বরিশাল জেলার বাবুগঞ্জ থানার আগরপুর ইউনিয়নের রহিমগঞ্জ গ্রামের গোড়াপত্তন করেন আব্দুর রহিম। তিনি এই গ্রামেরই একজন প্রভাবশালী এবং সম্মানিত ব্যক্তি। তাঁর নামানুসারেই এই গ্রামের নাম রাখা হয়েছে রহিমগঞ্জ। তখন ইংরেজ আমল। পাকিস্তান আমল গত হয়ে যাওয়ার পর স্বাধীন বাংলাদেশ আমলে এই রহিমগঞ্জ যে ইউনিয়নের অন্তর্ভুক্ত সেই ইউনিয়নের নামও পরিবর্তন হয়ে যায়। এবার নাম পরিবর্তন হয় আব্দুর রহিম হাওলাদারের পৌত্র মহিউদ্দিন জাহাঙ্গীরের নামে। এই পরিবার শুধু বাংলাদেশের একটি গ্রাম বা ইউনিয়নের নামই পরিবর্তন করেনি বরং এই পরিবারের এক সদস্য মহিউদ্দিন জাহাঙ্গীরের কল্যাণে একটি দেশের নাম, আয়তন এবং জাতিসত্ত্বারও পরিবর্তন হয়ে গিয়েছিল। আর সে দেশটির নাম বাংলাদেশ। অবশ্য তার পেছনে রয়েছে রক্তে ভেজা একটি করুণ অধ্যায়। সে অধ্যায়টি রচনা করেছিলেন আব্দুল মোতালেব হাওলাদারের সন্তান ক্যাপ্টেন মহিউদ্দিন জাহাঙ্গীর।
১৯৭১ সালের ১৪ ডিসেম্বর চাঁপাইনবাগঞ্জ ঘাঁটি পাকিস্তানি হানাদারদের দখল থেকে মুক্ত করতে গিয়ে এক সম্মুখ সমরে শহীদ হন ক্যাপ্টেন মহিউদ্দিন জাহাঙ্গীর। মুক্তিযুদ্ধে এই অসামান্য বীরত্বের জন্য তাঁকে ‘বীরশ্রেষ্ঠ’ উপাধিতে ভূষিত করা হয়। মহিউদ্দিন জাহাঙ্গীরের জন্ম ১৯৪৯ সালে বরিশাল জেলার বাবুগঞ্জ থানার আগরপুর ইউনিয়নের রহিমগঞ্জ গ্রামে। তাঁর পিতা আবদুল মোতালেব হাওলাদার। তাঁর দাদা আবদুর রহিম হাওলাদার একজন প্রতাপশালী ও সম্মানী ব্যক্তি ছিলেন। তাঁরই নামানুসারে গ্রামের নাম রাখা হয় রহিমগঞ্জ। মহিউদ্দিনের বাবা ছিলেন মায়ের এক আদুরে সন্তান। অতি আদরের কারণে লেখাপড়াটা আর বেশিদূর এগোয়নি। মাইনর পাসের পরই থেমে যায়। গান-বাজনার প্রতি তাঁর ছিল বিশেষ মোহ। বাপ-দাদার আমলে তৈরি পাকা দালানেই চিরকাল কাটিয়ে দিয়েছেন। সম্পত্তির ওপর তাঁর কোনোরূপ মোহ ছিল না। মায়ের আদুরে ছেলেকে মা-ই ছোটবেলায় বিবাহ করিয়ে দিয়েছিলেন। জন্ম নিলেন মহিউদ্দিনরা তিন ভাই, তিন বোন। সংসারে ছেলেমেয়ে এলেও মোতালেব হাওলাদার চোখ ফেরালেন না, তিনি রইলেন তাঁর গান-বাজনা নিয়ে।
