ফরিদপুর। প্রমত্ত পদ্মার তীর ঘেঁষে গড়ে ওঠা এক জনপদ। ফরায়েজী আন্দোলনের প্রাণপুরুষ হাজী শরীয়ত উল্লাহর স্মৃতিধন্য ফরিদপুর। নারিকেলবাড়িয়ায় তীতুমীরের বাঁশের কেল্লা ইংরেজ কর্নেলের কামানের গোলায় পুড়ে ছাই হয়ে গেলে ফরিদপুরে নতুন করে গড়ে ওঠে স্বাধিকার আন্দোলন। তবে একটু ভিন্নমাত্রায়, আরব মুলুক থেকে হজ্ব সেরে শরীয়ত উল্লাহ নামের এক ভদ্রলোক সরাসরি যুদ্ধ বিগ্রহে না গিয়ে তিনি এ এলাকার মুসলমানদেরকে ঈমান আকিদার প্রশ্নে একতাবদ্ধ করতে লাগলেন। এই করে ফরিদপুরের মানুষেরা আস্তে আস্তে এক বিশাল আন্দোলন গড়ে তোলে। ইতিহাসে এই আন্দোলনই ফরায়েজী আন্দোলন নামে খ্যাত। ফরায়েজী আন্দোলনের কল্যাণেই ফরিদপুরের মানুষেরা স্বাধীনতার প্রশ্নে একটু বেশি সচেতন আর ধর্মীয় ব্যক্তিত্ব যেমন, ইমাম, মৌলভি, সুফি, দরবেশ তাঁরা একটু বেশি সম্মান পান।
ফরিদপুরের এক পল্লীর তেমনি এক সম্মানিত ব্যক্তি মুন্সি মেহেদী হোসেন। ফরিদপুর জেলার মধুখালি থানার সালামতপুর গ্রামে তাঁর বসতি। তিনি এই গায়ের মসজিদের ইমাম। ফজরের নামাজের ইমামতি সেরে কিছুক্ষণ মসজিদে বসে দুরুদ পড়ে আকাশ ফর্সা হয়ে এলে তিনি মসজিদ থেকে বের হয়ে আপনমনে গায়ের পথ ধরে হাঁটছেন আর ভাবছেন নিজের ভূত ভবিষ্যত্ নিয়ে। গায়ের মসজিদের ইমাম হিসেবে তিনি এ এলাকায় যথেষ্ঠ শ্রদ্ধার পাত্র। সম্মানও পান সকল শ্রেণির মানুষের কাছে। কিন্তু কেবল শ্রদ্ধা আর সম্মান দিয়ে কী জীবন চলে? অথচ একমাত্র ছেলে রব বড় হয়ে উঠছে ধীরে ধীরে। আর কয়দিন পরেই তাকে স্কুলে ভর্তি করতে হবে। তার জন্য প্রয়োজন বাড়তি টাকার, এই টাকার যোগান আসবে কোত্থেকে? অজান্তেই একটা দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে আসে মুন্সি মেহেদী হোসেনের বুক থেকে।
সাক্ষরজ্ঞানসম্পন্ন এক স্ত্রী মুকিদুন্নেছা, এক ছেলে মুন্সি আব্দুর রউফ এবং দুই মেয়ে জহুরা ও হাজেরাকে নিয়ে মুন্সি মেহেদী হোসেনের সংসার। অভাব অনটন সংসারে লেগেই আছে কিন্তু কমতি নেই সুখের। প্রতিদিন সকালে মসজিদ থেকে বাড়ি ফিরে মুন্সি মেহেদী হোসেন ছেলে রবকে নিয়ে বৈঠকখানায় বসে যান শ্লেট আর চক নিয়ে। পরম মমতায় ছেলে রবকে শ্লেটে লিখে লিখে চিনিয়ে দেন এক একটি বর্ণমালা। মুন্সী আব্দুর রউফ ওরফে রবের শিক্ষার হাতেখড়ি বাবার