‘তোমার চিঠি পেয়েছি অনেকদিন হয়েছে। foreign exchange -এর অনুমতি অবশেষে পাইনি। …ভাইসাব তোমার ২৬ তারিখের চিঠি পেয়েছেন। আমাকে বলেছেন তোমার কয়েকদিনের জন্য বাড়ি আসা খুবই প্রয়োজন। চিঠি পেয়েই লুটুকে নিয়ে কয়েকদিনের জন্য বাড়ি এসো’ – ১৯৭১ সালের ২রা মার্চ ঢাকায় বসে করাচি প্রবাসী মামাতো ভাই ড. আব্দুল মতিনকে চিঠিতে এই কথাগুলো লিখেছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মৃত্তিকাবিজ্ঞান বিভাগের (বর্তমান মৃত্তিকা, পানি ও পরিবেশ বিভাগ) সিনিয়র লেকচারার ড. ফজলুর রহমান খান। ইচ্ছে ছিল ডক্টরেট-পরবর্তী পড়াশুনার অনুমতি পেলে, উচ্চশিক্ষার্থে লন্ডনে অবস্থানরত স্ত্রীর কাছে গিয়ে একসঙ্গে থাকবেন তিনি। কিন্তু উচ্চতর শিক্ষার জন্য ঢাকা শহর ছেড়ে যাওয়ার কিংবা সস্ত্রীক ঢাকায় আসতে বলেছিলেন যে ভাইকে তাঁর সঙ্গে দেখা হওয়ার সুযোগ হয়নি ফজলুর রহমান খানের। ২৬ মার্চের ভোর রাতের প্রথম প্রহরে পাক সেনাদের গুলিতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আবাসিক শিক্ষক ভবনে শাহাদাত বরণ করেন অত্যন্ত সরল মনের, অমায়িক ও বিনয়ী এই শিক্ষক। প্রবাসের মাটিতে স্বামীর মৃত্যু সংবাদ পেয়ে উদ্ভ্রান্ত স্ত্রী ফরিদা রউফ খান উচ্চশিক্ষার স্বপ্ন ছেড়ে দিয়েছিলেন তখনই। আর ‘ছোট ভাই’-এর লেখা ২রা মার্চের সেই চিঠিটি ড. মতিন পেয়েছিলেন এপ্রিল মাসে তাঁর মৃত্যু সংবাদ পাওয়ার কয়েকদিন পরে।
১৯৭০-এর জানুয়ারীতে স্ত্রী ফরিদা রউফ খান (ডাক নাম শিরীণ) পিএইচডি করতে যখন লন্ডনে গেলেন, ড. ফজলুর রহমান খান তখন থাকতেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের তত্কালীন ইকবাল হলের (বর্তমান জহুরুল হক হল) পাশের আবাসিক শিক্ষক ভবনের তিন তলায়, পূর্বদিকের ২৩/এফ ফ্ল্যাটটিতে। কলেজ পড়ুয়া ভাগ্নে কাঞ্চন এবং ঘরের কাজের সহযোগী ১০/১২ বছরের একটি ছেলেও থাকত তাঁর সঙ্গে। প্রায় প্রতিদিন সন্ধ্যায় ফজলুর রহমান খান যেতেন এলিফ্যান্ট রোডে ছোট ভায়রা ড. শামিমুজ্জামান বসুনিয়ার ৩০৮ নম্বর বাড়িটিতে। ড. শামিমুজ্জামান বসুনিয়ার এক চাচাতো ভাই এবং আওয়ামী লীগের প্ল্যানিং কমিশনের উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা মোহাম্মদ হোসেন বসুনিয়াও তখন নিজের বাসা ছেড়ে এসে থাকতেন এই বাড়িতে। একই রাস্তার ৩০৯ নম্বর বাড়িতে থাকতেন ড. বসুনিয়ার চাচা শ্বশুর খন্দকার রফিকুল হক। আওয়ামী লীগের উপদেষ্টা পরিষদের অন্যতম ঘনিষ্ঠ ব্যক্তি এবং ভয়েস অব আমেরিকার তত্কালীন প্রধান এই চাচার কাছে প্রতি রাতে জানা যেত ঢাকা শহর তথা তত্কালীন পূর্ব পাকিস্তানের চলমান সামগ্রিক অবস্থা সম্পর্কে। পড়াশুনা, রাজনীতি ইত্যাদি বিষয়ে আলোচনা আর বিভিন্ন গল্পে সময় পার করে তাঁরা তিনজন রাত আটটা-নয়টা পর্যন্ত অপেক্ষা করতেন এই চাচার জন্য।
