একদিকে নিজের জীবন আর অন্য দিকে মহাপ্রস্থানের পথ – নির্মম মৃত্যু। এর যে কোনো একটিকে বেছে নিতে বলা হলো তাঁকে। তিনি নির্মম মৃত্যুকেই হাসিমুখে আলিঙ্গন করার দৃঢ় শপথ নিলেন। পাক হানাদার বাহিনী তাঁর সামনে একটি বিবৃতির কাগজ ধরে বলেছিল, এই বিবৃতিতে স্বাক্ষর করে পাকিস্তানের প্রতি আনুগত্য প্রকাশ করবেন অথবা মৃত্যুকে বেছে নেবেন। সিদ্ধান্ত নিতে তাঁর সামান্যতম দেরিও হয়নি। হানাদার বাহিনী তাঁকে যে বিবৃতির কাগজটি দিয়েছিল সেটি টুকরো টুকরো করে ছিঁড়ে ফেলে দিলেন। দেশমাতৃকার জন্য, স্বাধীন বাংলার জন্য হাসিমুখে জীবনকে বিলিয়ে দিয়ে নির্ভয়ে বীরের মতো আলিঙ্গন করেছিলেন মৃত্যুকে। আর এই চিরস্মরণীয় মানুষটি হলেন তত্কালীন জাতীয় পরিষদ সদস্য, সাবেক মন্ত্রী ও আওয়ামী লীগ নেতা মশিউর রহমান।
মশিউর রহমানের জন্ম ১৯১৭ সালের ফেব্রুয়ারী মাসে যশোর জেলার চৌগাছা থানার সিংহঝুলী গ্রামে। তাঁর পিতার নাম মোহাম্মদ ইসমাইল হোসেন এবং মাতা সৈয়দুন্নেসা। মশিউর রহমানরা ছিলেন তিন ভাই ও তিন বোন। তিনি ছিলেন দ্বিতীয়। মশিউর রহমানের বাল্যকালে লেখাপড়া শুরু হয় গ্রামেরই প্রাইমারি স্কুলে। পরে তিনি যশোর জেলা স্কুলে ভর্তি হন। ১৯৩৬ সালে যশোর জেলা স্কুল থেকে ম্যাট্রিক পাশ করেন। ইন্টারমিডিয়েট ভর্তি হন কলকাতার তত্কালীন ইসলামিয়া কলেজে (বর্তমানে মৌলানা আজাদ কলেজ)। সেখান থেকেই ১৯৩৮ সালে আই.এ. এবং ১৯৪০ সালে বি.এ. পাশ করেন। এরপর ১৯৪৪ সালে কলকাতা রিপন কলেজ থেকে আইন পেশায় ডিগ্রিপ্রাপ্ত হন। আইন পড়াকালীন সময়ে তিনি একটি মার্চেন্ট অফিসের ইংরেজ বড় সাহেবের সেক্রেটারি হিসাবে কাজ করায় ইংরেজিতে দক্ষতা ও নিপুণতা অর্জনে সক্ষম হন।
কলকাতাতে ছাত্র অবস্থাতেই মশিউর রহমান রাজনীতির সাথে যুক্ত হয়ে পড়েন। ১৯৪৫ সালে তিনি মুসলিম লীগে যোগ দেন। এ সময়ে তাঁর সঙ্গে পরিচয় ঘটে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের। এ সময় তিনি হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীর সংস্পর্শেও আসেন। বৃটিশবিরোধী আন্দোলনে শহীদ সোহরাওয়ার্দীর বিশ্বস্ত সহচর ছিলেন মশিউর রহমান। দেশ বিভাগের পর তিনি ফিরে আসেন নিজ জেলায় এবং আইন পেশায় আত্মনিয়োগ করেন। ১৯৪৬-এ বঙ্গীয় আইন সভার নির্বাচনে যশোর জেলা মুসলিম লীগের নির্বাচনী অভিযান পরিচালনায় তিনিই নেতৃত্ব দেন। পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার শুরু থেকেই তিনি অগ্রসরমান সম্ভাবনাময় তরুণ নেতা হিসাবে মুসলিম লীগ সরকারের দমনপীড়ন অগ্রাহ্য করে জনগণকে সংগঠিত করতে অগ্রণী ভূমিকা পালন করেন।
পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পর বাঙালীরা শিকার হয় শোষণ আর নির্যাতনের। পশ্চিম পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠী বাঙালী জনগোষ্ঠীর উপর চাপিয়ে দেয় উর্দু ভাষা। এর প্রতিবাদে ছাত্রসমাজ প্রবলভাবে বিক্ষোভ দেখায়। রাজপথে নামে। ‘উর্দুই হবে পাকিস্তানের একমাত্র রাষ্ট্রভাষা’-পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী কায়েদে আযম মোহাম্মদ আলী জিন্নাহর এই অপ্রত্যাশিত ঘোষণার প্রতিবাদে সারাদেশে ছাত্র ধর্মঘট আহ্বান করা হয়।
‘রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদ’-এর আহ্বানে ১৯৪৮ সালের ১১ মার্চ যশোর শহরে একটি ছাত্র ধর্মঘট হয়। সেটি ছিল সিপিআই (ভারতের কমিউনিস্ট পার্টি)-এর ছাত্র সংগঠন স্টুডেন্ট ফেডারেশন প্রভাবিত, মশিউর রহমান তাতে নেতৃত্বের ভূমিকা পালন করেন। পাকিস্তানি কর্তৃপক্ষ তখন যশোর শহরের পরিস্থিতি বুঝতে পেরে ১৪৪ ধারা জারি করে। ১৪৪ ধারা ভেঙ্গে ছাত্রসমাজ মিছিল বের করে এবং ছাত্রদের এক বিশাল প্রতিবাদ সভা হয় যশোর ট্রেডিং ব্যাংক ময়দানে (বর্তমানে টিএন্ডটি ময়দান)। এই সভায় সভাপতিত্ব করেন মশিউর রহমান। পাকিস্তানের বিরুদ্ধাচরণ করায় ও রাষ্ট্রভাষা বাংলার পক্ষ অবলম্বন করায় ওইদিন তাঁকে গ্রেফতার করে পাকিস্তান কর্তৃপক্ষ। সেসময় যশোরের অনেক রাজনৈতিক নেতার বিরুদ্ধে গ্রেফতারি পরোয়ানা ও মিথ্যা অজুহাতে রাজনৈতিক গ্রেফতারের প্রতিবাদে তিনি ১৯৪৮ সালে স্থানীয় কারাগারে আমরণ অনশন শুরু করেন। দীর্ঘ প্রায় ২০ দিন এভাবে অনশন করার পর প্রশাসন তাঁর দাবী মেনে নেয়। তখন কলকাতা থেকে হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী এসে মশিউর রহমানের অনশন ভাঙ্গান।
কারাগার থেকে বেরুনোর পর তিনি আরো উত্সাহ নিয়ে আইন ব্যবসার পাশাপাশি রাজনীতিতে সময় দেয়া শুরু করেন। তখন পর্যন্ত বাঙালী মধ্যবিত্তের আশা-আকাঙ্ক্ষার জায়গাটি থেকে মুসলিম লীগ একেবারে বিতাড়িত হয়নি। এর মধ্যেই মুসলিম লীগের প্রার্থী হিসাবেই মশিউর রহমান ১৯৪৯ সালে সর্বকনিষ্ঠ অর্থাত্ মাত্র ৩২ বছর বয়সে যশোর জেলা পরিষদের চেয়ারম্যান পদে বিপুল ভোটে নিবাচিত হন। কিন্তু বাঙালীর প্রতি মুসলিম লীগ সরকারের বৈষম্যমূলক নীতি যতই প্রকট হতে থাকে, মশিউর রহমানের সাথেও মুসলিম লীগের দ্বন্দ্ব তত বাড়তে থাকে। একপর্যায়ে তত্কালীন মুসলিম লীগ সরকারের সঙ্গে মতানৈক্য ঘটায় ১৯৪৯ সালে তিনি যশোর জেলা পরিষদের পদ থেকে পদত্যাগ করেন।
