ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের আবাসিক এলাকা। ৩৪ নম্বর ভবনের মূল গেইটের কাছে এলোমেলো পড়ে আছে চারটি মৃতদেহ। সমস্ত ভয়, দ্বিধা-দ্বন্দ্ব উপেক্ষা করে এই চারটি মৃতদেহের পাহারাদার হয়ে ভবনের সিঁড়িতে বসে আছে বার বছরের একটি বালক। যেন তার আর কিছু করার নেই। বাবা-ভাই-চাচার মৃত্যুতে কাঁদতে নেই। এই চারজনের কাতারে তারও থাকার কথা ছিল। কারণ ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চের সেই কাল রাতে পাকসেনারা বাবা-ভাই-চাচার সাথে তাকেও ধরে এনেছিল হত্যা করার জন্য। কিন্তু চারজনকে হত্যার পর যখন শেষে তার পালা আসে, তাকেও গুলি করা হবে, তখন একজন পাকসেনা ছোট বলে তাকে ছেড়ে দেয়। সে প্রথমবারের মতো বেঁচে যায়।
২৬ মার্চ সকালে সৈন্যরা চারটি মৃতদেহসহ তাকে সঙ্গে নিয়ে জগন্নাথ হলের মাঠের দিকে যায়। জগন্নাথ হলে আটকে রাখা ১৫/২০ জন ছাত্রকে দিয়েই সব মৃতদেহ টানানো হয়। তাদেরকে দিয়েই কবর খোঁড়ানো হয়। মৃতদেহগুলোকে একসাথে কবর দেয়ার পর যারা কবর খুঁড়েছিল তাদেরকে আবার লাইনে দাঁড় করানো হয়। এবার এদেরকেও হত্যা করা হবে। তারপর যথারীতি এক এক করে সবাইকে ব্রাশফায়ার করা হয়। গুলি খাওয়ার পরও সেই কাতার থেকে প্রাণ নিয়ে ফিরে আসতে পেরেছিলেন তিনজন। এই লাইনেও সেই বার বছরের ছেলেটি ছিলো। কিন্তু ছোট বলে এবারো পাকসেনারা তাঁকে ছেড়ে দেয়, বেঁচে যায় সে।
এই বার বছরের ছেলেটি হলো শহীদ বুদ্ধিজীবী অধ্যাপক এ.এন.এম মুনীরউজ্জামানের ছোট ছেলে জাকারিয়া মাসুদ। যাঁর চোখের সামনেই বাবা মুনীরউজ্জামান, দুই ভাই ও চাচাকে হত্যা করা হয়।
১৯৪৮ সালে জাকারিয়া মাসুদের বাবা এ.এন.এম মুনীরউজ্জামান প্রভাষক হিসাবে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের গণিত বিভাগে যোগদান করেন। তখন পর্যন্ত পরিসংখ্যান বিষয়টিকে গণিতের একটি পার্ট হিসাবে পড়ানো হতো। ১৯৪৯ সালেই মুনীরউজ্জামানের প্রচেষ্টায় পরিসংখ্যান বিষয়ে মাস্টার্স ডিগ্রী কোর্স খোলা হয়। ১৯৫০ সাল থেকেই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পরিসংখ্যান বিভাগ স্বতন্ত্র বিভাগ হিসাবে প্রতিষ্ঠিত হয়। ১৯৬১ সালে তিনি রিডার (এসোসিয়েট প্রফেসর) হিসাবে পদোন্নতি পান। ১৯৬৭ সালে তিনি বিভাগীয় চেয়ারম্যানের দায়িত্ব পালন করেন। একটানা প্রায় ২৩ বছর তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যাপনা করেন। বাংলাদেশের পরিসংখ্যান বিদ্যায় তিনি পালন করেছেন পথিকৃৎ-এর ভূমিকা। তাঁকে বলা হয় ‘লগ পাইওনিয়ার’।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকতা শুরুর পর এ.এন.এম মুনীরউজ্জামান প্রথমে জহুরুল হক হলের (সাবেক ইকবাল হল) উত্তরে একটা বাংলোতে থাকতেন। এরপর তিনি শহীদ মিনারের পিছনে ৩৪ নম্বর ভবনের ৩৪/ই নাম্বার ফ্ল্যাটে পরিবার নিয়ে বসবাস শুরু করেন। ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ টিএসসি থেকে সেনাবাহিনীর একটি ট্রুপ রাত আনুমানিক সাড়ে বারোটার দিকে বেরিয়ে যায় শহীদ মিনার এলাকায় অবস্থিত শিক্ষকদের আবাসিক কোয়ার্টারের দিকে। পাকসেনাদের কয়েকটি গাড়ি রাতের নিস্তব্ধতা বিদীর্ণ করে ৩৪ নম্বর ভবনের সামনে এসে দাঁড়ায়। প্রায় শ’খানেক সশস্ত্র পাকসেনা। তারা প্রথমেই লাথি মেরে ভবনের মূল গেইট ভেঙ্গে ফেলে। সেনাবাহিনীর একজন অফিসার একটি হ্যান্ডমাইকে তিনজন শিক্ষকের নাম ঘোষণা করে এবং তাদেরকে বেরিয়ে আসতে বলে। এই তিনজন শিক্ষক হলেন, পরিসংখ্যান বিভাগের এ. এন. এম মুনীরউজ্জামান, ইংরেজী বিভাগের অধ্যাপক ড. জ্যোতির্ময় গুহ ঠাকুরতা, দর্শন বিভাগের গোবিন্দ চন্দ্র দেব (জে.সি. দেব)। যদিও অধ্যাপক ড. জে. সি. দেব তখন সেখানে থাকতেন না।
পরপর তিনবার এভাবে নাম ঘোষণা করার পর, পাকসেনারা একটু অপেক্ষা করে কেউ বেরিয়ে আসছে কিনা দেখার জন্য। কিন্তু যখন দেখল কেউ বেরিয়ে আসছে না, তখন পাকসেনাদের একটি দল সরাসরি উঠে যায় ওই ভবনের তৃতীয় তলায় অর্থাৎ ৩৪/ই নম্বরের ফ্ল্যাটে। এই ফ্ল্যাটেই থাকেন অধ্যাপক এ. এন. এম. মুনীরউজ্জামান। পাকসেনারা লাথি মেরে দরজা ভেঙ্গে তাঁর ঘরে ঢুকে যায়। ফ্ল্যাটে তখন ছিলেন মুনীরউজ্জামান, তাঁর স্ত্রী সৈয়দা মাহমুদা জামান, বড় ছেলে আকরামুজ্জামান, একমাত্র মেয়ে লুলু নাসরিন, ছোট ছেলে জাকারিয়া মাসুদ, ছোট ভাই অ্যাডভোকেট শামসুজ্জামান, এক বোন রিজিয়া ওয়াহাব ও বোনের ছেলে সৈয়দ নাসিরুল ওয়াহাব। বোন ও ভাগ্নে কয়েকদিন আগেই অধ্যাপক মুনীরউজ্জামানের বাসায় বেড়াতে এসেছিলেন।
ঘরের ভিতর ঢুকেই অধ্যাপক মুনীরউজ্জামানের কাছে একজন পাকসেনা বেশ কয়েকবার তাঁর পরিচয় জানতে চান। মুনীরউজ্জামান প্রতিবারই তাঁর নাম ও পরিচয় বলেন। পাকসেনারা তাদের টার্গেট সম্পর্কে নিশ্চিত হয়ে যায়। তারপর আর কোনো কথা বলেনি বা সময় নেয়নি তারা। পরিবারের পাঁচজন পুরুষ সদস্যকে ধরে ভবনের নিচ তলায় নিয়ে আসে। প্রথমে অধ্যাপক মুনীরউজ্জামানকে তারা মাটিতে বসতে বলে। কিন্তু মাটিতে বসতে অস্বীকৃতি জানান তিনি। তখন পাকসেনারা তাঁর পায়ে বেয়নেট দিয়ে আঘাত করে। এরপরই মুনীরউজ্জামানকে মাথায় রাইফেল ঠেকিয়ে গুলি করা হয়। তারপর একে একে গুলি করে এ্যাডভোকেট শামসুজ্জামান, আকরামুজ্জামান এবং সৈয়দ নাসিরুল ওয়াহাবকে। এদের সবাইকে বুকে গুলি করে একজন পাকসেনা। চারজনই মাটিতে লুটিয়ে পড়েন।
অধ্যাপক মুনীরউজ্জামানের জন্ম ১৯২৪ সালে ঝিনাইদহ জেলার কাচেরখোল গ্রামের এক অভিজাত মুসলিম পরিবারে। তাঁর পিতার নাম মৌলভী মোহাম্মদ মুসা। তিনি ছিলেন ডিস্ট্রিক্ট ম্যাজিস্ট্রেট। মা শামসুন্নেছা খাতুন। মুসা-শামসুন্নেছা দম্পতির দুই ছেলের মধ্যে মুনীরউজ্জামান ছিলেন সবার বড়। ছোট ছেলে নুরুজ্জামান। যিনি পরে ড. হাসানজ্জামান হিসাবে পরিচিত হন। তিনিও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষক ছিলেন। খুব অল্প বয়সেই মুনীরউজ্জামান তাঁর মাকে হারান। পরে মৌলভী মোহাম্মদ মুসা পুনরায় বিয়ে করেন।
