তাঁদের পাড়ার এক লোকের পালক মেয়ের জামাইয়ের নাকি আরও একটা বউ আছে। অন্য গ্রামে একটা বিয়ে করে সেই বউকে সেখানে ফেলে রেখে এখানে এসে আবার বিয়ে করেছে। ঘটনাটা পাড়ার সবাই জানে, কিন্তু কেউ কিছু বলে না। পাড়ার লোকজন ভাবে, এ নিয়ে বলাবলি হলে এই মেয়েটাকে ফেলে যদি জামাইটা চলে যায়। মেয়েটার বাড়ির লোকজনও তাই ভাবে। মোর্তজার কিন্তু ব্যাপারটা ভাল লাগে না। জামাই লোকটিকে তাঁর অসহ্য লাগে। সারা দিন ঘুরে বেড়ায়, কোনো কিছু করে না। লোকটি শ্বশুর বাড়ির লোকজনের একেবারে ঘাড়ে চেপে বসেছে। তার কাছে মেয়ে বিয়ে দিয়ে যেন সবাই দায়ে পড়ে গেছে। কী করা যায়? কী করা যায়? বুদ্ধি একটা আছে, লোকটিকে নিয়ে একটা কবিতা লিখতে হবে। কবিতা দিয়েই লোকটিকে ঘায়েল করতে হবে।
সেই জামাইকে একদিন বাগে পেয়ে তাকে নিয়ে লেখা কবিতাটি হাতে গুঁজে দেন মোর্তজা। কবিতা পড়ে জামাইবাবুর তো মাথা খারাপ। কবিতা তো নয়, এক ঝাঁক ভীমরুল যেন তার গায়ে হুল ফুটিয়ে দিয়েছে। জামাইবাবু রাগে জ্বলতে জ্বলতে ছুটে গেলেন মোর্তজার অভিভাবকদের কাছে। কবিতাটা দেখালেন তাঁদের। কাণ্ড দেখে অভিভাবকরাও গেলেন রেগে। মোর্তজাকে বিস্তর বকাঝকা করলেন তাঁরা। জামাইবাবুকে ডেকে বললেন, ‘আপনি কিছু মনে করবেন না। বাচ্চা ছেলে, কিছু বোঝে না।’
মোর্তজার বয়স তখন তেরো কি চৌদ্দ। অষ্টম শ্রেণীতে পড়েন তিনি। ওইটুকু বয়সেই এক নারীর অসহায়ত্ব তাঁকে আলোড়িত করেছিল। আর তাই তো সেই ছোট্ট ছেলেটিই অন্য সবার মতো মুখ বুজে সহ্য না করে এক নারীর প্রতি অন্যায়ের প্রতিবাদ করে উঠেছিলেন সেদিন। মানুষের সেবায় নিবেদিত, সমাজ ও রাষ্ট্র বদলের চিন্তায় বিভোর এই মানুষটিকে ১৯৭১ সালে পাকিস্তানী বর্বররা নির্মমভাবে হত্যা করে। আর এরপরই শহীদ বুদ্ধিজীবীদের তালিকায় তাঁর নাম যুক্ত হয়।
শহীদ বুদ্ধিজীবী ডা. মোহাম্মদ মোর্তজার জন্ম ১৯৩১ সালের ১ এপ্রিল। পশ্চিমবঙ্গের চব্বিশ পরগণা জেলার বসিরহাটের চণ্ডিপুর গ্রামের রক্ষণশীল এক মুসলিম পরিবারের সন্তান তিনি। দাদা মোহাম্মদ আব্বাস আলী ছিলেন ‘মোহাম্মদী’ পত্রিকার মালিক। মুসলমানদের মধ্যে মোহাম্মদ আব্বাস আলীই প্রথম কোরআনের বাংলা অনুবাদ করেন। বাবা মাওলানা আব্দুল মান্নান আল আযহারী ও মা সায়রা বেগম। কলকাতার ক্যাম্পবেল স্কুলের চতুর্থ শ্রেণীর ছাত্র থাকাকালেই ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনে শরিক হওয়ার দায়ে স্কুল থেকে বের করে দেওয়া হয় মোর্তজার বাবাকে। মোর্তজার যখন বয়স মাত্র দু’ মাস তখনই তাঁর বাবা আব্দুল মান্নান দেশ ছাড়তে বাধ্য হন। চলে যান মিসরে। মিসরের কায়রোতে আল আজহার বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্নাতকোত্তর হয়েছিলেন তিনি। অল্প বয়সেই মাকে হারান মোহাম্মদ মোর্তজা।