১৯৫০ সালে তিনি বগুড়ার চান্দবাইশ গ্রামের মাহমুদা খাতুনকে বিয়ে করেন। উচ্চশিক্ষিতা ও রুচিশীল মাহমুদা সারা জীবন স্বামীর পাশে থেকে তাঁকে দেশসেবার কাজে সহায়তা করেছেন। তিনি নিজেও ছিলেন পদস্থ সরকারি কর্মকর্তা। বাংলাদেশ পাবলিক সার্ভিস কমিশনের (পিএসসি) চেয়ারম্যান হিসাবে দক্ষতার সাথে দায়িত্ব পালন করে অবসর নিয়েছেন। মশিউর রহমান ও মাহমুদা মশিউর দম্পতির দুই ছেলে এবং দুই মেয়ে। বড় ছেলে ড. মাহমুদুর রহমান, দ্বিতীয় মেয়ে নাসরীন রহমান, তৃতীয় মেয়ে নিলুফার হাসান ও চতুর্থ ছেলে মাশকুর রহমান টুটুল।
মুসলিম লীগ সরকারের বৈষম্য ও নির্যাতনের বিরুদ্ধে ১৯৫২-র ভাষা আন্দোলন বাঙালী জাতীয়তাবাদের ভিত্তিকে সুদৃঢ় করে দেয়। ১৯৬৪ সালেই ছাত্র ও সমাজ ও বাঙালী জনগণ অনুভব করেন মুসলিম লীগ সরকারের বিরুদ্ধে ঐক্যবদ্ধ আন্দোলনের। ছাত্রসমাজ ডাক দেয় ‘হক-ভাসানী- সোহওয়ার্দী এক হওয়ার’। নেতৃত্বের অনেকের মধ্যে এ নিয়ে দ্বন্দ্ধ কাজ করলেও শেষ পর্যন্ত তারা বাধ্য হন যুক্তফ্রন্ট গঠনের। ১৯৫৪ সালের যুক্তফ্রন্ট নির্বাচনে মশিউর রহমান যশোর থেকে প্রাদেশিক পরিষদের সদস্য নির্বাচিত হন। এত বিপুল ভোটে তিনি নির্বাচিত হন যে বাকি ১৯ জন প্রতিদ্বন্দ্বীর সকলেই জামানত হারান। তখন যুক্তফ্রন্ট মন্ত্রিসভার প্রদেশে নেতৃত্ব দেন আতাউর রহমান খান। মশিউর রহমান সেই মন্ত্রিসভার প্রচার ও স্থানীয় স্বায়ত্বশাসন (১৯৫৬-১৯৫৭), বিচার ও সংবাদ বিষয়ক (১৯৫৭-১৯৫৮) এবং রাজস্ব ও স্থানীয় স্বায়ত্ত্বশাসন (১৯৫৮) মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব দক্ষতার সাথে পালন করেন।
১৯৫৮ সালেই পাকিস্তানের সেনাপ্রধান আইয়ুব খান এক সামরিক ক্যু-এর মাধ্যমে পাকিস্তানের দণ্ডমুন্ডের কর্তা হয়ে বসেন। ১৯৫৮ সালে মশিউর রহমান আবারো গ্রেফতার হন। প্রায় ছয় মাস বিনা বিচারে কারাভোগের পর জামিনে মুক্তি লাভ করেন। ১৯৬৪ সালের ২৫ জানুয়ারী শেখ মজিবুর রহমানের নেতৃত্বাধীনে আওয়ামী লীগ পুনরুজ্জীবিত হলে মশিউর রহমান আওয়ামী লীগ পুনর্গঠনে তাঁর অগ্রগামী হন।
ষাটের দশকের সূচনাতেই আইয়ুববিরোধী আন্দোলন ও স্বাধিকারের প্রশ্নে বাঙালী জাতি আবারো গর্জে ওঠে। রাজপথ প্রকম্পিত হতে থাকে স্বাধিকারের প্রশ্নে। রাজধানী ঢাকার সাথে সাথে সেই আন্দোলন ছড়িয়ে পড়ে জেলা-মহকুমা শহরগুলোতেও। তখন ঢাকার বাইরে দেশের অন্যান্য অঞ্চলে যাদের নিরলস শ্রম এবং ঐকান্তিক প্রচেষ্টায় শত বাধা-বিপত্তি উপেক্ষা করে দেশবাসীকে সেই আন্দোলনে টেনে আনা সম্ভব হয়েছিল তাদের মধ্যে যশোরের আওয়ামী লীগ নেতা মশিউর রহমান ছিলেন প্রথম সারিতে। ঢাকার বাইরে থাকলেও তিনি ছিলেন জাতীয় পর্যায়ের নেতা। আওয়ামী লীগের শীর্ষস্থানীয়দের একজন। পাকিস্তানের রাজনীতির এক প্রবল সন্ধিক্ষণে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ কর্তৃক ১৯৬৬ সালে ৬ দফা দাবি উত্থাপিত হয়। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব ৬ দফাকে বাঙালীর ‘মুক্তি সনদ’ বললেও ছাত্রসমাজ তা বলতে নারাজ। তারা ৬ দফার সঙ্গে ১১ দফা সংযুক্ত করেন। ৬ দফা ও ১১ দফার আন্দোলন চলতে থাকে সমান্তরালভাবে, স্বাধিকার প্রাপ্তির অধিকার নিয়ে। ঐতিহাসিক এই ৬ দফা আন্দোলনে মশিউর রহমান অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিলেন।