মুনীরউজ্জামানের শিক্ষা জীবন শুরু হয় কাচেরখোল বেণীপুর বিদ্যালয়ে। এখানে তিনি বছর দেড়েকের মতো পড়াশুনা করেন। পরে চলে যান নড়াইলে। সেখানেও কিছুদিন পড়ার পর পিতার চাকরিগত কারণে কলকাতায় চলে যান। সেখানেই তাঁর শিক্ষা জীবন অতিবাহিত হয়। মুনীরউজ্জামান ১৯৪০ সালে কলকাতা থেকে মেট্রিক পাশ করেন। ১৯৪২ সালে কলকাতার ইসলামিয়া কলেজ থেকে ইন্টারমিডিয়েট পাশ করেন। কলকাতার প্রেসিডেন্সি কলেজ থেকে গণিতে গ্রেজুয়েশন ডিগ্রী লাভ করেন ১৯৪৪ সালে এবং কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ১৯৪৬ সালে পরিসংখ্যানে মাস্টার্স ডিগ্রী লাভ করেন।
বিশ্ববিদ্যালয়ের গন্ডি পেরিয়েই প্রবেশ করেন চাকরি জীবনে। কলকাতার ইন্ডিয়ান স্ট্যাটিস্ট্রিক্যাল ইন্সটিটিউশনে কিছুদিন কাজ করেন। এরপর তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে যোগ দেন এবং তাঁর অক্লান্ত প্রচেষ্টায় ১৯৫০ সাল থেকেই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পরিসংখ্যান বিভাগ স্বতন্ত্র বিভাগ হিসাবে প্রতিষ্ঠিত হয়। কাজী মোতাহার হোসেন প্রথমে পদার্থ বিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক ছিলেন। পরে তাঁকে নিয়েই পরিসংখ্যান বিভাগ খোলা হয়। অধ্যাপক মুনীরউজ্জামানের চাইতে অধ্যাপক কাজী মোতাহার হোসেন যথেষ্ট সিনিয়র শিক্ষক ছিলেন। কাজী সাহেবকে সামনে রেখেই মুনীরউজ্জামান সব কাজ করতেন। পরিসংখ্যান বিভাগের প্রতিষ্ঠাকালীন সময় থেকেই তিনি অক্লান্ত পরিশ্রমের মধ্য দিয়ে একে গড়ে তোলেন। সহকর্মীদের বলতেন, এই ডিপার্টমেন্ট আমাদের সবার। তাই ডিপার্টমেন্টের উন্নতির জন্য সবাইকে একসাথে কাজ করতে হবে। সে সময় শিক্ষকরা সপ্তাহে ৩০-৩৫টা ক্লাস পর্যন্ত নিতেন। মুনীরউজ্জামান ছিলেন ডায়াবেটিকস-এর রোগী। নিয়মিত ইনসুলিন নিতে হতো তাঁকে। কিন্তু ডিপার্টমেন্টে আসতেন সকাল নয়টায়। সকালে ক্লাস ও প্রসাশনিক কাজকর্ম করতেন। দুপুরের খাবার আসত বাসা থেকেই। বিকেল থেকে শুরু করতেন নিজের গবেষণা ও পড়াশুনার কাজ। বাসায় ফিরতেন অনেক রাত্রে। বাসায় ফিরেও বই-পুস্তক নিয়ে বসতেন গবেষণার কাজে। একজন একাডেমিসিয়ান হিসাবে যে পরিমাণ পরিশ্রম তিনি করতেন তা ছিল ধারণাতীত।
