৭ মার্চ ১৯৭১। রেসকোর্স ময়দানে মঞ্চ প্রস্তুত। উপস্থিত সম্মিলিত দর্শক শ্রোতারা অধির আগ্রহে অপেক্ষা করছেন তাঁদের অবিসংবাদিত নেতার জন্য। অবশেষে তিনি এলেন এবং উঠে দাঁড়ালেন জনসমুদ্রের মঞ্চে। তিনি শুরু করলেন। তাঁর প্রতিটি শব্দ আছড়ে পড়তে লাগল, ঢেউ খেলে গেল জনসমুদ্রের মাঝে।
“এবারের সংগ্রাম মুক্তির সংগ্রাম
এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম।”
তারপর-
“রক্ত যখন দিয়েছি, রক্ত আরো দেবো
এদেশের মানুষকে মুক্ত করে ছাড়ব, ইনশাল্লাহ।”
রক্তদানের অহংকারে অহংকারী তাঁর কন্ঠস্বর, তা শোনাল আশার বাণীও। আর এই আশার বাণী হল স্বাধীনতা, যার জন্য দেশের প্রতিটি জনগণ ঝাঁপিয়ে পড়ে শত্রুর বিরুদ্ধে এবং তাঁর নির্দেশনায় দীর্ঘ নয় মাস জীবন বাজি রেখে যুদ্ধ করে ছিনিয়ে আনে স্বাধীনতা।
এই অবিসংবাদিত নেতা হলেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। অবিভক্ত ভারতবর্ষের গোপালগঞ্জ জেলার পাটগাতি ইউনিয়নের টুঙ্গিপাড়া গ্রামে তিনি ১৭ মার্চ, ১৯২০ সালে জন্মগ্রহণ করেন। বাবা শেখ লুত্ফর রহমান আর মা মোসাম্মত্ সায়েরা বেগম। পরিবারের প্রথম পুত্র। ৪ বোন ও ২ ভাইয়ের মাঝে তৃতীয় এ সন্তানকে আদর করে ডাকা হতো ‘খোকা’। ছেলেটির ভালো নাম রাখা হয় ‘শেখ মুজিবুর রহমান’।
হ্যাংলা, ছিপছিপে দৈহিক গঠন তাঁর, সুশ্রী। তাঁর বেড়ে ওঠা শুরু হয়। ছায়া-ঢাকা পথ-ঘাটহীন শহর থেকে দূরে নিভৃত পল্লীতে, তাঁর লালিত-পালিত ও পরিবর্ধিত হওয়া। বাড়িতেই তাঁর লেখাপড়ার হাতেখড়ি, পণ্ডিত সাখাওয়াত্ উল্লাহর কাছে৷ বড় হতে থাকেন তিনি। সামনের সময় অপেক্ষা করছে তাঁর ইতিহাস হয়ে ওঠার পথের দিকে চেয়ে।
৭ বছর বয়সে ১৯২৭ সালে তাঁর স্কুল শিক্ষার শুরু গমা ডাংগা প্রাথমিক বিদ্যালয়ে। এরপর গোপালগঞ্জ পাবলিক স্কুলের তৃতীয় শ্রেণীতে ভর্তি হন ১৯২৯ সালে। শেখ মুজিবুর রহমানের পিতা ছিলেন মাদারীপুর দায়রা আদালতের সেরেস্তাদার। ১০/১১ বছর বয়সে তিনি পুত্রকে নিজের কাছে মাদারীপুরে নিয়ে যান। সেখানকার মাদারীপুর ইসলামিয়া হাই স্কুলে তাঁকে ভর্তি করে দেওয়া হয় চতুর্থ শ্রেণীতে। ১৯৩৬ সালে তিনি গোপালগঞ্জ মিশন স্কুলে পঞ্চম শ্রেণীতে ভর্তি হন।
মাদারীপুর থাকার সময়েই শেখ মুজিবুর রহমানের বেরিবেরি রোগের কারণে চোখে ছানি পড়ে। শেখ লুত্ফর রহমান ছেলেকে কলকাতা মেডিকেল কলেজের বিখ্যাত চক্ষু চিকিত্সক ডা. টি আহমদের কাছে নিয়ে যান। সেখানে সফল অস্ত্রপচারের পর তিনি সুস্থ হলেও ডাক্তারের পরামর্শে তখন থেকেই চশমা পড়তে শুরু করেন।