কাছেই। কিন্তু লেখাপড়া তাঁর মোটেই ভালো লাগে না। যদিও মেধার কমতি নেই তথাপি সারাদিন টো টো করে ঘুরে বেড়ানোতেই তাঁর আনন্দ। মাঠ ঘাট তাঁর পরিচিত বন্ধু। এই দুরন্ত বালক মুন্সি আব্দুর রউফ ১৯৭১ সালের ৮ এপ্রিল দেশমাতৃকার স্বাধীনতার জন্যে রাঙামাটির মহালছড়ির চিংড়িখাল এলাকায় এক অসম যুদ্ধে অসীম সাহসীকতার সাথে যুদ্ধ করতে করতে শহীদ হয়ে যান। এই অসামান্য অবদানের জন্য তাঁকে ‘বীরশ্রেষ্ঠ’ উপাধিতে ভূষিত করা হয়।
মুন্সি আব্দুর রউফ জন্মেছিলেন ১৯৪৩ সালের মে মাসে। ফরিদপুর জেলার মধুখালি থানার সালামতপুর গ্রামে। বাবার কাছেই তাঁর লেখাপড়ার হাতেখড়ি। মাও ছিলেন সাক্ষরজ্ঞানসম্পন্ন। বাবা তাঁকে ডাকতেন রব বলে। অসম্ভব সাহসী ও মেধাবী রউফের লেখাপড়ার প্রতি ঝোঁক ছিলো না মোটেইর অথচ বাবা মায়ের অক্লান্ত চেষ্টা ছিলো তাঁকে পড়াশুনায় মনযোগী করে তুলতে। কিন্তু বইয়ের পাঠ তাঁর ভালো লাগত না। ছোট চাচা মুন্সি মোতালেব হোসেনের সঙ্গই বরং তাঁর অধিক প্রিয় ছিলো। চাচা মুন্সি মোতালেব হোসেন ছিলেন ইস্ট পাকিস্তান রাইফেলসের হাবিলদার। চাচা যখনই বাড়ি ফিরতেন তখনি তিনি তাঁকে শোনাতেন সৈনিকদের সুশৃঙ্খল ও রোমাঞ্চিত জীবনের গল্প। সৈনিকদের লেফট রাইট শব্দ তাঁর কানে মধুর ঝংকার তুলত। তাই বাবার চেষ্টা মায়ের চোখ রাঙানো এড়িয়ে বালক রউফ মধুমতি নদীর তীর ধরে ঘুরে বেড়ায়। দিনে দিনে প্রিয় সন্তানটির এরকম দুরন্তপনা দেখে তাঁদের উদ্বেগের অন্ত নেই। একদিকে আর্থিক অনটন অন্যদিকে ছেলের স্কুলে অমনোযোগিতা দেখে মা মুকিদুন্নেছা একদিন রউফের উপরে রেগে গেলেন। মা একদিন তাঁকে পড়তে বসার জন্য বললেন। কিন্তু ছেলে রউফ পড়তে না বসে গাছের পাখিদের সাথে মিতালিতে ব্যস্ত, এই দেখে মা ছেলেকে দিলেন বকা। ছেলেও অভিমানে ঘর থেকে বের হয়ে দিলেন দৌড়। ছেলে ছুটছে, মা-ও পেছন পেছন ছুটছেন ছেলেকে ধরার জন্য। ছুটতে ছুটতে একেবারে মধুমতি নদীর কিনারে। পাড়ে দাঁড়িয়ে মাকে দৃঢ় স্বরে বললেন, আমাকে ধরতে এলে নদীতে ঝাঁপিয়ে পড়ব কিন্তু। মায়ের রক্ত হিম হয়ে এল। ছেলের এই জেদী রূপ মা এর আগে দেখেননি কখনো। এরপর মা গলার স্বর নরম করে ছেলেকে বুঝিয়ে সুঝিয়ে বাড়ি নিয়ে আসেন। আর কোনদিন তাঁকে তিনি বকাঝকা করেননি। এরপর থেকে ছেলেও অবশ্য কিছুটা মনোযোগী হয়েছিলেন লেখাপড়ার প্রতি।