এভাবে চলতে চলতেই এক সময় ১৯৭১-এর ফেব্রুয়ারি মাস এলো, তারপর এল মার্চ। ৭ মার্চ রেসকোর্সে বঙ্গবন্ধুর ঐতিহাসিক ভাষণ শুনতে গেলেন সবাই একসঙ্গে। এর কিছুদিন পরে ড. ফজলুর রহমান খানের পক্স হলে তাঁকে দেখাশুনার জন্য শ্বশুর বাড়ির বিশ্বস্ত ব্যক্তি, প্রায় ষাট বছর বয়সী জবান আলী এলেন তাঁর বাসায়। মার্চের ২০ থেকে ২৪ তারিখ পর্যন্ত প্রতিদিনই জবান আলীকে নিয়ে ৮/১০ মিনিট পায়ে হেঁটে এলিফ্যান্ট রোডের ৩০৮ নম্বর বাড়িতে গিয়েছেন ফজলুর রহমান খান। সেই বাসায় গল্প করে, চাচার কাছে সর্বশেষ খবর শুনে এবং কোনো কোনো রাতে খাবার খেয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ২৩/এফ নম্বর ফ্ল্যাটটিতে ফিরে আসতেন তিনি।
‘৭১-এর ২৫ মার্চ সন্ধ্যায় অন্য দিনগুলোর মতোই ড. ফজলুর রহমান খান এবং জবান আলী যান ড. বসুনিয়ার বাসায়। সেদিন রাত ন’টার পর বাসায় ফিরে চাচা জানালেন, ‘অবস্থা খুব একটা ভালো নয়, ঝামেলা আসতে পারে’- বলেই আবার বেরিয়ে পড়লেন তিনি। ফজলুর রহমান ও জবান আলীকে রাতটা তাঁর বাসায় থেকে যেতে বলেন ড. বসুনিয়া। কিন্তু ভাগ্নে কাঞ্চন বাসায় একা থাকবে ভেবে সেদিন ভাত না খেয়েই জবান আলীকে নিয়ে নিজের বাসায় চলে আসেন ফজলুর রহমান। কাঞ্চন সেদিন সন্ধ্যায় গিয়েছিলেন আজিমপুরে তাঁর বাবার বাসায়। তাকেও রাতটা সেখানেই থাকতে বলা হয়। কিন্তু মামা একা থাকবে ভেবে কাঞ্চনও চলে আসেন মামার ইকবাল হলের ২৩/এফ নম্বর ফ্ল্যাটটিতে।
সেদিন রাত বারোটার দিকে পুরো ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায় শুরু হয় পাক-বর্বর পশুদের তাণ্ডব। জগন্নাথ হল ও ইকবাল হল থেকে শুরু হয় তাদের নির্মম-নিষ্ঠুর ও পাশবিক হত্যাযজ্ঞ। এরপর তাদের নজর পড়ে ইকবাল হলের পাশে শিক্ষকদের ভবনের দিকে। দরজা দিয়ে ঢুকে লম্বা বারান্দা পার হয়ে যে শোবার ঘর, দরজা বন্ধ করে সেই ঘরেই ছিলেন কাজের ছেলে, কাঞ্চন, জবান আলী এবং ড. ফজলুর রহমান খান। রাত শেষ হয়ে যখন ফজর নামাজের সময় হয়ে আসছে, এমন সময় ধাক্কা শুরু হলো বাসায় প্রবেশের প্রধান দরজায়। বুটের লাথিতে প্রধান দরজা ভেঙে ভেতরে প্রবেশ করে সশস্ত্র বর্বর পাক-সেনা, চিত্কার ও গালিগালাজ করে তারা বের হয়ে আসতে বলে বাসার ভেতরের সবাইকে। চিরকালের সরল মনের ফজলুর রহমান ভেবেছিলেন হাত তুলে বেরিয়ে এলে কিছু হবে না। ভয় আর আতঙ্ক নিয়ে তিনজন দরজা খুলে হাত তুলে বেরিয়ে আসেন শোবার ঘরের সামনে। মুহূর্তের একঝাঁক গুলিতে মেঝেতে লুটিয়ে পড়ে তিনটি নিরপরাধ প্রাণ। ভীত কাজের ছেলেটা বাথরুমের মধ্যে লুকিয়ে বেঁচে গিয়েছিল। গুলিবিদ্ধ কাঞ্চন একটিও কথা বলতে পারেনি।
