ঝিলু যখন পঞ্চম শ্রেণীর ছাত্র তখন উঠোনের কাঁঠাল গাছে খোদাই করে লিখে রাখে ‘ঝিলু দি গ্রেট’। গানের প্রতি ছিল ঝিলুর প্রচন্ড ঝোঁক। ছেলেবেলা থেকেই তার কণ্ঠ ছিল সুরেলা। পড়ালেখায় মন নেই ঝিলুর, সারাক্ষণ গুনগুন করে গেয়ে চলে গান। গানের প্রতি তাঁর এই আগ্রহ দেখে পরিবারের সদস্যরা তাঁর উজ্জ্বল ভবিষ্যতের আশা ছেড়ে দিয়েছে। ঝিলুর বাবা নাজেম আলী পুত্রের স্বভাবে পরিবর্তন আনতে না পেরে সবসময় বিচলিত থাকেন। তাঁর বড় শখ হলো ছেলে বড় হয়ে ডিস্ট্রিক্ট বোর্ডের ইঞ্জিনিয়ার হবে। সেজন্য একদিন বললেন- ‘বেডার কাণ্ড দেহো। ওরে আবাইগ্যা, গাছডার গায়েতো লেইখা রাখছোস- ‘ঝিলু দি গ্রেট’। গান গাইয়া কি আর গ্রেট হইতে পারবি?’ কিন্তু ঝিলু বলল, ‘দেখ একদিন ঠিকই আমি ‘ঝিলু দি গ্রেট’ হবো।’
‘ঝিলু দি গ্রেট’ হওয়ার স্বপ্নে বিভোর এই ছেলেটি পঞ্চাশের দশকে কণ্ঠের গান আর প্রিয়সঙ্গী বেহালাকে সম্বল করে বরিশাল থেকে তত্কালীন পূর্ব পাকিস্তানের রাজধানী ঢাকায় এলেন এবং জড়িয়ে পড়লেন সাংস্কৃতিক ও রাজনৈতিক নানা কর্মকাণ্ডে। আর বরিশালের সেই ঝিলু ঢাকার সংস্কৃতিকর্মীদের কাছে হয়ে গেলেন প্রিয় আলতাফ মাহমুদ ৷ আলতাফ মাহমুদ গান বাঁধেন, সুরারোপ করেন এবং গেয়ে শোনান ৷ এরই মধ্যে শুরু হল ভাষার অধিকার আদায়ের লড়াই ৷ এ লড়াইয়ের এক পর্যায়ে ১৯৫২ সালের একুশে ফেব্রুয়ারিতে শহীদদের রক্তে রঞ্জিত হলো ঢাকার রাজপথ ৷ এর প্রতিক্রিয়ায় আবদুল গাফফার চৌধুরী লিখলেন অসামান্য কবিতা – ‘আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো একুশে ফেব্রুয়ারি’। আর ওই কবিতায় সুর বসালেন আলতাফ মাহমুদ এবং এদেশের কোটি জনতা একবাক্যে স্বীকার করলেন, ‘আলতাফ মাহমুদ দি গ্রেট’।
আলতাফ মাহমুদ ১৯৩৩ সালের ২৩ ডিসেম্বর বরিশাল জেলার মুলাদী থানার অন্তর্গত পাতারচর গ্রামে এক সম্ভ্রান্ত পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। আলতাফ মাহমুদের বাবার নাম নাজেম আলী হাওলাদার এবং মা কদ বানুর একমাত্র পুত্র সন্তান আলতাফ মাহমুদ। আলতাফ মাহমুদের বাবা প্রথমে আদালতের পেশকার এবং পরবতীর্তে জেলা বোর্ডের সেক্রেটারি ছিলেন।
