মোঃ ইসমাইল হোসেন ১৯৭১ এর মহান মুক্তিযুদ্ধে দেশের জন্য প্রাণ বিসর্জনকারী নির্ভীক সৈনিকদের একজন। ময়মনসিংহ জেলার ফুলবাড়িয়া থানার ভবানীপুর গ্রামে বাবা মানিক সরকার এবং মা আয়েশা খাতুনের দ্বিতীয় সন্তান মোঃ ইসমাইল হোসেন ১৯২৪ সালে এক ঐতিহ্যবাহী সম্ভ্রান্ত মুসলিম তালুকদার পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন।
বাবা মানিক সরকার ছিলেন ভীষণ মুক্তমনা ও আধুনিক চিন্তাধারার একজন মানুষ। সবসময় তিনি শোষিত মানুষের পাশে থেকেছেন এবং শাসকদের বিরুদ্ধে সোচ্চার হয়েছেন। এরই ধারাবাহিকতায় জমিদার বিরোধী আন্দোলনে তিনি সরাসরি নেতৃত্বদান করেন এবং তাঁর তালুকদার খেতাব বর্জন করেন।
শহীদ মোঃ ইসমাইল হোসেন তাঁর শিক্ষা জীবন শুরু করেন স্থানীয় হোরবাড়ী স্কুলে এবং পরবর্তীতে ত্রিশালের দরিরামপুর উচ্চ বিদ্যালয় থেকে ম্যাট্রিক পাস করেন। পরবর্তীতে তিনি তাঁর পূর্ব পুরুষগণের প্রতিষ্ঠিত ভবানীপুর সিনিয়র মাদ্রাসায় শিক্ষকতা শুরু করেন। শিক্ষকতা শুরু করার জন্য স্থানীয় ভাবে তিনি ইসমাইল মাস্টার নামে পরিচিত হন।
শহীদ ইসমাইল বাবার আদর্শকেই অনুসরণ করে নিজের জীবন গড়ে তোলেন এবং বাবার মতই অন্যায়ের সাথে কোনদিন আপোষ করেননি। সবসময় সোচ্চার থেকেছেন যেকোন অন্যায়ের প্রতিবাদ করার ক্ষেত্রে এবং দীর্ঘদিন পাকিস্তান সরকারের চালিয়ে আসা আবহেলা ও দুঃশাসনের বিরুদ্ধে সবসময়ই প্রতিবাদ জানিয়ে এসেছেন। তিনি ছিলেন একজন দয়ালু, সৎ এবং ব্যক্তিত্বসম্পন্ন মানুষ। একই সাথে তিনি ছিলেন একজন সমাজসেবক ও সংগ্রামী মানুষ। এক্ষেত্রে বলা যায় বাবার আদর্শকে অনুসরণ করে বেড়ে ওঠা ইসমাইল হোসেন সততা ও আদর্শের কাছে কখনও মাথা নত করেননি এবং নিজের জীবন দিয়ে তিনি তা প্রমাণ করে গেছেন।
পরবর্তী সময়ে ইসমাইল হোসেন মাস্টার বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবর রহমানের আদর্শে অনুপ্রাণিত হয়ে আওয়ামী লীগ-এ যোগদান করেন এবং অল্প কিছুদিনের মধ্যেই তিনি তাঁর যোগ্যতার স্বাক্ষর রাখতে সম্ভব হন। এরই ধারাবাহিকতায় অল্পসময়ের মধ্যেই তিনি আওয়ামী লীগের একজন শক্তিশালী নেতায় পরিণত হন। মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন সময়ে তিনি ভবানীপুর ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সহ-সভাপতি হিসেবে নিযুক্ত ছিলেন।
