১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ। অন্যান্য দিনের মতো সেদিনও বৈকালিক ভ্রমণে বের হয়েছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের দর্শন বিভাগের অধ্যাপক ড. গোবিন্দচন্দ্র দেব। তবে মনটা কেমন যেন ভালো লাগছিল না সেদিন। দেশের রাজনৈতিক অস্থিরতায় নিজের অসমাপ্ত কাজগুলোর কথা মনে পড়ছিল বারবার। ইয়াহিয়া-ভুট্টো চক্রের গোপন দুরভিসন্ধির শঙ্কাটাই প্রবল হয়ে উঠছিল। এসব ভাবতে ভাবতে অসুস্থ বোধ করেন তিনি, বাড়ি ফিরে তাড়াতাড়ি শুয়ে পড়েন বিছানায়। এর কয়েক ঘন্টা পরেই শুরু হয় ভয়াল সেই রাত। আধুনিক মারণাস্ত্রে সজ্জিত হয়ে পশ্চিম পাকিস্তানী সেনাবাহিনী তত্কালীন পূর্ব পাকিস্তানের নিরস্ত্র, ঘুমন্ত মানুষের উপর ঝাঁপিয়ে পড়ে। সারারাত ধরেই গোলাগুলি চলে পুরো ঢাকা শহর জুড়ে, বিশেষ করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায়। জগন্নাথ হলে গুলিবর্ষণের প্রচণ্ড শব্দ আর ভীত-অসহায় মানুষের আর্তচিত্কারে ঘুম থেকে জেগে ওঠেন ড. দেব। অস্থিরভাবে পায়চারি করেন; মেয়ে রোকেয়া সুলতানাকে আশ্বস্ত করে বলেন, ‘আমি তো কোনো অন্যায় করিনি, আমাকে ওরা কিছু করবে না।’ ভোর হওয়ার অপেক্ষায় বাবার পাশে রোকেয়া সুলতানা ও ছোট্ট শিশুকন্যাকে কোলে নিয়ে তাঁর স্বামী মোহাম্মদ আলী দাঁড়িয়ে থাকেন।
ভোরের আলো তখনো বের হয়নি। কাছের কোনো মসজিদ থেকে ভেসে এল ফজরের আজান। বাবাকে চা করে খাওয়ালেন রোকেয়া সুলতানা। জগন্নাথ হলের সামনে তখন গিজগিজ করছে পাক-সেনারা, হলের মাঠে জড়ো করা হয়েছে আহত-নিহতদের অসংখ্য দেহ। রোকেয়া সুলতানা শিউরে উঠে বাবাকে জানালেন সেসব কথা, কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে তারপর শান্তস্বরে ড. দেব বললেন, ‘প্রার্থনার জায়গা করে দাও।’ কথা শেষ না হতেই দরজায় বুটের লাথি পড়ল। অশ্লীল ভাষায় গালাগাল শুরু করে বর্বর পশুর দল – ‘মালাউন কা বাচ্চা দরজা খোল।’ কোলের শিশুকন্যাকে তার মায়ের কাছে দিয়ে দরজা খুলতে যান মোহাম্মদ আলী। মুহূর্তে এক ঝাঁক গুলির শব্দ আর একটি আর্তচিত্কার শোনা গেল, মেঝেতে লুটিয়ে পড়েন মোহাম্মদ আলী। পাক সৈন্যরা এগিয়ে এলে বিছানা থেকে উঠে দাঁড়িয়ে ড. দেব বলেন, ‘কী চাও বাবারা?’ উত্তরে জল্লাদের দল স্টেনগান দিয়ে ড. দেবের মাথা ও বুক বরাবর গুলি করে। ড. দেবের রক্তাক্ত নিথর দেহ পড়ে রইল মেঝেতে, রোকেয়া সুলতানা শিশুকন্যাকে কোলে নিয়ে ভীত-সন্ত্রস্ত হয়ে দাঁড়িয়ে রইলেন। চলে যাবার মিনিট কুড়ি পরে পাকবাহিনী আবার ফিরে এসে ড. দেবের মৃতদেহ টেনে হিঁচড়ে নিয়ে যায় জগন্নাথ হলের মাঠে।
এভাবেই ১৯৭১ সালের ২৬ মার্চের ভোর রাতে বর্বর পাক সেনাবাহিনীর হাতে শহীদ হন খ্যাতিমান ও আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত দার্শনিক অধ্যাপক ড. গোবিন্দচন্দ্র দেব। তিনি শুধু একজন দার্শনিকই ছিলেন না, ছিলেন অসাম্প্রদায়িক চেতনাসম্পন্ন একজন মানবদরদি ও সমাজহিতৈষি ব্যক্তিত্ব। এই মনীষী দর্শনকে ভালোবেসেছিলেন মনেপ্রাণে, যার সাধনায় তিনি ব্রতী ছিলেন সারাজীবন। তিনি ঘোষণা করেছিলেন, ‘Philosophy is my first love, philosophy is my second love and philosophy is my last love.’