চারটা গুলিতে বিদ্ধ হয়েও অনেক বছর বেঁচে ছিলেন যে জবান আলী, তাঁর কাছে ড. ফজলুর রহমান খান একটি কথাই শুধু বলেছিলেন, ‘জবান, শিরীণের সঙ্গে আর জীবনে দেখা হলো না’। ২৬ মার্চের ভোর রাতের প্রথম প্রহরে শহীদ হলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন দায়িত্বশীল শিক্ষক এবং সহৃদয় ও কোমল ব্যক্তিত্ব ড. ফজলুর রহমান খান। নিথর শরীরে শোবার ঘরের মেঝেতে দেড় দিন পড়ে থাকার পর ২৭ তারিখ সকাল ৮টার দিকে কারফিউ শিথিল হলে আত্মীয়-পরিজনেরা শহীদ ড. ফজলুর রহমান খান এবং কাঞ্চনের মরদেহ সমাধিস্থ করেন আজিমপুর কবরস্থানে।
শহীদ ড. ফজলুর রহমান খানের পিতা প্রয়াত আব্দুল হাকিম খানের প্রকৃত নিবাস ছিল নেত্রকোনা জেলার আটপাড়া উপজেলার বানিয়াজান গ্রামে। আব্দুল হাকিম সাহেবের মামাতো বোন প্রয়াত শামসুন্নেসা আহমেদ-এর স্বামী প্রয়াত খান সাহেব আব্দুল আজিজ আহমেদ নেত্রকোনা জেলার মোহনগঞ্জ উপজেলার একজন বিশিষ্ট ব্যক্তি ছিলেন। ব্রিটিশ সরকারের সময়ে প্রথমে ইউনিয়ন বোর্ডের প্রেসিডেন্ট এবং পরে নেত্রকোনা জেলার অনারারি ম্যাজিস্ট্রেট নিযুক্ত হয়ে ব্রিটিশ ও পাকিস্তান উভয় শাসনামলের অনেকটা সময় ধরে উক্ত দুই পদে নিয়োজিত ছিলেন তিনি। নামের সঙ্গে ‘খান সাহেব’ খেতাবটি ছিল ব্রিটিশদের দেয়া।
মোহনগঞ্জ উপজেলার টেংগাপাড়া গ্রামে তাঁর মূল বাড়ির পাশ দিয়ে রেলওয়ে স্টেশন তৈরির সময় বাড়িটির বেশ খানিকটা জমি অধিগ্রহণ করা হলে খান সাহেব সপরিবারে চলে আসেন একই উপজেলার কাজিয়াটি গ্রামে তাঁর নতুন বাড়িতে। এ নতুন বাড়িতেই থাকতেন শহীদ ড. ফজলুর রহমান খানের পিতা আব্দুল হাকিম খান। শিক্ষার প্রতি অত্যন্ত অনুরাগী খান সাহেব পুরনো বাড়ির অনেকটা জায়গা জুড়ে ১৯৩১ সালে প্রতিষ্ঠা করেন মোহনগঞ্জ পাইলট হাই স্কুল (বর্তমান মোহনগঞ্জ গভর্নমেন্ট পাইলট হাই স্কুল) এবং পরবর্তীতে ১৯৬৯ সালে কাজিয়াটি গ্রামে প্রতিষ্ঠা করেন মোহনগঞ্জ কলেজ। এই হাই স্কুলের প্রাথমিক বিদ্যালয় শাখার প্রধান শিক্ষক হিসেবে যোগদান করেন জনাব আব্দুল হাকিম খান।
এলাকায় তিনি পরিচিত ছিলেন একজন পণ্ডিত ব্যক্তি হিসেবে। প্রাইমারি স্কুলের লম্বা গড়নের এই প্রধান শিক্ষক কিছুটা রাগী প্রকৃতির ও মেজাজি ছিলেন, তবে অত্যন্ত কঠোর, নীতিবান এবং একজন উচিত্ বক্তা ছিলেন তিনি। মোহনগঞ্জ পাইলট হাই স্কুলের পুরনো ছাত্রছাত্রীরা এবং এলাকার সব মানুষ তাঁকে অত্যন্ত শ্রদ্ধা করত, আবার ভয়ও পেত। খান সাহেবের চাচাতো বোন ফিরোজা খাতুন-এর সঙ্গে বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হয়ে আব্দুল হাকিম সে বাড়িতেই সংসার জীবন শুরু করেন। তাঁদের ঘরে প্রথম জন্মগ্রহণ করেন মেয়ে জোহরা বেগম, এরপর ছেলে বজলুর রহমান খান এবং ১৯৩৯ সালের ২ মার্চ তৃতীয় সন্তান ফজলুর রহমান খান। মাতা ফিরোজা খাতুন যখন আকস্মিকভাবে পরলোকগমন