নানার (মায়ের মামা) বাড়িতে মানুষ হয়েছেন মোর্তজা। সেখানেই তাঁর পড়াশুনা শুরু হয়। লেখাপড়ায় ভীষণ মনোযোগী ছিলেন তিনি। ছোটবেলায় তাঁকে দারুণ অর্থসংকটের মধ্য দিয়ে যেতে হয়েছে। তিনি ছিলেন অত্যন্ত মেধাবী। দুষ্টুমিতেও ছিলেন সেরা। তবে পড়ার সময় ছিলেন খুব মনোযোগী। গান গাইতেও পছন্দ করতেন তিনি। অর্থের অভাবে মাঝে মাঝে এক চাচার সাথে গ্রামের বিভিন্ন বাজারে গান গাইতে বেরিয়ে যেতেন। গান গেয়ে যে টাকা পেতেন তা নিজের জন্য এবং গ্রামের গরিব বাসিন্দাদের ঘরদোর মেরামত বা মেয়েদের বিয়ে দেওয়ার কাজে খরচ করতেন।
গ্রামের স্কুলে হাতেখড়ি হলেও মোহাম্মদ মোর্তজার প্রাথমিক শিক্ষা বালিগঞ্জ স্কুলে। ১৯৪৬ সালে কলকাতার বালিগঞ্জ সরকারি উচ্চ বিদ্যালয় থেকে মাধ্যমিক পরীক্ষায় মেধা তালিকায় স্থান নিয়ে প্রথম বিভাগে উত্তীর্ণ হন। কলকাতার প্রেসিডেন্সি কলেজ থেকে ১৯৪৮ সালে উচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষায় আরও ভাল করেন তিনি। এরপর ভর্তি হন শিবপুর ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজে। ভর্তি পরীক্ষা দিয়েছিলেন কলকাতা মেডিক্যাল কলেজেও। পরিবারের সবার আগ্রহ ছিল মেডিকেলের ব্যাপারে। তাই ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজ ছেড়ে তিনি এসে ভর্তি হন কলকাতা মেডিকেল কলেজে। বেশ আগ্রহ নিয়েই কলকাতা মেডিকেল কলেজে চিকিত্সাবিদ্যা পড়ছিলেন তিনি। প্রথম ও দ্বিতীয় বর্ষে পরপর প্রথম হয়েছিলেন। এই কৃতিত্বের কারণে তিনি শিক্ষকদের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছিলেন। কিন্তু ১৯৫০ সালে কলকাতায় দাঙ্গা দেখা দেওয়ায় কলকাতা মেডিক্যালের পড়াশুনায় ইতি টানতে হয় তাঁকে এবং তিনি চলে আসেন ঢাকায়।
মোর্তজা যখন ঢাকায় আসেন তখন তাঁর সম্বল ছিল একটা চিঠি ও ঠিকানা লেখা এক টুকরো কাগজ। চোখের সামনে অচেনা এক শহর। যেখানে বন্ধু নেই, নেই কোনো আত্মীয়-স্বজন। কলকাতা মেডিকেলের এক অধ্যাপকের পরামর্শে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গাকে পেছনে ফেলে ঢাকায় এসেছেন তিনি। ভরসা একটাই – কলকাতা মেডিকেলের সাবেক অধ্যাপক ডা. টি. আহমেদ ঢাকা মেডিকেলের অধ্যক্ষ। তাঁরই সহযোগিতায় ভর্তি হলেন ঢাকা মেডিকেলের তৃতীয় বর্ষে। ভর্তি হতে পেরে বিধান রায়ের মতো চিকিত্সক হওয়ার হারানো স্বপ্নকে আবার ফিরে পেলেন তিনি।
অচেনা এই শহর এবং শহরের মানুষকে আপন করে নিলেন। এখানকার মানুষের সুখ-দুঃখের সঙ্গে নিজের সুখ-দুঃখ ভাগাভাগি করে নিলেন। এ সময় চিকিত্সাবিদ্যার পাশাপাশি সাহিত্য, ইতিহাস, রাজনীতি ও দর্শন নিয়েও তাঁর পড়াশুনা চলছিল সমান গতিতে। মেডিকেলে পড়াশুনার অংশ হিসেবে রোগীদের রোগের ইতিহাস পুঙ্খানুপুঙ্খরূপে লিপিবদ্ধ করতে হতো তাঁকে। এ কাজ করতে গিয়ে তিনি উপলব্ধি করলেন, রোগীদের অনেকেই শারীরিক ব্যাধির চেয়ে সামাজিক ব্যাধিরই শিকার বেশি। শুধু দেহের ও মনের চিকিত্সায় তাঁদের রোগ ভাল হওয়ার নয়। সমাজের চিকিত্সাটা আগে দরকার।