ভালোই চলছিলো তাঁদের অভাব অনটনের কিন্তু সুখের সংসারটি। এই মৃদু মন্দ ছন্দে চলা সংসারে একদিন হঠাত্ ঝড়ের ঝাপটা এসে আছড়ে পড়ে। মুন্সি আব্দুর রউফের বাবা মুন্সি মেহেদী হোসেন হঠাত্ করে মৃত্যুবরণ করেন। মুন্সি আব্দুর রউফের বয়স তখন খুবই অল্প। মৃত্যু কী বিষয় তখনো সে সম্পর্কে তাঁর কোন ধারণা জন্মেনি। আত্মীয় স্বজন, পাড়া প্রতিবেশিরা যখন কাঁদছিলো তখন তিনি মাকে জিজ্ঞেস করছিলেন, মা, বাবা কি সত্যিই মারা গেছে? মা কী জবাব দেবেন? দীর্ঘ শোকের ছায়ায় ছেলেকে বুকে জড়িয়ে ধরে কেবল তিনি কাঁদছিলেন। বাবার মৃত্যুর পর এক ছেলে আর দুই মেয়ে জহুরা ও হাজেরাকে নিয়ে মা মুকিদুন্নেছা অকূলপাথারে পড়েন। নিত্য অভাবের মধ্য দিয়ে সংসার চালাতে হিমশিম খাচ্ছেন তিনি। বাধ্য হয়ে অন্যের বাড়ির কাঁথা সেলাই, শিকে তৈরি করার কাজ নেন। এমনিভাবে মুকিদুন্নেছা দুঃখের দীর্ঘতম দিনগুলি একটি একটি করে পাড়ি দেন। সাথে থাকে ছেলেমেয়েকে বড় মানুষ করার স্বপ্ন।
বাবার মৃত্যুর পর বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে পরিবর্তন ঘটতে থাকে আব্দুর রউফের জীবনাচারেও। আস্তে আস্তে কমে যেতে থাকে তাঁর দুরন্তপনা। লেখাপড়ার প্রতি মনোযোগ বাড়ে। এর ফলে মেধাবী বলে তাঁর সুনামও হয়। গাঁয়ের প্রাথমিক স্কুল শেষ করার পর ভর্তি হন থানা শহরের হাইস্কুলে। এই সময় প্রায়ই মায়ের দুঃখ কষ্ট দেখে তিনি বিচলিত হয়ে পড়তেন। ভাবতেন কী করে মায়ের কষ্ট লাঘব করা যায়। এতটুকুন ছোট ছেলে কী আর করতে পারেন তিনি? তবে চাচার কাছে শুনেছেন সপ্তম শ্রেণী পাশ করতে পারলে তিনি পাকিস্তান সেনাবাহিনীতে যোগ দিতে পারবেন। অষ্টম পড়া অবস্থায় এল সেই সুযোগ। ১৯৬৩ সালের মে মাসে আব্দুর রউফ যোগ দেন ইস্ট পাকিস্তান রাইফেলস-এ।
সেনাবাহিনীতে যোগ দিয়েও রউফের মন ছিলো বাড়ির দিকে। নিয়মিত মাকে টাকা পাঠাতেন, চিঠি লিখতেন। ছুটি নিয়ে মাঝে মাঝেই বাড়ি চলে আসতেন। রউফের চাকরি হওয়াতে মায়ের কষ্টও অনেকাংশে লাঘব হলো। মায়ের আকাঙ্ক্ষা উজ্জ্বল হলো। সুন্দর এক ভবিষ্যতের স্বপ্ন রচনা করেন তিনি। রউফের বিয়ে দিয়ে সুন্দর এক ফুটফুটে পুত্রবধু ঘরে আনবেন তিনি। তার আগে বিয়ে দিবেন ছোট মেয়ে হাজেরার। মায়ের মনে পড়ে বড় মেয়ের বিয়ের সময় শাড়ি কিনে দিতে পারেননি বলে দুঃখে কেঁদেছিলেন। সেই কৈশোরেই রউফ মাকে সান্ত্বনা দিয়ে বলেছিলেন, ‘দেখো মা আমি বড় হয়ে চাকরি করবো। তখন অনেক শাড়ি কিনে দেব।’ মা-ও ছেলেকে ঘন ঘন পত্র পাঠাতেন। ছেলেকে বাড়ি আসার তাগাদা দিতেন। ১৯৭১ সালে রউফ এক চিঠির উত্তরে মাকে লিখেছিলেন, “এখন একটু কাজের ব্যস্ততা বেড়েছে, তাই আগের মতো ঘন ঘন ছুটি পাই না। তার জন্য তুমি চিন্তা করো না। ছোট বোনের বিয়ে ঠিক করো। আমি নতুন শাড়ি নিয়ে বাড়ি আসবো।” কিন্তু বোনের জন্য নতুন শাড়ি নিয়ে মুন্সি আব্দুর রউফ আর কোনদিনই বাড়ি ফিরে আসেননি।
তখন ১৯৭১ সাল। বাংলাদেশের রাজনীতিতে আসছে এক যুগান্তকারী পরিবর্তন। পশ্চিম পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠীর অত্যাচার আর নিপীড়নের বিরুদ্ধে স্বাধীনতার দাবীতে গর্জে ওঠেছে সমগ্র বাঙালী। আর বাঙালীর এই নায্য চাওয়াকে দমিয়ে রাখার জন্য শুরু হচ্ছে পাকিস্তানী শাসকগোষ্ঠী ও পাকিস্তানী সেনাবাহিনীর ষড়যন্ত্রের নতুন অধ্যায়। পাশাপাশি সতর্ক ইপিআর ও সেনাবাহিনীর বাঙালী সদস্যরাও। যেকোনো পরিস্থিতির মোকাবিলায় তাঁরাও সদা প্রস্তুত। ফলে বাড়ি যাওয়া কমে গেছে মুন্সি আব্দুর রউফের।
১৯৭১ সালের ২৫ মার্চের আগে মুন্সি আব্দুর রউফ চট্টগ্রামে ১১ উইং-এ চাকরিরত ছিলেন। তিনি ছিলেন মাঝারি মেশিনগান ডিপার্টমেন্টের ১ নং মেশিনগান চালক। মুক্তিযুদ্ধ শুরু হলে তিনি অষ্টম ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের সঙ্গে যুক্ত হন। তখন সবে যুদ্ধের প্রস্তুতিপর্ব। মাঝে মাঝে গড়ে তোলা হচ্ছে ছোটখাটো প্রতিরোধ। পার্বত্য চট্টগ্রামের রাঙামাটি-মহালছড়ি জলপথ। শান্ত হ্রদের পাশে আকাশ ছুঁয়ে থাকা মাথা উঁচু মৌন পাহাড়ের সারি। এমন নির্জন পরিবেশের জলপথ দিয়ে পাকিস্তানী সশস্ত্র বাহিনীর চলাচলে প্রতিরোধের দায়িত্ব পড়ল অষ্টম ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের কোম্পানির উপর। কোম্পানিটি বুড়িঘাট এলাকার চিংড়িখালের দুই পাড়ে অবস্থান নিয়ে গড়ে তুললো প্রতিরক্ষা ঘাঁটি। ল্যান্স নায়েক মুন্সি আব্দুর রউফ ছিলেন সেই কোম্পানিরই একজন মুক্তিযোদ্ধা।
