবকিছুকে বিবেচনা করতেন তাঁর নিরীক্ষার দক্ষতা দিয়ে। বুকে ছিল তাঁর সত্যের সাহস আর মনে ছিল নেতার প্রতি অবিচল আস্থা।
দূরদর্শিতা ছিল তাঁর অসামান্য। পকিস্তানিরা একটি সুশিক্ষিত সৈন্যবাহিনী। তাদের সাথে লড়াই করার জন্য দরকার মুক্তিযোদ্ধা প্রশিক্ষণ, অস্ত্র, গোলা-বারুদ। এসব কিছুর ব্যবস্থা করাও সহজ ছিল না। কিন্তু তিনি সবকিছু মোকাবিলা করেছেন দক্ষতার সাথে। বিশ্ব রাজনীতির বিভিন্ন বিষয়ের সাথে সমন্বয় সাধন এবং নতুন জন্ম নেয়া বাংলাদেশের প্রতি সমর্থন আদায়ের লক্ষ্যে কূটনৈতিক তত্পরতাও চালিয়ে যান তাজউদ্দীন। এমনিভাবে যুদ্ধের সময়ে কখনও যুদ্ধক্ষেত্রে, কখনও শরণার্থী শিবিরে, কখনো ভারতীয় মন্ত্রীদের সাথে বৈঠক করে আবার কখনও স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের সংগ্রামী শিল্পীদের সাথে নিয়ে তাঁর যুদ্ধের প্রতিটি দিন কাটতে থাকে।
রক্ত ঝরতে থাকে।
কান্না ঝরতে থাকে।
সে কান্নায় লেখা হতে থাকে আগামীর ইতিহাস।
তিনি বুঝেছিলেন এ যুদ্ধের পরিণতি আসন্ন শীতকালের ভেতরই হয়ে যাবে। তাঁর তত্পরতায় সঠিকভাবেই এগোতে থাকে সবকিছু। ভারত স্বীকৃতি দেয় বাংলাদেশকে। দিনটি ৬ ডিসেম্বর ১৯৭১। ডিসেম্বরের শুরুতে ভারতীয় মিত্র বাহিনী যৌথভাবে বাঙালী মুক্তিবাহিনীর সাথে যুদ্ধে অংশ নেয়। প্রচন্ড আক্রমণে পর্যুদস্ত হয়ে পড়ে পাক হানাদার বাহিনী। যুদ্ধ চলাকালীন মুজিব নগর সরকারের কতিপয় ষড়যন্ত্রী নেতা পাকিস্তানের সাথে সমঝোতার চেষ্টা করেছিল। কিন্তু তা কঠোর হস্তে দমন করা হয়।
পাকিস্তানিদের রসদ সরবরাহে বাধা হয়ে দাঁড়ায় মুক্তিযোদ্ধারা। তাদের পক্ষে মুক্তিবাহিনীর গেরিলা আক্রমণ প্রতিহত করা ছিল দুস্কর। অবশেষে পাকিস্তানিরা পরাজয় স্বীকার করতে বাধ্য হয়।
১৯৭১ সালের ১৬ই ডিসেম্বর অভ্যুদয় ঘটে বাংলাদেশের বিজয় পাখির। ১৯৭২ সালের ৪ জানুয়ারি তাজউদ্দীন এক টিভি ভাষণে বলেন- ‘৩০ লক্ষাধিক মানুষের আত্মাহুতির মাঝ দিয়ে আমরা হানাদার পশুশক্তির হাত থেকে পদ্মা-মেঘনা-যমুনা বিধৌত বাংলাদেশকে স্বাধীন করে ঢাকার বুকে সোনালি রক্তিম বলয় খচিত পতাকা উত্তোলন করেছি।’
তিনি জানতেন তিনি একজন ধাত্রী। আর অভ্যূদিত বাংলাদেশের জনক রয়েছেন শত্রু শিবিরে বন্দি। তিনি কাঁদেন দুঃখে, ক্ষোভে, বেদনায়। মুক্তি দাবি করেন জাতির জনকের।