১৯৫১ সালের ২৭ এপ্রিল ডায়রিতে লিখেছিলেন, ‘কবিতা আমার জন্মগত আর চিকিত্সা আমার অবস্থাগত।…হতভাগ্য মুসলমান সমাজের জন্য একটা কিছু করিবার অপরাজেয় বীর্য্যবান কামনা লইয়া সকল অবস্থায় তীব্র শত্রুতার মাঝখানে আমি আমার যুদ্ধ আরম্ভ করিয়াছিলাম।’ মুসলমান সমাজের কল্যাণের তীব্র বাসনা থেকেই ঢাকা মেডিকেলে পড়ার শেষ দিকে এসে প্রগতিশীল রাজনীতির সঙ্গে জড়িয়ে পড়েন তিনি।
সাহিত্যচর্চা, চিকিত্সাবিদ্যা ও রাজনীতি- এই তিন ধারায় নিজেকে সমানভাবে এগিয়ে নিচ্ছিলেন মোর্তজা। মেডিকেলে পড়ার পাশাপাশি লিখছিলেন কবিতা, নাটক, ছোটগল্প, উপন্যাস। ১৯৫১ সালে তিনি লিখেছিলেন ‘সমাজপতি’ নাটক। ধর্মীয় অন্ধবিশ্বাসের সুযোগ নিয়ে সমাজপতিরা যেভাবে নিজেদের কামনা-বাসনা চরিতার্থ করে তাই তিনি তুলে ধরেন এ নাটকের মাধ্যমে।
১৯৫৪ সালে এমবিবিএস ডিগ্রি লাভ করেন মোর্তজা। এরপর চিকিত্সাবিদ্যায় উচ্চতর ডিগ্রি লাভের জন্য বিদেশ যাওয়ার সুযোগ এসেছিল তাঁর। তিনি সেই সুযোগ গ্রহণ করেননি। কারণ তিনি মনে করতেন – চিকিত্সক হয়ে সমাজের কিছু মানুষের উপকার করা যায় কিন্তু সমাজের দারিদ্র্য, শোষণ, বৈষম্য, অপরাধ, অনাচারের মতো ব্যাধি দূর করা যায় না। এজন্য চাই সুস্থ ও কল্যাণকর রাজনীতি। তাই তিনি দেশে থেকে দেশের মানুষকে চিকিত্সা সেবা দেওয়ার পাশাপাশি রাজনীতির সঙ্গে নিজেকে জড়িয়ে ছিলেন।
ব্যক্তিগত জীবনে উন্নতির হাতছানি এড়িয়ে ১৯৫৫ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মেডিকেল অফিসার হিসেবে কাজ শুরু করেন মোর্তজা। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে চাকরি করার একটা কারণ হচ্ছে, এখানে থাকলে তিনি বিশ্ববিদ্যালয়ের সমৃদ্ধ লাইব্রেরি ব্যবহার করতে পারবেন এবং নিরিবিলিতে অধ্যয়ন চালিয়ে যেতে পারবেন। বিশ্ববিদ্যালয়ে আসার পর থেকে মৃত্যুর পূর্ব পর্যন্ত দীর্ঘ ১৬ বছর একই পদে চাকরি করেছেন। এই ১৬ বছরের অধিকাংশ সময়ই দিনের অর্ধেকটা ব্যয় করতেন চিকিত্সা করে আর বাকি অর্ধেকটা কেটে যেত গ্রন্থাগারে। বাসায় ফিরেও চলত পড়াশুনা আর লেখালেখি। রাত দুইটা-তিনটার আগে ঘুমাতেন না। ঘুম কাটানোর জন্য একটা লেকচার-স্ট্যান্ডের মতো উঁচু টেবিল বানিয়ে নিয়েছিলেন। সেটার ওপর বইপত্র রেখে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে পড়াশুনা ও লেখালেখি করতেন।
