বাগানের গোলাপ গাছে খুব সুন্দর একটা গোলাপ ফুল ফুটেছিল সেদিন। অনেক প্রাণবন্ত, অনেক সজীব। যেন নতুনের বার্তাবহ। কারও আগমনী গান গাইছে, হালকা কুয়াশা ভেজা সকালে। সে আগমনী গানের সত্য ধারায় এই বাগানওয়ালা বাড়িতে জন্ম নেয় এক ছোট্ট ফুটফুটে শিশু। গোলাপ ফুলের মতো মনোহর, প্রাণ-প্রাচুর্যে ভরা। শিশুসুলভ স্নিগ্ধতায় টলটলে। দাদা সৈয়দ আবদুর রইস তাই নাম রাখলেন গোলাপ।
কবি কাজী নজরুল ইসলাম তখন নতুনের জয়গান গেয়ে, ধূমকেতুর মতো ঝাণ্ডা উড়িয়ে বাংলার সাহিত্য আকাশে আগমন করেছেন, আলোড়ন তুলেছেন। গানের সুরে বিদ্রোহের আগুন ছড়াচ্ছেন মানুষের মনে। সৈয়দ আব্দুর রইস তাতেও প্রভাবিত। আর তাই শিশুটির ভালো নাম রাখা হলো, নামের পূর্বে বংশ পদবী জুড়ে দিয়ে সৈয়দ নজরুল ইসলাম। ১৯২৫ সালের ১৮ ফেব্রুয়ারি জন্মগ্রহণ করা এই শিশুটি বড় হতে লাগল। কিশোরগঞ্জ জেলার, সদর থানার, যশোদল দামপাড়া/বিদ্দামপাড়া তার বিচরণ ক্ষেত্র। লেখাপড়ার হাতেখড়ি হয় যশোদল মিডল ইংলিশ স্কুলে। এরপর কিশোরগঞ্জ আজিমুদ্দিন হাই স্কুল আর ময়মনসিংহ জেলা স্কুলে কাটে তাঁর স্কুল জীবন। ময়মনসিংহ জেলা স্কুল থেকে ১৯৪১ সালে দুই বিষয়ে লেটার মার্কসসহ প্রথম বিভাগে ম্যাট্রিক পাস করেন। ১৯৪৩ সালে আনন্দমোহন কলেজ থেকে কৃতিত্বের সাথে প্রথম বিভাগে আই.এ. পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন। এরপর আসেন বিশ্ববিদ্যালয় জীবনে। ভর্তি হন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাস বিভাগে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় হলে থাকাকালে সাংগঠনিক রাজনীতির সাথে পরিচয় হয় তাঁর। সলিমুল্লাহ মুসলিম হলের ছাত্র সংসদের ক্রীড়া সম্পাদক হন প্রথম বর্ষে পড়ার সময়। এরপর ১৯৪৭-৪৮ সালে সলিমুল্লাহ্ মুসলিম হলের সহ-সভাপতি হিসেবে নির্বাচিত হয়ে দায়িত্ব পালন করেন। পরে মুসলিম ছাত্রলীগের সম্পাদক নির্বাচিত হন। ১৯৪৮ সালে মাস্টার্স উত্তীর্ণ হবার আগেই আনন্দমোহন কলেজে অধ্যাপনার কাজে নিযুক্ত হন। পরবর্তীকালে অবশ্য ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে তিনি ইতিহাসে প্রথম শ্রেণীতে মাষ্টার্স ডিগ্রী অর্জন করেন।
দিন গড়িয়ে যেতে থাকে। মায়ের ভাষার দাবিতে সোচ্চার হতে থাকে বাঙালী ছাত্র-জনতা। সৈয়দ নজরুলের মনে আঘাত হানে বাংলা ভাষার প্রতি কটাক্ষ। বাঙালীর উপর উর্দু ভাষাকে চাপিয়ে দেয়ার চেষ্টা বিদ্রোহের আগুন জ্বালে তাঁর মনে। নজরুল ইসলাম আত্মনিয়োজিত হন ভাষা আন্দোলনে। বাংলা ভাষার রাষ্ট্রীয় মর্যাদা দাবির প্রথম কমিটির উল্লেখযোগ্য সক্রিয় সদস্য এবং এ সময় গঠিত সর্বদলীয় অ্যাকশন কমিটির সদস্য হিসেবে তিনি ভাষা আন্দোলনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন। তিনি সিলেট রেফারেন্ডামের ছাত্র প্রতিনিধি দলের আহ্বায়ক ছিলেন।
