১৯৭১ সালের ১৪ ডিসেম্বর সকাল। ভারতীয় বিমান বাহিনীর মিগগুলো খুব নিচ দিয়ে উড়ে গিয়ে বিনা বাধায় বোমা ফেলছে ঢাকার ক্যান্টনমেন্ট ও গভর্নর হাউসে। শান্তিবাগের একটি বাসার বারান্দায় দাঁড়িয়ে এক বাবা তাঁর সাত বছরের সন্তানকে দেখাচ্ছেন সেই দৃশ্য আর বলছেন, ‘দেখো দেখো। স্বাধীনতার আর বেশি দেরি নেই। দেখছ না, প্লেনগুলো কেমন নিচ দিয়ে উড়ে গিয়ে বোমা ফেলছে। কেউ বাধা দিতে পারছে না। ২৪ ঘন্টার মধ্যেই স্বাধীন হয়ে যাব আমরা। ওরা আর আমাদের ঠেকিয়ে রাখতে পারবে না।’
প্রিয় পুত্র সুমনকে এই কথাগুলো বলতে বলতে যেন উত্তেজিত হয়ে উঠছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক মোফাজ্জল হায়দার চৌধুরী। ভেতরে তাঁর দারুণ এক তোলপাড়। মুক্ত হতে যাচ্ছে দেশ। দেশের মানুষের জন্য আসছে কাঙ্ক্ষিত সেই মুক্তি। আসছে অনেক রক্ত আর প্রাণের বিনিময়ে। বহু প্রত্যাশিত সেই স্বাধীনতা নাগালের মধ্যে চলে আসায় উত্তেজনা ধরে রাখতে পারছিলেন না তিনি।
মুক্তিযুদ্ধের প্রায় পুরো সময়টাই স্ত্রী ও সন্তানদের নিয়ে তিনি ছিলেন বিশ্ববিদ্যালয়ের ফুলার রোডের বাসায়। বন্ধু-বান্ধব শুভাকাঙ্ক্ষীরা তাঁকে বারবার কলকাতায় চলে যেতে বলেছেন। তিনি তাদের কথা মানেননি। ঢাকায় তাঁর প্রতিটি রাত কেটেছে দারুণ উত্কন্ঠায়। কিন্তু শেষপর্যন্ত ফুলার রোডের ওই বাসা ছাড়তেই হলো। ১০ ডিসেম্বর এসে উঠেছিলেন কেএম দাস লেনে শের-এ-বাংলার বাসায়। আরও অনেক লোক ছিল সেখানে। মোফাজ্জল হায়দার চৌধুরী ছিলেন সারা জীবনের চুপচাপ মানুষ। এই বাসার এত মানুষের হৈ-চৈ তাঁর ভালো লাগছিল না। এছাড়া মুরুব্বি ও অনেক আত্মীয়-স্বজনের ভিড়ে অস্বস্তিতে ছিলেন তিনি। দু-এক দিনের মাথায় তাই ওই বাসা ছেড়ে এসে উঠলেন ছোট ভাই লুত্ফুল হায়দার চৌধুরীর শান্তিবাগের বাসায়।
১৪ ডিসেম্বর দুপুর দেড়টা। টেবিলে ভাত দেয়া হয়েছে। মোফাজ্জল হায়দার চৌধুরী যাচ্ছিলেন গোসল করতে। বাথরুমে তাঁর গোসলের পানি ও কাপড়চোপড় সব প্রস্তুত। ঠিক তখনই বাইরের দরজায় কড়া নাড়ার শব্দ। লুত্ফুল হায়দার চৌধুরী এগিয়ে গিয়ে দরজাটা খুলে দিলেন। খুলে দিয়েই অবাক হলেন তিনি। নাক পর্যন্ত কাপড় দিয়ে ঢাকা কতগুলো লোক হাতের রাইফেল উঁচিয়ে ভেতরে ঢুকে পড়ল। সংখ্যায় তারা বিশ-পঁচিশ জন। তাদের একজন লুত্ফুল হায়দার চৌধুরীকে জিজ্ঞেস করল, ‘স্যার কি বাসায় আছেন?’
