বাবা হিসেবে সন্তানের স্মৃতিচারণ, তাতে আদর আর শাসনই মনে পড়ার কথা, কিন্তু তার কোনোটিই গভীরভাবে আমার জীবনে আসেনি। কারণ পৃথিবীতে আসার মাত্র এগার দিন বয়সে গর্ভধারিণী (মনোয়ারা বেগম) মাকে হারালে চাচীর কোলেই ঠাঁই হয় আমার। তাই চাচা-চাচিদের, দাদি, পরবর্তীতে মা এবং অন্যান্যের অতিরিক্ত আদর-স্নেহের প্রখরতায় বাবার আদর বা শাসন কোনোটিই তেমন প্রভাব ফেলার সুযোগ পায়নি।
জীবনের শেষ প্রান্তে উপস্থিত দাদিকে বাবা সম্পর্কে জিজ্ঞেস করলে শুধু কাঁদতে থাকেন, চাচাদের জিজ্ঞেস করলে সজোরে কেঁদে ওঠেন। মাকে জিজ্ঞেস করলে আনমনা হয়ে চেয়ে থাকেন। তাছাড়া এসব ব্যাপারে তাকে নাকি তেমন কিছু বলতো না। তবু চাপা কান্না বুকে নিয়ে বারবার তাদের কাছে জানতে চাই। কারণ আমাকে জানতে হবে। না জানলে প্রশ্ন থেকে যাবে।
তাই একজন শহীদের অজানা বিষয়, জীবন-দর্শন, মানবতাবোধ এবং জীবনের উল্লেখযোগ্য ঘটনা বিভিন্ন নির্ভরযোগ্য সূত্র থেকে যথাযথভাবে উল্লেখ করার চেষ্টা করছি। ছামান আলী তালুকদারের পুত্র আমার বাবা শহীদ অধ্যাপক আব্দুল ওয়াহাব তালুকদার। যাকে সবাই ওয়াহাব বলেই ডাকতো। পাঁচ ভাই এবং এক বোনের মধ্যে তিনি ছিলেন চতুর্থ। শহীদ ওয়াহাব ১৯৪৩ সালের ৩ জানুয়ারি অবিভক্ত ভারতের পশ্চিমবঙ্গের সাবেক করদ রাজ্য কুচবিহারের অন্তর্গত দিনহাটা মহাকুমাধীন কালমাটি গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন।
সবুজ মাঠ, পাখিদের কলকাকলি আর বাবা-মার আদর-স্নেহের মধ্য দিয়েই তিনি শৈশবকাল অতিক্রম করেন। শৈশব থেকেই লেখাপড়ার প্রতি তাঁর বিশেষ ঝোঁক ছিল। ছাত্র হিসেবে তাঁর মেধা ছিল অত্যন্ত প্রখর এবং ধীরস্থির। ১৯৫০ সালের সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার সময় তাঁর পিতা সপরিবারে বর্তমান ভুরুঙ্গামারী থানার সিংঝাড় গ্রামে স্থায়ীভাবে বসবাস শুরু করেন। তখন তিনি চতুর্থ শ্রেণীর ছাত্র। কিন্তু কিছুদিন পর তাঁর বাবা মারা যাওয়ায় ভাইদের ঐকান্তিক প্রচেষ্টায় প্রথমে বাউশমারী মাদ্রাসা এবং পরে ১৯৫৮ সালে ভুরুঙ্গামারী পাইলট হাইস্কুল থেকে ম্যাট্রিক পাশ করেন। পরবর্তীতে রংপুর কারমাইকেল কলেজ থেকে ১৯৬০ সালে ইন্টারমিডিয়েট এবং ১৯৬২ সালে ডিগ্রি পাশ করেন। এরপর ১৯৬৪ সালে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ইতিহাস ও সংস্কৃতিতে এম.এ. পাশ করেন।