আলতাফ মাহমুদ ছিলেন বরিশাল জেলা স্কুলের ছাত্র। ছেলেবেলায় গান গাওয়ার পাশাপাশি ছবি আঁকার প্রতিও আলতাফ মাহমুদের ঝোঁক ছিল। গান গাওয়া এবং ছবি আঁকায় তিনি ছিলেন স্কুলের সেরা। মেধাবী এবং বুদ্ধিমান হিসেবে শিক্ষকদের কাছে তাঁর সুনাম ছিল। যতটা আগ্রহ তাঁর ছবি আঁকা আর গান গাওয়ার প্রতি ততটা পড়াশুনার প্রতি ছিল না বলে শিক্ষকরা দুঃখ করতেন। ১৯৪৮ সালে কলকাতা বোর্ডের অধীনে আলতাফ মাহমুদ ম্যাট্রিক পাস করেন। ১৯৪৮ সাল থেকে তিনি দেশের রাজনৈতিক আন্দোলন সম্পর্কে আগ্রহী হয়ে ওঠেন। বরিশাল ব্রজমোহন কলেজে ইন্টারমিডিয়েটে ভর্তি হন, কিন্তু বেশি দিন পড়াশোনা করেননি। কলকাতা আর্ট কলেজে কিছুদিন পড়াশোনা করেন। কিন্তু এখানেও তিনি কোর্স শেষ করেননি।
বরিশাল জেলা স্কুলের সপ্তম শ্রেণীর ছাত্র থাকাকালীনই সাংগঠনিক কর্মকাণ্ডে জড়িয়ে পড়েন। ১৯৪৫-৪৬ সালে ‘তরুণ মহফিল’-এর একজন উৎসাহী কর্মী হিসেবে পরিচিতি লাভ করেন। তখন বিভিন্ন সাংস্কৃতিক ও সমাজকল্যাণমূলক প্রতিষ্ঠানের জন্য তহবিল সংগ্রহের প্রয়োজনে অনুষ্ঠানের আয়োজন হতো। সে অনুষ্ঠান মাতিয়ে তুলতেন আলতাফ মাহমুদ। পাঠাগার প্রতিষ্ঠায় যেমন উদ্যোগী ছিলেন তেমনই পাঠক হিসেবেও ছিলেন মনোযোগী। ১৯৪৭ সালের ১৪ আগস্ট পকিস্তান প্রতিষ্ঠার দিনটিতে বরিশাল শহরে যেসব বিজয় তোরণ নির্মিত হয়েছিল তার বেশ ক’টির শিল্পনির্দেশক ছিলেন তিনি। ১৯৪৭ সালের ১৩ আগস্ট দিবাগত রাত বারোটা এক মিনিটে ‘তরুণ মাহফিলের’ পক্ষ থেকে স্বাধীনতা বরণের জন্য যে সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়েছিল তার প্রথম গানের কণ্ঠশিল্পী ছিলেন আলতাফ মাহমুদ।
১৯৪৮ সাল থেকে তিনি গণসঙ্গীতের দিকে ঝুঁকে পড়েন। বরিশালের এক জনসভায় ‘ম্যায় ভূখা হু’ গানটি গেয়ে আলতাফ মাহমুদ রাতারাতি জনপ্রিয় হয়ে ওঠেন। নিজামুল হকের সাহচর্যে আলতাফ মাহমুদ সত্যিকারের পথ খুঁজে পান গণসঙ্গীতের। সারা বাংলায় কীভাবে সঙ্গীতের মাধ্যমে জনগণকে অধিকার সচেতন করে তোলা যায়, তাদের স্বাধিকারের বাণী শোনানো যায়, সে চিন্তায় মগ্ন থাকতেন নিজামুল হক ও আলতাফ মাহমুদ।
বাংলাদেশের শ্রেষ্ঠ গণসঙ্গীত শিল্পী আবদুল লতিফ বলেন, ‘আলতাফ মাহমুদের কণ্ঠ ছিল অদ্ভুত সুন্দর। যত না সুরকার হিসেবে নাম, তার চেয়েও অনেক বেশি সুন্দর কণ্ঠশিল্পী হিসেবে। ওর ছেলেবেলার কণ্ঠ শুনেই বুঝতে পেরেছিলাম ছেলেটা বিখ্যাত হবে। আমার ওই গানটি… ‘ওরা আমার মুখের কথা কাইড়া নিতে চায়/কথায় কথায় তারা আমায় হাতকড়া লাগায়’, আলতাফের মতো করে আর কেউ গাইতে পারেনি কোনোদিন, এমনকি আমি নিজেও না। তার সুরে যে আবেগ এবং অর্থ প্রকাশ পেত, তা না শুনলে বোঝানো যাবে না।’