‘কেন? তাঁকে কী দরকার?’ বললেন তিনি।
রাইফেলধারীদের একজন তখন বলল, ‘আমাদের কমান্ডার গাড়িতে বসে আছেন। উনি স্যারের সঙ্গে একটু কথা বলবেন।’ ততক্ষণে ৩০/৩৫ জন রাইফেলধারী আলবদর বাড়িটা চারপাশ থেকে ঘিরে ফেলেছে। বাড়িতে কান্নার রোল পড়ে গেছে। কাঁদছেন মোফাজ্জল হায়দার চৌধুরীর স্ত্রী তাহমিনা, কাঁদছে শিশুপুত্র সুমন। কিন্তু বাড়িতে সবার ছোট শোভন ও ইমন (লুত্ফুল হায়দার চৌধুরীর পুত্র) ব্যাপারটা বুঝতে পারছে না। তাদের বয়স তখন সবে চার হলো। শোভন এসে ভাই সুমনকে জিজ্ঞেস করল, ‘মাত্র এই কয়েকটা রাইফেল দেখে তোমরা সবাই ভয়ে কাঁদছ কেন?’
রাইফেলধারীরা তখন মোফাজ্জল হায়দার চৌধুরীকে নিয়ে বেরিয়ে যাচ্ছিল। তাহমিনা এসে সামনে দাঁড়ালেন। বললেন, ‘আমার স্বামীকে কোথায় নিয়ে যাচ্ছেন আপনারা? উনি এখনো গোসল করেননি, ভাত খাননি।’
রাইফেলধারীদের একজন বলল, ‘ভাবি, আপনি ঘাবড়াবেন না। উনি তো আমাদের স্যার। উনার কি কোনো ক্ষতি আমরা করতে পারি? আমরা এখনি উনাকে ফেরত দিয়ে যাব।’
লোকগুলোর কথায় মোটেও আস্থা রাখতে পারছিলেন না তাহমিনা। মোফাজ্জল হায়দার চৌধুরী তখন স্ত্রীকে আশ্বস্ত করলেন। ম্লান হেসে বললেন, ‘তোমরা ভয় পাচ্ছ কেন? আমি তো কোনো অন্যায় করিনি।’
স্ত্রী তাহমিনা ও ভাই লুত্ফুল হায়দার বুঝতে পারছিলেন, অন্যায় না করাটাই তাঁর বড় অন্যায়। কিন্তু তাঁদেরও তখন কিছু করার নেই। মোফাজ্জল হায়দার চৌধুরী বাইরে রাস্তায় দাঁড়ানো কাদামাখা মাইক্রোবাসটায় গিয়ে উঠলেন। এগিয়ে গেলেন তাহমিনা ও লুত্ফুল হায়দার। বাসের কাছে এসে রাইফেলধারীদের বললেন, ‘উনাকে যেখানে নিয়ে যাবেন, আমরাও সেখানে যাব।’ রাইফেলধারী লোকগুলো তাঁদের কথায় বিরক্ত ও বিব্রত। বলল, ‘তার আর দরকার নেই। উনি এখনই চলে আসবেন।’ আর কোনো কথা বলার সুযোগ না দিয়ে মোফাজ্জল হায়দার চৌধুরীকে নিয়ে চলে গেল তারা। স্বাধীনতা লাভের ঠিক পূর্ব মুহূর্তে চিরকাঙ্ক্ষিত স্বাধীন দেশকে না দেখেই আত্মীয়-স্বজনের কাছ থেকে এভাবে বিদায় নিতে হলো মোফাজ্জল হায়দার চৌধুরীকে। এ বিদায়ই হলো তাঁর চিরবিদায়। আর ফিরে এলেন না তিনি।
১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর দেশের মানুষ স্বাধীনতা পেল, কিন্তু ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাজ্ঞ এই অধ্যাপককে পেল না। দেশ, জাতি ও ভাষার কল্যাণে নিবেদিত এই বুদ্ধিজীবীকে পেল না তারা। সুমন ও শোভন ফিরে পেল না তাদের বাবাকে। সৈয়দা তাহমিনা মনোয়ারা নুরুন্নাহার ফিরে পেলেন না তাঁর জীবনসঙ্গীকে। লুত্ফুল হায়দার চৌধুরী ফিরে পেলেন না তাঁর ভাইকে।
