এক দুর্ঘটনার মধ্য দিয়ে ডাক্তার আজহারুল হকের সাথে আমার পরিচয়- পরিচয় থেকে জীবন সাথী। আর এক দুর্ঘটনার মধ্য দিয়ে তিনি হারিয়ে গেলেন আমার জীবন থেকে চিরদিনের মত। আমার সবচেয়ে ছোট ভাই ওমর জন্ম থেকেই মস্তিষ্কবিকৃত। আমাদের গ্রামের বাড়ী পাংশাতে একদিন সে রাগে উন্মত্ত হয়ে আরেক ভাই বাবরকে গুলি করার জন্য বন্দুক নিয়ে তাড়া করে, তড়িৎবেগে আমি দৌড়ে বাবরকে বাঁচানোর জন্য যাই – অমনি গুলি ছুড়ে বসে ওমর আর ঐ গুলির ছররা পিছন থেকে আমার ঘাড়ের উপর অংশে লেগে যায়। অলৌকিকভাবে প্রাণে বেঁচে গেলেও ছররা বের করার জন্য আমাকে দ্রুত ঢাকায় এনে তৎকালীন প্রখ্যাত শল্যচিকিৎসক প্রফেসর আনসারীর অধীনে ভর্তি করা হয়। পরপর দু’দিন আমার ঘাড়ে জটিল অপারেশন করে ডা. আনসারী ছররা বের করতে সক্ষম হন। মারাত্মক এই ঝুঁকিপূর্ণ অপারেশনে ডা. আজহার সহকারী হিসাবে অংশ নেন। আজহার ছিলেন ডা. আনসারীর খুব প্রিয় ছাত্র। ঐ সময় ক্লিনিকে ডা. আজহারকে দেখতাম সদাকর্মব্যস্ত থাকতে, কখনও ধীর পায়ে হেঁটে এক রুম থেকে অন্য রুমে যেতে দেখিনি। সব সময়ই একপ্রকার দৌড়েই চলা-ফেরা করতে দেখেছি। প্রথম থেকেই তাঁর মাঝে কর্মচঞ্চলতা, উৎফুল্লতা আমি লক্ষ্য করেছি। ঘন্টার পর ঘন্টা অপারেশন থিয়েটারে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে কাজ করতে কোনোরূপ বিরক্তি ছিল না তাঁর। গভীর রাত পর্যন্ত ক্লিনিকে জটিল রোগী নিয়ে ব্যস্ত থেকেছেন অথচ একটুও ক্লান্ত হননি। তিনি ছিলেন তাঁর পেশার প্রতি খুব আন্তরিক, শেখার প্রতি গভীর মনোযোগী। অত্যন্ত সুস্বাস্থ্যের বেঁটে-কাটো শ্যামলা রং-এর ছিলেন তিনি।
স্মৃতিচারণ করা বড় কঠিন, বড় কষ্টের-তা যদি মধুর না হয়ে হয় এরকম-১৯৭০ সালের ১৫ই ফেব্রুয়ারীতে আমাদের বিয়ে হয় যার পরিসমাপ্তি ঘটে ১৯৭১ সালের ১৫ই নভেম্বর, এক হৃদয়বিদারক-নিষ্ঠুরতা, বর্বরতার মধ্য দিয়ে। মাত্র এক বছর নয় মাস ছিল আমাদের বিবাহিত জীবন।
কিন্তু ভাবলে অবাক লাগে এত স্বল্প সময়ের যে স্মৃতি ডা. আজহার আমার জীবনে রেখে গেছেন তা লিখে শেষ করার নয়। আজ বিশেষ করে মনে পড়ছে ‘৭১ সালের ২৫শে সার্চের সেই ভয়াল কালরাতের বিভীষিকার কথা। আমি ২৪শে মার্চ হঠাৎ করেই অসুস্থ হয়ে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের ৩১ নাম্বার কেবিনে ভর্তি হই। ঐ একই সময়ে আমার শ্রদ্ধেয় শাশুড়ী ও আমার ভাইয়ের ফুফুশাশুড়ীও রোগী হিসাবে আগে থেকেই হাসপাতালে ছিলেন। এক সাথে এই তিন রোগী দেখাশুনার দায়িত্ব নিলেন ডা. আজহার। ২৫শে মার্চের রাতে তিনি বাসায় না ফিরে আমার কেবিনেই থেকে গেলেন। রাত ১০টার দিকে কর্তব্যরত সিসটার আমাকে প্যাথেডিন ইনজেকশন দিয়ে চলে যাবার পর পরই আমরা ঘুমিয়ে পড়লাম। ডা. আজহার কেবিন সংলগ্ন বারান্দায় ঘুমাতে গেলেন। ডা. আজহার তখন ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের বহিঃবিভাগের শল্য বিভাগে সহকারী সার্জন হিসাবে চাকুরীরত। তাই আমি ভর্তি হবার দিন থেকে তাঁর কাজের ফাঁকে ফাঁকে কেবিনে এসে আমাকে দেখে যেতেন। ২৫শে মার্চ বেলা ১১টার দিকে ডা. আজহার হাসপাতাল ক্যান্টিন থেকে কাবাব ও সিঙ্গাড়া কিনে আমার কেবিনে এলেন, ঐ সময় আমার বড়বোন মিসেস শাহবুদ্দিনও এসেছিলেন। খাবারগুলো বোনের হাতে দিয়ে এবং কিছু নিজেও নিয়ে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে খেতে শুরু করলেন আজহার, তখন আমি শুয়ে চেয়ে তাঁকে দেখছিলাম, সাদা এপ্রোন ও কালো প্যান্টে ওঁকে সেদিন আমার চোখে কেন জানি খুব ভাল লাগছিল। খেতে খেতে তিনি আমার বোনকে উদ্দেশ্য করে বললেন, ‘আপা, আজকে কিছু একটা হতে পারে, দেশের পরিস্থিতি খুব খারাপের দিকে যাচ্ছে, যে কোন মূহুর্তে কারফিউ হয়ে যেতে পারে। ১৯ নাম্বার ও ২০ নাম্বার ওয়ার্ড খালি করার হুকুম হয়েছে।’ আমি সাথে সাথে আতঙ্কিত হয়ে কি হয়েছে জিজ্ঞাসা করাতে তিনি ‘ও কিছু না, অফিসে অনেক কাজ আছে’ বলে তাড়াতাড়ি চলে গেলেন।
বিয়ের পর থেকেই ডাক্তারকে দেখতাম এইসব রাজনৈতিক ব্যাপারে খুব আগ্রহ দেখাতে, প্রায় সময়ই নানা বিষয়ে গভীর আলোচনা করতেন অন্যদের সাথে। নতুন নতুন খবর নিয়ে বাসায় ফিরে কী উৎসাহ নিয়েই না কথাগুলো আমাকে বলতেন। ছাত্রজীবনে তিনি কোন ছাত্র সংগঠন করতেন কিনা জানি না। তবে প্রগতিশীল রাজনৈতিক চিন্তাধারা ও মতাদর্শে বিশ্বাসী ছিলেন এবং তৎকালীন ঢাকা মেডিকেল কলেজের ভি.পি. হুমায়ুন কবীরের সাথে তাঁর খুব অন্তরঙ্গতা দেখতাম। ২৫শে মার্চের রাত ১২টার দিকে যখন আমি প্যাথেডিনে গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন তখন বিকট আওয়াজে হঠাৎ ঘুম ভেঙ্গে গলে, আজহার তখন কেবিনের বারান্দায় ঘুমিয়ে, মনে হচ্ছিল সমস্ত ঢাকা শহর যেন থর থর করে কাঁপছে। আমি আয়াকে বলার আগেই দেখি ডাক্তার নিজেই কেবিনে ঢুকে দ্রুত আমার বেডটি ওয়ালের দিকে টেনে নিচ্ছেন। কারণ বেডটি ছিল জানালা বরাবর। অবিরাম বিকট বিকট গুলির শব্দে, কামানের তোপ ও অন্যান্য আগ্নেয়াস্ত্রের শব্দে আমি দিশেহারা হয়ে প্রায় অজ্ঞান হয়ে থর থর করে কাঁপছিলাম। এমন কাঁপুনি যে, আজহার আমাকে জাপটে ধরেও ঠেকাতে পারছিলেন না। তখনও বুঝতে পারছিলাম না মহাকালের নৃশংস, জঘন্যতম হত্যাকান্ড ঘটছে এই শহরে।
সারাটা রাত আমাদের এভাবেই কাটলো। পরদিন ২৬শে মার্চ সকালে গোলাগুলির আওয়াজ কিছুটা কমে এসেছে, মনে হলো পরিস্থিতি কিছুটা শান্ত। হাসপাতালের তিন তলা কেবিনে অসুস্থ অবস্থাতেই স্পষ্ট বুঝতে পারছিলাম সারাটা শহর যেন দ্রুত থমথমে হয়ে শ্মশানের নিস্তব্ধতায় ভরে উঠেছে। এই সময়ে আজহারের পরনের এ্যাপ্রোনে রক্তের দাগ দেখতে পেয়ে জিজ্ঞাসা করে জানতে পারলাম হাসপাতালে অসংখ্য বুলেটবিদ্ধ, বোমার আঘাতপ্রাপ্ত মুমূর্ষু আহত রোগীতে ভরে গেছে, কোন ওয়ার্ড এমনকি করিডোর বা বারান্দা খালি নাই। হাসপাতালে তখন উপস্থিত ডাক্তারের সংখ্যা খুবই নগণ্য, আজহারসহ সামান্য যে কয়জন ডাক্তার উপস্থিত ছিলেন তাঁরা সবাই মিলে আহতদের অস্ত্রোপচার করে বুলেট বের করতে শুরু করেছেন। আমরা ২৮শে মার্চ ১৯৭১ থেকে ২৪শে মে, ‘৭১ পর্যন্ত পরীবাগের নোওয়া ভাইয়ের বাসায় ছিলাম। এস. টি. এস. মাহমুদ, আমার নোওয়া ভাই তখন ওয়াপদার ইঞ্জিনিয়ার।ওখানে থাকার সময় আজহার একটি ঝুঁকিপূর্ণ, দুঃসাহসিক অথচ মানবিক কাজ করছিলেন যা আমি অনেক পরে জানতে পেরেছিলাম। আজিমপুর কলোনীর ১ নাম্বার বিল্ডিং-এর বি ফ্ল্যাটে ফুড ডিপার্টমেন্টের এক ভদ্রলোকের ছেলে ঝিনাইদহ ক্যাডেট কলেজের দশম শ্রেণীর ছাত্রকে ২৬শে মার্চ সকাল ১০টার দিকে পাক-আর্মিরা কলোনীতে ঢুকে ঐ ১ নাম্বার বিল্ডিং-এর ছাদের কালো পতাকাটি নামিয়ে ফেলার নির্দেশ দেয়। ছেলেটি যখন ঐ কালো পতাকাটি নামানোর জন্য ছাদে ওঠে ঠিক সেই সময় নীচ থেকে আর্মিরা গুলি করে। গুলিটি ছেলেটির পায়ে লাগে।