শহীদ ইসমাইল হোসেন মাস্টার ১৯৭১ সালের মহান মুক্তিযুদ্ধে বঙ্গবন্ধুর ডাকে সারা দিয়ে ৪৭ বৎসর বয়সে মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করেন। মুক্তিযুদ্ধ শুরু হওয়ার পর তাঁর নেতৃত্বে ভবানীপুর সিনিয়র মাদ্রাসার আট জন শিক্ষক ও ছয় জন ছাত্র মুক্তিযুদ্ধে সরাসরি অংশগ্রহণ করেন।
এসময় ময়মনসিংহ জেলার ফুলবাড়ীয়া থানার মৌলভী শাহাবুদ্দিন ও আওয়ামী লীগ থেকে নির্বাচিত এম.পি. এ মোছলেম উদ্দিন-এর নেতৃত্বে রাজাকার, আলবদর, আলশামস বাহিনীর সমন্বয়ে শান্তি কমিটি গঠন করে এবং আওয়ামী লীগের বিশিস্ট নেতাকর্মী যারা মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করেন, তাদের একটি তালিকা প্রস্তুত করে। এরপর তালিকা অনুযায়ী তাদের বাড়িঘরে লুটপাট চালান হয় এবং লুটপাট শেষে বাড়িঘর আগুনে পুড়িয়ে দেয়। এছাড়া হত্যা, ধর্ষণসহ নানা ধরনের অপরাধ সংগঠিত হয়। ঐ সময় শহীদ ইসমাইল হোসেন সাহেবের বাড়ী-ঘর, গরু-ছাগল, জিনিসপত্র রাজাকার আলবদর বাহিনী লুট করে নিয়ে যায়।
এরপর আসে সেই দিন, ১৩ই নভেম্বর, ১৯৭১ সাল, রোজ শনিবার। পবিত্র রমজান মাস চলছিল। ১৩ই নভেম্বর ময়মনসিংহ জেলার ফুলবাড়ীয়া থানার আছিম বাজারে পাকিস্তানী রাজাকার, আলবদর, বাহিনীর শক্তিশালী ঘাটি দখল করার লক্ষ্যে প্রস্তুত বঙ্গবীর কাদের ছিদ্দিকির বাহিনী ১৭নং কোম্পানীর কমান্ডার ইদ্রিছ আলীর নেতৃত্বে অন্যান্যদের সাথে মোঃ ইসমাইল হোসেন মাস্টার সাহেবও আছিম বাজার মুক্ত করার যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেন। দীর্ঘ সময় রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের পর পাকিস্তান হানাদার বাহিনী ও তাদের এদেশীয় দোসররা পিছু হটতে বাধ্য হয় এবং অনেকেই জীবন নিয়ে পালিয়ে যায়। আছিম বাজার হয় দখলদার মুক্ত।
আছিম বাজারের যুদ্ধ শেষে মুক্তিযোদ্ধারা জয়লাভ করার পর নিজ নিজ বাড়িতে ফিরে যাচ্ছিলেন এবং জয়োল্লাসে ছত্রভঙ্গ অবস্থায় ছিলেন। এসময় পাকিস্তানী রাজাকার, আলবদর ও আলশামস বাহিনী যারা পালিয়ে গিয়েছিল তারা আছিম বাজারের পথে ফিরে আসে এবং মুক্তিযোদ্ধাদেরকে পিছন থেকে অতর্কিতে আক্রমণ করে। এ সময় শহীদ ইসমাইল হোসেন সাহেবের পায়ে রাজাকার বাহিনী গুলি চালায় এবং তিনি গুলিবিদ্ধ হয়ে আহত অবস্থায় আছিম বাজারের ৫০০ গজ দক্ষিণ-পশ্চিমে জমির উদ্দিন বেপারীর বাড়ীতে আত্মগোপন করেন। ইসমাইল মাস্টার গুলিবিদ্ধ হয়েছেন এবং জমির উদ্দিন বেপারীর বাড়িতে আত্মগোপন করেছেন, সংবাদটি দ্রুতই রাজাকার বাহিনীর কাছে পৌঁছে যায়। অন্যদিকে, উক্ত সংবাদটি ভবানীপুর সিনিয়ার মাদ্রাসার শিক্ষক মাওলানা হাবিবুল্লাহ জানতে পেরে মাদ্রাসার ছাত্র আব্দুল হালিমসহ কয়েজনকে নিয়ে ইসমাইল হোসেন সাহেবকে উদ্ধার করতে আসেন। কিন্তু এসময় মৌলভী শাহাবুদ্দিন ও মোছলেম উদ্দিনের নেতৃত্বাধীন পাকিস্তানী রাজাকার, আলবদর, আলশামস বাহিনীর আমজাদ হাজী, রিয়াজউদ্দিন, সৈয়দ আলী, আক্কাছ, আব্দুল জব্বার, আমির হোসেন, রুস্তুম আলী, ওয়াজেদ আলী, মোহাম্মদ আলীসহ আরও ২০/২৫ জন রাজাকার আলবদর বাহিনীর সদস্য জমির উদ্দিন বেপারীর বাড়ী আক্রমণ করে এবং ইসমাইল হোসেন মাস্টার সাহেবকে আহত অবস্থায় আটক করে। এরপর আরও নৃশংস ভাবে রাজাকার বাহিনী ইসমাইল মাস্টার সাহেবের পেটে গুলি করে এবং তাঁকে অর্ধমৃত অবস্থায় পায়ে রশি লাগিয়ে টেনে-হিচড়ে আছিম বাজারে জাম তলার পাশে তালগাছের গোড়ায় ফেলে বন্ধুকের বাট দিয়ে বেদম ভাবে প্রহার করে শরীরের বিভিন্ন অঙ্গ-প্রতঙ্গ ভেঙ্গে ফেলে। এসময় মৌলভী হাবিবুল্লাহ ও আব্দুল হালিমসহ কয়েকজন ছাত্র পালিয়ে গিয়ে আত্মরক্ষা করতে সক্ষম হন।
পরবর্তীতে বাশদীরবন্দ নামক এলাকায় প্রায় ৪৩ জন মুক্তিযোদ্ধা ও সাধারণ মানুষকে রাজাকার-আলবদর বাহিনী হত্যা করে। মুক্তিযোদ্ধা ভবানীপুর গ্রামের আব্দুল বারেক ও পার্শ্ববর্তী তিতারচালা গ্রামের আব্দুল কাদের, আছিমুদ্দিন মোল্লা, দুলাল, মমতাজ, আব্দুল করিম, আব্দুল রশিদসহ ১৩টি লাশ ও অর্ধমৃত মুক্তিযোদ্ধাদেরকে আছিম বাজারের জাম তলার কাছে তালগাছের গোড়ায় একত্রিত করে। এসময় মৃতদেহগুলিকে তারা এদিকে সেদিকে ছড়িয়ে ছিটিয়ে রাখে এবং জীবিতদেরকে বেদম মারপিট করে। এতো নির্যাতনের পরেও মোঃ ইসমাইল হোসেন মাস্টার জীবিত ছিলেন। এরপর একটি ট্রাকে জীবিতদেরকে তুলে তাদের ওপর মৃতদেহগুলি তুলে দিয়ে ফুলবাড়ীয়া বাজারের কাছে ‘আখিনা’ নদীর তীরে আনা হয়। এখানে আনার পর ইসমাইল হোসেন মাস্টার সাহেবসহ অর্ধমৃত কয়েকজনকে ‘আখিনা’ নদীর তীরে জবাই করে হত্যা করা হয় এবং সবশেষে ভালুকজান বধ্যভূমিতে নিক্ষেপ করা হয়।
এভাবেই বাংলার মাটিতে পাকিস্তানী হানাদার বাহিনী ও তাদের এদেশীয় দোসরদের হাতে নির্মম ভাবে প্রাণ হারান বাংলার অগণিত সংগ্রামী ও দেশপ্রেমিক সন্তান। শহীদ ইসমাইল হোসেন মাস্টার তাদেরই একজন, যিনি নিজের জীবন দিয়ে রক্ষা করে গেছেন এদেশের মাটি।
শহীদ হওয়াকালীন সময়ে মোঃ ইসমাইল হোসেন মাস্টার ১ ভাই, ৪ বোন, স্ত্রী, ৪ পুত্র ও ৩ কন্যা রেখে যান।
তথ্য সহযোগিতায়ঃ
এ.কে.এম. ফজলুল হক দুলাল (মোঃ ইসমাইল হোসেনের পুত্র)
এ্যাডভোকেট, ময়মনসিংহ সদর
লেখক : আতিকা বিনতে বাকী রোমা