১৯৫০ সালে ধূমকেতু শিল্পী সংঘ – সংগঠনের সাথে যুক্ত হন তিনি। পরবর্তীতে তিনি পূর্ব পাকিস্তান যুবলীগ-এর সাথে সম্পৃক্ত হয়ে পড়েন। যুবলীগের সাংস্কৃতিক ফ্রন্টের শিল্পী হিসেবে তিনি প্রথমদিকে যুক্ত ছিলেন। ‘৫২-র রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনে আলতাফ মাহমুদ ছিলেন একজন সক্রিয় কর্মী। ১৯৬৭ সালের ফেব্রুয়ারির ২১, ২২ ও ২৩ তারিখ-এই তিনদিন পল্টন ময়দানে তাঁদের উদ্যোগে লক্ষ লক্ষ জনতার উপস্থিতিতে ‘জ্বলছে আগুন ক্ষেতেখামারে’ শীর্ষক যে গীতিনৃত্যনাট্য মঞ্চস্থ হয় তা অসীম উদ্দীপনা সৃষ্টি করেছিল সেদিন জনমনে। এই গীতিনৃত্যনাট্যের সঙ্গীত পরিচালনা করেন আলতাফ মাহমুদ। অভিনয়ও করেন। আলতাফ মাহমুদের সহশিল্পী হিসেবে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান, অলি আহমদ অংশগ্রহণ করেছিলেন। এই অনুষ্ঠানে আলতাফ মাহমুদ তাঁর দরদি গলায় উদাত্ত কণ্ঠে গেয়েছিলেন, ‘ও বাঙালী, ঢাকার শহর রক্তে ভাসাইলি…।’
১৯৫৪ সালের নির্বাচনের সময় বাবা নাজেম আলী মুলাদীর স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে দাঁড়িয়েছিলেন। নির্বাচন প্রচারণায় তিনি এতই আন্তরিক ছিলেন যে, পিতার পক্ষেও কোনো মঞ্চে ওঠেননি, বরং পিতার বিরোধিতাই করেছেন। নির্বাচন শেষে ১৯৫৪ সালের ৩০ মে ৯২/ক ধারা জারি করে পাকিস্তান শাসকচক্র অনেককেই গ্রেফতার করে। পুলিশের হুলিয়া মাথায় নিয়ে নিজামুল হক ও আলতাফ মাহমুদ বরিশালে গিয়ে আত্মগোপন করেন। ১৯৫৫ সালের ৬ জুন ৯২/ক ধারা প্রত্যাহার করা হলে শিল্পীরা আবার প্রাকাশ্যে আসেন। এরই মধ্যে আত্মগোপন অবস্থায় আলতাফ মাহমুদ একটি জনপ্রিয় গান রচনা করেন, ‘মেঘনার কূলে ছিল আমার ঘর/হঠাৎ একটা তুফান আইয়া/ভাইসা নিল তারে রে’। এই গানটি ভৈরবের এক জনসভায় আলতাফ মাহমুদকে ৭ বার, ১১ বার মতান্তরে ১৯ বার গেয়ে শোনাতে হয়।
আলতাফ মাহমুদ যতগুলি গান গেয়েছেন তার সবগুলিই দেশ, মা ও মাটিপ্রেম মেশানো। সময়টা ছিল স্বাধিকারের জন্য জাতিকে উজ্জীবিত করার। যার ফলে আলতাফ মাহমুদ সুরে সুরেই জাতির হৃদয়ে স্পন্দন তুলতে পেরেছিলেন। ১৯৬৬ সালের মধ্যেই শিল্পী আলতাফ মাহমুদ সুরারোপ, কণ্ঠদান এবং সঙ্গীত পরিচালনায় পূর্ণ প্রতিষ্ঠালাভ করেন।