সেদিন, ৮ এপ্রিল ১৯৭১। গনগনে মধ্যদুপুরের এক বিশেষ মুহূর্ত। সূর্য মাথার উপর থেকে পশ্চিম দিকে হেলে পড়ার জন্য বিশেষ প্রস্তুতি নিচ্ছে। নীরব-নির্জন হ্রদের বুক চিরে শান্ত পানিতে অস্থির ঢেউ তুলে এগিয়ে আসতে লাগলো সাতটি স্পিডবোট এবং দুটো লঞ্চ। এগুলোর মধ্যে রয়েছে পাকিস্তানী হানাদার বাহিনীর দুই কোম্পানি সৈন্য। তাদের সঙ্গে স্বয়ংক্রিয় এবং ভারী অস্ত্রশস্ত্র। এটি পাকিস্তান সেনাবাহিনীর দ্বিতীয় কমান্ডো ব্যাটেলিয়নের কোম্পানি। লক্ষ্য বুড়িঘাটের মুক্তিবাহিনীর নতুন প্রতিরক্ষা ঘাঁটি।
লক্ষ্যের দিকে তীব্রগতিতে ছুটে আসছে দুটি স্পিড বোট এবং দুটি লঞ্চ। এগুলোতে রয়েছে ছয়টি তিন ইঞ্চি মর্টার আর অনেক মেশিনগান ও অনেক রাইফেল। অন্যদিকে এই জলপথ পাহারা দিচ্ছে ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের যে কোম্পানিটি, সেই কোম্পানিটি মাত্র কয়েকদিন আগে পাকিস্তান বাহিনী ত্যাগ করে আসা।
মুক্তিযোদ্ধাদের প্রতিরক্ষা ঘাঁটির কাছাকাছি পৌঁছেই পাকিস্তান বাহিনী শুরু করল আক্রমণ। স্পিড বোট থেকে ক্রমাগত চালাতে লাগল মেশিনগানের গুলি আর লঞ্চ দুটো থেকে ছুটে আসছে অবিরাম তিন ইঞ্চি মর্টারের শেল। মুক্তিযোদ্ধাদের দিকে ঝাঁকে ঝাঁকে আসতে লাগল গুলির পর গুলি। গোলাগুলির প্রচণ্ড শব্দে আকাশ বাতাস কেঁপে উঠল। পানির ভেতর অদ্ভূত আলোড়ন উঠল। শব্দগুলো পাহাড়ের গায়ে গায়ে বাড়ি খেয়ে এক মহাধ্বণিযজ্ঞের সূচনা করল। শীতল সবুজে হঠাত্ যেন লেগে গেল শব্দের আগুন। পাকিস্তানী বাহিনীর একটাই উদ্দেশ্য, রাঙামাটি-মহালছড়ির জলপথ থেকে মুক্তিযোদ্ধাদের পিছু হটিয়ে নিজেদের অবস্থান প্রতিষ্ঠা। আক্রমণের আশংকা মুক্তিযোদ্ধাদের মনে আগেই ছিল। তাঁদের লোকবল, অস্ত্রশস্ত্র নেই বললেই চলে। কিন্তু মনের ভেতর দেশের জন্য জমানো আছে অসীম সাহস, তেজ ও দৃপ্ত অঙ্গীকার। দৃঢ় প্রত্যয় বুকে নিয়ে তাঁরা ঝাপিয়ে পড়েছিল দেশকে বর্বরদের হাত থেকে মুক্ত করার জন্য। মুক্তিযোদ্ধারা খুব দ্রুতই পজিশন নিয়ে নিল পরিখায়। কিন্তু শত্রুপক্ষের গোলাগুলির তীব্রতা এত বেশি ছিলো যে, ভেঙে যেতে লাগল প্রতিরোধ ব্যবস্থা। শত্রুদের মর্টার চিহ্নিত করে ফেলল মুক্তিযোদ্ধাদের সঠিক অবস্থান। আর তাই তীব্র গুলিবর্ষণে ভেঙে পড়ল প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা।