এই মোতালেব হাওলাদারের সন্তান মহিউদ্দিন জাহাঙ্গীর ছাত্র হিসেবে ছিলেন বেশ মেধাবী। পাস করেন আই.এস.সি.। কথা খুবই কম বলতেন আর পরোপকারী হওয়ার কারণে এলাকায় বেশ পরিচিতিও ছিল। খেলাধুলাও করতেন ভালো। পাশাপাশি ছিলেন রাজনীতি সচেতন। কলেজ জীবনেই তিনি পাঠ করেন লেনিন, মাও-সেতুং, চে গুয়েভারা। জাহাঙ্গীর আই.এস.সি. পাস করেন ১৯৬৬ সালে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যয়নরত অবস্থায়ই পনেরো বছর বয়সে তিনি যোগ দেন পাকিস্তান সামরিক একাডেমিতে ক্যাডেট হিসেবে। ১৯৬৮ সালের জুন মাসে তিনি লাভ করেন ইঞ্জিনিয়ার্স কোরে কমিশন্ড অফিসারের র্যাঙ্ক। ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধ শুরু হওয়ার সময়ে তিনি পশ্চিম পাকিস্তানের কাবাকোরাম এলাকায় ১৭৩ ইঞ্জিনিয়ার ব্যাটালিয়নে বহাল ছিলেন।
সেই সময় পাকিস্তানী হানাদাররা বাঙালীদের পাখির মতো মারছে। ক্যাপ্টেন মহিউদ্দিন জাহাঙ্গীর পশ্চিম পাকিস্তানে বসে সেগুলো শুনছিলেন আর কীভাবে দেশে আসা যায় ভাবছিলেন। তাঁর নিদ্রা পালিয়েছিল চোখ থেকে। পশ্চিম পাকিস্তানে আটকেপড়া তাঁর অন্যান্য বন্ধুও খুঁজছিলেন পালানোর উপায়। অন্যান্য বাঙালী তরুণ অফিসারও পালানোর পথ খুঁজছেন। ৩ জুলাই ১৯৭১। ক্যাপ্টেন মহিউদ্দিন জাহাঙ্গীর, ক্যাপ্টেন সালাহউদ্দিন মমতাজ, ক্যাপ্টেন শাহরিয়ার রশিদ খান, ক্যাপ্টেন আব্দুল আজিজ পাশা এবং ক্যাপ্টেন আনাম শিয়ালকোটের কাছে সীমান্ত পেরিয়ে পালাতে সক্ষম হন। জাহাঙ্গীর এর আগে এদের কাউকেই চিনতেন না। তাঁর বন্ধু ক্যাপ্টেন হামিদের সহায়তায় এদের সঙ্গে যোগাযোগের সূত্র হয়। সে সময় তাঁরা সবাই ক্যাপ্টেন ছিলেন।
শিয়ালকোট থেকে ২০-২৫ মাইল দূরবর্তী মুনাওয়ার তাবী নদীর ওপরে মারালা হেডওয়ার্ক ড্যাম। পরিকল্পনা অনুযায়ী তাঁরা ঐ ড্যাম পেরিয়ে পালানোর চিন্তা করলেন। সেখানে একটা মাজার ছিল। আগের দিন তাঁরা শিয়ালকোটে এসে একটা হোটেলে উঠেছিলেন। কিনে রেখেছেন কালচে ছাইরঙা সালোয়ার-কামিজ, মিলিশিয়াদের পোশাক। ৩ জুলাই একটি ট্যাক্সি যোগে রওনা দিলেন মাজার জিয়ারত করতে। মাজারটা একটি টিলার ওপর অবস্থিত। টিলার নিচ থেকে ছেড়ে দিলেন ট্যাক্সি, ভাংতি নেই বলে ইচ্ছে করেই ট্যাক্সিওয়ালাকে দিয়ে দিলেন একশো টাকার একটা নোট। কেউ যেন সন্দেহ করতে না পারে এ কারণেই টাকাটা দেয়া। ড্রাইভার ট্যাক্সি নিয়ে চলে যাওয়ায় তাঁরা আর টিলার ওপর উঠলেন না। নিচেই মাগরিবের নামাজ পড়ে অন্ধকার গাঢ় হবার জন্য অপেক্ষা করতে লাগলেন। তারপর শার্ট-প্যান্ট খুলে পরে নিলেন মিলিশিয়াদের পোশাক। সকলেই কোমরে রাখলেন একটা করে পিস্তল, সালাহউদ্দিন হাতে নিলেন ছোট্ট একটা কোরান শরীফ।