দর্শনপ্রেমিক এই মনীষী সাধারণ্যে সুপরিচিত জিসি দেব নামে। তাঁর প্রকৃত নাম গোবিন্দচন্দ্র দেব পুরকায়স্থ। ১৯০৭ সালের ১ ফেব্রুয়ারি সিলেট জেলার বিয়ানী বাজারের পঞ্চখণ্ড পরগনার লাউতা গ্রামের সম্ভ্রান্ত দেব পুরকায়স্থ পরিবারে তিনি জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর জনৈক পূর্বপুরুষ পঞ্চম শতাব্দীতে আদিনিবাস ভারতের গুজরাট থেকে সিলেটে চলে আসেন এবং স্থায়ীভাবে বসবাস শুরু করেন। সম্ভবত ব্রাহ্মণত্য রক্ষা করতে না পেরে সিলেটে এসে তাঁরা দেব পুরকায়স্থ উপাধি গ্রহণ করেন। পরবর্তীকালে অবশ্য পুরকায়স্থ উপাধি বর্জন করেন তাঁরা। গোবিন্দ দেবের মাতা শরত্ সুন্দরী দেবী। পিতা ঈশ্বরচন্দ্র দেব পুরকায়স্থ ছিলেন একজন ছোটখাটো ব্যবসায়ী। তাঁর ছয় পুত্র ও এক কন্যা সন্তানের মধ্যে গোবিন্দচন্দ্র দেব ছিলেন প্রথম পক্ষের চতুর্থ সন্তান। তাঁর পিতার উচ্চশিক্ষা ছিল না, তবে পরিশ্রম, কর্মদক্ষতা, তীক্ষ্ণবুদ্ধি ইত্যাদি সহজাত গুণের কল্যাণে তিনি গড়ে তুলেছিলেন সমৃদ্ধশালী পারিবারিক জীবন। দেব পরিবারে অর্থনৈতিক সচ্ছলতা যেমন ছিল, তেমনি সবধরনের ধর্মীয়, সামাজিক, সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানগুলো পালন করা হতো নিয়মমতোই। এমন সুখ-স্বাচ্ছন্দ্যের জীবনে হঠাত্ একদিন চরম সংকট নেমে আসে। ব্যবসা-সংক্রান্ত একটি ভুল সিদ্ধান্তে ঈশ্বরচন্দ্রকে তাঁর জমিজমা, সহায়সম্বল বিক্রি করতে হয়। ফলে মারাত্মক অর্থনৈতিক বিপর্যয়ে পড়ে যান তিনি। প্রাচুর্য্য থেকে সর্বস্বান্ত হয়ে তিনি পতিত হন চরম দারিদ্র্যে। এ দুঃখকে সহজভাবে মেনে নিতে পারেননি তিনি। অচিরেই রোগে-শোকে, অপ্রকৃতিস্থ হয়ে ১৯২৫ সালে পরলোকগমন করেন ঈশ্বরচন্দ্র দেব।
শৈশবে টোলের পণ্ডিতদের কাছে হিন্দু ধর্ম ও সংস্কৃত ভাষা বিষয়ে পাঠ গ্রহণ করেছিলেন গোবিন্দচন্দ্র দেব। নিজ গ্রাম লাউতায় অবস্থিত তত্কালীন ‘লাউতা বালক বিদ্যালয়’-এ প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষাজীবন শুরু করেন তিনি। স্কুলজীবনের সেই দিনগুলোতে তিনি ছিলেন অত্যন্ত দুরন্ত প্রকৃতির। বিদ্যালয়ে যাবার নাম করে বাড়ি থেকে বেরিয়ে মাঝে মাঝে লুকিয়ে থাকতেন পাশের জঙ্গলে। লাউতা বালক বিদ্যালয়-এর পর তিনি ‘মধ্য ইংরেজি স্কুল’-এ পড়াশুনা করেন ষষ্ঠ শ্রেণী পর্যন্ত এবং ১৯২১ সালে ভর্তি হন ‘পঞ্চখণ্ড হরগোবিন্দ উচ্চ বিদ্যালয়’-এ। উক্ত বিদ্যালয় থেকে গোবিন্দ দেব ১৯২৫ সালে সংস্কৃত ও গণিতে লেটারসহ প্রবেশিকা পরীক্ষায় প্রথম বিভাগে উত্তীর্ণ হন। এই ফলাফলের জন্য তিনি লাভ করেন সরকারি বৃত্তি। এরপর তিনি কলকাতায় বড় ভাই বীরেন্দ্রচন্দ্র দেব পুরকায়স্থের কাছে চলে যান এবং ভর্তি হন কলকাতার রিপন কলেজে (বর্তমানে স্যার সুরেন্দ্রনাথ কলেজ)। এই কলেজ থেকে তিনি ১৯২৭ সালে যুক্তিবিদ্যায় লেটারসহ প্রথম বিভাগে উচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন এবং সরকারি বৃত্তি লাভ করেন। একই বছরে তিনি ভর্তি হন কলকাতার সংস্কৃত কলেজে বি.এ. সম্মান শ্রেণীতে। কলেজের তত্কালীন অধ্যক্ষ ও ভারতীয় দর্শন-বিশেষজ্ঞ ড. সুরেন্দ্রনাথ তরুণ গোবিন্দ দেবের মেধা, অধ্যবসায় এবং তীক্ষ্ণ ও গভীর চিন্তাশক্তির পরিচয় পেয়ে তাঁকে বিশেষ স্নেহের দৃষ্টিতে দেখতেন। সংস্কৃত কলেজ থেকেই গোবিন্দ দেব ১৯২৯ সালে দর্শনশাস্ত্রে দ্বিতীয় শ্রেণীতে বি.