১৯৪৭ সাল। ভারত বিভক্তির এ সময়, সিলেট ভারত না পাকিস্তান কোন্ দেশের অন্তর্ভুক্ত হবে এ সমস্যা সমাধানে গণভোটের আয়োজন করা হয়। এ সময় পাকিস্তানের পক্ষে প্রচারণা চালাতে সৈয়দ নজরুল একদল ছাত্র নিয়ে সিলেট যান। একই সময়ে কলকাতা ইসলামিয়া কলেজের তুখোড় ছাত্রনেতা, কলেজ ছাত্র সংসদের জিএস হিসেবে শেখ মুজিবুর রহমানও পাকিস্তানের পক্ষে জনমত গড়ে তুলতে সিলেট আসেন। এখানেই এই দুই উদীয়মান নেতার পরিচয় ঘটে। পরিচয় থেকে বন্ধুত্ব। বন্ধুত্ব থেকে আজীবনের রাজনৈতিক সহকর্মী।
পিতার ইচ্ছা ছেলে সিএসপি অফিসার হোক। এ ইচ্ছা পূরণে তিনি ১৯৪৯ সালে সিএসপি পরীক্ষা দেন ও উত্তীর্ণ হয়ে কর বিভাগে অফিসার পদলাভ করেন। কিন্তু তিনি মাত্র এক বছর সেই চাকরি করেন। কারণ একবার একটি গুরুত্বপূর্ণ ফাইল নিয়ে ঊর্ধ্বতন কমিশনারের রুমে গিয়েছেন, কমিশনার তাঁকে বসতে না বলায় অপমানিত বোধ করেন তিনি। চাকরিতে ইস্তফা দেন। এরপর আর এ ধরনের সরকারি চাকরি করেননি।
১৯৫০ সালে কটিয়াদীর বনেদি পরিবারের মেয়ে বেগম নাফিসা ইসলামের সঙ্গে পরিণয়সূত্রে আবদ্ধ হন সৈয়দ নজরুল ইসলাম। ১৯৫১ সালে তিনি সরকারি চাকুরিতে ইস্তফা দেবার পর ময়মনসিংহে আনন্দমোহন কলেজে অধ্যাপনায় ফিরে আসেন। অধ্যাপনার কাজে ব্যস্ত থাকাকালীনই তিনি এলএলবি পরীক্ষায় সাফল্যের সাথে উত্তীর্ণ হন এবং ১৯৫৫ সালে ময়মনসিংহ বার কাউন্সিলে যোগ দিয়ে আইন পেশাকে জীবনের ব্রত হিসেবে বেছে নেন।
তিনি শেখ মুজিবের রাজনৈতিক ভাবাদর্শের অংশীদার ছিলেন। তাঁর দ্বারা প্রভাবিতও ছিলেন নিজের স্বকীয়তা বজায় রেখে। যোগ দেন আওয়ামী লীগে। সাধারণ মানুষের ভাগ্যের উন্নয়ন তাঁর লক্ষ্য হয়ে দাঁড়ায়।
১৯৫৭ সালে তিনি খ্যাতিমান রাজনীতিক, সু-সাহিত্যিক ও পাকিস্তানের সাবেক বাণিজ্যমন্ত্রী আবুল মনসুর আহমেদকে কাউন্সিলের মাধ্যমে হারিয়ে বৃহত্তর ময়মনসিংহ জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি নির্বাচিত হন। ঐ কাউন্সিলে তত্কালীন আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক শেখ মুজিবুর রহমান নিজে উপস্থিত ছিলেন।
রাজনীতি সৈয়দ নজরুলের ধ্যান-জ্ঞানে পরিণত হয়। তিনি সপরিবারে থাকতেন ময়মনসিংহ শহরে কিন্তু অধিকাংশ সময় কাটতে থাকে ঢাকায় আওয়ামী লীগের রাজনীতিতে অংশ গ্রহণের মাধ্যমে। রাজনীতির কারণে চষে বেড়িয়েছেন সারা দেশ। বিশেষত উত্তরবঙ্গ এবং চট্টগ্রামেও তাঁর ঈর্ষণীয় জনপ্রিয়তা ছিল। তাই শেখ মুজিবুর রহমান এসব এলাকা সফর করার সময় সঙ্গে নিয়ে যেতেন সৈয়দ নজরুল ইসলামকে। “সৈয়দ নজরুল-বাংলার বুলবুল”- তখন সৈয়দ নজরুলের নামে স্লোগান উঠত।