শিয়ালকোটে দু-তিন দিন ধরেই প্রচণ্ড বৃষ্টিপাত হচ্ছিল। বৃষ্টির পানিতে কোথাও হাঁটুপানি, কোথাও কোমরপানি, গলা পানি। তার মধ্যে আবার ঘুটঘুটে অন্ধকার। এভাবে হাঁটতে হাঁটতে একসময় চলে এলেন পাকিস্তানের রেঞ্জারদের এক ক্যাম্পের সামনে। তারা উটে চড়ে টহল দিচ্ছিল। মহিউদ্দিনরা তখন পানির নিচে কোনোরকমে নাকটাকে উপরে দিয়ে শ্বাস-প্রশ্বাস নিয়ে লুকিয়ে রইলেন। রাত ১টার দিকে পৌঁছলেন মুনাওয়ার নদীর ধারে। নদীটা কোনোরকমে পার হতে পারলেই ভারত। কিন্তু নদীর স্রোত দেখে তাঁরা ভড়কে গেলেন। নিজেরা ভালো সাঁতারু হওয়া সত্ত্বেও এমন তীব্র ধারালো স্রোতের বিরুদ্ধে সাঁতার কাটা একেবারেই অসম্ভব মনে হলো তাঁদের কাছে। কিন্তু পার তো হতেই হবে। নিজেদের মধ্যে পরামর্শ করে চলে গেলেন নদীর পাড় ধরে দু’তিন মাইল উজানে। যেখানে নদী সরু পাওয়া যাবে সেখানেই পাড়ি দেবেন।
এক জায়গায় গিয়ে তাঁরা নামলেন নদীতে। নদীর প্রচণ্ড স্রোতে তাঁরা উল্টোপাল্টি পর্যন্ত খেয়ে গেলেন। শেষ পর্যন্ত পা রাখতে পারলেন ভারতের মাটিতে। প্রথমেই গেলেন নিকটবর্তী বিএসএফের ব্যাটালিয়ান হেড কোয়ার্টারে। সেখান থেকে দিল্লি, অতঃপর কলকাতা। পশ্চিম পাকিস্তান থেকে চারজন বাঙালী সামরিক অফিসার পালিয়ে এসেছেন শুনে বাঙালী, মুক্তিবাহিনী ও বাঙালী শরণার্থীদের প্রাণে বিপুল উত্সাহ জাগল। মুক্তিযুদ্ধের চিফ কমান্ডার কর্নেল ওসমানী যুদ্ধক্ষেত্র থেকে কলকাতায় এলেন এই পাঁচ বীরকে অভ্যর্থনা দেয়ার জন্য।
কলকাতা থেকেই পাঁচ ক্যাপ্টেনের বিচ্ছিন্নতা। মহিউদ্দিন জাহাঙ্গীর ৭নং সেক্টরে, যোগ দিলেন মেহেদীপুরে মুক্তিবাহিনীর ক্যাম্পে। ক্যাপ্টেন আনাম ৪নং সেক্টরে, সিলেট রণাঙ্গনে। মেহেদীপুরের অদূরেই বয়ে চলেছে মহানন্দা নদী। মেহেদীপুর ক্যাম্পের দায়িত্ব পেয়েছেন ক্যাপ্টেন মহিউদ্দিন জাহাঙ্গীর। বয়স মোটে তেইশ। তারুণ্যে টগবগ করে ফুটছেন তিনি। দৃঢ় প্রত্যয়ের এক অসম্ভব লড়াকু মানুষ। পরিধানে লুঙ্গি, গায়ে গেঞ্জি, মাথায় লাল গামছা, পায়ে ক্যানভাসের জুতো। এই তরুণ সেক্টর কমান্ডারকে দেখে মেহেদীপুর মুক্তিবাহিনীর যোদ্ধারা প্রথমে আঁচ করতে পারেনি কতটা ইস্পাতকঠিন তাঁর মন, কতটা বলিষ্ঠ তাঁর স্বভাব। তাঁর কঠোর নিয়মানুবর্তিতা, কর্তব্যপরায়ণতা এবং ক্লান্তিহীন অধ্যবসায় তাঁর অল্প বয়স আর বাচ্চা বাচ্চা চেহারাটাকে অতিক্রম করে পরিণত করেছে এক প্রবল ব্যক্তিত্বে। তাঁর নামে সবাই এক ডাকে দাঁড়িয়ে যায়।
