মোহাম্মদ রুহুল আমিন। সমুদ্র পাড়ের জেলা নোয়াখালীর এক গৃহস্থ পরিবারের সন্তান। পাখির মতো আয়তাকার চোখ ছিল তাঁর। ছিলেন সুঠাম দেহের অধিকারী। ভালোবাসতেন দেশ, দেশের মাটি আর দিগন্তবিস্তারী সমুদ্র। সমুদ্র খুব প্রিয় ছিল তাঁর। তাঁর প্রিয় খেলার মধ্যে ছিল নদীতে ডুব সাঁতার কাটা। নদীতে ডুব সাঁতার খেলতে খেলতেই বড় হন তিনি। পানিতে যখন খেলা করেন তখন তা নিতান্তই স্বাভাবিক মনে হয়। মনে হয় জলের দেবতা বুঝি পানিতে অদ্ভুত আলোড়ন তুলছেন। আর তিনি যখন ডাঙায় উঠে আসেন তখন মনে হয় ভুল করে কোন জলদেবতা ডাঙায় উঠে এসেছেন। এই জলদেবতাই একদিন বাংলাদেশের জন্মলগ্নের এক সন্ধিক্ষণে বাংলার জলপথকে শত্রুমুক্ত করতে গিয়ে অসীম সাহসে ঢেলে দিয়েছিলেন বুকের তাজা রক্ত।
১৯৭১ সালের ১০ ডিসেম্বর খুলনার রূপসা উপজেলার বাগমারা গ্রামে রূপসা নদীতে নৌবাহিনীর জাহাজ পলাশ নিয়ে খুলনার উদ্দেশে রওনা হওয়ার পর ভারতীয় বিমান বাহিনীর সাথে এক ‘ভুল বোঝাবুঝির যুদ্ধে’ গোলার আঘাতে শহীদ হন আর্টিফিসার মোহাম্মদ রুহুল আমিন। যুদ্ধে তাঁর অসামান্য বীরত্বের জন্য তাঁকে ‘বীরশ্রেষ্ঠ’ উপাধিতে ভূষিত করা হয়।
মোহাম্মদ রুহুল আমিন জন্মগ্রহণ করেন ১৯৩৫ সালে নোয়াখালী জেলার বেগমগঞ্জ থানার বাগপাদুরা গ্রামে। রুহুল আমিনের বাবা আজহার পাটোয়ারী। মায়ের নাম জোলেখা খাতুন। তাঁদের পরিবারটি ছিল সচ্ছল গৃহস্থ পরিবার। রুহুল আমিন তাঁদের প্রথম সন্তান। সাত ভাই-বোন, আত্মীয়-স্বজন, পাড়া-প্রতিবেশী সকলের কাছেই তিনি ছিলেন প্রিয়পাত্র। দীর্ঘদেহী, সুঠাম স্বাস্থ্যের অধিকার হওয়ার ফলে অনেকের মধ্য থেকে তাঁকে চেনা যেত।
পড়ালেখার শুরু নিজ গ্রামের প্রাইমারি স্কুলে। হাইস্কুলে পড়তে হয় পার্শবর্তী থানার আমিষাপাড়ায়। প্রথম দিকে তাঁদের সংসারে অভাব-অনটনের ছোঁয়া না লাগলেও ছেলেমেয়ে বড় হতে হতে পরিবারে দেখা দেয় অসচ্ছলতা। তাই হাইস্কুল পাস করার পরই রুহুল আমিনকে জীবিকার সন্ধানে বের হতে হয়।
পরিবারে পিতাকে সাহায্য করার মানসে ১৯৫৩ সালে তিনি যোগ দেন জুনিয়র মেকানিকাল ইঞ্জিনিয়ার হিসেবে তত্কালীন পাকিস্তান নৌবাহিনীতে। চাকরি হবার পরই শুরু হয় প্রশিক্ষণ। প্রথমেই তাঁকে যেতে হয় করাচির অদূরে আরব সাগরের মধ্যে অবস্থিত মনোরা দ্বীপে পিএমএস বাহাদুর-এ। প্রাথমিক প্রশিক্ষণ সমাপ্ত হলে তিনি যোন দেন পিএনএস কারসাজে অর্থাত্ নৌবাহিনীর কারিগরি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে। ১৯৫৮ সালে শেষ হয় তাঁর পেশাগত প্রশিক্ষণ। ১৯৬৫ সালে তিনি নির্বাচিত হন মেকানিশিয়ান কোর্সের জন্য এবং পিএনএস কোর্স সমাপ্তির পর আর্টিফিসার পদে নিযুক্ত হন। ১৯৬৮ সালে তিনি বদলি হন চট্টগ্রাম পিএনএস বখতিয়ার নৌঘাঁটিতে।