১৯৬৬ সালের ১৬ অক্টোবর বিল্লাহ পরিবারের বড় মেয়ে সারা আরা, ডাকনাম ঝিনুর সাথে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হন আলতাফ মাহমুদ। বিল্লাহ পরিবারের সব সদস্যই সংস্কৃতিমনা। আলতাফ মাহমুদের সাথে বিয়ের পর বিল্লাহ পরিবারের সারা আরা হয়ে যান সারা আরা মাহমুদ। আলতাফ মাহমুদের সাথে সারা আরার বয়সের ব্যবধান অনেক। তাঁদের যখন বিয়ে হয় সারা তখন দশম শ্রেণীর ছাত্রী। আলতাফ মাহমুদের বয়স তখন ৩৫-৩৬ বছর। বিয়ের প্রস্তাব এলে সারার পরিবারের সদস্যরা বয়সের বিশাল দূরত্বের জন্য প্রথমে অসম্মতি জানান । কিন্তু বেগম সুফিয়া কামালের মধ্যস্থতায় শেষ পর্যন্ত বিয়ে সম্পন্ন হয়। বিয়ের পর দু’জনের দাম্পত্যজীবনের পরিধি ছিল মাত্র পাঁচ বছর। বয়সের ব্যবধান সত্ত্বেও তাঁদের দাম্পত্য জীবন ছিল সুখের। পাঁচ বছরের বিবাহিত জীবনে তাঁদের ঘরে জন্ম নেয় একমাত্র মেয়ে শাওন।
১৯৫৫-৫৬ সালের কথা। ভিয়েনায় আয়োজন করা হয় বিশ্ব শান্তি সম্মেলন। সেখানে অংশ নেয়ার জন্য পূর্ব পাকিস্তান থেকে কতক নেতা-কর্মী আমন্ত্রিত হয়। আলতাফ মাহমুদ পাকিস্তান সাংস্কৃতিক দলে ভিয়েনা শান্তি সম্মেলনে যাওয়ার জন্য মনোনীত হন। কর্তৃপক্ষ টিকিটেরও ব্যবস্থা করেন। করাচি হয়ে যেতে হবে ভিয়েনা। যথারীতি করাচি গেলেন তিনি। কিন্তু করাচি গিয়ে দেখা গেল এক ভিন্ন চিত্র। আলতাফ মাহমুদকে ভিয়েনা যেতে দেয়া হলো না। তাঁর পাসপোর্ট আটক করা হলো। কারণ হিসেবে তৎকালীন পাকিস্তান সরকার কোনো ব্যাখ্যা প্রদান করেনি। প্রতিনিধি দলের সবাই ভিয়েনা চলে যান। তিনি করাচিতেই থেকে যান। ঢাকায় ফিরে আসার মতো আর্থিক সঙ্গতিও তাঁর ছিল না।
মনের দুঃখকে চাপা দিয়ে কোনো এক অজানা সংগ্রামে লিপ্ত হওয়ার জন্য মনে মনে তৈরি হতে থাকলেন আলতাফ মাহমুদ। সংকল্প নিলেন করাচিতেই তিনি ভাগ্য গড়বেন। সে কারণে করাচিতে ভাগ্যান্বেষণ শুরু করেন। রেডিও পাকিস্তানের সংবাদ পাঠক আফতাব আহমদের মাধ্যমে প্রথমেই দেবু ভট্টাচার্যের সাথে পরিচয় হয়। এখানে তিনি পেয়ে যান বিখ্যাত সুরস্রষ্টা তিমিরবরণ সরোদিয়াকে (১৯০৪-১৯৮৭), সঙ্গীতসম্রাট আলাউদ্দিন খানের হাতেগড়া ছাত্র, যিনি আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন যন্ত্রশিল্পী। এ শিল্পী তখন করাচিতে ছিলেন। তাঁরই শিষ্য সঙ্গীত পরিচালক দেবু ভট্টাচার্য।