বস্তুত ১৯৬৬ সালের ৬ দফা উত্থাপিত হওয়ার পর এদেশের রাজনীতিতে এক গুণগত পরিবর্তনের সূচনা হয়। আওয়ামী লীগ নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব এমন এক সময়ে ৬ দফার দাবি উত্থাপন করেন যখন ছাত্র আন্দোলন একেবারে তুঙ্গে। এর মধ্যে ১৯৬৫ সালের পাক-ভারত যুদ্ধ বাঙালীর মোহভঙ্গের মাত্রাকে যেন আরো খানিকটা উসকে দিয়েছিল। তত্কালীন পূর্ব পাকিস্তানের জনগণ উপলব্ধি করতে পেরেছিল বাইরের হামলার মুখে তারা কতটা অরক্ষিত ও অসহায়। পাকিস্তান রাষ্ট্র ও পশ্চিম পাকিস্তানের মদদপুষ্ট এবং তাদের প্রতি অনুগত এক বিশাল সামরিক বাহিনী পূর্ব পাকিস্তানের জনগণের কোনো কাজেই আসবে না সেটা তারা বুঝে ফেলে। পূর্ব পাকিস্তানের জনগণ তাদের অসহায়ত্বের প্রমাণ পেলেন হাতেনাতে।
১৯৬৬ সালে ৬ দফা দাবিতে আন্দোলন চলাকালে খুলনার এক জনসভায় বক্তৃতা করতে যান বঙ্গবন্ধু। বিশাল এই জনসভায় বক্তৃতা করে ঢাকা ফেরার পথে যশোরে সামরিক কর্তৃপক্ষের নির্দেশে তাঁকে গ্রেফতার করা হয়। পাকিস্তানী সামরিক কর্তৃপক্ষের নির্দেশ ছিল গ্রেফতার করেই যেন বঙ্গবন্ধুকে ঢাকা পাঠিয়ে দেয়া হয়। কিন্তু যশোরে মশিউর রহমানসহ অন্যান্য আইনজীবীরা আদালতে মামলা লড়ে তাঁকে জামিনে মুক্ত করেন এবং মুক্তির পর তিনি মশিউর রহমান সাহেবের বাসায়ই ছিলেন। ১৯৬৬ থেকে ১৯৬৮ সাল এই দুই বছর ছিল পাকিস্তানের রাজনীতিতে এক গুরুত্বপূর্ণ ও একই সঙ্গে ক্রান্তিকাল। ১৯৬৬ সালে ৬ দফার মাধ্যমে যে ‘স্বাধীকারের’ প্রশ্ন উত্থাপিত হয়েছিল ১৯৬৮ সালে তা এসে ‘স্বাধীনতার’ প্রশ্নে জেগে উঠে। ইতিমধ্যে বাঙালী জাতীয়তাবাদ প্রশ্নে যে আন্দোলন ধীরে ধীরে স্বাধীনতার দিকে অগ্রসর হচিছল তাকে কঠোর হস্তে দমন করার জন্য আইয়ুব খান মিথ্যা আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা সাজায়। তাতে একনম্বর আসামি করা হয় বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে। আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলার নামে আসলে এদেশের ৩২ জন স্বাধীনতাকামী বীর বাঙালি সংগ্রামীর মৃত্যুদণ্ড দেয়ার এক প্রহসন সাজায় পাকিস্তানী কর্তৃপক্ষ।