লেখাপড়া শেষ করে অন্যান্য চাকরির সুযোগ সুবিধা পেলেও পেশা হিসেবে শিক্ষকতাকেই বেছে নেন। ১৯৬৫ সাল থেকে শহীদ হওয়ার পূর্ব-পর্যন্ত তিনি বর্তমান কুড়িগ্রাম সরকারী কলেজে অধ্যাপনা করতেন। ছোটবেলা থেকে ধীরশান্ত অথচ সদা হাসি-খুশি মানসিকতার অধিকারী আমার বাবা মুক্তবুদ্ধি ও অসাম্প্রদায়িক চিন্তা চেতনায় বিশ্বাসী ছিলেন।
স্বাধীনতা পাগল অসংখ্য মানুষের মধ্যে শহীদ ওয়াহাব ছিলেন একজন। তিনি স্বাধীনতার একজন সক্রিয় সৈনিক ছিলেন। দেশাত্মবোধকে তিনি সবচেয়ে বেশি প্রাধান্য দিতেন। ছাত্রজীবন থেকেই তিনি সর্বদা চিন্তা করতেন কিভাবে নিপীড়িত মানুষকে সেবা করা যায়।
স্বাধীনতা আন্দোলনে তিনি নিজেকে সেভাবেই তৈরি করে নেন। ‘৭১-এ মার্চের প্রথম সপ্তাহে যখন জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান এবং পাকিস্তান সরকারের মধ্যে আলোচনায় অচলাবস্থা দেখা দেয় তখন বিশ্ববিদ্যালয়ে অধয়নরত তাঁর কিছু ছাত্র তাঁর সাথে দেখা করেন এবং সার্বিক পরিস্থিতি সম্পর্কে আলোচনা করেন। এ অবস্থায় তাদের করণীয় কি তাঁর কাছে জানতে চাইলে তিনি তাদেরকে ধৈর্য ধরতে বলেন ও পরিকল্পনা মাফিক চলতে পরামর্শ দেন। এর কয়েকদিন পরই তিনি সপরিবারে কুড়িগ্রাম ছেড়ে প্রথমে নিজ গ্রামে চলে যান এবং এলাকার বিভিন্ন পেশাজীবী মানুষকে মুক্তিযুদ্ধে সংগঠিত করতে থাকেন। এই অবস্থায় তিনি আমার বড় চাচা, তৎকালীন ইউ.পি. চেয়ারম্যান আবদুস সামাদ তালুকদারকে পদত্যাগ করার পরামর্শ দেন। চাচা পদত্যাগ করেছিলেন। কয়েকদিন পরই মুক্তিযুদ্ধ শুরু হয়; ফলে বাবা নিজ গ্রামে থাকাও নিরাপদ মনে করেননি। সেখান থেকে মানিককাজী গ্রামে আমার নানার বাড়িতে ৬/৭ দিন থাকার পর ভারতের কালমাটি গ্রামে আলহাজ শামসউদ্দিন (আমার চাচার শ্বশুর) সাহেবের বাড়িতে পরিবারের অন্যান্য সদস্যদের সাথে অস্থায়ীভাবে বসবাস করেন। এরপর তিনি মুক্তিযুদ্ধে সরাসরি যোগ দেন এবং ১ মে থেকে ১ জুন ১৯৭১ পর্যন্ত বামনহাট ইউথ ক্যাম্পে ট্রেনিং নেন। (প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধা জাতীয় তালিকা প্রণয়ন কমিটি কর্তৃক ফরম নং- ‘শ’-০০৩৯৭৬। এম.এফ. নং-৬)। পরবর্তীতে ৬নং সেক্টরের অধীন বামনহাট যুব শিবিরের ক্যাম্প ইনচার্জ হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। এই সেক্টরের কমান্ডার ছিলেন এম.