২৫ মার্চ ১৯৭১। মধ্যরাতে ঢাকা শহরের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ল পাকিস্তানী সৈন্যরা। নির্বিচারে নিরীহ বাঙালীদের হত্যা করতে শুরু করল তারা। তত্কালীন পূর্ব পাকিস্তানের জনসাধারণের গণতান্ত্রিক রাজনৈতিক অধিকারকে পদানত করতে তারা শুরু করল হত্যা ও ত্রাসের এক বিভীষিকাময় অধ্যায়। রাত আড়াইটার দিকে হানাদার সেনাবাহিনীর কতকগুলি সশস্ত্র গাড়ি ঢুকে পড়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের জগন্নাথ হলে। নির্বিচার হত্যাযজ্ঞ চালায় তারা। ছাত্রদের হত্যার পর তারা ঢুকে পড়ে শিক্ষকদের আবাসিক হলে। শহীদ মিনার সংলগ্ন শিক্ষক কোয়ার্টারের বাইরের গেটের তালা ভেঙে তারা ভিতরে ঢুকে পড়ে। প্রত্যেক শিক্ষকের বাসার দরজায় ভারি বুটের লাথি পড়ে। কয়েকজন সৈন্য অধ্যাপক জ্যোতির্ময় গুহঠাকুরতার বাসায় ঢুকে চিত্কার করে ওঠে : ‘প্রফেসার হ্যায়?’
উত্তরে বেরিয়ে এসে বাসন্তী গুহঠাকুরতা জানালেন, অধ্যাপক সাহেব বাসায় আছেন। একজন সামরিক কর্মকর্তা বললেন, ‘উনকো লে যায়েগা।’
বাসন্তী গুহঠাকুরতা শুধালেন, ‘কিউ লে যায়েগা? কাঁহা লে যায়েগা?’
তারপর তিনি স্বামীকে গিয়ে বললেন, ‘ওরা তোমাকে অ্যারেস্ট করতে এসেছে।’
অধ্যাপক নিঃশব্দে সৈন্যদের সামনে এসে দাঁড়ালেন। সৈন্যরা জোর করে ধরে তাঁকে ঘরের বাইরে টেনে নিয়ে গেল। তাঁকে জিজ্ঞাসা করা হলো নাম কী, ধর্ম কী ইত্যাদি। অধ্যাপক নিজের নাম ও ধর্মের পরিচয় দিলেন। তারপরই গুলির শব্দ। একটা গুলি ভেদ করে গেল তাঁর গ্রীবা। আবার একটি গুলি হলো, সেটি বিদ্ধ করল তাঁর কোমর। লুটিয়ে পড়লেন সদাহাস্যময়, বন্ধু ও ছাত্রবত্সল, নিরীহ, আপনভোলা মানুষ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজী বিভাগের অধ্যাপক জ্যোতির্ময় গুহঠাকুরতা। কিন্তু সংজ্ঞা হারালেন না, যেন প্রায়-স্বাভাবিক কন্ঠেই স্ত্রীকে ডেকে বললেন, ‘বাসন্তী, জল দাও।’ ওনার ডাক শুনে একই ফ্ল্যাটের শহীদ মুনিরুজ্জামানের স্ত্রী বাসন্তী গুহঠাকুরতাকে খবর দিলেন-তাঁর স্বামী বাইরে গুলিবিদ্ধ অবস্থায় পড়ে আছেন। তখন বাসন্তী গুহঠাকুরতা বাসার ও পাড়ার লোকজনের সাহায্যে ড. জ্যোতির্ময় গুহঠাকুরতাকে ঘরে নিয়ে আসেন।
পরদিন ২৬ মার্চ ঢাকা শহরে কারফিউ। অবরুদ্ধ অবস্থায় বাসার মধ্যেই কেটে গেল সারা দিন। অদূরেই ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল; কিন্তু বের হওয়ার কোনো উপায় নেই।
২৭ তারিখ সকালে কারফিউ তুলে নেওয়া হলে তাঁকে নেওয়া হলো ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে। কিন্তু চিকিত্সা কিছুই তেমন হলো না; তাছাড়া তেমন কিছু করারও আর ছিল না। চিকিৎসকরা বিস্ময় প্রকাশ করে বললেন, ‘উনি যে কেমন করে এ কয়দিন বেঁচে আছেন, সেটাই আমাদের কাছে বিস্ময়।’