৭নং সেক্টরের কমান্ডার লে. কর্নেল নূরুজ্জামানের সঙ্গে ক্যাপ্টেন জাহাঙ্গীর যখন ভারতীয় জেনারেলদের সঙ্গে মিটিংয়ে যেতেন তখনও তাঁর পরিধানে লুঙ্গি, গেঞ্জি, গামছাই থাকত। কিন্তু তাঁর পরিকল্পনা, বুদ্ধি-যুক্তির জন্য সবাই তাঁকে সমীহ করত। ভারতীয় জেনারেলসহ সকলেরই তাঁর সম্পর্কে ধারণা ছিল উচ্চ।
ক্যাপ্টেন জাহাঙ্গীরের অধীনে কিছু ছোট ছোট সাব-সেক্টর ছিল। সেগুলোর কার্যকলাপের সমন্বয় সাধন করাও তাঁর দায়িত্বের মধ্যে ছিল। বিভিন্ন বয়সের, বিভিন্ন পেশার লোকজনের সমন্বয়ে গড়া মুক্তিবাহিনীর পরিচালনা খুব একটা সহজ ছিল না। এগুলোকে খুব সহজ-সুন্দরভাবে পরিচালনা করতে তাঁর জুড়ি ছিল না। তিনি তাঁর অধীনের সকলকে সাধারণ জীবনযাপনের শিক্ষাটা দিতেন খুব কঠোরভাবেই। রেডিওতে গান শোনা তিনি মোটেও পছন্দ করতেন না। তাঁর কথা ছিল সারা বাংলাদেশ যখন জ্বলছে তখন গান নয়, খবরের পর মুক্তিবাহিনীর যোদ্ধাদের রেডিও শোনার আর কোনো প্রয়োজন থাকতে পারে না। কারণ তিনি নিজ চোখে দেখেছেন ২৫ মার্চের পর পশ্চিম পাকিস্তানে বাঙালী মেয়েদের বিক্রির দৃশ্য। পাকিস্তানীরা বাঙালী মেয়েদের বিক্রি করছে। এ দেশে করছে মা-বোনদের নির্যাতন- এসবে যথেষ্ট ক্ষুব্ধ ছিলেন তিনি। তাই তিনি মনে করতেন আগে মুক্তি, তারপর গান।
যুদ্ধ, অ্যাকশন, অপারেশন ব্যতীত কিছুই জানতেন না মহিউদ্দিন জাহাঙ্গীর। তাঁর ধ্যান-জ্ঞানে ছিল যুদ্ধের ধ্যান, শত্রু হননের ধ্যান, দেশের মাটিকে মুক্ত করার ধ্যান। তাঁর অধীনে অনেক অ্যাকশন গ্রুপ থাকত, যাঁরা ব্রিজ উড়াত, রেললাইন ভাঙত, থানা দখল করত। জাহাঙ্গীর নিজেই সবসময় অ্যাকশন অপারেশনের পরিকল্পনা করতেন। নিজেই থাকতেন অ্যাকশনে সবার আগে। তাই প্রতিটি অ্যাকশন গ্রুপই চাইত জাহাঙ্গীর যেন তাঁদের দলে থাকেন।
৩ ডিসেম্বর ১৯৭১। বাংলাদেশ জুড়ে সব ফ্রন্টে দখলদার বাহিনীর বিরুদ্ধে শুরু হলো চূড়ান্ত লড়াই। মেহেদীপুর ক্যাম্পেও প্রস্তুতি শুরু হলো। এরই মধ্যে কোথাও কোথাও হানা দিয়েছে মুক্তিযোদ্ধারা। যেন পরীক্ষা করে নিয়েছে নিজেদের শক্তি। এখন প্রস্তুতি শুরু চূড়ান্ত লড়াইয়ের। মহানন্দা নদীর অপর পারে চাঁপাইনবাবগঞ্জ শহর। সেখানে শক্ত ঘাঁটি গেড়ে আছে পাকিস্তানী হানাদাররা। সে ঘাঁটি আগলাতেই নদীর তীর ঘেঁষে তারা তৈরি করে রেখেছে প্রতিরক্ষা দুর্গ। জনশূন্য চারদিকে। ঝোপঝাড়, গাছপালায় ভরা এই প্রতিরক্ষা দুর্গ। সেখানে তাদের হটানোর দায়িত্ব অর্পিত হয়েছে ক্যাপ্টেন মহিউদ্দিন জাহাঙ্গীরের উপর।