কে. আবুল বাশার, বীর উত্তম। ১৯৭৩ সালের ১ সেপ্টেম্বর এই বীর মুক্তিযোদ্ধা বিমান বাহিনী প্রধান থাকা অবস্থায় ষড়যন্ত্রমূলক এক বিমান দুর্ঘটনায় নিহত হন। দায়িত্ব পালনকালে শহীদ ওয়াহাব মুক্তিযোদ্ধাদের দেখাশুনা এবং তাঁদের খাবার, রেশন ইত্যাদি পরিচালনা করতেন। মাঝে মধ্যে আমাদের দেখতে আসতেন তবে বেশিরভাগ সময় তিনি বামনহাটে থাকতেন। মা যখন নানার পরিবারসহ সাহেবগঞ্জে থাকতেন সেখানেও তাদের খোঁজ খবর নিতেন। এছাড়া তিনি মুক্তিযোদ্ধাদের বিভিন্ন উপদেশ প্রদান করতেন এবং যাচাইয়ের মাধ্যমে যুবকদেরকে যুব শিবিরে ভর্তি করাতেন।
অন্যান্য দিনের মতো ৭ আগস্ট ১৯৭১ ঘুম থেকে উঠে আনুমানিক সকাল ৯টায় সামান্য নাস্তা খেয়ে বাইরে কিছু লোকের সাথে কথা বলেন এবং কর্মস্থল বামনহাটের দিকে রওয়ানা দেন। পথিমধ্যে তাঁর বড় ভাই আব্দুস সামাদ তালুকদারের সাথে দেখা হয় এবং বলেন, ‘আমি বামনহাট থেকে ঘুরে আসি।’ চাচা তাঁকে যেতে নিষেধ করলেও তাঁর কথা না শুনে বামনহাটে চলে যান। বামনহাট থেকে কয়েকজন সহকর্মী আবুল কাশেম মাস্টার, ডা. মুজিবর রহমান, ভারতের আব্দুল হামিদ পঞ্চায়েতসহ সিংঝাড় গ্রামে ভারত-বাংলাদেশ সামান্তে অবস্থিত বগনী-ব্রীজে অবস্থানরত একদল মুক্তিযোদ্ধার সঙ্গে যুদ্ধের বিভিন্ন কলাকৌশল নিয়ে আলোচনা করেন। এমন সময় মুক্তিযোদ্ধারা বলেন, ‘স্যার আমরা এখনও ভাত খাইনি, পাশের বাড়িতে ভাত রান্না করতে দিয়েছি, এখুনি নিয়ে আসবো।’ বাবা তাঁদের ভাত খাওয়ার অনুমতি দেন এবং ফরহাদ নামক এক তরুণকে পাহারা রাখেন। বেলা তখন বিকেল। রেল লাইনটি তখন জঙ্গলে পরিপূর্ণ ছিল। এমন সময় হঠাৎ পাকিস্তানী হানাদার বাহিনীর একদল সিপাই রেল লাইনের পাশ দিয়ে এসে অতর্কিত আক্রমণ করে। পাহারারত ছেলেটি চিৎকার দেওয়ার সাথে সাথে ব্রাশ ফায়ারে মাটিতে লুটিয়ে পড়ে এবং সঙ্গে সঙ্গে এ চির সবুজ বাংলা মায়ের বুক থেকে বিদায় নেয়, ইতিহাসের পাতায় লিখে রাখে তাঁর নাম। এ অতর্কিত আক্রমণে মুক্তিযোদ্ধা দলটি ছত্রভঙ্গ হয়ে যায়। কোনো সিদ্ধান্ত নেওয়ার সুযোগ তাঁরা পায়নি, ফলে পিছু হঠতে বাধ্য হন। ইতোমধ্যে বৃষ্টির মতো গুলির শব্দে এলাকায় আতংক ছড়িয়ে পড়ে।