২৮ ও ২৯ মার্চ গেল, ৩০ মার্চ সকালে তিনি পৃথিবী থেকে বিদায় নিলেন। চেতনা চিরলুপ্ত হওয়ার আগে গুন গুন করে গাইলেন: ভেঙেছ দুয়ার, এসেছ জ্যোতির্ময়…।
কিন্তু এই নৃশংস, বিভীষিকাময় পরিণতি তাঁর জন্য অনিবার্য ছিল না। এটা তিনি অবশ্যই এড়াতে পারতেন। ২৫ মার্চের গণহত্যা ও বুদ্ধিজীবী নিধনযজ্ঞ শুরু হওয়ার আগেই তিনি সপরিবারে চলে যেতে পারতেন নিরাপদ কোনো স্থানে। কিন্তু অটল কর্তব্যপরায়ণ এই শিক্ষক, যাঁর উপর একটি আবাসিক হলের সকল ছাত্র ও কর্মচারীর সব দায়িত্ব অর্পিত, তিনি সেই দায়িত্ব এড়িয়ে নিজের প্রাণ বাঁচানোর জন্য নিরাপদ আশ্রয়ে পলায়নের চেষ্টা করেননি।
সারা মার্চ মাস জুড়ে ঢাকা শহর রাজনৈতিক অস্থিরতায় উত্তাল। অনিশ্চয়তা ও নিরাপত্তাহীনতা ক্রমশ প্রকট হয়ে উঠছিল; সকলের মনেই আশঙ্কা ঘনিয়ে উঠছিল ভয়াবহ রক্তপাতের। এসব সম্পর্কে সম্পূর্ণ ওয়াকিবহাল ছিলেন অধ্যাপক জ্যোতির্ময় গুহঠাকুরতাও। উপরন্তু ২৫ মার্চের আগে তাঁর আত্মীয়-স্বজনরা লোক মারফত বলে পাঠিয়েছিলেন, তাঁরা যেন বিশ্ববিদ্যালয় কোয়ার্টার ছেড়ে গেণ্ডারিয়ার ওদিকে কোথাও গিয়ে আশ্রয় নেন। সেটা হবে অপেক্ষাকৃত নিরাপদ। কিন্তু বাসন্তী দেবীর ভাষ্য: “আমার স্বামী বললেন, ‘আমি হলের দায়িত্ব ছেড়ে যাই কি করে? ভাইস চ্যান্সেলার বিচারপতি চৌধুরীও ঢাকাতে নেই। তিনি নিজে অনুরোধ করে আমাকে ন’মাস আগে প্রভোস্টের দায়িত্ব গ্রহণ করিয়েছেন। ছেলেরা সব আবার হলে ফিরে আসছে। আমি তাদের ছেড়ে যাব কি করে? না, বাসন্তী তা হয় না। যা হবার তা হবে।'” বাসন্তী দেবী নিজেও স্বামীকে অনুরোধ করেন, অন্তত কিছুদিনের জন্য নিরাপদ কোথাও সরে গিয়ে থাকা যায় না? তার উত্তরে অধ্যাপক বলেন, ‘হলে কর্মচারিরা রয়েছে, ছাত্রছাত্রীরা রয়েছে, ওদের সর্বনাশ হলে আমি ফিরে এসে মুখ দেখাব কি করে?’
এভাবেই অধ্যাপক জ্যোতির্ময় গুহঠাকুরতার নাম যুক্ত হয় একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধের প্রথম প্রহরে শহীদ বুদ্ধিজীবীদের নামের তালিকায়। সংখ্যালঘু হিন্দু সম্প্রদায়ের তিনজন শহীদ বুদ্ধিজীবীর তিনি অন্যতম। ধর্মভিত্তিক দ্বি-জাতিতত্ত্বের ভিত্তিতে ১৯৪৭ সালে দেশবিভাগ, মুসলমানদের আলাদা রাষ্ট্র পাকিস্তানের জন্মের ফলে অমুসলিম, বিশেষত হিন্দু সম্প্রদায়ের মানুষের মনে জেগে ওঠা নৈরাশ্য ও নিরাপত্তাহীনতার বোধ এবং ১৯৫০ সালে ঢাকায় ভয়াবহ সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার ফলে বহু হিন্দু দেশত্যাগ করতে বাধ্য হন। জগন্নাথ কলেজ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এবং অন্যান্য শিক্ষা প্রতিষ্ঠান থেকে বহু হিন্দু শিক্ষক ভারতে চলে যান, ফলে শিক্ষা ক্ষেত্রে বিরাট শিক্ষকসংকট সৃষ্টি হয়। সেই সংকট তীব্রতর হওয়ার প্রক্রিয়ায় যুক্ত হননি অধ্যাপক জ্যোতির্ময় গুহঠাকুরতা। নানাবিধ অসুবিধার সম্মুখীন হয়েও তিনি আপন মাতৃভূমি ত্যাগ করে কোথাও চলে যাননি। তিনি ভালোবাসতেন তাঁর স্বদেশকে, মাতৃভূমির প্রতি তাঁর কর্তব্যবোধও ছিল অপরিসীম, এবং প্রিয় মাতৃভূমির জন্যই তিনি আপন প্রাণ উত্সর্গ করে গেছেন।