এ. সম্মান ডিগ্রি লাভ করেন। এরপর তিনি দর্শনশাস্ত্রে এম.এ. শ্রেণীতে ভর্তি হন কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে। ভারতীয় উপমহাদেশের প্রখ্যাত দার্শনিক ড. সর্বপল্লী রাধাকৃষ্ণন, ড. হীরালাল হালদার, কৃষ্ণচন্দ্র ভট্টাচার্য (কেসি ভট্টাচার্য), ড. মহেন্দ্রনাথ সরকার প্রমুখ দার্শনিকের ঘনিষ্ঠ সান্নিধ্য লাভ করেন তিনি এ বিশ্ববিদ্যালয়ে। তাঁদের উত্সাহ ও উদ্দীপনায় গভীরভাবে দর্শন অধ্যয়ন ও গবেষণায় আত্মনিয়োগ করেন গোবিন্দ দেব। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ১৯৩১ সালে দর্শনশাস্ত্রে প্রথম শ্রেণীতে প্রথম স্থান লাভ করে এম.এ. ডিগ্রি অর্জন করেন তিনি। এই ফলাফলের জন্য তিনি লাভ করেন বিশ্ববিদ্যালয় স্বর্ণপদক ও হেমচন্দ্র মুখার্জি রৌপ্যপদক।
এম.এ. পাস করার পর ১৯৩১ সালেই গোবিন্দ দেব কলকাতার রিপন কলেজে যোগদান করেন দর্শন ও ন্যায়শাস্ত্রের শিক্ষক হিসেবে। ১৯৩৪ সালে উচ্চতর গবেষণার জন্য তিনি বৃত্তি নিয়ে গমন করেন ভারতের মহারাষ্ট্র প্রদেশে অবস্থিত অমলনারের বিশ্বখ্যাত দর্শন গবেষণা কেন্দ্র Pratap Centre of Philosophy তে। কেসি ভট্টাচার্য তখন এই গবেষণা কেন্দ্রের পরিচালক ছিলেন। ভারতের এ Greatest Dialectician বলে পরিচিতি লাভ করা, মৌলিক চিন্তার অধিকারী ও আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন এই সুপণ্ডিত দার্শনিকের তত্ত্বাবধানে গোবিন্দ দেব ভারতীয় দর্শন বিশেষ করে বেদান্ত দর্শনে গবেষণা শুরু করেন। ১৯৩৭ সালের দিকে কলকাতায় ফিরে এসে তিনি পুনরায় শিক্ষকতায় যোগদান করেন রিপন কলেজে। ইতিমধ্যে ১৯৩৯ সালে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শুরু হলে এর প্রভাব পড়ে কলকাতায়। তখন কলেজ কর্তৃপক্ষের সিদ্ধান্তে রিপন কলেজটি স্থানান্তর করা হয় বর্তমান বাংলাদেশের দিনাজপুরে। গোবিন্দ দেবও দিনাজপুরে চলে এসে এই কলেজে শিক্ষকতা শুরু করেন। এখানে অবস্থানকালেই রচনা করেন তাঁর দীর্ঘ গবেষণার ফসল Reason, Intuition and Reality (প্রজ্ঞা, স্বজ্ঞা ও বাস্তবসত্তা) শিরোনামের অভিসন্দর্ভটি। উক্ত গবেষণা অভিসন্দর্ভের জন্য ১৯৪৪ সালে তিনি কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পিএইচডি ডিগ্রি লাভ করেন। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শেষ হলে ১৯৪৫ সালে দিনাজপুর থেকে কলেজটি আবার স্থানান্তরিত হয় কলকাতায়। কিন্তু ড. দেব থেকে যান দিনাজপুরে। স্বল্পকাল স্থায়ী কলেজটিকে পূর্ণরূপ দেয়ার জন্য একই স্থানে তিনি একে প্রতিষ্ঠা করেন সুরেন্দ্রনাথ কলেজ নামে। কলেজটির অধ্যক্ষ-সম্পাদক হিসেবে দায়িত্ব গ্রহণ করেন তিনি। তিনি এই কলেজের প্রতিষ্ঠাতা-অধ্যক্ষই শুধু ছিলেন না, ছিলেন এর প্রাণ ও হৃদয়। কলেজের অর্থনৈতিক সঙ্কটের দিনে সহযোগীদের সঙ্গে নিয়ে তিনি গ্রামে-গঞ্জে ঘুরে ঘুরে কলেজের জন্য তহবিল গড়ে তুলতে সভা সমিতি করেছেন। ১৯৪৬ সাল থেকে ১৯৫৩ সাল পর্যন্ত তিনি এই কলেজে অধ্যক্ষের দায়িত্ব দক্ষতার সঙ্গে পালন করেন।