বাবার অন্যান্য সঙ্গী তাঁকে সোজা রেলপথে না গিয়ে অন্যদিকে যেতে বললেও তিনি কর্ণপাত করেননি। তিনি সোজা দৌড়াতে থাকেন। লম্বা এবং সুঠাম দেহের অধিকারী এই বত্রিশ বছরের টগবগে যুবকটিকে দেখেই পাকবাহিনীর দলটি তাঁকে লক্ষ করে ব্রাশ ফায়ার করতে থাকে। সম্ভবত এক পর্যায়ে বাবার পায়ে গুলি লাগে। ফলে আহত অবস্থায় জঙ্গলে আত্মগোপন করেন। একজন মৃত্যু পথযাত্রীর জীবনে বেঁচে থাকাই শেষ সাধ হলেও সাধ্য যে থাকে না তাই হয়তো ঘটেছিল ঐ মূহুর্তে। আর এটা যে কত মর্মস্পর্শী এবং হৃদয়বিদারক তা তিনিই অনুভব করতে পারেন, যিনি জীবনকে এ সুন্দর পৃথিবীতে ধরে রাখার জন্য প্রাণপণ চেষ্টা করেন।
নর পিশাচের দলটি বাবাকে অতিক্রম করে আরও ভিতরে ঢুকে পড়ে। তিনি ততক্ষণে তাঁর প্রাণপ্রিয় বাংলা এবং বাঙ্গালীর জন্যে জীবন উৎসর্গ করে মৃত্যুর কাছাকাছি চলে এসেছেন। জীবনের শেষ মুহূর্তে বাবা বুলেটে ক্ষতবিক্ষত দেহ নিয়ে উহ! আহ! শব্দে কাতরাচ্ছিলেন। শব্দ শুনে রক্তপিপাসু দলটি তাঁকে ধরে ফেলে। মুক্তিযুদ্ধের কাগজপত্র পেয়ে হয়তোবা আক্রোশে ফেটে পড়ে এবং তাঁর হাতের ঘড়ি ও অন্যান্য কাগজপত্র নিয়ে নেয়। আর সে আক্রোশেই বুকসহ দেহের বিভিন্ন অংশে বেয়োনেটের খোঁচায় ঝাঝরা করে দেওয়া হয়। তখন তাঁর পরনে ছিল লুঙ্গি এবং শার্ট। হানাদাররা রক্তাক্ত দেহটিকে পার্শ্ববর্তী একটি ডোবায় ফেলে চলে যায়।
সেদিন থেকেই আমরা হারালাম একজন আদর্শ পিতাকে, মা হারালেন একজন আদর্শ পুত্রকে, স্ত্রী হারালো একজন আদর্শ স্বামীকে, ভাই-বোনেরা হারালো একজন আদর্শ ভাইকে, সর্বোপরি জাতি হারালো একজন আদর্শ সন্তানকে। অধ্যাপক ওয়াহাবের শহীদ হওয়ার সংবাদ ছড়িয়ে পড়ার সাথে সাথে আত্মীয়-স্বজনসহ সমগ্র এলাকায় শোকের ছায়া নেমে আসে। জ্ঞান হারিয়ে ফেলেন শহীদের মা সালমা বেগম এবং স্ত্রী বেগম মেশরুন্নাহার, ভাই-বোনসহ আত্মীয়-স্বজনদের কেউ কেউ মূর্চ্ছা যেতে থাকেন, কেউবা নীরবে চোখের পানি ফেলেন।
শহীদের আর দু-সন্তান শামীম, স্বপন আমার মতোই আজকে যখন বুঝতে চেষ্টা করে, জানতে চেষ্টা করে অনেক কিছু, সেদিন তারা আরও ছোট ছিল।
সেদিন তাদের কান্নায় বর্তমানের অনুভূতি না থাকলেও আজকে যখন অন্যান্য শহীদ সন্তানদের মতো বাবার স্মৃতি চারদিকে খুঁজে ফেরে, কিন্তু কোথাও পায় না, তখন বাবাকে ঠাঁই দেয় কল্পনালোকে। বাবার শায়িত মুখটি আমাকে দেখানো হয়েছে কিন্তু এখন অনেক চেষ্টা করেও তা স্মৃতিতে আনতে পারিনি। প্রচন্ড গোলা-গুলির কারণে তাঁর মরদেহ বাংলাদেশে আনা সম্ভব হয়নি। সে পরিস্থিতিতে চাচারা ভারতীয় এলাকাবাসীর সহযোগিতায় বগনী নদীর কিনারে অবস্থিত কালমাটি মসজিদ চত্বরে তাঁকে দাফন করা হয়।
