১৯৬৯ সালের ১ নভেম্বর মিরপুরে বিহারীদের সাথে পুলিশ বাহিনীর এক সংঘর্ষ হয়। মামুন মাহমুদ তখন পুলিশের এসপি। তিনি নিজেই ঘটনাস্থলে উপস্থিত ছিলেন। বিহারীদের মধ্যে অবস্থান নিয়ে এক অবাঙালী সামরিক অফিসার বিহারীদেরকে ইন্ধন যোগাচ্ছিল মারমুখী হওয়ার জন্য। সেদিন অনেক পুলিশ এই ঘটনায় আহত হয়। এক পর্যায়ে বিহারীরা দুজন পুলিশের সদস্যকে জোর করে তুলে নিয়ে যেতে চায়। মামুন মাহমুদ নিজে গিয়ে তাদের রক্ষা করেন। কিন্তু সে সময় বিহারীদের ইটের আঘাতে তাঁর কপাল ফেটে যায়। স্বাভাবিকভাবেই এসপি সাহেবের কপাল ফাটিয়ে দিয়েছে দেখে রাজারবাগ পুলিশ লাইনের বাঙালী সদস্যরা উত্তেজিত হয়ে পড়ে। তারা অস্ত্রাগার থেকে অস্ত্র নিয়ে এই ঘটনার প্রতিশোধ নিতে চায়। তখন সামনে গিয়ে দাঁড়ালেন মামুন মাহমুদ নিজে। তাঁর এক কথায় সমস্ত পুলিশ লাইন ঠান্ডা হয়ে যায়। তাঁর বক্তব্য ছিল-এখনই শক্তি ক্ষয় নয়, সামনে অনেক সময় আমাদের পাড়ি দিতে হবে। এই ঘটনা পাকিস্তানী শাসকগোষ্ঠীকে হতবাক করে দেয়। তারা বুঝে ফেলেছিল মামুন মাহমুদ সত্যিকার অর্থেই পুলিশ বাহিনীর সদস্যদের ‘নেতা’ হয়ে উঠেছেন।
১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ ক্র্যাকডাউন হবার সময় একটা ব্যাপক হত্যাকাণ্ড ঘটানো হয়। এই হত্যাকাণ্ডে পাকিস্তানীদের প্রধান টার্গেট ছিল যাঁরা যুদ্ধ পরিচালনা করবে তাঁদেরকে সরিয়ে দেওয়া। বিশেষত তাঁদেরকেই যাঁরা বিভিন্ন পেশাভিত্তিক সংগঠনে কাজ করছিলেন। এরই অংশ হিসাবে ২৬ মার্চ হতে ৩০ মার্চ পর্যন্ত ব্যাপক মানুষ গায়েব করে দিয়েছে পাকিস্তানী সামরিক বাহিনী। তারমধ্যে মামুন মাহমুদ একজন। যিনি তখন রাজশাহীর ডিআইজি ছিলেন।
মামুন মাহমুদের জন্ম ১৯২৮ সালের ১৭ নভেম্বর চট্টগ্রামে তাঁর নানার বাড়িতে। বাবা ডা. ওয়াহিদউদ্দিন মাহমুদ এবং মা শামসুন নাহার মাহমুদ। ওয়াহিদউদ্দিন মাহমুদ ছিলেন তত্কালীন কলকাতা মেডিক্যাল কলেজের প্রিন্সিপাল কাম সুপারিনটেন্ডেট। পরিবারটি সাংস্কৃতিক ও রাজনৈতিক দিক থেকে ছিল খুবই অগ্রসর। মামুন মাহমুদের মা তখন থেকেই ছিলেন নারী আন্দোলনের একজন বলিষ্ঠ সংগঠক। মামুন মাহমুদের মামা হাবিবুল্লাহ বাহার ও মা দুজনেই ছিলেন দেশ-বিভাগ-পূর্ব ‘বুলবুল’ পত্রিকার সম্পাদক।
এই পরিবারের সাথে বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল ইসলামের সম্পর্ক ছিল খুবই ঘনিষ্ঠ। মামুন মাহমুদের জন্মের পর নজরুল তাঁকে ‘শিশুর যাদুঘর’ কবিতা দিয়ে আশীর্বাদ করেন। একটি অভিজাত সাংস্কৃতিক পরিমন্ডলের মধ্যেই মামুন মাহমুদের বেড়ে ওঠা। ছেলেবেলা থেকেই তিনি ছিলেন প্রচন্ড মেধাবী। মাত্র সাড়ে পাঁচ বছর বয়সেই রবীন্দ্রনাথকে চিঠি লেখেন। রবীন্দ্রনাথ সে চিঠির জবাবও দিয়েছিলেন। তাঁর সেই চিঠি রবীন্দ্রনাথের মৃত্যুর বছর ১৯৪১ সালে ‘সওগাত’ পত্রিকায় প্রকাশিত হয়। পরিবারে দু’ভায়ের মধ্যে মামুন মাহমুদ বড়।