করেন, ফজলুর রহমান খান তখন এক-দেড় বছরের কোলের শিশু। খান সাহেব আব্দুল আজিজ আহমেদ-শামসুন্নেসা আহমেদ দম্পতির ঘরে ছিল দুই ছেলে এবং তিন মেয়ে। নিজের সন্তানদের সঙ্গে ফুপাতো ভাই আব্দুল হাকিমের মা-হারা তিন সন্তানকে মাতৃস্নেহে বড় করেন তাদের এই মামি। ফজলুর রহমান খান এবং তাঁর দুই ভাইবোনের কাছে তাঁদের মামি ছিলেন মায়েরই মতো এবং মামি শামসুন্নেসা আহমেদকে ‘আম্মা’ বলেই সম্বোধন করতেন তাঁরা।
গাছপালা শোভিত, ছায়াঘেরা প্রকাণ্ড দুইটি উঠোন – ভিতরের দিকের উঠোনের পশ্চিমে দুইতলা কাঠের ঘর, সামনের দিকের উঠোনের এক পাশে একতলা বড় বড় অনেকগুলো ঘর, আর পূর্বদিকে বিরাট পুকুরসমেত একটি বাড়ি। ১৯৭১ সালে পাকিস্তানী সেনা-সদস্যরা বাড়ির অর্ধেকটা পুড়িয়ে ফেলার পূর্ব পর্যন্ত খান সাহেব আব্দুল আজিজের নতুন বাড়ির ছবি ছিল এরকমই। কাজিয়াটি গ্রামের এই মস্ত বাড়িতেই পিঠাপিঠি বেড়ে উঠতে থাকে দুই পরিবারের আট সন্তান। খান সাহেবের অনুপ্রেরণাতেই পরবর্তীতে পিএইচডি ডিগ্রি অর্জন করেছিলেন একই বাড়ীর তিন সন্তান। বড় ভাই বজলুর রহমান খান, ছোট ভাই ফজলুর রহমান খান এবং তাঁর এক বছরের ছোট আব্দুল মতিন – তিনজন একসঙ্গে স্কুলে যেতেন, একসঙ্গেই খাওয়া-দাওয়া করতেন। ফুটবল, ভলিবল, ব্যাডমিন্টন ইত্যাদি খেলাধুলায়ও তিনজন থাকতেন একসঙ্গে। বাড়ির পুকুরটাতে তাঁরা একসঙ্গে গোসল করতেন, সাঁতার প্রতিযোগিতা করতেন নিজেদের মধ্যেই।
সন্তানেরা একটু বড় হলে আব্দুল হাকিম খান টেংগাপাড়া গ্রামে হাই স্কুলের পাশে প্রাপ্ত সম্পত্তির আলাদা বাড়িতে বসবাস করা শুরু করেন। সন্তানদের কথা ভেবে। দ্বিতীয় স্ত্রী গ্রহণ করেন তিনি এক কন্যাসন্তানের জন্ম দিয়ে কিছুদিন পরে তাঁর দ্বিতীয় স্ত্রীও মৃত্যুবরণ করেন। এরপর আব্দুল হাকিম সাহেবের তৃতীয় স্ত্রীর ঘরে আসে আট সন্তান। স্কুলের শিক্ষকতা থেকে অবসর নেয়ার পর ছোটখাটো ব্যবসা করতেন তিনি। নিজের আর্থিক অবস্থা ততোটা ভালো না থাকলেও তাঁর সন্তানেরা নিজেদের চেষ্টায় এবং আত্মীয়-পরিজনদের সহযোগিতায় উচ্চশিক্ষায় শিক্ষিত হয়েছিলেন।
সব ভাইবোনের মধ্যে ফজলুর রহমান খান শৈশবকালে ছিলেন অত্যন্ত চঞ্চল ও দুরন্ত প্রকৃতির। বাবার একমাত্র সাইকেলটাতে অন্য কারো চড়ার এমনকি ধরারও অনুমতি ছিল না, একাই চড়তেন ফজলুর রহমান। তবে লেখাপড়ায় তিনি ছিলেন অত্যন্ত মনযোগী ও মেধাবী। মোহনগঞ্জ পাইলট হাই স্কুলের প্রাথমিক বিদ্যালয় শাখায় যখন তিনি শিক্ষাজীবন শুরু করেন, তাঁর মেধার পরিচয় পাওয়া যায় তখন থেকেই। ক্লাশের পরীক্ষাগুলোতে সবসময় প্রথম হতেন তিনি। পড়াশুনার পাশাপাশি স্কুলের বিভিন্ন বিচিত্রানুষ্ঠান যেমন নাটক, কবিতা আবৃত্তি, বক্তৃতা ইত্যাদিতে সক্রিয় অংশগ্রহণ ছিল ফজলুর রহমান এবং তাঁর অন্য দুই ভাইয়ের।