দিনাজপুরের সুরেন্দ্রনাথ কলেজের অবলুপ্তি ঘটলে ১৯৫৩ সালে ড. দেব যোগ দেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের দর্শন বিভাগের প্রভাষক হিসেবে। তিনি ১৯৬২ সালের ১লা আগস্ট উন্নীত হন রিডার পদে এবং এর কিছুদিন পরে নিযুক্ত হন দর্শন বিভাগের বিভাগীয় প্রধান। ১৯৬৫ সালে তিনি অধ্যাপক পদে উন্নীত হন এবং অধ্যাপক ও বিভাগীয় প্রধানের দায়িত্ব পালন করেন মৃত্যুর পূর্ব পর্যন্ত। বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকতার পাশাপাশি হল প্রশাসনের দায়িত্বও অত্যন্ত দক্ষতার সঙ্গে পালন করেন জিসি দেব। তিনি ১৯৫৬ সালের ৩রা মার্চ থেকে ১৯৫৭ সালের ৩০ জুন পর্যন্ত সম্মিলিত ঢাকা-জগন্নাথ হলের সর্বশেষ যৌথ ভারপ্রাপ্ত প্রাধ্যক্ষ হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। জগন্নাথ হল স্বতন্ত্র সত্ত্বায় ফিরে এলে তিনি পুনরায় ১৯৫৭ সালের ৩০ জুন থেকে ১৯৬৬ সাল পর্যন্ত একটানা জগন্নাথ হলের প্রাধ্যক্ষের দায়িত্ব পালন করেন। কয়েক মাসের ছুটি শেষে ২ এপ্রিল ১৯৬৭ সাল থেকে ২০ এপ্রিল ১৯৭০ সাল পর্যন্ত পুনরায় জগন্নাথ হলের প্রাধ্যক্ষের দায়িত্ব পালন করেন। শিক্ষার প্রতি গভীর অনুরাগ থেকে তিনি দায়িত্ব পালন করেছেন তত্কালীন পূর্ব পাকিস্তান পালি ও সংস্কৃত বোর্ডের সম্পাদক, ঢাকাস্থ রামকৃষ্ণ মিশনের সম্পাদক, তদানীন্তন পূর্ব পাকিস্তান সরকারের অধীনে শিক্ষাসংস্কার কমিশনের সদস্য, বাংলা একাডেমির কার্যনির্বাহী কমিটির সদস্য ইত্যাদি গুরুত্বপূর্ণ পদে।
ড. গোবিন্দ দেব তাঁর চিন্তাচেতনায় ছিলেন সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ দার্শনিক সক্রেটিসের ভাবশিষ্য। দর্শনের প্রতি প্রগাঢ় অনুরাগ ও ভালোবাসা ছিল তাঁর। দর্শনের সাধনায় তিনি মগ্ন থাকতেন আত্মভোলার মতো। তিনি বলতেন, ‘আমার আর কিছু থাক আর না থাক দর্শনের ওপর প্রগাঢ় আসক্তি আছে। জীবনের নানা ঝড়-ঝঞ্ঝায় এই আসক্তিই আমাকে বাঁচিয়ে রেখেছে।’ তাঁর ছোটবেলায় প্রচলিত অধ্যাত্মবাদ ও বস্তুবাদ নামক দুটি পরস্পরবিরোধী চিন্তাধারা তাঁকে দর্শনে নিজস্ব মতবাদ রচনায় প্রভাবিত করেছে। দার্শনিক প্লেটোর ভাববাদ বা অধ্যাত্মবাদকে তিনি মনে করতেন একদেশ-দর্শী, আর মার্কসীয় বস্তুবাদী দর্শনে মানুষের আধ্যাত্মিক সত্ত্বার অনুপস্থিতির কারণে একেও সমর্থন করতে পারেননি। খ্রিস্টান মিশনারিদের কাছে কৈশোরের আট বছরের জীবন ড. দেবকে করে তুলেছিল অধ্যাত্মবাদে বিশ্বাসী আর তাঁর দুঃসাহসিক ও পরবর্তীতে বিপর্যস্ত, হতাশাগ্রস্ত পিতার জীবন তাঁকে দিয়েছিল বস্তুবাদে বিশ্বাস। সে কারণেই তিনি অনুভব করেছিলেন এমন একটি দার্শনিক মতবাদের যা মানুষের অর্থনৈতিক মুক্তি নিশ্চিত করবে, একইসাথে তাকে আধ্যাত্মিক মুক্তিও দেবে। অধ্যাত্মবাদ ও বস্তুবাদ উভয় মতের সমন্বয়ে তিনি গঠন করেন সমন্বয়ী ভাববাদ নামক দার্শনিক মতবাদের। এই সমন্বয়ী ভাববাদকে তিনি অভিহিত করেছেন তাঁর জীবনের সংগীত বলে। এই মতবাদ তাঁর কাছে ‘নিছক একটি মতবাদই নয়, নিছক কোনো যুক্তির মালা গাঁথা নয়, বরং জীবনকে ব্যবহারিক অভিযোজনের মাধ্যমে সুন্দর করার প্রয়াস।’ তাঁর মতে দর্শন মানেই জীবনদর্শন। আজীবন এই জীবনদর্শনেরই চর্চা করেছেন তিনি। তাঁরই চেষ্টায় ১৯৬৪ সালে ঢাকায় স্থাপিত হয় দর্শন ভবন নামে একটি প্রতিষ্ঠান। মনীষী দেবের নেতৃত্বে দর্শনের অনেক মূল্যবান বইসমৃদ্ধ এই গ্রন্থাগারে অনুষ্ঠিত হতো বিভিন্ন শিক্ষামূলক ও সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান। সেখানে অংশগ্রহণ করতেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের দর্শন বিভাগের ছাত্র-শিক্ষক এবং বাইরের আমন্ত্রিত অতিথিবৃন্দ। জায়গা-জমি সংক্রান্ত জটিলতায় দর্শন ভবনের অবলুপ্তি ঘটলে এর অর্থ-সম্পদের উল্লেখযোগ্য অংশ ড. দেব তাঁর জীবদ্দশায় দান করে দেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়কে। পরবর্তীতে তা যুক্ত হয়ে যায় ১৯৮০ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের দর্শন বিভাগে প্রতিষ্ঠিত ‘গোবিন্দ দেব দর্শন গবেষণা কেন্দ্র’ -এর সম্পদের সঙ্গে।
