১৯৫২ সালের ২৬ ফেব্রুয়ারী জননিরাপত্তা আইনে তাঁকে গ্রেফতার করা হয়। তিনি কারাগারের যে কক্ষে বন্দি ছিলেন সেখানে অন্য রাজবন্দিদের মধ্যে ছিলেন মোজাফ্ফর আহমদ, অলি আহাদ, মোহাম্মদ তোয়াহা, অজিত গুহ, মওলানা আব্দুর রশীদ তর্কবাগীশ ও শেখ মুজিবুর রহমান আর অন্য কক্ষে ছিলেন রণেশ দাশগুপ্ত সহ ষাট-সত্তর জন কমিউনিস্ট। দেখতে দেখতে একবছর গড়িয়ে ১৯৫৩ সাল এল। কমিউনিস্ট বন্দিরা জেলে ২১শে ফেব্রুয়ারি পালন করতে চাইলেন। রণেশ দাশগুপ্ত তাঁর পূর্বপরিচিত এবং রাজনৈতিক অঙ্গনের সহকর্মী ছিলেন। তাই সবাই রণেশ দাশগুপ্তকে ধরলেন তাঁকে অনুরোধ করতে, তিনি যেন ২১শে ফেব্রুয়ারী উপলক্ষে একটা নাটক লিখে দেন। রণেশ দাশগুপ্ত তাঁর কাছে গোপনে চিঠি পাঠালেন, জেলখানায় করার মতো একটি নাটক লিখে দেয়ার জন্য। নারী চরিত্র থাকলেও পুরুষ যেন তা করতে পারে সেভাবে। রণেশ দাশগুপ্ত তাঁকে জানালেন রাত ১০টার পর আলো নিভে গেলে নাটকটি মঞ্চস্থ হবে। তিনি নারী চরিত্র ছাড়াই জেলখানার মধ্যে বসেই রচনা করলেন একটি নাটক। যেসব ছাত্রবন্দী রাতে হারিকেন জ্বালিয়ে লেখাপড়া করে তাদের ৮/১০টি হারিকেনের আলোয় মঞ্চ সাজিয়ে তাঁর লেখা নাটকটি সেদিন মঞ্চস্থ হয়েছিল।
এই নাটকটিই হলো ২১-এর অমর নাটক ‘কবর’। আর এটিই ভাষা আন্দোলনের একমাত্র নাট্য দলিল। রণেশ দাশগুপ্তের অনুরোধে জেলখানায় বসেই যিনি এই নাটকটি লিখেছিলেন তিনি হলেন মুনীর চৌধুরী। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক, প্রবন্ধিক ও নাট্যকার মুনীর চৌধুরী। যাঁকে মায়ের বাড়া গরম ভাত রেখে পাকিস্তানী হায়নাদের দোসর এদেশের রাজাকার, আলবদরদের সাথে চলে যেতে হয়েছে চিরতরের জন্য। মায়ের বাড়া সেই ভাত খেতে আর কোনোদিন ফিরে আসেননি তিনি।
পাকিস্তানের সামরিক প্রশাসক ও বিশ্ববিদ্যালয়ের চ্যান্সেলর লেফটেন্যান্ট জেনারেল টিক্কা খান মুনীর চৌধুরীকে চিঠি পাঠিয়ে সতর্ক করে দিয়েছেন তিনি যেন রাষ্ট্রবিরোধী কোনো কাজে জড়িত না হোন। স্ত্রী লিলি চৌধুরী ও তিন ছেলে ভাষণ, মিশুক, তন্ময়কে নিয়ে তিনি তখন ফুলার রোডে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের স্টাফ কোয়ার্টারে থাকেন। চিঠি পাওয়ার পর সবদিক বিবেচনা করে গিয়ে উঠলেন সেন্ট্রাল রোডের পৈত্রিক বাড়িতে। তার দেড়মাস পরের ঘটনা…
সেন্ট্রাল রোডের দারুল আফিয়া। সকাল এগারোটার দিকে মুনীর চৌধুরী গোসল সেরে ভালো করে গা মোছেননি পর্যন্ত। পিঠ দিয়ে বিন্দু বিন্দু জল গড়িয়ে কোমরের পিছন দিকে লুঙ্গিটা ভিজে যাচ্ছিল। এরই মধ্যে মাকে খাবার দিতে বলেছেন। খেয়েই বেরুবেন কোথাও। তাড়াহুড়া করছেন।
দিনটি ছিল ১৯৭১ সালের ১৪ ডিসেম্বর। দেশ স্বাধীন হওয়ার আর মাত্র আটচল্লিশ ঘণ্টা বাকি। মুক্তিবাহিনী ও মিত্রবাহিনী মিলে পর্যুদস্ত করে দিয়েছে পাক সেনাদের। ইতিমধ্যে সোভিয়েত ইউনিয়ন যুক্তরাষ্ট্রকে বঙ্গোপসাগরের নির্দিষ্ট জল সীমানা অতিক্রম না করার জন্য সাবধান করে দিয়েছে। রাও ফরমান আলী মার্কিন মুল্লুকের কর্ণধারদের সাথে যোগাযোগ করে আরজি জানিয়েছেন, পাক সৈন্যদের বাংলাদেশ থেকে ভালোয় ভালোয় চলে যাবার ব্যবস্থা করে দিলে ওরা নাকি সব ছেড়ে-ছুড়ে দিয়ে চলে যাবে। খবর পাওয়া যাচ্ছিল গত দুই দিন ধরেই – দেশের বিভিন্ন অঞ্চল হানাদারমুক্ত, স্বাধীন। সবার চোখ তখন নতুন এক স্বপ্নে বিভোর। দেশ স্বাধীন হবে। নতুন মানচিত্র, নতুন পতাকা, নতুন দেশ হবে। দেশটির নাম হবে ‘বাংলাদেশ’।
