দেশ স্বাধীন হতে যাচ্ছে, শেলফে বইয়ের ভেতর বাংলাদেশের পতাকা আছে। কীভাবে আনন্দ করবি ঠিক কর।’ দেশ স্বাধীন হওয়ার মাত্র দুই দিন আগে অর্থাত্ ১৪ ডিসেম্বর ছোট ভাইবোনদের উদ্দেশ্যে এই কথাগুলি বলেছিলেন শহীদ অধ্যাপক গিয়াসউদ্দিন আহমদ। স্বাধীন দেশের নতুন সূর্যটা দেখার জন্য সবাই অধীর হয়ে অপেক্ষা করছে। পৃথিবীর মানচিত্রে বাংলাদেশ নামে একটি নতুন দেশের জন্ম দেখার আনন্দ বুকে নিয়ে সবার মতো গিয়াসউদ্দিনও অপেক্ষা করছেন অধীর হয়ে আর ভাই-বোনদের সাথে প্রস্তুতি নিচ্ছেন স্বাধীনতার লাল সূর্যটাকে বরণ করে নেবার। কিন্তু স্বাধীন বাংলাদেশকে দেখার ও ভাইবোনসহ সবার সাথে আনন্দে মেতে ওঠার সৌভাগ্য হয়নি তাঁর। মুক্ত দেশের মুক্ত আকাশ দেখার আগেই ১৪ ডিসেম্বর এদেশের রাজাকার-আলবদরদের বিশ্বাসঘাতকতায় তাঁর জীবনশিখা নিভে যায়।
১৯৭১ সালের অক্টোবর-নভেম্বর মাসেই দেশের বিভিন্ন স্থানে গেরিলাদের আক্রমণ অনেক বেড়ে যায়। যশোর, খুলনাসহ আরো অনেক এলাকা মুক্তিবাহিনীর দখলে চলে আসে ডিসেম্বরের ৭-৮ তারিখ থেকে। স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র থেকে প্রচার হয় কুমিল্লা ও ব্রাহ্মণবাড়িয়া থেকে চলে যাওয়ার সময় পাকবাহিনীর দ্বারা অনেক বুদ্ধিজীবীকে হত্যা করার খবর। ১০ ডিসেম্বর বিকেলের দিকে অনির্দিষ্টকালের জন্য কারফিউ জারি হয় ঢাকায়। ১২ ডিসেম্বর সামরিক বাহিনীর লোকজনের থাকার জন্য তাদেরই নির্দেশে বাড়ি ছেড়ে অন্যত্র চলে যেতে হয় অনেককে। গিয়াসউদ্দিন আহমদ তখন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মহসীন হলের হাউস টিউটরের দায়িত্বে নিয়োজিত ছিলেন। ১৩ ডিসেম্বর সকালের দিকে কারফিউ শিথিল হলে তিনি তাঁর আত্মীয়দের খবর নিতে বের হন। সেদিনই বাসা ছেড়ে দেওয়ার নির্দেশ আসে গিয়াসউদ্দিন আহমদের বোন ফরিদা বানু ও তাঁর পরিবারের কাছে। ১৩ ডিসেম্বর তাঁদেরকে নিজের মহসীন হলের বাসায় নিয়ে আসেন গিয়াসউদ্দিন। তাঁর বোনসহ আরো কয়েকজন আত্মীয়ও ছিলেন তাঁর বাসাতেই।
১৪ ডিসেম্বর কাদা-লেপা ইপিআরটিসির (বর্তমানের বিআরটিসি) একটা লাল মাইক্রোবাস মহসীন হলের হাউস টিউটরদের বাসার সামনে থামল। সাধারণ পোশাক পরা, মুখে রুমাল বাঁধা একজন ও রাইফেল হাতে দুইজন নেমে এল গাড়ি থেকে। আশপাশের বাসাগুলোর টেলিফোনের তার কেটে ফেলা হলো। কিছুক্ষণ পরেই ধাক্কা পড়ল গিয়াসউদ্দিন আহমদের বাসার দরজায়। মাইক্রোবাস থেকে নেমে আসা সেই তিনজন ঘরে ঢুকে রাইফেল তাক করে বিভিন্ন ঘর, খাটের তলায় গিয়াসউদ্দিনকে খুঁজে না পেয়ে চলে যায়। মিনিট দশেক পরে আবার ফিরে এসে ঘরগুলো ভালো করে খুঁজল তারা। সেদিন সকাল থেকেই পানি ছিল না মহসীন হলে। হলের মিস্ত্রির অনুপস্থিতিতে গিয়াসউদ্দিন আহমদ তখন হলের পানি সঙ্কট নিরসনে কাজ করছিলেন। এ কথা শুনে সেই তিনজন তখন হলের পাম্পের কাছে যায়। সেখানে গিয়াসউদ্দিন আহমদকে পেয়ে হলের দারোয়ানের গামছা দিয়ে চোখ বেঁধে মাইক্রোবাসে উঠিয়ে নিয়ে যায়। সেদিনই অন্য অনেক বুদ্ধিজীবীর সঙ্গে তাঁকেও মিরপুরের বধ্যভূমিতে গুলি করে হত্যা করে পাষণ্ডরা।