নবম শ্রেণীতে পড়ার সময়, মিশন স্কুলে ছাত্রদের সভা হবে। এসডিও ১৪৪ ধারা জারি করে সেই সভা বন্ধ করে দেন। ছাত্ররা সমবেত হয়ে মসজিদে গিয়ে সভা করে। শেখ মুজিব দাঁড়িয়ে দু’একটা কথা বলতেই তাঁকে গ্রেফতার করে সেকেন্ড কোর্টে হাজির করে দু’ঘন্টা আটক রাখা হয়। ছাত্রদের বিক্ষোভ ও চাপে শেষ পর্যন্ত কোর্ট থেকেই তাঁকে ছেড়ে দিতে বাধ্য হয়। এটাই তাঁর ঘটনাবহুল জীবনের প্রথম গ্রেফতার।
মাত্র ১৮ বছর বয়সে ১৯৩৮ সালে শেখ মুজিবুর রহমানের বিয়ে হয় ফজিলাতুন্নেসা ওরফে রেনুর সাথে। পরবর্তীকালে এ দম্পতির ৩ পুত্র ও ২ কন্যা সন্তান জন্ম নেয়।
১৯৪০ সালে, অবিভক্ত বাংলার প্রধানমন্ত্রী, শেরেবাংলা এ.কে. ফজলুল হক ও খাদ্যমন্ত্রী হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী গোপালগঞ্জ স্কুল পরিদর্শনে আসেন। পরিদর্শন কাজ শেষে বাংলোতে ফেরার পথে এক ছাত্র তাঁদের পথ আগলে দাঁড়ায়। অকপটে বলে যায়, ছাত্রাবাসের ছাদ চুইয়ে পড়া পানিতে বর্ষাকালে ছাত্রদের বিছানাপত্র নষ্ট হবার ভোগান্তির কথা। তা মেরামতের দাবি জানায় সে। প্রধানমন্ত্রী তত্ক্ষণাত্ তাঁর স্বেচ্ছাধীন তহবিল থেকে ১,২০০ টাকা মঞ্জুর করেন এবং ছাত্রাবাসটি মেরামত করার নির্দেশ দেন।
সোহরাওয়ার্দী ছেলেটির সত্ সাহস, কর্তব্যজ্ঞান ও নির্ভীকতায় মুগ্ধ হন। পিয়ন মারফত স্লিপ পাঠিয়ে বাংলোতে এনে নানারকম আলাপ-আলোচনা করেন ও প্রীত হন ছেলেটির প্রতি। এই ছেলেটি আর কেউ নয় পরবর্তীকালের অনেক বিদ্রোহের অগ্রপুরুষ ও সময়ের প্রয়োজনে অনেক মহান বাক্য উচ্চারণ করা শেখ মুজিবুর রহমান। যিনি সোহরাওয়ার্দীকে রাজনৈতিক গুরু বলে স্বীকার করতেন। আর শেরেবাংলা পরবর্তীকালে শেখ মুজিবুর রহমানকে ‘নাতি’ বলে সম্বোধন করতেন।
১৯৪২ সালে গোপালগঞ্জ মিশন হাইস্কুল থেকে তিনি প্রবেশিকা পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন। পরে কলকাতার ইসলামিয়া কলেজে (বর্তমান মাওলানা আজাদ কলেজ) আই.এ. ক্লাসে ভর্তি হন। তখন থেকেই মুসলীম লীগ রাজনীতিতে হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীর সংস্পর্শে আসেন তিনি।
শেখ মুজিবুর রহমান ১৯৪৬ সালে কলকাতা ইসলামিয়া কলেজের ছাত্র সংসদের সাধারণ সম্পাদক পদে নির্বাচিত হন। ১৯৪৭ সালে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে ইসলামিয়া কলেজ থেকে রাষ্ট্রবিজ্ঞান ও ইতিহাসে অনার্সসহ ব্যাচেলার ডিগ্রি লাভ করেন। তখন থেকেই তিনি ছিলেন প্রাদেশিক বেঙ্গল মুসলিম লীগের কর্মী এবং ১৯৪৩ সাল থেকেই ছিলেন সর্বভারতীয় মুসলিম লীগের কাউন্সিলর। বঙ্গীয় মুসলিম লীগ নেতা সোহরাওয়ার্দী-হাসিম গ্রুপের সাথে তিনি ছিলেন সক্রিয়ভাবে যুক্ত। ১৯৪৬ সালের সাধারণ নির্বাচনে মুসলিম লীগ তাঁকে ফরিদপুর জেলার দায়িত্বে নিয়োজিত করে।