মা ছেলের জন্য ভাত বেড়েছেন। গরম ভাত থেকে ধোঁয়া উড়ছে। চুল না আঁচড়িয়েই খেতে বসতে যাবেন মুনীর চৌধুরী। ঠিক এই সময় একটা জিপ বাসার গেটে এসে থামল। জিপের আরোহীদের সবারই কালো কাপড় দিয়ে মাথা ও মুখ ঢাকা, চোখ দুটো কেবল দেখা যায়, চিনবার কোনো উপায় নেই। কয়েকজন জিপ থেকে নেমে অনুমতির অপেক্ষা ছাড়াই বাসায় ঢুকে সরাসরি তাঁর কাছে গিয়ে একজন বলল, ‘আপনাকে আমাদের সাথে যেতে হবে, আমাদের কমান্ডার আপনাকে যেতে বলেছেন।’ কথা শুনে মুহূর্তেই একটা আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ল পরিবারের সবার মাঝে। মুখঢাকা মানুষগুলোর কথা শুনে মা আগলে দাঁড়ালেন পথ। কিছুতেই যেতে দিবেন না ছেলেকে। ওদের একজন তখন বলল, ‘আপনারা শুধু শুধু ভয় পাচ্ছেন, আমাদের কমান্ডারের সাথে দেখা করে এখুনি তিনি ফিরে আসবেন। আমরাই তো দিয়ে যাব।’ লুঙ্গি ও গেঞ্জি পরা ছিল তাঁর। পাজামা-পাঞ্জাবি পরতে ঘরের ভেতরে যেতে চাইলে সাথে সাথেই মুখঢাকা একজন বলে উঠল, ‘আর কিছুই গায়ে দিতে হবে না স্যার। আপনি কেবল যাবেন আর আসবেন।’ এক মুহূর্ত ভাবলেন তারপর বললেন, ‘ঠিক আছে চলুন।’ বেরিয়ে গেলেন কালো কাপড় দিয়ে মুখঢাকা ওদের সাথে, যারা তাঁকে একেবারে নিয়ে যেতে এসেছিল। পেছনে রেখে গেলেন মায়ের বাড়া গরম ভাত, মা, ভাইবোন, বিশ্ববিদ্যালয়, সহকর্মী, ছাত্রছাত্রী, স্ত্রী আর প্রিয় উত্তরাধিকার। আর ফিরে এলেন না তিনি। খুঁজেও পাওয়া যায়নি মুনীর চৌধুরীকে আর কোনোদিন।
মুনীর চৌধুরী জন্মেছিলেন ১৯২৫ সালের ২৭ নভেম্বর। দিনটি ছিল শুক্রবার। ঢাকা জেলার অন্তর্গত মহকুমা মানিকগঞ্জে। একটি শিক্ষিত সম্বান্ত পরিবার। মাবাবার দ্বিতীয় সন্তান মুনীর। বাবা আব্দুল হালিম চৌধুরী তখন মানিকগঞ্জ মহকুমার এস ডি ও। যদিও তাঁর পৈত্রিক ভিটা নোয়াখালী জেলায় রামগঞ্জ থানার গোপাইরবাগ গ্রামে।
মুনীর চৌধুরীর পিতামহ আব্দুস সোবহান ছিলেন গোপাইরবাগ গ্রামের একজন বিত্তবান কৃষিজীবী। তবে বিত্তের চেয়ে বিদ্যার প্রতি ছিল তাঁর অগাধ টান। ছেলে আব্দুল হালিমকে বংশের মধ্যে সবচেয়ে বেশি শিক্ষিত করেছেন। আব্দুল হালিম চৌধুরী ছিলেন তাঁর বংশের প্রথম ইংরেজি শিক্ষিত ব্যক্তি। প্রতিভা ও যথাযথ অধ্যবসায় দিয়ে তিনি বৃত্তি নিয়ে আলীগড় বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্নাতক ডিগ্রী লাভ করে ডেপুটি ম্যাজিস্ট্রেট হয়ে কর্মজীবন শুরু করেন। বদলির চাকরি ছিল তাঁর। মুনীরের জন্মের সময় পেশাগত কারণেই আব্দুল হালিম চৌধুরী তখন পরিবার নিয়ে মানিকগঞ্জে। আব্দুল হালিম প্রচুর পড়াশোনা করতেন। চাকরি করার কারণে তাঁর ব্যস্ততা থাকলেও নিজের পড়াশুনা ও ছেলেমেয়েদের পড়াশুনার খোঁজখবর নিতে এতটুকু ঘাটতি ছিল না। তাঁর ব্যক্তিগত সংগ্রহে ছিল প্রচুর দেশি-বিদেশি বই। বলতে গেলে মুনীরের জন্মই হয়েছে বইয়ের মাঝে। মুনীর চৌধুরীর বয়স যখন চৌদ্দ তখন বাবা আব্দুল হালিম চৌধুরী তাঁকে সাতাশ খণ্ডের এনসাইক্লোপিডিয়া ব্রিটানিকা এনে দেন।