চিন্তাবিদ ও সুপণ্ডিত দার্শনিক হিসেবে খ্যাতি লাভ করা গোবিন্দচন্দ্র দেব দৈনন্দিন জীবনে ছিলেন অত্যন্ত সাধারণ। প্রতিদিন ভোরবেলায় উঠে গীতা-বাইবেল-কোরআন পড়তেন। তারপর ধ্যানে বসে মৌনব্রত পালন করতেন। চেহারা ও বেশভূষাও তাঁর অতি সাধারণ অথচ জ্ঞাননিষ্ঠ একটি জীবনেরই পরিচয় বহন করত। স্ফীত উদরে মোটাসোটা দেহের গড়ন, আশুতোষ-গোঁফ, একমাথা সাদাকালো অগোছালো চুল – এই ছিল তাঁর সামগ্রিক চেহারা। নিজের বিরাট দেহ সম্পর্কে রসিকতা করে তিনি নিজেই বলেছেন ‘বাল্যাবধি দর্পণের সঙ্গে প্রায় অসহযোগ।’ নিত্য পরিধেয় সাদা ধূতি, পাঞ্জাবি ও চাদরের অনাড়ম্বর পোশাকে তাঁর এই ‘বিরাট দেহ’ বোধহয় তাঁর খ্যাতির সাথে বেশভূষার একটা বিস্তর তফাত তৈরি করত কারো কারো মনে। একবার স্টিমারের প্রথম শ্রেণীর (আপার ক্লাসের) দরজার সামনে ড. দেবকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে টিকেট পরীক্ষক ভদ্রলোক অত্যন্ত অবাক হয়ে বলেছিলেন ‘এটা আপার ক্লাস।’ বিষয়টি বুঝতে পেরে সুরসিক দার্শনিক স্পষ্ট ও প্রাঞ্জল ইংরেজিতে ওই কর্মকর্তাকে বলেন: ‘My dear friend, my appearance is third class, but my ticket is first class।’ এমনই সহজ সরল, সদাপ্রফুল্ল মানুষ ছিলেন তিনি। আর ছিলেন ভোজনরসিক। তবে গুছিয়ে খেতে পারতেন না তিনি, খেতেন বাচ্চাদের মতো ছড়িয়ে ছিটিয়ে। একজন সুবক্তাও ছিলেন তিনি। ক্লাশকক্ষ ও বিভিন্ন সভা-সমিতিতে তাঁর স্বভাবসুলভ বাচনভঙ্গি ও রসালো গল্প-উপমার সাহায্যে দেয়া বক্তৃতা যে কারও মনোযোগ আকর্ষণ করে রাখত ঘন্টার পর ঘন্টা। অ্যারিস্টটলের অনুসারীদের মতো তিনিও ছিলেন একজন ‘পেরিপেটেটিক’ দার্শনিক। যে কোনো স্থানে বক্তৃতা দিতেন পায়চারি করে। ইংরেজি, বাংলা উভয় ভাষাতেই তাঁর ছিল অগাধ পাণ্ডিত্য। সুরসিক শিল্পীর মতো রসাত্মক গল্প, কৌতুক মিশিয়ে দর্শনের কঠিন ও আপাত নীরস তত্ত্বকে উপস্থাপন করতেন তাঁর বক্তৃতায় ও লেখায়।
ড. দেব ‘Reason, Intuition and Reality‘ শিরোনামের অভিসন্দর্ভ লিখে ডক্টরেট ডিগ্রী লাভ করেছিলেন কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে। ১৯৫২ সালে এই অভিসন্দর্ভ বই আকারে প্রকাশিত হয় ‘Idealism and Progress‘ নামে। এই বইটিসহ ড. জিসি দেবের প্রকাশিত মোট বই নয়টি, যার মধ্যে দুইটি বাংলায় এবং সাতটি ইংরেজিতে। তাঁর জীবদ্দশায় প্রকাশিত অন্য বইগুলো হলো ‘Idealism: A New Defense and a New Application‘, ‘আমার জীবন দর্শন’,’Aspirations of the Common Man’, ‘The Philosophy of Vivekananda and the Future of Man‘, ‘তত্ত্ববিদ্যা-সার’, এবং ‘Buddha, the Humanist.’ তাঁর মৃত্যুর পরে অধ্যাপক আমিনুল ইসলামের সম্পাদনায় ১৯৮৪ সালে প্রকাশিত হয় ‘Parables of the East‘ এবং ১৯৯৩ সালে ‘My American Experience‘ নামক বই দুটি। এছাড়া দেশ-বিদেশের বিভিন্ন পত্র-পত্রিকায় তাঁর ১৬টি বাংলা ও ৫৪টি ইংরেজি প্রবন্ধ প্রকাশিত হয়। এগুলোর মধ্যে ‘দর্শন ও একজগৎ’, ‘বিশ্ব সভ্যতায় মুসলিম দার্শনিকদের দান’, ‘সমন্বয় দর্শন ও মানুষের ভবিষ্যৎ’, ‘Religion without Theological Affiliation’, ‘Humanism and Rationalism’, ‘In Search of a New Philosophy of Education’, ‘Science and Religion‘ ইত্যাদি উল্লেখযোগ্য।