বাবার চাকরিসূত্রে মামুন মাহমুদের পরিবারকে নানা জায়গায় ঘুরে বেড়াতে হয়েছে। কলকাতায় গিয়ে ওয়হিদউদ্দিন মাহমুদ একটু থিতু হন। বৃটিশ সরকারের চাকরির কারণে বাসা ভাড়া নিয়ে থাকতেন পার্কষ্ট্রীটে। ফলে মামুন মাহমুদের লেখাপড়ার হাতেখড়ি হয় কলকাতার প্যাট মেমোরিয়াল স্কুলে। পরে ভর্তি হন বালিগঞ্জ হাই স্কুলে। সেখান থেকেই ১৯৪২ সালে প্রথম বিভাগে প্রবেশিকা পাশ করেন। ১৯৪৪ সালে কলকাতা প্রেসিডেন্সি কলেজ থেকে আই.এ. এবং ১৯৪৬ সালে আলিগড় বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বি.এ. ডিগ্রী অর্জন করেন। ১৯৪৯ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগ থেকে মাস্টার্স ডিগ্রী লাভ করেন।
মামুন মাহমুদের স্কুল-কলেজ জীবনের সময় বৃটিশবিরোধী আন্দোলন ছিল তুঙ্গে। তিনি নিজে সরাসরি সে আন্দোলনে যুক্ত না হলেও তাঁর বুকে লাগে বৃটিশবিরোধী আন্দোলনের হাওয়া। মামা হাবিবুল্লাহ বাহার তখন পুরোদস্তুর রাজনীতিবিদ। মুসলিম লীগ করেন। বন্ধুদের অনেকেই স্বদেশি। বাবা ওয়াহিদউদ্দিন মাহমুদ যেহেতু ছিলেন বৃটিশ কর্মকর্তা তাই তাঁদের বাড়িটি অনেক স্বদেশির জন্যই ছিল নিরাপদ ও গোপন আশ্রয়। পিতা-মাতার অজান্তেই মামুন তখন অনেক ‘স্বদেশি-বন্ধুকেই’ বাড়িতে আশ্রয় দিতেন।
দু’শ বছরের বৃটিশ শাসনের নিগঢ় থেকে মুক্ত হয়ে ১৯৪৭ সালে ভারতবর্ষ ভাগ হয়ে দুটি স্বাধীন রাষ্ট্রে বিভক্ত হলো। যার মূল ভিত্তিই ছিল দ্বিজাতিতত্ত্ব। তখন অন্য অনেক মুসলিম পরিবারের মতো ওয়াহিদউদ্দিন মাহমুদের পরিবারও কলকাতা বন্দর থেকে জাহাজে চড়ে। পাকিস্তানী পতাকা খচিত সেই জাহাজের যাত্রিরা পাকিস্তান-জিন্দাবাদ বলতে বলতে চট্টগ্রাম বন্দরে এসে ভিড়েন।
ধর্মের ভিত্তিতে ভাগ হওয়া পাকিস্তানের পূর্ব অংশে সংখ্যাগরিষ্ঠ বাঙালীদের বাস। কিন্তু পাকিস্তানের রাজনীতি তখন মূলত নিয়ন্ত্রিত হতো পশ্চিম পাকিস্তান থেকেই। এরমধ্যে ওয়াহিদউদ্দিন মাহমুদ পূর্ব পাকিস্তানের প্রথম সার্জন জেনারেল পদে অধিষ্ঠিত হন। হাবিবুল্লাহ বাহার হন স্বাস্থ্যমন্ত্রী। আর মামুন মাহমুদ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হয়ে বেশ ভালোভাবেই জড়িয়ে পড়েন ঢাকার ক্রীড়া ও নাট্য আন্দোলনের সাথে।