১৯৪৭ সালের ১৪ ও ১৫ আগস্ট যথাক্রমে পাকিস্তান ও ভারত স্বাধীনতা লাভ করে। ১৯৪৮ সালে তিনি ঢাকায় আসেন এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে আইন বিভাগে ভর্তি হন। কিন্তু বিশ্ববিদ্যালয়ের চতুর্থ শ্রেণীর কর্মচারীদের ন্যায্য দাবি-দাওয়ার প্রতি কর্তৃপক্ষের বৈষম্যমূলক আচরণের বিরুদ্ধে আন্দোলনে নেতৃত্ব দেওয়ার অভিযোগে ১৯৪৯ সালের প্রথমদিকে তাঁকে বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বহিষ্কার করা হয়। তারপরই তিনি আবার গ্রেফতার হয়ে যান। তাই তাঁর বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষা জীবন আর সমাপ্ত হয়নি। ১৯৪৯ সালের ২১ জানুয়ারি মুক্তি লাভ করেন শেখ মুজিব।
এ বছরের ২৩ জুন, ঢাকার রোজ গার্ডেনে এক গোপন বৈঠকে পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী-মুসলীম লীগ গঠিত হলো। একজন রাজবন্দি হিসেবে তখন তিনি ফরিদপুর জেলে অন্তরীণ ছিলেন। কারাবন্দি থেকেই শেখ মুজিব নির্বাচিত হলেন অন্যতম যুগ্ম-সম্পাদক পদে। ১৯৪৯ সালের জুলাই মাসে জেল থেকে বেরিয়েই শেখ মুজিব আওয়ামী লীগের প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি মাওলানা আব্দুল হামিদ খান ভাসানীর সঙ্গে খাদ্য সংকটের বিরুদ্ধে আন্দোলনে ঝাঁপিয়ে পড়লেন। অক্টোবরে আর্মানীটোলা থেকে এক বিশাল ভুখা মিছিল থেকেই গ্রেফতার হলেন মাওলানা ভাসানী, শামসুল হক আর শেখ মুজিব।
১৯৫২ সাল। তিনি তখনও জেলে। ভাষার জন্য আন্দোলন-সংগ্রামে দেশ তখন উত্তপ্ত। ২১শে ফেব্রুয়ারি পূর্ববঙ্গ প্রাদেশিক পরিষদের বাজেট অধিবেশনের দিনটিকে ঘোষণা করা হলো ‘ভাষা দিবস’ হিসেবে। মুখ্যমন্ত্রী নুরুল আমীন আকস্মিকভাবে ১৪৪ ধারা জারি করলে গভীর রাতে কিছু ছাত্রনেতা ১৪৪ ধারা ভাঙ্গার সিদ্ধান্ত নেন। শেখ মুজিব কারাগার থেকে এই সিদ্ধান্তের প্রতি সমর্থন জানান এবং মহিউদ্দিন আহমদকে সঙ্গে নিয়ে অনশন অব্যাহত রাখেন।