১৯৭১ সালের মার্চে পাক হানাদার বাহিনী কর্তৃক সংঘটিত বর্বরতম ঘটনার সময় রুহুল আমিন চট্টগ্রামে কর্মরত ছিলেন। নৌঘাঁটিতে বসে বসে শুনেছেন নির্দয়ভাবে তাঁর স্বজন, পাড়া প্রতিবেশীদের হত্যার খবর। শুনেছেন আর ফুঁসে ওঠেছেন। মনে মনে নিজেকে তৈরি করেছেন প্রতিশোধ নেয়ার জন্য। দেশকে মুক্ত করার সংগ্রামে কিভাবে নিজেকে যুক্ত করা যায় সে পথ খুঁজছেন। কিন্তু নৌঘাঁটিতে বসে তা সম্ভব নয়। সুতরাং সবার আগে এখান থেকে বের হতে হবে। বাঙালী সৈনিকরা তখন পাকিস্তানী সেনাদের চব্বিশ ঘন্টা নজরদারীর মধ্যে। এখান থেকে বের হওয়াও তো চাট্টিখানি কথা নয়। তিনি মনে মনে পালানোর জন্য প্রস্তুতি নিতে থাকেন। এবং একদিন সবার অলক্ষ্যে সকলের চোখকে ফাঁকি দিয়ে বের হয়ে পড়েন নৌঘাঁটি থেকে। পালিয়ে সীমান্ত পার হয়ে তিনি চলে যান ত্রিপুরা। যোগ দেন ২ নং সেক্টরে। মেজর শফিউল্লাহর নেতৃত্বে ২ নং সেক্টরে তিনি সেপ্টেম্বর মাস পর্যন্ত মুক্তিযুদ্ধে সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ করেন এবং স্থলযুদ্ধের বিভিন্ন অপারেশনে যোগ দেন।
১৯৭১ সালের সেপ্টেম্বর মাসে বাংলাদেশ নৌবাহিনী গঠনের উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়। এ উদ্দেশ্যে নৌবাহিনীর সদস্যদের যাঁরা বিভিন্ন সেক্টর ও সাব-সেক্টরে থেকে মুক্তিযুদ্ধ করছিলেন তাঁদেরকে সেপ্টেম্বর মাসে একত্রিত করা হয় আগরতলায় এবং গঠন করা হয় ১০ নং সেক্টর। ইঞ্জিনরুম আর্টিফিসার মোহাম্মদ রুহুল আমিন নৌবাহিনীর সদস্যদের সঙ্গে আগরতলায় একত্রিত হয়ে কলকাতায় আসেন এবং যোগ দেন ১০ নং নৌ সেক্টরে।
ভারত সরকার কলকাতা বন্দরে কর্তব্যরত দুটি টাগ বোট বাংলাদেশ নৌবাহিনী গঠনের জন্য বাংলাদেশ সশস্ত্র বাহিনীকে উপহার দেয়। টাগ বোট দুটিকে কলকাতার গার্ডেন রিচ নৌ-ওয়ার্কশপে আনা হয় এবং প্রতিটি টাগ বোট কানাডীয় ধরনের দুটি বাফার গান লাগিয়ে এবং ব্রিটিশ ধরনের ৫০০ পাউন্ড ওজনের চারটি মার্ক মাইন বহন করার উপযোগী করে গানবোটে রূপান্তরিত করা হয়। একাত্তর সালের ১২ অক্টোবর কলকাতার মেয়র প্রফুল্ল কুমার ঘোষ গার্ডেন রিচ জেটিতে আনুষ্ঠানিকভাবে গানবোট দুটি পানিতে ভাসান। এ গানবোট দুটির নামকরণ করা হয় ‘পদ্মা’ ও ‘পলাশ’। মুক্তিবাহিনীর প্রধান সেনাপতি কর্নেল আতাউল গনি ওসমানীর নির্দেশক্রমে রুহুল আমিন যোগ দেন ‘পলাশ’ গানবোটের আর্টিফিসার পদে।