তাঁর পৈত্রিক নিবাস ছিল বরিশালের বানারীপাড়ায়। পিতা কুমুদচন্দ্র গুহঠাকুরতা ও মাতা সুমতি গুহঠাকুরতা উভয়ে ছিলেন স্কুলশিক্ষক; চাকুরিসূত্রে যখন তাঁর মা ময়নসিংহ শহরের অধিবাসী, তখন ১৯২০ সালে সেই শহরেই জন্মগ্রহণ করেন জ্যোতির্ময় গুহঠাকুরতা। শিক্ষিত মধ্যবিত্ত সংস্কৃতিবান পরিবারের সন্তান জ্যোতির্ময়ের বিদ্যাশিক্ষায় হাতেখড়ি ঘটে সেখানেই। ১৯৩৬ সালে তিনি ময়মনসিংহ জেলা স্কুল থেকে প্রথম বিভাগে এসএসসি পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন। তারপর তিনি চলে যান কলকাতা; প্রেসিডেন্সি কলেজে উচ্চমাধ্যমিক শ্রেণীতে ভর্তি হন এবং এক বছর পড়াশুনা করেন। কিন্তু টাইফয়েডে আক্রান্ত হওয়ায় নির্ধারিত সময়ে ফাইনাল পরীক্ষা দিতে পারেন না। পরে ময়মনসিংহ আনন্দ মোহন কলেজে ভর্তি হয়ে ১৯৩৯ সালে প্রথম বিভাগে এইচ.এস.সি. পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হওয়ার পর তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি সাহিত্যে ভর্তি হন এবং ১৯৪২ সালে প্রথম শ্রেণীতে প্রথম স্থান অধিকার করে বি.এ. অনার্স ডিগ্রি অর্জন করেন। অনার্স পরীক্ষায় ইংরেজীতে অত্যন্ত কৃতিত্বপূর্ণ ফলাফল করায় এবং সাবসিডিয়ারী বিষয় দর্শনে রেকর্ড নম্বর পাওয়ায় তিনি পোপ মেমোরিয়েল স্বর্ণপদক লাভ করেন। ১৯৪৩ সনে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি বিভাগ থেকে দ্বিতীয় শ্রেণীতে প্রথম স্থান অধিকার করে স্নাতকোত্তর ডিগ্রি অর্জন করেন।
তাঁর কর্মজীবন শুরু হয় ১৯৪৪ সালে কিশোরগঞ্জের নবপ্রতিষ্ঠিত গুরুদয়াল কলেজে। সেখানে দুই বছর দায়িত্ব পালনের পর তিনি ময়মনসিংহ আনন্দমোহন কলেজে ইংরেজী বিভাগে প্রভাষক হিসেবে যোগ দেন। সেখানে ছয় মাস শিক্ষকতার পর ১৯৪৬ সালে তিনি চলে আসেন ঢাকায়, যোগ দেন ঢাকার জগন্নাথ কলেজে। সেখানে তিন বছর শিক্ষকতার পর ১৯৪৯ সালের ১২ নভেম্বর অস্থায়ী প্রভাষক হিসেবে যোগ দেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজী বিভাগে। তাঁর পদ স্থায়ী হয় ১৯৫০ সালের ১৬ সেপ্টেম্বর। এই পদে প্রায় দুই দশক শিক্ষকতা করার পর তিনি পিএইচডি করতে বিলেত যান ১৯৬৩ সালে। ১৯৬৭ সালে লন্ডন বিশ্ববিদ্যালয়ের কিংস কলেজ থেকে কৃতিত্বের সঙ্গে পিএইচডি ডিগ্রি অর্জন করেন; তাঁর অভিসন্দর্ভের শিরোনাম ছিল ক্ল্যাসিক্যাল মিথস্ ইন দি প্লেইজ অব সুইনবার্ন, ব্রিজেজ, স্টার্জ মুর অ্যাণ্ড এলিয়ট।