২১ ফেব্রুয়ারি পুলিশের গুলিতে সালাম, বরকত, রফিক, জব্বার, শফিউর শহীদ হন। কারাগারে স্বাস্থ্যের দ্রুত অবনতি হওয়ায় ২৭ ফেব্রুয়ারি শেখ মুজিবকে ছেড়ে দেওয়া হয়। মাওলানা ভাসানী স্বীয় ক্ষমতাবলে শেখ মুজিবকে আওয়ামী মুসলীম লীগের অস্থায়ী সাধারণ সম্পাদক নিযুক্ত করেন। ১৯৫২ সালে মহাচীনের রাজধানী পিকিং (বর্তমানে বেইজিং) নগরীতে আয়োজিত বিশ্ব শান্তি সম্মেলনে যোগ দেন শেখ মুজিব। ১৯৫৩ সালের ৯ জুলাই তিনি পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী মুসলীম লীগের কাউন্সিল অধিবেশনে দলের সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হন। ১৯৬৬ সালে দলের সভাপতি হবার আগ পর্যন্ত তিনি এ পদে ছিলেন।
হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী, যিনি শেখ মুজিবের রাজনৈতিক দীক্ষাগুরু, তাঁর মতো শেখ মুজিবও পার্টির সংগঠন ও দক্ষ ব্যবস্থাপনার গুরুত্ব অনুধাবন করতেন। দলকে সুসংগঠিত করার লক্ষ্যে তিনি ১৯৫৭ সালে আতাউর রহমান খানের মন্ত্রিপরিষদ (১৯৫৬-১৯৫৮) থেকে পদত্যাগ করেন এবং তৃণমূল পর্যায়ে সংগঠন গড়ে তোলার কাজে আত্মনিয়োগ করেন। মুজিব ছিলেন দক্ষ সংগঠক। তিনি ষাটের দশকের মধ্যবর্তী সময়ে হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীর অনিচ্ছা সত্ত্বেও আওয়ামী লীগকে পুনরুজ্জীবিত করার সাহসী পদক্ষেপ গ্রহণ করেন এবং অগ্রসর হতে সক্ষম হন। সোহরাওয়াদী তখনও রাজনৈতিক দলসমূহ পুনরুজ্জীবনের পক্ষে ছিলেন না এবং এনডিএফ বা ন্যাশনাল ডেমোক্রেটিক ফ্রন্টভুক্ত হয়ে একযোগে সকলের কাজের পক্ষে ছিলেন। কিন্তু ১৯৬৩ সালে শেখ মুজিব এনডিএফ ত্যাগের ঘোষণা দেন।
২৫ জানুয়ারি, ১৯৬৪ সালে শেখ মুজিবুর রহমানের বাসভবনে অনুষ্ঠিত এক সভায় আওয়ামী লীগকে পুনরুজ্জীবিত করা হয়। সেই সভায় মওলানা তর্কবাগীশ সভাপতি এবং শেখ মুজিবুর রহমান সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হন।
১৯৬৬ সালের ৫ ফেব্রুয়ারি লাহোরে অনুষ্ঠিত বিরোধী দলগুলোর জাতীয় সম্মেলনে শেখ মুজিবুর রহমান ঐতিহাসিক ৬ দফা দাবি পেশ করেন। এই প্রস্তাবিত ৬ দফা ছিল বাঙালী জাতির মুক্তি সনদ।
১৯৬৬ সালের ১ মার্চ শেখ মুজিবুর রহমান আওয়ামী লীগের সভাপতি এবং তাজউদ্দীন আহমদ সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হন। এবছর প্রথম তিন মাসে শেখ মুজিব ৮ বার গ্রেফতার হন।
এ সময় রাজনৈতিক অঙ্গন অনেক বেশি উত্তপ্ত হয়ে উঠে। ৬ দফা প্রকাশ হওয়ায় বাঙালীদের হৃদয়ে আশার নতুন আলো দেখা দেয়। ১৯৬৮ সালের ১৮ জানুয়ারি পাকিস্তানি শোষকগোষ্ঠী স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের জারিকৃত এক প্রেসনোটে আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলার ১নং বিবাদী হিসেবে শেখ মুজিবকে ঢাকার কেন্দ্রীয় কারাগারের গেট থেকে গ্রেফতারের ঘোষণা দেয়। এর পূর্বের ২০ মাসও শেখ মুজিব জেলে আটক ছিলেন।