আইয়ুব সরকারের আমলে মোনায়েম খান এবং তাঁর সৃষ্ট এনএসএফ সৈয়দ নজরুল এবং তাঁর পরিবারের উপর বিভিন্ন রকম নির্যাতন চালিয়ে যেতে থাকে। তবুও তিনি ছিলেন তাঁর বিশ্বাস ও সিদ্ধান্তে অটল। ১৯৬৪ সালে তিনি ইডেন চত্বরে অনুষ্ঠিত আওয়ামী লীগের কাউন্সিল থেকে কমিটির সিনিয়র সহ-সভাপতি নিযুক্ত হন। ১৯৭২ সাল পর্যন্ত এ পদে অসীন ছিলেন এ নেতা।
১৯৬০-এর দশকে জেনারেল আইয়ুব খান মৌলিক গণতন্ত্র নামে একটি স্থানীয় সরকার পদ্ধতির প্রবর্তন করেন। পাকিস্তানের রাষ্ট্রপতি জেনারেল আইয়ুব খান একটি নতুন পদ্ধতির মাধ্যমে গণতন্ত্রকে তৃণমূল পর্যায়ে ছড়িয়ে দেওয়ার লক্ষ্যে মৌলিক গণতন্ত্র আদেশ-১৯৫৯ জারি করেন। অবশ্য পূর্ব পাকিস্তানের রাজনৈতিক দলগুলোর অধিকাংশ এ সম্পর্কে ভিন্নমত পোষণ করত। তাদের দৃষ্টিতে এটা ছিল জেনারেল আইয়ুব ও তার সহযোগী কায়েমী স্বার্থবাদী গোষ্ঠীর ক্ষমতা কুক্ষিগত করার একটি সুনিপুণ অপকৌশল। ১৯৬৪ সালে এ মৌলিক গণতন্ত্রের নামে প্রহসনের নির্বাচনে বিডি মেম্বারদের টাকা বা ক্ষমতার লোভে মগজ বিক্রির কারণে সৈয়দ নজরুল এমএনএ নির্বাচিত হতে পারেননি। কিন্তু তারপরও তিনি আন্দোলন-সংগ্রামে ছিলেন সকলের অগ্রভাগে।
সারা দেশ জুড়ে বাঙালী জাতির স্বাধিকার আদায়ের লড়াই শুরু হয়ে গেছে এরই মধ্যে। এরই মাঝে শেখ মুজিবুর রহমান ঘোষণা করেন তাঁর ৬ দফা, বাঙালীর মুক্তির সনদ। ১৯৬৬ সাল। সৈয়দ নজরুল দেশব্যাপী ৬ দফার পক্ষে প্রচারণা চালান ও জনমত গড়ে তোলেন। ৬ দফার তীব্রতা কমাতে আইয়ুব খানের মনোনীত প্রাদেশিক গভর্ণর মোনায়েম খাঁ, শেখ মুজিবুর রহমানসহ অনেক প্রথিতযশা নেতাকে বারংবার গ্রেফতার করে এবং কর্মীদের উপর জুলুম নির্যাতন চালায়। বাংলার ও আওয়ামী লীগের জন্য সংকটময় সময় এটা। বাঙালীর আন্দোলন-সংগ্রামের আর এক কাণ্ডারী তাজউদ্দীন আহমদও গ্রেফতার হন। ১৯৬৬ সালের ৯ মে সঙ্কটময় মুহুর্তে সৈয়দ নজরুল আওয়ামী লীগের ভারপ্রাপ্ত সভাপতির দায়িত্ব গ্রহণ করেন। নিষ্ঠার সাথে সে দায়িত্ব পালন করেন ১৯৬৯ সাল পর্যন্ত। এগিয়ে নিতে থাকেন স্বাধিকার আন্দোলনকে।
১৯৬৮ সালে শেখ মুজিবুর রহমানকে প্রধান আসামি করে আগড়তলা ষড়যন্ত্র মামলা নামের একটি তথাকথিত রাষ্ট্রদ্রোহী মামলা দায়ের করা হয়। সৈয়দ নজরুল এ মামলায় শেখ মুজিবুরের অন্যতম আইনজীবীর দায়িত্ব পালন করেন। ১৯৬৯ সালের গণঅভ্যূত্থানে বিভিন্ন রাজনৈতিক দল ডেমোক্রেটিক অ্যাকশন কমিটি নামে একটি সর্বদলীয় সংগ্রাম কমিটি গঠন করে। তিনি এ কমিটির গুরুত্বপূর্ণ নেতা হিসেবে দায়িত্ব পালনকালে