দর্শনে বিশেষ অবদান এবং বিভিন্ন সামাজিক ও সাংস্কৃতিক প্রতিষ্ঠানে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখার জন্য গোবিন্দ দেব জাতীয় ও আন্তর্জাতিক পর্যায়ে সম্মানিত হয়েছেন অনেকবার। তদানীন্তন ‘পূর্ব পাকিস্তান সারস্বত সমাজ’ কর্তৃক ১৯৬১ সালে তাঁকে ‘দর্শন সাগর’ উপাধিতে ভূষিত করা হয়। গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার শহীদ ড. গোবিন্দচন্দ্র দেবকে শিক্ষা ক্ষেত্রে গৌরবময় অবদান ও কীর্তির স্বীকৃতিস্বরূপ ১৯৮৫ সালে তাঁকে মরণোত্তর একুশে পদক পুরস্কারে এবং বাংলাদেশের স্বাধীনতা ও মুক্তিযুদ্ধে অবদানের জন্য ২০০৮ সালে মরণোত্তর স্বাধীনতা পুরস্কারে ভূষিত করেন। শহীদ দেবের স্মৃতি রক্ষা, তাঁর দর্শনের প্রচার ও প্রকাশনার জন্য ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের দর্শন বিভাগে ১৯৭২ সালে প্রতিষ্ঠিত হয় ‘দেব স্মৃতি সংসদ’ ও ‘দেব স্মৃতি পাঠাগার’। ১৯৮০ সালে এই বিভাগে প্রতিষ্ঠিত হয় ‘Dev Centre for Philosophical Studies‘ নামক একটি সেন্টার যা পরে নামকরণ হয় গোবিন্দ দেব দর্শন গবেষণা কেন্দ্র নামে। আন্তর্জাতিক পর্যায়ে তিনি পাকিস্তান ফিলসফিক্যাল কংগ্রেস ও ইন্ডিয়ান ফিলসফিক্যাল কংগ্রেসের সভাপতি ও শাখা সভাপতি হিসেবে এবং যুক্তরাজ্যের দি ইউনিয়ন অব দ্য স্টাডি অব জেনারেল রিলিজিয়ন্স-এর এবং যুক্তরাষ্ট্রের মিশিগান বিশ্ববিদ্যালয়ের ফিলসফি অব সায়েন্স অ্যাসোসিয়েশনের সদস্য নির্বাচিত হন। মাঝেমধ্যে দু-এক বছরের বিরতিসহ মৃত্যুর পূর্ব পর্যন্ত তিনি অধিষ্ঠিত ছিলেন পাকিস্তান ফিলসফিক্যাল কংগ্রেস পূর্ব পাকিস্তান শাখার সম্পাদক হিসেবে। ‘৬৬-৬৭ এবং ‘৭০-৭১ সালে তিনি দুইবার ভিজিটিং ফুল ব্রাইট অধ্যাপক ও বক্তারূপে যুক্তরাষ্ট্রের পেনসেলভেনিয়া প্রদেশের Wilkes College-এ গমন করেন। তাঁর পাণ্ডিত্যের স্বীকৃতিস্বরূপ এবং মানবতাবাদী দর্শন প্রচারের জন্য যুক্তরাষ্ট্রে ১৯৬৭ সালের ২৬শে মে স্থাপিত হয় দি গোবিন্দ দেব ফাউন্ডেশন ফর ওয়ার্ল্ড ব্রাদারহুড। এ প্রতিষ্ঠানের সভাপতির আমন্ত্রণক্রমেই ১৯৭০ সালের অক্টোবর মাসে তিনি পুনরায় চলে যান উইল্কিস কলেজে ভিজিটিং প্রফেসর হিসেবে। ভিজিটিং প্রফেসরের দায়িত্ব সম্পন্ন করে ড. দেব দেশে ফিরে আসেন ১৯৭১ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে এবং পুনরায় যোগদান করেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের দর্শন বিভাগের অধ্যাপকের পূর্বপদে। এর মাত্র কিছুদিন পরই তিনি নির্মমভাবে নিহত হন পাকিস্তান সেনাবাহিনীর নৃশংস ও অতর্কিত আক্রমণে।