এভাবেই ঘৃণ্য হায়েনার কূটকৌশলের কাছে পরাস্ত হয়ে পাকিস্তানী জল্লাদ বাহিনীর হাতে শহীদ হন গিয়াসউদ্দিন আহমদ। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাস বিভাগের ছাত্রছাত্রীদের কাছে যিনি ছিলেন প্রিয় গিয়াস স্যার, অনুজদের কাছে শ্রদ্ধেয় গিয়াস ভাই, জ্যেষ্ঠ ও আত্মীয়-পরিজনদের কাছে আদরের ‘বাচ্চু’।
বর্তমান বাংলাদেশের নরসিংদী জেলার আমদিয়া ইউনিয়নের অন্তর্ভুক্ত প্রাকৃতিক সৌন্দর্যে মনোমুগ্ধকর গ্রামটির নাম বেলাব। এ গ্রামের অধিবাসী ছিলেন গিয়াসউদ্দিন আহমদের পিতা আবদুল গফুর। ঢাকা কলেজ থেকে পদার্থবিদ্যায় সম্মান নিয়ে বি.এ. পাস করার পর জনাব আবদুল গফুর যখন প্রেসিডেন্সি কলেজে এম. এ. ক্লাসে পড়তেন, তখন বিখ্যাত পরিসংখ্যানবিদ প্রশান্তকুমার মহলানবীশ তাঁর সহপাঠী ছিলেন এবং তাঁর এক ক্লাস নিচেই পড়তেন বিখ্যাত বৈজ্ঞানিক সত্যেন বসু ও মেঘনাদ সাহা। গিয়াসউদ্দিন আহমদের মাতা শামসুন্নাহার বেগম কিশোরগঞ্জ জেলার কালিকাপ্রসাদের বিখ্যাত জমিদার বংশে জন্মগ্রহণ করেছিলেন। আবদুল গফুর সাব-ডেপুটি ম্যাজিস্ট্রেট পদে কর্মরত ছিলেন পশ্চিম বাংলার উত্তর চব্বিশ পরগনা জেলার ব্যারাকপুরে। সেখানে ১৯৩৩ সালের ১১ আগস্ট জন্মগ্রহণ করে এক ফুটফুটে শিশু। নতুন শিশুর আগমনে পরিবারের সবার মধ্যেই ছিল সীমাহীন আনন্দ। নাম যখন ঠিক হয়নি, সবাই আদর করে তাকে ডাকত ‘বাচ্চু’। এরপর আকিকা করে নাম দেওয়া হলো গিয়াসউদ্দিন আহমদ। তখনকার সমাজের অন্য পরিবারগুলোর মতো আবদুল গফুরও তাঁর সব ছেলেমেয়েকে কঠোর নিয়ম-শৃঙ্খলার মধ্যে বড় করেন। পিতা-মাতা সযত্নে গঠন করেছিলেন একটি শিক্ষিত ও আলোকিত পরিবার। তৃতীয় সন্তান বাচ্চুর পরে আবদুল গফুর-শামসুন্নাহার দম্পতির সংসারে আরও এসেছে এক ছেলে ও চার মেয়ে। তবে বাচ্চুর জন্য বাবা-মা ও ভাই-বোনদের মনে ছিল আলাদা জায়গা। পিতার সব কঠিন নিয়ম-কানুন শিথিল করা হতো কেবল বাচ্চুর ক্ষেত্রেই। বাচ্চুও পরবর্তীতে হয়ে উঠেছিলেন পরিবারের সবচেয়ে দায়িত্বশীল সদস্য।
শৈশবকাল থেকেই বাচ্চু ছিলেন সবার আদরের পাত্র। তাঁর স্নিগ্ধ চেহারার দিকে তাকালে চোখ ফেরানোই কঠিন হতো। স্বভাব-চরিত্রে অতি ধীরস্থির, উচ্চকন্ঠ কিন্তু মধুরভাষী বাচ্চুর লেখাপড়ায় ছিল গভীর আগ্রহ। বাচ্চু ১৯৪২ সালে ঢাকার সেন্ট গ্রেগরিজ স্কুলে তৃতীয় শ্রেণীতে ভর্তি হন। স্কুলের খাতায় তাঁর নাম গিয়াসউদ্দিন আহমদ। ক্লাসের সেরা ছেলে, সেরা বক্তা ও সেরা আবৃত্তিকার ছিলেন গিয়াসউদ্দিন। বাবার সরকারী চাকরি থেকে অবসর গ্রহণ ও সপরিবারে গ্রামে আসার ফলে ১৯৪৩-‘৪৪ এই দুই বছর গ্রামের বাড়িতে গৃহশিক্ষকের কাছে পড়াশুনা করেন তিনি। ১৯৪৪ সালের শেষের দিকে চাকরিতে পুনর্নিয়োগ লাভ করে ঢাকায় আসেন তাঁর বাবা। গিয়াসউদ্দিন আহমদ আবার সেন্ট গ্রেগরিজ স্কুলে ষষ্ঠ শ্রেণীতে ভর্তি হন ১৯৪৫ সালে। এই স্কুল থেকে তিনি ১৯৫০ সালে গণিতে লেটারমার্কসহ মেধা তালিকায় দশম স্থান অর্জন করে প্রবেশিকা (ম্যাট্রিকুলেশন) পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন। এরপর সেন্ট গ্রেগরিজ কলেজ (পরবর্তীকালে নটরডেম কলেজ)-এর ছাত্র থাকাকালে কলেজের তত্কালীন ইতিহাসের শিক্ষক ফাদার গিলেসবি, যুক্তিবিদ্যা ও দর্শনের শিক্ষক ফাদার গাঙ্গুলি ইত্যাদি খ্যাতিমান দিকপালের কাছে গিয়াসউদ্দিন ছিলেন অত্যন্ত প্রিয়পাত্র। এই কলেজ থেকেই ১৯৫২ সালে তিনি গণিতে লেটারমার্কসহ মেধা তালিকায় অষ্টম স্থান অধিকার করে প্রথম বিভাগে আই. এ. পাস করেন। সে-বছরই তাঁর বাবা আবার চলে যান গ্রামের বাড়িতে। গিয়াসউদ্দিন আহমদ তখন সলিমুল্লাহ হলের আবাসিক ছাত্র হিসেবে ভর্তি হন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাস বিভাগে। ১৯৫৫ সালে তিনি এই বিভাগ থেকে বি. এ. (সম্মান) পাস করেন এবং একই বিভাগে এম. এ. শ্রেণীতে ভর্তি হন। কিন্তু অসুস্থতার জন্য পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করতে পারেননি প্রথম বছর। পরের বছর অর্থাত্ ১৯৫৭ সালে তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ইতিহাসে এম. এ. পাস করেন। বি.এ ও এম.এ উভয় পরীক্ষায় তিনি দ্বিতীয় শ্রেণীতে প্রথম হন।
এম.এ পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হওয়ার পরপরই কর্মজীবনে প্রবেশ করেন গিয়াসউদ্দিন আহমদ। ১৯৫৭ সালের নভেম্বর মাসে তিনি ঢাকা জগন্নাথ কলেজের ইতিহাস বিভাগের প্রভাষক নিযুক্ত হন। ১৯৫৮-র আগস্টে তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাস বিভাগে অস্থায়ী প্রভাষক পদে নিযুক্ত হন এবং ১৯৬২ সালে স্থায়ী পদ লাভ করেন। বিশ্ববিদ্যালয়ে যোগদানের অল্পদিনের মধ্যেই তিনি নিজেকে একজন অত্যন্ত সফল শিক্ষক হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করতে সক্ষম হয়েছিলেন। ইংরেজি ও বাংলা উভয় ভাষায় তাঁর ছিল লক্ষণীয় দক্ষতা। অত্যন্ত সরল ইংরেজিতে ইংল্যান্ডের শাসনতান্ত্রিক ইতিহাস ও ইউরোপের ইতিহাস পড়াতেন তিনি। আর ছাত্রছাত্রীরা মন্ত্রমুগ্ধ হয়ে তাঁর গম্ভীর, উচ্চ-কন্ঠস্বরের এসব বক্তৃতা শুনতো। প্রিয় গিয়াস স্যারের সরল ও প্রাঞ্জল বক্তৃতা ক্লাসের সব ছাত্রছাত্রীর কাছেই ছিল অন্যতম প্রধান আকর্ষণ। সে-সময়ে দেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর ইতিহাস বিষয়ের পাঠ্যসূচির পরিধি ছিল অত্যন্ত সঙ্কীর্ণ। অন্যদিকে বিলেতের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে বিশেষ করে অক্সফোর্ড, কেম্ব্রিজ ও লন্ডন বিশ্ববিদ্যালয়ে ইতিহাসের পাঠ্যসূচি ছিল অপেক্ষাকৃতভাবে অনেক সমৃদ্ধ। গিয়াসউদ্দিন তাই ঠিক করেছিলেন সুযোগ পেলে ঐসব বিশ্ববিদ্যালয়ে অনার্স ডিগ্রীর জন্য পড়াশুনা করবেন। সৌভাগ্যক্রমে ১৯৬৪ সালে তাঁকে কমনওয়েলথ বৃত্তির জন্য মনোনীত করা হয় এবং তিনি উক্ত বৃত্তি নিয়ে উচ্চশিক্ষার্থে যুক্তরাজ্যে গমন করেন। অন্যদের মতো পি.এইচ. ডি. ডিগ্রীর জন্য ভর্তি না হয়ে তিনি ভর্তি হন বিখ্যাত শিক্ষা প্রতিষ্ঠান লন্ডন স্কুল অব ইকোনমিক্স-এ, আন্তর্জাতিক ইতিহাস বিভাগের সম্মান শ্রেণীতে। তিন বছর অধ্যয়নের পর কৃতিত্বের সঙ্গে আন্তর্জাতিক ইতিহাসে বি.