বাংলাদেশের এক দ্বীপ জেলা ভোলা। ভোলা জেলার দৌলতখান থানার পশ্চিম হাজিপুর গ্রাম। এই গ্রামেরই সন্তান হাবিবুর রহমান। তিনি সেনাবাহিনীর হাবিলদার। থাকেন কুমিল্লা সেনানিবাসে। গ্রামে তিনি হাফিজ মিলিটারি নামে পরিচিত। সরকারি ছুটিছাটায় হাবিবুর রহমান যখন গ্রামে আসেন তখন তাঁর সাথে থাকেন স্ত্রী মালেকা বেগম ও দুই সন্তান মোস্তফা কামাল এবং মোস্তাফিজুর রহমান। এই বাপ-দাদার ভিটেয় কেউ তাঁকে আর হাবিবুর রহমান ডাকে না। সবাই তাঁকে ডাকে হাফিজ মিলিটারি নামে। এই ডাক ছেলে মোস্তফা কামালের মনে এক মধুর অনুরণন তোলে। এই ডাক শুনে শুনে অল্পবয়সী মোস্তফা কামাল নিজের মনেই ঠিক করে ফেলেন বড় হয়ে পিতার মতোই তিনিও হবেন একজন সৈনিক। ১৯৪৭ সালের ১৬ ডিসেম্বর ভোলার দৌলতখান থানার পশ্চিম হাজিপুর গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন এই মোস্তফা কামাল। ছেলেবেলায় ছিলেন খুব ডানপিটে স্বভাবের।
তাঁর ছেলেবেলা কেটেছে কুমিল্লা সেনানিবাসে পিতার সরকারি আবাসে। সেনানিবাসের সাজানো গুছানো পথ ধরে হাঁটতে হাঁটতে তাঁর দিন কেটে যায়। স্কুল ফাঁকি দিয়ে মোস্তফা কামাল ঘুরে বেড়ান সৈনিকদের ছাউনিতে। স্কুলের পড়াশোনার চেয়ে মোস্তফা কামালের ভালো লাগে সৈনিকদের কুচকাওয়াজ, মার্চপাস্ট। আর অন্য সৈনিকদের মতো একজন দীপ্ত সৈনিক হওয়ার জন্য নিজে নিজে তৈরি হতে থাকেন। কিন্তু পুত্রের এই ইচ্ছেয় বাধ সাধেন পিতা। পিতা চাননি তাঁর ছেলে সেনাবাহিনীতে যোগ দিক। ফলে ২০ বছর বয়সে মোস্তফা কামাল একদিন কাউকে না জানিয়ে বাড়ি থেকে হঠাত্ নিরুদ্দেশ হয়ে যান। কোথাও তাঁকে আর খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। এই নিরুদ্দেশের দিনগুলোতে তিনি চুপিচুপি যোগ দেন পাকিস্তান সেনাবাহিনীতে। ১৯৬৮ সালে চতুর্থ ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টে তাঁর চাকরি চূড়ান্ত হওয়ার পর পিতা-মাতা তাঁর সন্ধান পান।
১৯৭১ সালের মার্চের মাঝামাঝি সময়ে কুমিল্লা সেনানিবাস থেকে চতুর্থ ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টকে পাঠানো হয় ব্রাহ্মণবাড়িয়ায়। তখন সারাদেশে ছড়িয়ে পড়ছে স্বাধীনতা যুদ্ধের স্ফুলিঙ্গ। স্বাধীনতার দাবিতে সারা দেশ উত্তাল। প্রতিটি সেনানিবাসে থমথমে অবস্থা। বাঙালী সামরিক অফিসারদের চেয়েও অধিক ক্ষুব্ধ, ক্রুদ্ধ, উদ্বেলিত উত্তেজিত ছিল বাঙালি সিপাহীরা।