সম্মিলিত নেতৃত্বের অগ্রভাগে চলে আসেন। তিনি ডেমোক্রেটিক অ্যাকশন কমিটির আট দফা এবং ছাত্র সমাজ ঘোষিত ১১ দফা কর্মসূচির মাঝে খুবই দক্ষতার সাথে সমন্বয় সাধন করেন। রাজনৈতিক অস্থিরতা ক্রমান্বয়ে বাড়তে থাকে। এ অচলাবস্থা নিরসনের জন্য সরকার রাওয়ালপিন্ডিতে বিরোধী দলগুলোকে নিয়ে গোলটেবিল বৈঠক আহ্বান করে। প্রথমে ১৯৬৯ সালের ২৬ ফেব্রুয়ারি এবং পরে ১০-১৩ মার্চ দু’দফা এ বৈঠক হয়। তিনি আওয়ামী লীগের প্রতিনিধি দলের অন্যতম নেতা হিসেবে এ সময় বৈঠকে যোগদান করেন।
আইয়ুব শাসনামলের অধিকাংশ সময় শেখ মুজিব কারারুদ্ধ ছিলেন। তাঁকে বার বার গ্রেফতার করা হতো। এ সময় একবার, এক সাংবাদিক মোনায়েম খানকে (জন্মসূত্রে ময়মনসিংহ অঞ্চলের) প্রশ্ন করেছিলেন, ‘শেখ মুজিবকে বার বার আটক করলেও সৈয়দ নজরুলকে কেন আটক করেন না?’ মোনায়েম খান বলেছিলেন, ‘আমি চাইনা ময়মনসিংহ অঞ্চলে আর এক মুজিবের উত্থান ঘটুক।’
গোলটেবিল বৈঠকে সৈয়দ নজরুলের এবং আওয়ামী লীগ নেতাদের বলিষ্ঠ ভূমিকা এবং প্রবল জনমতের চাপে শেখ মুজিব মুক্তি পান। পতন ঘটে পাকিস্তানের লৌহমানব আইয়ুব খানের। সরকার রাজনৈতিক দলগুলোর আন্দোলনে পরাভূত হয়ে ১৯৭০ সালে সাধারণ নির্বাচন আহ্বান করে। সৈয়দ নজরুল ১৯৭০-এর নির্বাচনে ময়মনসিংহ-১৭ আসন থেকে এম.এন.এ. নির্বাচিত হন। সৈয়দ নজরুল ইসলাম সেই ঐতিহাসিক নির্বাচনে জয়লাভের পর আওয়ামী লীগের সংসদীয় দলের উপনেতা নির্বাচিত হন। সে নির্বাচনে আওয়ামী লীগ বাংলার মানুষের রায়ে বিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠতা পায়। কিন্তু পশ্চিম পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠী বাংলার মানুষের হাতে ক্ষমতা দিতে অস্বীকার করে। গণপরিষদের বৈঠক বাতিল করে দেয় সামরিক শাসক ইয়াহিয়া। পিছন থেকে কলকাঠি নাড়ে পিপিপি নেতা জুলফিকার আলী ভুট্টো। ইয়াহিয়া বৈঠকের নামে কালক্ষেপণ করতে থাকে। সারা বাংলা জুড়ে আবারো শুরু হয় আন্দোলন। বাঙালী দাবানলের মতো জ্বলে ওঠে। বঙ্গবন্ধু বাংলায় অসহযোগ আন্দোলনের ডাক দেন।
১৯৭১ সালের আন্দোলন-সংগ্রামেও সৈয়দ নজরুল ইসলাম ছিলেন অগ্রগামী। ১৯ মার্চ, ১৯৭১। ইয়াহিয়া প্রাদেশিক পরিষদের সংখ্যাগরিষ্ঠ দল আওয়ামী লীগের সাথে বৈঠক করেন। শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে সে প্রতিনিধি দলের সদস্য ছিলেন সৈয়দ নজরুল ইসলাম।