যুদ্ধের এই পর্যায়ে প্রতিরক্ষা ঘাঁটির কমান্ডার মুন্সি আব্দুর রউফ দেখলেন যে, এভাবে কিছুক্ষণ চলতে থাকলে ঘাঁটির সকলেই মারা পড়বেন। তিনি তখন কৌশলগত কারণেই পশ্চাদপসারণের সিদ্ধান্ত নিলেন। এই সিদ্ধান্তের কথা সৈন্যদের জানানো মাত্র সৈন্যরা যে যেভাবে পারে পিছু হটতে লাগল। মুন্সি আব্দুর রউফ দেখলেন, শত্রু এগিয়ে এসেছে খুব কাছে আর এভাবে সকলে একযোগে পিছু হটতে চাইলে একযোগে সকলেই মারা পড়বে। কাভার দেওয়ার জন্যে কাউকে না কাউকে পিছনে দাঁড়িয়ে থাকতে হবে। যেই ভাবা সেই কাজ। তিনি পিছু হটলেন না। কাভার দেওয়ার জন্য নিজ পরিখায় দাঁড়িয়ে গেলেন মুন্সি আব্দুর রউফ স্বয়ং। অসম্ভব সাহসে, দৃঢ়চিত্তে মেশিনগানটি উঁচুতে তুলে ফেললেন। অনবরত গুলি করতে লাগলেন পাকিস্তানী স্পিড বোটগুলোকে লক্ষ্য করে। প্রচণ্ড সাহসের সঙ্গেই তিনি কাজে লাগালেন পাকিস্তান রাইফেলসে কাজ করার অভিজ্ঞতা। ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টে তিনি যোগই দিয়েছেন দেশকে হানাদার মুক্ত করার লক্ষ্যে। পাকিস্তানী হানাদারদের তিনি পথ ছেড়ে দিতে রাজি নন। শত্রু সেনাদের বিরুদ্ধে একাই লড়তে লাগলেন এই অকুতোভয় বীর।
ল্যান্স নায়েক আব্দুর রউফ এক একটা স্পিড বোটকে লক্ষ্য স্থির করে মেশিনগান দিয়ে অবিরাম গুলিবর্ষণ করতে থাকেন। তাঁর প্রচণ্ড গুলি-বৃষ্টিতে থমকে গেল শত্রুরা। তারা প্রত্যাশাও করেনি এমন পাল্টা আক্রমণ হতে পারে। রউফের গুলি খেয়ে একের পর এক শত্রুসেনা লুটিয়ে পড়তে লাগল। একটি একটি করে সাতটি স্পিড বোটই ডুবে গেল। এমন পর্যায়ে শত্রু সেনারা তাদের দুটি লঞ্চ নিয়ে পিছু হটতে বাধ্য হলো। পিছু হটতে হটতে দুটো লঞ্চই চলে গেল রউফের মেশিনগানের গুলির আওতার বাইরে নিরাপদ দুরত্বে। হানাদার বাহিনী এবার তাদের লঞ্চ থেকে শুরু করল মর্টারের গোলা বর্ষণ। তারা লক্ষ্য স্থির করল, যেভাবেই হোক থামিয়ে দিতে হবে মুক্তিবাহিনীর মেশিনগানটাকে।
একের পর এক ক্রমাগত মর্টারের গোলার বিরুদ্ধে যুদ্ধ করা রউফের একার পক্ষে সম্ভব ছিলো না। শত্রুর একটি মর্টারের গোলা হঠাত্ এসে পড়ে তার বাঙ্কারে। মৃত্যুশেলে ঝাঁঝড়া হয়ে যায় তাঁর সমস্ত শরীর। থেমে গেলেন তিনি। হাত থেকে পাশে ছিটকে পড়ল মেশিনগান। ততক্ষণে তাঁর সহযোগী যোদ্ধারা সবাই পৌঁছে যেতে পেরেছে নিরাপদ দুরত্বে। প্রকৃত বন্ধুর মতো একটি মাত্র মেশিনগান দিয়ে একই সঙ্গে শত্রুদের ঘায়েল করলেন এবং সহযোদ্ধাদের রক্ষা করলেন।