অধ্যাপক এ. এন. এম. মুনীরউজ্জামান শিক্ষকতার পাশাপাশি গবেষণামূলক কাজেও বিপুল প্রশংসা কুড়িয়েছেন। তাঁর মৌলিক বই ও গবেষণা পত্রের সংখ্যা ১৭টি। যা বিশ্বের নামি গবেষণা পত্র-পত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছে। তাঁর কিছু বই এখনো পশ্চিমা বিশ্বে গুরুত্বের সাথে পড়ানো হয়। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে অবস্থিত ইন্সটিটিউট অব স্ট্যাটিস্ট্রিক্যাল রিসার্চ এন্ড ট্রেনিং-এর তিনি ছিলেন প্রধান উদ্যোক্তা। এছাড়াও তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সোসিও-ইকোনমিক সার্ভে বোর্ডের (বর্তমান নাম ব্যুরো অব ইকোনমিক রিসার্চ) প্রতিষ্ঠাতাদের অন্যতম। জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত তিনি এই প্রতিষ্ঠানের সার্ভে ডিজাইনার, পরিসংখ্যান উপদেষ্টা এবং গবেষক হিসাবে দায়িত্ব পালন করে গেছেন।
তাঁর ছাত্রদের মধ্যে অনেকেই আজ সমাজের বিভিন্ন ক্ষেত্রে প্রতিষ্ঠিত। তারা স্বপ্রতিভায় ভাস্বর। এদের মধ্যে কেউ কেউ পরে একই বিভাগে মুনীরউজ্জামানের সহকর্মীও হন। তাদের মধ্যে অন্যতম অধ্যাপক ড. এম. নুরুল ইসলাম। শহীদ অধ্যাপক মুনীরউজ্জামানের স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে তিনি বলেন, ‘আমাদের সময় ছাত্র-শিক্ষকদের মধ্যে গভীর শ্রদ্ধার সম্পর্ক ছিল; দূরত্বও ছিল। তিনি ছিলেন সৌম্য ও শান্ত। সাদা শার্ট ও সাদা প্যান্টের সাথে কালো টাই ব্যবহার করতেন। প্রতিদিন একই ধরনের পোষাকেই আমরা তাঁকে দেখতাম। দেখলেই ভক্তি করতে ইচ্ছে করত।’ তিনি বলেন, ‘মুনীরউজ্জামান স্যার অদ্ভূতভাবে পরীক্ষা নিতেন। পরীক্ষার আগে ক্লাসে গিয়ে ছাত্রদের বলতেন তোমাদের পরীক্ষার প্রশ্ন তোমরাই করবে। ছাত্ররা নিজেদের মতো করে একটা প্রশ্ন তৈরি করে দিত। স্যার অনেকগুলো প্রশ্ন থেকে বেছে একটা প্রশ্নপত্র তৈরি করতেন। তিনি বলতেন, যে ভালো প্রশ্ন করতে পারে, সে ভালো উত্তর দিতে পারে। ক্লাসে তিনি যখন অঙ্ক করাতেন হঠাৎ করেই হয়তো খেয়াল করলেন যে, অঙ্কটি ভুল হয়েছে। তখন ছাত্রদের বলতেন, অঙ্কটা ভুল হয়েছে। কিন্তু তোমরা এটাও লিখে রাখ। তাহলে তোমরা বুঝতে পারবে কোথায় ভুল হওয়ার সম্ভাবনা থাকে। মুনীরউজ্জামান স্যার ছিলেন পরিসংখ্যানে গভীর পান্ডিত্যের অধিকারী, তাই ছাত্রদের তিনি পড়াতে পারতেন সহজ ও বোধগম্য ভাষায়। গল্পের মতো করেই তিনি অঙ্ক পড়াতেন।’
অধ্যাপক এ. এন. এম. মুনীরউজ্জামানের আরেকটি ঘটনার স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে একই বিভাগের শিক্ষক প্রফেসর শাহাদাত আলী মল্লিক বলেন, “ক্লাসে হাজিরা নেয়ার জন্য অনেক ছাত্রই আমার কাছে এখনো আসে। তাদের মধ্যে হয়তো কেউ কেউ সত্যিকার অর্থেই কোনো বাস্তব কারণে ক্লাসে উপস্থিত থাকতে পারেনি। কিন্তু তারপরেও আমি কোনো গর-হাজির ছাত্রকে ক্লাসে পার্সেন্টেজ দিইনা। এটা মুনীরউজ্জামানের কাছ থেকে শেখা। তিনি আমাকে চাকরি জীবনের প্রথমে যখন তাঁর সহকর্মী হিসাবে যোগদান করি তখনই বলেছিলেন, ‘দেখুন বৃটিশ আমলের একটি ঘটনা- একবার ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের একটি ছাত্র বাইরে গিয়ে খুন করে বসে। সে সেই খুন থেকে বাঁচার জন্য যে কোনোভাবেই হোক পরে ক্লাসের খাতায় পার্সেন্টেজ নিয়ে নেয়। কিন্তু পরে সেই পার্সেন্টেজ সে আদালতে দাখিল করে দেখায়, খুন যখন হয়েছিল তখন সে ক্লাসে ছিল। ছাত্রের এই চতুরতার জন্য একটি খুনের বিচার হয়নি। একজন খুনি রক্ষা পেয়ে গেল। এটা অনেক বড় অপরাধ। শিক্ষক হিসাবে এই অপরাধ কখনো করবেন না।'”