আহত ছেলেটির গুলি বের করার জন্য অভিভাবকরা হন্যে হয়ে ডাক্তার খুঁজে শেষে ২৭শে মার্চ বুলেটবিদ্ধ ছেলেটির বাবা ডাক্তার পাবার আশায় ঢাকা মেডিকেলে যান এবং উপস্থিত কয়েকজন ডাক্তারকে ঘটনাটি বলে ছেলেটির জীবন বাঁচানোর জন্য কাতর প্রার্থনা করেন। এই কথা শোনামাত্র ডা. আজহার সাথে সাথে রাজী হয়ে ছেলেটির বাবার সাথে গোপনে আজিমপুরে ঐ বাসাতে গিয়ে বুলেটটি অল্পক্ষণের মধ্যেই অত্যন্ত সুচারুরূপে বের করতে সক্ষম হন। এরপর থেকে প্রতিদিন আজহার ছেলেটির ড্রেসিং বদলানোর জন্য খুব গোপনে ঐ বাসায় যেতেন। অল্প কিছুদিনের মধ্যেই ছেলেটি পূর্ণ সুস্থ হয়ে যায়। এখন ছেলেটি মেরিন ইঞ্জিনিয়ার হয়েছে শুনেছি। তার নাম এখন আর মনে নেই। এত বড় একটা ঝুঁকিপূর্ণ ও দুঃসাহসিক কাজ তিনি করলেন সম্পূর্ণই আমার অজ্ঞাতসারে।২৪শে মে, ১৯৭১ বিকেলে আমাদের নিজের বাসায় ফিরে আসি। যুদ্ধ শুরু হবার আগে আজহার বিকেলের দিকে কাজী আলাউদ্দিন রোডের ‘শামীম ব্রাদার্স’ নামের ফার্মেসীতে বসতেন।
যুদ্ধের সময় হাতীরপুলে বাসার কাছেই ‘সাইদা ফার্মেসী’-তে বসা শুরু করলেন। কিন্তু তখন তিনি সব সময়ই অনেক রাত করে বাসায় ফিরতে লাগলেন। দেশের ঐরকম একটা অস্বাভাবিক পরিস্থিতিতে তিনি রোজ দেরী করে ফেরায় আমার ভয়, ঊৎকন্ঠা, উদ্বেগ বেড়ে যেতে থাকে। দেরী করে ফেরা দেখে আমার সব সময়ই মনে হত আজকে নিশ্চয়ই ডাক্তারকে মিলিটারীরা ধরে নিয়ে গেছে। কেন যে একথা আমার বারবারই মনে হতো আজও বুঝি না। তিনি রাতে ফিরে এলে মনে হতো বুক থেকে যেন ভারী পাথর সরলো, ভালো করে নিঃশ্বাস নিতে পারছি। রোজ রোজ দেরী করার কারণ কি জিজ্ঞাসা করলে, – দূরে কলে গিয়েছিলেন বা রোগীর ভীড় ছিল ইত্যাদি অজুহাত দিতেন, কখনও আসল কথাটি বলতেন না। এই ভয়াবহ যুদ্ধের সময় তাঁকে প্রাকটিস না করার জন্য বার বার অনুরোধ করতাম, কত বলেছি, কি দরকার বিকেলে ফার্মেসীতে বসে? না বসলেই কি নয়? উত্তরে তিনি সব সময় হাসতে হাসতে বলেছেন, ‘আমি ডাক্তার মানুষ আমার যা ডিউটি তা তো আমাকে করতেই হবে, রোগীরা কি বিনা চিকিৎসায় মারা যাবে?’ যত নিষেধ করি তত যেন বেশী মেতে যেতে লাগলেন। রোগী দেখা নিয়ে, যেন কোন নেশায় ধরেছে তাঁকে।
যুদ্ধের ভেতর এত রোগীই বা কোত্থেকে আসে একদিন জিজ্ঞেস করতে বললেন, ‘আরে বোঝ না কেন, ডাক্তার কই, বেশীর ভাগই তো এখন এখানে নেই, ডাক্তারের অভাব, তাই্ এত ভীড় মনে হচ্ছে।’ এই ভাবেই উৎকন্ঠা, উদ্বেগ নিয়ে দিন চলতে লাগলো। প্রায়ই রাত করে বাসায় ফিরে নতুন নতুন সংবাদ আমাকে শোনাতেন, বলতেন, আর কয়টা দিন সবুর করো, দ্যাখো না কি হয়, শীগগীরই দেশ স্বাধীন হয়ে যাচ্ছে। মুক্তিযোদ্ধারা অমুক দিন ঢাকা শহরের অমুক জায়গায় হামলা করবে অথবা অমুক তারিখে যুদ্ধ শুরু হয়ে যাচ্ছে ইত্যাদি। মাঝে মধ্যেই অনেক করে চাল, ডাল, তেল, আলু কিনে রাখতেন। একদিন বললেন, ‘১৪ই অক্টোবর যুদ্ধ শুরু হয়ে যাবে, মুক্তিবাহিনীরা এ্যাটাক করবে।’ তার জন্য খাবার কিনে আলাদা করে তুলে রাখলেন। এটা শহীদ হবার মাত্র এক-দেড় মাস আগের কথা। সেই চাল, ডাল সম্পূর্ণ ধরা ছিল, শহীদ হবার পর তা গরীব দুঃখীকে খাওয়ানো হয়েছিল। তিনি বলেছিলেন আমাদের আগত বাচ্চার (আমি তখন প্রথম অন্তঃসত্ত্বা) কাপড়-চোপড় ডেটল দিয়ে ধুয়ে পৃথক একটা সুটকেস রেডী রাখতে, এজন্য দোকান থেকে বাচ্চার জন্য নতুন কাপড়ও কিছু কিনে এনেছিলেন। আরো বলেছিলেন যখন তখন আমাদের এখান থেকে সরে যেতে হবে, এমন কি গ্রামে গঞ্জে যেতে হতে পারে।