এবার সম্মিলিতভাবে দেশ গঠনে আত্মনিয়োগ করেন। শেখ মুজিবুর রহমান দেশে ফিরে এলে মন্ত্রী পরিষদ শাসিত সরকার ব্যবস্থা প্রবর্তন করা হয়। তাজউদ্দীন আহমদ হন নয়া সরকারের অর্থ ও পরিকল্পনা মন্ত্রী। ১৯৭৩-এ ঢাকা-২২ আসন থেকে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন। এতদিন যিনি সংগ্রাম করেছেন দেশ স্বাধীনের জন্য এখন তিনি সংগ্রামে নামেন দেশ গঠনের। দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়ন ও অর্থনৈতিক সমৃদ্ধির ব্যবস্থাকে চাঙা করার জন্য প্রচেষ্টা চালিয়ে যান তিনি। কিন্তু যুদ্ধবিধ্বস্ত একটি ভঙ্গুর অর্থনৈতিক ব্যবস্থাকে চাঙা করে তুলতে বেগ পেতে হয় তাঁকে।
নতুন দেশে নেতা কর্মীদের সাথে দলের, আর জনগণের সাথে সরকারের দূরত্ব বাড়তে থাকে। ১৯৭৪ সালে আওয়ামী লীগের দ্বি-বার্ষিক কাউন্সিলের সমাপনী অধিবেশনের বক্তৃতায় তিনি দল, সরকার এবং নেতা ও কর্মীদের মাঝে দূরত্ব দূর করে, সংগঠন এবং সরকারের মাঝে এক নিবিড় সম্পর্ক গড়ে তুলতে ভবিষ্যত্ নেতৃত্বের প্রতি আহ্বান জানান।
এদিকে সুবিধাভোগী, দুর্নীতিপরায়ণ, চাটুকার রাজনীতি সংশ্লিষ্টদের নির্লজ্জ তত্পরতা বেড়েই চলে। শেখ মুজিবের সাথে তাজউদ্দীন আহমদের দূরত্ব বাড়তে থাকে। তাঁদের মাঝে নীতিগত বিরোধ দেখা দেয়। তাঁদের সুন্দর সম্পর্কে ফাটল ধরে।
এক পর্যায়ে শেখ মুজিবুর রহমানের নির্দেশে মন্ত্রীপরিষদ থেকে পদত্যাগ করেন তাজউদ্দীন আহমদ। তিনি নিয়মতান্ত্রিক রাজনীতিতে বিশ্বাস করতেন। তিনি ছিলেন মনে প্রাণে দেশপ্রেমিক। চাইতেন না কোনোদিনই তাঁকে জড়িয়ে এমন কোনো বিতর্কের সৃষ্টি হোক যা থেকে জাতির বৃহত্তর স্বার্থের কোনো ক্ষতি হয়। আর তাই একাত্তরের রক্ষক্ষয়ী মুক্তিযুদ্ধের সফল নেতা মন্ত্রীসভা থেকে বিদায় নিলেন স্বাধীনতা লাভের মাত্র ২ বছর ১০ মাসের মাথায়।
যে নেতা দেশের জন্য পরিবার পরিজন ভুলে গিয়েছেন। ১৯৭০-এর ঘূর্ণিঝড়ে নিজ হাতে মৃতদেহ টেনেছেন। ১৯৭১-এ মুক্তিবাহিনীকে সাংগঠনিক নেতৃত্ব দিয়েছেন, বঙ্গবন্ধুর আদর্শের সাথে একাত্ম থেকেছেন, তাঁকেই শেখ মুজিবের নির্দেশে পদত্যাগ করতে হয়। তিনি ছিলেন একজন আদর্শবাদী নেতা। আদর্শই তাঁর কাছে ছিল বড়। পদত্যাগেও তাই ব্যক্তি নয় নীতিগত বিষয়ই ছিল প্রধান।