সামরিক নিয়ন্ত্রণ নিজেদের হাতে রাখার জন্য সশস্ত্র বাহিনীর অবাঙালী অধিনায়কেরা বিভিন্ন বাঙালী রেজিমেন্টকে একস্থান থেকে আরেকস্থানে স্থানান্তর করছিল। এই অভ্যন্তরীণ নিরাপত্তা শক্তিশালী করার উদ্দেশ্যেই কুমিল্লা থেকে ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় স্থানান্তর করা হয়েছিল ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টকে। কিন্তু উদ্দেশ্য শেষ পর্যন্ত ব্যর্থ হয়। মেজর শাফায়েত জামিল (পরবর্তীতে কর্নেল ও অবসরপ্রাপ্ত) কিছুসংখ্যক বাঙালী অফিসারের সহায়তায় ২৭ মার্চের সকালবেলা ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় সেসময়ের অবাঙালী অধিনায়ক লে. কর্নেল খিজির হায়াত খান এবং সমস্ত পাকিস্তানী অফিসার ও জওয়ানদের নিরস্ত্র করে বন্দি করে ফেলেন। অপরদিকে মেজর খালেদ মোশাররফ অন্য একটি কোম্পানি নিয়ে সিলেটের শমসেরনগর থেকে বিদ্রোহে যোগ দেন এবং নেতৃত্ব গ্রহণ করেন।
স্বাধীনতা যুদ্ধে সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণের জন্য ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় অবস্থান নেয় চতুর্থ ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্ট। মোস্তফা তখন চব্বিশ বছরের দীপ্ত তরুণ। চার বছর যাবত্ কাজ করছেন সেনাবাহিনীতে। তিনি স্বচক্ষে দেখেছেন বাঙালীদের উপর পাকিস্তানীদের নিষ্ঠুর আচরণ। রেডিওতে শুনেছেন ৭ মার্চের বঙ্গবন্ধুর জ্বালাময়ী ভাষণ। স্বাধীনতার স্বপ্নে তাঁর দু’চোখ জ্বলে ওঠে। ঘরে ছিল তাঁর তরুণী বধূ, সদ্যজাত শিশুপুত্র। ছিল ভাই-বোন, মা-বাবা, পিতামহী। সকলের মায়া ত্যাগ করে দেশ ও স্বাধীনতার এক বিপুল প্রেমে যোগ দেন চতুর্থ ইস্ট বেঙ্গলের সঙ্গে। সেদিন যেসব উত্ফুল্ল সিপাহী ছাউনি থেকে বেরিয়ে এসে আকাশমুখে গুলি ছুড়তে ছুড়তে জয়োল্লাসে মত্ত হয়েছিলেন, সিপাহী মোস্তফা কামাল ছিলেন তাঁদের মধ্যভাগে। ফাঁকা গুলি ছোড়া দেখে মেজর শাফায়েত সঙ্গে সঙ্গেই নির্দেশারোপ করেন যেন আর একটি গুলি বিনা কারণে নষ্ট না করা হয়। কারণ প্রতিটি গুলিই মহামূল্যবান হয়ে উঠছে আগামী সময়ের জন্য। ফলে বন্ধ হয় ফাঁকা গুলি ছোড়ার উত্সব।
স্বাধীনতা যুদ্ধের শুরু। ব্রাহ্মণবাড়িয়াকে ঘিরে গড়ে তোলা হয় তিনটি প্রতিরক্ষা ঘাঁটি। আশুগঞ্জ, উজানীস্বর এবং ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় এন্ডারসন খালের পাশে এসব প্রতিরক্ষা ঘাঁটি গড়ে তোলা হয়। আশুগঞ্জের প্রতিরক্ষা ঘাঁটিতে দুই কোম্পানি সৈন্য এবং অন্য দুটোতে একটি করে কোম্পানি। এ সময় রেজিমেন্টে যোগ দিতে থাকেন ছাত্র, চাকরিজীবী, কৃষক, মজুর, বিডিআর, পুলিশসহ সর্বস্তরের স্বাধীনতাকামী