অধ্যাপক মুনীরউজ্জামানের সাথে নিজের শেষ সাক্ষাতের কথা স্মরণ করে শাহাদাত আলী মল্লিক লিখেছেন, “স্যারের বাসা ছিল তখন জহুরুল হক হলের (সাবেক ইকবাল হল) উত্তরে একটা বাংলোতে। কোনো এক প্রসঙ্গে একদিন বললেন তিনি বাসাটা পাল্টানোর চিন্তা করছেন। কারণ হিসাবে বললেন, ইকবাল হলে প্রায়ই গণ্ডগোল হয়। আর বাসার সবাই ভয় পায়। তাই এখান থেকে চলে যেতে হবে।…একদিন বাসায় গিয়ে জানলাম আমার শিক্ষক ঐ বাসা ছেড়ে শহীদ মিনারের পিছনে এক বাসায় চলে গেছেন।… নিয়তির কি পরিহাস! ভাবতে অবাক লাগে ভয়ের কারণে আমার শিক্ষক জহুরুল হক হলের পিছনের বাসা ছেড়ে শহীদ মিনারের পেছনের বাসায় এলেন। আর এই বাসায় এসেই তিনি শেষ পর্যন্ত জীবন দিলেন।”
এ.এন.এম. মুনীরউজ্জামানের ছোট ছেলে জাকারিয়া মাসুদ আজো ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চের সেই কালরাতের ঘটনার কথা মনে করে শিউরে ওঠেন। বাকরুদ্ধ হয়ে যান। নিজের বাবা, দুই ভাই, চাচাকে হত্যার দৃশ্য আজো তাঁকে তাড়া করে ফেরে। সেই নির্মম হত্যাকাণ্ডের যন্ত্রণা বুকে চেপে ধরে সেদিনের সেই বার বছরের বালক আজ পঞ্চাশের দোরগোড়ায়। মায়ের মুখের দিকে তাকালে আজো দেখতে পান বাবার মুখ, ভাইয়ের মুখ, চাচার মুখ। কিন্তু জানেন, তাঁরা আজ সবাই স্মৃতি। তাঁদের কেউ আর কোনোদিন ফিরে আসবে না। তাঁদের জন্যই এই বাংলায় রক্তিম সূর্য ওঠে। তাঁদের জন্যই লাল-সবুজের পতাকা ওড়ে বাংলার প্রতিটি ঘরে ঘরে।
শত দুঃখ আর যন্ত্রণার মধ্যেও এই একটাই গর্ব এখনো জাকারিয়া মাসুদের। তিনি শহীদ পিতার সন্তান। মুক্তিযুদ্ধে তাঁর পরিবারের চারজন মানুষ জীবন দিয়েছে। এই গর্বে তাঁর বুকটা ভরে যায়।
সংক্ষিপ্ত জীবনী:
নাম :এ. এন. এম. মুনীরউজ্জামান
জন্ম : অধ্যাপক মুনীরউজ্জামানের জন্ম ১৯২৪ সালে ঝিনাইদহ জেলার কাচেরখোল গ্রামের এক অভিজাত মুসলিম পরিবারে।
বাবা : তাঁর বাবার নাম মৌলভী মোহাম্মদ মুসা। তিনি ছিলেন ডিস্ট্রিক্ট ম্যাজিস্ট্রেট।
মা : শামসুন্নেছা খাতুন। মুসা-শামসুন্নেছা দম্পতির দুই ছেলের মধ্যে মুনীরউজ্জামান ছিলেন সবার বড়।
পড়াশোনা : মুনীরউজ্জামানের শিক্ষা জীবন শুরু হয় কাচেরখোল বেণীপুর বিদ্যালয়ে। এখানে তিনি বছর দেড়েকের মতো পড়াশোনা করেন। পরে চলে যান নড়াইলে। সেখানেও কিছুদিন পড়ার পর পিতার চাকরিগত কারণে কলকাতায় চলে যান। সেখানেই তাঁর শিক্ষা জীবন অতিবাহিত হয়। মুনীরউজ্জামান ১৯৪০ সালে কলকাতা থেকে মেট্রিক পাশ করেন। ১৯৪২ সালে কলকাতার ইসলামিয়া কলেজ থেকে ইন্টারমিডিয়েট পাশ করেন। কলকাতার প্রেসিডেন্সি কলেজ থেকে গণিতে গ্রেজুয়েশন ডিগ্রী লাভ করেন ১৯৪৪ সালে এবং কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ১৯৪৬ সালে পরিসংখ্যানে মাস্টার্স ডিগ্রী লাভ করেন।