কলকাতায় ছাত্র থাকাকালীন সময়েই ‘স্বদেশি-বন্ধুদের’ প্রভাবে মামুন মাহমুদ রাজনীতির প্রথম পাঠ নিয়ে ফেলেছিলেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হওয়ার পর সেই সুপ্ত প্রবণতাগুলোই নানা মাত্রায় বিকশিত হতে শুরু করে। কলকাতার পরিচিত অনেকেই তখন ঢাকায় স্থায়ী আবাস গড়েছেন। ফলে অনেক বামপন্থী নেতার সাথে তিনিও ঢুকে পড়লেন ছাত্র রাজনীতির ময়দানে। ১৯৪৮ সালেই শরিক হন ভাষা আন্দোলনে। যোগাযোগ গড়ে ওঠে নিষিদ্ধ ঘোষিত তত্কালীন কমিউনিস্ট পার্টির নেতাদের সাথেও।
১৯৪৭ সালের ১২ ডিসেম্বর রাষ্ট্রভাষা প্রশ্নে প্রথম সংঘর্ষ ঘটে পলাশি ব্যারাকে। সেই সংঘর্ষে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজ, মেডিকেল কলেজ ও ব্যারাকে অবস্থিত সাধারণ ছাত্ররা জড়িয়ে পড়ে। অনেকের আশা ছিল পাকিস্তানের নেতা কায়েদে আযম জিন্নাহ বোধ হয় বাঙালীর প্রাণের আকুতি বুঝতে পারবেন। কিন্তু তিনিও যখন উর্দুকেই পাকিস্তানের একমাত্র রাষ্ট্রভাষা করার কথা ঘোষণা করলেন তখন সকলেই হতাশ হলো। ছাত্ররা ভাষার দাবিতে আরো সোচ্চার হয়ে উঠল। ১৯৪৮ সালের ১১ মার্চ রাষ্ট্রভাষা বাংলার দাবিতে ছাত্ররা মিছিল বের করলে আব্দুল গণি রোডে পুলিশ ব্যাপক লাঠিচার্জ করে। সেই মিছিলে মামুন মাহমুদ গুরুতর আহত হন। এসময় নানা রাজনৈতিক কর্মকান্ডে জড়িয়ে পড়ার কারণে পুলিশের খাতায় নাম উঠে যায় তাঁর। ভাগ্নের এহেন কর্মকান্ডের কথা শেষপর্যন্ত হাবিবুল্লাহ বাহারের কানে দেয় পাকিস্তানের শাসক কর্তৃপক্ষ।
বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বেরিয়ে সেন্ট্রাল সুপারিয়র সার্ভিসে পরীক্ষা দিয়ে পুলিশ সার্ভিসে চাকরি জীবন শুরু করেন মামুন মাহমুদ। কিন্তু তাঁর নিজের পছন্দ ছিল ফরেন সার্ভিসে কাজ করার। কর্মজীবনে তিনি কুড়িগ্রাম, ব্রাহ্মণবাড়িয়া, চট্টগ্রাম, পার্বত্য চট্টগ্রাম, ফরিদপুর, খুলনা, ঢাকা, ময়মনসিংহ ও রাজশাহীতে এসডিপি, এসপি এবং ডিআইজি পদে কাজ করেন। একজন দক্ষ, সত্ ও নিষ্ঠাবান কর্মকর্তা হিসাবে মামুন মাহমুদ ছিলেন সর্বত্রই প্রশংসিত।
মামুন মাহমুদ যখন চাকরি জীবনে প্রবেশ করেন তখন এই ভূখন্ডে বাঙালী জাতীয়তাবাদের বীজ ধীরে ধীরে প্রস্ফুটিত হতে শুরু করেছে। যেহেতু তিনি নিজে ছিলেন সেই ধারার একজন বলিষ্ঠ কর্মী সেহেতু তাঁর গোটা চাকরি জীবনেই তিনি তার সুস্পষ্ট প্রমাণ রেখে গেছেন। আর এই মনোবৃত্তির কারণেই বারবার তাঁকে পশ্চিম পাকিস্তানী শাষকগোষ্ঠী ও তার দোসরদের কোপানলে পড়তে হয়েছে। কিন্তু দেশপ্রেম ও ন্যায়-নিষ্ঠার সাথে তিনি কখনোই আপোষ করেননি।