বাঙালী। ১৪ এপ্রিল ১৯৭১। পাকিস্তানী মিলিটারি একযোগে হেলিকপ্টার গানশিপ, গানবোট এবং এফ-৮৬ স্যেবার ফাইটার বোম্বার বিমান নিয়ে আশুগঞ্জ এবং এন্ডারসন খালের প্রতিরক্ষা ঘাঁটি দুটোতে আক্রমণ করে। নয় ঘন্টা ধরে একযোগে যুদ্ধ চলার সময় পাকিস্তানী বাহিনী বিমান থেকে বোমা ফেলে, নেভাল গানবোট থেকে গোলা ছোঁড়ে, হেলিকপ্টার যোগে প্যারাসুট পরে সৈন্য নামিয়ে মুক্তিবাহিনীকে ব্যতিব্যস্ত করে তোলে। এমন আগ্নেয়াস্ত্রের সামনে মুক্তিবাহিনীর অস্ত্র একেবারেই মামুলি। আশুগঞ্জের ঘাঁটির পেছনেই হেলিকপ্টার দিয়ে অসংখ্য পাকিস্তানী সৈন্য নামানো হলো। মুক্তিবাহিনী কৌশলে পশ্চাদপসরণ করে ব্রাহ্মণবাড়িয়া-আখাউড়া রেলপথ ধরে চলে এল আখাউড়ায়। এই আখাউড়াকে কেন্দ্র করে নতুনভাবে মোট তিনটি প্রতিরক্ষা ঘাঁটি গড়ে তোলা হলো। তিতাস নদীর ব্রিজে, আখাউড়ার দক্ষিণে গঙ্গাসাগরে এবং তার উত্তরে দরুইন গ্রামে। ইতিমধ্যেই মোস্তফা কামালের সাহস, বুদ্ধি ও কর্মতত্পরতা মুগ্ধ করে মেজর সাফায়াত জামিলকে। তিনি তাঁকে ২নং প্লাটুনের ল্যান্সনায়েক নির্বাচিত করেন। সে অনুসারে মোস্তফা কামাল দশজন সৈন্যের সেকশন কমান্ডার হন। এই ২নং প্লাটুনকেই দরুইন গ্রামের প্রতিরক্ষা ঘাঁটির দায়িত্ব দেওয়া হলো।
মোস্তফা কামাল বিশ্বাস করতেন, সৈনিকদের শক্ত মনোবল, সাহসই এক-একটি দুর্গ। এই বিশ্বাসে নিবদ্ধ হয়ে মাত্র দশজন সৈন্য নিয়ে তিনি দরুইন গ্রামে প্রতিরক্ষা ঘাঁটির দায়িত্ব নিলেন। এদিকে পাকিস্তানী বাহিনীর ত্রিমুখী আক্রমণে স্বাধীনতাকামী বাঙালীদের অবস্থা একেবারে মুমূর্ষু। তাঁরা শুধু উন্মাদের মতো যুদ্ধ করেই যাচ্ছে। এ রকম কঠিন পরিস্থিতিতে কোনো প্রতিরক্ষা ঘাঁটিতেই খাবার সরবরাহ করা সম্ভব হয়নি। দুদিন পেটের ক্ষুধা নিয়ে শত্রুর মুহুর্মুহু আক্রমণ সামলানো ঘাঁটির সৈন্যদের জন্য একেবারে অসম্ভব হয়ে পড়েছিল।
যুদ্ধের সার্বিক পরিস্থিতি ও খাবার সংগ্রহের জন্য মোস্তফা কামাল নিজেই দরুইন গ্রাম থেকে ব্যাটালিয়ন সদর দপ্তর আখাউড়ায় এলেন। তাঁকে দেখেই ক্ষুব্ধ হলেন চতুর্থ ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের উপ-অধিনায়ক মেজর শাফায়াত জামিল। অত্যন্ত বিরক্তির স্বরে বললেন, ‘একি! তুমি কেন এসেছ তোমার প্রতিরক্ষা ছেড়ে? তুমি না সেকশন কমান্ডার? তোমার ঘাঁটি ছেড়ে আসাটা খুব অন্যায় হয়েছে। নিজে না এসে কোনো সিপাহীকে পাঠালেই তো এ কাজ হতো।’