এই সব শুনে শুনে আমি অবাক হয়ে বললাম, ‘আপনি এত সব কথা কোত্থেকে পান।’ এর উত্তরে তাঁর স্বভাবসুলভ হাসি দিয়ে বলতেন, ‘আরে, আমার কাছে সব খবরই আসে, লোকে খবর দিয়ে যায়, তুমি আমাকে কি মনে করো?’ এ সমস্ত কথা জোরে জোরে বলে হো হো করে হাসতেন। এত জোরে বলতেন যে, আশে-পাশের বাসার লোকজনও বুঝি শুনতে পেতেন। তখনও আমি এইসব কথার মর্ম বুঝিনি। শহীদ হবার পর সাইদা ফার্মেসীর তখনকার মালিকদের কাছে জানতে পারলাম কেন তিনি অধিক রাত্রে বাসায় ফিরতেন। তারাই আমাকে জানালেন ডাক্তার আহত, বুলেটবিদ্ধ ও অসুস্থ মুক্তিযোদ্ধাদের ডেরায় গিয়ে চিকিৎসা করতেন, বুলেট বের করতেন।মুক্তিযোদ্ধাদের একবার চোখ ওঠা রোগ হয়েছিল, তখন নাকি ডাক্তার ওদের জন্য ভীষণ কষ্ট করে ওষুধ জোগাড় করে নিজ হাতে পৌঁছে দিতেন। হাতীরপুল এলাকাটা ছিল মুক্তিযোদ্ধাদের আখড়া, তাই যত ঔষধ, চিকিৎসা সব আজহার করতেন। তিনি এক সময় আমাকে এও বলেছিলেন, ‘১৪ই অক্টোবর থেকে বুদ্ধিজীবীদের ধরপাকড় শুরু হবে।’ দেখতে দেখতে ১৫ই নভেম্বর সেই অভিশপ্ত দিনটি চলে এলো আমার জীবনে। ঐদিন ভোর পৌনে ৬টায় আমার ঘুম ভাঙল, আমি ডাক্তারের এ্যাপ্রোনটা লন্ড্রী থেকে আনার জন্য কাজের ছেলে শাহাদৎ-কে পয়সা দিলাম। কিছুক্ষণ পর ছেলেটি ফিরে এসে বললো, ‘বেগম সাহেব, এ্যাপ্রোন আনতে পারলাম না, কারফিউ হয়ে গেছে, মিলিটারীরা পুরা হাতীরপুল, সেন্ট্রাল রোড, হাকিম হাউস এলাকা ঘিরে রেখেছে। আমাকে হাত উঁচু করতে বললো এবং বুকে রাইফেল ধরে বললো, তুমি কোথায় যাচ্ছো, কোথায় কাজ করো?’ আমি তাকে জিজ্ঞেস করলাম, ‘ওরা তোমার সাথে কি ভাষায় কথা বলেছে?’ ছেলেটি বললো, ‘বাংলায়’। তখন আমি তাকে বললাম, ‘তুমি রাজাকার দেখেই ভয় পেয়ে গেলে।’ এর পর ওকে শান্ত হতে, বিশ্রাম নিতে বললাম।
এরমধ্যে আমাদের বুয়া চা দিয়ে গেল, আজহারের বেডটি খাওয়ার অভ্যাস ছিল। আমিও চা খেলাম, আমি তখনও বুঝতে পারিনি-তাঁর সাথে এই শেষ বেডটি খাওয়া। এরপরই আমি খুব অস্থির হয়ে উঠলাম ডাক্তার কিভাবে হাসপাতালে যাবেন ভেবে। কারণ আমি জানতাম ও দেখেছি, আজহার খুবই কর্তব্য ও সময়নিষ্ঠ। ঝড়, বৃষ্টি-বাদল, অসুখ-বিসুখ, বিপদ-আপদের মধ্যেও সে হাসপাতালে বা চেম্বারে সময় মত যাবেই যাবে, কখনই এর অন্যথা হয়নি। তাঁর মত কর্তব্যপরায়ণ লোক খুব কমই দেখেছি। এরপর আমরা এক সাথে সকালের নাস্তা খেলাম, সেই ছিল আজহারের জীবনের শেষ খাওয়া। তখন সকাল সাতটা, সেদিন ছিল সোমবার, ২৫শে রমজান। আমরা রোজা ছিলাম না।নাস্তা খেতে খেতে তাঁকে বললাম, ‘আপনাকে আজ হসপিটালে যেতে হবে না।’ তার উত্তরে তিনি বললেন, ‘তোমাকে ফেলে তো এমনি যাব না, হসপিটালে ফোন করি এ্যাম্বুলেন্স পাঠানোর জন্য, যদি এ্যাম্বুলেন্স আসে তবে যাবো।’’সাদা সার্ট ও কালো প্যান্ট পরে স্টেথো নিয়ে আজহার বাড়ীওয়ালার বাসায় গেলেন হাসপাতালে ফোন করতে। আমি আমাদের বারান্দায় দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করছিলাম ফোন করে ডাক্তার ফিরে আসবেন বলে। কিন্তু তিনি ফিরে না এসে বাসার মেইন গেটে এ্যাম্বুলেন্সের জন্য অপেক্ষা করছিলেন। এই একই বাসার তিনতলায় থাকতেন ডা. হুমায়ুন কবীর, তাঁর বোনের বাসায়। ইতিমধ্যে ডা. হুমায়ুন কবীরের ছোট বোন মোমরাজ আমাকে জিজ্ঞেস করলো, ‘ভাবী, ডাক্তার ভাই কি চলে গেছেন?’ আমি বললাম, ‘এখনও যাননি, হসপিটালে ফোন করার জন্য বাড়ীওয়ালা হাকিম সাহেবের বাসায় গেছেন, এ্যাম্বুলেন্স যদি আসে তাহলেই যাবেন, না হলে যাবেন না।’ এই কথা শুনে ডা. হুমায়ুন কবীরও প্রস্তুত হলেন আজহারের সাথে এ্যাম্বুলেন্স করে হসপিটালে যাবার জন্য।