এছাড়া সে সময় করাচিতে বাংলার বিশিষ্ট শিল্পীদের মধ্যে ছিলেন শেখ লুতফর রহমান, মাহমুদুন্নবী, সঙ্গীত পরিচালক আলী হোসেন, নৃত্যশিল্পী আমানুল হক, আলতামাস প্রমুখ। অল্প সময়ের মধ্যে সবাইকে নিয়ে এবং সবার সম্পৃক্ততায় করাচিতে গড়ে ওঠে এক শিল্পীগোষ্ঠী ‘ইস্ট পাকিস্তান এসোসিয়েশন’ । করাচি প্রবাসী বাঙালিদের চেষ্টাতে প্রতিষ্ঠিত হয় করাচির ‘নজরুল একাডেমি’। এসব সংস্থার উদ্যোগে যত অনুষ্ঠান হয় তার অন্যতম প্রধান উদ্যোক্তা হলেন আলতাফ মাহমুদ।
করাচিতেই প্রথম চলচ্চিত্রে সঙ্গীত পরিচালনার দিকে হাত বাড়ান আলতাফ মাহমুদ। ওস্তাদ আবদুল কাদের খাঁ, প্রখ্যাত খেয়াল গায়ক ওস্তাদ রমজান আলী খাঁ ও তাঁর ভাগ্নে ওস্তাদ ওমরাও বুন্দু খাঁ, বিশিষ্ট তবলাবাদক ওস্তাদ আল্লাদিত্তা খাঁ, ওস্তাদ জিরে খাঁ, বিশিষ্ট সেতারী ওস্তাদ কবীর খাঁ, বিশিষ্ট বীণকার ওস্তাদ হাবিব আলী খাঁ- ভারত উপমহাদেশের সঙ্গীত জগতের এসব দিকপাল ব্যক্তিগতভাবে আলতাফ মাহমুদকে স্নেহ করতেন। এঁদের সান্নিধ্যে আলতাফ মাহমুদ সঙ্গীত জগতের বিভিন্ন শিক্ষা নেন এবং সঙ্গীতজ্ঞ হিসেবে আসন অর্জন করেন।
১৯৫৬ সালে আলতাফ মাহমুদ করাচি বেতারে প্রথম সঙ্গীত পরিবেশন করেন। পরবর্তীকালে এই বেতার থেকে ‘ইত্তেহাদে ম্যুসিকি’ নামে দশ মিনিটের একটি অনুষ্ঠান প্রযোজনা ও পরিচালনা করেন। আর এই অনুষ্ঠানের জন্য সঙ্গীত লেখা, গ্রন্থনা, সুরারোপ, সঙ্গীত পরিচালনা সবকিছু করেছেন আলতাফ মাহমুদ। এভাবেই তিনি বেতার সঙ্গীতে নিজেকে ব্যস্ত রাখেন।
১৯৬৪ সালে ঢাকায় ফিরে আসার আগে তিনি ছায়াছবির গানে কণ্ঠদানসহ সহকারী সঙ্গীত পরিচালকের আসনে পৌঁছতে সক্ষম হন। এছাড়াও তিনি মিনি কলের গানের রেকর্ড করেছিলেন ৩০টি। আর সে সব ছিল পল্লী উন্নয়নের জন্য সরকারি প্রচারণামূলক সঙ্গীত। ছায়াছবির গানে সুরারোপ, কণ্ঠদান এবং সঙ্গীত পরিচালনায় অসামান্য মেধার ছাপ দেখিয়ে ছায়াছবির জগতে আলতাফ মাহমুদ পূর্ণ প্রতিষ্ঠা পেয়েছিলেন। ছায়াছবিতে প্রথম কণ্ঠ দেন এ.জে. কারদারের ‘জাগো হুয়া সাভেরা’তে। গানের বাণী- ‘হাম হর নদীকা রাজা।’ প্রথম গানেই চলচ্চিত্রাঙ্গনে আলতাফ মাহমুদের জয়জয়কার পড়ে যায়। করাচিতে অবস্থানকালে ‘নীলা পর্বত’ ছবিতেও কণ্ঠদান করেন।
‘তানহা’ ছায়াছবিতে আলতাফ মাহমুদ প্রথম এককভাবে সঙ্গীত পরিচালক হয়ে কাজ করেন। ‘তানহা’ ছাড়া ‘আঁকাবাঁকা’, ‘ক খ গ ঘ’, ‘কুঁচবরণ কন্যা’, ‘সুয়োরাণী দুয়োরাণী’-তে কণ্ঠদান করেন এবং প্রথম দুটোতে অভিনয়ও করেন আলতাফ মাহমুদ। ‘বাঁশরী’ ছবিতেও অতুলপ্রসাদের ‘পাগলা মনটারে তুই বাঁধ’ গানেও কণ্ঠদান করেন। ছায়াছবির সুরকার সত্য সাহা।