মোস্তফা কোনো কথা বললেন না। নিজেই নিজেকে মনে মনে দোষারোপ করলেন। তাঁর মনে হলো, এমন ভয়ংকর যুদ্ধের সময় নিজের ঘাঁটি ছেড়ে আসাটা তাঁর মোটেও ঠিক হয়নি। খাবার সংগ্রহ এবং যুদ্ধের সঠিক পরিস্থিতি জানার জন্য নিজে আসার চেয়ে কাউকে পাঠালেই হয়তো ভালো হতো। কারণ সে সেকশন কমান্ডার। একটা ভুল মনস্তাপে ভুগতে থাকেন মোস্তফা। সাথে সাথে মনে মনে সিদ্ধান্ত নেন, কখনোই নিজ পরিখা ত্যাগ করবেন না।
১৬ এপ্রিল পাকিস্তানী হানাদার বাহিনী কুমিল্লা-আখাউড়া রেললাইন ধরে উত্তর দিকে অগ্রসর হতে থাকল। একটাই উদ্দেশ্য চতুর্থ ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টকে চিরতরে নিশ্চিহ্ন করে মাটির সাথে মিশিয়ে দিয়ে ব্রাহ্মণবাড়িয়া দখল করে নেয়া। ১৭ এপ্রিল সকাল থেকেই শুরু হয় দরুইন গ্রামে প্রতিরক্ষা ঘাঁটি ২নং প্লাটুনের ওপর আর্টিলারি গোলাবর্ষণ। মাত্র দশজন সৈন্য নিয়ে শক্তিশালী পাকিস্তানী সৈন্যদের মোকাবিলা প্রায় অসম্ভব। মোস্তফা সেক্টর প্রধানের কাছে সংবাদ পাঠালেন বাড়তি সেনা সহায়তার জন্য। চিন্তায় অস্থির হয়ে উঠলেন। আত্মরক্ষার জন্য প্লাটুনের সবাই অবস্থান নেয় পরিখার ভেতর। দুপুরের দিকে হাবিলদার মুনির আহমেদের নেতৃত্বে ১১নং প্লাটুন দরুইন গ্রামে এসে পৌঁছাল। কিছুটা স্বস্তির নিশ্বাস এল দরুইনের নিরাপত্তা ঘাঁটিতে। শেষ রাতের দিকে হানাদার বাহিনীর গোলাবর্ষণ কিছুটা কমে আসে। তবু সবাই সারারাত জেগে থাকল।
১৮ এপ্রিল ভোরবেলা। আকাশে উড়ে এল কালো মেঘের সারি। ঈশাণ কোণ থেকে আসতে লাগল শীতল বাতাস। মুক্তিযোদ্ধারা মনে মনে ভাবল, আসুক মেঘ, বৃষ্টিতে ভাসিয়ে দিক সব। তাহলে হয়ত শত্রুরা একটু দমে যাবে। সকালটা একরকম নির্বিঘ্নেই কাটল। পাকিস্তানী বাহিনী কোনোরকম গোলাবর্ষণই করল না। শুধু কয়েকটা হেলিকপ্টার উড়ে গেল উজানীস্বর পুলের দিকে। খাবার এলেও মোস্তফা পরিখা থেকে উঠে এলেন না। প্লাটুনের সবাই একে একে খাবার নিয়ে গেল। তিনি এলএমজি হাতে নিজের ট্রেঞ্জে অতন্দ্র, অনড়।
বেলা এগারোটা। পাকিস্তানী বাহিনী আবার গোলাবর্ষণ শুরু করল। আর সাথে সাথেই শুরু হলো প্রচণ্ড বৃষ্টি। কিন্তু বৃষ্টিকে অবজ্ঞা করেই এগিয়ে এল শত্রু। আধঘন্টার মাঝে অবস্থান নিল মোগরা বাজার ও গঙ্গাসাগরে। সাড়ে এগারোটায় এ দুটো অবস্থান থেকে আসতে লাগল অনবরত গুলির ধারা। মোগরা বাজারের একটি উঁচু দালানের ছাদে শত্রুরা বসাল একটি মেশিনগান। আর এ থেকেই মারাত্মকভাবে দরুইনের ঘাঁটিতে গোলাবর্ষণ করে যাচ্ছিল।
বেলা বারোটায় আক্রমণ হলো তীব্রতরভাবে। পশ্চিম দিক থেকে পাকিস্তানী বাহিনী এবার সরাসরি আক্রমণ করে বসল। একটা গুলি এসে বিদ্ধ করল মেশিনম্যানকে। সঙ্গে সঙ্গে বন্ধ হয়ে গেল মেশিনগান। মোস্তফা মুহুর্ত দেরি না করে মেশিনগানটি হাতে তুলে নিয়ে গুলি চালাতে লাগলেন।