তিনি বাংলার শোণিতাক্ত সূর্যের সঙ্গে মিশে গেলেন। মায়ের বুক খালি হলো, বোনের জন্য বিয়ের শাড়ি নেওয়া হলো না, অথচ নিজের বুকের আলো দিয়ে উজ্জ্বল করলেন তিনি স্বাধীনতার পথ। হয়ে গেলেন অমর, বীর, শহীদ, বীরশ্রেষ্ঠ।
১৬ ডিসেম্বর ১৯৭১। দেশ স্বাধীন হলো। অনেকেই যুদ্ধ শেষে ঘরে ফিরে এলেন। মুকিদুন্নেছার একমাত্র ছেলে বীরশ্রেষ্ঠ আব্দুর রউফ ঘরে ফিরলেন না। ছেলে হারানোতে তাঁর কোন কষ্ট নেই। বরং গর্ব করে বলেন, ‘শেয়াল-কুকুরের মতো পালিয়ে না মরে দেশের জন্যে, মানুষের জন্যে বীরের মতো লড়াই করে মৃত্যুবরণ করেছে আমার ছেলে।’ ল্যান্স নায়েক মুন্সি আব্দুর রউফের জন্মস্থান ফরিদপুরের সালামতপুর গ্রামের নাম পরিবর্তন করে রাখা হয়েছে রউফনগর। এ গ্রামেই ১৭ নভেম্বর ২০০৭ ইং তারিখে স্থাপন করা হয়েছে বীরশ্রেষ্ঠ মুন্সি আব্দুর রউফ গ্রন্থাগার ও স্মৃতি জাদুঘর প্রকল্পের ভিত্তিপ্রস্তর। বীরশ্রেষ্ঠর পরিবারের দেওয়া ৫২ শতাংশ এবং বীরশ্রেষ্ঠ মুন্সি আব্দুর রউফ স্মৃতি পরিষদের মাধ্যমে এলাকাবাসীর দেওয়া ৪৮ শতাংশ, মোট এক একর জায়গায় ওপর এই গ্রন্থাগার ও জাদুঘর।
চির রুদ্রের প্রতীক এই বীরকে সমাহিত করা হয়েছিলো রাঙামাটি শহরের রিজার্ভ বাজারে কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারের পাশে। ১৯৯৬ সালে রাঙামাটিবাসী প্রথম জানতে পারে, এ চিরসবুজ পাহাড়ের মাঝেই ঘুমিয়ে আছেন বীরশ্রেষ্ঠ মুন্সি আব্দুর রউফ। ঐ সময় দয়ালন চন্দ্র চাকমা নামে এক আদিবাসী বীরশ্রেষ্ঠ মুন্সি আব্দুর রউফের সমাধিস্থল শনাক্ত করেন। শনাক্ত করার পর তাঁর সমাধিস্থলটি সরকার নতুনভাবে সংরক্ষণের ব্যবস্থা নিয়েছে।
সংক্ষিপ্ত জীবনী :
নাম : মুন্সি আব্দুর রউফ
জন্ম : ১ মে, ১৯৪৩।
জন্মস্থান : ফরিদপুর জেলার মধুখালী থানার সালামতপুর গ্রামে।
পিতা : মুন্সি মেহেদী হোসেন।
মা : মোছাঃ মুকিদুন্নেছা।
কর্মস্থল : ইস্ট পাকিস্তান রাইফেলস।
যোগদান : ৮ মে ১৯৬৩ সাল।
পদবী : ল্যান্স নায়েক।
মুক্তিযুদ্ধে অংশরত সেক্টর : ১ নং সেক্টর।
মৃত্যু : ২০ এপ্রিল, ১৯৭১ সাল।
সমাধি স্থল : রাঙামাটি শহরের রিজার্ভ বাজারে কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারের পাশে।
সূত্র : উইকিপিডিয়া, বাংলাপিডিয়া
বীরশ্রেষ্ঠ; রচনা: চন্দন চৌধুরী।
লেখক : এহসান হাবীব