লণ্ডন বিশ্ববিদ্যালয়ে পিএইচডি গবেষণাকালে ১৯৬৪ সালের ১০ জুলাই তিনি যোগ দেন হেইগে অনুষ্ঠিত ইন্টারন্যাশনাল হিউম্যানিস্ট অ্যান্ড এথিক্যাল ইউনিয়নের সম্মেলনে। সেখানে তিনি বক্তৃতা করেন পাকিস্তান ও ভারত উভয় দেশের প্রতিনিধি হিসেবে। এই ঘটনায় পাকিস্তান সরকার তাঁর প্রতি ভীষণ রুষ্ট হয়, তাঁকে ভারতের চর বলে অভিযুক্ত করে এবং তাঁর ভারত ভ্রমণে যাওয়ার ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে। তিনি অনেকবার বৃদ্ধা মাকে দেখার জন্য কলকাতা যাওয়ার অনুমতির জন্য আবেদন করেন; পূর্ব পাকিস্তানের স্বরাষ্ট্র দপ্তর থেকে ইতিবাচক সুপারিশসহ তাঁর পাসপোর্ট বার বার পশ্চিম পাকিস্তানে কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্র দপ্তরে পাঠানো হয়, কিন্তু সেখানে তা বার বার নামঞ্জুর হয়ে ফিরে আসে। এর আগে ১৯৬৩ সালে উচ্চশিক্ষার্থে তাঁর বিলেত যাওয়ার অনুমতিও পাকিস্তান কর্তৃপক্ষ প্রাথমিকভাবে নাকচ করে দিয়েছিল। অনেক কাঠখড় পুড়িয়ে অবশেষে সেই অনুমতি মিলেছিল। একইভাবে বেশ কয়েক বছর ধরে প্রত্যাখ্যাত হওয়ার পর অবশেষে তিনি মাকে দেখতে কলকাতা যাওয়ার অনুমতি পেয়েছিলেন ১৯৭১ সালের গোড়ার দিকে।
পিএইচডি করতে বিলেত যাওয়ার আগে ১৯৫৮ সালের অক্টোবর মাসে তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের জগন্নাথ হলের আবাসিক শিক্ষক নিযুক্ত হন। ১৯৬৩ সালে বিলেত যাওয়ার পূর্ব পর্যন্ত তিনি ঐ পদেই ছিলেন। পিএইচডি শেষে দেশে ফিরে তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজী বিভাগে রিডারের দায়িত্ব গ্রহণ করেন ১৯৬৭ সালের ডিসেম্বর মাসে। তিনি আমৃত্যু ঐ পদেই ছিলেন। এরপর ১৯৭০ সালের ২০শে এপ্রিল জগন্নাথ হলের প্রাধ্যক্ষের দায়িত্ব গ্রহণ করেন। ঐ পদে দায়িত্বরত অবস্থায় তিনি শহীদ হন। তিনি ফ্রেণ্ডস্ সেন্টার, ঢাকা (ইন্টারন্যাশন্যাল কোয়েকার সার্ভিসের কেন্দ্র), বুলবুল ললিত কলা একাডেমী, ঢাকা এবং আন্তর্জাতিক র্যাডিক্যাল হিউম্যানিস্ট এসোসিয়েশনের সদস্য ছিলেন।
অত্যন্ত মনোযোগের সাথে তিনি ছাত্রদের শেখাতেন। প্রখর মেধাসম্পন্ন ও আকর্ষণীয় ব্যক্তিত্বের অধিকারী শিক্ষক ছিলেন জ্যোতির্ময়। কথা বলতেন স্পষ্ট উচ্চারণে। তিনি ছাত্রদেরকে জ্ঞান দেওয়ার পাশাপাশি তাদের জানার আগ্রহটাও তৈরী করতেন। তিনি মনে করতেন শুধুমাত্র বাংলা সাহিত্য জানলেই চলবে না, বিশ্বসাহিত্যের মূলধারাগুলি সম্পর্কেও জানা প্রয়োজন। সেই মুল ধারাগুলির সাহায্যে বাঙ্গালি সংস্কৃতি শোনা দরকার। ছাত্রদের সাথে ছিল তাঁর প্রীতিপূর্ণ সম্পর্ক। আর ছাত্রদের সাথে তাঁর এই প্রীতিপূর্ণ সম্পর্ক বিশ্ববিদ্যালয়ের শান্তিশৃঙ্খলা রক্ষায় সহায়তা করেছিল। স্বাধীনতার পর বাংলাদেশে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়কে কেন্দ্র করে বিভিন্ন প্রগতিশীল আবৃত্তি, বিতর্ক ও নাট্য গোষ্ঠীর জন্ম হয়েছিল। এর পটভূমি প্রস্তুত করতে স্বল্পসংখ্যক সংস্কৃতিবান এবং সাহিত্য অনুরাগি শিক্ষক গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছিলেন। জ্যোতির্ময় গুহঠাকুরতা ছিলেন তাঁদের মধ্যে অগ্রগণ্য।