১৯৭১ সালের ৬ ডিসেম্বর। মুক্তিবাহিনীর বীর যোদ্ধারা অসম বিক্রমে দখল করে নেন যশোর সেনানিবাস। এর পরবর্তী লক্ষ্য হিসেবে ধরা হলো মংলা বন্দরকে হানাদার বাহিনীর কাছ থেকে মুক্ত করা। মংলা বন্দরে পাকিস্তান বাহিনীর দখলকৃত নৌঘাঁটি পিএনএস তিতুমীর দখল তাঁদের পরবর্তী উদ্দেশ্য। মূলত এই উদ্দেশ্যেই ‘পদ্মা’, ‘পলাশ’ এবং মিত্রবাহিনীর গানবোট ‘পানভেল’ হলদিয়া ঘাঁটি থেকে যাত্রা করে বাংলাদেশ অভিমুখে। সুন্দরবনের আড়াই বানকিতে ভারতীয় সীমান্তরক্ষী বাহিনীর পেট্রোলক্রাস্ট ‘চিত্রাঙ্গদা’ ৮ ডিসেম্বর ‘পদ্মা’, ‘পলাশ’ ও ‘পানভেল’-এর সঙ্গে যোগ দেয়। বাংলাদেশী কোনো অভিজ্ঞ উচ্চ পর্যায়ের নৌযোদ্ধা না থাকার কারণে এই নৌ-অভিযানের অফিসার ইন টেকনিক্যাল কমান্ডের দায়িত্ব নেন ভারতীয় ক্যাপ্টেন মনেন্দ্রনাথ সামন্ত।
৯ ডিসেম্বর, রাত। বাধাহীনভাবেই গানবোটগুলো সুন্দরবনের হিরণ পয়েন্টে অবস্থান করে। সেখানে রাতযাপনের পর ১০ ডিসেম্বর ভোর ৪টার দিকে যাত্রা করে মংলা বন্দরের দিকে। কোনোরকম প্রতিরোধ ব্যতীতই তিনটি রণতরী পৌঁছে গেল মংলা বন্দরে। সকাল তখন সাড়ে সাতটা। মংলা বন্দরেই থেকে গেল ভারতীয় সীমান্তরক্ষী পেট্রলক্রাস্ট ‘চিত্রাঙ্গদা’।
শুরু হলো মূল অভিযান। মংলা বন্দর পার হয়ে গানবোটগুলো আরও ভেতরে খুলনার দিকে এগিয়ে যাচ্ছে। একসময় গানবোটগুলো খুলনা শিপইয়ার্ড ছেড়ে পৌঁছায় রূপসা ফেরিঘাটের কাছে। তখন দুপুর ১২টার কাছাকাছি। ঠিক এমনি সময় আকাশের অনেক উঁচুতে দেখা গেল তিনটি জঙ্গি বিমান। পাকিস্তানীদের বিমান অনুমান করে ‘পদ্মা’ ও ‘পলাশ’ থেকে চাওয়া হলো বিমানগুলোকে চ্যালেঞ্জ করে গুলি ছোড়ার অনুমতি। কিন্তু মিত্রবাহিনীর ক্যাপ্টের মনেন্দ্রনাথ সামন্ত জানালেন, বিমানগুলো ভারতীয়র ভারতের পশ্চিম দিনাজপুরের এয়ারফিল্ড থেকে এসেছে এগুলো। সুতরাং উদ্বিগ্ন হবার মতো কোনো কারণ নেই। শুনে সবাই আক্রমণের প্রস্তুতি থেকে বিরত থাকল। কারণ ভারতীয় বিমান বাহিনীকে জানানো হয়েছিল এই এলাকায় যাতে কোনো ভাবেই বোম্বিং না করা হয়। আর তাছাড়া গানবোটগুলোর উপরিভাগ হলুদ রঙেও রাঙানো হয়েছিল এবং মিত্রবাহিনীকে জানানো হয়েছিল হলুদ রং করা গানবোটগুলো আমাদের, অর্থাৎ এই গানবোটগুলোতে আক্রমণ করা যাবে না।
কিন্তু হঠাত্ শুরু হলো পটপরিবর্তন। ভারতীয় বিমানবাহিনীর অতি উত্সাহী কয়েকজন বিমান সেনার খামখেয়ালির কারণে সদ্য গঠিত বাংলাদেশ নৌবাহিনীকে দিতে হয়েছিল বিপুল খেসারত। এক প্রকার অবাক করে দিয়ে বিমানগুলো নীচে নেমে এল। দক্ষিণ-পশ্চিমে উড়ে গেল খুব নিচু দিয়ে। তারপর পাক দিয়ে এসেই হঠাত্ বোমা ফেলল। একটা বোমা গিয়ে পড়ল ‘পদ্মা’-র ইঞ্জিনরুমে। ইঞ্জিনরুম হলো একেবারে বিধ্বস্ত স্প্লিন্টারের আঘাতে হতাহত হলো বহু নাবিক। পুরোপুরি অচল হয়ে গেল পদ্মা।