শেখ মুজিব গ্রেফতারের পূর্বেই দলীয় হাইকমান্ড গঠন করে গিয়েছিলেন। সৈয়দ নজরুল ছিলেন দলীয় হাইকমান্ডের প্রধানতম নেতা। ২৫ মার্চ দুপুরবেলা শেখ মুজিবুর রহমান পূর্ব পাকিস্তান ডিএফআই চিফ মারফত গোপন খবরে অবগত হন যে, রাতে ঢাকায় ক্রাকডাউন হতে যাচ্ছে। দ্রুত শেখ মুজিব হাইকমান্ড এবং অন্যান্য নেতাদের গোপন আশ্রয়ে যাবার নির্দেশ দেন। নিজে রয়ে যান ধানমন্ডির ৩২ নম্বর রোডের বাড়িতে। ২৫ মার্চ রাতে শেখ মুজিবুর রহমান গ্রেফতার হলে সৈয়দ নজরুল ইসলাম আওয়ামী লীগের ভারপ্রাপ্ত সভাপতির দায়িত্ব গ্রহণ করেন।
সৈয়দ নজরুল ২৫ মার্চ রাতে ছিলেন প্রখ্যাত চক্ষু চিকিত্সক ডা. আলীম চৌধুরীর বাসায়। ২৫ মার্চের ধ্বংসযজ্ঞের পরদিন ডা. চৌধুরীর স্ত্রী শ্যামলী নাসরিন চৌধুরীর সহায়তায় বিধবা মহিলার পোশাক ও পরচুলা পরে, রিকশাযোগে সৈয়দ নজরুল নরসিংদী চলে যান। পথে দু’বার পাক আর্মি রিকশা থামায়। চালক জানায়, আমার অসুস্থ বিধবা মাকে রিকশায় করে নিয়ে যাচ্ছি। নরসিংদী নিরাপদে চলে আসার পিছনে ওই রিকশাওয়ালার অবদান তিনি সর্বদা কৃতজ্ঞতাভরে স্মরণ করতেন। এরপর তিনি কটিয়াদী চলে যান। তাঁর অবস্থানের খবর জানাজানি হয়ে গেলে তিনি কিশোরগঞ্জ শহরে আসাদুজ্জামান সাহেবের বাসায় আশ্রয় নেন। এরই মাঝে রাতে তাঁর সাথে দেখা করতে আসেন তাঁর জ্যেষ্ঠপুত্র সৈয়দ আশরাফ ও হামিদুল হক। তাঁরা জিপে করে সৈয়দ নজরুল ইসলামকে নিয়ে যান হালুয়াঘাট সীমান্তে। মধ্যরাতে তাঁরা হালুয়াঘাট পৌঁছেন। ভোর হবার আগেই সীমান্ত পাড়ি দেন।
এদিকে তাজউদ্দীন আহমদ আগেই সীমান্ত পাড়ি দিয়ে ভারতে চলে যেতে পেরেছিলেন। তিনি সেখানে দলীয় হাইকমান্ড এবং অন্যান্য নেতাদের সাথে যোগাযোগের চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছিলেন। এবং বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধে ভারতের সহযোগিতার বিষয়ে ভারত সরকারের সাথে যোগাযোগ চালিয়ে যাবার সাথে সাথে একটি স্বাধীন সরকার গঠনের প্রক্রিয়াও এগিয়ে নিতে সক্ষম হয়েছিলেন।
তাজউদ্দীন আহমদ শেখ মুজিবুর রহমানকে রাষ্ট্রপতি এবং তাঁর অনুপস্থিতিতে উপ-রাষ্টপতি সৈয়দ নজরুল ইসলামকে অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি এবং নিজে প্রধানমন্ত্রী হিসেবে একটা সরকারের কাঠামো তৈরি করেন এবং ১০ এপ্রিল রেডিওতে স্বাধীন বাংলাদেশ সরকারের প্রধানমন্ত্রী হিসেবে ভাষণ দেন। তিনি অন্যান্য নেতাদের খোঁজ-খবর করতে শুরু করেন এবং ১১ এপ্রিল একটা ছোট বিমান যা খুব নিচু দিয়ে উড়তে পারে তাতে চড়ে, দু’দেশের সীমান্ত সংলগ্ন ছোট ছোট বিমান বন্দরে নেমে স্থানীয় আওয়ামী লীগ নেতাদের খোঁজ-খবর নিচ্ছিলেন। ময়মনসিংহ সীমান্তে সৈয়দ নজরুলকে বিশেষভাবে খোঁজ করার জন্য আগেই খবর দিয়ে রেখেছিলেন। এসময় বিএসএফের স্থানীয় অফিসার জানান, ডালু পাহাড়ের নিচে সৈয়দ নজরুল ও আব্দুল মান্নান রয়েছেন।