সেদিনই ছিল ডা. হুমায়ুন কবীরের ইন্টার্নশিপের প্রথম দিন। হুমায়ুন কবীরও রেডী হয়ে গেটে এসে দাঁড়ালেন। গেট থেকে বের হয়ে সামনে যাওয়া যাচ্ছিল না, আলবদররা কর্ডন করে রেখেছিলো বলে। হয়ত ডাক্তাররা ভেবেছিলেন এ্যাম্বুলেন্স ভেতরে গেটের কাছে এলে তাঁরা রওয়ানা দেবেন। কিন্তু আল-বদররা এ্যাম্বুলেন্স থামিয়ে চেক করে ওরা ফেরৎ পাঠিয়ে দেয়। পরে বিভিন্ন প্রত্যক্ষদর্শী দোকানীর কাছ থেকে ঘটনাটা জানতে পেরেছিলাম।আমি ও আমার ভাই সৈয়দ রফিকুস সালেহীন মনে করেছি এ্যাম্বুলেন্স এসেছে ও আজহার, হুমায়ুন কবির নিশ্চয়ই হসপিটালে চলে গেছেন। আমরা এই বিষয়টিই আলোচনা করছিলাম। হঠাৎ দেখি আমাদের বারান্দায় ৫ জন লোক ঢুকছে, এর মধ্যে ৪ জনের গাঢ় জলপাই রঙের পোষাক, মাথায় ক্যাপ ও হাতে বেয়োনেট লাগানো রাইফেল। সিভিল ড্রেসে একজন লোক, চোখে কালো গগলস, তার হাতে কোন অস্ত্র ছিল না, এই ব্যক্তিই আসসালামালাইকুম দিল, আমি ও আমার ভাই তাড়াতাড়ী রুম থেকে বারান্দায় এসে দাঁড়ালাম, ওরা আমাদের বুক বরাবর রাইফেল তাক করে জিজ্ঞাসা করলো, ‘ডা. হুমায়ুন কবিরকে চেনেন?’ আমি তাঁকে বাঁচানোর জন্য বললাম, ‘না, চিনি না।’ তখন ওরা আমার ভাইকেও জিজ্ঞাসা করলো চেনেন কিনা, তিনিও ‘না’ বললেন। এরপর ওরা আমাকে জিজ্ঞাসা করলো, ‘আপনার হাসবেন্ডের নাম কি? তিনি কি করেন?’ আমি তাঁর নাম ও পেশা বললাম। মেডিকেলে চাকুরী করে শুনে কত নাম্বার রুমে বসেন, কোন ডিপার্টমেন্টে আছেন ইত্যাদি জিজ্ঞেস করলো, আমি সব ঠিক ঠিক জবাব দিলাম। শেষে তারা জিজ্ঞাসা করলো, ‘এখন উনি কোথায়?’ বললাম, ‘হসপিটালে।’ এই কথা শুনে একজন রাইফেলধারী অন্য একজন রাইফেলধারীর চোখা-চোখি করলো এবং একটু মৃদু হাসলো। এরপর ওরা ঘরে ঢুকে চেয়ারের গদি কয়েকটা উল্টিয়ে দেখে চলে গেল, যাবার সময় বললো, ‘ডোন্ট মাইন্ড।’
হাকিম হাউসের আর কোন ফ্ল্যাটে বা বাসায় তারা তল্লাশী করলো না বা গেলোও না। ওরা চলে যাবার পর পরই কারফিউ উঠে গেল এলাকার, আমি তখনই তিনতলায় ডা. হুমায়ুন কবীরের বোনের বাসায় দৌড়ে গেলাম ওদের সাবধান করবার জন্য। এও বলে এলাম হুমায়ুন কবীর যেন আজ রাতে বাসায় না ফেরেন। এমন সময় পাশের ফ্ল্যাটের ভাড়াটে মজিলা জাভিনের আম্মা এসে আমাকে বললেন, ‘ভাবী, সবাই বলাবলি করছে, ডাক্তার ভাইকে নাকি ওরা ধরে নিয়ে গেছে।’ এই কথা শোনা মাত্র আমার শরীরে যেন বিদ্যুৎ বয়ে গেল, আমি যেন বোবা হয়ে গেলাম, কিছুতেই কথাগুলো বিশ্বাস হলো না। আমি সাথে সাথে নীচে বাসায় চলে এসে আমার ভাই সালেহীনকে বললাম। শুনে তিনিও বিশ্বাস করলেন না। আমি আতঙ্কে অস্থির হয়ে পড়লাম, কি করতে হবে না হবে কিছুই বুঝে উঠতে পারছিলাম না। ইতোমধ্যে হাসপাতাল থেকে মান্নান নামের একজন পিয়ন এসে খবর দিল আজহার এখনও পৌঁছায়নি, তখন বেলা সাড়ে এগারটা হবে। আমার মাথায় যেন আকাশ ভেঙ্গে পড়লো, পায়ের নীচ থেকে মাটি সরে যেতে লাগলো। সারা ‘হাকিম হাউস’ এলাকায় বিদ্যুতের মত কথাটা ছড়িয়ে পড়লে সবাই বিষাদক্লিষ্ট, কালো মুখ নিয়ে জড়ো হতে লাগলো।