সুদর্শন ও ভদ্র ব্যবহারের এ মানুষটি রাজনৈতিক নেতা সুলভ কর্কশ কন্ঠের বদলে ছিলেন শান্ত ও কোমল ব্যবহারের অধিকারী। নিতান্ত সাধারণ পোশাকের আর মোটা ফ্রেমের চশমা পরা এই অসাধারণ মানুষের জীবনে শৌখিনতা বা বিলাস বলতে যেটুকু ছিল তা তাঁর ভাষায়- ‘আমার আর কিছু না থাক চুল আঁচড়াবার বিলাস আছে। হোক সামান্য, তবুতো বিলাস।’ (তাজউদ্দীন আহমদের ডায়েরি ১ম খন্ড) পরবর্তী জীবনে চুলে সুগন্ধী ব্রিল ক্রিম ব্যবহার করেছেন।
দৃপ্ত পায়ে, সারাদেশে রাজনৈতিক তত্পরতায় ব্যস্ত মানুষটিকেই আবার দেখা যায় কুষ্টিয়ার ছেঁউরিয়ার লালন আখড়ায় বাউল পরিবেষ্টিত মরমি গানের সমঝদার রূপে। এ এক অন্য অনন্য দৃশ্যকল্প।
ইতিহাস তার নিজস্ব নির্মাণের ক্রমধারার মাঝে কিছু ফাঁকা স্থান রেখে যায়, তা যদি সঠিকভাবে পূর্ণ হতো তাহলে ট্রাজেডি নামক শব্দটার সৃষ্টি হতো না। যুদ্ধ পরবর্তী বঙ্গবন্ধু সরকার থেকে পদত্যাগ করা তাজউদ্দীন আহমদ আর পূর্ববর্তী তাজউদ্দীন আহমদের মাঝের সেই শূন্যস্থান ইতিহাস কার ব্যর্থতায় পূরণ করতে পারেনি তা আজও প্রশ্ন। তা যদি সঠিকভাবে পূর্ণতা পেত, তবে স্বাধীনতা পরবর্তী ইতিহাস হয় তো হতো অন্য রকম।
১৯৭৫ সালের জুলাই মাসের শেষে তিনি জানতে পারেন যে, সেনাবাহিনীর মাঝে একটি গ্রুপ রয়েছে যারা শেখ মুজিবুর রহমানের প্রতি চরম অসন্তুষ্ট। তারা তাঁকে মেরে ফেলার পরিকল্পনা করছে। ঐ রাতেই শেখ মুজিবকে নিজে গিয়ে সচেতন করেন তাজউদ্দীন। তাঁর আশঙ্কাকে সত্য করে দিয়ে ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট শেখ মুজিবুর রহমানকে স্বপরিবারে হত্যা করা হয়। এ ভয়াবহ রূঢ়, নৃশংস ঘটনায় সবাই স্তম্ভিত। ঘটনার বীভত্সতায় তিনি আক্ষেপ করে বলেন, ‘বঙ্গবন্ধু জেনেও গেলেন না তাঁর শত্রু কে আর বন্ধু কে? তিনি বন্ধুকে চিনতে পারলেন না।’ তাজউদ্দীন আহমদের আক্ষেপ ছিল শেখ মুজিবুর রহমান তাঁকে কখনও নিভৃতে জিজ্ঞাসা করেননি স্বাধীনতা যুদ্ধের ৯ মাসের কথা।
বঙ্গবন্ধু হত্যাকান্ডের পর সবাই তাজউদ্দীন আহমদকে আত্মগোপনে যাবার জন্য বলতে থাকেন। কেননা বঙ্গবন্ধুর অবর্তমানে পরবর্তী লক্ষ্য হবেন তাঁর কাছের মানুষরা। কিন্তু তিনি আত্মগোপন করতে অস্বীকৃতি জানান।
অবশেষে সবার আশঙ্কাই সত্য হয়। ১৫ আগস্ট প্রথম গৃহবন্দী ও পরে ২২ আগস্ট গ্রেফতার করা হয় তাঁকে। পরিবারের সদস্যদের প্রতি শুধু বলে গেলেন- ‘ধরে নাও আজীবনের জন্য যাচ্ছি।’ দৃঢ়তার প্রতীক তিনি। ৩ কন্যা, ১ পুত্রসহ স্ত্রীকে ছেড়ে যাবার সময় একটুও বিচলিত ছিলেন না তিনি। ভুল বোঝাবুঝির অন্তর্দহনে দগ্ধ তাঁর হৃদয়। কিন্তু অন্যায়ের কাছে মাথা নত না করা দর্পিত পদক্ষেপ।