এ. অনার্স (সম্মান) ডিগ্রী অর্জন করে গিয়াসউদ্দিন আহমদ ১৯৬৭ সালে দেশে ফিরে এসে পুনরায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ইতিহাস বিভাগে প্রভাষকের পদে যোগ দেন। শিক্ষক হিসেবে এবং সলিমুল্লাহ্ মুসলিম হল ও মহসীন হলে হাউস টিউটরের দায়িত্বে থাকার সময় তিনি ছাত্রদের প্রকৃত অভিভাবকের ভূমিকা পালন করেন।
বাহান্নর ভাষা আন্দোলন ও তার পরবর্তী বিভিন্ন ধর্মঘট, মিছিল, ক্লাস বর্জন ইত্যাদিতে গিয়াসউদ্দিন থাকতেন প্রতিবাদীদের প্রথম সারিতে। অন্যায়ের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করাকে ব্যক্তিগত দায়িত্ব হিসেবে নিয়েছিলেন তিনি। ঊনসত্তরের স্বৈরাচারবিরোধী গণআন্দোলনেও তিনি অংশগ্রহণ করেন সক্রিয়ভাবে। ১৯৭১ সালের দুঃসহ-আর্ত দিনগুলোতে তাঁর সমসাময়িক অনেকেই যখন আত্মগোপন করে পালিয়ে বেড়াচ্ছিলেন, তখন নিরাপত্তার ঠাঁই পেয়েও সে সুযোগ গ্রহণ করেননি গিয়াসউদ্দিন। ‘৭১-এর ২৫ মার্চের হত্যাযজ্ঞের পর তিনি লোকচক্ষুর অন্তরালে নিয়োজিত হন এক মহান ব্রতে। প্রতিটি শহীদ পরিবারের খোঁজ নিয়ে তাঁদের সহযোগিতা করার চেষ্টা করেন এবং শহীদদের ওপর একটি পরিসংখ্যান তৈরি করেন। অর্থ, ওষুধ, কাপড়-চোপড় ও খাবার সংগ্রহ করে বিপদগ্রস্ত পরিবার ও মুক্তিযোদ্ধাদের সাহায্য করতেন তিনি। মুক্তিযোদ্ধারা তখন নিয়মিত আসা-যাওয়া করতেন ঢাকায়। তাদের সাথে যোগাযোগ রাখতেন গিয়াসউদ্দিন। টাকা-পয়সা, কাপড়-চোপড়, ওষুধপত্র ইত্যাদি জোগাড় করে সেসব মুক্তিযোদ্ধাদের হাতে তুলে দিতেন, কখনো পৌঁছে দিতেন তাঁদের নির্দিষ্ট ঠিকানায়। কখনো ডাক্তার নিয়ে পৌঁছে যেতেন কোনো আহত মুক্তিযোদ্ধার আস্তানায়।
গিয়াসউদ্দিন আহমদের ছোট ভাই এবং সে-সময়ে দেশের একমাত্র এফআরসিএস নিউরোসার্জন রশিদউদ্দিনকে প্রায়ই জোর করে নিয়ে যাওয়া হতো ঢাকা সিএমএইচে যুদ্ধাহত ও মাথায় আঘাত পাওয়া পাকিস্তানী সৈন্যদের চিকিত্সার জন্য। রশিদউদ্দিন অত্যন্ত গোপনে, গিয়াসউদ্দিনের সহযোগিতায় আহত মুক্তিযোদ্ধাদেরও চিকিত্সা করে সুস্থ করার দায়িত্ব পালন করতেন। সেপ্টেম্বর মাসে আলতাফ মাহমুদ ও কয়েকজন মুক্তিযোদ্ধা পাক-বাহিনীর হাতে বন্দি হন। এদের মধ্যে ডা. রশিদউদ্দিনের চিকিত্সাধীন মুক্তিযোদ্ধাও ছিলেন। এ ঘটনার পর বর্ডার পার হয়ে ভারতে যাওয়ার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন ডা. রশিদউদ্দিন। সেপ্টেম্বরের মাঝামাঝি গিয়াসউদ্দিনই তাঁকে ডেমরা ঘাটে দিয়ে আসেন। ভাই-বোনরা তখন তাঁকেও অনেক করে বলেন ভারতে চলে যেতে। কিন্তু দেশ ছেড়ে যাবার মানুষ নন গিয়াসউদ্দিন। দেশে তখন অনেক কাজ তাঁর। প্রতিদিন সন্ধ্যায় একটা খাকি প্যান্ট ও শার্ট পরে বেরিয়ে পড়তেন রাস্তায়। ছয় ফুটের মতো লম্বা, গৌরবর্ণের এই মানুষটিকে হঠাত্ দেখলে বিদেশি মনে করে ভুল হতো। বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসের বাড়ি বাড়ি গিয়ে তিনি খবর নিতেন কার ঘরে খাবার