অধ্যাপক মোফাজ্জল হায়দার চৌধুরী ফুল খুব ভালোবাসতেন। বাইরে থেকে ফুল এনে নিজ হাতে ফুলদানিতে সাজিয়ে রাখতেন তিনি। পুত্র সুমন ও শোভনকেও ভালোবাসতেন খুব। একবার বাবার সোনার পার্কার কলম ভেঙে ফেলেছিল সুমন। মা এজন্য তাঁকে মেরেছিলেন। এ কারণে রাগ করে খাওয়া বন্ধ করে দিয়েছিলেন মোফাজ্জল হায়দার চৌধুরী। ফুল আর সন্তানদের মতোই ছিল দেশ ও মুক্তিযোদ্ধাদের প্রতি তাঁর ভালোবাসা। শান্তিনিকেতনে পড়াশোনা করেছেন তিনি। কলকাতায় তাঁর অনেক বন্ধু-বান্ধব। ইচ্ছে করলেই দেশ ছেড়ে আশ্রয় নিতে পারতেন কলকাতায়। যুদ্ধের সময় বিপন্ন দেশকে ছেড়ে যাননি তিনি।
পরিবারের বড় সন্তান হওয়ার কারণে তাঁকে অনেক ঝামেলা পোহাতে হয়েছে ছাত্র অবস্থাতেই। নোয়াখালী জেলার বেগমগঞ্জ থানার খালিশপুর গ্রামের মিয়াবাড়িতে ১৯২৬ সালের ২২ জুলাই তাঁর জন্ম। বাবা বজলুর রহিম চৌধুরী ও মা মাহফুজা খাতুন। এই দম্পতির পাঁচ সন্তান। মোফাজ্জল হায়দার চৌধুরীর বাবা ছিলেন সেকালের ম্যাট্রিকুলেট। মাত্র নয় বছর বয়সেই তিনি তাঁর সাহিত্যরসিক বাবাকে হারান। বাবার মৃত্যুর পর গ্রামের বাড়িতে পারিবারিক জমিজমা নিয়ে বিরোধ শুরু হয়। ১৯৪৭ সালে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে এম.এ. পড়ার সময় দাঙ্গা শুরু হলে গ্রামে ফিরে আসেন তিনি। বাড়িতে এসে পারিবারিক সম্পত্তি সংক্রান্ত বিরোধ মিটিয়ে দেন। দীর্ঘ এই বিরোধ মিটিয়ে ফেলার জন্য তাঁকে স্বার্থ ত্যাগ করতে হয়। তা করতে তিনি দ্বিধা করেননি। সাদা মনের মানুষ মোফাজ্জল হায়দার চৌধুরীর বাসার কাজের লোক ছিল নুরু নামের একজন। নুরুকে খুবই আদর করতেন তিনি। এই নুরুই আলবদরদের রাস্তা দেখিয়ে শান্তিবাগে লুত্ফুল হায়দার চৌধুরীর বাসায় নিয়ে এসেছিল।
মোফাজ্জল হায়দার চৌধুরী বাংলা সাহিত্যের বিভিন্ন শাখায় বিচরণ করেছেন। গল্প, কবিতা, নাটক ও প্রবন্ধ, গান, ভাষা বিষয়ক গবেষণা মিলিয়ে তাঁর রচনার সংখ্যা একেবারে কম নয়। রক্ষণশীল এক মধ্যবিত্ত মুসলিম পরিবারে তাঁর জন্ম হলেও সাহিত্যরসিক বাবার প্রভাব পড়েছিল তাঁর ওপর। এছাড়া ছোটবেলা থেকেই জগত্ ও জীবনের জটিল রহস্য তাঁর মনোযোগ কাড়ে। শৈশবের স্মৃতিচারণ করে ‘রঙিন আখর’ গ্রন্থের ‘লেখার উত্স’ নামের রচনায় মোফাজ্জল হায়দার চৌধুরী লিখেছেন ‘এখনও আমার মনে পড়ে চার-পাঁচ বছর বয়সের কথা। দ্বিপ্রহরের অবসর সময় মা আমায় শুইয়ে রাখতেন, বাইরে যেন দুষ্টুমি করতে যেতে না পারি। ঘরের বারান্দায় চিত্ হয়ে শুয়ে শুয়ে চেয়ে থাকতুম আকাশের দিকে। নীল স্বচ্ছ আকাশের উপর দিয়ে সাদা-সাদা মেঘ ভেসে চলে যেত। আমার মনে হত এরাও এক প্রাণী, কিংবা বুঝিবা মেঘরাজ্যের শিশু।