দার্শনিক গোবিন্দচন্দ্র দেব ছিলেন অকৃতদার। কোনো সন্তানের জনক না হয়েও তাঁর অনেক ছাত্রছাত্রীর কাছেই তিনি ছিলেন পিতার মতো। ছাত্রছাত্রীদের তিনি অত্যন্ত ভালোবাসতেন। অনেক ছাত্রকেই তিনি বিপদে আপদে সাহায্য করেছেন বিভিন্নভাবে। রোগগ্রস্ত ছাত্রদের শয্যাপাশে উপস্থিত হয়েছেন গভীর রাতেও। জ্যোতিপ্রকাশ দত্ত ও রোকেয়া সুলতানাকে লালন-পালন করেছেন পালিত পুত্র-কন্যা হিসেবে। সবরকমের সুযোগ-সুবিধা দিয়ে উভয়কেই উচ্চশিক্ষায় প্রতিষ্ঠিত করেছেন, তাঁদের বিয়ের ব্যবস্থা করেছেন। তাঁদের জন্য তিনি উইল করে দিয়েছেন তাঁর স্থাবর-অস্থাবর সম্পত্তির এক উল্লেখযোগ্য অংশ। জাতি-ধর্ম-বর্ণ-গোত্র নির্বিশেষে সকলকেই তিনি দেখতেন সমান স্নেহ-মমতার দৃষ্টিতে। সকল ধর্মের প্রতিই তাঁর ছিল সমান শ্রদ্ধা। সকল ছাত্র, সহকর্মী, কর্মচারীর সঙ্গে তাঁর ছিল মধুর সম্পর্ক। অপরিচিত অনেক ক্ষুধার্ত মানুষকে বাসায় নিয়ে খাইয়েছেন তিনি, অন্ন-বস্ত্র-অর্থ দিয়ে যথাসাধ্য সাহায্য করেছেন বিভিন্নজনকে। পরিচিত সবার কাছে তিনি ছিলেন একান্ত আপনজন।
সত্কাজ করে একশো বছর বেঁচে থাকার ইচ্ছে ব্যক্ত করেছিলেন জিসি দেব তাঁর ‘আমার জীবন দর্শন’ গ্রন্থের শুরুতে। তাঁর সেই ইচ্ছের যবনিকাপাত ঘটে ‘৭১ এর ২৬ মার্চের ভোর রাতে, কতিপয় বিশ্বাসঘাতকের সহযোগিতায় পাকিস্তানী বর্বর সেনাবাহিনীর হাতে। তবে যতদিন বেঁচে ছিলেন, জীবনঘনিষ্ঠ ও মানবতাবাদী দর্শন প্রচার করেছেন তিনি। ৬৪ বছর বয়সে জীবনের অবসান ঘটলেও ‘সমন্বয়ী দার্শনিক মতবাদ’-এর প্রবক্তা শহীদ গোবিন্দচন্দ্র দেব বেঁচে আছেন মানবপ্রেমের মূর্ত প্রতীক হয়ে অসংখ্য মানুষের হৃদয়ে।
এক নজরে গোবিন্দচন্দ্র দেব
পূর্ণনাম, জন্ম : গোবিন্দচন্দ্র দেব পুরকায়স্থ; ১৯০৭ সালের ১লা ফেব্রুয়ারি সিলেট জেলার বিয়ানী বাজারের পঞ্চখণ্ড পরগনার লাউতা গ্রামের সম্বান্ত ‘দেব পুরকায়স্থ’ পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন।
বাবা-মা : ঈশ্বরচন্দ্র দেব পুরকায়স্থ, শরত্ সুন্দরী দেবী।
পরিবার : অকৃতদার। জ্যোতিপ্রকাশ দত্ত ও রোকেয়া সুলতানা যথাক্রমে তাঁর পালিত পুত্র ও কন্যা।
শিক্ষা : মাধ্যমিক – পঞ্চখণ্ড হরগোবিন্দ উচ্চ বিদ্যালয়, ১৯২৫; উচ্চমাধ্যমিক – রিপন কলেজ, কলকাতা, ১৯২৭; স্নাতক (সম্মান) – দর্শনশাস্ত্রে, সংস্কৃত কলেজ, ১৯২৯; স্নাতকোত্তর – কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়, ১৯৩১; পিএইচডি – কালকাতা বিশ্ববিদ্যালয়, ১৯৪৪।
পেশা : দার্শনিক ও অধ্যাপক।
কর্মজীবন : ১৯৩১-১৯৪৪, ১৯৩৭-১৯৩৯ কলকাতার রিপন কলেজে শিক্ষকতা; রিপন কলেজ দিনাজপুরে স্থানান্তরিত হলে সেখানে শিক্ষকতা করেন; দিনাজপুরে প্রতিষ্ঠা করেন সুরেন্দ্রনাথ কলেজ এবং এর প্রতিষ্ঠাতা-অধ্যক্ষ হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন ‘৪৬ থেকে ‘৫৩ পর্যন্ত। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের দর্শন বিভাগের প্রভাষক নিযুক্ত হন ১৯৫৩ সালে, ‘৬২তে রিডার পদে উন্নীত হন। একই বছরের শেষের দিকে বিভাগীয় প্রধান এবং ১৯৬৫ সালে অধ্যাপক পদে উন্নীত হন। ঢাকা-জগন্নাথ হলের যুগ্ম সত্তার সর্বশেষ যৌথ ভারপ্রাপ্ত প্রাধ্যক্ষ (১৯৫৬ থেকে ১৯৫৭ পর্যন্ত); জগন্নাথ হলের প্রাধ্যক্ষ ১৯৫৭ থেকে ১৯৬৬ সাল পর্যন্ত এবং ‘৬৭ থেকে ‘৭০ পর্যন্ত। তিনি তত্কালীন পূর্ব পাকিস্তান পালি ও সংস্কৃত বোর্ডের সম্পাদক, ঢাকাস্থ রামকৃষ্ণ মিশনের সম্পাদক, তদানীন্তন পূর্ব পাকিস্তান সরকারের অধীনে শিক্ষাসংস্কার কমিশনের সদস্য, বাংলা একাডেমীর কার্যনির্বাহী কমিটির সদস্য ইত্যাদি হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন।