চিকিত্সক হিসেবে মোর্তজা ছিলেন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের কাছে অত্যন্ত নির্ভরযোগ্য একজন। যখনই কারো অসুখ-বিসুখে ডাক পড়ত তিনি ছুটে যেতেন। বিশ্ববিদ্যালয় ছুটি হলেই চলে যেতেন পাবনা, কুষ্টিয়া, যশোর, খুলনা, বরিশাল। ফ্রি স্যাম্পল হিসেবে পাওয়া ওষুধ বিলি করতেন গরিবদের মাঝে আর বিনামূল্যে চিকিত্সা করতেন গ্রামের মানুষের। রিকসায় চড়তেন না মোর্তজা। অন্যের ঘাড়ের ওপর আয়েশ করে চলাটাকে অপমানের বিষয় মনে করতেন। রিকসায় চড়াটা তাঁর কাছে বেশ অমানবিক মনে হতো।
১৯৬৭ সালের ২৩ এপ্রিল সাঈদার সঙ্গে বিয়ে বন্ধনে আবদ্ধ হন মোহাম্মদ মোর্তজা। বিয়েতে মোর্তজার অভিভাবক ছিলেন অধ্যাপক আবদুর রাজ্জাক। বিয়ের স্মৃতিচারণ করে সাঈদা মোর্তজা লিখেছেন, ‘বিয়ের এক সপ্তাহ আগেও জানতাম না আমার বিয়ে হচ্ছে এবং তা ডা. মোর্তজার সঙ্গে। তিনি খালার কাছে আমাকে বিয়ে করার প্রস্তাব দিয়েছিলেন। তাঁর ইচ্ছেতেই তিনদিনের মধ্যে বিয়ে ঘটে গেল। বিয়ের পর ফুলার রোডের বাসায় এলাম মুনীর চৌধুরীর গাড়িতে করে। মুনীর চৌধুরী নিজেই ড্রাইভ করেছিলেন।…বিয়ের প্রথম রাতেই ডা. মোর্তজা আমাকে আত্মপরিচয় ব্যক্ত করে বললেন, এই সমাজের নানা অন্যায়ের সঙ্গে আপোষ করে বেঁচে থাকা তার পক্ষে সম্ভব নয়। এই সমাজকে ভেঙ্গে সুস্থ ও সুন্দর করে গড়তে প্রতিজ্ঞাবদ্ধ তিনি। আমি যেন তাঁর এই প্রতিজ্ঞা রক্ষা করার চেষ্টা করি। শোষণের রাজনীতি বিলোপ আর শোষণমুক্ত সমাজ গড়ার রাজনীতি- এসব কিছুই বোঝতাম না আমি। তবে মানুষকে কষ্ট দেওয়া, অন্যায় করা দেখলে আমার খুব খারাপ লাগত। তাই তাঁর কথা সেদিন মন দিয়ে শুনেছিলাম।’
১৯৭১ সালে বাঙালীর স্বাধীনতা সংগ্রামের শুরুর দিকে ডা. মোর্তজা ও সাঈদা মোর্তজার দ্বিতীয় পুত্রসন্তান অর্ণব নীলিমের জন্ম হয়। ২৭ মার্চে স্ত্রী ও দুই সন্তানকে নিয়ে তিনি ফুলার রোডের ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কোয়ার্টার থেকে চলে গেলেন গ্রিন রোডে সাঈদা মোর্তজার এক ভাইয়ের বাসায়। সপ্তাহ দেড়েক পরে সবাইকে নিয়ে আবার কোয়াটারে ফিরে এলেন। ফিরে এসে সাঈদার ভয় দূর হচ্ছিল না। সাঈদার ভয় দেখে মোর্তজা রসিকতা করে গান গাইতেন, ‘জীবনমৃত্যু পায়ের ভৃত্য, চিত্ত ভাবনাহীন’। ভালো গাইতেন তিনি। ‘৭১ সালের মাঝামাঝি সময়ে পাকিস্তানী বাহিনী ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কয়েকজন শিক্ষককে ধরে নিয়ে যায়। এতে সাঈদার ভয় আরও বেড়ে যায়। তিনি মোর্তজাকে বাসা ছাড়তে বললেন। মোর্তজা বললেন, ‘ওঁদের ছেড়ে দেয় কি না তা আগে দেখি। ছেড়ে না দিলে চলে যাব।’ এর কয়েকদিন পর পাকিস্তানী হানাদাররা শিক্ষকদের ছেড়ে দেয়। এ কারণে কোয়ার্টার ছাড়ার সিদ্ধান্ত আর নিলেন না তিনি।