১৯৬৯ সালে আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলার শুনানি সমাপ্ত হয়। সৈয়দ নজরুল ইসলাম এ মামলার অন্যতম প্রধান আইনজীবী ছিলেন। একই সময়ে তিনি আওয়ামী লীগের ভারপ্রাপ্ত সভাপতির দায়িত্বও পালন করছিলেন।
এ সময় ছাত্র ধর্মঘট এবং বিক্ষোভে ঢাকাসহ সারা দেশ ফুঁসে ওঠে। পুলিশের লাঠিচার্জ, কাঁদুনে গ্যাস, কারফিউ, সান্ধ্য আইন, ১৪৪ ধারায় দেশ অস্থির হয়ে ওঠে। ‘জয় বাংলা’ স্লোগানে প্রকম্পিত হতে থাকে রাজপথ। অবশেষে সরকার প্যারোলে মুক্তি নিয়ে শেখ মুজিবকে গোলটেবিল বৈঠকে অংশগ্রহণের কথা বললে তিনি তা প্রত্যাখান করেন। অবশেষে বাধ্য হয়ে আইয়ুব খান আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা সংক্রান্ত অর্ডিন্যান্স বাতিল করেন। মুক্তি লাভ করেন শেখ মুজিবসহ আগরতলা মামলার অন্য আসামিরা।
১৯৬৯ সালের ২৩ ফেব্রুয়ারি ঢাকার রেসকোর্স ময়দানে কেন্দ্রীয় ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের উদ্যোগে আয়োজিত বিশাল জনসভায় শেখ মুজিবুর রহমানকে গণসম্বর্ধনা দেওয়া হয়। সেই সভায় ছাত্র-জনতার পক্ষ থেকে সভার সভাপতি তোফায়েল আহমদ শেখ মুজিবুর রহমানকে ‘বঙ্গবন্ধু’ উপাধিতে ভূষিত করেন।
১৯৭০ সালের ৭ ডিসেম্বর অনুষ্ঠিত হয় পাকিস্তানের সাধারণ নির্বাচন। এ নির্বাচনে আওয়ামী লীগ বিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করে। নিরঙ্কুশ এ বিজয়ে আওয়ামী লীগ জাতীয় পরিষদের পূর্ব পাকিস্তানের ১৬৯টি আসনের মাঝে ১৬৭টি এবং প্রাদেশিক পরিষদের ৩১০টি আসনের মধ্যে ১৯৯টি আসন লাভ করে।
১৯৭১ সালের ৩ জানুয়ারি রেসকোর্সের জনসভায় বঙ্গবন্ধু জনপ্রতিনিধিদের শপথ গ্রহণ পরিচালনা করেন। পাকিস্তানের দুই প্রদেশের জন্য দুই প্রধানমন্ত্রীর যে দাবি ভূট্টো করেছিল বঙ্গবন্ধু তার তীব্র সমালোচনা করে তা প্রত্যাখান করেন। ১৪ জানুয়ারি প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া শেখ মুজিবুর রহমানকে পাকিস্তানের ভবিষ্যত্ প্রধানমন্ত্রী বলে উল্লেখ করেন। কিন্তু জাতীয় পরিষদের অধিবেশন আহ্বান করেও ১লা মার্চ তা অনির্দিষ্টকালের জন্য স্থগিত ঘোষণা দিলে দেশ জুড়ে প্রতিবাদের ঝড় ওঠে। ৩ মার্চ সারাদেশে হরতাল পালিত হয়। দেশ জুড়ে শুরু হয় অসহযোগ আন্দোলন।
আসে ঐতিহাসিক ৭ মার্চ। রেসকোর্স ময়দানে লাখো জনতার ঢল নামে। সবাই বঙ্গবন্ধুর নির্দেশনার অপেক্ষায়। এ সেই দিন, যেদিন তিনি প্রদান করেন এক ঐতিহাসিক ভাষণ। তাতে ছিল নির্দেশনা আর সশস্ত্র সংগ্রামের জন্য প্রস্তুতির কথা।