পূর্ব পাকিস্তানের রাজনীতির এই দুর্যোগপূর্ণ সময়ে মশিউর রহমান পালন করেন এক অভূতপূর্ব ভূমিকা। আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলায় বঙ্গবন্ধুর প্রধান কুশলী ছিলেন সালাম খান। সঙ্গে ছিলেন অ্যাড. জহির উদ্দিন, অ্যাড. মজিবর রহমান, অ্যাড. জুলমত আলী খানসহ আরো কয়েকজন। সে সময় আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা পরিচালনার জন্য বেগম মুজিব যশোর থেকে বিশেষ অনুরোধ করে ঢাকায় নিয়ে আসেন মশিউর রহমানকে। মামলা পরিচালনায় তাঁর প্রজ্ঞা, বুদ্ধিমত্তা ও দক্ষতা ছিল অসাধারণ। মামলার প্রয়োজনেই তিনি প্রায় এক বছর যশোর ও নিজের পেশাগত কাজকর্ম, ঘর-সংসার ছেড়ে ঢাকায় অবস্থান করেছিলেন।
ইতিমধ্যে আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলাকে কেন্দ্র করে আইয়ুব খানের মসনদ নড়বড়ে হয়ে পড়ে। প্রবল ছাত্র আন্দোলনের মুখে ১৯৬৯ সালের জানুয়ারী মাসেই পাকিস্তানের মসনদ থেকে বিদায় নেন এই ফিল্ড মার্শাল। পর্দার অন্তরালে থেকে রক্তপাতহীন এক সামরিক অভ্যুত্থানের মাধ্যমে ক্ষমতা নেয় ইয়াহিয়া খান। বস্তুত যে আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা শুরু হয়েছিল ৩২ জন বাঙালী মুক্তি সেনানীকে মৃত্যুদণ্ড দেয়ার লক্ষ্য নিয়ে তার পরিসমাপ্তি হয় পাকিস্তানের মৃত্যুদণ্ড ঘোষণার মধ্য দিয়ে।
মশিউর রহমানের এই রাজনৈতিক পথচলা অবশ্য একেবারে সরলরৈখিক ছিল না। ১৯৬৭ সালের ৩০ এপ্রিল পিডিএম গঠিত হলে মশিউর রহমান আওয়ামী লীগ ছেড়ে তাতে যোগ দেন। পিডিএম-কে কেন্দ্র করে আওয়ামী লীগ দুইভাগে বিভক্ত হলেও তিনি পিডিএমপন্থী আওয়ামী লীগের ভাইস প্রেসিডেন্ট নিযুক্ত হন। ১৯৬৯-এ পিডিএমপন্থী আওয়ামী লীগ ত্যাগ করে পুনরায় শেখ মুজিবের প্রতি আস্থা জ্ঞাপন করে মূল আওয়ামী লীগে ফিরে আসেন।
ইয়াহিয়া খান ক্ষমতায় বসার পর আন্দোলনের চাপের কাছে জাতীয় নির্বাচন দিতে বাধ্য হন। ১৯৭০ সালের এই নির্বাচনই ছিল জনগণের পক্ষে পাকিস্তানের কবরে শেষ পেরেক ঠোকা। সেই নির্বাচনে মশিউর রহমান যশোর-৩ আসন থেকে আওয়ামী লীগের মনোনীত প্রার্থী হিসাবে বিপুল ভোটে জয়লাভ করেন। পশ্চিম পাকিস্তানী শাসকগোষ্ঠী নানা টালবাহানার মধ্য দিয়ে তখন ক্ষমতা হস্তান্তর করতে বিলম্ব করে। ১৯৭০ সালের ১ মার্চ সারাদেশে শুরু হয় অসহযোগ আন্দোলন। এই অসহযোগ আন্দোলন চলাকালে যশোরের জনগণ স্থানীয় সেনানিবাসে খাদ্যসহ সব ধরনের সরবরাহ বন্ধ করে দেয়। এই আন্দোলনে যশোরে নেতৃত্ব দেন মশিউর রহমান।