আমার ভাই সাথে সাথে ‘সাইদা ফার্মেসী’-এর মালিকদের খবরটা দিলেন ও বাড়ীওয়ালার ফোনে মগবাজারে বড় দুলাভাই ও অন্যান্য ভাইদের জানালেন। শুরু হয়ে গেল খোঁজ করার জন্য ছোটাছুটি। আমার ভাই ও দুলাভাই হাসপাতালে গিয়ে দেখেন কে বা কারা যেন ডাক্তারদের দৈনিক উপস্থিতির হাজিরা খাতায় আজহারের নামের পাশে ‘পি’ অর্থাৎ প্রেজেন্ট লিখে রেখেছে। সাথে সাথে এই আশ্চর্যজনক ব্যাপারটা হাসপাতাল কর্তৃপক্ষের দৃষ্টিগোচর করা হলে সুপার নিজে কেটে দিলেন। এদিকে আশে-পাশের বাসা ও দোকানীদের কাছ থেকে নানা কথা আসতে শুরু করলো,- আমাদের বাসার গেটের কাছে যে তেঁতুল গাছটি সেখানে দাঁড়িয়ে আজহার ও হুমায়ুন কবীরের সাথে আল-বদররা কথা বলছিলো, সামনের তিনতলা বিল্ডিং-এর ভাড়াটে ভদ্রলোক উপর থেকে সব প্রত্যক্ষ করেছেন; এ দৃশ্য ঝাঁপ- ফেলা কয়েকজন দোকানীও ঝাঁপের ফুটো দিয়ে দেখেছেন, কিন্তু দূরত্বের জন্য কি কথাবার্তা হচ্ছিল তা আর কেউ বুঝতে পারেননি। তবে এক পর্যায়ে আজহার তেঁতুল গাছে হাত ঠেস দিয়ে যখন কথা বলছিলেন তখন ওরা ডাক্তারের হাতের ডানায় রাইফেল দিয়ে বাড়ি মারে এবং ডাক্তার তখন থতমত খেয়ে ও হতভম্ব হয়ে সোজা হয়ে দাঁড়ায় এবং মুখটা নাকি ফ্যাকাশে হয়ে যায়।
সাথে সাথে কয়েকজন এসে সামনে, পিছনে রাইফেল তাক করে ওঁদের দু’জনকে তেঁতুল গাছের তলা থেকে হাতিরপুল পর্যন্ত হাঁটিয়ে নিয়ে গিয়ে একটি জীপ গাড়ীতে তোলে। সেই গাড়ীতে নাকি হাতিরপুল এলাকার আজিজ ওয়ার্কশপের মালিক খান নামে পরিচিত বিহারী লোকটি ছিল, সেই লোকই নাকি সে সময় দালালি করতো।ডাক্তারের ও আমার আত্মীয়-স্বজন ভাই বন্ধু সবাই ডাক্তারের খোঁজে যে যেখানে পারে হন্যে হয়ে চারিদিকে বেরিয়ে পড়লেন, সময় কি ভাবে গড়িয়ে যেতে লাগলো জানি না। আমার কেবলই মনে হচ্ছিল, এই বুঝি ডাক্তার ফিরে এলেন। কিন্তু না, সন্ধ্যা হলো, রাত হলো, গভীর রাত হলো, না ডাক্তারের ফেরার লক্ষণ দেখা গেল না। এরই মধ্যে আমার ইঞ্জিনিয়ার ভাই আমাকে তাঁর পরীবাগের বাসায় নিয়ে গেলেন। সারারাত আমি ডাক্তারের ফিরে আসার আশায় অপেক্ষা করলাম এক বুক অজানা আতঙ্ক, আশঙ্কা নিয়ে। বাসায় কারো মুখে কথা ছিল না, ঘুম ছিল না কারো চোখে। কখন যেন ভোর হলো, ১৬ই নভেম্বর ১৯৭১ সাল। মনে হচ্ছিল, এই বুঝি আজহার ফিরে এলেন-প্রতীক্ষা, দুরু দুরু বুকে আশা নিয়ে প্রতীক্ষা করছি। কিন্তু হায়। এরই মধ্যে নিয়তির যা লিখন তা লেখা হয়ে গেছে; আমি জানি না। আমার ভাই-বোনরা ১৬ই নভেম্বর সকালেই সবাই জেনে গেছে চরম খবরটা। শুধু আমাকে জানানো হয়নি। ততক্ষণে ডা. আজহার ও ডা. হুমায়ুন কবীরের হাত-পা, চোখ বাঁধা, শুধু জাঙ্গিয়া পরা নিথর, নীরব তর-তাজা দেহ দু’টি নটরডেম কলেজের সামনের কালভার্টের নীচ থেকে তুলে ঠেলা গাড়ীতে করে তাঁদেরই প্রিয় শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান/ কর্মস্থল ঢাকা মেডিকেল কলেজের মর্গে রাখা হয়েছে। আমাকে শুধু ধৈর্য ধরতে বলা হচ্ছে। সকাল থেকেই ডাক্তারের ভাই, বোন, আত্মীয়-স্বজন একে একে এসে বাসা ভরে গেছে কারও মুখে কোন কথা নেই।