আবারও ফিরে এল বিমানগুলো। এবারের বোমাগুলো থেকে কোনোরকমে রক্ষা পেল ‘পলাশ’ ও ‘পানভেল’। কিন্তু সকলে ভয় পেয়ে গেল। কে কী করবে ঠিক বুঝে উঠতে পারছে না। ঠিক তখন পলাশের অধিনায়ক লেফটেন্যান্ট কমান্ডার রায় চৌধুরী সকলকে জাহাজ ত্যাগ করার জন্য আদেশ দেন। এমন আদেশ শুনে বেশ ক্ষুব্ধ হলেন রুহুল আমিন। যুদ্ধ না করে তিনি ভীরুর মতো জাহাজ ছেড়ে যাবেন না। তিনি সকলকে আহবান করলেন জাহাজ ত্যাগ না করার জন্য। তিনি হানাদার বাহিনীর বিমানগুলোতে গুলি চালাতে অনুরোধ জানালেন ক্রুদের। নিজে চলে গেলেন ইঞ্জিনরুমে দায়িত্ব পালন করার জন্য। যে করেই হোক বিমান হামলা থেকে গানবোটকে বাঁচাতে হবে। কিন্তু কেউই অধিনায়কের আদেশ অমান্য করে ঝুঁকি নিতে রাজি হলো না। আর তাই বিমানগুলোকেও আর চ্যালেঞ্জ করে আক্রমণ করা হলো না।
এবার বিমানগুলো পেছন দিক থেকে উড়ে এল। কোনোরকম বাধা ছাড়াই চালাল বোমাবর্ষণ। একটা বোমা এসে পড়ল ‘পলাশ’-এর ওপর। ধ্বংস হলো ইঞ্জিনরুম। আগুন নিয়ন্ত্রণে আনা সম্ভব হলো না। বরং জাহাজে রাখা গোলাবারুদ ফুটতে শুরু করল। এই অসম্ভব বিস্ফোরণে ছিন্নবিচ্ছিন্ন হলে গেল রুহুল আমিনের দেহ।
এই অসম সাহসী বীরের শবদেহ সমাহিত করা হয় খুলনার রূপসা উপজেলার বাগমারা গ্রামে রূপসা নদীর তীরে। তাঁর কবরটি আজও তাঁর বীরত্বের শক্তি ও শোককে বুকে নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে রূপসা ফেরিঘাটের লুকপুরে।
বীরশ্রেষ্ঠ আর্টিফিসার মোহাম্মদ রুহুল আমিনের জন্মস্থান নোয়াখালীর বাগপাদুরা গ্রামের নাম পরিবর্তন করে এখন রাখা হয়েছে তাঁর নামে আমিননগর। বাড়ির সম্মুখে বীরশ্রেষ্ঠর পরিবারের দেয়া ২০ শতাংশ জমিতেই স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়ের উদ্যোগে নোয়াখালী জেলা পরিষদ ৬২ লাখ টাকা ব্যয়ে নির্মাণ করেছে রুহুল আমিন স্মৃতি জাদুঘর ও গ্রন্থাগার।
দেশকে মুক্ত করার জন্য দায়িত্বকে যিনি সবচেয়ে পবিত্রতম মনে করেছেন তিনি অর্টিফিসার রুহুল আমিন। অন্য সব নাবিকের মতো অধিনায়কের নির্দেশে অনায়াসেই জাহাজ ত্যাগ করে নদীতে ঝাঁপ দিয়ে নিজের জীবন বাঁচাতে পারতেন। কিন্তু তিনি তা করেননি। নিজের প্রাণের চেয়েও মূল্যবান ভেবেছেন নিজের রণতরীকে। তিনি করে গেছেন জীবন দিয়ে যুদ্ধ। তাই তিনি শহীদ, পরম গৌরব, বীরশ্রেষ্ঠ এবং বাংলার পতাকার রক্তিম পলাশ।
সংক্ষিপ্ত জীবনী :
মোহাম্মদ রুহুল আমিন
জন্ম : ১৯৩৪ সাল
জন্মস্থান : নোয়াখালী জেলার বেগমগঞ্জ থানার বাগপাদুরা গ্রামে।
পিতা : মোঃ আজহার পাটোয়ারী।
মা : মোছাঃ জুলেখা খাতুন।
কর্মস্থল : নৌবাহিনী।
পদবী : স্কোয়াড্রন ইঞ্জিনিয়ার।
মুক্তিযুদ্ধে অংশরত সেক্টর : ১০নং সেক্টর।
মৃত্যু : ১০ ডিসেম্বর, ১৯৭১ সাল।
সমাধিস্থল : রূপসা ফেরিঘাটের লুকপুরে।
সূত্র : উইকিপিডিয়া, বাংলাপিডিয়া
বীরশ্রেষ্ঠ; রচনা: চন্দন চৌধুরী।
লেখক : এহসান হাবীব