…নির্জন দুপুরের শান্ত আকাশের সেই অলস মেঘগুলির সঙ্গে সঙ্গে আমার ক্ষুদ্র শিশু চিত্তখানিও উড়ে চলে যেত কোন সুদূরে যেন পাড়ি দিতে। ঘুমতে ঘুমতে স্বপ্ন দেখতাম, আমি সে মেঘের রাজ্যে পেঁৗছে গেছি। সেখানে বেগুনী, নীল আর গোলাপী রঙের কী অপূর্ব সমারোহ। হঠাত্ ঘুম টুটে গিয়ে মনে হত, এই আকাশ এই মেঘ- এই সমস্ত বাইরেরটাই বুঝি স্বপ্ন। বহুদূর থেকে শুনলাম চিলের দীর্ঘ বাঁশীর মতো ডাক, তাতে মনে হত অজানা দূরের হয়তো বা সেই স্বপ্নলোকের বাঁশী।’
মোফাজ্জল হায়দার চৌধুরীর এই বর্ণনায় তাঁর সংবেদনশীল ও কল্পনাপ্রবণ মনের পরিচয় খুব স্পষ্ট। এই সংবেদনশীল ও কল্পনাপ্রবণ মন বারবার বাস্তবের কঠিন আঘাতে ক্ষতবিক্ষত হয়েছে। শৈশবে বাবাকে হারিয়ে দারুণ কষ্টের মধ্য দিয়ে বেড়ে উঠতে হয়েছে তাঁকে। স্বামীর মৃত্যুর পর পাঁচ সন্তানকে মানুষ করার দায়িত্ব পড়ে মা মাহফুজা খাতুনের ওপর। এর সাথে যোগ হয় পারিবারিক সম্পত্তি নিয়ে উত্তরাধিকারীদের লড়াই। এসব ক্ষেত্রে মাকে বিভিন্নভাবে সহায়তা করেছেন তিনি। ঢাকায় উচ্চ মাধ্যমিক বা কলকাতায় স্নাতক ও স্নাতকোত্তর পড়ার সময় বারবার পারিবারিক বিভিন্ন সমস্যার কারণে তাঁকে ছুটে যেতে হয়েছে নোয়াখালীর খালিশপুরে। ছোট ভাই ও বোনদের লেখাপড়া ও অন্যান্য সহযোগিতার দায়িত্বও তাঁকেই নিতে হয়েছে।
দুঃখ-কষ্ট, অনাদর ও পারিবারিক নানা সমস্যা ও জটিলতার মধ্যেও অবিচল থেকেছেন তিনি। লেখাপড়ায় ছেদ পড়তে দেননি কিছুতেই। আপ্রাণ চেষ্টা করেছেন ভালো করার। ভালো করেছেনও। লেখাপড়ার পাশাপাশি চর্চা করেছেন সাহিত্য। শৈশবের সেই ভাবুক মনটিকে তিনি বাস্তবের কঠিন কষাঘাত থেকে আগলে রেখেছেন। জীবনের জটিল অভিজ্ঞতা আর মনের সংবেদনশীলতায় মোফাজ্জল হায়দার চৌধুরী হয়ে উঠেছেন সৃষ্টিশীল, মননশীল ও যুক্তিনিষ্ঠ এক সাহিত্যিক। রচনা করেছেন গান, কবিতা, গল্প ও উপন্যাস। রচনা করেছেন যুক্তিনিষ্ঠ সব প্রবন্ধ। দূরদর্শী চিন্তা করেছেন দেশ ও জাতিকে নিয়ে।
শৈশবে নোয়াখালীর বিভিন্ন স্কুলে পড়লেও মোফাজ্জল হায়দার চৌধুরীর স্কুল জীবনের শেষ চার বছর কেটেছে নোয়াখালী আহমদিয়া হাই ইংলিশ স্কুলে। এই স্কুলে থেকেই কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে ১৯৪২ সালের মাধ্যমিক পরীক্ষায় তিনি প্রথম বিভাগে চতুর্থ স্থান লাভ করেন। ১৯৪৪ সালে ঢাকা ইন্টারমিডিয়েট কলেজ থেকে ঢাকার ‘বোর্ড অব ইন্টারমিডিয়েট অ্যান্ড সেকেন্ডারি এডুকেশন’-এর উচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষায় প্রথম বিভাগে প্রথম স্থান অধিকার করেন তিনি। ১৯৪৪ সালে কলকাতার