আমি তখন শুধু থর থর করে কাঁপছি আর কাঁদছি ও বলছি, ‘তোমরা কেউ কোন কথা বলছো না কেন? আমার সামনে কেউ আসছো না কেন?’ সবাই আমাকে দেখে যেন মুখ লুকাচ্ছিলো। মুরব্বীরা কেউ কেউ ‘ছবর করো, ছবর করো’ বলছিলেন। আমি বলছিলাম, ‘কেন ছবর করবো? ছবর তো মানুষ মরে গেলে করতে বলে, তবে আমাকে কেন একথা বলা হচ্ছে?’ এই রকমভাবেই সকাল থেকে বিকেল পর্যন্ত গেল। শেষে ইফতারের ও মাগরীবের কিছু আগে আমাকে আমার জীবনের সবচেয়ে কঠিন, সবচেয়ে নিদারুণ সবচেয়ে সত্যি কথাটি আমার বড় ননদ মনোআপা (মিসেস মনোয়ারা ইসলাম) শুনালেন,…তাঁদের ভাই ‘শহীদ’ হয়ে গেছেন। মুহূর্তেই কানে এলো, ডেডবডি আমার এক নজর দেখার জন্য নীচে সিঁড়ির গোড়ায় অপেক্ষায় আছে। ঠিক বুঝে উঠতে পারছিলাম না কি হচ্ছে বা হয়েছে, মাথাটা বোঁ বোঁ করে ঘুরে চোখে কেমন যেন আঁধার দেখছিলাম, সবকিছু বোঝার আগেই দেখতে পেলাম আমাকে ধরাধরি করে দোতলায় সিঁড়ির প্রান্তে আনা হলো, আমি উপর থেকে নীচে দেখলাম খাটিয়ায় শ্বেত, শুভ্র বসনে শায়িত সদা কর্মব্যস্ত, চঞ্চল, হাস্য-উৎফুল্ল মানুষটি পরম নিশ্চিন্তে ঘুমাচ্ছেন। আমি যেন স্বপ্ন দেখছিলাম, নিজের চোখকে বিশ্বাস হচ্ছিল না।
কিন্তু হায়! কাছ থেকে আমাকে কেউ দেখতে দিল না, দূর থেকে এক ঝলক দেখিয়েই ওরা নিয়ে গেল, সন্ধ্যা ঘন হয়ে আসছে,- কারফিউ হয়ে যেতে পারে তাই তড়িঘড়ি করে ওরা আমাকে ভাল করে না দেখতে দিয়েই আজহারকে নিয়ে গেল, চিরদিনের মত নিয়ে গেল-আমি শেষ দেখাটা ভালো করে দেখতেও পেলাম না। শুনেছি নরপশুরা ডাক্তারকে কোন গুলি খরচ করে নয়, এমনকি বেয়নেট দিয়েও নয়, শুধু পিটিয়ে শ্বাসরোধ করে হত্যা করেছিল,-এই কি সহ্য করা যায়? কি যন্ত্রণা, কি কষ্টই না দিয়ে ওঁর তরতাজা ৩১ বছরের জীবনটা বের করেছে। শেষ হয়ে গেল সব, ধুলিসাৎ হয়ে গেল আজহারের স্বপ্ন, কত কল্পনা ছিল, কত সাধ ছিল, ডাক্তার বড় হবে, আরও বড় হবে, আমাদের ছেলে হবে, সংসার হবে, কিন্তু সব কিছুই অসমাপ্ত থেকে গেল, অপূর্ণ রয়ে গেল, শুরু হল আমার জীবনে অমানিশার অন্ধকার, ভবিষ্যতহীন ভবিষ্যতের। ডাক্তার হারিয়ে যাবার পর ভাল করে আমি কাঁদতেও পারিনি, বুক ফাটা কান্না করারও উপায় ছিল না। ওয়াপদা কলোনী ভাইয়ের বাসার পাশেই ছিল শাহবাগ রোড, ঐ রাস্তা দিয়ে সারাক্ষণ অনবরত মিলিটারী জীপ আসা-যাওয়া করতো। আমার ভাই জোরে কান্না শুনলে বলতেন, ‘এখানে ডেডবডি আনা হয়েছিল তা অনেকেই জানে, আবার কান্না-কাটি শুনলে ওরা এসে আমাদের সবাইকে উঠিয়ে নিয়ে মেরে ফেলতে পারে।’ তাই শত দুঃখ, শত কষ্ট বুকের মাঝেই অতি যন্ত্রণায বেঁধে রাখতে হয়েছে।
এই চাপা কষ্ট নিয়েই দিন গড়িয়ে যেতে লাগলো, অবশেষে ঠিক এক মাস পর এলো বিজয়ের সেই ১৬ই ডিসেম্বর। আসন্ন ভয়াবহ যুদ্ধের আশঙ্কায় নিরাপদ স্থানের জন্য আমরা পরীবাগ থেকে আমার ভাইয়ের সাথে ইস্কাটন গার্ডেনে দুলাভাইয়ের খালার বাসায় অপেক্ষাকৃত নিরাপদ ভেবে আশ্রয় নিয়েছিলাম। ১৬ই ডিসেম্বর যখন প্রথম আমি নিজ কানে দূর থেকে ‘জয় বাংলা’ ধ্বনি শুনতে পেলাম তখন আমার মনপ্রাণ তোলপাড় করে কান্নার ঢল নেমে এলো, সবচেয়ে বেশী প্রাণ খুলে ঐ সময় কাঁদলাম। তখনই আমি বেশী করে বুঝতে পারলাম ডাক্তার নেই। আমার হৃদয় ছিঁড়ে যাচ্ছিল এই ভেবে মাত্র ১টি মাসের জন্য ডাক্তারকে হারালাম, মাত্র কয়েকটি দিনের ব্যবধানে দেশ স্বাধীন হলো, অথচ ডাক্তার দেখতে পেলো না। সবাই কত আনন্দ করছে, কিন্তু আমি সহ্য করতে পারছিলাম না। স্বাধীনতা যদি আরও দেরী করে, অনেক দেরী করে আসতো তবে হয়ত আমার কষ্টটা, জ্বালাটা বোধ হয় কিছুটা লাঘব হতো।১৮ই ডিসেম্বর ইস্কাটন গার্ডেন থেকে আবার ভাইয়ের পরীবাগের বাসায় ফিরছিলাম, রাস্তায় দেখলাম, শুধু ইন্ডিয়ান আর্মির গাড়ী আর শুধু প্রাইভেট কার, পিক-আপ পেছনে গাদা-গাদী করে মালপত্র নিয়ে গাড়ীগুলি এদিক থেকে ওদিকে ছুটে চলেছে। আমি তখন অনুভব করলাম, এখন তো ফেরার পালা, সবাই এখন যার যার ঘরে, সংসারে ফিরে যাচ্ছে, কিন্তু আমি যাচ্ছি কোথায়? আমি তো আমার সংসারে ফিরে যেতে পাররাম না।