দেশ স্বাধীন হতে আর মাত্র দুই দিন বাকি। নিশ্চিত পরাজয় দেখে মরিয়া হয়ে উঠল পাকিস্তানী হানাদাররা। তারা তাদের শেষ চাল চালল। লেলিয়ে দিল স্থানীয় দোসর আলবদর, রাজাকার, আলশামস বাহিনীকে। দেশের সর্বত্র তারা চালাল হত্যাযজ্ঞ। দেশপ্রেমিক চিন্তাশীল মানুষদের খুন করে চিন্তাহীন, দিকনির্দেশনাহীন, ভবিষ্যত্শূন্য এক অথর্ব জাতির দেশে পরিণত করতে চাইল বাংলাদেশকে। পাকিস্তানীদের এই কুপরিকল্পনার শিকার হলেন ডা. মোহাম্মদ মোর্তজাও।
১৯৭১ সালের ১৪ ডিসেম্বর সকাল। মোর্তজার ফুলার রোডের বাসার সামনে এসে থামল কাদামাখা একটি বাস। বাস থেকে লাফিয়ে নামল কাপড়ে মুখ ঢাকা সাত-আটজন রাইফেলধারী। ঢুকে গেল তারা মোর্তজার বাসায়। মোর্তজার তখনও সকালের নাস্তা হয়নি। রাইফেলধারীরা মোর্তজার পরিচয় নিশ্চিত হয়ে স্ত্রী ও কন্যার কাপড় দিয়ে তাঁর চোখ দুটো বেঁধে ফেলল। সাঈদা সামনে এসে দাঁড়ালে তাঁকে রাইফেলের বাঁট দিয়ে ধাক্কা মেরে মেঝেতে ফেলে দিল এবং মোর্তজাকে নিয়ে বেরিয়ে গেল। এর মাত্র দুই দিন পর অর্থাত্ ১৬ ডিসেম্বর স্বাধীনতা লাভ করল বাংলাদেশ। স্বাধীন বাংলাদেশে ১৮ ডিসেম্বর মোর্তজার গলিত মৃতদেহের সন্ধান পাওয়া গেল মিরপুরের বধ্যভূমিতে।
শহীদ বুদ্ধিজীবী ডা. মোহাম্মদ মোর্তজার লেখা ‘সমাজপতি’ নাটকের কথা আগেই বলা হয়েছে। এরপর তিনি ‘প্রেম ও পুরুষ’ নামে আরও একটি নাটক রচনা করেন। এই দুটো নাটকের পর বেশকিছু ছোটগল্প রচনা করেন তিনি। তাঁর এসব রচনায় মানুষের সামাজিক ও ব্যক্তিগত সমস্যার পাশাপাশি অর্থনৈতিক সমস্যাকেও একটা বড় সমস্যা হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে। তাঁর আরও একটি উল্লেখযোগ্য রচনা ‘চরিত্রহানির অধিকার’। এই উপন্যাসে তিনি বাঙালীর আর্থ-রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট ধরে কিছু চরিত্র উপস্থাপন করেছেন যেগুলো সমাজের বিভিন্ন অংশের প্রতিনিধি। উপন্যাসের নায়ক মালেক চৌধুরী উগ্র বাঙালী জাতীয়তাবাদী। মালেক চৌধুরী বাঙালীর ‘রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনের মানস-সন্তান’। আবার নায়িকা রোকেয়া ইসলাম ইংরেজ উপনিবেশবাদের ফসল। মালেক যেমন বাংলা ভাষার ব্যবহারে অত্যন্ত সচেতন, রোকেয়া তেমনি অধিকাংশ কথাই বলে ইংরেজিতে। দেশি-বিদেশি সংস্কৃতির একটা জগাখিচুড়ি মিশ্রণে সৃষ্ট অপজাত সমাজের সন্তান রোকেয়া মনে করে মাতৃভাষাটা সে যেমন বলে তেমনি হওয়া উচিত। রোকেয়ার মাধ্যমে মোহাম্মদ মোর্তজা বাঙালী সমাজের বিত্তশালী ও প্রভাবশালী একটা অংশের যে চিত্র তুলে ধরে ছিলেন তা এখনও বর্তমান।