কর্মজীবন : ১৯৪৮ সালে জাকারিয়া মাসুদের বাবা এ.এন.এম. মুনীরউজ্জামান প্রভাষক হিসাবে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের গণিত বিভাগে যোগদান করেন। তখন পর্যন্ত পরিসংখ্যান বিষয়টিকে গণিতের একটি পার্ট হিসাবে পড়ানো হত। ১৯৪৯ সালেই মুনীরউজ্জামানের প্রচেষ্টায় পরিসংখ্যান বিষয়ে মাস্টার্স ডিগ্রী কোর্স খোলা হয়। ১৯৫০ সাল থেকেই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পরিসংখ্যান বিভাগ স্বতন্ত্র বিভাগ হিসাবে প্রতিষ্ঠিত হয়। ১৯৬১ সালে অধ্যাপক মুনীরউজ্জামান রিডার (এসোসিয়েট প্রফেসর) হিসাবে পদোন্নতি পান। ১৯৬৭ সালে তিনি বিভাগীয় চেয়ারম্যানের দায়িত্ব পালন করেন। একটানা প্রায় ২৩ বছর তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যাপনা করেন। বাংলাদেশের পরিসংখ্যান বিদ্যায় তিনি পালন করেছেন পথিকৃৎ-এর ভূমিকা। তাঁকে বলা হয় ‘লগ পাইওনিয়ার’।
গবেষণা : অধ্যাপক এ. এন. এম. মুনীরউজ্জামান শিক্ষকতার পাশাপাশি গবেষণামূলক কাজেও বিপুল প্রশংসা কুড়িয়েছেন। তাঁর মৌলিক বই ও গবেষণা পত্রের সংখ্যা ১৭টি। যা বিশ্বের নামী গবেষণা পত্র-পত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছে। তাঁর কিছু বই এখনো পশ্চিমা বিশ্বে গুরুত্বের সাথে পড়ানো হয়। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে অবস্থিত ইন্সস্টিটিউট অব স্ট্যাটিস্ট্রিক্যাল রিসার্চ এন্ড ট্রেনিং-এর তিনি ছিলেন প্রধান উদ্যোক্তা। এছাড়াও তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের স্যোসিও-ইকোনমিক সার্ভে বোর্ডের (বর্তমান নাম ব্যুরো অব ইকোনমিক রিসার্চ) প্রতিষ্ঠাতাদের অন্যতম। জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত তিনি এই প্রতিষ্ঠানের সার্ভে ডিজাইনার, পরিসংখ্যান উপদেষ্টা এবং গবেষক হিসাবে দায়িত্ব পালন করে গেছেন।
পরিবার : তাঁর স্ত্রী সৈয়দা মাহমুদা জামান, বড় ছেলে আকরামুজ্জামান, একমাত্র মেয়ে লুলু নাসরিন, ছোট ছেলে জাকারিয়া মাসুদ।
মৃত্যু : ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ রাতে পাকবাহিনীরা তাঁকে ধরে নিয়ে যায় এবং হত্যা করে।
তথ্যসূত্র : লেখাটি তৈরি করার জন্য অধ্যাপক এ. এন. এম. মুনীরউজ্জামানের ছোট ছেলে আবু মুসা ম. মাসুদউজ্জামান (জাকারিয়া মাসুদ), তাঁর ছাত্র ও সহকর্মী প্রফেসর শাহাদাৎ আলী মল্লিক, অধ্যাপক ড. এম. নুরুল ইসলাম-এর সাক্ষাৎকার নেয়া হয়েছে। এছাড়াও বাংলা একাডেমী থেকে প্রকাশিত ‘স্মৃতি ১৯৭১’-এর ৫ম খন্ড থেকেও কিছু তথ্য নেয়া হয়েছে।
লেখক : চন্দন সাহা রায়