প্রকাশনা : মোট গ্রন্থ নয়টি, যার মধ্যে দুইটি বাংলায় এবং সাতটি ইংরেজিতে। জীবদ্দশায় প্রকাশিত বই ‘Idealism and Progress’ (1952), ‘Idealism: A New Defence and a New Application’ (1958), ‘আমার জীবন দর্শন’ (১৯৬০), ‘Aspirations of the Common Man’ (1963), ‘The Philosophy of Vivekananda and the Future of Man‘ ‘তত্ত্ববিদ্যা-সার’ (১৯৬৬), এবং ‘Buddha, the Humanist’ (1969)। মৃত্যুর পরে প্রকাশিত হয় ‘Parables of the East’ (1984)এবং ‘My American Experience’ (1993)। এছাড়া ১৬টি বাংলা ও ৫৪টি ইংরেজি প্রবন্ধ প্রকাশিত হয় বিভিন্ন পত্র-পত্রিকায়।
স্বীকৃতি : তাঁর দর্শনের প্রচার ও প্রকাশনার জন্য ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের দর্শন বিভাগে প্রতিষ্ঠিত হয় দেব স্মৃতি সংসদ (১৯৭২), দেব স্মৃতি পাঠাগার (১৯৭২) এবং ‘Dev Centre for Philosophical Studies‘ (১৯৮০) (পরে নামকরণ হয় গোবিন্দ দেব দর্শন গবেষণা কেন্দ্র)। দার্শনিক অবদানের স্বীকৃতিস্বরূপ আন্তর্জাতিক পর্যায়ে নির্বাচিত হন পাকিস্তান ফিলসফিক্যাল কংগ্রেস ও ইন্ডিয়ান ফিলসফিক্যাল কংগ্রেসের সভাপতি ও শাখা সভাপতি হিসেবে। মৃত্যুর পূর্ব পর্যন্ত তিনি অধিষ্ঠিত ছিলেন পাকিস্তান ফিলসফিক্যাল কংগ্রেস পূর্ব পাকিস্তান শাখার সম্পাদক হিসেবে। তিনি যুক্তরাজ্যের দি ইউনিয়ন অব দ্য স্টাডি অব জেনারেল রিলিজিয়ন্স-এর এবং যুক্তরাষ্ট্রের মিশিগান বিশ্ববিদ্যালয়ের ফিলসফি অব সায়েন্স অ্যাসোসিয়েশনের সদস্য নির্বাচিত হন। দুইবার ভিজিটিং ফুল ব্রাইট অধ্যাপক ও বক্তারূপে যুক্তরাষ্ট্রের পেনসেলভেনিয়া প্রদেশের Wilkes College-এ গমন করেন। তাঁর পাণ্ডিত্যের স্বীকৃতিস্বরূপ এবং মানবতাবাদী দর্শন প্রচারের জন্য যুক্তরাষ্ট্রে ১৯৬৭ সালের ২৬শে মে স্থাপিত হয় দি গোবিন্দ দেব ফাউন্ডেশন ফর ওয়ার্ল্ড ব্রাদারহুড।
পুরস্কার : মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষায় কৃতিত্বপূর্ণ ফলাফলের জন্য সরকারী বৃত্তি লাভ করেন। এম.এ. পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়ে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বিশ্ববিদ্যালয় স্বর্ণপদক ও হেমচন্দ্র মুখার্জি রৌপ্যপদক লাভ করেন। পূর্ব পাকিস্তান শিক্ষিত সমাজ কর্তৃক ১৯৬১ সালে ‘দর্শন সাগর’ উপাধিতে ভূষিত হন। গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার কর্তৃক শিক্ষা ক্ষেত্রে গৌরবময় অবদান ও কীর্তির স্বীকৃতিস্বরূপ মরণোত্তর একুশে পদক (১৯৮৫) এবং বাংলাদেশের স্বাধীনতা ও মুক্তিযুদ্ধে অবদানের জন্য স্বাধীনতা পুরস্কার (২০০৮) (মরণোত্তর) লাভ করেন।
মৃত্যু : ১৯৭১ সালের ২৬ মার্চ ভোররাতের প্রথম প্রহরে পাকিস্তানী হানাদার বাহিনীর গুলিতে শহীদ হন অধ্যাপক ড. গোবিন্দচন্দ্র দেব।
কৃতজ্ঞতা: গোবিন্দচন্দ্র দেব-এর দুর্লভ ছবি ও গুরুত্বপূর্ণ তথ্য দিয়ে সাহায্য করেছেন অধ্যাপক ডক্টর প্রদীপ রায়। তাঁর প্রতি রইল আন্তরিক কৃতজ্ঞতা।
তথ্যসূত্র:
– সাক্ষাত্কার: রোকেয়া সুলতানা (শহীদ গোবিন্দচন্দ্র দেব-এর পালিতা কন্যা);
– আমিনুল ইসলাম; গোবিন্দচন্দ্র দেব: জীবন ও দর্শন; সূচীপত্র; ঢাকা; ২০০৮
– ডক্টর প্রদীপ রায় ও মালবিকা বিশ্বাস সম্পাদিত; গোবিন্দচন্দ্র দেব: জীবন ও দর্শন; অবসর; ঢাকা; ২০০৮
– ডক্টর প্রদীপ রায় সম্পাদিত; গোবিন্দচন্দ্র দেব: অগ্রন্থিত প্রবন্ধ ও অন্যান্য রচনা; বাংলা একাডেমী, ঢাকা; ২০০২
লেখক : মোঃ কুতুব উদ্দিন সজিব