এরই মাঝে ১৫ মার্চ ইয়াহিয়া ঢাকা আসে আলোচনার জন্য, যা ২৫ মার্চ সকাল পর্যন্ত চলে। কিন্তু আলোচনা অসমাপ্ত রেখে হঠাত্ ইয়াহিয়া গোপনে পশ্চিম পাকিস্তানে চলে যায়। এদিকে ঢাকায় ২৫ মার্চ রাতে পাকিস্তানি সামরিক জান্তারা নিরীহ জনগণের উপর বর্বরোচিত হামলা করে। গণহত্যা চালায়। ২৫ মার্চ সকালে শেখ মুজিবুর রহমান পূর্ব পাকিস্তান ডিএফআই চিফ মারফত খবর পান ঢাকায় ক্র্যাকডাউন হতে যাচ্ছে। সাথে সাথে তিনি দলীয় হাই কমান্ডের নেতা ও অন্যান্য নেতাদের আত্মগোপনে যাবার নির্দেশ দেন। নিজে রয়ে যান ধানমন্ডির ৩২ নম্বর রোডের বাড়িতে। ২৫ মার্চ রাতের শুরুতেই শেখ মুজিবুর রহমানকে গ্রেফতার করা হয়। প্রথমে ঢাকা ক্যান্টনমেন্টে এবং পরে তাঁকে পশ্চিম পাকিস্তানে নিয়ে যাওয়া হয়।
এরপর বঙ্গবন্ধুর আদর্শের হাইকমান্ড গোপনে ভারতে চলে যায়। সেখানে অন্যান্য নেতাদের সহযোগিতায় এবং ভারত সরকারের সহযোগিতায় বঙ্গবন্ধুর অবর্তমানে তাঁকেই রাষ্ট্রপতি, সৈয়দ নজরুল ইসলামকে উপ-রাষ্ট্রপতি, তাজউদ্দীন আহমদ প্রধানমন্ত্রী, এ.এইচ.এম. কামরুজ্জামান, এম. মনসুর আলী, খন্দকার মোশতাক আহমদকে মন্ত্রী করে স্বাধীন বাংলাদেশ সরকার গঠন করা হয়। ১৯৭১-এর ১৭ এপ্রিল মেহেরপুরের বদ্যিনাথ তলার আম্রকাননে সরকার শপথ গ্রহণ করে। প্রবাসী এ সরকার মুক্তিযুদ্ধ সংগঠন ও পরিচালনা এবং বহিঃর্বিশ্বের সাথে যোগাযোগও সমর্থনের চেষ্টা চালিয়ে যেতে থাকে। অবশেষে দীর্ঘ নয় মাসের সংগ্রাম, ২ লাখ মা-বোনের ইজ্জত আর ৩০ লাখ বাঙালীর রক্তে স্নাত হয়ে স্বাধীনতার সূর্য ওঠে। ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর দেশ স্বাধীন হয়। যার জন্য এতদিনের অপেক্ষা, প্রতীক্ষা।
স্বাধীন দেশে ফিরে বাংলাদেশ সরকার তাদের কাণ্ডারী বঙ্গবন্ধুর মুক্তির জন্য আন্তর্জাতিক জনমত গড়ে তোলে এবং ১৯৭২ সালের ১০ জানুয়ারী তিনি লন্ডন হয়ে বাংলাদেশে আসেন। এদিন ‘দৈনিক ইত্তেফাক’-এর শিরোনাম ছিল- ‘ঐ মহামানব আসে, দিকে দিকে রোমাঞ্চ জাগে।’ ‘দৈনিক পূর্বদেশ’- ‘ভেঙ্গেছে দুয়ার, এসেছে জ্যোতির্ময়।’ আবারও রেসকোর্স ময়দানে এসে দাঁড়ান তিনি। লাখো মানুষ আনন্দাশ্রু ভেজা চোখে তাদের জাতির জনককে বরণ করে নেয়।
এবার তিনি হাত দেন দেশ গঠনে। মন্ত্রী পরিষদ শাসিত শাসন ব্যবস্থা প্রবর্তন করেন এবং নিজে প্রধানমন্ত্রী হন। ১৯৭৩ সালের সাধারণ নির্বাচনে আওয়ামী লীগ আবার সরকার গঠন করে। তিনি প্রায় সাড়ে তিন বছর বাংলাদেশের সরকার প্রধান হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। কিন্তু তাঁকে অত্যন্ত প্রতিকূলতা এবং বিধ্বস্ত অবস্থার মাঝে কাজ করতে হয়।