১৯৭১ সালের ১০ ডিসেম্বর। লেফটেন্যান্ট কাইয়ুম, লেফটেন্যান্ট আউয়ালসহ ৫০ জন মুক্তিযোদ্ধা নিয়ে একটি আক্রমণের উদ্যোগ নিলেন ক্যাপ্টেন মহিউদ্দিন জাহাঙ্গীর। বেশ কয়েকটা নৌকায় তাঁরা উজানে পাড়ি জমালেন। ভোররাত। চাঁপাইনবাবগঞ্জের পশ্চিমে বারঘরিয়া। সেখানে অবস্থান নিয়ে পরিকল্পনা করা হলো হানাদার বাহিনীকে মিত্রবাহিনী দিয়ে গোলাবর্ষণ করে বিভ্রান্ত করে দেয়ার। এই অপ্রস্তুত অবস্থাতে আক্রমণ চালাবে মুক্তিবাহিনী। কিন্তু মিত্রবাহিনী গোলাবর্ষণ না করার ফলে মুক্তিবাহিনী নতুন কৌশল পরিকল্পনা করল।
১৪ ডিসেম্বর ১৯৭১। ভোররাত। চাঁপাইনবাবগঞ্জকে দখল করার জন্য শুরু হলো চূড়ান্ত অপারেশন। ক্যাপ্টেন মহিউদ্দিন জাহাঙ্গীর জানতেন এটি খুব ঝুঁকিপূর্ণ অভিযান, জানতেন সহকর্মীরাও। তাই তিনি সহকর্মীদের জিজ্ঞেস করলেন এই অভিযানে কারা তাঁকে সঙ্গ দিবেন। সিদ্ধান্ত নেয়ার স্বাধীনতা তিনি সঙ্গীদের দিয়েছিলেন। মাত্র ২০ জন তাঁর ডাকে সাড়া দিলেন। ২০ জন মুক্তিযোদ্ধা নিয়ে তিনি রওনা দিলেন। শীতের শেষ রাত। প্রচণ্ড শীতে হাত-মুখ জমে যাচ্ছে। রেহাইচর এলাকা দিয়ে তাঁরা মহানন্দা নদী পায়ে হেঁটে পাড়ি দিলেন। উত্তর দিক দিয়ে আক্রমণের সূচনা করা হলো। অতর্কিত হামলা করে বেয়নেটের মাধ্যমে খতম করতে করতে তাঁরা এগোতে লাগলেন দক্ষিণ দিকে। ক্যাপ্টেন জাহাঙ্গীর এমনভাবে আক্রমণের পরিকল্পনা করেছিলেন যাতে উত্তর থেকে শত্রু নিধন করার সময় শত্রু দক্ষিণ দিক থেকে গুলি করতে না পারে। সম্মুখ ও হাতাহাতি যুদ্ধ ক্রমেই তীব্র আকার ধারণ করতে থাকে। আর মাত্র কয়েকটা বাঙ্কারের পাকসেনা বাকি। তখনই দেখা দিল সমস্যা। পাকিস্তান সিভিল আর্মড ফোর্সের কয়েকজন সৈন্য বাঁধের ওপর ছিল তারা ব্যাপারটা টের পেয়ে গেল। তারা যোগ দিল পাকিস্তানী বাহিনীর সঙ্গে। এরপরই পাকিস্তানী বাহিনী শুরু করে দিল গুলিবর্ষণ। কিন্তু জাহাঙ্গীর পিছু হটতে নারাজ। তিনি ভয়ে ভীত নন। তিনি সবাইকে নির্দেশ দিলেন এগিয়ে যাওয়ার জন্য। পাশাপাশি তিনি নিজেও এগিয়ে যেতে লাগলেন সামনের দিকে। তিনি হয়ে উঠলেন অদম্য দুঃসাহসী।