নাটক, গল্প, উপন্যাস ইত্যাদির চেয়ে ডা. মোহাম্মদ মোর্তজার শক্তিশালী রচনা হচ্ছে তাঁর প্রবন্ধ। বিভিন্ন বিষয় নিয়ে তিনি প্রবন্ধ লিখেছেন। দেশ ও সমাজের উন্নয়নের সঙ্গে জড়িত বিভিন্ন প্রসঙ্গ বিশ্লেষণের মাধ্যমে সামনে এগিয়ে যাওয়ার পথ খুঁজে নেওয়ার চেষ্টা করেছেন তিনি তাঁর প্রবন্ধগুলোতে। ভাষা আন্দোলন পরবর্তী সময়েও বাঙালির ভাষা নিয়ে তর্ক-বিতর্কের যখন শেষ হচ্ছিল না তখন তিনি প্রবন্ধ লিখেছেন ‘ভাষার রূপ’ (১৯৫৮)। বাঙালীর ভাষার রূপ কী হবে তা তিনি আলোচনা করেছেন এ প্রবন্ধে। ‘শিক্ষার জগাখিচুড়ি: কিন্ডারগার্টেন বনাম মাদ্রাসা’ (১৯৬৩) প্রবন্ধে সমসাময়িক শিক্ষাব্যবস্থার ত্রুটিবিচ্যুতিতিগুলো তুলে ধরার চেষ্টা করেছেন। যৌতুক সমস্যা নিয়ে লিখেছেন ‘বাণিজ্যিক বিবাহ’ প্রবন্ধ। ‘প্রেম ও বিবাহের সম্পর্ক’ নামের একটি বই লিখেছিলেন তিনি। মানুষের প্রেম ও বিবাহের সনাতন ধারণার অচলায়তন ভেঙে দেওয়ার চেষ্টা করেছিলেন তিনি সেই বইয়ের মাধ্যমে। ১৯৬৪ সালে তিনি ‘জনসংখ্যা ও সম্পদ’ গ্রন্থের জন্য পেয়েছিলেন ন্যাশনাল ব্যাংক পুরস্কার। এই গ্রন্থে তিনি জনসংখ্যা কখন সমস্যা এবং কখন সমস্যা নয় সেসব বিষয়ে বিস্তারিত আলোচনা করেছেন। জনসংখ্যাকে সম্পদে পরিণত করার বিভিন্ন দিক তিনি তুলে ধরেছেন এ গ্রন্থে। চিকিত্সক হওয়ায় সাধারণ মানুষের পাঠের উপযোগী চিকিত্সা ও বিজ্ঞান বিষয়ক গ্রন্থও তিনি অনুবাদ করেছেন।
মোহাম্মদ মোর্তজা সমকালীন সমাজ ও রাজনীতির বহুবিধ প্রসঙ্গ নিয়ে আলোচনা করেছেন তাঁর লেখায়। তাঁর সব লেখারই সুনির্দিষ্ট উদ্দেশ্য ছিল। সমাজ ও মানুষের কল্যাণের আকাঙ্ক্ষা থেকে প্রত্যক্ষ প্রয়োজনের কথা বিবেচনা করে তিনি কলম চালিয়েছেন। স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্ব সম্পর্কে বাঙালী জাতিকে সচেতন করে তুলতে তিনি লিখেছেন, ‘রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনের পটভূমি ও তাত্পর্য’, ‘মধ্যবিত্ত কোন পথে’, ‘দেশে দেশে মুক্তিযুদ্ধ’, ‘প্যালেস্টাইনবাসীদের মুক্তিযুদ্ধ কোন পথে?’, ‘মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের গণ-আন্দোলন’, ‘জাপানে ছাত্র-শ্রমিকের সংগ্রাম’, ‘লাওসে গণযুদ্ধ’, ‘ধোফারে ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদের নাভিশ্বাস’, ‘বার্মায় জনযুদ্ধের সাফল্য’, ‘থাইল্যান্ডের গণযুদ্ধ এগিয়ে চলেছে’ ইত্যাদি প্রবন্ধ। এসব প্রবন্ধের মাধ্যমে মোহাম্মদ মোর্তজা নিজের দেশ ও জাতিকে অনুপ্রাণিত করতে চেয়েছেন। মোহাম্মদ মোর্তজা সমকালীন সমাজ ও রাজনীতির বহুবিধ প্রসঙ্গ নিয়ে আলোচনা করেছেন তাঁর লেখায়। তাঁর সব লেখারই সুনির্দিষ্ট উদ্দেশ্য ছিল। সমাজ ও মানুষের কল্যাণের আকাঙ্ক্ষা থেকে প্রত্যক্ষ প্রয়োজনের কথা বিবেচনা করে তিনি কলম চালিয়েছেন। স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্ব সম্পর্কে বাঙালী জাতিকে সচেতন করে তুলতে তিনি লিখেছেন, ‘রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনের পটভূমি ও তাত্পর্য’, ‘মধ্যবিত্ত কোন পথে’, ‘দেশে দেশে মুক্তিযুদ্ধ’, ‘প্যালেস্টাইনবাসীদের মুক্তিযুদ্ধ কোন