এরপর স্বাধীনতার ঠিক একমাস পর ১৪ই জানুয়ারী ১৯৭২ সালে আমাদের অতি আকাঙ্খিত একমাত্র পুত্র সন্তান আশরাফুল হক নিশাত রাত সাড়ে ন’টায় জন্মগ্রহণ করলো। ডাক্তারের হারিয়ে যাওয়ার ঠিক দুই মাস পর এলো ডাক্তার ও আমার সবচেয়ে আদরের ধন নিশান, কিন্তু ডাক্তারের ভাগ্যে তা আর দেখা হলো না।ডা. আজহারুল হক ১৯৪০ সালের ২রা মার্চ ঢাকায় জন্মগ্রহণ করেন। বাবা মরহুম জহুরুল হক, মা মরহুমা ফাতেমা খাতুন। আদিবাড়ী পশ্চিমবঙ্গের নদীয়া জেলায়। মাত্র ২ বছর বয়সেই আজহার পিতৃহারা হন। তাঁর বাবা ঢাকা সেন্ট্রাল জেলে জেলার থাকার সময় ওখানেই তাঁর জন্ম হয়। ৭ ভাই, ৪ বোনের বৃহৎ সংসারে আজহারকে অত্যন্ত আর্থিক দৈন্য-দশায় মধ্যে লেখা-পড়া শিখতে হয়েছে। বড়ভাই জনাব আনোয়ারুল হকের কর্মস্থল নোয়াখালী, সিলেট, চিটাগাং, বরিশালসহ ঢাকাতে আজহারের স্কুলজীবন কেটেছে। ছোটবেলা থেকেই তিনি খেলাধুলায় ভীষণ মেতে থাকতেন, বিশেষ করে ফুটবল ছিল তাঁর প্রিয় খেলা। ভালো খেলোয়াড় হিসাবে তিনি বহু কাপ, মেডেল ও শিল্ড পেয়েছেন – যা আজও তার স্বাক্ষর বহন করে। খেলাধুলা ছাড়াও তিনি ভালো গান গাইতে পারতেন এবং অভিনয়ও করতেন। স্কুল, কলেজে বিভিন্ন অনুষ্ঠানে তিনি অংশগ্রহণ করতেন। সিলেটে থাকার সময় তিনি বহু নাটকে অভিনয় করেছেন। অত্যন্ত সহজ-সরল সাদা-সিধে মানুষ ছিলেন তিনি। তিনি এত বিনয়ী ছিলেন যে, কখনও কারো সাথে ‘আপনি’ ছাড়া ‘তুমি’ করে কোনদিন কথা বলেননি।
তাঁর কর্মস্থলে তৃতীয় ও চতুর্থ শ্রেণীর কর্মচারীদের মধ্যে তিনি খুবই জনপ্রিয় ছিলেন, আজও তাদের কারও কারও সাথে আমার দেখা হলে কান্না-জড়িত কন্ঠে তাঁকে স্মরণ করে। তিনি কোন রিকসাওয়ালাকেও পর্যন্ত ‘তুমি’ বলে সম্বোধন করতেন না। তিনি গরীব, দুঃখীদের জন্য বিনা পয়সায় চিকিৎসা করতেন। বহু রিকসাওয়ালা বস্তিবাসী তাঁর ভক্ত ছিল। তাঁর লাশ পাওয়ার খবর ছড়িয়ে পড়ার সাথে সাথে ১৬ই নভেম্বর হাতীরপুলের বাসায় বহু বস্তির লোক, রিকসাওয়ালা, দিন-মজুর, বাসার কাজের লোক কাঁদতে কাঁদতে ভীড় জমিয়েছিল। ছোট-বড় সবার সাথেই তিনি অতি সহজেই মিশতে পারতেন, তাঁর মিষ্টভাষীর কথা আজও সবাই বলাবলি করেন। অত্যন্ত প্রাণ-উজ্জ্বল ও চঞ্চল প্রকৃতির ও কঠোর পরিশ্রমী ছিলেন, ক্লান্ত হওয়া খুব একটা দেখিনি। গভীর রাত পর্যন্ত মেডিকেলের বই-পত্র নিয়ে পড়াশোনা করতেন, -সারাদিন হাড়ভাঙা পরিশ্রমের পরও। কারণ বিলেতে গিয়ে বড় ডিগ্রী আনার তাঁর স্বপ্ন ছিল, টাকা- পয়সা উপার্জনের দিকে কোন ঝোঁক ছিল না, একবার সৌদি আরবে তাঁর চাকুরী হওয়ার কথা হয়েছিল, কিন্তু তিনি লেখাপড়ার জন্য বিলেতে যাবার ব্যাঘাত ঘটবে বলে যাননি।
তিনি ১৯৬৮ সালে সলিমুল্লাহ মেডিকেল কলেজ থেকে এম.বি.বি.এস. পাশ করেন। খুব ভাল রেজাল্ট করেছিলেন তিনি। সার্জারীতে তাঁর খুব ভাল হাত ছিল। এরপর ১ বছর ইন্টার্নী করে, ১৯৬৯ সালে ২৬শে জুন ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে যোগদান করেন। তিনি গান শুনতে খুব ভালবাসতেন। দেশী খাবারই তাঁর প্রিয় ছিল, ইলিশ মাছ, গরুর মাংস প্রিয় কাবার।
লেখক : সৈয়দ সালমা হক; ‘স্মৃতি:১৯৭১’, দ্বিতীয় খন্ড, প্রথম প্রকাশ-১৯৮৯, সম্পাদনা-রশীদ হায়দার।