অতঃপর জীপে করে আবদুল মান্নান ও সৈয়দ নজরুল ইসলাম কলকাতায় আসেন। নজরুল ইসলামের সাথে তাজউদ্দীন আহমদের দেখা হয়। তিনি তাজউদ্দীনকে ডেকে নিয়ে একান্তে কথা বলেন। তিনি ঘটনা প্রবাহ সম্পর্কে অবহিত হন। সৈয়দ নজরুল ইসলাম প্রধানমন্ত্রী হিসেবে তাজউদ্দীন আহমদকে মোবারকবাদ জানান। সৈয়দ নজরুল ইসলাম উপ-রাষ্ট্রপতি হিসেবে দায়িত্ব পালন করতে সম্মত হন এবং ১৭ এপ্রিল শেখ মুজিবুর রহমানের আদর্শের হাইকমান্ডকে নিয়ে গঠিত সরকার মেহেরপুরের বদ্যিনাথতলার আম্রকাননে শপথ গ্রহণ করে। এ শপথ গ্রহণ অনুষ্ঠানে তিনি তাঁর ভাষণে বলেন- ‘যদি বিশ্বাসঘাতকতা করি, তবে আস্তাকুঁড়ে নিক্ষেপ করবেন।’ তিনি তাঁর দায়িত্ব পালনের প্রতি ছিলেন প্রখর সচেষ্ট।
প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদের সাথে সুচিন্তিত মতামত বিনিময়ের মাধ্যমে এবং সমঝোতার ভিত্তিতে তাঁরা সরকার পরিচালনা ও যুদ্ধকে এগিয়ে নিতে থাকেন। এক সময় তাঁর পরিবারের সদস্যরা কলকাতায় পৌঁছেন। তিনি সপরিবারে থাকতেন পার্ক সার্কাসের সিআইটি কলোনির বাড়িতে।
উপ-রাষ্ট্রপতি সৈয়দ নজরুল ইসলাম এবং প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদের যোগ্য নেতৃত্ব এবং বাংলাদেশের মুক্তিকামী জনগণ ও মুক্তিযোদ্ধাদের প্রবল আক্রমণের মাধ্যমে বাংলাদেশ স্বাধীনতার দিকে একটু একটু করে এগিয়ে যেতে থাকে। কিন্তু অন্য রাষ্ট্রের আনুষ্ঠানিক স্বীকৃতি তখনও পায়নি বাংলাদেশ। অক্টোবর মাসে রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ব্রেজনেভ দিল্লী সফরে আসেন। তখন ইন্দিরা গান্ধী, সৈয়দ নজরুল, তাজউদ্দীন এবং ব্রেজনেভের রুদ্ধদ্বার বৈঠক হয়। সে বৈঠকে ইন্দিরা গান্ধীর কাছে সৈয়দ নজরুল ইসলাম বাংলাদেশের স্বীকৃতির দাবি করেন। সময় এগিয়ে যেতে থাকে। চিঠির মাধ্যমে আনুষ্ঠানিকভাবে বেশ কয়েকবার ভারতের প্রধানমন্ত্রীর কাছে স্বীকৃতির আবেদন জানানো হয়। অবশেষে দিল্লী থেকে ডিপি ধর কলকাতায় আসেন এবং দু’দিনব্যাপী আলোচনা হয় অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি ও প্রধানমন্ত্রীর সাথে। আলোচনার মাধ্যমে পারস্পরিক সমঝোতা ও বিশ্বাসের ভিত্তিতে ভারত সরকার স্বাধীন বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দেয় ৬ ডিসেম্বর। ভারতীয় সেনাবাহিনী মুক্তিবাহিনীর সাথে যৌথভাবে যুদ্ধে অংশ নেয়। ৭ ডিসেম্বর যশোর সেনানিবাসের পতন হয়। এরপর যশোর আসেন সৈয়দ নজরুল এবং সেখানে তাঁর বক্তব্যে সাম্প্রদায়িক দলগুলোকে নিষিদ্ধ ঘোষণা করেন। তারপর একটু একটু করে জয়ের বন্দরে ভীড়ে বাংলাদেশের বিজয়ের তরী। ১৬ ডিসেম্বর, ১৯৭১ সাল। বাংলাদেশ স্বাধীন হয়।