স্কুলে পড়ার সময়ই তিনি চেষ্টা করতেন কিছু উপার্জন করতে। প্রতি বছর পরীক্ষা শেষ হওয়ার পর নতুন বই কেনার সময় হলে স্কুলের মাঠের এক কোনায় বই সাজিয়ে পুরাতন বইয়ের দোকান দিতেন তিনি। মূল দামের তিন ভাগের এক ভাগ দামে তিনি পুরাতন বই কিনতেন আর বিক্রি করতেন অর্ধেক দামে। গ্রামের অন্য কেউ এই ব্যবসা করত না বলে এই ব্যবস্থাটা তার প্রতি বছরের একটা নিয়মিত উপার্জনের মতো দাঁড়িয়ে গিয়েছিল। পুরাতন বইয়ের বিক্রেতারা ফজলুর রহমানের একমাত্র দোকানটিতে বই বিক্রি করতে আসতেন আর সব বই একসঙ্গে পাওয়া যেত বলে ক্রেতার সংখ্যাও ছিল ভালো। পরবর্তীতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে শেষবর্ষে পড়ার সময় তিনি আর্থিক সাহায্য পেয়েছেন বড় ভাই কলেজ শিক্ষক বজলুর রহমান খানের কাছ থেকে। বজলুর রহমান পরে পিএইচডি সম্পন্ন করে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাস বিভাগ থেকে অবসর গ্রহণ করেন।
স্কুলজীবন থেকেই ফজলুর রহমান ছিলেন রাজনীতি সচেতন ব্যক্তিত্ব। ১৯৫২ সালে রাষ্ট্রভাষা বাংলার দাবিতে ছাত্র-আন্দোলন শুরু হলে অনেক ছাত্রকে হত্যা করা হয়। সর্বত্র ছড়িয়ে পড়ে এ খবর, হরতালে স্কুলের পড়াশুনা তখন বন্ধ। স্কুলের সব ছাত্রের সঙ্গে বজলুর রহমান খান, ফজলুর রহমান খান ও আব্দুল মতিন – তিন ভাইয়ের সক্রিয় অংশগ্রহণ ছিল নুরুল আমিনের বিরুদ্ধে স্লোগান-সম্বলিত মিছিলে। একই বছরের ডিসেম্বরে পাকিস্তান ন্যাশনাল স্কাউট জাম্বুরি হয় করাচিতে। ফজলুর রহমান খান, আব্দুল মতিন এবং স্কুলের অপর মেধাবী ছাত্র সৈয়দ আহমেদসহ (যিনি পরবর্তীতে কেবিনেট সেক্রেটারি হয়েছিলেন) মোট ৭ জন করাচি যান সেই জাম্বুরিতে অংশগ্রহণের জন্য। জাম্বুরির পরে সবাই একসঙ্গে পশ্চিম পাকিস্তানের লাহোর, রাওয়ালপিন্ডি, পেশোয়ার, কোয়েটা ভ্রমণ করেন। একসঙ্গেই তাঁরা ফিরে আসেন দিল্লি ও আগ্রা হয়ে তত্কালীন পূর্ব পাকিস্তানে।
পূর্ব পাকিস্তানে ফিরে এসে ১৯৫৩ সালে আব্দুল মতিন ভর্তি হন আরমানিটোলা গভর্নমেন্ট হাইস্কুলে আর বজলুর রহমান খান এবং ফজলুর রহমান খান থেকে যান মোহনগঞ্জ পাইলট হাই স্কুলেই। ১৯৫৪ সালে এই স্কুল থেকে ফজলুর রহমান প্রথম বিভাগে ম্যাট্রিক পাস করেন এবং ঐ বছরই ভর্তি হন ময়মনসিংহ আনন্দমোহন কলেজে। অসুস্থতার কারণে ১৯৫৬ সালে এই কলেজ থেকে তিনি আই.এস.সি. পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করতে পারেননি। পরের বছর পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করে দুর্ঘটনাজনিত কারণে একটি ব্যবহারিক পরীক্ষায় অকৃতকার্য হয়েছিলেন তিনি, কিন্তু তারপরও প্রথম বিভাগ সমমানের নম্বর ছিল তাঁর। অবশেষে ১৯৫৮ সালে একই কলেজ থেকে তিনি প্রথম বিভাগে আই.এস.সি. পাস করেন।