প্রেসিডেন্সি কলেজে ইংরেজি অনার্স (স্নাতক সম্মান) ক্লাসে ভর্তি হন। অল্পদিনের মধ্যেই কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের পাঠ্যসূচি অনুসারে শান্তিনিকেতনের শিক্ষাভবনে বাংলা অনার্স পড়ার সুযোগ পান। ১৯৪৬ সালে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের স্নাতক সম্মান পরীক্ষায় প্রথম শ্রেণীতে প্রথম হন। ১৯৫৮ সালে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের শতবার্ষিকীতে বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা স্নাতক সম্মান পরীক্ষায় ওই বছর পর্যন্ত সর্বোচ্চ নম্বর পাওয়ার স্বীকৃতি হিসেবে তাঁকে ‘স্যার আশুতোষ’ স্বর্ণপদক প্রদান করা হয়। ১৯৪৬-৪৭ শিক্ষাবর্ষে মোফাজ্জল হায়দার চৌধুরী কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে বাংলায় এম.এ. ক্লাসে অধ্যায়ন করেন। দাঙ্গা পরিস্থিতির কারণে তিনি আবার শান্তিনিকেতনে ফিরে যান। ১৯৪৮ সালে শান্তিনিকেতনের লোকশিক্ষা সংসদের ‘সাহিত্য ভারতী’ পরীক্ষায় তিনি প্রথম শ্রেণীতে দ্বিতীয় হন। এ সময় তিনি অধ্যাপক প্রবোধ চন্দ্র সেনের তত্ত্বাবধানে রবীন্দ্র সাহিত্যে গবেষণা করছিলেন। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের অনুমোদন না থাকায় শান্তিনিকেতনের ‘সাহিত্য ভারতী’ উপাধি এম.এ. ডিগ্রির সমমানের ছিল না।
১৯৪৯ সালে মোফাজ্জল হায়দার চৌধুরী তত্কালীন রেডিও পাকিস্তানের ঢাকা কেন্দ্রে ‘স্ক্রিপ্ট রাইটার’ হিসেবে যোগ দেন। ১৯৫১ সালে তিনি জগন্নাথ কলেজে বাংলা বিভাগে প্রভাষক হিসেবে যোগ দেন। পরে সেন্ট গ্রেগরিজ কলেজে (পরবর্তী নাম নটরডেম কলেজ) খণ্ডকালীন প্রভাষক হিসেবেও তিনি কাজ করেন। ১৯৫৩ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের এম.এ. প্রথম ও শেষ পর্ব পরীক্ষায় অংশ নেন তিনি। এই দুটি পরীক্ষায় তিনি প্রথম পর্বে দ্বিতীয় শ্রেণীতে প্রথম এবং শেষ পর্বে প্রথম শ্রেণীতে প্রথম হন। ১৯৫৫ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের অধ্যাপক হিসেবে যোগ দেন। ১৯৫৭ সালে ব্রিটিশ কাউন্সিলের বৃত্তি নিয়ে লন্ডনে যান। লন্ডন বিশ্ববিদ্যালয়ের স্কুল অব অরিয়েন্টাল অ্যান্ড আফ্রিকান স্টাডিজে দু’বছর অধ্যায়ন ও গবেষণা করেন। ১৯৭০ সালে কেন্দ্রীয় বাংলা উন্নয়ন বোর্ড রবীন্দ্র সাহিত্যের আলোচনায় বিশেষ অবদানের জন্য তাঁকে অভিনন্দিত করে। ওই বছরই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগে সহযোগী অধ্যাপক পদে উন্নীত হন তিনি।