১৯৭১ সালের ৩ মার্চ অসহযোগ আন্দোলন চলাকালে পাকসৈন্যরা যশোরে চারুবালা করকে নির্মমভাবে গুলি করে হত্যা করে। অসহযোগ আন্দোলনের মধ্যে জনতার ক্ষোভ আরো তুঙ্গে উঠে। তারা চারুবালা করের মৃতদেহ নিয়ে শহরে সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে মিছিলে নামে। মশিউর রহমান নিজে সেই মিছিলের নেতৃত্ব দেন। মিছিলটি সার্কিট হাউজের সামনে পৌঁছালে বিক্ষুব্ধ জনতা সেনাবাহিনীর দিকে ইট-পাটকেল মারতে শুরু করে। এক পর্যায়ে জনতা মারমুখী হয়ে সেনাবাহিনীকে ধাওয়া করে সার্কিট হাউসের ভিতর ঢুকিয়ে দেয় এবং সেখানে সেনাবাহিনীকে আক্রমণ করার প্রস্তুতি নেয়। সেনাবাহিনীর দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্নেল তোফায়েল এসময় গুলি চালানোর নির্দেশ দিলে মশিউর রহমান গিয়ে সার্কিট হাউজের সামনে দাঁড়ান। তিনি সেনাবাহিনীকে গুলি চালনা থেকে নিবৃত্ত থাকার আহ্বান জানান এবং জনগণকে স্থানীয় ঈদগাঁহের দিকে সরিয়ে নিতে সক্ষম হন।
১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ পাকহানাদার বাহিনী শুরু করে অপারেশন সার্চ লাইট। ইতিহাসের সেই কালো অধ্যায়ে নিরস্ত্র বাঙালীর উপর চালানো হয় নির্বিচারে গণহত্যা। রাজধানী ঢাকা থেকে মানবতাবিরোধী এই তাণ্ডবলীলা শুরু হলেও ষড়যন্ত্রের জাল বিছানো ছিল সারা দেশেই। ২৫ মার্চ বিকালেই বঙ্গবন্ধু ঢাকা থেকে যশোরে অবস্থানরত মশিউর রহমানকে ফোন করেন এবং পরিস্থিতি ভালো নয় বলে জানান। সন্ধ্যার দিকে মশিউর রহমান একবার বাড়ি থেকে বেরিয়ে যাওয়ার পরিকল্পনা করেন। কিন্তু কী ভেবে আবার বাসায়ই অবস্থান করেন। ছোট ছোট ছেলে-মেয়েদের বাড়ির বাইরে পাঠিয়ে দেয়া হয়। বাড়িতে রয়ে গেলেন শুধুমাত্র তিনি নিজে, স্ত্রী এবং বড় ছেলে।
২৫ মার্চ রাত ১টার দিকে পাকিস্তানী সেনাবাহিনী গাড়ি নিয়ে এসে যশোরের সার্কিট হাউজ রোডের মশিউর রহমানের পুরো বাড়িটি ঘিরে ফেলে। তাঁকে গ্রেফতার করে নিয়ে যাওয়া হয় যশোর ক্যান্টমেন্টে। গ্রেফতারের পরই মশিউর রহমানের উপর শুরু হয় নির্মম নির্যাতন। তাঁকে বলা হয় পাকিস্তানের পক্ষে বিবৃতি দেয়ার জন্য। তিনি রাজি হননি। প্রায় একমাস অমানুষিক নির্যাতন করা হয় তাঁকে ক্যান্টনমেন্টে। সে সময় ক্যান্টনমেন্টে আরো যাঁরা বন্দি ছিলেন তাঁদের কথা থেকে জানা যায়, বিবৃতি দিতে অস্বীকার করায় পাকসৈন্যরা তাঁর শরীরের চামড়া ধারালো চাকু দিয়ে ছিলে ফেলেছিল। নির্যাতনের এই মধ্যযুগীয় বর্বরতার মুখেও বিন্দুমাত্র আপোষ করেননি দেশপ্রেমিক মশিউর রহমান। এ সময় মশিউর রহমানের যশোরের বাড়িটি মর্টারের গোলায় ধ্বংস করে দেয়া হয়। তাঁর গ্রামের বাড়িতে আগুন লাগিয়ে দেয়া হয়। প্রতিহিংসামূলকভাবে মশিউর রহমানের চাচাতো ভাই মতিয়ার রহমানকে জীবন্ত দ্বগ্ধ করে নির্মমভাবে হত্যা করা হয়।
সঠিক দিনক্ষণের হিসাব না জানলেও আনুমানিক ১৯৭১ সালের ২৫ এপ্রিল পাক হানাদার বাহিনী স্বাধীনতার অকুতোভয় সৈনিক মশিউর রহমানকে হত্যা করে। তাঁর মৃতদেহটা পর্যন্ত সেদিন খুঁজে পায়নি তাঁর পরিবার।
সংক্ষিপ্ত জীবনী