তিনি ‘মুকতি’ নামে একটি পত্রিকা বের করেছিলেন। ‘মুকতি’ বলতো মুক্ত বুদ্ধির কথা। কিন্তু ‘মুকতি’ দীর্ঘস্থায়ী হয়নি বেশীদিন। তিনি বিভিন্ন পত্রিকায় প্রবন্ধসহ অনেক বিষয়ে লেখালেখি করেছেন। তাঁর প্রকাশিত রচনার মধ্যে রয়েছে রেডিও বক্তৃতা, বৃটিশ কাউন্সিল ও অন্যান্য সংস্থা আয়োজিত বিভিন্ন আলোচনা সভায় বক্তৃতা, ইওরোপে থাকাকালীন র্যাডিক্যাল হিউমানিস্ট কনফারেন্স পাকিস্তান ও ভারতের প্রতিনিধি হিসাবে বক্তৃতা প্রভৃতি। বাংলা এবং ইংরেজী দুই ভাষাতেই তিনি স্বচ্ছন্দে বিচরণ করতেন। তাঁর লেখার পরিমান ছিল অনেক কম। কারণ তিনি আড্ডা দিতে খুব ভালবাসতেন। ফলে তাঁর চিন্তার বেশীরভাগই আড্ডার সময় বলে ফেলতেন। সেই চিন্তার লিখিতরূপ দেওয়ার প্রবল তাগিদ অনুভব করেননি কখনও।
শিক্ষকতা ও সাহিত্যের পাশাপাশি বাগানের প্রতিও ছিল তাঁর প্রচন্ড ঝোঁক। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কোয়ার্টারে যেখানে তিনি থাকতেন সেখানে তাঁর একটি বাগান ছিল। ছাত্রছাত্রীসহ সবাই তাঁর বাগান- প্রীতির কথা জানতেন। বাগানে নতুন সুন্দর ফুল ফুটলে তিনি সবাইকে ডেকে দেখাতেন। পত্রপত্রিকাতে ছাপানোর জন্য তাঁর বাগানের ছবি অনেকেই তুলে নিয়ে যেতেন। জ্যোতির্ময় গুহঠাকুরতার বাগানপ্রিয়তা নিয়ে এক মজার ঘটনা আছে- একবার কলেজের ছেলেরা কিভাবে যেন জেনে গেল তাঁদের স্যার ইন্টারমিডিয়েটের ইংরেজীর একটা প্রশ্নপত্র করেছেন। ঢাকার বেশ কয়েকটা কলেজের ছাত্ররা রচনা তৈরী করলো গার্ডেনিং-এর ওপর। আর জগন্নাথ হলের ছেলেদের সাজেশন জোগাড় করে অন্যান্য জেলার কিছু কিছু কলেজের ছেলেরাও রচনা তৈরী করলো একই বিষয়ের উপর। কিন্তু পরীক্ষাতে দেখা গেল রচনা-বিষয়ের মধ্যে গার্ডেনিং নেই, আছে ‘ফিশিং অ্যাজ এ হবী’। সেই অতি বুদ্ধিমান ছেলেগুলো স্যারের কাছে যেতেই তিনি হো হো করে হাসতে লাগলেন।
তাঁর বাগান সম্পর্কে তাঁর এক ছাত্রের স্মৃতিচারণ- কাছে যেতেই স্যার বললেন: ‘আরে, দেখে যাও কত সব ডালিয়া ফুটেছে আমার বাগানে। গেটের ভেতর ঢুকে বাগানটা ঘুরে দেখলাম স্যারের সঙ্গে। কি কোমল রঙিন ডাগর ডাগর ডালিয়া আর কি সুসজ্জিত সমারোহ! সত্যি মুগ্ধ হবার মতো। কোন্ বেডে কি সার দেয়া হয়েছে কোন্ বেডে কি কি রঙের ফুল ফোটানোর ব্যবস্থা হয়েছে এবং তার ফলে টোটাল এফেক্ট কি হলো, রঙে বিন্যাস অন্যরকম হলে কি প্যাটার্ন হতো ইত্যাদি অনেক কিছু কথা হলো। এই বেড থেকে ঐ বেডে যাচ্ছেন আর কথার ফাঁকে ফাঁকে হাসির ফোয়ারা। আমার মনে হচ্ছিল স্যারের মুখটাই যেন জীবন্ত ডাগর ডালিয়া-ঐ চশমা পরা ভরাট মুখটা অন্তরের উপচে পড়া আনন্দে এমনই ঝলমল করছিল। নিজের খেলনা নিয়ে যেমন শিশুর আনন্দ ও গৌরব, তাঁর বাগান সেরকমই তাঁর কাছে।’