তিনি যুদ্ধ বিধ্বস্ত একটি অসংখ্য সমস্যা-সঙ্কুল, সাড়ে ৭ কোটি জনমানুষ অধ্যুষিত দেশের সমস্যা সমাধানের কাজ শুরু করেছিলেন শূন্য হাতে দেশ পরিচালনার মাধ্যমে। আইনশৃঙ্খলা পুনঃপ্রতিষ্ঠা, খাদ্য উত্পাদন বাড়ানো, মুক্তিযোদ্ধাদের পুনর্বাসন, তাদের দেশ গড়ার কাজে আত্মনিয়োগ করার সুযোগ সৃষ্টি, বিচ্ছিন্ন যোগাযোগ ব্যবস্থা পুনঃস্থাপন, অনাহারি ক্ষুধার্ত মানুষের মুখে অন্ন যোগান এবং আরো নানামুখী সমস্যার মুখোমুখি হতে হয়েছে তাঁকে। স্বাধীনতার পরবর্তী সময়। বিপুল অস্ত্র তখনও দেশের সাধারণ মানুষের মাঝে রয়ে গেছে। তিনি আইন-শৃঙ্খলা পুনঃপ্রতিষ্ঠা এবং দেশ জুড়ে অবৈধ অস্ত্র উদ্ধারের জন্য রক্ষী বাহিনী গঠন করেন। এ পদক্ষেপ ব্যর্থ হয়। এরই সাথে তাঁর সরকারের মাঝে অবস্থানকারী কতিপয় ক্ষমতালোভী, চাটুকার, স্বার্থলোভীর নির্লজ্জ কর্মতত্পরতায়, বিভিন্ন কর্মকাণ্ডে দুর্নীতি ছড়িয়ে পড়ে। দেশে দুর্ভিক্ষ দেখা দেয়। শেখ মুজিবের সাথে তাঁর দুঃসময়ের অনেক প্রকৃত সাথীর দুরত্ব বেড়ে যায়।
এ অবস্থা থেকে উত্তোরণের জন্য শেখ মুজিব একদলীয় বাকশাল গঠনের সিদ্ধান্ত নেন। এবং দ্বিতীয় বিপ্লবের কর্মসূচি ঘোষণা করেন। কিন্তু কোনো সুখকর উন্নতি আসার আগেই ক্ষিপ্ত হয়ে ওঠে স্বাধীনতা বিরোধীদের তাবেদার এক শ্রেণীর উচ্চাভিলাষী, সেনাবাহিনীর কতিপয় বিপথগামী সদস্য। এ সময় বিভিন্ন গোয়েন্দা সংস্থা এবং প্রথিতযশা রাজনৈতিক নেতারা সেনাবাহিনীর এক অংশের মাঝে তাঁর উপর পুঞ্জিভূত ক্ষোভের কথা শেখ মুজিবকে অবগত করেন। কিন্তু তিনি বলতেন-‘এরা আমার সন্তানের মতো।’ তাঁর স্বভাব-সুলভ উদারতা তাঁর বিপদ ডেকে আনে।
১৫ আগস্ট ১৯৭৫ সাল। রাতে সেনাবাহিনীর বিপথগামী সেনারা ধানমন্ডির ৩২ নম্বরের শেখ মুজিবুর রহমানের বাসভবন ঘেরাও করে ভেতরে প্রবেশ করে এবং তাঁর স্ত্রী, পুত্র, পুত্রবধু, আত্মীয়-স্বজনসহ ১৭ জনকে গুলি করে হত্যা করে। তাঁর মৃতদেহ হেলিকপ্টারে করে টুঙ্গিপাড়া নেওয়া হয় এবং তড়িঘড়ি করে দাফন করা হয়। তাঁর মন্ত্রিসভার সদস্য খন্দকার মোশতাক আহমদের প্রত্যক্ষ মদদে এ হত্যাকাণ্ড সংগঠিত হয়। বাঙালী জাতি চিত্কার করে কাঁদার পরিবর্তে স্তম্ভিত হয়ে যায়। দেশের স্বাধীনতার জনক তাঁর বুলেট বিদ্ধ ঝাঁঝড়া বুক নিয়ে ঘুমিয়ে রয়েছেন যে এই মাটিতেই। এ যে লজ্জা, শোক কি তাকে অতিক্রম করতে পারে?