মুনীর চৌধুরীর মা আফিয়া বেগম। শিক্ষাদীক্ষার দিক থেকে তাঁর মায়ের বংশের ঐতিহ্যও ছিল বেশ উজ্জ্বল। আফিয়া বেগমের বাবা আব্দুস সোবহান ছিলেন কুমিল্লা জেলার বিশিষ্ট আইনজীবী আর মা সৈয়দা সৈয়োদান শিক্ষিত- দৃঢ়চেতা আধুনিক একজন মহিলা। আফিয়া বেগমও প্রচুর বই পড়তেন। আব্দুল হালিম চৌধুরীর সাথে বিয়ে হওয়ার পর সে সুযোগ যেন আরো বেড়ে যায়। আব্দুল হালিম ছেলেমেয়েদের পাশাপাশি স্ত্রীকেও ইংরেজি, অংক পড়াতেন।
মুনীর চৌধুরীসহ তাঁর চৌদ্দজন ভাইবোনদের শিক্ষাদীক্ষার পেছনে বাবার বিশাল ভূমিকা থাকলেও ধৈর্যশীলা, মমতাময়ী এই মা তাঁর সব ছেলেমেয়েদের উচ্চশিক্ষা লাভের পাশাপাশি মানবিক মূল্যবোধ অর্জনের প্রেরণা জুগিয়েছেন। নগরকেন্দ্রিক জীবনযাপন করলেও মুনীর চৌধুরীর বাল্য ও কৈশোর কেটেছে দেশের বিভিন্ন জেলা ও মহকুমা শহরে। অনেকটা গ্রামীণ পরিবেশেও।
তাঁর প্রাতিষ্ঠানিক জ্ঞানচর্চার শুরু বগুড়া থেকে। তারপর পিরোজপুরের সরকারি উচ্চ বিদ্যালয়, আলীগড় বিশ্ববিদ্যালয় ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে। ১৯৩৫ সালে আব্দুল হালীম চৌধুরী পিরোজপুর থেকে ঢাকায় বদলি হয়ে আসেন। আর এখান থেকেই মুনীরের পুরোপুরি শিক্ষাজীবনের শুরু। মুনীরকে ঢাকা কলেজিয়েট স্কুলে ভর্তি করানো হলো। তিন বছর পর মহকুমা হাকিম আব্দুল হালিম চৌধুরীকে আবার ঢাকার বাইরে বদলি করে দেন। কিন্তু এবার তিনি তাঁর সন্তানদের সঙ্গে নিয়ে যাননি। লেখাপড়ার কথা চিন্তা করে ঢাকায় একটি বাড়ি ভাড়া করে তাঁদের থাকার ব্যবস্থা করেন।
১৯৪১ সালে মুনীর চৌধুরী ঢাকা কলেজিয়েট স্কুল থেকেই প্রথম বিভাগে ম্যাট্রিকুলেশন পাশ করেন। বাল্যকাল থেকেই অসাধারণ মেধাবী ছিলেন মুনীর। তবে প্রাতিষ্ঠানিক পড়াশুনায় মনোযোগী তিনি কখনোই ছিলেন না। পাঠ্যবইয়ের ছকবাঁধা পাঠ্যক্রম তাঁকে কখনোই আকর্ষণ করেনি। বাল্যকাল থেকেই ছিলেন প্রচণ্ড দুরন্ত স্বভাবের। কৈশোরে এসে তা আরো বেড়ে যায়। তখনই স্কুল ফাঁকি দেয়া ও স্কুল পালিয়ে সিনেমা দেখায় যথেষ্ঠ অভ্যস্থ হয়ে গিয়েছিলেন। স্কুল জীবনের শেষ দুটি বছর তাঁকে সিনেমার নেশায় পেয়ে বসেছিল। সে সময়ে ঢাকার ব্রিটানিয়া সিনেমা হলে গিয়ে ইংরেজি সিনেমাই বেশি দেখতেন মুনীর।
যে বছর তিনি ম্যাট্রিকুলেশন পাশ করেন সে বছরেই তাঁকে আলীগড় বিশ্ববিদ্যালয়ে আই.এস.সি.-তে ভর্তি করানো হয়। মুনীরের স্বভাবসুলভ চাঞ্চল্য ও ঔদাসিন্যতার দিক বিবেচনা করেই উচ্চাকাঙ্ক্ষী বাবা চিন্তা করলেন, এখান থেকে আই.এস.সি. পাশ করার পর ছেলেকে তিনি ডাক্তারি পড়াবেন। যদিও শেষপর্যন্ত বাবার সে আশা পূর্ণ হয়নি। তবে পারিবারিক বিধিনিষেধ ও শৃঙ্খলা ছেড়ে আলীগড়ে এসে মুনীর জীবনের আর এক নতুন স্বাদ পান। ফলে আরো স্বাধীনচেতা হয়ে ওঠেন মুনীর। নিয়মিত বন্ধুদের সাথে আড্ডা দিচ্ছেন, ঘুরে বেড়াচ্ছেন, ক্লাসের পড়াশুনায় খুব একটা মন নেই। কিন্তু ক্লাসের পড়াশুনায় মন না থাকলেও সে সময় আলীগড় বিশ্ববিদ্যালয়ের বিশাল লাইব্রেরিই হয়ে ওঠে তাঁর বিশ্ববিদ্যালয় জীবনের প্রধান আকর্ষণ। তখনই বিশ্বের বিখ্যাত লেখকদের রচনার সাথে তাঁর ঘনিষ্ঠ যোগাযোগ ঘটে।