১৯৬২ সালের একটি ঘটনার পর পাকিস্তানী কর্তৃপক্ষের সাথে তাঁর সরাসরি মতবিরোধ শুরু হয়। সেসময় তিনি খুলনার এসপি। পূর্ব পাকিস্তানের মুসলিম লীগের প্রভাবশালী নেতা খান সবুরের এক ঘনিষ্ঠ সহযোগীকে তিনি চোরাকারবারের দায়ে গ্রেফতার করেন। কর্তৃপক্ষের চাপ সত্ত্বেও তিনি সেই চোরাকারবারীকে ছাড়তে অস্বীকার করেন।
পুলিশের চাকরি জীবনে মামুন মাহমুদের উপলব্ধি ছিল কোনো অবস্থাতেই অন্যায়কারী আইনের হাত থেকে যেন রেহাই না পায়, আবার নিরীহ লোকও যেন পুলিশের হাতে অযথা হয়রানির স্বীকার না হয়। বাঙালী জাতীয়তাবাদের প্রতি প্রবল আস্থা, মার্কসবাদের প্রতি অনুরাগ স্বাভাবিকভাবেই তাঁর মধ্যে এদেশের গরীব-মেহনতি মানুষের প্রতি সহানুভূতিশীল হতে সাহায্য করে। সবচেয়ে বড় কথা তিনি গোটা পুলিশ বিভাগের সহকর্মীদেরই মনে করতেন একই পরিবারের সদস্য। তাদেরকে বিপদে ফেলে কখনোই মামুন মাহমুদ পিছু হটতেন না।
তিনি যখন ঢাকা জেলার এসপি ছিলেন তখন অনেক ছাত্রনেতা ও রাজনৈতিক নেতার সাথে তাঁর ঘনিষ্ঠ যোগাযোগ ছিল। যাঁরা গোটা ষাটের দশক জুড়ে উত্তাল গণআন্দোলনে নেতৃত্ব দিচ্ছিলেন। অনেক সময় মামুন মাহমুদ নিজেই উদ্যোগী হয়ে তাঁদের আগাম জানিয়ে দিতেন কোন কোন রাস্তায় গুলি করা হবে। এমনকি তাঁদেরকে শান্তিপূর্ণভাবে মিটিং-মিছিল করার জন্য নানাভাবে সাহায্য-সহযোগিতা করতেন। এজন্য তাঁকে নানাভাবে জবাবদিহিতা করতে হতো পাকিস্তানী কর্তৃপক্ষের কাছে। কিন্তু মামুন মাহমুদ সাফ সাফ জানিয়ে দিতেন ‘কোনো গন্ডগোল না হলে তো আমরা মিছিলকারীদের উপর হামলা চালাতে পারিনা।’ ১৯৭০ সালের ১৭ জানুয়ারি ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের সভায় সরকারী নির্দেশ থাকার পরও গুলি করেননি বলে তাঁকে ২৪ ঘন্টার নোটিশে ঢাকা থেকে ময়মনসিংহে বদলি করে দেওয়া হয়। তথাকথিত আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলার অন্যতম আসামি খান শামসুর রহমানের বিচার চলাকালে, পাকিস্তানী সামরিক বাহিনীর জনৈক অফিসারের প্রশ্নের জবাবে ‘আমার ঘনিষ্ঠ বন্ধু’ বলে অভিহিত করেছিলেন। সে সময়ে সেটি ছিল খুবই সাহসের কাজ।
১৯৬৬ সালে সারা বাংলা ৬ দফা আন্দোলনকে কেন্দ্র করে উত্তপ্ত। বঙ্গবন্ধু শেখ মজিবুর রহমান গেছেন খুলনায় রাজনৈতিক সভা করার জন্য। মামুন মাহমুদের কাছে উপর থেকে নির্দেশ আসে বঙ্গবন্ধুকে গ্রেফতার করার। কিন্তু সরকারের আদেশ সেদিন তিনি পালন করেননি। এ কারণে তাঁকে উপর থেকে চাপ দেওয়া হয়। বঙ্গবন্ধুর সাথে তাঁর সম্পর্ক এতোটাই ঘনিষ্ঠ ছিল যে মামুন তাঁকে সেকথা জানালে তিনি নিজেই মামুন মাহমুদের বাসায় চলে আসেন গ্রেফতার হওয়ার জন্য।