যতদিন পর্যন্ত সীমান্তে কাঁটাতারের বেড়া ছিল না ততদিন পর্যন্ত অধ্যাপক ওয়াহবের আত্মীয়-স্বজন ও এলাকার লোকজন তাঁর কবর জিয়ারত করতে পারতেন। কিন্তু সীমান্তে কাঁটাতারের বেড়া দেওয়ার পর ভারতীয় সীমান্তে অবস্থানরত ভারতীয় সীমান্তরক্ষী বাহিনী বিএসএফ সীমান্ত নিরাপত্তা ব্যবস্থা জোরদার করে এবং এরপর থেকেই কবরের কাছে যেতে বাধা দেয়। স্বাধীনতার এতগুলো বছর পরেও তাঁর মরদেহ বাংলাদেশে আনা সম্ভব হয়নি।
স্বাধীনতার যে স্বপ্ন-সাধ বুকে লালন করে বাবা যুদ্ধে গিয়েছিলেন সে স্বাধীনতা তিনি দেখে যেতে পারেননি, স্পর্শ করতে পারেননি প্রিয় পতাকা। শহীদ অধ্যাপক ওয়াহাব অত্যন্ত সাদাসিধে, নম্র-ভদ্র স্বভাবের লোক ছিলেন। মধ্যবিত্ত পরিবারের সন্তান হলেও ছাত্রজীবন থেকেই সামাজিকতার দিক থেকে তিনি ছিলেন এক ধাপ এগিয়ে। বিভিন্ন সমাজকল্যাণমূলক কাজে নিজেকে অত্যন্ত গভীরভাবে নিয়োজিত রেখেছিলেন। লেখা-পড়ার প্রতি ছোটবেলা থেকেই নিজের যেমন স্পৃহা ছিল, অন্যদেরকেও তেমনি অনুপ্রাণিত করতেন। তাঁর অনেক ছাত্র আছেন যারা আজ সমাজে প্রতিষ্ঠিত। তাদের অনেকেই বলেন আমি তোদের বাসায় ছিলাম। উনি খুব আদর করতেন। তিনি একজন নিষ্ঠাবান শিক্ষক ছিলেক বলেই এত অল্প সময়ের মধ্যে ছাত্র, শিক্ষক কর্মচারীদের নিকট ভালো শিক্ষক হিসেবে শ্রদ্ধাভাজন হন। মানুষ হিসেবে তিনি ছিলেন সদালাপী ও মিষ্টভাষী। সকলের প্রতিই কেমন যেন মমত্ববোধ ছিল, বিশেষ করে ছোটদের ভালোবাসতেন অত্যধিক।
তিনি নিজেকে অত্যন্ত সহজভাবে এলাকার প্রতিটি স্তরের মানুষের মনে ভালোবাসা ও শ্রদ্ধার আসন গড়েছিলেন। একজন্যই হয়তো গভীর মমতা, ভালোবাসা আর শ্রদ্ধাভরে আজও তাঁকে স্মরণ করে কুড়িগ্রামের লোকেরা। এসব গুণাবলীর কারণেই প্রায়ই বাবা সম্পর্কে যখন গভীরভাবে ভাবি তখন ছোটবেলার কথা মনে পড়ে। যখন স্কুলে যেতাম, যদি কেউ জানতো আমি শহীদ ওয়াহাবের ছেলে, তখন আদর করে বলতো, ‘ভালোভাবে লেখাপড়া করবে। তোমাকে তোমার বাবার মতো মানুষ হতে হবে।’ জানিনা কতটুকু হতে পেরেছি তবে অনেকেই নাকি বাবার কিছু প্রভাব আমার মাঝে খুঁজে পান। তখন আনন্দের পাশাপাশি কষ্টও হয় এবং মনে হয় এমন একজন আদর্শ পিতার সান্নিধ্য পেলে হয়তো নিজেকে ভালোভাবে গড়ে তুলতে পারতাম। শহীদ ওয়াহাব ছিলেন ক্রীড়ামোদী এবং সংস্কৃতিমনা। কুড়িগ্রামের প্রায় প্রতিটি সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে তাঁর নিয়মিত উপস্থিতি ছিল। স্থানীয়ভাবে তিনি একজন ভালো খেলোয়াড় হিসেবে