‘শান্তিনিকেতনের প্রাক্তন ছাত্র ও রবীন্দ্রনাথের পরিবেষ্টনীর মধ্যে দীর্ঘকাল পালিত’ হওয়ায় শান্তিনিকেতন ও রবীন্দ্রনাথ মোফাজ্জল হায়দার চৌধুরীকে বিভিন্নভাবে প্রভাবিত করেছিল। তাঁর প্রথম উল্লেখযোগ্য গ্রন্থও তাই রবীন্দ্রনাথকেই নিয়েই। রবীন্দ্রনাথকে তিনি যেভাবে উপলব্ধি করেছেন তা তুলে ধরেছেন ‘রবি পরিক্রমা’ গ্রন্থে। এ প্রসঙ্গে তিনি বইটির নিবেদন অংশে বলেছেন, ‘অন্য লোকরা কী বলেন, তার সার সংকলন করে আমার লাভ কী? তাতে আমার বক্তব্যের কিছু মর্যাদা বা গুরুত্ব বাড়ে বলে তো আমার মনে হয় না।’ নিতান্ত অধ্যাপকের মতো অ্যাকাডেমিক প্রবন্ধ তিনি লেখেননি। তিনি লিখেছেন প্রাণসঞ্চারী লেখা। অন্য অনেকের মতো কিশোর বয়সে পদ্যচর্চা দিয়েই সাহিত্যচর্চা শুরু করেছিলেন মোফাজ্জল হায়দার চৌধুরী। তা সত্ত্বেও কবিতা, গল্প, উপন্যাস বা নাটক রচনা তাঁর মুখ্য ছিল না। তাঁর মুখ্য ছিল বাংলা ভাষা, বাংলার মানুষ, বাংলার ঐতিহ্য, বাঙালির উন্নতি। সেজন্য গল্প, কবিতা, নাটকের আশ্রয়ে নয়, সরাসরি ভাব ও বক্তব্য প্রকাশের মাধ্যম প্রবন্ধকেই বেছে নিয়েছিলেন তিনি।
ষাটের দশকে তত্কালীন পাকিস্তান সরকারের প্রত্যক্ষ সহযোগিতায় বাংলা সাহিত্যকে পাকিস্তানি করণের একটা চেষ্টা তীব্র হয়ে উঠেছিল। বাংলা ভাষা ও সাহিত্য থেকে হিন্দু লেখকদের অবদান বাদ দেওয়ার মতো সংকীর্ণ ও সাম্প্রদায়িক মানসিকতার বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়েছিলেন মোফাজ্জল হায়দার চৌধুরী। বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের সামগ্রিক ঐতিহ্য রক্ষায় তিনি লেখায় ও বক্তৃতায় ছিলেন তত্পর। কলম ধরে ছিলেন বাঙালি ও বাংলার মূল স্রোতের অনুকূলে।
মোফাজ্জল হায়দার চৌধুরী ছিলেন বিশ্লেষক। বাংলা ভাষা, সংস্কৃতি, সাহিত্য, সমাজ, রাজনীতি ও শিক্ষা বিষয়ে বিভিন্ন বিশ্লেষণী প্রবন্ধের মাধ্যমে বাঙালি জাতিকে সামনে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করেছেন তিনি।
ধর্মীয় গোঁড়ামি ও সাম্প্রদায়িকতা যখন মাথাচাড়া দিয়ে উঠেছে তখন মোফাজ্জল হায়দার চৌধুরী জাতিকে দিক নির্দেশনা দেয়ার লক্ষ্যে বলেছেন, ‘আজকালকার সংঘাত ধনী আর নির্ধনে, দ্বীনদার আর বেদ্বীনে নয়।’
রাষ্ট্র ও রাজনীতিকরা যখন ধর্মকে ব্যবহার করে রাজনৈতিক ফায়দা হাসিলের চেষ্টা নিয়েছে তখনই জাতিকে সচেতন করে দিতে মোফাজ্জল হায়দার চৌধুরী বলেছেন, ‘আমরা আধুনিক যুগের, বিংশ শতাব্দীর নাগরিক। আমরা আমাদের রাষ্ট্রকে দেখতে চাই আধুনিক রাষ্ট্ররূপে। ইসলামী রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার ভাঁওতা দিয়ে আমাদের কেউ আধুনিক রাষ্ট্রের সুযোগ-সুবিধা ও অধিকার থেকে বঞ্চিত করবে এ আমরা সহ্য করব কেন?’