৬ দফা আন্দোলনকে কেন্দ্র করে ১৯৬৬ সালের ৭ জুন সারাদেশে মিছিল-মিটিং-সমাবেশ নিষিদ্ধ করে ১৪৪ ধারা জারি করা হলেও মামুন মাহমুদ কিন্তু খুলনায় ১৪৪ ধারা জারি করার প্রয়োজন বোধ করলেন না। এমনকি সেদিন কাউকে গ্রেফতারও করেননি। সেজন্য তাঁকে লিখিতভাবে পুলিশ প্রধানের দপ্তর থেকে সতর্ক করে দেওয়া হয়েছিল। পাকিস্তানী স্বৈরাচারী সরকারের অন্যায় দমননীতিকে মামুন মাহমুদ কোনোদিনই অন্ধভাবে সমর্থন করতে পারেননি।
মামুন মাহমুদ ১৯৫৪ সালের ২৬ মার্চ মোশফেকা মাহমুদকে বিয়ে করেন। মোশফেকা মাহমুদ ছিলেন সুশিক্ষিতা ও উন্নত সংস্কৃতির মানুষ। নিজে লেখালেখি করতেন। চাকরি জীবনে প্রবেশ না করলেও বাঙালী মধ্যবিত্তের অভিধানে ‘গৃহিণী’ বলে যে শব্দটি আছে তিনি তাও ছিলেন না। বেগম রোকেয়া ছিলেন মোশফেকা মাহমুদের খালা। অন্তহীন সময় তিনি ব্যয় করতেন সাংস্কৃতিক কর্মকান্ড ও সমাজসেবায়। মামুন মাহমুদের একজন নির্ভরযোগ্য বন্ধু হিসাবেই তাঁকে সারাজীবন ছায়া দিয়ে গেছেন। এই দম্পত্তির এক মেয়ে ও এক ছেলে। বড় মেয়ে যেবা মাহমুদ চিকিত্সক। ছেলে জাভেদ মাহমুদ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পাস করে এখন ব্যবসা করছেন। দুজনই পরিবার নিয়ে ঢাকায় বসবাস করেন। মামুন মাহমুদ তাঁর পরিবারের প্রতিটি সদস্যের কাছেই একজন ভালো বন্ধু। তিনি কখনোই সন্তানদের সাথে তথাকথিত পিতৃত্বসুলভ আচরণ করতেন না।
যদিও তিনি খুব ব্যস্ত সময় কাটাতেন তবু সুযোগ পেলেই পরিবার নিয়ে বেরিয়ে পড়তেন বিভিন্ন গ্রাম-জেলা ঘুরে বেড়াতে। বাংলার প্রাচীন ঐতিহ্য নিয়ে তাঁর খুব গর্ববোধ ছিল। আর সেই গর্বে যেন সন্তানেরাও গর্বিত হয় সেই চেষ্টাই তিনি করতেন। দেশের বিভিন্ন ঐতিহাসিক স্থানে তাঁদের নিয়ে যেতেন, তার ইতিহাস শোনাতেন। নিয়ে যেতেন যাত্রা, কবিগান, পুঁথিপাঠের আসর, সার্কাস, বাউল গানের আসরে। ছেলেমেয়েদের মধ্যে এই বোধ জাগিয়ে তোলার চেষ্টা করতেন তাঁরা এদেশের ৭ কোটি মানুষেরই অংশ। সবার স্থান একই কাতারে। বড় মেয়ে যেবা মাহমুদ বাবা সম্পর্কে স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে বলেন, “দেশের রাজনীতি সম্পর্কেও তিনি আমাদের সচেতন থাকতে বলতেন। আজো মনে পড়ে, ১৯৬৯ সালে পুলিশের গুলির বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করে দেশের সব ছাত্র-ছাত্রী কালো ব্যাজ পরলেও, আমি পরতে রাজী হইনি। দুপুরে বাসায় ফিরে বাবা আমাকে প্রশ্ন করলেন, ‘তোমার কালো ব্যাজ কোথায়?’ বললাম, ‘তুমি যেখানে পুলিশ সুপার, তোমার বিরুদ্ধে কেমন করে আমি ব্যাজ পড়তে পারি।’ বাবা হাসতে হাসতে জবাব দিলেন, ‘আমি সরকারী চাকরি করি, কিন্তু তুমি তো জনগণের একজন। তোমাকে তাদের মধ্যে মিশে যেতে হবে, তোমার মতো চিন্তা করতে হবে। বাঙালীর স্বাধীনতার কথা ভাবতে হবে। তুমি আমার মেয়ে এই সময় একথা ভাবা ঠিক হবে না।'”