হঠাত্ একটা গুলি এসে পড়ল সরাসরি ক্যাপ্টেন মহিউদ্দিন জাহাঙ্গীরের কপালে। মাটিতে লুটিয়ে পড়লেন এই অসম সাহসী যোদ্ধা। হানাদারদের বেপোরোয়া গুলি বর্ষণের সামনে টিকতে পারলেন না তাঁর বাকি সহযোদ্ধারাও। তাঁরা পিছু হটলেন, নদীতে দিলেন ঝাঁপ। ডুব-সাঁতার দিয়ে চলে গেলেন নিরাপদ দূরত্বে। প্রচণ্ড শীতে তাঁরা নদী পাড়ি দিয়ে মৃতপ্রায় অবস্থায় হাজির হলেন মেহেদীপুর মুক্তিবাহিনীর ক্যাম্পে। শোকের মাতম উঠল চারদিকে। দিকে দিকে রটে গেল ক্যাপ্টেন মহিউদ্দিন জাহাঙ্গীরের শহীদ হবার সংবাদ। মুক্তিবাহিনীর সব সদস্য দ্রুত এই শোককে শক্তিতে পরিণত করে প্রতিশোধের জন্য মরিয়া হয়ে উঠলেন। তাঁদের প্রবল আক্রমণের মুখে পিছু হটতে বাধ্য হলো বর্বররা। মুক্ত হলো চাঁপাইনবাবগঞ্জ।
ক্যাপ্টেন জাহাঙ্গীরের রক্তক্ষরা নিষ্প্রাণ দেহ নদীর পাড় থেকে উদ্ধার করে সম্মাননার মধ্য দিয়ে সমাহিত করা হলো গৌড়ের ঐতিহাসিক সোনা মসজিদ প্রাঙ্গণে। আজও ধীরে বহে সেই মহানন্দা তার ঢেউয়ে ঢেউয়ে উচ্চারণ করে যায় বীরশ্রেষ্ঠ মহিউদ্দিন জাহাঙ্গীরের নাম।
বরিশালের নিজ গ্রামের নাম তাঁর দাদার নামে হওয়ায় পরিবার ও গ্রামবাসীর ইচ্ছে অনুসারে তাঁর ইউনিয়নের নাম আগরপুর পরিবর্তন করে মহিউদ্দিন জাহাঙ্গীর ইউনিয়ন করা হয়েছে। ছেলের মৃত্যুর ছত্রিশ বছর পর এই বীরশ্রেষ্ঠর জননী সাফিয়া বেগম বললেন, ‘ছেলে গেছে, রাষ্ট্র পাইছি, বীরশ্রেষ্ঠ জাহাঙ্গীরের মা হইছি- এর চেয়ে গর্বের আর কী থাকতে পারে!’ সরকারী প্রকল্পের মাধ্যমে বরিশাল জেলা পরিষদ ৪৯ লক্ষ টাকা ব্যয়ে বীরশ্রেষ্ঠর পরিবারের দান করা ৪০ শতাংশ জায়গার ওপর নির্মাণ করছে বীরশ্রষ্ঠ মহিউদ্দিন জাহাঙ্গীর স্মৃতি জাদুঘর ও গ্রন্থাগার।
বীরশ্রেষ্ঠ ক্যাপ্টেন মহিউদ্দিন জাহাঙ্গীর দেশপ্রেমের এক প্রকৃত প্রতীক। নিজের জীবন দিয়ে দেশকে ভালোবেসে তিনি দেখিয়ে গেছেন- ভালোবাসলে এভাবেই ভালোবাসতে হয়, জীবনের মূল্য দিয়ে রচনা করতে হয় তাকে। এ কারণেই তিনি বীরশ্রেষ্ঠ. দুরন্ত প্রেমিক। তাই গেঁথে আছে আমাদের স্বাধীনতার আলোয় তাঁর নাম।
সংক্ষিপ্ত জীবনী :
মহিউদ্দিন জাহাঙ্গীর
জন্ম : ১৯৪৯
জন্মস্থান : বরিশাল জেলার বাবুগঞ্জ থানার রহিমগঞ্জ গ্রামে।
পিতা : আব্দুল মোতালেব হাওলাদার।
মা : মোসাম্মাত্ সাফিয়া বেগম।
কর্মস্থল : সেনাবাহিনী।
যোগদান : ১৯৬৭ সাল।
পদবী : ক্যাপ্টেন।
মুক্তিযুদ্ধে অংশরত সেক্টর : ৭নং সেক্টর।
মৃত্যু : ১৪ ডিসেম্বর, ১৯৭১ সাল।
সমাধিস্থল : চাঁপাইনবাবগঞ্জের সোনা মসজিদ প্রাঙ্গণ।
সূত্র : উইকিপিডিয়া, বাংলাপিডিয়া।
বীরশ্রেষ্ঠ, রচনা: চন্দন চৌধুরী।
লেখক : এহসান হাবীব