স্বাধীন দেশে শেখ মুজিবুর রহমান দেশে ফেরার পর সংসদীয় শাসন ব্যবস্থায় সৈয়দ নজরুল ইসলাম শিল্প মন্ত্রী হিসাবে দায়িত্ব গ্রহণ করেন। যুদ্ধ বিধ্বস্ত বাংলাদেশে নতুন করে শিল্পের উপযোগী পরিবেশ তৈরিতে তিনি আত্মনিয়োগ করেন এবং শিল্প ব্যবস্থা আধুনিকায়নে মনোযোগী হন। ছিলেন সংবিধান প্রণয়ন কমিটির গুরুত্বপূর্ণ সদস্য। সংসদে ১৯৭২ সালে উপনেতা নির্বাচিত হন। ১৯৭৩ সালে ময়মনসিংহ-২৮ আসন থেকে পুনরায় সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন এবং দ্বিতীয়বারের মতো নির্বাচিত হন সংসদদলীয় উপনেতা। শিল্পমন্ত্রী থাকাকালে, শিল্প মন্ত্রণালয়ে শিল্প কারখানা জাতীয়করণ করার সুপারিশ দেন এবং তা করা হয়। তিনি নতুন শিল্প কারখানা স্থাপন এবং শিল্প-বান্ধব পরিবেশ সৃষ্টিতে আত্মনিয়োগ করে দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলে ছুটে যেতে লাগলেন। যুদ্ধ বিধ্বস্ত নতুন দেশে এসব কাজ ছিল খুবই কঠিন। ১৯৭৫ সালে শেখ মুজিবুর রহমান রাষ্ট্রপতি হলে তিনি উপরাষ্ট্রপতি হন এবং নবগঠিত বাংলাদেশ কৃষক-শ্রমিক আওয়ামী লীগ (বাকশাল)-এর সহ-সভাপতি নির্বাচিত হন।
সেনাবাহিনীর কতিপয় বিপথগামী সদস্য স্বাধীনতা যুদ্ধে পরাজিত শক্তির প্রত্যক্ষ মদদে ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে হত্যা করে এবং সৈয়দ নজরুল ইসলাম, তাজউদ্দীন আহমদ, এ.এইচ.এম. কামরুজ্জামান এবং এম. মনসুর আলীকে গ্রেফতার করে। খুনী চক্র বঙ্গবন্ধুর আদর্শের সাথী চার জাতীয় নেতাকে নিয়ে ভয়ে ছিল। খুনি চক্র সৈয়দ নজরুল ইসলামকে তাদের রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় অংশগ্রহণ করার জন্য চাপ দেয়। কিন্তু তিনি বলেন- ‘বঙ্গবন্ধুর আদর্শের সাথে কোন বেঈমানি নয়।’
জেলখানায় ১৯৭৫ সালের ৩ নভেম্বর রাত। থমথমে অবস্থা। অন্য তিন জাতীয় নেতাসহ সৈয়দ নজরুল ইসলামকে একত্রিত করা হয় একই ঘরে। জেলখানায় অবৈধভাবে প্রবেশ করা খন্দাকর মুশতাকের অনুসারি ও সেনা সমর্থিত মাত্র ৪ জন সৈন্য ৬০টি বুলেট ও বেয়নেট দিয়ে খুঁচিয়ে হত্যা করে চার জাতীয় নেতাকে। সৈয়দ নজরুল ইসলামকে দাফন করা হয় বনানী কবরস্থানে।
ওরা চেয়েছিল স্বাধীনতা যুদ্ধে জয়ী মুক্তিযুদ্ধের আদর্শের চেতনা ও আশা-আকাঙ্ক্ষাকে দমিয়ে দিতে। ওরা পারেনি। বুলেট স্ববাক কন্ঠকে রুদ্ধ করতে পারে, কিন্তু কন্ঠের বাণীকে নয়। খুনিরা পেরেছিল সৈয়দ নজরুল ইসলামকে হত্যা করতে, কিন্তু তাঁর আদর্শকে নয়।
সংক্ষিপ্ত জীবনী :
নাম : সৈয়দ নজরুল ইসলাম
জন্ম : কিশোরগঞ্জ জেলার, সদর থানার, যশোদল দামপাড়া/বিদ্দামপাড়া গ্রামে ১৯২৫ সালের ১৮ ফেব্রুয়ারি জন্মগ্রহণ করেন।