পথে?’, ‘মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের গণ-আন্দোলন’, ‘জাপানে ছাত্র-শ্রমিকের সংগ্রাম’, ‘লাওসে গণযুদ্ধ’, ‘ধোফারে ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদের নাভিশ্বাস’, ‘বার্মায় জনযুদ্ধের সাফল্য’, ‘থাইল্যান্ডের গণযুদ্ধ এগিয়ে চলেছে’ ইত্যাদি প্রবন্ধ। এসব প্রবন্ধের মাধ্যমে মোহাম্মদ মোর্তজা নিজের দেশ ও জাতিকে অনুপ্রাণিত করতে চেয়েছেন।
সরাসরি বামপন্থী রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত ছিলেন মোহাম্মদ মোর্তজা। ছাত্রজীবন থেকেই সমাজ বদলের স্বপ্নে রাজনীতিতে জড়িয়ে ছিলেন নিজেকে। পূর্ব পাকিস্তান কমিউনিস্ট পার্টির সঙ্গে যোগাযোগ ছিল তাঁর। ১৯৬৬ সালে এ দল বিভক্ত হয়ে যায়। বিভক্ত হয়ে গড়ে ওঠা মার্কসবাদী-লেনিনবাদী পার্টির সঙ্গে জন্মলগ্ন থেকেই তাঁর ঘনিষ্ট সম্পর্ক ছিল। ১৯৭০ সালের শেষ দিকে এসে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চাকরি ছেড়ে গ্রামে চলে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন মোর্তজা। গ্রামের সাধারণ মানুষকে সমাজ পরিবর্তনের রাজনীতি সম্পর্কে সচেতন করা আর তাদের চিকিত্সা সেবা দেওয়া ছিল তাঁর উদ্দেশ্য। অধ্যাপক আব্দুর রাজ্জাক তাঁকে টঙ্গি থাকার ব্যবস্থা করার আশ্বাস দিয়েছিলেন। সেখানে শ্রমিকদের মধ্যে কাজ করার সম্ভাবনা দেখে আব্দুর রাজ্জাকের কথায় তিনি তখন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ছাড়েননি। বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের জন্য বাসায় তিনি সমাজবাদের ক্লাস নিতেন। দেশের মানুষকে সমাজ পরিবর্তনের ব্যাপারে সচেতন ও অনুপ্রাণিত করতে তিনি ও বদরুদ্দীন ওমর মিলে প্রকাশ করেছিলেন ‘গণশক্তি’ পত্রিকা। বদরুদ্দীন ওমর ছিলেন সেই পত্রিকার ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক। পত্রিকাটির প্রতি সংখ্যায় দুই-তিনটি লেখা থাকত মোর্তজার। সেখানে ছদ্মনামে লিখতেন তিনি।
”যুদ্ধ একটা জাতীয় প্রয়োজন। যুদ্ধের মধ্য দিয়েই জাতীয় চরিত্র তৈরি হয়। তাই আমি চাই যুদ্ধ। এ যুদ্ধে আমি মরে যাব। আমার ছেলে প্রাণ দেবে, তার ছেলে দেবে, এভাবে একদিন সত্যিকারের মানুষ তৈরি হবে”- এই কথাগুলো বলে গেছেন শহীদ বুদ্ধিজীবী ডা. মোহাম্মদ মোর্তজা।
এদেশের রাজাকার-আলবদরদের বিশ্বাসঘাতকতায়, তাদের ঘৃণ্য চক্রান্তের কাছে সেদিন ডা. মোহাম্মদ মোর্তজা প্রাণ দিয়েছিলেন ঠিকই কিন্তু তাঁর সত্যিকার মানুষ তৈরির সেই স্বপ্নকে বাস্তবে রূপ দেওয়ার দায়িত্ব দিয়ে গেছেন পরবর্তী প্রজন্মের কাঁধে।
সংক্ষিপ্ত পরিচিতি
জন্ম ও বংশ পরিচয়