এক কালের কম্যুনিস্ট নেতা এবং মৌলিক মানবতাবাদী মানবেন্দ্রনাথ রায়ের মতবাদে বিশ্বাসী ছিলেন জ্যোতির্ময় গুহঠাকুরতা। মানবেন্দ্রনাথ রায় প্রতিষ্ঠিত র্যাডিক্যাল ডিমোক্র্যাটিক পার্টির সঙ্গে যুক্ত ছিলেন তিনি। এ সংগঠন কোন জঙ্গী আন্দোলনের সংগঠন ছিল না। এই সংগঠনটি ছিল শ্রেণী-ঊর্ধ্ব একটি মানবতাবাদী সংগঠন। যেখানে সব শ্রেণীর মানুষকে সমানভাবে দেখা হত। সেই সময় র্যাডিক্যাল হিউম্যানিস্ট বলে যারা পরিচিত ছিলেন তাঁদের সংখ্যা হাতে গোনা কয়েকজন ছিল। এই হাতে গোনা গুটিকয় ব্যক্তির সঙ্গে বিশেষ সম্পর্ক ও বন্ধুত্ব ছিল তাঁর। র্যাডিক্যালদের নিয়মিত স্টাডিক্যাম্প বা শিক্ষা শিবির বসত। শিক্ষা শিবিরের মেয়াদ ছিল কমপক্ষে চার পাঁচ দিন, কখনো বা আট-দশ দিন। কাশ্মীর থেকে অন্ধ্র ও মাদ্রাজ, গুজরাত, মহারাষ্ট্র থেকে পশ্চিম বাংলা, পূর্ব বাংলা, বিহার, উড়িষ্যা- উপমহাদেশের দূর দূর অঞ্চল থেকে শিবিরে যাঁরা যোগ দিতে আসতেন তাঁদের মধ্যে কেউবা ট্রেড ইউনিয়নিস্ট, কেউবা অধ্যাপক, কেউবা গ্রামাঞ্চলের কর্মী, কেউবা সাংবাদিক, চিকিত্সক অথবা আইনজীবী। জ্যোতির্ময় যোগ দিতে আসতেন ঢাকা থেকে। এছাড়া জ্যোতির্ময় গুহঠাকুরতা স্কুলে অষ্টম শ্রেণীর ছাত্র থাকাকালেই নেতাজী সুভাষ বোসকে উদ্দেশ্য করে একটা কবিতা লিখেছিলেন।
মিশুকে প্রকৃতির মানুষ ছিলেন তিনি। ঠোঁটে সবসময় হাসি লেগে থাকত। জমিয়ে আড্ডা দিতেন। আড্ডায় একসঙ্গে গল্প ও গান দুই চলত। গানের গলা ছিল চমত্কার। গানের সঞ্চয়ও ছিল বিচিত্র। কিছুটা অলস স্বভাবের ছিলেন। জীবনে উন্নতি বা প্রতিষ্ঠার পিছনে ছোটেননি তিনি। বিশ্বাস করতেন মানবতাবাদের আদর্শে। তাঁর মধ্যে ছিল অটুট ও অফুরন্ত আশাবাদ। মানুষের উপর ছিল অগাধ বিশ্বাস। আর তিনি ছিলেন অসামান্য ব্যক্তিগত মানবিক গুণাবলীর অধিকারি এবং এক মহত্ আদর্শের প্রতি নিষ্ঠাবান একজন মানুষ। এই গুণাবলীর কারণে সাম্প্রদায়িক সংকীর্ণতা থেকে নিজেকে সম্পূর্ণরূপে মুক্ত রাখতে সক্ষম হয়েছিলেন তিনি। গুলির আঘাতে মারাত্মকভাবে আহত হয়ে যখন তিনি মৃত্যু পথযাত্রী, তখনও তিনি বিশ্বাস করতেন, যে উন্মত্ত হিংসা ও বিদ্বেষের তিনি শিকার হয়েছেন, সে হিংসা ও বিদ্বেষ একদিন দূর হবে; মানুষ তার সৃজনশীল প্রতিভার পূর্ণবিকাশ ঘটিয়ে এক নতুন সুন্দরতর পৃথিবী সৃষ্টি করতে সক্ষম হবে।