এরপর কিছুটা গণিত ভীতির কারণে এবং ড. আব্দুল মতিনের পরামর্শে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের তত্কালীন মৃত্তিকাবিজ্ঞান বিভাগে ভর্তি হন ফজলুর রহমান খান। এই বিভাগ থেকেই তিনি ১৯৬০ সালে প্রথম শ্রেণীতে বি.এস.সি. (পাস) ডিগ্রি লাভ করেন। সে বছরই তিনি এম.এস.সি. শ্রেণীতে ভর্তি হন এবং মৃত্তিকার লবণাক্ততা (Soil Salinity) বিষয়ে এম.এস.সি. থিসিস সম্পন্ন করে ১৯৬২ সালে দ্বিতীয় শ্রেণীতে এম.এস.সি. ডিগ্রি লাভ করেন। ১৯৬৩ সালের ১ আগস্ট তিনি মৃত্তিকাবিজ্ঞান বিভাগের লেকচারার নিযুক্ত হন। ১৯৬৪ সালে তিনি উচ্চশিক্ষার জন্য লন্ডনে গমন করেন এবং ভর্তি হন যুক্তরাষ্ট্রের ওয়েলস প্রদেশের অ্যাবারিস্টওয়িথ বিশ্ববিদ্যালয়ে। সেখান থেকে পরে চলে যান লন্ডন বিশ্ববিদ্যালয়ের ইম্পেরিয়াল কলেজে। লিলিয়ান পেনসন হল-এ থেকে তিনি গবেষণাকর্ম শুরু করেন প্রফেসর ড. এ. এইচ. কর্নফিল্ড -এর তত্ত্বাবধানে। চার বছরের গবেষণা শেষে ‘ A Study on the Nutrient Metabolism in Soil at High Moisture Levels‘ বিষয়ে গবেষণা-অভিসন্দর্ভ রচনা করে ১৯৬৮ সালের ২৫ জুলাই তিনি পিএইচডি ডিগ্রি লাভ করেন। লন্ডনের ইম্পেরিয়াল কলেজে পিএইচডি সম্পন্ন করে তিনি ওমরাহ্ পালন করতে যান। দেশে ফিরে ১৯৬৮ সালের ১ আগস্ট তিনি পুনরায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মৃত্তিকাবিজ্ঞান বিভাগের প্রভাষকের পূর্ব পদে যোগদান করেন। একই বছরের ১৫ আগস্ট তিনি উক্ত বিভাগের সিনিয়র লেকচারার পদে উন্নীত হন।
তত্কালীন ঢাকা হোটেল ইন্টারকন্টিনেন্টাল-এ (বর্তমান রূপসী বাংলা হোটেল) ১৯৬৯- এর ৯ জানুয়ারি মিঞা মোহাম্মদ আব্দুর রউফ এবং শাহানী বেগমের কন্যা ফরিদা রউফ খান-এর সঙ্গে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হন ড. ফজলুর রহমান খান। ফরিদা রউফ খান ছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পদার্থবিজ্ঞান বিভাগের অত্যন্ত মেধাবী ছাত্রী। এই বিভাগ থেকে ১৯৬৭ সালে তিনি প্রথম শ্রেণীতে দ্বিতীয় স্থান অধিকার করে এম.এস.সি. ডিগ্রি লাভ করেন। অত্যন্ত ধার্মিক ও পর্দানশিন কিন্তু উদারমনা ব্যক্তিত্ব ছিলেন তিনি। ‘৬৯-এর শেষের দিকে ফজলুর রহমান খান ও ফরিদা রউফ খান দম্পতির ঘরে একটি অপূর্ণকালিক (প্রিম্যাচিউর) কন্যাসন্তানের জন্ম হয়। কিন্তু জন্মের মাত্র ১৪ দিনের মাথায় শিশুটি মারা যায়। প্রথম সন্তানের মৃত্যু ভীষণভাবে বিষাদগ্রস্ত করে বাবা-মাকে। উচ্চশিক্ষার জন্য ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বৃত্তি পেয়েও স্বামীকে ছেড়ে প্রবাসে যেতে মন টানছিল না ফরিদা খানের। কিন্তু স্বামীর উত্সাহ ও অনুপ্রেরণাতেই বিবাহিত জীবনের এক বছর পূর্ণ হওয়ার পরের দিন ‘৭০-এর ১০ জানুয়ারি উচ্চশিক্ষার্থে বিলেতে গমন করেন তিনি। লন্ডনে অবস্থানরত ড. বজলুর রহমান খানের কাছে স্বামীর মৃত্যুসংবাদ পেয়ে পড়াশুনা তিনি ছেড়ে দেন। একটা স্কুলে চাকরি গ্রহণ করে সেখানেই কয়েক বছর ছিলেন ফরিদা খান। ১৯৭৪-এ বাবা মারা গেলে তিনি বাংলাদেশে আসেন, পরে আবার গমন করেন লন্ডনে। প্রায় ৩৭ বছর সেখানে থাকার পর বাকি জীবন জন্মস্থান বরিশালে কাটানোর জন্য তিনি ফিরে আসেন নিজ দেশে।