শহীদ ডা. মোহাম্মদ মোর্তজার জন্ম ১৯৩১ সালের ১ এপ্রিল ভারতের পশ্চিমবঙ্গের চব্বিশ পরগণা জেলার বসিরহাটের চণ্ডিপুর গ্রামে। বাবা মাওলানা আব্দুল মান্নান আল আযহারী। মা সায়েরা বেগম। আব্দুল মান্নান কলকাতার ক্যামবেল স্কুলের চতুর্থ শ্রেণীর ছাত্র থাকাকালেই ব্রিটিশ-বিরোধী আন্দোলনে জড়িত থাকার কারণে রাসটিকিট পান। পরে মিসরের আল আজহার বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্নাতকোত্তর ডিগ্রি লাভ করেছিলেন।
শিক্ষা
মোহাম্মদ মোর্তজা ১৯৪৬ সালে কলকাতার সরকারী বালিগঞ্জ স্কুল থেকে মেধা তালিকায় বিশেষ স্থান নিয়ে মাধ্যমিক পাস করেন। ১৯৪৮ সালে কলকাতার প্রেসিডেন্সি কলেজ থেকে মেধা তালিকায় বিশেষ স্থান নিয়ে উচ্চ মাধ্যমিক পাস করেন। ১৯৫৪ সালে ঢাকা মেডিকেল কলেজ থেকে এমবিবিএস ডিগ্রি লাভ করেন।
পেশা
মোহাম্মদ মোর্তজা ১৯৫৫ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চিকিত্সা কেন্দ্রে যোগ দেন। মৃত্যুর আগপর্যন্ত তিনি সেখানেই কাজ করেন।
পরিবার
১৯৬৭ সালের ২৩ এপ্রিল বিয়ে করেন মোহাম্মদ মোর্তজা। স্ত্রী সাঈদা মোর্তজা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় গ্রন্থাগারে ডেপুটি গ্রন্থাগারিক হিসেবে কাজ করেছেন। এই দম্পতির দুই সন্তান। বড় – কন্যা দ্যুতি অরণি এবং ছোট – পুত্র অর্ণব নীলিম।
গ্রন্থ
অনুবাদ গ্রন্থ : চিকিত্সাশাস্ত্রের কাহিনী, প্রাচীন বিজ্ঞানের ইতিহাস, ঐতিহাসিক বস্তুবাদ, শান্তি না শক্তি, হুনানের কৃষক আন্দোলন, জনযুদ্ধের বিজয় দীর্ঘজীবী হোক। প্রবন্ধ গ্রন্থ : জনসংখ্যা ও সম্পদ, প্রেম ও বিবাহের সম্পর্ক, পাক-ভারত যুদ্ধের তাত্পর্য। উপন্যাস: চরিত্রহানির অধিকার। এছাড়া ১৯৮৫ সালে নাজমা জেসমিন চৌধুরীর সম্পাদনায় বাংলা একাডেমী থেকে প্রকাশিত হয়েছে ‘মোহাম্মদ মোর্তজা রচনাবলী’।
মৃত্যু
১৯৭১ সালের ১৪ ডিসেম্বর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ফুলার রোডের বাসা থেকে পাকিস্তানী হানাদারদের দোসর আলবদর বাহিনীর সদস্যরা মোহাম্মদ মোর্তজাকে ধরে নিয়ে যায়। ১৯৭২ সালের ৪ জানুয়ারি মিরপুরের বধ্যভূমি থেকে তাঁর গলিত মৃতদেহ উদ্ধার করা হয়।
কৃতজ্ঞতা
এই লেখাটির জন্য ব্যক্তিগতভাবে সহযোগিতা করেছেন শহীদ ডা. মোহাম্মদ মোর্তজার স্ত্রী সাঈদা মোর্তজা। এছাড়া নাজমা জেসমিন চৌধুরীর সম্পাদনায় বাংলা একাডেমী থেকে প্রকাশিত ‘মোহাম্মদ মোর্তজা রচনাবলী’ (প্রথম খণ্ড, নভেম্বর ১৯৮৫) বিশেষ সহায়ক হয়েছে। সহায়ক হয়েছে রক্তঋণ থেকে ১৯৯২ সালে প্রকাশিত ‘মুক্তিযুদ্ধে শহীদ চিকিত্সক: স্মৃতিকথা’, সময় প্রকাশনের ১৯৯১ সালে প্রকাশিত আমীরুল ইসলাম ও আসলাম সানী সম্পাদিত ‘আমার বাবা: শহীদ বুদ্ধিজীবীর সন্তানদের স্মৃতিকথা’, বাংলা একাডেমী থেকে রশিদ হায়দারের সম্পাদনায় প্রকাশিত ‘স্মৃতি: ১৯৭১’ ও ‘শহীদ বুদ্ধিজীবী কোষগ্রন্থ’ এবং বাংলা একাডেমীর ‘শহীদ বুদ্ধিজীবী স্মারকগ্রন্থ’৷
লেখক : ষড়ৈশ্বর্য মুহম্মদ