১৯৬৪ সালে তিনি পূর্ব পাকিস্তানের রাজধানী ঢাকায় ফিরে এসে যথারীতি গান নিয়ে মেতে ওঠেন এবং পূর্ব পাকিস্তানের ছায়াছবির গানে প্রবেশ করেন। কণ্ঠদানের পাশাপাশি একজন খ্যাতিমান সঙ্গীত পরিচালক হয়ে ওঠেন। ১৯৭১ সালে বেহালা, তবলা, হারমোনিয়মের সাথে আলতাফ মাহমুদের হাতে উঠে আসে রাইফেল । শহরের যেখানেই মিছিল আর আলোচনা অনুষ্ঠান হয় সেখানেই আলতাফ মাহমুদ উপস্থিত থাকেন। শহীদ মিনারের বিভিন্ন অনুষ্ঠানে সঙ্গীত পরিচালনা ও কণ্ঠদান করেন তিনি। সেই সময় রাজারবাগ পুলিশ লাইনের ঠিক বিপরীত দিকে ৩৭০ নম্বর আউটার সার্কুলার রোডের বাসায় থাকতেন আলতাফ মাহমুদ। ২৫ মার্চ হানাদার বাহিনী তাদের মারণাস্ত্র দিয়ে রাজারবাগ পুলিশ লাইনের টিনসেডগুলোতে আগুন লাগিয়ে দেয়।
২৬ তারিখ সকালে পরিবারের সদস্যদের নিয়ে পাশের বাড়িতে আশ্রয় নেন তিনি। ২৭ মার্চ কয়েক ঘণ্টার জন্য কার্ফ্যু শিথিল হলে আলতাফ মাহমুদ সবাইকে নিয়ে কমলাপুরের বৌদ্ধবিহারে আশ্রয় নেন। সেখানে ১৮ দিন থাকার পর আবার চলে আসেন রাজারবাগ পুলিশ লাইনের আউটার সার্কুলার রোডের বাসায়। এখানে ফিরে এসে তিনি বিচলিত ও চিন্তিত হয়ে পড়েন। দেশ, আত্মীয়-স্বজন এবং জনগণের দুরবস্থার কথা ভেবে অস্থিরতায় কাটে তাঁর সারাটি সময় এবং এ সময়ই তিনি মুক্তিযুদ্ধে সক্রিয় অংশগ্রহণের সিদ্ধান্ত নেন এবং ঢাকা শহরে কতগুলো অপারেশনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন। সেক্টর কমান্ডার মেজর খালেদ মোশাররফের নির্দেশে হোটেল ইন্টারকন্টিনেন্টালে একটি অপারেশন হয় আলতাফ মাহমুদের অংশগ্রহণে।
আলতাফ মাহমুদ, হাফিজ সাহেব এবং সামাদ সাহেব মিলে সিদ্ধান্ত নেন, বিশ্বব্যাংক প্রতিনিধিদলের ঢাকায় অবস্থানকালে হোটেলে বোমা বিস্ফোরণ ঘটাবেন তাঁরা। ক্র্যাক প্লাটুনের অন্যতম সদস্য সামাদ সাহেব নিয়ন সাইনের ব্যবসা করেন। ঘটনাচক্রে ঐ সময় হোটেল ইন্টারকন্টিনেন্টালে নিয়ন সাইনের একটা কন্ট্রাক্ট চলে আসে। নিয়ন বাল্বের ভেতরে বিস্ফোরক ভরে হোটেলের ভেতরে পাচার করে দেয়া হয়। তবে বিশ্বব্যাংকের প্রতিনিধিদল তখন হোটেলে আসেনি, তারপরও বিদেশি সাংবাদিকদের জানানোর জন্য হোটেলে বিস্ফোরণ ঘটানো হয়। এতে ফলও হয়। হোটেলে বহু বিদেশি সাংবাদিক ছিলেন। তাঁদের মাধ্যমে এই বিস্ফোরণের খবর সারা বিশ্বে ছড়িয়ে পড়ে।