তত্কালীন পূর্ব পাকিস্তানের শিক্ষা ব্যবস্থার সংকট সমাধানের উপায় তিনি খুঁজে বের করার চেষ্টা করেছেন। তিনি দেখেছেন, আমাদের শিক্ষা ব্যবস্থার ত্রুটির কারণে শিক্ষার্থীদের শুধু বুদ্ধিবৃত্তির চর্চাই হয়, তার মনে যে অন্যান্য সুকুমার বৃত্তি থাকে সেগুলোর বিকাশ হয় না। এজন্য শিক্ষার্থী পূর্ণাঙ্গ মানুষ হয়ে ওঠে না। তিনি প্রতিটি শিক্ষার্থীর জীবনকে পরিপূর্ণ করে তোলার জন্য তাঁর বুদ্ধিবৃত্তির পাশাপাশি অন্যান্য সুকুমার বৃত্তিগুলোর চর্চার সুযোগ শিক্ষা ব্যবস্থায় রাখার ব্যাপারে পরামর্শ দিয়েছেন। চার-পাঁচটি ভাষা শেখার ব্যর্থ চেষ্টা থেকে শিক্ষার্থীদের রেহাই দেয়ার পরামর্শ দিয়ে তিনি শিক্ষার সকল স্তরে মাতৃভাষা চালু করার কথা বলেছেন।
শহীদ মোফাজ্জল হায়দার চৌধুরী তাঁর সময়ে দেশ ও জাতি যাতে বিভিন্ন সংকট ও সংশয় কাটিয়ে নিজস্ব শক্তি ও স্বভাবের জোরে এগিয়ে যেতে পারে সেজন্য পথ খুঁজেছেন। লিখেছেন বিভিন্ন বিষয়ে দিকনির্দেশনামূলক প্রবন্ধ। আজকের সময়ে এসেও তাঁর সেসব রচনার প্রয়োজনীয়তা একটুও কমেনি। এখনও তাঁর লেখা আমাদের নতুন প্রজন্মকে দিকনির্দেশনা দিতে পারে।
বাংলাদেশ ও বাঙালি জাতির ভবিষ্যত্ নির্মাণের লক্ষ্যে চিন্তা, লেখা, বক্তৃতা দেয়া ছাড়াও মুক্তিযোদ্ধাদের সক্রিয়ভাবে সহযোগিতা দিয়েছেন তিনি। এ কারণেই পাকিস্তানি হানাদারদের দোসর রাজাকার, আলবদররা তাঁকে ধরে নিয়ে যায়। আর খুঁজে পাওয়া যায়নি। এমনকি রায়েরবাজার বধ্যভূমিতেও তাঁর মৃতদেহ পাওয়া যায়নি।
সংক্ষিপ্ত পরিচিতি
জন্ম ও বংশ পরিচয়
বাংলা ভাষার উল্লেখযোগ্য শিক্ষাবিদ, প্রাবন্ধিক ও গবেষক শহীদ মোফাজ্জল হায়দার চৌধুরীর জন্ম ১৯২৬ সালের ২২ জুলাই নোয়াখালীর বেগমগঞ্জ থানার খালিশপুর গ্রামে। বাবা বজলুর রহিম চৌধুরী ও মা মাহফুজা খাতুন। এই দম্পতির পাঁচ সন্তান। মোফাজ্জল হায়দার চৌধুরীর বাবা ছিলেন সেকালের ম্যাট্রিকুলেট। মাত্র নয় বছর বয়সেই তিনি তাঁর সাহিত্যরসিক বাবাকে হারান।
শিক্ষা
মোফাজ্জল হায়দার চৌধুরী ১৯৪২ সালে নোয়াখালীর আহমদিয়া হাই ইংলিশ স্কুল থেকে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে অনুষ্ঠিত মাধ্যমিক পরীক্ষায় প্রথম বিভাগে চতুর্থ স্থান অধিকার করেন। এরপর ঢাকা ইন্টারমিডিয়েট কলেজ থেকে ১৯৪৪ সালে বোর্ড অব ইন্টারমিডিয়েট অ্যান্ড সেকেন্ডারি এডুকেশনের অধীনে অনুষ্ঠিত উচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষায় প্রথম বিভাগে প্রথম স্থান লাভ করেন। ভর্তি হন শান্তিনিকেতনে। শান্তিনিকেতনের শিক্ষার্থী হিসেবে ১৯৪৬ সালে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে স্নাতক সম্মান