স্বাধীনতার জন্য জীবনদান যদি সর্বোচ্চ মূল্য হয় তবে মনে হয় বাঙালী জাতির মত এত বেশী মূল্য বিশ্বের কোন জাতিকে দিতে হয়নি। আমাদেরই বাবা-মা, ভাই-বোন এবং বাংলাদেশের অগণিত শহীদের পবিত্র রক্তের উপর আজ আমরা দাঁড়িয়ে আছি। মানবেতিহাসের নৃশংসতম হত্যাকান্ডের নির্মম শিকার, বাংলাদেশের স্বাধীনতাকামী তিরিশ লাখ শহীদের একজন হলেন আমার বাবা মো. শফিকুল আনোয়ার। জন্ম ফেণী জেলার পূর্ব ছাগলনাইয়া গ্রামে, ৯ই ফেব্রুয়ারী ১৯৩৯ সালে।
বাবা ছিলেন তৎকালীন পাকিস্তান ইন্টারন্যাশনাল এয়ারলাইন্স-এর একজন উর্ধ্বতন প্রকৌশলী। স্বগ্রাম পূর্ব ছাগলনাইয়া এবং কুমিল্লা ভিক্টোরিয়া কলেজ থেকে যথাক্রমে প্রবেশিকা ও উচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষায় পাশ করে ১৯৫৭ সালে শিক্ষানবীশ যন্ত্রকৌশল (এপ্রন্টিস্ মেকানিক) হিসাবে তৎকালীন পি.আই.এ.-তে যোগদান করেন। পাকিস্তান বিমান বাহিনীর করাচীর কৌরঙ্গী ক্রীক-এ অবস্থিত স্কুল অব এ্যারোনটিকস-এ বিমান রক্ষণাবেক্ষণ সম্পর্কে তিন বছরব্যাপী বেসিক কোর্স সম্পন্ন করে আরও এক বৎসর হাতে-কলমে পি.আই.এ.-এর এয়ারলাইন্স ট্রেনিং সেন্টারে বিভিন্ন এয়ারক্রাফ্টের উপর টাইপ ও ট্রেড কোর্স সাফল্যের সাথে সমাপ্ত করেন। অতঃপর ১৯৬১ সনে পাকিস্তান সিভিল এভিয়েশন কর্তৃপক্ষ কর্তৃক এপ্রুভ ইন্সপেক্টর হিসেবে বোয়িং জাহাজের উপর অনুমোদন পান। অতঃপর ১৯৬৩ সনে এয়ার ক্রাফট মেইনটেন্যান্স ইঞ্জিনিয়ারিং লাইসেন্স পরীক্ষায় সাফল্যের সাথে পাশ করে এয়ার ফ্রেম ট্রেডের প্রকৌশলী হিসাবে বোয়িং-এ দায়িত্ব পালন শুরু করেন করাচীতে। ১৯৬৫ সনের প্রথম দিকে তিনি ঢাকায় বদলী হয়ে আসেন। ১৯৭১ সনের মার্চ পর্যন্ত তিনি এখানেই কর্মরত ছিলেন।
আমার বাবা এই বাংলাকে, বাঙলার মানুষকে ভালবেসেছিলেন – এই ছিল তাঁর অপরাধ। গ্রাম বাংলার মানুষের মুক্তি আদায়ের সংগ্রামে তিনি সব সময়ই ছিলেন দৃঢ় সংকল্প। তাই বাঙালী জাতীয়তাবাদ, স্বাধিকার তথা আমাদের সর্বশেষ মুক্তি সংগ্রামে তিনি ছিলেন অগ্রভাগে। সারাদেশে যখন অসহযোগ আন্দোলন শুরু হয় – তখন পি.আই.এ.-র বাঙালী কর্মচারীরাও সেই আন্দোলনের সাথে পূর্ণ একাত্মতা ঘোষণা করে। তাদের বিভিন্ন মিছিল-মিটিং ইত্যাদি কর্মকান্ডের পুরোভাগের একজন ছিলেন আমার বাবা। অসহযোগ আন্দোলনে যোগদানের পর সরকার কর্তৃক বারবার চাকুরীতে ফিরে যাওয়ার ঘোষণা দেয়া সত্ত্বেও তিনি আর নিজ চাকুরীতে ফিরে যাননি। ২৫শে মার্চের পর তিনি গ্রামে চলে যান। তারপর যখন শুরু হলো গ্রাম থেকে গ্রামান্তরে পাক বাহিনীর নির্মম অত্যাচার, বর্বর পাষন্ডরা যখন লক্ষ লক্ষ মানুষকে নির্বিচারে হত্যা করছিল – গ্রামের পর গ্রাম জ্বালিয়ে পুড়িয়ে ছারখার করে দিচ্ছিল, তখনকার সেই ভয়ঙ্কর দিনগুলোতে তিনি এক গ্রাম ছেড়ে আরেক গ্রামে পালিয়ে বেড়ান। কিন্তু সেই পালিয়ে থাকার মাঝেও তিনি মুক্তির বাণী প্রচার করে গেছেন ঘরে ঘরে। গ্রামের উৎসাহী যুবকদের অনুপ্রাণিত করেছিলেন মুক্তিবাহিনীতে যোগ দিয়ে হানাদার দস্যুদের প্রত্যক্ষ মোকাবেলা করার জন্য! গ্রামের মানুষদের প্রস্তুত করে তুলেছিলেন প্রতিরোধ যুদ্ধের জন্য। তাই আজও গ্রামের মানুষরা ভুলতে পারে না আমার বাবার মত একজন দেশপ্রেমিককে।