কারা অন্তরীণ তিনিসহ আরও ৩ জাতীয় নেতা। সৈয়দ নজরুল ইসলাম, এম. মনসুর আলী, এ.এইচ.এম কামরুজ্জামান। জেলে বসে অপেক্ষা করতে থাকেন পরবর্তী দৃশ্যকল্পের। তাজউদ্দীন আহমদ জেলে স্বেচ্ছায় কাঠ কাটেন, ফুল গাছ লাগান, নিজ হাতে কাপড় পরিষ্কার করেন, আর রাতে বসে লিখতে থাকেন মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস ভিত্তিক ডায়েরি। স্ত্রীকে তিনি বারবার বলে গেছেন কালো বর্ডার দেয়া লাল মলাটের সেই ডায়েরির কথা। কিন্তু সে ডায়েরি আর বাঙালী জাতির হাতে আসেনি। জাতি বঞ্চিত হয়েছে ধাত্রীর কাছ থেকে দেশের জন্মকথার অনেক অজানা সত্য জানতে। কারাগারে সেনা সদস্যদের আনাগোনা বাড়তে থাকে। তাঁর কাছে আর কারাগারকে নিরাপদ মনে হয় না। শঙ্কা সত্য হয়। ১৯৭৫ সালের ৩ নভেম্বর অস্ত্রের দমকে স্তব্ধ করে দেওয়া হয় ৪ নেতার জীবন ও শরীর। সে আর এক লজ্জাজনক, বেদনা-বিধুর ঘটনা। নিহত হন বাঙালী জাতির স্বাধীনতার কান্ডারীরা।
৪ নভেম্বর সন্ধ্যা পর্যন্ত হত্যার স্থানেই পড়ে থাকে মৃতদেহ। পরিবারকে খবর দেয়া হয় ৩৬ ঘন্টা পর আর রাতে জেলগেটে আত্মীয়দের হাতে মৃতদেহ তুলে দেয়া হয়। দাফন করা হয় বনানী গোরস্থানে।
১৯৭১-এ কারা অন্তরীন শেখ মুজিবুর রহমান শূন্য বিশাল যুদ্ধক্ষেত্রে দখলদার বাহিনীর সাথে যুদ্ধ, বঙ্গবন্ধুর অনুপস্থিতিতে সরকার গঠন এবং পরিচালনা, একই সঙ্গে নিজের দলের লোকজনের আত্মঘাতী আক্রমণ মোকাবেলা করেছেন, কিন্তু জর্জরিত হয়েছেন অন্তর্ঘাতে। আহত হয়েছেন তাদের আঘাতে যারা তাঁর কর্তব্য সম্পাদনের প্রতি নিষ্ঠাকে স্বার্থপরতার অজুহাতে সিক্ত করার অপচেষ্টা করেছে।
কর্মময় জীবনে কোনো কাজেই দাবি করেননি নিজ কৃতিত্বের। কর্তব্য বিবেচনা করে নিঃস্বার্থভাবে, একাগ্রচিত্তে কাজ করে গেছেন। বলেছেন- ‘মুছে যাক আমার নাম কিন্তু বেঁচে থাক বাংলাদেশ।’
শত বছরে কিছু মহান দায়িত্ব পালনের জন্য সময় কিছু মহান ব্যক্তির হাতে দায়িত্ব অর্পণ করে। নিঃসঙ্গ সারথী তাজউদ্দীন আহমদ সময়ের খুঁজে বের করা এমন একজন সুমহান ব্যক্তিত্ব, যিনি না থাকলে আমাদের মুক্তিযুদ্ধের গৌরবময় সময়ের ইতিহাস হয়ত লেখা হতো অন্যভাবে।
সংক্ষিপ্ত জীবনী:
নাম: তাজউদ্দিন আহমদ
জন্ম: কাপাসিয়ার দরদরিয়া গ্রামে ১৯২৫ সালের ২৩ জুলাই জন্মগ্রহণ করেন।
মা ও বাবা: মা মেহেরুন্নেসা খানম এবং বাবা মৌলবি ইয়াসিন খান।