পরীক্ষায় প্রথম শ্রেণীতে প্রথম হন। এই কৃতিত্বের জন্য কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় তাঁকে স্বর্ণপদক প্রদান করে। ১৯৫৩ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে প্রথম শ্রেণীতে প্রথম হয়ে স্নাতকোত্তর ডিগ্রী লাভ করেন। ১৯৫৭ সালে লন্ডন বিশ্ববিদ্যালয়ের স্কুল অব অরিয়েন্টাল অ্যান্ড আফ্রিকান স্টাডিজে দু’বছর ভাষাতত্ত্ব অধ্যায়ন ও গবেষণা করেন।
পেশা
মোফাজ্জল হায়দার চৌধুরীর পেশাগত জীবন শুরু হয় রেডিও পাকিস্তানের ঢাকা কেন্দ্রে। এখানে তিনি ১৯৪৯ সালে ‘স্ক্রিপ রাইটার’ হিসেবে যোগ দেন। ১৯৫১ সালে জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগে প্রভাষক হিসেবে যোগ দেন তিনি। ১৯৫৫ সালে তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগে অধ্যাপনায় যোগ দেন। ১৯৭০ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে বাংলা বিভাগে রিডার পদে উন্নীত হন।
পরিবার
১৯৫৬ সালে মোফাজ্জল হায়দার চৌধুরী বিয়ে করেন সৈয়দা তাহমিনা মনোয়ারা নুরুন্নাহারকে। তাঁদের দুই পুত্র তাসনিম সুমন হায়দার চৌধুরী ও তানভীর শোভন হায়দার চৌধুরী।
গ্রন্থ
বাংলা একাডেমী থেকে ১৯৭৮ সালে মোহাম্মদ মনিরুজ্জামানের সংকলন ও সম্পাদনায় প্রকাশিত হয় ‘মোফাজ্জল হায়দার চৌধুরী রচনাবলী’ প্রথম খণ্ড। রচনাবলির দ্বিতীয় খণ্ড প্রকাশিত হয় ১৯৮২ সালে। মোফাজ্জল হায়দার চৌধুরীর লেখা উল্লেখযোগ্য গ্রন্থ ‘বাংলা বানান ও লিপি সংস্কার’ (১৩৬৮), ‘রবি পরিক্রমা’ (১৯৬৩), ‘রঙিন আখর’ (১৩৭০), ‘কলোকোয়াল বেঙ্গলী’ (১৯৬৩), ‘সাহিত্যের নবরূপায়ন’ (১৩৭৬)।
মৃত্যু
১৯৭১ সালের ১৪ ডিসেম্বর পাকিস্তানি হানাদারদের দোসর আলবদররা মোফাজ্জল হায়দার চৌধুরীকে ধরে নিয়ে যায়। এরপর তাঁর আর কোনো খবর পাওয়া যায়নি। আলবদররাই তাঁকে হত্যা করে। ঢাকার মিরপুরের বধ্যভূমিতে তাঁর জীবনের করুণ পরিসমাপ্তি ঘটে।
কৃতজ্ঞতা
এই লেখাটির জন্য ব্যক্তিগতভাবে সহযোগিতা করেছেন শহীদ অধ্যাপক মোফাজ্জল হায়দার চৌধুরীর পুত্র তানভীর হায়দার চৌধুরী। এছাড়া মোহাম্মদ মনিরুজ্জামানের সম্পাদনায় বাংলা একাডেমী থেকে প্রকাশিত ‘মোফাজ্জল হায়দার চৌধুরী রচনাবলী’ (প্রথম ও দ্বিতীয় খণ্ড, ১৯৭৮ ও ১৯৮২) বিশেষ সহায়ক হয়েছে। সহায়ক হয়েছে সময় প্রকাশনের ১৯৯১ সালে প্রকাশিত আমীরুল ইসলাম ও আসলাম সানী সম্পাদিত ‘আমার বাবা: শহীদ বুদ্ধিজীবীর সন্তানদের স্মৃতিকথা’, বাংলা একাডেমী থেকে রশিদ হায়দারের সম্পাদনায় প্রকাশিত ‘স্মৃতি: ১৯৭১’ ও ‘শহীদ বুদ্ধিজীবী কোষগ্রন্থ’ এবং বাংলা একাডেমীর ‘শহীদ বুদ্ধিজীবী স্মারকগ্রন্থ’।
লেখক : ষড়ৈশ্বর্য মুহম্মদ