একজন সরকারী উচ্চপদস্থ অফিসার হয়েও তাঁর সরকারী বাসভবনে ও অফিসে ১৯৭১ সালে মার্চ মাসের প্রথম সপ্তাহ থেকেই কালো পতাকা উত্তোলন করেছিলেন। তাছাড়া ২৫ মার্চের আগের সপ্তাহে গণআন্দোলনের সহায়তা করার প্রচেষ্টায় কয়েকজন রাজনৈতিক নেতা, কর্মী ও বাঙালী কর্মকর্তাদের নিয়ে গোপনে রুদ্ধদ্বার বৈঠকে মিলিত হয়েছেন কয়েকবার। এদের মধ্যে জাতীয় নেতা কামরুজ্জামানও ছিলেন। কিন্তু এসব গোপন মিটিংয়ের কোনো কিছুই গোপন থাকেনি পাকিস্তানী কর্তৃপক্ষের কাছে।
২৫ মার্চ সারাদিনই মামুন মাহমুদ খুব চিন্তিত ছিলেন। পুলিশ বাহিনীকে সর্বোচ্চ সতর্ক থাকতে বলেন। কিন্তু পাকিস্তানী বাহিনীর সাথে যেকোনো সম্মুখ সমর থেকে দূরে থাকার নির্দেশ দেন। রাতে বাসায় ফিরে তিনি স্ত্রীকে বলেন, আজ রাত দুটো তিনটের দিকে সাংঘাতিক কিছু ঘটতে পারে।
এর কিছুক্ষণ পরই রাত দেড়টার দিকে তিন ট্রাক পশ্চিম পাকিস্তানী সৈন্য রাজশাহী পুলিশ লাইন ও উচ্চপদস্থ বাঙালী সরকারী কর্মকর্তাদের বাসভবনগুলো ঘিরে রাখে। সেসময় কেটে দেওয়া হয় টেলিফোন লাইন, নিভিয়ে দেয়া হয় রাস্তার বাতি। ঢাকায় তখন শুরু হয়ে যায় পাকিস্তানী বাহিনীর বর্বর গণহত্যা।
২৬ মার্চ ছিল মামুন মাহমুদ ও মোশফেকা দম্পতির ১৭তম বিবাহবার্ষিকী। অন্য সময় এদিনটি সাধারণত তিনি পরিবারের সদস্যদেরকে নিয়ে আনন্দঘন পরিবেশে কাটান। পরিবার নিয়ে বেড়াতে যান। কিন্তু এবারই প্রথম ব্যতিক্রম হলো। সারাদিন বাসায় বসে রইলেন। ছেলে-মেয়ে-স্ত্রী ও নিজের জন্য যেসব বই উপহার হিসেবে কিনেছিলন সেগুলির মধ্যে নিজে স্বাক্ষর করলেন। বেলা ১১টার দিকে রাজশাহীর এসপিসহ একজন পাকিস্তানী ক্যাপ্টেন আসে তাঁর সাথে দেখা করতে। পাকিস্তানী বাহিনী ২৫ মার্চ রাতেই রাজশাহীর পুলিশ লাইনের ট্রেজারিতে ঢুকতে চেয়েছিল কিন্তু পুলিশ তাদেরকে ঢুকতে দেয়নি। মামুন মাহমুদ পাকিস্তানী ক্যাপ্টেনকে জানালেন, পুলিশ ঠিক কাজই করেছে। কারণ পাসওয়ার্ড ছাড়া কেউ ট্রেজারিতে ঢুকতে পারবে না। তবু ক্যাপ্টেন বারবার ট্রেজারি খুলে দেওয়ার কথা বলেন। এক পর্যায়ে মামুন মাহমুদ উত্তেজিত হয়ে বলেন, ‘তাহলে আমার কাছে এসেছেন কেন? ক্ষমতা এখন আপনাদের হাতে, আপনারাই ব্যবস্থা নেন। আপনারা তো এখন ক্ষমতার জোরে মানুষকে গুলি করেও হত্যা করতে পারেন।’ মামুন মাহমুদের দৃঢ় অবস্থানে ক্যাপ্টেন লজ্জিত হয়ে স্থান ত্যাগ করে।