১৯৭১ সানের ২৮শে অক্টোবর, বৃহস্পতিবার। সেদিন ছিল পবিত্র রমজান মাসের ৭ তারিখ। গোপন সূত্রে খবর ছিল লেমুসা বাজারে মুক্তিযোদ্ধাদের একটি ছদ্মবেশী দল খবর সংগ্রহের জন্য আসতে পারে। জোহরের নামাজের পর বাবা বাজারের দিকে রওয়ানা হন। তাঁর উদ্দেশ্য ছিল যুদ্ধের সংবাদ নেওয়া। সেদিন আবার ছিল হাটবার। হাটে প্রচুর লোক সমাগম হয়েছিল। হঠাৎ আছরের সময় এই ভীড়ের মধ্যে নিরীহ জনসাধারণের উপর পাকিস্তানীদের দোসর ঘৃণ্য রাজাকারেরা শুরু করে প্রচন্ড গুলিবর্ষণ কোনরূপ হুশিয়ারী ছাড়াই। হত-বিহ্বল মানুষ প্রাণভয়ে ছুটাছুটি শুরু করে। সবাই আতঙ্কগ্রস্ত। সাথে সাথে লুটিয়ে পড়ল কিছু তাজা প্রাণ। আর এ সময় বাজারের নিকটস্থ কালিদহ ক্যাম্প থেকে আরও পাকসেনা এসে রাজাকারদের সাথে যোগ দেয়। আতঙ্কিত মানুষদের হাহাকার আর্তচিৎকারের মধ্যে বাবা ছুটে গিয়েছিলেন বাজারের শেষ প্রান্তে। সম্ভবত এখানে কোথাও মুক্তিযোদ্ধা দলটির থাকার কথা ছিল।
ফেণী ট্রাঙ্করোড ও খদ্দর-রোডের সংযোগস্থল, বর্তমানে এশিয়ান হাইওয়ে – এখানেই রাজাকাররা তাঁকে লক্ষ্য করে গুলি করে হত্যা করে। সেদিন রাতে কারফিউ জারি করে দেয়ায় – কেউ আর তাঁর খোঁজে বাড়ী থেকে যেতে পারেনি। পরদিন শুক্রবার খুব ভোরে রাস্তার পাশে ধান ক্ষেতে মাথার পিছন দিকে গুলিবিদ্ধ অবস্থায় রক্তের সাগরে নিমজ্জিত বাবার লাশ পাওয়া যায়। চারটি অবুঝ শিশু যাদের বয়স যথাক্রমে সাড়ে ছয়, পাঁচ ও দুই বৎসর এবং মাত্র বার দিন তারা বুঝতেও পারল না তাদের বাবা কোথায় চলে গেলেন। অবরুদ্ধ অরক্ষিত বাংলাদেশে তিনি তাঁর প্রিয় স্বজনদের রেখে গিয়ে লক্ষ শহীদের কাতারে সামিল হলেন। শনিবার ৩০শে অক্টোবর তাঁর নিজ গ্রাম পূর্ব ছাগলনাইয়াতে তাঁকে দাফন করা হয়। আমার বাবা তাঁর প্রকৌশলী জীবনে অনেক কৃতিত্বের অধিকারী ছিলেন। স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশে নিজস্ব এয়ারলাইন্স গড়ে তোলার স্বপ্ন দেখতেন তিনি সব সময়। এ ব্যাপারে তিনি ছিলেন প্রচন্ড আশাবাদী আর তাই পাকিস্তানী অফিসারদের সাথে প্রতিযোগিতায় টিকে থাকার জন্য প্রচন্ড পরিশ্রম করে নিজেকে একজন দক্ষ ইঞ্জিনিয়ার হিসাবে গড়ে তুলেছিলেন। পি.আই.এ. কর্তৃপক্ষের বাঙালী বিদ্বেষ নীতির মাঝেও তাঁর খ্যাতি বাঙালী প্রকৌশলীদের সর্বোচ্চ পর্যায়ে পৌছানোর পথকে সুগম করেছিল। কিন্তু মুক্ত স্বাধীন দেশে তিনি তাঁর মেধা কাজে লাগাতে পারলেন না।
পরাধীন বাংলাদেশের সেই বিভীষিকাময় দিনগুলিতে যে লোকটিকে মানুষ দেখেছে চরম আশাবী, মুক্ত স্বাধীন বাঙলাদেশে আজ তিনি অনুপস্থিত। তাঁর স্বপ্ন সার্থক হলেও এখন আমি ও আমার মা, ভাই, বোন মাঝে মাঝে ভাবি, এই স্বাধীনতা কি আমরা চেয়েছিলাম?
আমার স্মৃতিতে বাবা অস্পষ্ট। মাকে বাবার কথা জিজ্ঞেস করলে তিনি নীরবে অশ্রুপাত করেন। তাঁকে তাই স্মৃতিতাড়িত করতে চাইনে। বরং আমার বাবা দেশের জন্য প্রাণ দিয়েছেন, এই আমার গৌরব এবং সামগ্রিক স্মৃতি।
লেখক : মো. সাইফুল আনোয়ার (মো: শফিকুল আনোয়ারের ছেলে)