শিক্ষক ফজলুর রহমান খান ছিলেন অত্যন্ত নম্র ও সৌহার্দ্যপূর্ণ, ভদ্রচিত্তের একজন মানুষ। সব সহকর্মীর সঙ্গে বিনয়ীভাবে কথা বলতেন তিনি, ছাত্রছাত্রীদের সঙ্গেও তাঁর ব্যবহার ছিল অত্যন্ত অমায়িক। তিনি নিজে একজন অত্যন্ত বিদ্বান ব্যক্তি ছিলেন এবং ক্লাশকক্ষেও পড়াতেন অত্যন্ত নিষ্ঠার সঙ্গে। বিষয়বস্তুকে ছাত্রছাত্রীদের সামনে উপস্থাপন করতেন অত্যন্ত সরল ও আকর্ষণীয়ভাবে। যে কোনো সমস্যা-সমাধানে ছাত্রছাত্রীদের জ্বালাতনেও তিনি কখনো বিরক্তি প্রকাশ করতেন না। মৃত্তিকাবিজ্ঞানের গবেষণায় পর্যাপ্ত সময় পাননি তিনি, কিন্তু তাঁর আদর্শ, সততা ও আন্তরিকতা প্রভাবিত করেছে তাঁর অনেক ছাত্রছাত্রীকে।
অত্যন্ত ধর্মভীরু ব্যক্তিত্ব ছিলেন শহীদ ড. ফজলুর রহমান। তবে ধর্মীয় গোঁড়ামি ছিল না তাঁর মধ্যে। কখনও ধর্ম নিয়ে বাড়াবাড়ি করতেন না তিনি। নিজ দেশে এবং লন্ডনেও তিনি নিভৃতে কিন্তু নিয়মিত রোজা-নামাজ করতেন। মানুষের সমস্যা সমাধানের কথা তিনি বিবেচনা করতেন সবার আগে। হিন্দু-মুসলিম অধ্যুষিত যে গ্রামটিতে ফজলুর রহমান বড় হয়েছেন, সেখানে অনেক গুণী হিন্দু ও মুসলমান শিক্ষকের সান্নিধ্য পেয়েছিলেন তিনি। এ সবকিছু থেকেই তিনি নিজেকে গঠন করেছিলেন একজন অসাম্প্রদায়িক চিন্তার অধিকারী ব্যক্তিত্ব হিসেবে।
ড. ফজলুর রহমান খান স্বপ্ন দেখতেন রাজনৈতিক বিভাজনহীন শিক্ষায়তনের। কোনো রাজনৈতিক কর্মকান্ডে সংশ্লিষ্টতা না থাকা সত্ত্বেও ২৫ মার্চের সেই নির্মম হত্যাযজ্ঞের শিকার হতে হয়েছিল তাঁকেও। তাঁর শাহাদাত বরণে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মৃত্তিকাবিজ্ঞান বিভাগ সেদিন হারিয়েছিল একজন রাজনৈতিক পক্ষপাতহীন, আন্তরিক হৃদয়ের শিক্ষককে, যাঁর শূন্যতা আজ অনুভূত হয় অনেক শিক্ষক-ছাত্রের মনে। আর ‘৭১-এর ২৬ মার্চের পর থেকে দীর্ঘ পথ একলা পাড়ি দিয়ে স্ত্রী ফরিদা রউফ খান তাঁর নিঃসঙ্গ জীবনকে বয়ে চলেছেন একজন শহীদ স্বামীর স্মৃতিকে বুকে ধারণ করে।
সংক্ষিপ্ত জীবনী:
পূর্ণনাম : ফজলুর রহমান খান
জন্ম : ১৯৩৯ সালের ২ মার্চ
জন্মস্থান : নেত্রকোনা জেলার মোহনগঞ্জ উপজেলার কাজিয়াটি গ্রামে
পিতা : আব্দুল হাকিম খান
মাতা : ফিরোজা খাতুন
স্ত্রী : ফরিদা রউফ খান