২৬ মার্চ সন্ধ্যার সময় হানাদার বাহিনীর একজন ক্যাপ্টেন এসে বলে গেল ডিআইজি সাহেবের সাথে রংপুর থেকে ওয়ারলেসে একজন ব্রিগ্রেডিয়ার কথা বলবেন। মামুন মাহমুদ সেদিন সন্ধ্যায় জিপের একজন পাঞ্জাবী চালক ও নিজের দেহরক্ষী নিয়ে বের হয়ে গেলেন। আর ফিরে এলেন না। যে দানবের হাত থেকে তিনি দেশকে রক্ষা করতে চেয়েছিলেন, তাদের গোপন হিংসার আঘাতে কপট রাত্রির আড়ালে চিরতরে হারিয়ে গেলেন মামুন মাহমুদ।
পরিবার থেকে পরদিনই মামুন মাহমুদের খোঁজ করা শুরু হয়। কিন্তু কেউ বলতে পারছে না তিনি কোথায় আছেন। একদিন পর একইভাবে গায়েব করে দেয়া হয় রাজশাহীর এসপি মজিদ সাহেবকে। ডিআইজি ও এসপি সাহেবের গায়েব হওয়ার খবরে পুরো পুলিশ লাইন উত্তেজিত হয়ে পড়ে। তারা পাকিস্তানী বাহিনীর সাথে সংঘর্ষে যেতে চায়। কিন্তু পাকিস্তানী বাহিনী পুলিশকে কথা দেয় ডিআইজি ও এসপি সাহেবকে ফিরিয়ে আনা হবে। আসলে সেটি ছিল পাকিস্তানী সামরিক বাহিনীর কূটচাল। পাকিস্তানী বাহিনীর কথা বিশ্বাস করে পুলিশ লাইনের সকল পুলিশ যখন অস্ত্র রেখে দুপুরের খাবারে বসে তখনই শুরু হয়ে যায় মেশিনগান থেকে বৃষ্টির মতো গুলি আর মর্টার শেল নিক্ষেপ। যাঁরা পুলিশ লাইনে লাইন ধরে ভাত খেতে বসেছিলেন তাঁদের সকলের গুলিবিদ্ধ নিথর দেহ লুটিয়ে পড়ে ভাতের থালায়। এরকম বর্বরতাই সেদিন পাকিস্তানী সামরিক বাহিনী চালিয়েছিল নিরীহ বাঙালীদের উপর।
মামুন মাহমুদ নিখোঁজ হওয়ার ঠিক এক সপ্তাহ পর সামরিক ইন্টিলিজেন্স-এর এক পাঞ্জাবী ক্যাপ্টেন সালমান মাহমুদ এসে এক সেট কাপড় নিয়ে যায় মামুন মাহমুদের জন্য। ২ এপ্রিল মামুন মাহমুদকে ফিরিয়ে দেওয়া হবে বলেও ওয়াদা করেন সেই সামরিক অফিসার। মামুন মাহমুদের পরিবার একটু আশার আলো দেখে। কিন্তু এক মাসেরও বেশি সময় পার হয়ে যাবার পর মামুন মাহমুদের পরিবারকে জানানো হয় তিনি রাজশাহীতে নেই। ঢাকায় মেজর জেনারেল রাও ফরমান আলীর কাছ থেকে যেন খবর নেয়া হয়।
তখন পরিবারের সকলে ঢাকায় চলে আসেন। সাত মাস ধরে রাও ফরমান আলীকে অনেক চিঠি দেওয়া হয়। নভেম্বরের শেষ দিকে একটি ছোট চিরকুট পাঠানো হয় মামুন মাহমুদের পরিবারের কাছে। যাতে লেখা ছিল : It has been checked with all army Hqs. Mr. Mamun mahmood is not under detention with any army authority. Army authority of Rajshahi lost track of him after they were forced to vacate Rajshahi during the week of April 1971 .