দুপুরের পর পাক হানাদারের আক্রমণ আরও তীব্রতর আকার ধারণ করল। প্রবল বৃষ্টির কারণে তাদের তীব্রতা হ্রাস পেতে পারে এমনটি ধারণা করছিল মুক্তিযোদ্ধারা। ফল উল্টো হওয়ায় তাঁরা সামান্য হতবিহ্বল হয়ে পড়েন। তবে সেকশন কমান্ডার মোস্তফার অবিচলিত মনোভাব ফের তাঁদের আত্মবিশ্বাস ফিরিয়ে আনতে সাহায্য করে।
পাকিস্তানী সৈন্যরা সংখ্যায় অনেক বেশি। সঙ্গে তাদের বিপুল অস্ত্রের ভাণ্ডার। তারা দক্ষিণ, পশ্চিম ও উত্তর দিক থেকে দরুইনকে প্রায় ঘিরে ফেলল। তাদের কাছে মুক্তিযোদ্ধারা সংখ্যায় একেবারে নগণ্য। ভারী অস্ত্র নেই বললেই চলে। এই অবস্থায় কৌশল গ্রহণ করতে হলো- প্রথমত সামনা-সামনি যুদ্ধ করে মৃত্যুবরণ করা, দ্বিতীয়ত পূর্বদিকে পশ্চাদপসরণ করে নিরাপদ আশ্রয়ে চলে যাওয়া। পশ্চাদপসরণের সিদ্ধান্তই অধিক যুক্তিযুক্ত মনে হলো তাঁদের কাছে। কিন্তু পিছু হটতে হলেও তো কিছুটা সময় প্রয়োজন। পিছু হটার সময় কাভার দেবে কে? কিন্তু পিছু না হটলে সবার মৃত্যু অবধারিত। মোস্তফা কামাল স্থির করলেন তিনিই কাভারিং ফায়ার দেবেন। এই উদ্দীপ্ত, তারুণ্যের প্রতীক, তেজি সংগ্রামী মানুষটি নিজে পরিখার মধ্যে দাঁড়িয়ে গেলেন। একাই গুলি চালাতে লাগলেন উত্তরে, দক্ষিণে, পশ্চিমে। মোস্তফা নির্দেশ দিলেন সবাইকে পিছু হটার জন্য। কিন্তু তাঁকে রেখে অন্যরা যেতে চায় না। মোস্তফা বললেন, কেউ একজন কাভারিং ফায়ারের দায়িত্ব না নিলে বাকি সবাইকে মরতে হবে। সেকশন কমান্ডার হিসেবে এটা আমারই দায়িত্ব।
মোস্তফা কামালকে দুর্গের মধ্যে রেখেই বাকিরা খুব সাবধানে পিছু হটতে লাগলেন। মোস্তফা অনবরত গুলি চালাতে লাগলেন শত্রুদের ওপর। তাঁর গুলির তোড়ে হানাদার বাহিনী এগোতে গিয়ে থামতে বাধ্য হলো। এবার অন্য মুক্তিযোদ্ধারা তাঁকে সরে আসার জন্য অনুরোধ জানান। কিন্তু মোস্তফা মনস্থির করে ফেলেছেন। তিনি অনড়, অদম্য, নিজেই এক বিশাল দুর্গম দুর্গ। তাঁকে ভেদ করবে একমাত্র মৃত্যু। ক্রমাগত গুলি চালাতে লাগলেন শত্রুর ওপর। কিন্তু বিধি বাম, একসময় তাঁর গুলি ফুরিয়ে গেল। হানাদার বাহিনী ত্রিমুখী আক্রমণে তাঁকে ঘিরে গুলি চালাতে লাগল। গুলিতে গুলিতে ঝাঁঝরা হয়ে গেল মোস্তফার শরীর। নিজের পরিখাতেই ঢলে পড়েন তিনি। তাঁর এমন বীরত্বের কারণেই অন্য সহযোদ্ধারা বেঁচে রইলেন আগামী সময়ে যুদ্ধ করার জন্য।