নেই, কার জামা-কাপড় নেই, কার শীতের গরম কাপড়ের প্রয়োজন, কে অসুস্থ ইত্যাদি। শুধু খোঁজ নিয়েই ক্ষান্ত হননি তিনি। এর-ওর কাছ থেকে সামর্থ্য অনুযায়ী অর্থ সংগ্রহ করতেন। তারপর সেসব দিয়ে তাঁর অনেক সহকর্মী, বিশেষ করে হিন্দু ধর্মাবলম্বী শিক্ষকদের নিরাপদ আশ্রয়ের চেষ্টা করতেন। চতুর্থ শ্রেণীর কর্মচারীদের জীবন চালানোর জন্য নূ্ন্যতম খরচের টাকা জোগাড় করতেন। এভাবে সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের সহকর্মীর জীবন বাঁচাতে গিয়ে অথবা বেতন-স্থগিত চতুর্থ শ্রেণীর ছাপোষা কর্মচারীদের জীবন চালানোর চেষ্টা করতে গিয়ে হয়ত তিনি চোখে পড়ে গিয়েছিলেন পাকিস্তানী প্রশাসক বা অনুরূপ কোনো কর্তৃপক্ষ বা তাঁদের অনুগত দালালদের।
সেপ্টেম্বর মাসের শেষদিকে একদিন সামরিক বাহিনীর লোকেরা মহসীন হলের তত্কালীন প্রাধ্যক্ষ ড. ওয়াদুদুর রহমান, হাউস টিউটর জহুরুল হক ও গিয়াসউদ্দিন আহমদকে রমনা থানায় ধরে নিয়ে যায়। সারাদিন জিজ্ঞাসাবাদ শেষে ড. ওয়াদুদ, জহুরুল হক ও গিয়াসউদ্দিনকে ফিরিয়ে দিয়ে গেলেও পরের দিন আবার তাঁদের যেতে হয় রমনা থানায়। পরের দিনও জিজ্ঞাসাবাদ করে ছেড়ে দেওয়া হয় তাঁদের। অনেক বন্ধু-বান্ধব ও শুভানুধ্যায়ী গিয়াসউদ্দিনকে উপদেশ দেন যে, তিনি যেন নিজের বাড়িতে না থাকেন। গিয়াসউদ্দিন বলেন, ‘আমি তো কারো শত্রুতা করিনি, আমার আবার কী হবে?’
এমন সরলপ্রাণ মানুষটি পাকিস্তানী সৈন্যদের জিজ্ঞাসাবাদের পর ছাড়া পেলেও শেষপর্যন্ত ছাড়া পাননি নিজ দেশের রাজাকার- আলবদর-আল শামসদের হাত থেকে। এদের ষড়যন্ত্রেই তাঁকে প্রাণ দিতে হয় পাকিস্তানী জল্লাদদের হাতে। অন্য অনেক বুদ্ধিজীবীদের সঙ্গে তাঁর স্থান হয় মিরপুর গোরস্তানের গণকবরে। এরপর ‘৭২-এর ৪ জানুয়ারি মিরপুরের এই গণকবর থেকে গিয়াসউদ্দিন আহমদের লুঙ্গি, শার্ট, তাঁর চোখ বাঁধার গামছা এবং এগুলোতে জড়িয়ে থাকা কিছু দেহাবশেষ শনাক্ত করেন তাঁর পরিবারের সদস্যরা। সেগুলো নিয়ে অন্য শহীদদের সঙ্গে তাঁর দেহাবশেষ সমাহিত করা হয় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় মসজিদের পাশে।
দেশি ও পাকিস্তানী জল্লাদরা তাঁর জীবনপ্রদীপ নিভিয়ে দিলেও তিনি সারা জীবন আলো দিয়ে যাবেন তাঁকে দেওয়া বিভিন্ন মরণোত্তর সম্মাননার মাধ্যমে। গিয়াসউদ্দিন আহমদের স্মরণে তাঁর পরিবারের পক্ষ থেকে ১৯৭২ সালেই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাস বিভাগে অনার্স পরীক্ষায় প্রথম স্থান অধিকারীর জন্য শহীদ গিয়াসউদ্দিন বৃত্তি প্রদানের ব্যবস্থা করা হয়। তাঁর মূল্যবান ও অতি প্রিয় সব বই দান করা হয় এই বিভাগের সেমিনারে। পারিবারিক উদ্যোগেই তাঁর বেলাব গ্রামে শহীদ অধ্যাপক গিয়াসউদ্দিন আহমদ বালিকা বিদ্যালয়, শহীদ অধ্যাপক গিয়াসউদ্দিন আহমদ পাঠাগার এবং তাঁদের ডেপুটি বাড়ি নামে পরিচিত বাড়িটিতে আলোকিত ভুবন নামে একটি এতিমখানা ও একটি ডাকঘর প্রতিষ্ঠা করা হয়। গিয়াসউদ্দিন আহমদের সম্মানে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পশ্চিম