এদিকে মুক্তিযোদ্ধাদের মনোবল দৃঢ় থেকে দৃঢ়তর হতে থাকে। তাঁদের কাছে প্রচুর বিস্ফোরক থাকায় সেগুলো নিরাপদে রাখার স্থান পাওয়া নিয়ে দেখা দেয় সমস্যা। কিন্তু সাহসী মুক্তিযোদ্ধা আলতাফ মাহমুদ সব গোলাবারুদ তাঁর বাসায় কাঁঠাল গাছের নিচে একটা হাউজে রেখে ইট, পাথর, কাঠের টুকরো দিয়ে ঢেকে রাখেন। এপ্রিলের শেষের দিক থেকে আলতাফ মাহমুদ মুক্তিযুদ্ধের জন্য সঙ্গীত রচনায় ব্যস্ত হয়ে পড়েন। গান রচনা, সুরারোপ করা, কণ্ঠ দেয়া, রেকর্ড করে স্বাধীনবাংলা বেতার কেন্দ্রে পাঠানো সব কাজ বিশেষ গোপনীয়তার সাথে করতে থাকেন।
আগস্টের শেষ সপ্তাহে স্থির করেন, সেপ্টেম্বরের প্রথম সপ্তাহে তিনি ঢাকা ত্যাগ করবেন; চলে যাবেন পশ্চিমবঙ্গে এবং সেখান থেকে কাজ করবেন মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে। কিন্তু তিনি যেতে পারেননি। কারণ তার আগেই বন্দি হন হানাদারদের হাতে। তাঁদের প্ল্যাটুনের একজন গেরিলা ধরা পড়েন। পাঞ্জাবি পুলিশ ও সেনাবাহিনীর হাতে মার খেয়ে তিনি আলতাফ মাহমুদের বাসার কাঁঠাল গাছের নিচে লুকিয়ে রাখা গোলাবারুদের কথা বলে দেন। ৩০ আগস্ট ভোরবেলা আর্মিরা প্রথমে আলতাফ মাহমুদের পুরো বাড়িটি ঘিরে ফেলে। এরপর কয়েকজন ঘরে ঢুকে জিজ্ঞেস করে, ‘আলতাফ মাহমুদ কৌন হ্যায়?’ আলতাফ মাহমুদ জবাব দিলেন, ‘আমি’। এরপর আর্মিরা তাঁকে দিয়ে মাটি খুঁড়ে কাঁঠাল গাছের নিচে লুকিয়ে রাখা গোলাবারুদের ট্রাঙ্ক দুটি বের করে নেওয়ার পর তাঁকে সঙ্গে নিয়ে চলে গেল। তিনি যাওয়ার সময় তাঁর শ্যালকের কাছে তাঁর হাতে পরা একটা আংটি খুলে দিয়ে বললেন, ‘এটা ঝিনু এবং শাওনকে দিও। ওদের জন্য তো কিছু রেখে যেতে পারলাম না। দেশের মানুষ আছে ওদের জন্য।’
প্রথমে তাঁকে ধরে নিয়ে যেয়ে রাখা হয় রমনা থানায়। সেই সময় রমনা থানা থেকে ফিরে আসা একজন বন্দীর কাছ থেকে জানা যায় তাঁকে বন্দী অবস্থায় প্রচণ্ড নির্যাতন করা হয় এবং ৩ সেপ্টেম্বর চোখ বেঁধে তাঁকে নিয়ে যাওয়া হয়। কিন্তু তিনি জানেন না কোথায় তাঁকে নিয়ে যাওয়া হয়েছে এবং পরিবারের সদস্যসহ কেউ আর তাঁর খোঁজ পাননি।
দিনটি ছিল ১৯৮৬ সালের ২৪ অক্টোবর। এদিন সারা আরা মাহমুদের মা মারা গেলেন। বনানী গোরস্তানে দাফন সেরে মোনাজাত করে সবাই যখন বাড়ি ফিরছিলেন তখন হঠাৎ ১৮ বছরের শাওন চিৎকার করে তাঁর মামার উদ্দেশ্য বলে ওঠে, ‘তোমার মার একটা কবর আছে, জায়গা আছে- আমার বাবার কবর কোথায়?’
সেদিন কেউ তাঁর প্রশ্নের উত্তর দিতে পারেননি। আজ এত বছর পরও এদেশের মানুষ কী শাওনের এই কথার উত্তর দিতে পারবে?