শিক্ষা : ম্যাট্রিকুলেশন (মাধ্যমিক)- মোহনগঞ্জ পাইলট হাই স্কুল (১৯৫৪); আই.এস.সি. (উচ্চ মাধ্যমিক)- ময়মনসিংহ আনন্দমোহন কলেজ (১৯৫৮); বি.এস.সি. (পাস)- মৃত্তিকাবিজ্ঞান বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় (১৯৬০); এম.এস.সি.- মৃত্তিকাবিজ্ঞান বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় (১৯৬১); পিএইচডি- ইম্পেরিয়াল কলেজ, লন্ডন বিশ্ববিদ্যালয় (১৯৬৮)। পিএইচডিতে তাঁর গবেষণা-অভিসন্দর্ভের বিষয় ছিল ‘ A Study on the Nutrient Metabolism in Soil at High Moisture Levels’।
পেশা : শিক্ষকতা
কর্মজীবন : ১৯৬৩ সালের ১ আগস্ট তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মৃত্তিকাবিজ্ঞান বিভাগের প্রভাষক নিযুক্ত হন। পিএইচডি ডিগ্রি লাভ করার পর দেশে ফিরে ১৯৬৮ সালের ১ আগস্ট তিনি পুনরায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মৃত্তিকাবিজ্ঞান বিভাগের প্রভাষকের পূর্বপদে যোগদান করেন। একই বছরের ১৫ আগস্ট তিনি উক্ত বিভাগের সিনিয়র লেকচারার পদে উন্নীত হন।
মৃত্যু : ১৯৭১ সালের ২৬ মার্চের ভোররাতের প্রথম প্রহরে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের তত্কালীন ইকবাল হলের (বর্তমান জহুরুল হক হল) পাশের আবাসিক শিক্ষক ভবনের তিনতলার পূর্বদিকের ২৩/এফ ফ্লাটটিতে নিজের শোবার ঘরে পাকিস্তানী সেনাবাহিনীর গুলিতে শাহাদাত বরণ করেন ড. ফজলুর রহমান খান। নিথর শরীরে দেড় দিন পড়ে থাকার পর ২৭ তারিখ সকাল ৮টার দিকে কারফিউ শিথিল হলে তাঁর আত্মীয়-পরিজনেরা তাঁর মরদেহ সমাধিস্থ করেন আজিমপুর কবরস্থানে।
তথ্যসূত্র:
যাঁদের সাক্ষাত্কারের ভিত্তিতে এই জীবনচরিত তৈরি করা হয়েছে-
১. জনাবা ফরিদা রউফ খান (শহীদ ড. ফজলুর রহমান খানের স্ত্রী)।
২. ড. আব্দুল মতিন (শহীদ ড. ফজলুর রহমান খানের মামাতো-ফুপাতো ভাই); প্রাক্তন প্রধান প্রকৌশলী, বাংলাদেশ পরমাণু শক্তি কমিশন।
৩. ড. এম. শামিমুজ্জামান বসুনিয়া (শহীদ ড. ফজলুর রহমান খানের ছোট ভায়রা); অধ্যাপক, পুরকৌশল বিভাগ, বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়।
৪. ড. খলিলুর রহমান (শহীদ ড. ফজলুর রহমান খানের পিএইচডি সহপাঠী); প্রাক্তন অধ্যাপক, রসায়ন বিভাগ, শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়, সিলেট।
৫. ড. মোহাম্মদ সুলতান হোসেন (শহীদ ড. ফজলুর রহমান খানের সহকর্মী); অধ্যাপক, মৃত্তিকা, পানি ও পরিবেশ বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।
৬. ড. সৈয়দ ফজলে এলাহী (শহীদ ড. ফজলুর রহমান খানের ছাত্র); অধ্যাপক, মৃত্তিকা, পানি ও পরিবেশ বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।
৭. ড. শাহজাহান চৌধুরী (শহীদ ড. ফজলুর রহমান খানের ছাত্র); অধ্যাপক, মৃত্তিকা, পানি ও পরিবেশ বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।
লেখক : মোঃ কুতুব উদ্দিন সজিব