প্রান্তে অবস্থিত এফ. রহমান হলের উল্টো দিকে রাস্তার পাশের আবাসিক এলাকাটিকে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ অভিহিত করেছেন ‘শহীদ গিয়াসউদ্দিন আহমদ আবাসিক এলাকা’ নামে। শহীদ বুদ্ধিজীবীদের স্মরণে ইতিহাস বিভাগে প্রচলন করা হয়েছে ‘শহীদ বুদ্ধিজীবী স্মারক বক্তৃতা’। সেসব বক্তৃতা দিয়ে থাকেন দেশের প্রথিতযশা, মুক্ত-চিন্তা-চেতনার অধিকারী সর্বজনশ্রদ্ধেয় বুদ্ধিজীবীরা। এছাড়া ২০০৬ সালে একটি স্মারক গ্রন্থ প্রকাশ করা হয়েছে গিয়াসউদ্দিন আহমদের পরিবারের পক্ষ থেকে।
গিয়াসউদ্দিন আহমদরা ছিলেন আট ভাই-বোন। বড় ভাই নাসিরউদ্দিন আহমদ, ছোট ভাই রশিদউদ্দিন আহমদ এবং পাঁচ বোন খোরশেদা বানু, খালেদা বানু, হামিদা বানু, ফরিদা বানু ও সাজেদা বানু। ১৯৬১ সালের মে মাসে তাঁর মা ক্যান্সারে আক্রান্ত হয়ে মারা যান। আর ১৯৬৯ সালের ডিসেম্বর মাসে মারা যান তাঁর পিতা আবদুল গফুর। বাবা-মা, ভাই-বোন সবার প্রতিই তিনি ছিলেন খুব যত্নবান ও দায়িত্বশীল। গিয়াসউদ্দিন আহমদ বিয়ে করেননি। তাই বেঁচে থাকতে বাবা রাগ করে বলতেন, ‘আমার কতো যত্ন করছ তুমি। তোমার অসুখ হলে বুড়ো বয়সে কে দেখাশুনা করবে?’ বাবার সামনে কিছু না বললেও ভাইবোনদের কাছে হাসতে হাসতে গিয়াসউদ্দিন বলতেন, ‘বুড়ো বয়সে অসুখ হলে হাসপাতালে চলে যাবো।’ হয়ত অবচেতনভাবে তিনি জানতেন এই পৃথিবীতে বেশিদিন তাঁর থাকা হবে না। তাই কখনো ভবিষ্যত্ নিয়ে বড় ধরনের কোনো পরিকল্পনা করতে দেখা যেত না তাঁকে। অত্যন্ত সাদামাটাভাবে জীবন কাটিয়েছেন তিনি।
কোমল ও দরদী প্রকৃতির গিয়াসউদ্দিন ভালোবাসতেন গল্প করতে ও আড্ডা দিতে। তিনি ছিলেন বন্ধুবত্সল ও কর্তব্যপরায়ণ। তাঁর কথা বলার ভঙ্গি, গাম্ভীর্যপূর্ণ অভিব্যক্তি আকর্ষণ করত সবাইকে। দরাজ গলায় স্পষ্টভাবে উচ্চস্বরে কথা বলতেন তিনি। বিশ্ববিদ্যালয়ের বিশাল করিডোরগুলো, মাঠ ও ক্যান্টিন মুখর হয়ে থাকত তাঁর চঞ্চল পদচারনায়, সতীর্থদের সঙ্গে প্রাণখোলা হাসিতে ও স্পষ্টবাদী উচ্চারণে। দু-এক বছরের ছোট-বড় মিলিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ে তাঁর বন্ধুদের তালিকায় ছিলেন আবুল মাল আবদুল মুহিত, সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী, কে. এ. এম. সাদউদ্দিন, আনিসুজ্জামান, আবদুল মমিন চৌধুরী, মোকাদ্দেসুর রহমান এবং আরো অনেকে। তাঁর সুললিত কন্ঠস্বর এক দশকেরও বেশি সময় ধরে ক্লাসকক্ষের ভেতরে ও বাইরে অনেক তরুণ প্রাণকে মন্ত্রমুগ্ধ করেছে; উজ্জীবিত করেছে নিপীড়িত গণমানসের মুক্তি কামনা। তবে সভা-সমিতিতে কথা বলতেন না তিনি, লেখার প্রতিও আগ্রহ ছিল না তাঁর। তিনি খোলামনে কথা বলতেন ব্যক্তিগত আলাপচারিতায়, সেখানে বলতেন এক স্বপ্নময় পৃথিবীর কথা। তাঁকে দেখা যেত হলের ছাত্রদের অসংখ্য সমস্যা সমাধান করতে, প্রতিবেশী শিক্ষকদের বাড়ি বাড়ি গিয়ে তাঁদের খবর নিতে।