জন্ম : মশিউর রহমানের জন্ম ১৯১৭ সালের ফেব্রুয়ারী মাসে যশোর জেলার চৌগাছা থানার সিংহঝুলী গ্রামে। তাঁর পিতার নাম মোহাম্মদ ইসমাইল হোসেন এবং মাতা সৈয়দুন্নেসা। মশিউর রহমানরা ছয় ভাইবোন। তিনি ছিলেন দ্বিতীয়।
শিক্ষা : লেখাপড়া শুরু হয় গ্রামেরই প্রাইমারি স্কুলে। ১৯৩৬ সালে যশোর জেলা স্কুল থেকে ম্যাট্রিক পাশ করেন। কলকাতার তত্কালীন ইসলামিয়া কলেজে থেকেই ১৯৩৮ সালে আই.এ. এবং ১৯৪০ সালে বি.এ. পাশ করেন। এরপর ১৯৪৪ সালে কলকাতা রিপন কলেজ থেকে আইন পেশায় ডিগ্রিপ্রাপ্ত হন।
চাকরি : আইন পড়াকালীন সময়ে তিনি একটি মার্চেন্ট অফিসের ইংরেজ বড় সাহেবের সেক্রেটারি হিসাবে কাজ করায় ইংরেজিতে দক্ষতা ও নিপুণতা অর্জনে সক্ষম হন।
রাজনীতি : ১৯৪৫ সালে তিনি মুসলিম লীগে যোগদান করে। মশিউর রহমান ১৯৪৯ সালে সর্বকনিষ্ঠ অর্থাত্ মাত্র ৩২ বছর বয়সে যশোর জেলা পরিষদের চেয়ারম্যান পদে নিবাচিত হন। মুসলিম লীগ সরকারের সঙ্গে মতানৈক্য ঘটায় ১৯৪৯ সালে তিনি পদত্যাগ করেন। ১৯৫৪ সালের যুক্তফ্রন্ট নির্বাচনে মশিউর রহমান যশোর থেকে প্রাদেশিক পরিষদের সদস্য নির্বাচিত হন। মশিউর রহমান মন্ত্রিসভার প্রচার ও স্থানীয় স্বায়ত্ত্বশাসন (১৯৫৬-১৯৫৭), বিচার ও সংবাদ বিষয়ক (১৯৫৭-১৯৫৮) এবং রাজস্ব ও স্থানীয় স্বায়ত্ত্বশাসন (১৯৫৮) মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব দক্ষতার সাথে পালন করেন। ১৯৬৭ সালের ৩০ এপ্রিল পিডিএম-এ যোগ দেন। ১৯৬৯-এ মূল আওয়ামী লীগে ফিরে আসেন। ১৯৭০ সালে মশিউর রহমান যশোর-৩ আসন থেকে এমএনএ হন।
গ্রেফতার : ১৯৪৮ সালের ১১ মার্চ পাকিস্তানের বিরুদ্ধাচরণ করায় ও রাষ্ট্রভাষা বাংলার পক্ষ অবলম্বন করায় তাঁকে গ্রেফতার করে পাকিস্তান কর্তৃপক্ষ। ১৯৫৮ সালে মশিউর রহমান আবারো গ্রেফতার হন। প্রায় ছয় মাস বিনা বিচারে কারাভোগের পর জামিনে মুক্তি লাভ করেন।
পরিবার : মশিউর রহমান ১৯৫০ সালে বগুড়ার চান্দবাইশ গ্রামের মাহমুদা খাতুনকে বিয়ে করেন। এই দম্পতির দুই ছেলে এবং দুই মেয়ে। বড় ছেলে ড. মাহমুদুর রহমান, দ্বিতীয় মেয়ে নাসরীন রহমান, তৃতীয় মেয়ে নিলুফার হাসান, চতুর্থ ছেলে মাশকুর রহমান টুটুল।
মৃত্যু : ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ পাক হানাদার বাহিনী রাত ১টার দিকে যশোরের সার্কিট হাউজ রোডের বাড়িটি থেকে তাঁকে গ্রেফতার করে ক্যান্টমেন্টে নিয়ে যায়। গ্রেফতারের পরই মশিউর রহমানের উপর শুরু হয় নির্মম নির্যাতন। আনুমানিক ২৫ এপ্রিল পাক হানাদার বাহিনী তাঁকে হত্যা করে।
তথ্যসূত্র: লেখাটি তৈরি করতে মশিউর রহমানের ছোট ছেলে মাশকুর রহমান টুটুল এবং পত্রপত্রিকা প্রকাশিত নিবন্ধ থেকে সাহায্য নেয়া হয়েছে।
লেখক : চন্দন সাহা রায়