বিজ্ঞান নিয়ে পড়তে মুনীরের আগ্রহ একেবারেই ছিল না। তার উপর সিলেবাসের বাইরে পড়াশুনা, নিয়মিত আড্ডা, বন্ধুদের সাথে ঘুরে বেড়ানো, সবকিছু মিলিয়ে ক্লাসের পড়াশুনায় ব্যাপক ঘাটতি পড়ে তাঁর। যে কারণে আই.এস.সি. চূড়ান্ত পরীক্ষায় দুই বিষয়ে পরীক্ষা না দিয়ে তিনি ঢাকায় ফিরে আসেন। ছেলের এমন খেয়ালি সিদ্ধান্তে বাবা আব্দুল হালিম ক্ষুব্ধ ও হতাশ হন। তবে মেধার জোরে দেয়া পরীক্ষাগুলো ভালো হয়েছিল বলেই অপ্রত্যাশিতভাবেই মুনীর ১৯৪৩ সালে আই.এস.সি.-তে দ্বিতীয় বিভাগ নিয়ে পাশ করেন। সে বছরেই নিজের আগ্রহ ও বড় ভাই কবীর চৌধুরীর প্রেরণায় মুনীর চৌধুরী ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ইংরেজি সাহিত্য নিয়ে অনার্স-এ ভর্তি হন।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হওয়ার পর মুনীর চৌধুরীর জীবন কিছুটা অন্যদিকে বাঁক নিল। নতুন পরিবেশ, পরিস্থিতি ও প্রেক্ষাপট, নতুন অভিজ্ঞতা সব মিলিয়ে তাঁর শিক্ষা ও ব্যক্তিজীবন আরো সমৃদ্ধ হওয়ার সুযোগ পেল। প্রতিভাদীপ্ত, তীক্ষ্ণ বুদ্ধিসম্পন্ন তরুণ ছেলেগুলো তাঁকে আকর্ষণ করল। তাঁদের মেধা আর প্রজ্ঞা তাঁকে মুগ্ধ করল। রবিগুহ, দেবপ্রসাদ, মদন বসাক, সরদার ফজলুল করিম প্রত্যেকেই তখন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের এক একটি উজ্জ্বল মুখ।
এখানে এসেও পড়ুয়া হিসেবে মুনীর চৌধুরীর নাম ছিল বেশ। ইংরেজি সাহিত্যের ছাত্র হয়েও কোনোদিন মেকি ভাব ধরেননি বরং আলীগড়ি পোশাক পাল্টে পাজামা-পাঞ্জাবি পরেছেন। সাইকেল চালিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ে এসেছেন। এখানেও সেই একই অবস্থা ক্লাসের পড়াশুনায় মন নেই। তবে শেকসপিয়র, বার্নার্ড শ, চার্লস ডিকেন্স, ভিক্টোর হুগো, টলস্টয় তাঁর পড়া শেষ। এ সময়েই তিনি বামপন্থি রাজনীতির সাথে যুক্ত হয়ে পড়েন। ঢাকা বিশ্ববদ্যালয়ে থাকাকালীন সময়েই মুনীর চৌধুরী সাহিত্যচর্চা, নাট্যকর্ম, রাজনীতি একই সাথে চলিয়ে যান। তখনই রণেশ দাশগুপ্ত, অচ্যুত গোস্বামী, কিরণশঙ্কর সেনগুপ্ত প্রমুখ প্রগতিশীল লেখক ও রাজনীতিকদের সাথে তাঁর সুসম্পর্ক গড়ে ওঠে।
১৯৪৩ সালে তিনি ঢাকার বামপন্থী সংগঠন ‘প্রগতি লেখক ও শিল্পী সংঘ’-এ যোগ দেন। স্বরচিত কবিতা পাঠ ও রাজনৈতিক আলোচনা ছাড়াও এ সংঘের উদ্যোগে ফ্যাসিবাদ ও সাম্প্রদায়িকতাবিরোধী আন্দোলন গড়ে তোলেন তিনি। মুনীর চৌধুরী তখন এই সংঘের সক্রিয় কর্মী। সে সময় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে অনুষ্ঠিত নিখিল বঙ্গ সাহিত্য প্রতিযোগিতায় তিনি সর্বাধিক পুরস্কারও লাভ করেন।
রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক আন্দোলনে খুব বেশি সক্রিয় থাকার কারণে অনার্স ও মাস্টার্স পরীক্ষার ফল তেমন ভালো হয়নি। ১৯৪৬ ও ১৯৪৭ সালে তিনি দ্বিতীয় বিভাগে অনার্স ও মাস্টার্স ডিগ্রী লাভ করেন। কিন্তু পরীক্ষার ফল ভালো না হলেও তাঁর বন্ধু এবং শিক্ষকরা তাঁর মেধা, পড়াশুনা ও জানার প্রশংসা করতেন। এরই মধ্যে উপমহাদেশের আর্থ-সামাজিক ও রাজনৈতিক অবস্থা আমূল পাল্টে গেছে। সাম্প্রদায়িক খড়গ দিয়ে ভাগ করা হয়েছে ভারতকে। জন্ম হয়েছে পাকিস্তান নামের এক নতুন রাষ্ট্রের। পাকিস্তানের আবার দুই ভাগ, পূর্ব পাকিস্তান ও পশ্চিম পাকিস্তান। দীর্ঘ ব্রিটিশ শাসন ও শোষণের পর এ ভূখণ্ডে (পূর্ব পাকিস্তানে) নতুন করে শুরু হয় পশ্চিম পাকিস্তানের শোষণ। ফলে রাজনৈতিক দিক দিয়ে এ অঞ্চলের মানুষ তখনও অধিকার বঞ্চিত, নিপীড়িত।
ষড়যন্ত্র চলছিল উর্দুকে রাষ্ট্রভাষা করার। সে সময় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভাষা ষড়যন্ত্রের বিরুদ্ধে যে প্রথম ছাত্রসভা হয় সেখানে তিনি স্বাধিকার প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে সংগঠনের পক্ষ থেকে বক্তব্য রাখেন। ১৯৪৮ সালে মুনীর চৌধুরী প্রগতি লেখক ও শিল্পী সংঘের সম্পাদক নির্বাচিত হন এবং এই বছরেই তিনি কলকাতায় অনুষ্ঠিত কমিউনিস্ট পার্টির সম্মেলনে যোগ দেন। এ সময় বাবার সাথে তাঁর মতের পার্থক্য ও কিছুটা দ্বন্দ্ব তৈরি হয়। আব্দুল হালিম চৌধুরী সরকারী চাকরি করার কারণেই তাঁর সীমাবদ্ধতা ছিল অনেক। যে কারণে মুনীর চৌধুরী ও তাঁর ছোট বোন নাদেরা বেগমের বামপন্থী রাজনীতিতে সক্রিয় অংশগ্রহণ বাবা আব্দুল হালিম চৌধুরী কোনোভাবেই মেনে নিতে পারেননি। তাছাড়া তাঁর ছেলেমেয়েরা রাজনীতি করুক এটা তিনি কোনো সময়ই চাননি। বাবার আকাঙ্ক্ষা ছিল সুবোধ অন্যান্য ছেলেমেয়েদের মতোই তাঁর ছেলেমেয়েরা কেবল পড়াশুনা করবে শিক্ষিত হবে, মানুষের মতো মানুষ হবে। কিন্তু আব্দুল হালিম চৌধুরী নিষেধ করার পরও যখন দুই ভাই বোনকে রাজনীতি থেকে ফেরাতে পারলেন না তখন তাঁদের লেখাপড়ার খরচ দেয়া তিনি বন্ধ করে দিলেন। এসময় মা আফিয়া বেগম ও বড় ভাই কবীর চৌধুরী তাঁদের নানাভাবেই সহযোগিতা করতেন।
এক পর্যায়ে মুনীর রাজনৈতিক অঙ্গন থেকে আস্তে আস্তে সরে পড়লেন। তখন বাবার সাথে তাঁর সম্পর্কের যতটুকু অবনতি হয়েছিল সেটাও এক সময় স্বাভাবিক হয়ে গেল। তখন তিনি সাহিত্যচর্চায় মনোযোগী হলেন আর প্রচুর পড়াশোনা করতেন। এ সময় মুনীর চৌধুরী মুলত প্রবন্ধই বেশি লিখেছেন। তাঁর প্রধান রচনাগুলো মূলত এ পর্বের।
১৯৪৯ সালে মুনীর চৌধুরী খুলনার দৌলতপুর ব্রজলাল কলেজের ইংরেজির অধ্যাপক হয়ে খুলনায় চলে গেলেন। অধ্যাপনার পাশাপাশি সংসার জীবনও শুরু করলেন এ বছরেই। সংস্কারমুক্ত পরিবারের আধুনিক, শিক্ষিত ও শিল্পী লিলি চৌধুরীকে বিয়ে করলেন। লিলি চৌধুরীর পৈত্রিক বাড়ি টাঙ্গাইল জেলায় হলেও তাঁর জীবনের অধিকাংশ সময় কেটেছে কলকাতায়। লিলি চৌধুরী ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রী ছিলেন। এ সময় মুনীর চৌধুরী রাজনৈতিক তত্পরতার সাথে জড়িত থাকার অভিযোগে কারাবরণ করলেন।