“আমি মানুষ, সুতরাং কোনো মানুষই আমার অনাত্মীয় নয়”, এই বিখ্যাত উক্তি তিনি পরিপূর্ণভাবে বিশ্বাস করতেন, বিচারের চাইতে বিবেচনায় তাঁর ছিল বেশি আগ্রহ। বাস্তব জীবনে বিপদের ও ভয়ঙ্করের মুখোমুখি দাঁড়াতে তিনি এক প্রকার রোমাঞ্চ অনুভব করেছেন। আর তাই পঞ্চাশের দাঙ্গায় তিনি ছিলেন নির্ভীক। একাত্তরের সঙ্কটেও ব্যক্তিগত নিরাপত্তার কোন ব্যবস্থাই তিনি গ্রহণ করেননি।
এই নির্ভীক, কর্তব্যপরায়ণ ও কষ্টসহিষ্ণু মানুষটির জীবনের সঙ্গে জড়িয়ে অনেক কষ্ট করতে হয়েছে স্ত্রী বাসন্তী গুহঠাকুরতাকে। বাসন্তী ছিলেন জ্যোতির্ময়ের যোগ্য সহধর্মিনী ও জীবন-সাথী। বাসন্তী গুহঠাকুরতা নিজেও একজন ব্যক্তিত্বময়ী শিক্ষাবিদ। ঢাকার গেণ্ডারিয়া মনিজা রহমান বালিকা হাইস্কুলের তিনি অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা এবং সেখানকার প্রধান শিক্ষয়িত্রী ছিলেন। তাঁরা দুজনে ছিলেন একটি আদর্শ জুড়ি। বাসন্তী গুহঠাকুরতা ১৯৯৩ সালের ৯ সেপ্টেম্বর কলকাতার এক ক্লিনিকে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন। তাঁদের একমাত্র কন্যা মেঘনা গুহঠাকুরতা (দোলা)।
জ্যোতির্ময়ের মৃত্যুর পর যুদ্ধের ভয়াবহ ৯ মাস মেয়েকে নিয়ে ঢাকা শহরের বিভিন্ন জায়গায় ছদ্ম পরিচয়ে লুকিয়ে বেড়িয়েছেন বাসন্তী গুহঠাকুরতা। মুসলমান বন্ধুর বাড়ি, ইউরোপীয় বন্ধুর বাড়ি, অনাথ আশ্রম, ক্রীশ্চান মিশনারী হাসপাতালসহ বিভিন্ন জায়গায় পালিয়ে বেরিয়েছেন তিনি। আর সঙ্গে আগলে রেখেছেন তাঁদের ফটোর অ্যালবামটি এবং জ্যোতির্ময় বাবুর ডক্টরাল থিসিস ও অন্যান্য কিছু কিছু লেখা। জ্যোতির্ময়ের নাম থাকলে বিপদ হতে পারে ভেবে তিনি সবকিছু থেকে তাঁর নাম কেটে বাদ দিয়েছিলেন।
সংক্ষিপ্ত জীবনী:
পূর্ণ নাম : জ্যোতির্ময় গুহঠাকুরতা।
জন্মের তারিখ : ১০ই জুলাই ১৯২০।
জন্মস্থান : ময়মনসিংহ শহর।
পৈতৃক নিবাস : বানারী পাড়া, বরিশাল।
পিতার নাম : কুমুদচন্দ্র গুহঠাকুরতা (১৮৯০-১৯৩৫)।
মাতার নাম : সুমতি গুহঠাকুরতা (১৮৯৯-১৯৮৫)।
পরিবারের সদস্য : স্ত্রী- বাসন্তী গুহঠাকুরতা; কন্যা- মেঘনা গুহঠাকুরতা।
শিক্ষাগত যোগ্যতা :
এস.এস.সি. : ময়মনসিংহ জেলা স্কুল। সাল ১৯৩৬।
এইচ.এস.সি. : ময়মনসিংহ আনন্দ মোহন কলেজ। সাল ১৯৩৯।
বি.এ. অনার্স ( ইংরেজী বিভাগ) : ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের। সাল ১৯৪২।
এম.এ. (ইংরেজী বিভাগ) : সাল ১৯৪৩।
পিএইচডি : ১৯৬৭ সনের ৬ই জানুয়ারী লণ্ডন বিশ্ববিদ্যালয়ের অন্তর্গত কিংস কলেজ থেকে ইংরেজী সাহিত্যে কৃতিত্বের সাথে পিএইচডি ডিগ্রী অর্জন করেন। ১৯৬৩-৬৪ শিক্ষাবর্ষে উচ্চ শিক্ষার্থে বিলেত যান।
কর্মজীবন :