পড়াশোনা:
তাজউদ্দীন আহমদের পড়াশোনা শুরু বাবার কাছে আরবি শিক্ষার মাধ্যমে, একই সময়ে ১ম শ্রেণীতে ভর্তি হন বাড়ির দুই কিলোমিটার দূরের ভূলেশ্বর প্রাথমিক বিদ্যালয়ে। ১ম ও ২য় শ্রেণীতে ১ম স্থান অর্জন করেন। ৪র্থ শ্রেণীতে ভর্তি হন বাড়ি থেকে প্রায় ৫ কিলোমিটার দূরের কাপাসিয়া মাইনর ইংলিশ স্কুলে। মা’র প্রচেষ্টা ছিল ছেলেকে ইংরেজি মাধ্যম স্কুলে লেখাপড়া করানোর। সফল হন তিনি। এরপর বিদ্যালয় পরিবর্তনের ধারাবাহিকতায় পড়েছেন কালিগঞ্জ সেন্ট নিকোলাস ইনস্টিটিউশন, ঢাকার মুসলিম বয়েজ হাই স্কুল ও সেন্ট গ্রেগরিজ হাই স্কুলে। এসময় একজন স্কাউট হিসেবে স্কাউট আন্দোলনের সাথে যুক্ত হন। পরবর্তী কর্মজীবনে যা তাঁর প্রেরণা ও কাজ করার ক্ষমতা জুগিয়েছে। এসম্পর্কে তিনি বলেছেন – ‘স্কাউট হিসেবে শিক্ষা, স্বাধীনতা সংগ্রামে আমাকে অমানুষিক পরিশ্রম করতে প্রেরণা ও ক্ষমতা জুগিয়েছে।’ এছাড়া দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় সিভিল ডিফেন্স-এর ট্রেনিং নিয়েছিলেন তিনি।
এম.ই. স্কলারশিপ পরীক্ষায় ঢাকা জেলায় প্রথম স্থান লাভ করেন। শুধু তাই নয় প্রতিভার স্বাক্ষর রাখেন মেট্রিকুলেশন পরীক্ষায়। ১৯৪৪ সালে এই পরীক্ষায় অবিভক্ত বাংলায় দ্বাদশ স্থান লাভ করেন তিনি। এ সময়ই জড়িয়ে পড়েন মুসলিম লীগের রাজনীতির সাথে। হয়ে ওঠেন পার্টির সক্রিয় সদস্য। এবছর নির্বাচনে বঙ্গীয় মুসলিম লীগের কাউন্সিলর নির্বাচিত হন। যদিও মুসলিম লীগের গণবিচ্ছিন্ন রাজনীতির প্রতিবাদে, পরবর্তীতে দলের সাথে সম্পর্ক ত্যাগ করেছিলেন। একই বছর কলকাতায় শেখ মুজিবুর রহামনের সাথে পরিচয় হয় তাঁর। ভালো পড়াশোনার ধারাবাহিকতা বজায় ছিল উচ্চ মাধ্যমিকেও। ঢাকা বোর্ডে অর্জন করেন ৪র্থ স্থান এবং ভর্তি হন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে। উচ্চ শিক্ষায় তাঁর বিষয় ছিল অর্থনীতি। এমনই মেধা-উজ্জ্বল শিক্ষা জীবনের ধারক ছিলেন এ অনন্য ব্যক্তিত্ব।
বিয়ে: ১৯৫৯ সালের ২৬ এপ্রিল সৈয়দা জোহরা খাতুন লিলির সাথে পরিণয়সূত্রে আবদ্ধ হন তিনি। বিয়ের অলংকার ছিল বেলী ফুলের মালা। তাঁর স্নিগ্ধ চেতনা আর মানসিকতার সুগন্ধই বহন করছিল মালার শুভ্র বেলী ফুলগুলো। ছেলেমেয়ে: ৩ কন্যা ও ১ পুত্র।