জেল থেকে মুক্ত হওয়ার পর মুনীর চৌধুরী ১৯৫০ সালে ঢাকা জগন্নাথ কলেজের ইংরেজীর শিক্ষক হিসেবে যোগ দেন। জুলাই পর্যন্ত তিনি এ কলেজে ছিলেন। এরপর মুনীর চৌধুরী ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে বাণিজ্য বিভাগের ইংরেজী ও বাংলার খণ্ডকালীন শিক্ষক হিসেবে যোগ দিয়ে ১৯৫১ সাল পর্যন্ত এই বিভাগেই ছিলেন। তারপর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের অনুরোধে ইংরেজী বিভাগের অস্থায়ী শিক্ষক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। এসময় সক্রিয় রাজনীতি থেকে দূরে থাকলেও ছাত্রজীবনে অর্জিত রাজনৈতিক চেতনা থেকে দূরে সরে যাননি তিনি। তখন ভাষা আন্দোলনের প্রেক্ষাপট। মুনীর চৌধুরী ভাষা আন্দোলন ও স্বাধিকার আন্দোলনের একজন সক্রিয় কর্মী। মাতৃভাষা, মাতৃভূমি ও মানবিক অধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য চারদিকেই আন্দোলন তীব্র হয়ে উঠছিল।
মুনীর চৌধুরী তখন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক। কমিউনিস্ট পার্টির প্রত্যক্ষ কার্যক্রম থেকে সরে এলেও অধিকার আদায়ের প্রত্যেকটি আন্দোলনেই তাঁর মৌন ও পরোক্ষ সমর্থন ছিল। ১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারী, মাতৃভাষা রক্ষার দাবিতে ছাত্র-শিক্ষক-জনতার মিছিল শুরু হয়েছে। হঠাত্ শুনতে পেলেন গুলির শব্দ, সাথে সাথেই পাগলের মতো ছুটে গেলেন তিনি। এর পরের দিন অর্থাত্ ২২ ফেব্রুয়ারী ভাষা রক্ষার মিছিলে গুলিবর্ষণ ও হত্যার প্রতিবাদে প্রতিবাদ সভার আহ্বান করা হয়েছিল। মুনীর চৌধুরী ছিলেন এ প্রতিবাদ সভার প্রধান উদ্যোক্তা ও বক্তা। এই ঘটনায় তখনই বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন এবং পাকিস্তান সরকারের বৈরী দৃষ্টিতে পড়লেন তিনি এবং ১৯৫২ সালের ২৬ ফেব্রুয়ারী জননিরাপত্তা আইনে মুনীর চৌধুরীকে আবারও গ্রেপ্তার করা হয়।
কারাগারে থাকা অবস্থাতেই মুনীর চৌধুরী ১৯৫৩ এবং ১৯৫৪ সালে বাংলায় এম.এ. প্রথম পর্ব ও দ্বিতীয় পর্ব পরীক্ষা দিয়ে প্রথম শ্রেণীতে প্রথম স্থান অর্জন করলেন। তিন বছর কারাগারে থাকার পর ১৯৫৫ সালে মুনীর চৌধুরী কারাগার থেকে মুক্তি পান। মুক্ত হয়ে মুনীর চৌধুরী এবার ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে বাংলা বিভাগে অস্থায়ী প্রভাষক হিসেবে যোগ দেন এবং এক বছরের ব্যবধানে স্থায়ী প্রভাষক হিসেবে নিয়োগ লাভ করলেন। স্থায়ী প্রভাষক হিসেবে নিয়োগ পাওয়ার পর মুনীর চৌধুরী সাহিত্য ও নাট্যচর্চায় অনেক বেশি মনোযোগী হয়ে ওঠেন এবং দুই বছর প্রচুর পড়াশুনা করে ১৯৫৮ সালে তিনি যুক্তরাষ্ট্রের হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ভাষাতত্ত্বে এম.এ. করলেন। সে সময়টায় তিনি বিদেশি সাহিত্য, বিশেষ করে নাটকের উপর পড়াশুনার ব্যাপক সুযোগ পান। দেশে ফিরে এসে আবার তিনি শিক্ষকতা শুরু করলেন। এ সময়টায় মুনীর চৌধুরী লেখা ও মঞ্চ নাটক নির্মাণেই বেশি সময় দিয়েছিলেন। বিভিন্ন বিষয়ের উপর প্রবন্ধও লিখেছেন অনেক।