পরিচিত ছিলেন। তিনি নিয়মিত কুড়িগ্রাম পাবলিক লাইব্রেরি মাঠে টেনিস খেলতেন। ভলিবল, ফুটবল ও ক্যারামে পারদর্শী ছিলেন। তিনি ছাত্রদের সাথেও খেলাধুরার জন্য মাঠে নামতেন। ভলিবল জাতীয় প্রতিযোগিতায় স্থানীয়ভাবে অনেক খেলায় অংশগ্রহণ করেন। তিনি প্রতিদিন ক্লাবে যেতেন এবং অবসর সময়ে বই ও পত্রিকা পড়তে ভালোবাসতেন। ছোট থেকেই মাছ ধরার প্রচন্ড নেশা ছিল। তাই শিক্ষকতা করা অবস্থাতেও প্রায়ই গ্রামে গিয়ে মাছ ধরতেন। তিনি সাধারণত মাছ ও মাংস খেতে ভালোবাসতেন।
কিছু পেতে কিছু হারাতে হয়। ত্রিশ লক্ষ তাজা প্রাণ এবং দু-লক্ষ মা-বোনের ইজ্জত হারিয়ে আমরা পেয়েছি স্বাধীনতা। যার অঙ্গীকার ছিল সামাজিক, রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক মুক্তি, পারিশেষে শোষণমুক্ত সমাজ। আজ প্রশ্ন এসে যায় স্বাধীনতার স্বপ্নসাধ শহীদ পরিবারগুলো এবং এদেশের মানুষ কতটুকু পেয়েছে? আজকে যখন বাবার কবরের পাশে গিয়ে বাবাকে খুঁজে ফিরি অন্তরে এবং কল্পনালোকে তখন যেন মনে হয় সেদিনের ছোট্ট শিশুর মতোই বাবা স্নেহের পরশ বুলিয়ে আদর করে, সান্ত্বনা দেয় এবং বলে, ছি! বাবা কাঁদতে নেই। আমরা তো কেবল অঙ্গীকার পূরণ করেছি রক্ত দিয়ে। জাতিকে প্রশ্ন করো স্বাধীনতার স্বপ্নসাধ কেন ভূলুণ্ঠিত হচ্ছে। সেদিনতো এমন কথা ছিল না। কুড়িগ্রামে শহীদ ওয়াহাব রোড, কলেজে ওয়াহাব ছাত্রাবাস দেখে যেমন গর্ববোধ করি, দেশের সার্বিক চিত্র দেখে তেমনি অন্যান্য শহীদ সন্তানের মতোই কষ্ট বেড়ে যায়।
প্রতিটি শহীদ সন্তানের মতোই কান্নার পাশাপাশি বাবার রক্ত মাখা জামা-কাপড় যখন চোখের সামনে ভেসে ওঠে তখন যেন অশ্রু শুকিয়ে প্রতিবাদের ভাষা ও শক্তি খুঁজে পাই এবং খুঁজে পাই রক্তের প্রতিশোধ নেওয়ার অনুপ্রেরণা। মনে হয় বাবা নেই তাতে কি হয়েছে, এদেশ তো রয়েছে, দেশের মাটি রয়েছে, একজন শহীদের সন্তান হিসেবে এটাই আমার গর্ব। মানুষ স্বজন হারায় সত্যি কিন্তু আমাদের এ-হারানোর অনুভূতি যেমন অশ্রু ও শোকের, তেমনি গর্বের। আর এ অনুভূতি অন্যের প্রাণে কতটুকু আবেদন সৃষ্টি করবে তার উপরই নির্ভর করছে এ হারানো এবং গর্বের সার্থকতা।
সংগ্রহ : আমার বাবা – মোঃ মিজানুর রহমান তালুকদার; স্মৃতি ১৯৭১, অষ্টম খন্ড; সম্পাদনা – রশীদ হায়দার, প্রকাশকাল : ডিসেম্বর, ১৯৯৫, প্রকাশক : বাংলা একাডেমী, ঢাকা, পৃ. : ৬৪।
লেখক : মোঃ মিজানুর রহমান তালুকদার