দরুইন গ্রাম থেকে পশ্চাদপসরণ করে মুক্তিযোদ্ধারা আখাউড়া চলে যান। মেজর শাফায়েত জামিল তাঁদের নিয়ে ভারত সীমান্তে মনতলায় চলে যান। গঙ্গাসাগর ও দরুইন অধিকার করে একসময় পাকবাহিনী এলাকা ছেড়ে যায়। পরবর্তীতে দরুইনের স্থানীয় লোকেরা বুলেটে ঝাঁঝরা, বেয়নেটবিদ্ধ মোস্তফা কামালের মৃতদেহ খুঁজে পান। হানাদার বাহিনী যখন ট্রেঞ্জে প্রবেশ করে তখনও হয়তো মোস্তফার দেহে প্রাণ ছিল। বর্বর হানাদাররা বেয়নেট দিয়ে খুঁচিয়ে খুঁচিয়েই হয়তো তাঁকে হত্যা করেছে। দরুইনের মাটিতে শায়িত আছেন এই বীর। তাঁর অদমনীয় মানসিক দৃঢ়তা ও নিজেকে বিলিয়ে দিয়ে অন্যদের বাঁচিয়ে দেয়া মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসে এক অমর গৌরবগাথা। আর এ জন্যই তিনি পেয়েছেন বীরশ্রেষ্ঠর মর্যাদা।
বীরশ্রেষ্ঠ মোস্তফা কামালের জন্মস্থান ভোলার দৌলতখান উপজেলার হাজিপুর গ্রামে হলেও তাঁর নামে স্মৃতি জাদুঘর ও পাঠাগার হচ্ছে ভোলা সদর উপজেলার আলীনগর ইউনিয়নের মৌটুপী গ্রামে। কেননা হাজিপুর গ্রামটাই নদীগর্ভে বিলীন হয়ে গেছে। পাশাপাশি সরকার আখাউড়ায় স্থাপন করেছেন বীরশ্রেষ্ঠ মোস্তফা কামাল স্মৃতি কমপ্লেক্স। ২০০৩ সালে মা মালেকা বেগম পুত্রের শেষ আশ্রয়স্থলটি পরিদর্শন করে এসেছেন। তিনি এক সাক্ষাত্কারে বলেন, ‘বারবার ছুটে যেতে মন চায়, কিন্তু শরীর অসহায়। ছেলে দেশের জন্য শহীদ হইল। দেশের মানুষের লগে আমারও গর্ব হয়। আমি একজন বড় শহীদের, বীরশ্রেষ্ঠর মা। আমার পাওনের আর কিছু নাই। তয় আমার পোলার সংসারটাও ভাগ্যে লাগে নাই। বেবকই দুনিয়া ছাড়ল।’ বীরশ্রেষ্ঠর নামে প্রতিষ্ঠিত কলেজ প্রাঙ্গণের একটি কোণে ভোলা জেলা পরিষদের তত্ত্বাবধানে বীরশ্রেষ্ঠ মোস্তফা কামাল লাইব্রেরি ও জাদুঘর নির্মাণের কাজ চলছে। জেলা পরিষদ প্রায় সাড়ে ৪৭ লাখ টাকা ব্যয়ে নির্মাণ করছে এই কমপ্লেক্স।
ল্যান্স নায়েক মোহাম্মদ মোস্তফা কামালের নামানুসারে মৌটুপীর নাম পরিবর্তন করে রাখা হয়েছে কামালনগর। মোস্তফা কামালের স্ত্রী, ছেলেমেয়ে কেউই বেঁচে নেই। মা ছাড়া আর আছেন একটিমাত্র ভাই মোস্তাফিজুর রহমান।
সংক্ষিপ্ত জীবনী :
জন্ম : ১৬ ডিসেম্বর, ১৯৪৭
জন্মস্থান : ভোলা জেলার দৌলতখান থানার পশ্চিম হাজিপুর গ্রামে।
পিতা : হাবিবুর রহমান মণ্ডল।
মা : মোসাম্মত্ মালেকা বেগম।
কর্মস্থল : সেনাবাহিনী।
যোগদান : ১৯৬৮ সাল।
পদবী : সিপাহী।
মুক্তিযুদ্ধে অংশরত সেক্টর : ৮ নং সেক্টর।
মৃত্যু : ৮ এপ্রিল, ১৯৭১ সাল।
সমাধি স্থল : ব্রাহ্মণবাড়িয়ার আখাউড়ার দরুইন গ্রামে।
সূত্র : উইকিপিডিয়া, বাংলাপিডিয়া
বীরশ্রেষ্ঠ; রচনা: চন্দন চৌধুরী।
লেখক : এহসান হাবীব