খেলাধুলায়ও অত্যন্ত পারদর্শী ছিলেন তিনি। দাবা খেলায় সলিমুল্লাহ মুসলিম হলে ছিলেন চ্যাম্পিয়ন। তাঁর বাস্কেটবল খেলার নৈপুণ্যে সলিমুল্লাহ হল অথবা ইতিহাস বিভাগ জয়ী হতো অধিকাংশ সময়। টেনিস খেলায়ও তাঁর পারদর্শিতা ছিল লক্ষণীয়। কিন্তু ছোটবেলায় টাইফয়েডে আক্রান্ত হওয়া, কলেজে পড়ার সময় হার্নিয়া অপারেশন এবং এর বছরখানেক পরেই নিউমোনিয়ায় আক্রান্ত হওয়া ইত্যাদি কারণে শারীরিকভাবে কিছুটা দুর্বল ছিলেন তিনি। স্বাস্থ্যগত কারণে এক পর্যায়ে তাই তাঁকে বাস্কেটবল, টেনিস খেলা ছেড়ে দিতে হয়। খেলাধুলার পাশাপাশি গানেরও বিশেষ করে রবীন্দ্রসঙ্গীতের একজন ভক্ত ছিলেন তিনি। রবীন্দ্রনাথের ‘রাতে রাতে আলোর শিখা রাখি জ্বেলে’ গানটি ছিল তাঁর অত্যন্ত প্রিয়।
রাতে রাতে আলোর শিখা জ্বেলে রাখাকে যিনি জীবনের ব্রত করেছিলেন, তাঁরই জীবনশিখা নিভে গেছে এদেশের রাজাকার-আলবদরদের বিশ্বাসঘাতকতায়। তাদের ঘৃণ্য চক্রান্তের কাছে সেদিন গিয়াসউদ্দিনের ব্যক্তিসত্তা পরাজিত হয়েছিল ঠিকই, কিন্তু নিঃস্বার্থ, পরোপকারী শহীদ গিয়াসউদ্দিন আহমদ আজও বেঁচে আছেন স্বাধীন বাংলাদেশের আকাশে-বাতাসে-মাটিতে-বয়ে যাওয়া নদীর জলে।
সংক্ষিপ্ত জীবনী
পূর্ণনাম : গিয়াসউদ্দিন আহমদ।
জন্ম, জন্মস্থান : ১৯৩৩ সালের ১১ আগস্ট পিতার কর্মস্থল পশ্চিম বাংলার উত্তর চব্বিশ পরগনা জেলার ব্যারাকপুরে।
পিতা-মাতা: আবদুল গফুর, শামসুন্নাহার বেগম।
শিক্ষা: প্রবেশিকা (ম্যাট্রিকুলেশন)-সেন্ট গ্রেগরিজ স্কুল, ১৯৫০; আই. এ.-সেন্ট গ্রেগরিজ কলেজ (পরবর্তীকালে নটরডেম কলেজ), ১৯৫২; বি. এ. (সম্মান)- ইতিহাস বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, ১৯৫৫; এম. এ.-ইতিহাস বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, ১৯৫৭; বি. এ. অনার্স (সম্মান)- আন্তর্জাতিক ইতিহাস বিভাগ, লন্ডন স্কুল অব ইকোনমিক্স, ১৯৬৭।
পেশা : অধ্যাপনা।
কর্মজীবন : ঢাকা জগন্নাথ কলেজের ইতিহাস বিভাগের প্রভাষক (১৯৫৭); ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাস বিভাগের অস্থায়ী প্রভাষক (১৯৫৮); উক্ত পদে স্থায়ী পদ লাভ করেন ১৯৬২ সালে। লন্ডন স্কুল অব ইকোনমিক্স-এ আন্তর্জাতিক ইতিহাসে বি.এ. অনার্স (সম্মান) ডিগ্রি অর্জন করে ১৯৬৭ সালে দেশে ফিরে পুনরায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ইতিহাস বিভাগে প্রভাষকের পদে যোগ দেন। শিক্ষক হিসেবে এবং সলিমুল্লাহ্ মুসলিম হল ও মহসীন হলে হাউস টিউটরের দায়িত্বে থাকার সময় তিনি ছাত্রদের প্রকৃত অভিভাবকের ভূমিকা পালন করেন।
মুক্তিযুদ্ধে অবদান : বাহান্নর ভাষা আন্দোলন এবং ঊনসত্তরের স্বৈরাচারবিরোধী গণআন্দোলনে সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ করেন গিয়াসউদ্দিন আহমদ। ‘৭১-এর ২৫ মার্চের হত্যাযজ্ঞের পর তিনি প্রতিটি শহীদ পরিবারের খোঁজ নিয়ে তাদের সহযোগিতা করার চেষ্টা করেন এবং শহীদদের ওপর একটি পরিসংখ্যান তৈরি করেন। মুক্তিযোদ্ধাদের সঙ্গে নিয়মিত যোগাযোগ রাখতেন। অর্থ, ওষুধ, কাপড়-চোপড় ও খাবার সংগ্রহ করে বিপদগ্রস্ত পরিবার ও মুক্তিযোদ্ধাদের সাহায্য করতেন। হিন্দু ধর্মাবলম্বী অনেক শিক্ষকের নিরাপদ আশ্রয়ের জন্য চেষ্টা করেছেন। চতুর্থ শ্রেণীর কর্মচারীদের জীবন চালানোর জন্য নূ্যনতম খরচের টাকা জোগাড় করে তাদের সাহায্য করতেন। এসব কাজের জন্য সেপ্টেম্বর মাসের শেষদিকে সামরিক বাহিনীর লোকেরা তাঁকে রমনা থানায় ধরে নিয়ে সারাদিন জিজ্ঞাসাবাদ করে। পরের দিন আবার জিজ্ঞাসাবাদ শেষে তিনি ছাড়া পান।