একসময় মুনীর চৌধুরী রবীন্দ্র সাহিত্যের ভাববাদী ও বুর্জোয়া চেতনাকে প্রগতিবিরোধী বলে বিবেচনা করেছিলেন। কিন্তু তা বেশিদিন স্থায়ী হয়নি। পঞ্চাশের দশকের শুরুতেই তিনি আবার রবীন্দ্রবিরোধী চক্রের বিরুদ্ধে বস্তুবাদী সমালোচকের ভূমিকায় বেশ শক্তভাবেই লেখনি ধরেছিলেন। ১৯৬১ সালে ঢাকায় অনেক প্রতিবন্ধকতার মাঝেও রবীন্দ্র জন্ম শতবার্ষিকী উদ্যাপন করলেন। ১৯৬২ সালে মুনীর চৌধুরী প্রভাষক থেকে রিডার পদে উন্নীত হন এবং এই বছরেই নাটকের জন্য বাংলা একাডেমী পুরস্কার লাভ করলেন। ১৯৬৩ সালে তিনি জাপানের টোকিওতে নাট্যসম্মেলনে যোগ দিতে গেলেন এবং ফিরে এসে ঢাকা আর্টস কাউন্সিলের সহসভাপতি হিসেবে দায়িত্ব নিলেন। কিছুদিন পর ‘কৃষ্ণকুমারী’ ও ‘ভ্রান্তিবিলাস’ নাটক প্রযোজনা করলেন। ১৯৬৫ সালে মুনীর চৌধুরী গবেষণা সাহিত্যের জন্যে দাউদ পুরস্কার এবং ১৯৬৬ সালে পাকিস্তান সরকার প্রদত্ত সিতারা-ই-ইমতিয়াজ পুরস্কার লাভ করলেন।
১৯৬৭ সালের জুন মাসে তত্কালীন পাকিস্তানের তথ্য ও বেতার মন্ত্রী খাজা শাহাবুদ্দিন বেতার ও টেলিভিশনে রবীন্দ্র সংগীত প্রচার নিষিদ্ধ করলে মুনীর চৌধুরী এর লিখিত প্রতিবাদ জানান। এছাড়াও তিনি বাংলা ভাষা ও লিপির বিকৃতি কিংবা অপপ্রয়োগের বিরুদ্ধে সতর্ক এবং সচেষ্ট ছিলেন। ১৯৬৮ সালে বাংলা একাডেমীর তত্কালীন পরিচালক ডক্টর কাজী দীন মুহম্মদকে সম্পাদক করে বাংলা ভাষা সংস্কারের জন্য একটি কমিটি গঠন করলেন। কমিটি সরকারি চাহিদা মতো রিপোর্ট পেশ করে। কিন্তু এই কমিটির তিনজন বিশেষজ্ঞ অধ্যক্ষ মুহম্মদ আব্দুল হাই, ডক্টর এনামুল হক ও মুনীর চৌধুরী লিপি সংস্কারের বিরোধিতা করে আরেকটি রিপোর্ট উত্থাপন করলেন। কিন্তু বিশ্ববিদ্যালয় একাডেমিক কাউন্সিল তখন সৈয়দ সাজ্জাদ হোসেনের নেতৃত্বে সংস্কার কমিটির রিপোর্টটি বাস্তবায়ন করার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে। মুনীর চৌধুরী তখন যুক্তিনিষ্ঠভাবে বিভিন্ন পত্র পত্রিকায় প্রতিক্রিয়াশীল সিদ্ধান্তের প্রতিবাদ জানান।
১৯৬৮ সালে মুনীর চৌধুরী যখন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে বাংলা বিভাগের প্রধানের দায়িত্ব পান তখন বাংলার রাজনীতির উত্তাল সময়, ৬৯-এর গণ অভ্যুত্থান। ১৯৭০ সালে তিনি অধ্যাপক পদে পদোন্নতি লাভ করলেন। এ বছরই বাবা আব্দুল হালিম চৌধুরী মারা যান। ‘৭০-এর জাতীয় নির্বাচনে আওয়ামী লীগের সংখ্যাগরিষ্ঠতা লাভের পরও যখন আওয়ামী লীগ রাষ্ট্রক্ষমতা পায়নি তখন স্বাধীনতা যুদ্ধ ছাড়া বাঙালীদের সামনে আর কোনো পথ ছিল না।
১৯৭১ সালে তিনি কলা অনুষদের ডিন, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে ভাষাতত্ত্ব বিষয়ক সেমিনারে যোগ দিয়ে দেশে ফিরলেন। বাংলাদেশ তখন এক জ্বলন্ত আগ্নেয়গিরি। অসহযোগ আন্দোলন চলছে। মুনীর চৌধুরী পাকিস্তান সরকারের দেয়া সিতারা-ই-ইমতিয়াজ খেতাব বর্জন করলেন। চারদিকের অবস্থাটা তখন এমন, যে কোনো সময় কিছু একটা ঘটতে পারে। মুনীর চৌধুরী তা ভালোভাবেই বুঝতে পেরেছিলেন। বুঝতে পেরেছিলেন একটি রক্তক্ষয়ী সংগ্রাম অপরিহার্য। ঘটলও তাই, ঢাকার বুকে নেমে এল ২৫ মার্চের কালো রাত, হাজার হাজার নিরীহ মানুষকে নির্বিচারে হত্যা করা হলো।