শেষ পর্যন্ত স্বাধীনতার পর পরই ভারতীয় জেনারেল অরোরার সহায়তায় মোশফেকা মাহমুদ দেখা করেন রাও ফরমান আলীর সাথে। কিন্তু রাও ফরমান আলী কোনো তথ্যই দিতে চাননি। জেনারেল অরোরা তাকে চাপ দিলে তিনি শুধু একটি কথাই বলেন, ‘আমি কিছু জানি না।’
সংক্ষিপ্ত জীবনী
জন্ম : মামুন মাহমুদের জন্ম ১৯২৮ সালের ১৭ নভেম্বর চট্টগ্রামে তাঁর নানার বাড়িতে। বাবা ডা. ওয়াহিদউদ্দিন মাহমুদ এবং মা শামসুন নাহার মাহমুদ। দু’ভাইয়ের মধ্যে তিনি ছিলেন বড়।
শিক্ষা : মামুন মাহমুদের লেখাপড়ার হাতেখড়ি হয় কলকাতার প্যাট মেমোরিয়াল স্কুলে। পরে ভর্তি হন বালিগঞ্জ হাই স্কুলে। সেখান থেকেই ১৯৪২ সালে প্রথম বিভাগে প্রবেশিকা পাশ করেন। ১৯৪৪ সালে কলকাতা প্রেসিডেন্সি কলেজ থেকে আই.এ. এবং ১৯৪৬ সালে বি.এ. ডিগ্রী অর্জন করেন। ১৯৪৯ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগ থেকে মাস্টার্স ডিগ্রী লাভ করেন। ১৯৪৮ সালে ভাষা আন্দোলনে অংশগ্রহণ করেন।
চাকরি জীবন : সেন্ট্রাল সুপারিয়র সার্ভিসে পরীক্ষা দিয়ে পুলিশ সার্ভিসে চাকরি জীবন শুরু করেন মামুন মাহমুদ। কর্মজীবনে তিনি কুড়িগ্রাম, ব্রাহ্মণবাড়িয়া, চট্টগ্রাম, পার্বত্য চট্টগ্রাম, ফরিদপুর, খুলনা, ঢাকা, ময়মনসিংহ ও রাজশাহীতে এসডিপি, এসপি এবং ডিআইজি পদে কাজ করেন।
পরিবার : মামুন মাহমুদ ১৯৫৪ সালের ২৬ মার্চ মোশফেকা মাহমুদকে বিয়ে করেন। এই দম্পত্তির এক মেয়ে ও এক ছেলে। বড় মেয়ে যেবা মাহমুদ চিকিত্সক। ছেলে জাভেদ মাহমুদ ব্যবসায়ী।
মুক্তিযুদ্ধে অবদান : মুক্তিযুদ্ধ শুরুর অনেক আগে থেকেই পুলিশ বাহিনীর সদস্যদের স্বাধীনতার প্রশ্নে সংগঠিত করেন। তিনি বাঙালী রাজনৈতিক নেতাদের সাথেও নিয়মিত যোগাযোগ রাখতেন।
মৃত্যু : ২৬ মার্চ পাক হানাদার বাহিনী তাঁকে বাড়ি থেকে ডেকে নিয়ে যায় তারপর হত্যা করে।
তথ্যসূত্র:
১. শহীদ বুদ্ধিজীবী কোষগ্রন্থ- বাংলা একাডেমী
২. স্মৃতি: ১৯৭১, প্রথম খন্ড- বাংলা একাডেমী
৩. দীপক- বাংলাদেশ পুলিশ সমবায় সমিতির মাসিক পত্রিকা
৪. ডা. যেবা মাহমুদের (মামুন মাহমুদের কন্যা) সাক্ষাত্কার
লেখক : চন্দন সাহা রায়