আজও আছেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। দীর্ঘ দেহ, সফেদ পাজামা-পাঞ্জাবি, কালো মুজিব কোট, পেছনে আচড়ানো কাঁচা-পাকা চুল, কালো মোটা ফ্রেমের চশমা, হাতে পাইপ। শুধু সে পাইপ থেকে এডিনমুর’স তামাকের সুবাস বের হয় না।
সংক্ষিপ্ত জীবনী :
জন্ম : ১৭ মার্চ, ১৯২০, মঙ্গলবার।
বাবা ও মা : বাবা শেখ লুত্ফর রহমান ও মা মোসাম্মত্ সায়েরা বেগম।
শিক্ষাজীবন : ৭ বছর বয়সে ১৯২৭ সালে তাঁর স্কুল শিক্ষার শুরু গমা ডাংগা প্রাথমিক বিদ্যালয়ে। এরপর গোপালগঞ্জ পাবলিক স্কুলের তৃতীয় শ্রেণীতে ভর্তি হন ১৯২৯ সালে। শেখ মুজিবুর রহমানের পিতা ছিলেন মাদারীপুর দায়রা আদালতের সেরেস্তাদার। ১০/১১ বছর বয়সে তিনি পুত্রকে নিজের কাছে মাদারীপুরে নিয়ে যান। সেখানকার মাদারীপুর ইসলামিয়া হাই স্কুলে তাঁকে ভর্তি করে দেওয়া হয় চতুর্থ শ্রেণীতে। ১৯৩৬ সালে তিনি গোপালগঞ্জ মিশন স্কুলে পঞ্চম শ্রেণীতে ভর্তি হন।
১৯৪২ সালে গোপালগঞ্জ মিশন হাইস্কুল থেকে তিনি প্রবেশিকা পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন। পরে কলকাতার ইসলামিয়া কলেজে (বর্তমান মাওলানা আজাদ কলেজ) আই.এ. ক্লাসে ভর্তি হন।
শেখ মুজিবুর রহমান ১৯৪৬ সালে কলকাতা ইসলামিয়া কলেজের ছাত্র সংসদের সাধারণ সম্পাদক পদে নির্বাচিত হন। ১৯৪৭ সালে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে ইসলামিয়া কলেজ থেকে রাষ্ট্রবিজ্ঞান ও ইতিহাসে অনার্সসহ ব্যাচেলার ডিগ্রি লাভ করেন।
১৯৪৮ সালে তিনি ঢাকায় আসেন এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে আইন বিভাগে ভর্তি হন। কিন্তু বিশ্ববিদ্যালয়ের চতুর্থ শ্রেণীর কর্মচারীদের ন্যায্য দাবি-দাওয়ার প্রতি কর্তৃপক্ষের বৈষম্যমূলক আচরণের বিরুদ্ধে আন্দোলনে নেতৃত্ব দেওয়ার অভিযোগে ১৯৪৯ সালের প্রথমদিকে তাঁকে বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বহিষ্কার করা হয়। তারপরই তিনি আবার গ্রেফতার হয়ে যান। তাই তাঁর বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষা জীবন আর সমাপ্ত হয়নি।
বিয়ে ও পরিবার : মাত্র ১৮ বছর বয়সে ১৯৩৮ সালে শেখ মুজিবুর রহমানের বিয়ে হয় ফজিলাতুন্নেসা ওরফে রেনুর সাথে। পরবর্তীকালে এ দম্পতির ৩ পুত্র ও ২ কন্যা সন্তান জন্ম নেয়।
মৃত্যু : ১৫ আগস্ট ১৯৭৫ সাল।
তথ্যসূত্র:
১. বাংলা পিডিয়া।
২. উইকিপিডিয়া।
৩. মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতি – আমির-উল ইসলাম।
৪. দুশো ছেষট্টি দিনে স্বাধীনতা – মুক্তিযোদ্ধা মুহাম্মদ নুরুল কাদির।
৫. পলাশী প্রান্তর থেকে বাংলাদেশ – খুরশীদ আলম সাগর।
৬. দ্য বিট্রেয়াল অব ইস্ট পাকিস্তান – লে. জে.এ. কে. নিয়াজী।
৭. শেখ মুজিব ও বাংলাদেশ – শাহজাহান বিন মোহাম্মদ।
৮. বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান – সিরাজ উদ্দীন আহমদ।
৯. বাংলাদেশ গড়লেন যারা – সিরাজ উদ্দীন আহমদ।
১০. ভুট্টো, শেখ মুজিব বাংলাদেশ – রাও ফরমান আলী।
লেখক : রাজিত আলম পুলক