২৬ মার্চ ঘোষণা করা হলো স্বাধীনতা। শুরু হলো সাড়ে সাত কোটি মানুষের স্বাধীনতার সংগ্রাম, মুক্তির সংগ্রাম। দীর্ঘ নয় মাসের রক্তক্ষয়ী সংগ্রামের পর কাঙ্ক্ষিত স্বাধীনতা যখন বাঙালীর দোড়গোড়ায়, যখন স্বাধীনতা অর্জনের আর মাত্র ২ দিন বাকি, তখন আরো অনেকের মতো মুনীর চৌধুরীকেও ধরে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল। আর ফিরে আসেননি তিনি। পাকিস্তানী জানোয়ারদের পরিকল্পনা ছিল স্বাধীনতার পরও যেন এ জাতি মাথা তুলে দাঁড়াতে না পারে। এ জাতিকে মেধাশূন্য করাই ছিল পাকিস্তানী নরপশুদের মূল উদ্দেশ্য। কিন্তু মুনীর চৌধুরী তাঁর অসমাপ্ত কর্ম জীবনে যা রেখে গেছেন তা আজো আমাদের আলোর পথ দেখায়।
সংক্ষিপ্ত পরিচিতি : মুনীর চৌধুরী
জন্ম ও শৈশব
মুনীর চৌধুরীর জন্ম ১৯২৫ সালের নভেম্বর মাসে ঢাকার মানিকগঞ্জে। মুনীর চৌধুরীসহ তাঁরা ১৪ জন ভাইবোন ছিলেন। মুনীর চৌধুরীর বাবা আব্দুল আলিম চৌধুরী, মা আফিয়া বেগম।
পড়াশুনা
মুনীর চৌধুরী ১৯৪১ সালে ঢাকা কলেজিয়েট স্কুল থেকে মেট্রিক পাশ করেন। ১৯৪৩ সালে আলীগড় মুসলিম বিশ্ববিদ্যালয় থেকে আই.এস.সি. ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ১৯৬৪ সালে ইংরেজিতে অনার্স ও ১৯৪৭ সালে এম.এ. করেন। নিরাপত্তা বন্দি হিসাবে জেলে থাকা অবস্থাতেই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ১৯৫৩-৫৪ সালে বাংলায় এম.এ. প্রথম পর্ব ও দ্বিতীয় পর্বে পরীক্ষা দেন এবং প্রথম শ্রেণীতে প্রথম স্থান লাভ করেন। ১৯৫৮ সালে হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ভাষাতত্ত্বে ডিগ্রী নেন।
পেশা
অধ্যাপনা করতেন। ১৯৪৯-৫০ ব্রজলাল কলেজের ইংরেজি ও বাংলার অধ্যাপক। ১৯৫০ সালে জগন্নাথ কলেজের অধ্যাপক এবং পরে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ইংরেজী বিভাগে প্রভাষক পদে যোগ দেন। ১৯৫০-৫২, ১৯৫৪-৫৫ খণ্ডকালীন বাণিজ্য বিভাগ এবং বাংলা বিভাগের প্রভাষক। ১৯৫৫-৬২ বাংলা বিভাগের জৈষ্ঠ প্রভাষক, ১৯৬২-৭০ রিডার, ১৯৭০-৭১ বাংলা বিভাগের অধ্যাপক এবং ১৯৬৮-৭১ বাংলা বিভাগের প্রধান। ১৯৭১ সালে তিনি বাংলা বিভাগের ডিন হন। ছাত্র জীবন থেকেই বামপন্থী চিন্তাধারায় উদ্বুদ্ধ ছিলেন। ১৯৪৩ সালে প্রগতিশীল লেখক ও শিল্পী সংঘে যোগ দেন ও ১৯৪৮ সালে সম্পাদক নির্বাচিত হন। ১৯৫২-র ভাষা আন্দোলনসহ পরবর্তী আন্দোলনের সক্রিয় কর্মী ও সমর্থক।
পুরস্কার ও সম্মাননা
১৯৬২ সালে নাটকের জন্য বাংলা একাডেমী পুরস্কার ও গবেষণা সাহিত্যের জন্যে ১৯৬৫ সালে দাউদ পুরস্কার লাভ করেন।
তাঁর প্রকাশিত গ্রন্থ, নাটক
রক্তাক্ত প্রান্তর (১৯৬২), চিঠি (১৯৬৬), কবর (১৯৬৫), দন্ডকারণ্য (১৯৬৫), পলাশী ব্যারাক ও অন্যান্য (১৯৬৯)।
অনুবাদ নাটক
কেউ কিছু বলতে পারে না (১৯৬৭), রূপার কৌটা (১৯৬৯), মুখরা রমণী বশীকরণ (১৯৭০)।
প্রবন্ধগ্রন্থ
ডাইড্রেন ও ডি. এল. রায় (১৯৬৩), মীরমানস (১৯৬৫), তুলনামূলক সমালোচনা (১৯৬৯), বাংলা গদ্যরীতি (১৯৭০)।
তথ্যসূত্র : রশীদ হায়দার সম্পাদিত ‘শহীদ বুদ্ধিজীবি কোষগ্রন্থ’, বাংলা একাডেমী: ঢাকা, ‘আমার বাবা’ নামে লেখা ছেলে আসিফ চৌধুরীর লেখা থেকে, ফেরদৌসি মজুমদারের মুনীর চৌধুরি সম্পর্কে আলোচনা, মুনীর চৌধুরীকে নিয়ে লেখা বড় ভাই কবির চৌধুরীর বিভিন্ন প্রবন্ধ থেকে।
লেখক : পিয়াস প্রান্তিক