মরণোত্তর সম্মাননা : গিয়াসউদ্দিন আহমদের স্মরণে তাঁর পরিবারের পক্ষ থেকে ১৯৭২ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাস বিভাগে অনার্স পরীক্ষায় প্রথম স্থান অধিকারীর জন্য শহীদ গিয়াসউদ্দিন বৃত্তি প্রদানের ব্যবস্থা করা হয়। তাঁর মূল্যবান ও অতি প্রিয় সব বই দান করা হয় এই বিভাগের সেমিনারে। পারিবারিক উদ্যোগেই তাঁর বেলাব গ্রামে ‘শহীদ অধ্যাপক গিয়াসউদ্দিন আহমদ বালিকা বিদ্যালয়’, ‘শহীদ অধ্যাপক গিয়াসউদ্দিন আহমদ পাঠাগার’ এবং তাঁদের ডেপুটি বাড়ি নামে পরিচিত বাড়িটিতে ‘আলোকিত ভুবন’ নামে একটি এতিমখানা ও একটি ডাকঘর প্রতিষ্ঠা করা হয়। সম্প্রতি গিয়াসউদ্দিন আহমদের সম্মানে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পশ্চিম প্রান্তে অবস্থিত এফ. রহমান হলের উল্টো দিকে রাস্তার পাশের আবাসিক এলাকাটিকে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ অভিহিত করেছেন ‘শহীদ গিয়াসউদ্দিন আহমদ আবাসিক এলাকা’ নামে। শহীদ বুদ্ধিজীবী স্মরণে ইতিহাস বিভাগে প্রচলন করা হয়েছে ‘শহীদ বুদ্ধিজীবী স্মারক বক্তৃতা’। এছাড়া ২০০৬ সালে একটি স্মারক গ্রন্থ প্রকাশ করা হয়েছে গিয়াসউদ্দিন আহমদের পরিবারের পক্ষ থেকে।
মৃত্যু: ১৯৭১ সালের ১৪ ডিসেম্বর রাজাকার-আলবদরদের সহযোগিতায় পাকিস্তানি সৈন্যরা গিয়াসউদ্দিন আহমদকে মহসীন হল থেকে দারোয়ানের গামছা দিয়ে চোখ বেঁধে মাইক্রোবাসে উঠিয়ে নিয়ে যায়। সেদিনই অন্য অনেক বুদ্ধিজীবীর সঙ্গে তাঁকেও মিরপুরের বধ্যভূমিতে হত্যা করে। এরপর ১৯৭২ সালের ৪ জানুয়ারী মিরপুরের গণকবর থেকে গিয়াসউদ্দিন আহমদের লুঙ্গি, শার্ট, তাঁর চোখ বাঁধার গামছা এবং এগুলোতে জড়িয়ে থাকা কিছু দেহাবশেষ শনাক্ত করেন তাঁর পরিবারের সদস্যরা। সেগুলো নিয়ে অন্য শহীদদের সঙ্গে তাঁর দেহাবশেষ সমাহিত করা হয় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় মসজিদের পাশে।
কৃতজ্ঞতা: জনাব নুরুল হক (প্রাক্তন সচিব, বাংলাদেশ সরকার) ও ফরিদা বানু (প্রাক্তন সহযোগী অধ্যাপক, গণিত বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়); গিয়াসউদ্দিন আহমদের দুর্লভ ছবি ও বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ তথ্য দিয়ে সাহায্য করার জন্য।
তথ্যসূত্র:
১. আনিসুজ্জামান, ফরিদা বানু, ডা. রশিদউদ্দিন আহমদ, হামিদা বানু ও আতিকা বতুল খানম সম্পাদিত – ‘আছ নিশিদিন, আছ প্রতি ক্ষণে: শহীদ অধ্যাপক গিয়াসউদ্দিন আহমদ স্মরণে’; সাহিত্য প্রকাশ; ঢাকা; ২০০৬৷
২. বাংলা একাডেমী চরিতাভিধান; বাংলা একাডেমী; ঢাকা; পুনর্মুদ্রণ ২০০৫।
লেখক : মোঃ কুতুব উদ্দিন সজিব