তাঁর কর্মজীবন শুরু হয় ১৯৪৪ সালে কিশোরগঞ্জের নবপ্রতিষ্ঠিত গুরুদয়াল কলেজে। সেখানে দুই বছর দায়িত্ব পালনের পর তিনি ময়মনসিংহ আনন্দমোহন কলেজে ইংরেজি বিভাগে প্রভাষক হিসেবে যোগ দেন। সেখানে ছয় মাস শিক্ষকতার পর ১৯৪৬ সালে তিনি চলে আসেন ঢাকায়, যোগ দেন ঢাকার জগন্নাথ কলেজে। সেখানে তিন বছর শিক্ষকতার পর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজী বিভাগে অস্থায়ী প্রভাষক নিযুক্ত হন ১৯৪৯ সালের ১২ই নভেম্বর। তাঁকে প্রভাষক পদে স্থায়ী করা হয় ১৯৫০ সালের ১৬ই সেপ্টেম্বর। দীর্ঘ ১৮ বছর তিনি ঐ পদেই ছিলেন। এরপর লণ্ডন থেকে পিএইচডি ডিগ্রি নিয়ে দেশে ফিরেন। তিনি ১৯৬৭ সালের ডিসেম্বর মাসে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজী বিভাগে রীডার নিযুক্ত হন। তিনি আমৃত্যু ঐ পদেই ছিলেন। এছাড়া তিনি ফ্রেণ্ডস্ সেন্টার, ঢাকা (ইন্টারন্যাশন্যাল কোয়েকার সার্ভিসের কেন্দ্র), বুলবুল ললিত কলা একাডেমী, ঢাকা এবং আন্তর্জাতিক র্যাডিক্যাল হিউম্যানিস্ট এসোসিয়েশনের সদস্য ছিলেন।
১৯৫৮ সালের অক্টোবর মাসে তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের জগন্নাথ হলের আবাসিক শিক্ষক নিযুক্ত হন। ১৯৬৩ সালের সেপ্টেম্বর পর্যন্ত তিনি ঐ পদেই ছিলেন। এরপর ১৯৭০ সালের ২০শে এপ্রিল জগন্নাথ হলের প্রাধ্যক্ষের দায়িত্ব গ্রহণ করেন। ঐ পদে দায়িত্বরত অবস্থায় তিনি শহীদ হন।
আন্তর্জাতিক সভা-সমিতিতে অংশগ্রহণ :
তিনি ১৯৫১ সনে দেরাদুনে অনুষ্ঠিত সর্বভারতীয় হিউম্যানিস্ট এসোসিয়েশনের বার্ষিক সভায় যোগদান করেন।
উচ্চ শিক্ষার্থে বিলাতে অবস্থানকালে তিনি ১৯৬৪ সনের ১০ই জুলাই তারিখে নেদারল্যান্ডের হেগে অনুষ্ঠিত ইন্টারন্যাশনাল হিউম্যানিস্ট এন্ড এথিক্যাল ইউনিয়নের সম্মেলনে পাকিস্তান ও ভারতের প্রতিনিধিত্ব করেন।
পুরস্কার :
অনার্স পরীক্ষায় ইংরেজীতে খুব ভাল ফলাফল করায় এবং সাবসিডিয়ারী বিষয় দর্শনে রেকর্ড নম্বর পাওয়ায় তিনি পোপ মেমোরিয়েল স্বর্ণপদক লাভ করেন।
প্রবন্ধ : ‘রবীন্দ্রসাহিত্য মূল্যায়নের সমস্যা,’ আনিসুজ্জামান সম্পাদিত ‘রবীন্দ্রনাথ-সংকলন’, স্টুডেন্ট ওয়েজ, বাংলাবাজার, ঢাকা।
‘প্রগতি’, ‘প্রাদেশিকতা’ এবং ‘আমাদের শিক্ষা ব্যবস্থার ত্রুটি’ শীর্ষক এই তিনটি প্রবন্ধ পঞ্চাশের দশকের গোড়ার দিকে ঢাকার ‘দৈনিক সংবাদ’ পত্রিকার বিশেষ সংখ্যায় প্রকাশিত হয়।
‘অতি আধুনিক বিশ্বপ্রেস’, শতদল, ঢাকা হল বার্ষিকী, ১৯৫৪।
‘Literature and National Consciousness’, Matters of Moment, Dhaka, 1962. ‘The Writer’s Role in a Technological Society’ The writer and his social Responsibility: A Seminar, Dhaka, 1962.<
বই: Classical Myths in the plays of Swinburne. Bridges, Sturge Moore and Eliot, Posthumous Publication, Dhaka University
তথ্যসূত্র: শহীদ জ্যোতির্ময় গুহঠাকুরতা স্মারকগ্রন্থ; সম্পাদনা: সরদার ফজলুল করিম ও রংগলাল সেন।
লেখক : মৌরী তানিয়া