রাজনৈতিক জীবন: ১৯৪৮ এ প্রতিষ্ঠিত পূর্ব বাংলা ছাত্রলীগের অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা হয়েছিলেন তিনি। ছিলেন আওয়ামী মুসলিম লীগ গঠনের উদ্যোক্তাদের একজন। ১৯৫৩ সাল। ‘আওয়ামী মুসলীম লীগ’ দলের কাউন্সিলে আনুষ্ঠানিকভাবে ‘মুসলিম’ শব্দটি দলের নাম থেকে বাদ দেবার সিদ্ধান্ত নেয়। শেখ মুজিবুর রহমান দলের সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হন। এ সময়ই আওয়ামী লীগে সক্রিয়ভাবে যোগ দেন তাজউদ্দীন আহমদ। এ বছরই তিনি ঢাকা জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক হন। ১৯৫৪ সালের নির্বাচনে ঢাকা উত্তর-পূর্ব আসনে যুক্তফ্রন্ট প্রার্থী হন তাজউদ্দীন। প্রতিপক্ষ মুসলিম লীগের পূর্ব পাকিস্তান শাখার সাধারণ সম্পাদক প্রবীণ নেতা ফকির আব্দুল মান্নানকে ১৩ হাজার ভোটের ব্যবধানে হারিয়ে দেন। তখন তাঁর বয়স মাত্র ২৯ বছর। ১৯৬৪ সালে সাংগঠনিক সম্পাদক হন আওয়ামী লীগের। ৬ দফার ঐতিহাসিক ‘৬৬ সালে হন সাধারণ সম্পাদক। শেখ মুজিবুর রহমানকে রাষ্ট্রপতি করে, সৈয়দ নজরুল ইসলামকে শেখ মুজিবের অনুপস্থিতিতে অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি আর নিজে প্রধানমন্ত্রী হিসেবে ১০ এপ্রিল সরকার গঠন করেন ও ১৭ এপ্রিল মেহেরপুরের বদ্যিনাথ তলার আম্রকাননে শপথ গ্রহণ করেন। দেশ স্বাধীনের পর শেখ মুজিবুর রহমান দেশে ফিরে এলে মন্ত্রী পরিষদ শাসিত সরকার ব্যবস্থা প্রবর্তন করা হয়। তাজউদ্দীন আহমদ হন নয়া সরকারের অর্থ ও পরিকল্পনা মন্ত্রী। ১৯৭৩-এ ঢাকা-২২ আসন থেকে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন। এক পর্যায়ে শেখ মুজিবুর রহমানের নির্দেশে মন্ত্রীপরিষদ থেকে পদত্যাগ করেন তাজউদ্দীন আহমদ।
মৃত্যু: ১৯৭৫ সালের ৩ নভেম্বর।
তথ্যসূত্র:
১. ইতিহাসের পাতা থেকে – সিমিন হোসেন রিমি।
২. আলোকের অনন্তধারা – সিমিন হোসেন রিমি।
৩. তাজউদ্দীন আহমেদের ডায়রী।
৪. জাতীয় চার নেতা স্মারক গ্রন্থ।
৫. তিন নভেম্বর জেলের পাগলা ঘন্টা – এ্যাড. মোখলেসুর রহমান।
৬. মূলধারা ‘৭১ – মঈদুল হাসান।
৭. আত্মকথা ‘৭১ – নির্মলেন্দু গুণ।
৮. বাংলাপিডিয়া।
৯. দু’শো ছেষট্টি দিনে স্বাধীনতা – মুক্তিযোদ্ধা মুহাম্মদ নুরুল কাদির।
১০. পলাশী প্রান্তর থেকে বাংলাদেশ – খুরশীদ আলম সাগর।
১১. দ্য বিট্রেয়াল অব ইস্ট পাকিস্তান – লে. জে. এ. কে. নিয়াজী।
১২. তাজউদ্দীন আহমদ নিঃস্বঙ্গ সারথী – ভিডিও চিত্র।
১৩. সিমিন হোসেন রিমির সাক্ষাৎকার।
লেখক : রাজিত আলম পুলক