সংক্ষিপ্ত জীবনী:
জন্ম : আলতাফ মাহমুদ ১৯৩৩ সালের ২৩ ডিসেম্বর বরিশাল জেলার মুলাদী থানার অন্তর্গত পাতারচর গ্রামে এক সম্ভ্রান্ত পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন।
বাবা-মা : আলতাফ মাহমুদের বাবার নাম নাজেম আলী হাওলাদার এবং মা কদ বানুর একমাত্র পুত্র সন্তান আলতাফ মাহমুদ।
পড়াশুনা : আলতাফ মাহমুদ ছিলেন বরিশাল জেলা স্কুলের ছাত্র। ছেলেবেলায় গান গাওয়ার পাশাপাশি ছবি আঁকার প্রতিও আলতাফ মাহমুদের ঝোঁক ছিল। গান গাওয়া এবং ছবি আঁকায় তিনি ছিলেন স্কুলের সেরা। মেধাবী এবং বুদ্ধিমান হিসেবে শিক্ষকদের কাছে তাঁর সুনাম ছিল। যতটা আগ্রহ তাঁর ছবি আঁকা আর গান গাওয়ার প্রতি ততটা পড়াশুনার প্রতি ছিল না বলে শিক্ষকরা দুঃখ করতেন। ১৯৪৮ সালে কলকাতা বোর্ডের অধীনে আলতাফ মাহমুদ ম্যাট্রিক পাস করেন। ১৯৪৮ সাল থেকে তিনি দেশের রাজনৈতিক আন্দোলন সম্পর্কে আগ্রহী হয়ে ওঠেন। বরিশাল ব্রজমোহন কলেজে ইন্টারমিডিয়েটে ভর্তি হন, কিন্তু বেশি দিন পড়াশুনা করেননি। কলকাতা আর্ট কলেজে কিছুদিন পড়াশুনা করেন। কিন্তু এখানেও তিনি কোর্স শেষ করেননি।
সংসার জীবন : ১৯৬৬ সালের ১৬ অক্টোবর বিল্লাহ পরিবারের বড় মেয়ে সারা আরা, ডাকনাম ঝিনুর সাথে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হন আলতাফ মাহমুদ। বিল্লাহ পরিবারের সব সদস্যই সংস্কৃতিমনা। আলতাফ মাহমুদের সাথে বিয়ের পর বিল্লাহ পরিবারের সারা আরা হয়ে যান সারা আরা মাহমুদ। আলতাফ মাহমুদের সাথে সারা আরার বয়সের ব্যবধান অনেক। তাঁদের যখন বিয়ে হয় সারা তখন দশম শ্রেণীর ছাত্রী। আলতাফ মাহমুদের বয়স তখন ৩৫-৩৬ বছর। বিয়ের প্রস্তাব এলে সারার পরিবারের সদস্যরা বয়সের বিশাল দূরত্বের জন্য প্রথমে অসম্মতি জানান। কিন্তু বেগম সুফিয়া কামালের মধ্যস্থতায় শেষ পর্যন্ত বিয়ে সম্পন্ন হয়। বিয়ের পর দু’জনের দাম্পত্যজীবনের পরিধি ছিল মাত্র পাঁচ বছর। বয়সের ব্যবধান সত্ত্বেও তাঁদের দাম্পত্য জীবন ছিল সুখের। পাঁচ বছরের বিবাহিত জীবনে তাঁদের ঘরে জন্ম নেয় একমাত্র মেয়ে শাওন।
মৃত্যু : ১৯৭১ সালের ৩০ আগস্ট ভোরবেলা আর্মিরা প্রথমে আলতাফ মাহমুদের পুরো বাড়িটি ঘিরে ফেলে। এরপর কয়েকজন ঘরে ঢুকে জিজ্ঞেস করে, ‘আলতাফ মাহমুদ কৌন হ্যায়?’ আলতাফ মাহমুদ জবাব দিলেন, ‘আমি’। এরপর আর্মিরা তাঁকে দিয়ে মাটি খুঁড়ে কাঁঠাল গাছের নিচে লুকিয়ে রাখা গোলাবারুদের ট্রাঙ্ক দুটি বের করে নেওয়ার পর তাঁকে সঙ্গে নিয়ে চলে গেল।
প্রথমে তাঁকে ধরে নিয়ে যেয়ে রাখা হয় রমনা থানায়। সেইসময় রমনা থানা থেকে ফিরে আসা একজন বন্দীর কাছ থেকে জানা যায় তাঁকে বন্দী অবস্থায় প্রচণ্ড নির্যাতন করা হয় এবং ৩ সেপ্টেম্বর চোখ বেঁধে তাঁকে নিয়ে যাওয়া হয়। কিন্তু তিনি জানেন না কোথায় তাঁকে নিয়ে যাওয়া হয়েছে এবং পরিবারের সদস্যসহ কেউ আর তাঁর খোঁজ পাননি।
কৃতজ্ঞতা স্বীকার : সারা আরা মাহমুদ
লেখক : আশরাফী বিথী