পড়াশোনা : লেখাপড়ার হাতেখড়ি হয় যশোদল মিডল ইংলিশ স্কুলে। এরপর কিশোরগঞ্জ আজিমুদ্দিন হাই স্কুল আর ময়মনসিংহ জেলা স্কুলে কাটে তাঁর স্কুল জীবন। ময়মনসিংহ জেলা স্কুল থেকে ১৯৪১ সালে দুই বিষয়ে লেটার মার্কসসহ প্রথম বিভাগে ম্যাট্রিক পাস করেন। ১৯৪৩ সালে আনন্দমোহন কলেজ থেকে কৃতিত্বের সাথে প্রথম বিভাগে আই.এ. পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন। এরপর আসেন বিশ্ববিদ্যালয় জীবনে। ভর্তি হন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাস বিভাগে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় হলে থাকাকালে সাংগঠনিক রাজনীতির সাথে পরিচয় হয় তাঁর। সলিমুল্লাহ মুসলিম হলের ছাত্র সংসদের ক্রীড়া সম্পাদক হন প্রথম বর্ষে পড়ার সময়। এরপর ১৯৪৭-৪৮ সালে সলিমুল্লাহ্ মুসলিম হলের সহ-সভাপতি হিসেবে নির্বাচিত হয়ে দায়িত্ব পালন করেন। পরে মুসলিম ছাত্রলীগের সম্পাদক নির্বাচিত হন। ১৯৪৮ সালে মাস্টার্স উত্তীর্ণ হবার আগেই আনন্দমোহন কলেজে অধ্যাপনার কাজে নিযুক্ত হন। পরবর্তীকালে অবশ্য ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে তিনি ইতিহাসে প্রথম শ্রেণীতে মাষ্টার্স ডিগ্রী অর্জন করেন। ১৯৫১ সালে তিনি সরকারি চাকুরিতে ইস্তফা দেবার পর ময়মনসিংহে আনন্দমোহন কলেজে অধ্যাপনায় ফিরে আসেন। অধ্যাপনার কাজে ব্যস্ত থাকাকালীনই তিনি এলএলবি পরীক্ষায় সাফল্যের সাথে উত্তীর্ণ হন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় হলে থাকাকালে সাংগঠনিক রাজনীতির সাথে পরিচয় হয় তাঁর এবং পরবর্তীতে রাজনীতি সৈয়দ নজরুলের ধ্যান-জ্ঞানে পরিণত হয়।
পেশা : পিতার ইচ্ছা ছেলে সিএসপি অফিসার হোক। এ ইচ্ছা পূরণে তিনি ১৯৪৯ সালে সিএসপি পরীক্ষা দেন ও উত্তীর্ণ হয়ে কর বিভাগে অফিসার পদলাভ করেন। কিন্তু তিনি মাত্র এক বছর সেই চাকরি করেন। কারণ একবার একটি গুরুত্বপূর্ণ ফাইল নিয়ে ঊর্ধ্বতন কমিশনারের রুমে গিয়েছেন, কমিশনার তাঁকে বসতে না বলায় অপমানিত বোধ করেন তিনি। চাকরিতে ইস্তফা দেন। এরপর আর এ ধরনের সরকারি চাকরি করেননি। ১৯৫১ সালে তিনি সরকারি চাকুরিতে ইস্তফা দেবার পর ময়মনসিংহে আনন্দমোহন কলেজে অধ্যাপনায় ফিরে আসেন। অধ্যাপনার কাজে ব্যস্ত থাকাকালীনই তিনি এলএলবি পরীক্ষায় সাফল্যের সাথে উত্তীর্ণ হন এবং ১৯৫৫ সালে ময়মনসিংহ বার কাউন্সিলে যোগ দিয়ে আইন পেশাকে জীবনের ব্রত হিসেবে বেছে নেন।
মৃত্যু :১৯৭৫ সালের ৩ নভেম্বর।
তথ্যসূত্র :
১. মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতি – আমীর-উল-ইসলাম।
২. বাংলাপিডিয়া।
৩. সাপ্তাহিক ২০০০ – প্রকাশিত স্মৃতিকথা: সংগ্রাম ও আদর্শের সৈনিক।
৪. দৈনিক প্রথম আলো – প্রকাশিত কলাম।
লেখক : রাজিত আলম পুলক